সত্য ভালবাসা

সত্য ভালবাসা

বিয়ে করে আনার পর আমার স্ত্রী নেহাকে নিয়ে বের হতে লজ্জা ই লাগতো।বেপার টা এ নয় যে আমার স্ত্রী অসুন্দরী,কুৎসিত বা মোটা।এগুলো হলে হয়তোবা লজ্জা লাগতোনা।আমার স্ত্রী সুন্দরী।যে সে সুন্দরী নয়, চট করে কোন মেয়েকে দেখে কেউ যখন বলে দিতে পারে,দেখ মেয়েটা সুন্দর না!

আমার লজ্জা টা আমায় নিয়ে।আমার স্ত্রীকে নিয়ে লজ্জা পাবার মতন সাহস আমার নাই।সে বয়সে আমার চেয়ে ১৯বছরের ছোট।যখন আমাদের বিবাহ হয় সে সবে এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে আর আমি চাকরিতেও ৪বছর পার করেছিলাম।প্রথম প্রথম আমার বেশ আপত্তি থাকলেও মায়ের যুক্তির কাছে আমি হেরে যাই। বিয়েতে অমত জানাতে আসলেই মা তার নিজের আর বাবার বয়সের ফারাক এর কথা উদাহরণে এনে আমায় ঘায়েল করে দিতেন।

মেয়ে পক্ষের অমত ছিলনা।আমার থাকার মাঝে ছিল মাথায় কিছু চুল আর সৎ চরিত্র।এছাড়া আমার নেই চেহারা বা ছিলনা চাকরিতে ভালো বেতন।নেহাকে বিয়ের রাতে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিয়েতে রাজি হবার কারণ কী?

নেহা ইতস্তত হয়ে বলেছিল,জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে উপর থেকেই ফিক্সড করা থাকে।আমি রাজি হবার কে?

আমি হেসে বলেছিলাম,তার মানে আগে যে বিয়ের প্রস্তাব আসতো তোমার অমত থাকতোনা।

নেহা তখন মুখ বাঁকিয়ে বলে এর আগে আর বিয়ের প্রস্তাব আসেনি।

তখন আমার আরো খারাপ ই লেগেছিল।হয়তো আরো দিন দেখলে আমার চেয়ে ভালো বর পেতে পারতো।হয়তো সিদ্ধান্ত ভুল নিয়েছে নেহা বা নেহার পরিবার ওর উপর চাপিয়ে দিয়েছে।কিন্তু স্ত্রীর ওই কথা মনে করে নিজেকে স্বান্তনা দিতাম।বিয়ে উপর থেকেই ঠিক করে দেয়া।

সেবার নেহাকে কলেজ থেকে আনতে গেলাম।নেহার বান্ধবীদের কাছে কি অকপটেই আমায় পরিচয় করিয়ে দিল,আমি তার স্বামী।তারা যে আমার আড়ালে নিশ্চই বলবে, দেখ নেহার বর টা কি বুড়োটে, তাতে কোন ভুল নেই।আমি সবার চোখে টিটকারি চাহুনি দেখতে পেয়েছিলাম।

সেদিন বিছানায় শুয়ে খবরের পেপার পড়তে পড়তে নেহাকে জিজ্ঞেস করলাম,আচ্ছা তোমার বান্ধবীরা কখনো বলেনা যে এই বুড়ো লোকরে কেন বিয়ে করলে?

নেহা তখন রেগে গিয়ে বললো তার মানে তোমার কলিগ রা বলে এই পিচ্চি মেয়েকে কেন বিয়ে করেছো?আচ্ছা আমায় কি তুমি তোমার পাশে বেমানান মনে করো?

ওর উল্টো রাগ দেখে আমার খারাপ লাগেনি।বরং চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল,কপালে এমন ভালো বউ ছিল দেখেই হয়তো এতকাল মেয়েদের কাছ থেকে রিজেক্টেড হয়েছিলাম।

বিয়ের ৫বছরের মাথায় আমাদের কন্যা সন্তান এলো।নওশীন কে প্রথম কোলে নিয়েও আমি ভেবেছিলাম,যখন ও স্কুলে ভর্তি হয়ে বলবে এই আমার বাবা,তখন কি ওর বন্ধুরা হেসে বলবে,বাবা নাকি নানা?

মেয়ে হবার পর নেহার চাচাতো বোন দেখতে আসলো বাসায়।দুজন কথা বলতে বলতে এক পর্যায় বললো,বাচ্চাটা নেয়া উচিৎ হয়নিরে তোর।

নেহা রেগে গিয়ে বললো,কেন?

সে আমতা আমতা করে বললো আমি জানি তোর মনে কষ্ট।তোর দুলাভাই ও বলে এখনো তোর বিয়ের বয়স হয়নি।বুঝাই যায়না তোর বাচ্চা হয়েছে।সেখানে জহির ভাইকে বেশ বয়স্ক লাগে।

নেহা ক্ষেপে গিয়ে তখন বলে ফেললো, বাচ্চা ছেলে বিয়ে করেতো আপু ১০বছরেও বাচ্চার মুখ দেখার জন্য কাঁদো।
কই ইচ্ছে করলেই কি বাচ্চা নিতে পারো!

সেই কথার ভিত্তিতে তাদের সম্পর্ক একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। কি অদ্ভুত মেয়েরা তাইনা!স্বামীকে কিছু বললে তারা তাদের রক্তের সম্পর্কের সাথেও যুদ্ধ করে।

নেহাকে বললাম এভাবে বলা ঠিক হয়নি।মিথ্যে কিছু বলেনি।তুমি বলতে যে বুড়োর সেবা করতে হবে। আমিও বুড়ি হয়ে গেলেতো সেবা করতে পারবোনা।তাই বেছে বুড়ো বিয়ে করেছি।মরার আগে যাতে তাকে সেবা করে কবরে পাঠাতে পারি।
এই কথা নিয়েও রেগে মেয়েটা আমার সাথে ৫দিন কথা বলেনি।

সেবার অনেক হাসাতে চেষ্টা করেও ওকে হাসাতে পারছিনা।শেষ রাতের দিকে নিজের ইচ্ছেতেই এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল।

বললাম কি হয়েছে নেহা?

নেহা: আচ্ছা মানুষ কি বয়স অনুপাতেই মরে?তাহলে আমার ছোট ভাই কেন আমার আগে মরে গেল?

নেহার ভিতর অনেক টা আমার মায়ের গুন ছিল।সে যুক্তি বা উদাহরণ দিয়ে মানুষ কে ঘায়েল করে ফেলে।ভোর রাতে এমন কথা শুনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর এসব বলবোনা।আমি এই দুনিয়ায় চিরযৌবন সম্পন্ন পুরুষ। এভার গ্রিন।

নেহা হেসে কুটি কুটি হয়ে আমার বুকে মাথা রেখে বললো,ইয়েস,মাই হাবি ইজ ইয়াং ম্যান।হি ইজ এভার গ্রীন।
নওশীন ক্লাস থ্রি তে উঠলো।নেহা আজকাল কেমন মনমরা হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝি হয়তো এতদিন বাচ্চামি কেটে গেছে ওর। ও এখন অনুভব করে,সি ডিজার্বস বেটার।

জানালার পাশে প্রায় ই দাড়িয়ে আনমনে তাকিয়ে থাকে।প্রতিজ্ঞার কারনে বলিও না যে নেহা আমি বুড়ো তাই বলে আমায় তুমি দয়া করোনা।যদি তুমি চাও সিদ্ধান্ত নিতে পারো।

অল্প বয়সের মেয়েটার চোখের নিচে কালি জমে গেছে।রাতে বারান্দায় বসে জিজ্ঞেস করালাম,নেহা তুমি কি আমার সাথে সামাঞ্জস্যতা রাখার চেষ্টা করছো?

নেহা মলীন ভাবে বললো মানে?

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,এই যে আমার সাথে নিজের বয়স এক করাতে নিজের যত্ন করা ছেড়ে দিয়েছো।

নেহা:কই?মনে হয় চোখ ও বুড়া হয়ে গিয়েছে তোমার। সব উল্টা পাল্টা দেখো।এই বলে রেগে চলে গেল।

বিছানায় গিয়ে শুতেই নেহা আমার দিকে ফিরে বললো রাগ করেছো?মাফ করে দেও।

ইদানীং ওর হাব ভাব বুঝতে পারিনা।সব কিছুর আগে পরে ক্ষমা চায়।

নেহা ক্ষমা চাইছো কেন?

নেহা হেসে বলে যদি চলে যাই? ক্ষমা চাইবার সময় না পাই?

আমার বুক টা ধক করে উঠলো।তার মানে কি ও আমায় ছেড়ে চলে যাবে কারো কাছে?এতদিন আমি ই চাইতাম মুক্তি দিতে কিন্তু আজ ওর মুখে শুনে কষ্ট হচ্ছে।হয়তে এতদিনে বৃদ্ধ বয়সের সাথি ওকেই ভেবে ফেলেছি।এখন চট করে সব ফাঁকা হয়ে গেলে আমি কি করে মেনে নিব!

আজকাল অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ভয় পাই খুব।মনে হয় বাসায় গিয়ে সব ফাঁকা দেখবো।টেবিল এর উপর খাম দেখতে পাবো।

বাসায় ঢুকে টেবিল এর উপর সাদা কাগজ দেখে বার বার নেহাকে ডাকছি।বার বার গলা ধরে এসেছে।কী করবো আমি!কিভাবে বাঁচবো ভাবতে ভাবতে কান্না করে বসে পরলাম।

নেহা ঘাড় এ হাত রেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো এই কী হয়েছে তোমার! কাঁদছো কেন?অফিসে কিছু হয়েছে?

আমি নেহাকে জড়িয়ে ধরে বললাম তুমি যাওনি নেহা?

নেহা: কই যাব? ওয়াশ রুমে ছিলাম।ডাকার সাথে সাথে আসি কিভাবে?আমার কি পাখা আছে?নাকি পায়ে চাকা ফিট করা?

আমি চোখ মুছে টেবিল এর উপর কাগজ টা তুলে বললাম এটা কি?

নেহা: তোমার মেয়ে তোমায় এঁকেছে। আমায় বার বার বলে গেছে পাপা অফিস থেকে আসার পর ই দেখাতে।

আমি হেসে দিলাম।

নেহা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, তুমি ভেবেছিলে আমি চলে গেছি হি হি

আমি: আরেনা।ভাত দেও ক্ষুধা লেগেছে।

জ্বরের মাত্রা বেড়ে চলেছে নেহার।তার ভিতরে বার বার বলছে,নওশীনের বাবা ভেবেছিলে আমি তোমার সেবা করবো কিন্তু দেখোনা আজ তোমার ই সেবা করা লাগছে।আল্লাহ চাইলে এমন ই হয়।বার বার নিজেকে বুড়া ভেবে আমার পাপ বাড়িয়েছো তাই আল্লাহ আমায় বুড়া করে দিয়েছেন। আল্লাহ আমার উপর ক্ষেপে গিয়েছেন।

আমি ওর মুখে হাত দিয়ে বললাম,বউ এর সেবা করতে পারে ক জন?আল্লাহ আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন?

নেহা: কিসের পরীক্ষা?

আমি : এভার গ্রীন ক্ষেতাপ পাবার যোগ্য কিনা সেটার।

নেহা জ্বরের ভিতর ও থেমে থেমে হাসছে।

অফিস যাবার আগে নেহা আমায় হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, সকালের নাস্তা করে দিতে পারলাম না।খুব ক্লান্ত আমি।আজ যেওনা অফিসে।

আমি সেদিন রয়ে গেলাম।

নেহা: আচ্ছা আমি মারা গেলে নওশীন এর কি হবে?
ওর এই কথাটা শুনে আমি থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মাথা কি গেছে একেবারেই?নওশীন আসুক স্কুল থেকে ওর জানা উচিৎ ওর মা পাগল হয়েছেনেহা: শোন না আমি কাল আমার ভাইকে স্বপ্ন দেখলাম।আমায় লাল জামা দিয়ে বলছে এদিকে অল্প বয়সে যারা আসে তারা লাল জামা পরে।এটা পরে নে।

আমি ওর কপালে হাত দিয়ে বললাম জ্বর হলেই এত ভয় পেতে হয় নেহা?আমি আছিনা?

নেহা আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,আমার না খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে জানো?
বিয়ের পর নাম ধরে বা ওগো বলে ডাকতে লজ্জা হতো।বার বার চাইতাম বাচ্চা আসুক, ওর বাবা বলে ডাকবো।নওশীন আসার পর ওগো বলতে খুব ইচ্ছে হতো।এখন আমার ইচ্ছে হয় দুজন বৃদ্ধ বয়সে ঘুরে বেড়াতে পারতাম!মেয়েকে বিয়ে দেবো।

আমি ধমক দিয়ে বললাম,মেয়ে বিয়ে দিও,দরকার হলে আমায় ও আবার বিয়ে দিও।এখন থামো

নেহা: মরে যাবার পর সাথে সাথেই বিয়ে করে ফেলোনা যেন। যদি আমি আত্মা হয়ে দেখার সুযোগ পাই, কিনা রাগে আবার মরে যাই। পর পর দুবার মরার ব্যাথা নেয়া কি ঠিক হবে?

আমি: কি বলছো?

নেহা: মেয়েরা অনেক হিংসুক হয়।কবরে গিয়েও মনে হয় বরের দিকে নজর রাখতে পারলে ছারেনা।আমার নানা বলতেন কি জানো?নানুর কবরের কাছে গেলেই মনে হয় নানু বলে,ও নাছিমার বাপ বাজারে গিয়া ওই মহিলারে কেন দেখলেন?হি হি হি

আমি: আমিও মরে গেলে এমন বলবো কবরের কাছে যাইয়ো তুমি।

নেহা মলীন মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো, মেয়ের তাগিদে বিয়ে করো।আমি কষ্ট পাবোনা।

আমি: এই বুড়া বয়সে আমারে বিয়া দিতে চাও হা হা হা

নেহা চোখ না খুলেই বললো মাই হাবি এভার গ্রীন।তার মনের মতন বিশাল মন আমি আর কাউকে দেখিনি।

তার এক সপ্তাহের মাথায় ই নেহার ব্রেন ক্যান্সার ধরা পরলো।আমায় সময় ই দিল না সেবা করার।মাস খানেক এর মাঝেই আমায় ছেড়ে চলে যায়।

সেদিন নিজেই বললো আজ খুব সুস্থ লাগছে।ব্রেন ক্যান্সার ও মনে হয় বরের সেবায় ভালো হয়ে যায়।

নিজেই খাবার রান্না করলো।ওর এমন হাসি মুখ দেখে বুকে সাহস পাচ্ছিলাম।হয়তো মিরাকল কিছু হবে।

রাতে শুয়ে কাছুমাছু হয়ে বুকে মাথা রেখে বললো নওশীন আমার সি সি ক্যামেরা।ও আমার হয়ে নজর রাখবে।উল্টা পাল্টা করলেই খবর আছে কিন্তু।আমি হাসলাম।

গভীর রাতে বুকটা কেমন শীতল অনুভব করলাম।ভেবেছিলাম নেহার শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে হয়তো জ্বর আসবে।কিন্তু না,নেহা শক্ত হয়ে গেল।আমার কোমল বউ টা অল্প কয়েক ঘন্টার মাঝে এমন শক্ত হয়ে গেল কী করে!সেই উত্তর আমি আজ ও পাইনি।পাবো ও না।

নওশীনের ভার্সিটিতে আজ প্রথম দিন আমায় নিয়ে এলো জোর করে।চারদিকে এমন তরুণ তরুণীর মা বাবার ভিতর নিজেকে বয়স্ক লাগছে।নেহার চলে যাওয়াও আমার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে তিনগুন।নেহার জায়গায় কাউকে আনতে পারিনি।ওর এভার গ্রীন হাসবেন্ড কে কেউ হয়তো এভাবে দাম দিতনা।আমি জীবনে শুধু স্ত্রী ই পেয়েছিলাম না স্ত্রীর মতন স্ত্রী পেয়েছিলাম।যার বিরহে আমি কাঁদতে পারি আমরণ। আমার ক্লান্তি আসবেনা।

মেয়ে এসে বললো চলো পাপা সেল্ফি তুলি।

আমি বললাম বুড়া বয়সে কিসের পিক আর মা?

নওশীন আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো,মাই পাপা ইজ ইয়াং ম্যান।হি ইজ অলসো এভার গ্রীন।খানিক সময় মনে হলো নেহা ফিরে এসেছে আমার মেয়ের ভিতর।আবার মনে হল নেহার গলা মেয়ের গলায় বসিয়ে দিল।বার বার মনে হচ্ছে নেহা বলছে,কিগো বুড়া বলেছিলাম না আমার।মেয়ে হলো আমার কার্বন কপি।আমার সি সি ক্যামেরা।ও নজরে রাখবে তোমায়।মিললো তো?

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত