আজ আমাদের বিয়ে

আজ আমাদের বিয়ে

“আজ অনেকদিন আকাশের মন ভাল নেই। গোমরা মুখে কাল সারারাতও কেঁদেছে। রাস্তায় পাশে মেট্রোপলিটনের নালা গুলো পর্যন্ত ভরিয়ে দিয়েছে। নালার পানি সব হাঁটুর নিচে ছলাৎছলাৎ করছে। গা গিরগির করছে এই পানিতে পা ভিঁজিয়ে। কিছুই করার নেই। আজ পুনাকে ওর বাসা থেকে বের করতে না পারলে সারাজীবন মনটা নর্দমার মতো দুর্গন্ধ ছড়াতো। ভালবাসার জন্য মানুষ কতো কিছুই তো করে। আমরা না হয় মেট্রোপলিটন নর্দমার সাগর পেরোলাম।

এতো করে বারন করার পরেও কথা শুনলো না পুনা । ঠিক লাল একটা শাড়ি পরে বেড়িয়েছে। কতো করে বললাম বৃষ্টি বাদলের দিন সালোয়ার কামিজই ভাল। কিন্তু ও কোনদিন আমার কোন কথাই রাখেনা। নিজের যা ভাল মনে হয় তাই করে। আমিও অপেক্ষায় আছি। আমাদের ছেলেটা যখন একটু বড় হবে ওকে বলে দিবো, “তোর মায়ের কোন কথাই শুনবি না।” প্রতিশোধ।

বিকেল গড়িয়ে গেল। পুনাকে নিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশ এখন ভেউভেউ করে কাঁদছে। দেখে মনে হয় আকাশের বউ মরেছে। পুনা এক মনে বৃষ্টি দেখছে। কিন্তু আমি জানি ওর মনে অন্য ঝড় চলছে। আজ আর ওর ঘরে ফেরা হবে না। হয়তো আর কোনদিনই ফেরা হবে না। বাবা মাকে ছেড়ে গল্পের নায়িকাদের মতো এক কাপড়ে বেড়িয়ে গেছে। আজ আমাদের বিয়ে। একটা রিক্সা পেলেই কাজী অফিসের দিকে ঢেউ ঢেউয়ে তীরহারা এই নর্দমার সাগর পারি দিবো রে।

জাশেদের ফোন পেলাম। ইমতিয়াজ কে নিয়ে কাজী অফিসে পৌছে গেছে। পুনা আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাঁচের চুরি তিরতির করে কাঁপছে। আমার বুকে হাতুড়ি বাজলো- পুনা ভিতরে ভিতরে কাঁদছে না তো। হাত দেখাতেই পেয়ে গেলাম রিক্সা। কাছে আসতেই দেখি রিক্সার সামনে পর্দা নেই।

– মামা পর্দা কই।
– পর্দা বাতাসে উইরা গেছে।
– এই বৃষ্টির মধ্যে আপনার বেপর্দা রিক্সায় বসলে তো ভিজ্জা ঢোল হইয়্যা যামু।
– মামা গেলে যাবেন না গেলে নাই।

হঠাৎ পুনা আমার হাত ধরে টান দিয়ে রিক্সার দিকে এগিয়ে গেল। পুনা রিক্সায় উঠার সময় ওর ফর্সা পায়ের গোড়ালির দিকে চোখ চলে গেল। দেখি আলতা পরেছে। এই যুগে মেয়েরা তো আলতা পরেনা। কিন্তু দেখেই কেন যেন ভীষণ ভাল লাগলো।

রিক্সায় উঠতেই ও আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। আমি ওর কোমড়ের কাছে হাত রাখলাম। রিক্সা চলছে ধিরেধিরে। বৃষ্টির ঝাপটা আসছে। পুনার কাঁচের চুড়ি রিক্সার হালকা ঝাঁকিতে টুংটাং করছে। কি অসাধারণ লাগছে। পুনা আমার হাত ধরে আছে। আমাদের হাতের উপরে বৃষ্টি ফোটা পড়ছে। দু’জনে কাঁপছি। ও হয়তো শীতে কাঁপছে। কিন্তু আমি ভিন্ন কারণে। যখনই চিন্তা আসছে এতোদিনের ভালবাসার মানুষটাকে বউ করে পাবো। তখনই ভিতরে ভিতরে একটা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার সময় তাহলে চলেই এসছে।

পুনা ওর মাথাটা হালকা করে আমার কাঁধে রাখলো। আমার বাহু খামচি দিয়ে ধরলো। ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলাম। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি দু’জনে। এমন কাক ভেজা হয়ে কেউ এর আগে বিয়ে করেছে কিনা জানি না। পুনা কেঁপে উঠছে একটু পর পর। জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। আমিই এখন পুনার একমাত্র আশ্রয়। বাবা মাকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসছে কিছু চিন্তা না করেই। কই থাকবে কি খাওয়াবো কিছুই ভাবেনি মেয়েটা। এই মানুষটাকে আর যাই হোক কোন কষ্ট দেওয়া যাবেনা। সারাজীবন বুকে আগলে রেখে ভালবেসে যেতে হবে। হঠাৎ পুনার কথায় ঘোর ভাংলো।

– ব্যাগটা একটু ধরবে।
– দাও।

ব্যাগের সাইড পকেট থেকে চুলের কাঁটা বের করে চুল বেঁধে নিলো। বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ছে। রাস্তায় পানিও বাড়ছে। কমে যাচ্ছে কেবল রিক্সার গতি। পুনার ফোন বেজে উঠলো। দু’জন নির্বাক তাকিয়ে আছি দু’জনের দিকে। জানি কার ফোন হতে পারে। পুনা ঠোঁট কামড়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ওর মায়ের নাম্বার দেখে সাথে সাথে ফোন অফ করে দিয়ে আমায় দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। হতবাক হয়ে গেলাম। যেই পুনা রিক্সায় বসে হুট পর্যন্ত উঠায় না সেই পুনা আমায় জড়িয়ে ধরলো। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। পুনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম।

কাজী অফিসের কাছেই চলে এসেছি প্রায়। ফোন বের করে জাশেদকে একটা ম্যাসেজ দিলাম। রিক্সাওয়ালা কে বললাম ব্যাক করেন। যেখান থেকে আসছি ওখানে চলেন আবার। আমার কথা শুনে পুনা চমকে উঠলো।

– কি বলছো এইসব?
– কি সব?
– রিক্সা ব্যাক করতে বললে কেন?
– এভাবে চোরের মতো তোমায় নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করতে পারবো না পুনা ।
– আমি বাসায় গেলে আব্বু আম্মু আমায় মেরে ফেলবে। উনারা এতোক্ষণে সব জেনে গেছে। আমি চিঠি লিখে রেখে আসছিলাম।
– একটু আগে তোমার আম্মুর ফোন পেয়ে যেভাবে আমায় আকড়ে ধরেছিলে তখন মনে হলো তোমার মায়ের তাহলে কি অবস্থা হবে। মায়ের মনে কষ্ট দিলে সেটা সন্তানের জীবনে অভিষাপ হয়ে আসে। আজ আমরা বিয়ে করে হয়তো দু’জনে সুখি হবো। কিন্তু যারা আমাদের যারা জন্ম দিলো তাদের কতোটা কষ্ট হবে ভেবে দেখেছো।
– আমার বাবা মা কোনদিন তোমার কাছে আমায় বিয়ে দিবে না। উনারা আমার জন্য অন্য পাত্র দেখে রেখেছে। সবই তো জানো তুমি। কেন পাগলামি করছো।
– আমি তোমায় চুরি করতে পারবো না তোমার বাবা মায়ের কাছ থেকে। তোমায় অনেক অনেক অনেক ভালবাসি পুনা । কিন্তু উনাদের অমতে তোমায় বিয়ে করবো না।
– তোমাকে কখনোই মেনে নিবে না।

ঢুকরে কেঁদে উঠলো পুনা । সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বৃষ্টি একটু কমেছে। আমার বুকে ধরফরানি বাড়ছে। কি করে দাঁড়াবো ওর বাবা মায়ের সামনে। সামান্য একটা চাকরি করি আমি। বলার মতো কিছুই তো নেই আমার।

পুনাকে নিয়ে ওর বাসার সিড়ি দিয়ে উঠছি। ও আমার বাহু খামচি দিয়ে ধরে আছে। ভয়ে কাঁপছে। ৩ তলায় উঠে ওদের বাসার কলিংবেলে হাত রাখার আগে ওকে আমার দিকে একটু টানলাম। জড়িয়ে ধরে ওর কলাপে আলতো করে চুমু দিলাম। দেখি পুনার ঠোঁট কাঁপছে। চোখে পানি ছলছল করছে। ও বুঝে গেছে ওর বাবা মা রাজি না হলে এটাই আমাদের হয়তো শেষ দেখা। আমার বুকের কাছে শার্টটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে ঝাঁকি দিলো আমায়।

– এই চলো চলে যাই প্লিজ। আমি তোমায় হারাতে পারবো না। প্লিজ চলো।

আমি কলিংবেল টিপে দিলাম। কলিংবেলের শব্দ শুনে আমার কাছ থেকে ছিটকে গেল পুনা। আঁচল দিয়ে মুখের উপর চেপে কান্না আটকালো। ওর মা দরোজা খুলতে পেছনে দেখি ওর বাবাও দাঁড়িয়ে আছে। চারটা মানুষ নির্বাক দাঁড়িয়ে আছি। কারো মুখে কোন কথা নেই। ওর মা ভিতরে আসতে বলল। এতোটা ভদ্রতা আশা করিনি।

পুনাকে ওর মা ভিতরে গিয়ে ভেজা কাপড় পাল্টে নিতে বলল। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে চলে গেল। আমি বসে আছি রিমান্ড সেন্টারে। কাজের মেয়ে এসে চা দিয়ে গেল। আমিই নিরবতা ভাংগলাম।

– কি বলবো বুঝতে পারছি না। কোথা থেকে শুরু করবো জানিনা।

বুকে সাহস নিয়ে যা থাকে কপালে ভেবে আবার বলতে শুরু করলাম।

– পুনাকে অনেক ভালবাসি আমি। ও ও বাসে। আপনারা ওর জন্য পাত্র ঠিক করায় আমরা সিদ্ধান্ত নেই পালিয়ে বিয়ে করবো। কাজী অফিসের প্রায় কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলাম। এমন সময় আন্টির ফোন এলো। তখনই ঠিক করলাম আপনাদের মেয়ে কে পালিয়ে বিয়ে করবো না। আপনাদের অনুমতি ছাড়া কখনোই করবো না। আমার যোগ্যতা কম আমি জানি। আপনারা ওর জন্য যেই পাত্র ঠিক করেছেন তার সাথে বিয়ে দিলে ও কখনোই সুখি হতে পারবে না। ওর মন আমার কাছেই পরে থাকবে।

গলাটা শুকিয়ে গেল। এক গ্লাস পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললাম। কি বলছি এইসব প্রেমিকার বাবা মাকে। নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। বলে যখন ফেলেছি এখন এভাবেই চালিয়ে যেতে হবে।

– চাইলে আজই ওকে বিয়ে কর‍তে পারতাম। কিন্তু করিনি। আমি বাবা মায়ের অভিষাপ নিয়ে সারাজীবন বাঁচতে চাই না। এখন সবকিছু আপনাদের উপরে ডিপেন্ড করছে…

এইটুকু বলার পরেই দেখি ড্রয়িংরুমে চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে পুনা এলো। গোলাপি ড্রেসে ওকে পরীর মতো লাগছে। আমি আরো নার্ভাস হয়ে গেলাম। ওকে দেখবো নাকি কথা বলবো বুঝতে পারছিনা।”

আমাদের বিয়ে হয়েছে ৪ বছর হয়ে গেছে। সেদিন পুনার আসল রূপ দেখেছিলাম। কি করে এই মেয়ে ওর বাবা মাকে রাজি করিয়েছে ভাবলেই দস্যুরানী ফুলনদেবীর কথা মনে পরে। যাক সে কথা এখন সুখেই আছি এটাই অনেক কিছু।

দেড় বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে আছে আমাদের। ঠিক যেমন টা চাইতাম তেমনটাই হয়েছে। ওর মায়ের কোন কথাই শুনে না। পুনা যখন বলে, “তোমার ছেলেকে আর পালতে পারবো না। এইটুকুন একটা খরগোশের বাচ্চা তাও আমার কথা শুনেনা। বাপের মতোই ঘাড়ত্যাড়া হচ্ছে।” শুনেই বুকটা ভরে যায় আমার।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত