-আপনি একটু বাথরুমে যাবেন আমি কাপড় পাল্টাবো।
–আমার সামনেই পাল্টাও সমস্যা কি। সারারাত একসাথে কাটানোর পরেও লজ্জা পাচ্ছো?
-আচ্ছা আপনার যেতে হবেনা আমিই যাচ্ছি।
–আহা রাগ করছো কেন যাচ্ছি আমি।
লোকটা বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে চলে গেলো। রিফা তাড়াতাড়ি কাপড়টা পাল্টে নিলো। টেবিলের উপর থেকে লোকটার মানিব্যাগ থেকে দুটো হাজার টাকার নোট সরিয়ে ফেললো সে। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিলো। ফোনটা বাঁজছে রিফা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো নোমানের কল। রিফা প্রথমবার কলটা রিসিভ করলোনা, দ্বিতীয়বার ফোনটা রিসিভ করে ঘুম জাড়ানো কন্ঠে বললোঃ
-হ্যালো…
–ঘুমাচ্ছিলে?
-হ্যাঁ ঘুমাচ্ছিলাম। এতো সকাল সকাল ফোন করলে যে। কতো আরামে ঘুমাচ্ছিলাম, ঘুমটাই নষ্ট করে দিলে ধূর ছাই।
–সরি… ভাবলাম সকাল সকাল স্মরন করিয়ে দেই যে আজ একটা বিশেষ দিন।
-বিশেষ দিন, কিসের বিশেষ দিন।
–আজ আমাদের বিয়ে করার কথা। তোমার মনে নেই। রিফা সত্যি করে বলো তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও তো। আমাদের বিষয়ে তুমি সিরিয়াস তো।
-ব্রেইকে পা রাখো, শান্ত হও বাবা আমিতো ফাইজলামো করছিলাম। আমার সব স্মরন আছে আপনার স্মরন করিয়ে দিতে হবেনা।
–তুমিতো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আচ্ছা ঠিক আছে এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হও। সোজা কাজী অফিসে আসো সেখানেই দেখা হবে।
-আচ্ছা। রাখছি তাহলে, বায়।
রিফা রুম থেকে বের হওয়ার আগে বাথরুম বাইরে থেকে লক করে দিলো। এটা সে প্রতিবারই করে। থাক কিছুক্ষন বন্দি হয়ে। বাইরে বের হয়েই মনটা উদাস হয়ে গেলো। রৌদ নেই হালকা কুয়াশা সাথে মৃদু শীতল হাওয়া। আজ নোমানের সাথে রিফার বিয়ে। নোমানের পরিচয় হয় ফেসবুকে। ফেসবুকে একটা গল্প পড়ে রিফা নক দেয় নোমানকে। গল্পটা ছিলো এক পতিতার। মেয়েটাকে তার প্রেমিক পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। তারপরে পতিতালয়ে এসে এক ছেলে তার প্রেমে পড়ে যায়। একসময় সেই ছেলে তাকে সেখান থেকে পালিয়ে নিয়ে যায় দূরে কোথাও। বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়। তাদের সুখের সংসারের গল্পটা পড়ে রিফার বড্ড হিংসে হয়। তারও ইচ্ছে হয় যদি সেই ছেলেটার মতো কেউ তার জীবনেও কেউ থাকতো। রিফার গল্পটা একটু ভিন্ন। ছোট শহরের কিশোরি মেয়ের মনে স্বপ্ন জেগেছিলো সে অভিনেত্রি হবে। এক বড় ভাইয়ের কথায় বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। বড় ভাই কাজ দেয়ার নাম করে তাকে ভোগ করে। কাজ দেয়নি তা না কাজ দিয়েছে কিন্তু বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছে তার সর্বস্ব। শুধু তাই নয় ক্যামেরায় ধারণ করে রেখেছে সেই মূহূর্তের ভিডিও। রিফা তাদের হাতে বন্দি। এখন সে কল গার্ল কিছু অর্থের বিনিময়ে ধনীদের ক্ষনিকের আনন্দ দিয়ে থাকে।
সেই পতিতা মেয়েটার গল্প পড়ে নোমানকে নক করার পর তারা পরিচিত হয়। নোমানকে জানায় সে পেশায় মডেল। কিন্তু তার পাশাপাশি একজন কলগার্ল এটা জানানোর সাহস হয়নি। নিয়মিত কথা হতে থাকে তাদের। ধীরে ধীরে সম্পর্ক বন্ধুত্ব এবং ভালো লাগার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। নোমানের কথাগুলো রিফাকে মুগ্ধ করে। একটা মানুষের মানসিকতা কিভাবে এতো উদার হতে পারে। নোমান যেদিন রিফাকে প্রপোজ করেছিলো সেদিনই রিফা নোমানকে সত্যিটা বলে দিতে চেয়েছিলো যে সে একজন কল গার্ল, পতিতা। কিন্তু কেন যেন সাহস হয়ে ওঠেনি। হয়তো হারানোর ভয়ে। রিফার মনে বিশ্বাস ছিলো নোমানকে বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে যে তার কোন দোষ ছিলোনা। এসব করতে সে বাধ্য হয়েছে। একটা লুকানো সত্য দিয়ে শুরু হয় তাদের সম্পর্ক। কিন্তু আজ বিয়ের আগেই সে সব বলবে নোমাকে কিন্তু তার আগে তার একটা কাজ বাকি আছে।
নোমান শুয়ে শুয়ে কমেন্টের রিপ্লাই করছে। একটা কালো মেয়ের গল্প লিখেছিলো কাল। কিভাবে এক সুদর্শন যুবক এক কালো মেয়ের প্রেমে পড়ে সেই গল্প। লোকজন বেশ পছন্দ করেছে গল্পটি। ফোনটা রেখে পাশের বিছানার রায়হান ভাইকে ডাক দিলোঃ
-ভাই… ও ভাই…
রায়হান কাথার ভেতের থেকে মাথা বের করে বললোঃ
–কিরে?
-ভাই রেডি হন সময় হয়ে গেছে।
–এখনি বের হবি?
-জ্বী ভাই, উঠেন দেরি হচ্ছে।
–আরো স্বাক্ষি লাগবে তো। আমি একাই গেলে হবে। রুমের বাকি দুজন কই?
-তারা নিচে চা খেতে গেছে। উঠেন।
–মামা ছক্কা হাঁকাচ্ছো তাহলে। ডাইরেক্ট মডেল বিয়ে করতেছো? আমার দিকে তো মেসের বুয়াও ফিরে তাকায়না। কপাল বুঝছো। সব কপালের খেল। এক রুমেই থাকি কিন্তু তোমার বৌ হবে মডেল আমার কপালে কি আছে কে জানে।
-ভাই হিংসা কইরেন না তো। আপনার কপালেও কেউ না কেউ জুটে যাবে। এখন উঠেন দেরি হচ্ছে।
–আহা তর সইছেনা পাত্র সাহেবের। শরিরে কারেন্ট দৌঁড়ায়। অবশ্য এতো সুন্দরী মেয়ে পাইলে কার বা দেরি সহ্য হয় হে হে হে……
-ধূর ভাই হুদাই প্যাঁচাল পাড়েন। যান তো দেরি হচ্ছে। নাহলে পানি পাবেন না। গোসল তো দূরের কথা টিসু দিয়ে পেছন সাফ করতে হবে। এমনিতে আপনার শরির থেকে পাঠা পাঠা গন্ধ আসতেছে।
রায়হান নিজের বগলের কাছে নাক নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো, সোজা বাথরুমের দিকে চলে গেলো। নোমান পাঞ্জাবীটা পড়ে নিলো। আজ তার বিয়ে কিন্তু বাসায় কিছু জানানো হয়নি এখনো। বিয়ে করে এখনি তো বৌকে ঘরে তুলতে হচ্ছেনা। বান্ধবীদের মেসে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। পরে চাকরি পেলে বাসায় জানাবে। ততোদিন ব্যাপারটা চাপা থাকবে। রিফার দিক থেকে বিয়ের কোন চাপ ছিলোনা আসলে বিয়ের সিদ্ধান্তটা তারই। আজকালকের প্রেমের কোন গ্যারান্টি নেই। অবশ্য বিয়ের ও কোন গ্যারান্টি নেই। তবে বিয়ে করা থাকলে সম্পর্ক ভাঙ্গার আগে মানুষ লক্ষবার ভাববে। যেই ছোট কারনগুলোতে ব্রেকআপ হয় সেই কারনে বিয়ের সম্পর্ক ভাঙ্গেনা। যেই অভিমান বা অভিযোগে প্রেমের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় বিয়ের সম্পর্কে মানুষ সেটাতে নিজেকে মানিয়ে নেয়। তাই রিফাকে প্রেমিকা হিসেবে নয় বরং বৌ হিসেবে রাখতে চায় নোমান।
কাজী অফিসে অনেকক্ষন ধরে বসে আছে নোমান, রায়হান আর আরো দুজন রুমমেট। কাজী সাহেব বললেনঃ
–কি হলো আর কতোক্ষন লাগবে। টাকাটা নাহয় দিয়ে দেন কাগজের কাজগুলো এগিয়ে রাখি।
-আরেকটু অপেক্ষা করেন কনে আসছে।
–বুঝছি সাথে টাকা নেই। মেয়ের টাকায় বিয়ে হবে। তো ফোন দিয়ে দেখেন সে আসতেছে নাকি আসবেনা। অনেক দেখেছি ছেলে মেয়ে উভয়কে দেখেছি। একজন কে কাজী অফিসে পাঠিয়ে নিজে অন্যজনের সাথে ভেগে গেছে।
নোমান রিফাকে কল দিলোঃ
–হ্যালো…
-কোথায় তুমি, এতো দেরি হচ্ছে কেন?
–তুমি কাজী অফিসে?
-হ্যাঁ কাজী অফিসে আর কোথায় থাকবো। আসছো তো তুমি?
–এক কাজ করো। কাছেই একটা পার্লার আছে সেখানে একটু আসো।
-কেন?
–আসতে বলছি আসো।
নোমান রিক্সা নিয়ে পার্লারের সামনে আসলো। রিফাকে দেখে অবাক হলো। জিন্স টপ পড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। নোমান রিক্সা থেকে নেমে রিফার দিকে এগিয়ে গেলো। নোমানকে দেখে রিফা সিগারেটটা ফেলে জুতো দিয়ে সিগারেটের আগুন নিভালো।
-তুমি স্মোকিং করো?
–হ্যাঁ… কেন কোন সমস্যা? তুমিও তো স্মোকিং করো।
-আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু এসব কি পড়ে আছো। শাড়ি কোথায়?
–শাড়িও পড়বো বৌ ও সাঁজবো কিন্তু তার আগে কিছু কথা বলবো।
নোমান আর রিফা সিঁড়িতে পাশাপাশি বসলো। রিফা কি বলবে তা মনে মনে সাঁজিয়ে নিলো।
-নোমান ভালোবাসো আমাকে?
–কোন সন্দেহ আছে?
-আমার কিছু খারাপ দিক আছে।
–তোমাকে তো আগেই বলেছি আমার তাতে কিছু যায় আসেনা। তুমি যেমনি হও আমার কোন সমস্যা নেই শুধু আমার প্রতি ভালোবাসা সত্যি থাকলেই হবে।
-সমস্যা নেই কারন আমি রূপবতী তাই?
–তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?
-নোমান আমি তোমাকে যেটা বলবো সেটা শোনার পরে হয়তো তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেনা।
–দেখ রিফা তুমি হয়তো আমাকেও আর দশটা ছেলের মতোই ভাবছো। আমি অন্যসবার থেকে আলাদা।
-না তুমি অন্য সবার থেকে আলাদা সেটা তোমার লেখা পড়েই বুঝা যায়। সেজন্যই তো তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। আচ্ছা তাহলে আমার কথাটা বলি, আমি একজন কলগার্ল।
রিফার কথা শুনে নোমান কিছুক্ষনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কেন যেন তার মনে হচ্ছে রিফা মিথ্যা বলছে তাকে পরিক্ষা করার চেষ্টা করছে। নোমান নিচু গলায় বললোঃ
-আমার কোন আপত্তি নেই।
–ভেবে বলছো?
-হ্যাঁ…
–আমার ধারণা তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি। ওয়েট এটা দেখ।
-এটা কি?
–আমার রেইপড ভিডিও। এটা দিয়ে ব্লাকমেইল করেই আমাকে এই কাজে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার শরিরটাকে তারা নষ্ট করলেও মনটা এখনো পবিত্র আছে। ভিডিওটা সাইডে গিয়ে দেখ আমার সামনে দেখোনা প্লিজ।
নোমানের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। তার শরির থরথর করে কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। ঠোট আর গলা শুকিয়ে গেছে। বড্ড পানি তেষ্টা পাচ্ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। রিফা বললোঃ
–এখন বলো সবকিছু মেনে বিয়ে করতে চাও আমাকে?
নোমান চুপ করে আছে। তার মুখে কোন কথা নেই। রিফা আবারো বললোঃ
-চুপ করে রইলে যে। হ্যাঁ না কিছু তো বলো।
–রিফা আমাকে একটু সময় দাও। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে।
-কেন নোমান এখন ভাবার জন্য সময় লাগবে কেন। তুমি না বলতে আমার কোন অতিত ঘটনায় তোমার কিছু যায় আসেনা।
নোমান চুপ করে আছে। রিফা বললোঃ
-আঁখি মেয়েটা জানে আজ তোমার বিয়ে?
–কোন আঁখি?
-সেই কালো মেয়েটা যার সাথে তোমার দুবছরের সম্পর্ক ছিলো। আমি আসায় যাকে ব্যবহৃত টিস্যুর মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছো।
–আঁখির কথা তোমাকে কে বললো?
-বোকা মেয়েটা তোমাকে সত্যি ভালোবাসে। কোন ভাবে আমাকেই সে খুঁজে বের করেছে। আজ দেখা করে কাঁদতে কাঁদতে শুধু এটুকু বলেছে আপু ওকে ভালো রেখো। তার সাথে কেন প্রতারণা করলে নোমান?
–হ্যাঁ?
-তার দোষটা কি ছিলো, এটাই যে সে আমার মতো রূপবতী ছিলোনা? কিন্তু তুমি তো গল্প লিখতে কিভাবে এক সুদর্শন যুবক কালো একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। তুমি কেন দুবছরে আঁখিকে ভালোবাসতে পারলেনা? একটা পতিতা মেয়ের ভালোবেসে সংসারের গল্প লিখেছিলে তাহলে এখন কেন আমাকে মেনে নিতে পারছোনা? চুপ করে আছো কেন কথা বলো।
–সরি…
-সরি তাইনা। এসব আবেগ নিয়ে লিখা বড্ড সোজা কিন্তু যদি বাস্তব জীবনে এমন হতে না পারো তবে এমন গল্প লিখোনা। ভালো মানুষ হও, ভালো মানুষের মুখোশ পরোনা। এখন চোখের সামনে থেকে যাও তোমাকে দেখতেও ঘৃণা লাগছে।
নোমান চলে গেছে, রিফা বউ সেঁজেছে। রিক্সা চলছে রিক্সার হুড নামানো। লোকজন রিফার দিকে তাকাচ্ছে। রিফার চোখে পানি ছলছল করছে। মুখোশের পেছনের মানুষগুলোকে চেনা বড় দায়।