রুমানার সাথে প্রথম যেদিন আমার দেখা হলো সেদিনের কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। শনিবার দুপুর সোয়া একটার দিকে ধানমন্ডি বিডিআর গেটের কাছে এক রেস্তোরাঁতে পৌছলাম। রুমানার আসার কথা দেড়টায়, আমি আগেভাগেই টেবিল দখল করে একটা ড্রিঙ্কস নিয়ে বসলাম। কাঁটায় কাঁটায় দেড়টায় এসে হাজির হলো রুমানা। ভালো লাগলো তার সময় মতো আসাটা। সামনের চেয়ারে বসে হাতব্যাগটা সুন্দর করে রেখে আমার দিকে একটা হাসি দিয়ে তাকালো, তার পরেই উঠে দাঁড়িয়ে হাতব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, “এক মিনিট একটু আসছি।” বলে এগিয়ে গেলো টয়লেটের দিকে। আমি বসে থাকলাম। সাথে সাথেই আবার ফিরে এসে বলল, “চল অন্য কোনো রেস্তোরাঁতে।” কিছু বলার আগেই সে হাঁটা দিলো গেটের দিকে। বিল দিয়ে তার পিছু পিছু আমিও বেরিয়ে এলাম।
এবার সে নিজেই আর একটা রেস্তোরাঁ পছন্দ করে ঢুকলো সেখানে। ঢুকেই আমাকে দাঁড়াতে বলে রুমানা টয়লেটের দিকে পা বাড়ালো। খানিক বাদে ফিরে এসে বললো, হ্যাঁ এখানে বসা যায়। বসলাম আমরা কোণের একটা টেবিলে। খুব বেশী ভীড় নেই। রুমানা বলল, “আমি সব সময় আগে টয়লেট দেখে নেই যদি দেখি সেটা পরিষ্কার তবেই রেস্তোরাঁতে ঢুকি।” বুঝলাম কেমন মেয়ে রুমানা, খুব টিপটপ গোছালো। এবার ভালো করে তাকালাম তার দিকে। সুন্দর মুখের গড়ন, মায়াময় চোখ, খুব বেশী ফর্সা নয়, দোহারা গড়ন আর লম্বা পাঁচ ফুট চার হবে। বয়েস মনে হলো বাইশ। যেটা সব চাইতে বেশী আকর্ষণ করেছে আমাকে তা হলো তার লম্বা চুল। যখন পিছন ফিরে টয়লেটের দিকে যাচ্ছিল তখন দেখলাম তার মাথার চুলের বেণী। হাঁটুর নিচে আরো ছ’ইঞ্চি লম্বা। ভাবলাম, বিয়ে যদি করি একেই বিয়ে করবো।
মাস ছয়েক আগে ফেসবুকে রুমানার সাথে পরিচয়। আমার ছবি তোলার হবি। মাঝে মাঝে ফেবুতে আমার তোলা ছবি দেই। তারই একটা ছবি দেখে আমাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়েছিল রুমানা। তারপর কিছুদিন দুজনের কথা চালাচালির পর সেই ফ্রেন্ড রিকু পাঠায়। ফেবুতে ওর ছবি আর পরিচয় দেখে আমার পছন্দ হয়ে যায়। ছ’মাস পর সে দেখা করতে রাজি হয়। একটা মোবাইল কোম্পানিতে চাকরী করে রুমানা।
আমি তমাল, বয়েস পঁচিশ। মাস্টার্স করে চাকরী করি এক বহুজাতিক কোম্পানিতে। বাবা মার তিন নম্বর সন্তান আমি। সব চেয়ে বড় বোন আমার থেকে দশ বছরের বড়। আমার যখন দশ বছর তখন আপার বিয়ে হয়ে যায়। দুলাভাইএর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। তারপর বড় ভাইয়া, আমার থেকে সাত বছরের বড়। একটা বিদেশী ব্যাঙ্কে ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিবাহিত। আমি থাকি শান্তিনগরে বাবা-মা, ভাই-ভাবীর সাথে। পুরনো আমলের একতলা বাড়ী, বাবা চাকুরির টাকা জমিয়ে তৈরি করেছিলেন। পরিবারের সবার খুব আদরের আমি, শুধু আমার দুলাভাইএর কাছে ছাড়া। তিনি আমাকে দেখলেই মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলবেনই, “কি রে শালা কবে বিয়ে করবি। আর কদ্দিন শ্বাশুড়িআম্মা আর তোর ভাবীকে জ্বালাবি?” আমার যে এখন বয়েস পঁচিশ আর আমি যে একটা বিরাট চাকুরী করি সেটা তিনি মানতেই চান না। আর আমার মা বাবাও সেই রকম, জামাইকে দেখলেই আহ্লাদে তাদের দুজনের বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে যায়। আসলে আমার সাথে দুলাভাইএর এরকম ব্যবহারের কারণ আছে। তিনি তাঁর পরিচিত দু-দুটো বিয়ের সম্মন্ধ এনেছিলেন আমার জন্যে, আমি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছি। কি করবো, পছন্দ হয় নি যে।
এবার আসল কথায় আসি। রুমানার সাথে প্রথম দেখার হওয়ার পর ছয় মাস কেটে গেছে। আমাদের দুজনের মন দেয়া নেয়া গড়িয়েছে অনেকটা। সে আমার ঘরনি হয়ে আসলে আমাকে কি কি ত্যাগ করতে হবে তার একটা লম্বা লিষ্টি ধরিয়ে দিয়েছে। প্রথমেই আমার সিগারেট ছাড়তে বাধ্য করেছে। আমার ছবি তোলার ব্যাপারে কিছু বিধি নিষেধ জারী হয়েছে। যখন তখন হুট করে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যাবে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে, তবে সেটা মাসে একদিন। সে যা যা বলছে আমি সব তাতেই হ্যাঁ বলে সায় দিচ্ছি। এর মধ্যে একদিন আপা দুলাভাইসহ বাড়ির সবাই মিলে মেয়ে দেখে আসলেন। আঙটি দিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে আসলেন। বিয়ের কার্ডটার্ড ছাপানো চলছে। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে চব্বিশে আগস্ট। এতে করে অবশ্য আমাদের দেখা সাক্ষাতের কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
সতেরই আগস্ট সকালে সে আমাকে ফোন করে বললো এক ঘন্টার মধ্যেই তার সাথে দেখা করতে হবে খুব নাকি জরুরী। আমি একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে গেলাম পুরনো পল্টনে তাদের বাড়ির গলির মুখে। রুমানা উদ্বিগ্ন মুখে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। বেবিট্যাক্সিতে উঠে সে ধানমন্ডির একটা বিউটি পার্লারে যেতে বললো। সেখানে গিয়ে সে তার মাথার চুল দেখিয়ে বললো কি ভাবে খোঁপা করতে হবে। পার্লারের লোকেরা তার কথার কোনো গুরুত্বই দিলো না। শুধু বললো, “বিয়ের দিন সকাল সকাল চলে আসেন হয়ে যাবে।” খুব বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে আর একটা পার্লারে গেলাম আমরা, সেখানেও একই উত্তর শুনে খুব মুষড়ে গেলো রুমানা। এরপর আমরা গুলশানে এক বিউটি পার্লারে গেলাম ঐ বেবিট্যাক্সি নিয়েই। রুমানাকে চেয়ারে বসিয়ে এক মহিলা কর্মচারি দেখলেন। তিনি আর একজন মহিলাকে ডাকলেন, তারপর আরো একজনকে ডাকা হলো। তিন জন মিলে রুমানার চুল নিয়ে অনেক গবেষণা করলেন, কেমন করে বিয়ের খোঁপা করা হবে। এরপর বাইরে আমি বসে ছিলাম, আমাকেও ডাকা হলো। তারা বললেন এত বড় চুলের খোঁপা তারা কখনও করেননি। এতবড় চুলের খোঁপা করতে গেলে মাথায় পাখির বাসার মতো দেখাবে। তাই খোঁপা করা হয়ে গেলে সামনে একটা টায়রা বসিয়ে দেবেন। রুমানা তাতেই রাজি হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যে যার বাড়ি ফিরলাম আমরা।
কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো। যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম সেরে বিয়েবাড়ি থেকে আমাদের শান্তিনগরের বাড়ি আসতে রাত এগারোটা বেজে গেলো। রাত বারোটা নাগাদ ভাবী রুমানাকে নিয়ে আমার ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসলো। সে আগেই আমার ঘর ফুল দিয়ে সাজাতে মানা করে দিয়েছিলো, কারন ফুলে নাকি তার এলার্জি। আমার পাশের ঘরে ভাবীর দুই বান্ধবী, আপা-দুলাভাই আর বড় ভাই বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আমিও সেখানে বসে। দুলাভাই আমার কান ধরে বললেন, “যা শালা এখানে আর বসে থাকিসনে। একজন তোর জন্যে বসে আছে। আর জানি তুইও যাওয়ার জন্যে আঁকুপাঁকু করছিস।” কি করি ধীরে ধীরে আমার ঘরে গেলাম। ভাবী তখন রুমানার সাথে কথা বলছিল। আমাকে দেখে ভাবী তাকে বললো, “নাও তোমার জিনিষ তুমি বুঝে নাও।” এ কথা বলে পিছন থেকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
আমি দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে পরনের শেরওয়ানী আর পাঞ্জাবি খুলে আলনায় রাখলাম। তার পর গেঞ্জি পায়জামা পরে, বড় আলোটা নিবিয়ে ডিম আলোটা জ্বালিয়ে খাটের কাছে যেখানে রুমানা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছে সেখানে গেলাম। রুমানা বললো, “বড্ড গরম লাগছে পাখাটা একটু বাড়িয়ে দেবে।” আমি উঠে গিয়ে পাখাটা বাড়িয়ে দিয়ে রুমানার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাটা দিন খুব ধকল গেছে শরীরের ওপর। রুমানা বললো, “আচ্ছা এই বিয়ের শাড়ি পরে তো আবার কাল সকাল দুপুর কাটাতে হবে, তোমার আত্মীয় স্বজন নতুন বৌ দেখতে আসবেন না?” আমি বললাম, “হুঁ তা তো ঠিক।” রুমানা বললো, “শাড়িটা তাহলে খুলে রাখি, আর সেই সাথে খোঁপাটাও খুলি। মাথা ভার লাগছে।” আমি বললাম, “ঠিক আছে।”
রুমানা ওখানেই বসে বিয়ের শাড়িটা ধীরে ধীরে খুলে সুন্দর করে পাট করে ভাঁজ করে পাশে রাখলো। তারপর এক এক করে মাথার খোঁপার ক্লিপগুলো খুলে পুরো চুল খুলে ফেললো। সে ছিলো দেয়ালের দিকে, তাই আমি বললাম, “শাড়ীটা আমাকে দাও আমি রেখে দিচ্ছি পাশের আলনায়।” রুমানা বললো, “দরকার নেই আমিই রাখছি।” এই বলে সে খাটের উপরে উঠে দাঁড়ালো আমার পাশে। মাথার অনেক চুল তার মুখের ওপর জড়ো হয়েছিল খোঁপা খোলার সময়। সামনে একটু নিচু হয়ে মাথাটা পিছনের দিকে ঝাঁকিয়ে চুলগুলো সরাতে গেলো। আর তখনই হলো বিপত্তি। চিৎকার করে উঠলো রুমানা, “উ মাগো গেলুম গো।” আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে তাকিয়ে দেখি তার অনেকখানি মাথার চুল চলন্ত পাখার ব্লেডের সাথে জড়িয়ে গেছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে পাখার সুইচটা বন্ধ করলাম আর বড় লাইটটা জ্বালালাম। পাখা থেমে গেলো। রুমানার কাছে গেলাম, সে তখনও এক হাতে বিয়ের শাড়ী আর অন্য হাতে চুলের গোছা ধরে চেঁচাচ্ছে, “উঃ মাগো, গেলুম গো, গেলুম।”
পাশের ঘরের হৈ চৈ সহসা থেমে গেলো। একটু পরে ভাবী দরজায় টোকা দিয়ে আমার নাম ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “এই তমাল কি হইছে তোদের।” আমি বললাম, “ভাবী কিচ্ছু না। আমি বলছি একটু পরে।” ওদিকে রুমানার চেঁচানি থামেনা। সে আরো জোরে বলে চলেছে, “আর পারিনা, ব্যাথা করে যে।” আমি তাকে থামানোর জন্যে তার মুখ চেপে ধরি। তাতে হলো আর এক বিপত্ত্বি। সে তখন খাটের ওপর দুই পা দাপাতে লাগলো। অনেক দিনের পুরনো খাট। যতো সে লাফায় ততোই খাটের থেকে শব্দ বেরোয় ক্যঁচ কোঁচ, ক্যাচর ম্যাচোর। এবার দুলাভাইএর গলা শোনা গেলো। তিনি বললেন, “আরে শালা,একটু রয়ে সয়ে, বৌ তো পালিয়ে যাচ্ছে না।” আমার তখন ইচ্ছে করছিলো একটা মুগুর দিয়ে আমার আর দুলাভাইএর মাথা ফাটাই। রুমানার মুখ থেকে হাত সরিয়ে আবার টেবিলের কাছে গেলাম। আমার একটা কাঁচি আছে সেটা আর এখন খুঁজে পাচ্ছিনা। বিয়ের ডামাডোলে কে যে কোথায় সরিয়ে রেখেছে। অনেক খোঁজার পর অবশেষে কাঁচি পেলাম। সেটা নিয়ে আবার এলাম রুমানার কাছে। কাঁচি দেখে রুমানা বলে উঠলো, “সে কি কাঁচি দিয়ে কেনো? ব্লেড নেই? ব্লেড দিয়ে কাটো। কাঁচি দিয়ে কাটলে চুল উবড়া খেবড়া হয়ে যাবে যে।” আমি তার কোনো কথা না শুনে ধীরে ধীরে পাখার ডানা থেকে জড়িয়ে যাওয়া চুল, আমার সাধের চুল, যার কারনে প্রথম তার প্রেমে পড়েছিলাম সেই চুল, কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলতে লাগলাম। অনেকটা চুল কাটতে হলো জট ছাড়াতে গিয়ে। এদিকে রুমানার চিৎকার আর দরজার ওপাশের টিপ্পনি থেমে নেই। পাখা থেকে চুলের জট ছাড়ানো হয়ে গেলে রুমানা খাট থেকে নেমে বিয়ের শাড়ীটা কোনো রকমে গায়ে জড়িয়ে নিলো। আমি গেঞ্জি পায়জামা পরা অবস্থায় দরজা খুললাম। গরমে আর উত্তেজনায় আমাদের দুজনের শরীর নেয়ে ঘেমে একাকার। বাইরে এক দল উৎসুক মানুষের জটলা। সবাই রুমানার উশকো খুশকো খোলা চুল আর আমাদের দু’জনের আলুথালু বেশের দিকে তাকিয়ে আছে। কে নেই সেখানে, সামনে ভাবী আর দুলাভাই, তার পিছনে আপা আর ভাবীর দুই বান্ধবী, দু’জন কাজের মেয়ে, এমনকি মা বাবাও এসে হাজির। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে ঘোঁৎ করে শব্দ করে বললেন, “একটা গাধা তৈরি হয়েছে।” বলে চলে গেলেন। মা তাঁর পিছন পিছন চলে গেলেন। আপা চলে গেলেন, বড় ভাই চলে গেলেন। থাকলেন দুলাভাই আর ভাবী। তাঁরাও কিচ্ছু বললেন না। দুলাভাই অর্থপুর্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, “দ্বিতীয় ইনিংস কেমন খেলা হয় সেটার আর ধারা বিবরণী শুনতে চাই না। আমরা ঘুমোতে চাই, কাল অনেক কাজ আছে!