হার না মানা ভালবাসা

হার না মানা ভালবাসা

“সেদিন যদি হার মেনে ফিরে যেতাম তাহলে কি হতো?”
রাত তিনটায় বেলকনিতে দাড়িয়ে কথাটা মনে মনে ভাবছে ফাইজান। রুমে ঘুমিয়ে অাছে তার অপরূপ সুন্দর স্ত্রী অার ফুটফুটে মেয়েটি। বিয়ের মেয়েটির নাম ‘মেহের’।

ডিপ্রেশনের জন্য অাগে রাতে ঘুম হতনা অার এখন অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে। ছটফট করে রাতটা কাটিয়ে দেয় ফাইজান। মাঝে মাঝে খিদেও লাগে প্রচন্ড, নুডুলস খেতে ইচ্ছে করে কিন্ত বউটা বড্ড ঘুমকাতুরে তাই অার ডাক দেয়না। ‌সে নিজেই এক মগ চা বানিয়ে ‌টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে খেয়ে নেয়। টোস্ট বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে খেলে নাকি ব্রেডের স্বাদ পাওয়া যায়।

বউ তখন টিটকারি মেরে বলে,
তাহলে তো ব্রেড খেলেই পারো।
ফাইজান মুখে চুকচুক অাওয়াজ তুলে বলে, হিংসে হয় তোমার?
একসময় তো বিস্কুটখেকো বলে খ্যাপতো বউটা। মেহেরের জন্মের পর থেকে অার ডাকেনা। হয়তো ভয় পায় মেহেরও যদি বাবা না ডেকে বিস্কুটখেকো ডাকা শুরু করে।
বেলকনিতে বসে ভাবতে থাকে পুরনো দিনগুলির কথা।

স্কুলে থাকতে একজনকে ভালবাসতো ফাইজান প্রচন্ড রকমের কিন্তু বলার সাহস হয়নি কখনো। প্রায় চার বছর একসাথে পড়ে মাধ্যমিক দিয়েছে ওরা। কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস পায়নি সে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায় সে। হৃদয়ের মধ্য প্রচুর পরিবর্তন অাসে। একাকিত্ব অার ডিপ্রেশনের সঙ্গেই যেন ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে।প্রায় ছয়টি বছর এভাবে কাটিয়ে দেয় সে। ২০১৭ নতুন বছরে সে অাবার নিজেকে বদলাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। নিজেই নিজেকে বলে যে ভূলে যাবে অতীত কে। ফেসবুকটা বড়ই বিচিত্র জায়গা। কখন কাকে মিলিয়ে দেয় অার কাকে দূরে সরিয়ে দেয় ভাবা মুশকিল। ফাইজান ফেসবুক চালায় ঠিকই কিন্তু নিজের ছবি বা কোনটিই দেয়না সেখানে। অনেকে ইনবক্সে চাইলেও দিতে চাইতো না। কারণ জানতে চাইলে বলতো তার নিজের চেহারা নাকি তার ভাল লাগেনা।
২০১৭ সালের প্রথম দিকেই। ফেসবুক ব্রাউজ করছিল সে। সেখানে একটি মেয়ের ছবি দেখে থমকে যায় ফাইজান। সময় যেন অাটকে গিয়েছে। চোখ সরাতে পারছিলো না ছবিটি থেকে। অনেকটা দেখতে তার স্কুলের প্রথম ভালবাসার মেয়েটির মত। গাল দুটো খানিকটা উচুঁ যা তাকে স্বর্গী অপ্সরীর সৌন্দর্য দান করেছে। খাকিক্ষণ ভাবে সে, তারপর রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে দেয়। মেয়েটির কথা ভাবতে থাকে সারাদিন। টাইমলাইনে রবীন্দ্রনাতের সেই বিখ্যাত দুটো লাইন পোস্ট করে দেয়,

“প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
কয়েকজন সেখানে কমেন্ট ও করে জানার জন্য।

ঠিক দুদিন পর নোটিফিকেশন অাসে যে মেয়েটি তার বন্ধুত্ব গ্রহণ করেছে। সে ঘুরে ঘুরে মেয়েটির প্রোফাইল, ছবি দেখতে লাগলো রীতিমত মুগ্ধ হয়ে। ফাইজানের লজ্জাবোধটা বেশি হওয়ার অাগ বাড়িয়ে মেসেজ দেওয়ার সাহসটা হয়নি। মেয়েটির বাসা ফাইজানের পাশের পাড়াতেই ছিল অনেকবার দেখাও হয়েছে। এভাবেই চলে যায় প্রায় ছ’মাস। হঠাৎ একদিন মেয়েটি তাকে অানফ্রেন্ড করে দেয়। ফাইজান কারণ জানতে চাইলে সে উত্তর দেয়, সে তাকে চিনেনা তাই অানফ্রেন্ড করে দিয়েছে।

ফাইজানের কিছুটা খারাপ লাগে মেয়েটির এমন পদক্ষেপে, মানে শায়লার অানফ্রেন্ড করার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি সে।

ক’দিন পর শায়লার এক বান্ধবির জন্য অাবার যোগাযোগ হয় তাদের। কথা হয় অনেক কিছু। ফাইজান মাঝে মাঝে শায়লার বাসার সামনে গিয়ে মেসেজ দিত,

অামি তোমার বাসার সামনে, একটু বের হও অামি তোমাকে দেখব। শায়লা জিনিষগুলি স্বাভাবিক ভাবেই নিতো। তারপর শায়লা জানায় যে তার বয়ফ্রেন্ড অাছে। ফাইজান জিনিষটা স্বাভাবিকভাবেই নেয় কারণ এত সুন্দর একটা মেয়ে বয়ফ্রেন্ড থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বয়ফ্রেন্ডটা নাকি উড়নচন্ডি স্বভাবের, নিজের খেয়াল রাখেনা অার শায়লার কি খেয়াল রাখবে। শায়লা অার ফাইজানের বন্ধুত্ব অার প্রগাড় হয়।

দিনরাত কথা অার কথা যে কথা কখনো শেষ হতনা। নিজেরা নিজেদের সবকিছু শেয়ার করতো যা অন্য কারো সাথেও শেয়ার করতো না। নাম্বার অাদান প্রদান হয়। মাঝে মাঝে টুকটাক ফোনে কথা হত মাসে দু চারদিন তাও বড়জোর ৩০ সেকেন্ড। অনলাইনে অাসেন, সরি এই টাইপের কথাবার্তা অারকি। কারণ ফাইজান ফোনে কথা বলতে লজ্জাবোধ করতো। ফাইজান ফোনে বিব্রতবোধ করতো ভেবে শায়লাও তেমন চেষ্টা করতো না। তবে মেসেজে সবসময় কথার ঝুড়ি। ফাইজান সবসময় শায়লাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতো।

শায়লাদের গ্রামের অারেকটি মেয়ে ফাইজানের নামে শায়লার কাছে কিছু বিভ্রান্তি ছড়ায়। শায়লা ফাইজানকে কোন কিছু না বলেই সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফাইজান বুঝতে পারেনা সে কষ্ট পাবে নাকি অবাক হবে। প্রায় কয়েকমাস পর অাবার যোগাযোগ হয় তাদের।ভিূল বোঝাবুঝিটা ‌শেষ হয় তাদের। শায়লা তাকে সরি বলে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও পাঠায় । ফাইজান জানতে পারে শায়লার অাগের সম্পর্ক অার নেই। শায়লা নিজেকে বদলে ফেলেছে। তবে ফাইজান অার শায়লা অাগের মতই কথা বার্তা বলতো। প্রায় দেড় বছর হয়ে গিয়েছে ফাইজান ও শায়লার পরিচয়। সে যথেষ্ট জানে ও বুঝে শায়লাকে। শায়লাও একই কিন্তু বুঝতে দেয়না তাকে। ফাইজান বুঝতে পারে সে শায়লাকে অনেকটা পছন্দ করে। শায়লার সাথে সারাক্ষণ থাকতে চায়, কথা বলতে চায়, ঘুরতে চায়। কিন্ত কিছুই বলার সাহস হয়না।

ফাইজানের লিস্টে ফাহি নামের একটা মেয়ে ছিল দারুণ ছটফটে অার ডানপিটে। প্রায়ই কথা হয় দুজনের। ফাইজান ফাহিকে জানায় সে একজনকে পছন্দ করে কিন্ত বুঝতে পারছেনা কি করবে।

তারপর থেকে ফাহি অনবরত প্রেশার দিতে থাকে শায়লাকে প্রোপোজ করার জন্য। অার এও বলে যে চুপ থাকলে স্কুলে যাকে ভালবাসতা তাকে যেভাবে হারাইছো ওকেও এভাবে হারাবা।
রাত প্রায় দুটা ফাইজান সিদ্ধান্ত নেয় সে শায়লাকে জানিয়ে দেবে তার মনের কথা।
সে শায়লাকে মেসেজ করে,

অামার তোমাকে অনেক ভাল লাগে, তোমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগে, ঘুরতে ইচ্ছে হয়, তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই, তোমাকে ভাল রাখার দায়িত্বটা কি অামাকে দিবা?

এই প্রোপোজের বিস্তারিত ফাহিকে জানায়। ফাহি শুনে হাসতে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা,
-এভাবেও কেউ প্রোপোজ করে?
: কেন হয়নি?
– খুব বাজে হয়েছে।
: হলে হোক ঢং করে বলতে পারবো না।

ওদিকে শায়লা অনলাইন এসে ফাইজানের মেসেজ পড়ে। সে সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে পেছিয়ে “না” বলে দেয়। ফাইজান কিছুটা কষ্ট পায়। জীবনে প্রথম কাওকে ভালবাসার কথা বলেছে অার ‌সেখানে প্রত্যাখ্যান। ফাইজান শায়লাকে তেমন রিয়্যাকশন দেয়না চুপ করেই থাকে। সেদিনের মত শায়লা অফলাইন চলে গেলে ফাইজান ভাবতে থাকে তার কথা। চোখ বেয়ে জলধারা। মানুষ বলে ছেলেরা কান্না করেনা কথাটি সম্পূর্ন ভূল ফাইজার প্রমাণ। অতিরিক্ত কান্নার কারণসুলভ মাথা ব্যাথা হয় তার। একটানা পাচঁ দিন না খেয়ে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় সে। বাসার মানুষজন অবস্থা বেগতিক দেখে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

ফাইজান অার শায়লার তাও কথা হয় কিন্ত অাগের মত মজা করা সাহস পায়না সে। অথবা অধিকার নেই ভেবেই তেমন কিছু বলতে পারেনা। শায়লাও কিছু বলেনা। ফাইজান মনে মনে ভাবে সে শায়লাকে অার কখনো জ্বালাবেনা, পর্দার অাড়ালেই থেকে যাবে।

শায়লা ফাইজানকে অনেক কাকুতি মিনতি করতে থাকে তাকে ব্লক করে দেয়ার জন্য।
ফাইজান জবাব দেয় কখনো, জীবনেও না।
টুকটাক কথা হতো তাদের।

অনেকদিন পর ফাইজান অার শায়লার অাবার কথা হয়। শায়লা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দেয় সেও ফাইজানকে পছন্দ করে। শুরু হয় তাদের পথচলা। দুজন দুই শহরের কিন্তু ভালবাসার একই সুতোয় বাধা। মাঝে মাঝে ফাইজান শায়লার শহরে চলে যেত। দুজনে মিলে বন বাদাড়ে ঘুরতো হাতে হাত ধরে। এই শহরে যে তাদেরকে কে চেনেনা তাই ভয় নেই। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে চা খাওয়া। দুই প্লেট ফুচকা ওর্ডার দিয়ে দু প্লেটই ফাইজানের খেয়ে ফেলা এরকম হাজারো স্মৃতি।

শায়লা বলতে থাকে,
তুমি এত ফুচকা খাও কিভাবে?
– কেন মুখ দিয়ে, তুমি কি নাক দিয়ে খাও?
: উফফ, তুমি একাই যদি খাবে তাহলে অামাকে সাথে এনেছো কেন?
– একা দু প্লেট ওর্ডার করতে লজ্জা করে তাই।
: এত ভাল লাগে কেন ফুচকা?
– অনেক ভাল লাগে, তবে তোমার চেয়ে ১% কম।
: কিহ??? মাত্র ১%?
বলে রাগি লুক দিয়ে বের হয়ে যায় শায়লা।
ফাইজান ও হাসতে হাসতে বের হয় শায়লার পিছু পিছু।
শায়লা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। অার ফাইজান ও তার অফিসটি দেখাশোনা করে।
এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করবে। ফাইজানের বাসায় জানালে তারা সহজেই বিষয়টি মেনে নেয়। কিন্তু শায়লার বাসায় কিছু সমস্যা দেখা দেয় যা পরে ঠিক হয়ে যায়। সর্বসম্মতিতে তাদের বিয়েটা হয়ে যায়।
বাসর রাত। শায়লা ঘোমটা দিয়ে বসে অাছে রুমে। ফাইজান নার্ভাস হয়ে বাইরে দাড়িয়ে অাছে। ওর বন্ধু মেনন অার রাজু ওকে খোচাঁচ্ছে।
: ক্রাশকে বিয়ে করেছিস, তোর তো ব্যাটা লটারী লেগেছে। যা যুদ্ধে নেমে পড়।
-তোরা সবসময় মজা করিস, বাই।
ফাইজান রুমে ডুকতেই শায়লা পায়ে সালাম ধরে সালাম করল।
ফাইজান বলল, স্বামী নিয়ে সুখে থাকো অার অাগামী ১ বছরের ভিতর ২,৩ হালি বাচ্চা কাচ্চা জন্মাও।
: অাপনার খালি অাজাইরা কথা।
– তো বাসর রাতে কি গণিতের সূত্র বলবো।
: বেশি একবারে।

– শায়লা শুনো, বিয়ের অাগেও অামার তেমন চাওয়া পাওয়া ছিলনা। কখনো ফোনে কথা বলা, দেখা করার জন্য চাপ দিইনি শুধু চেয়েছি অামাকে ভালবেসো। এখনও তেমনি থাকবে শুধু অামার মাকে একটু দেখে রেখো। তিনি অামার কাছে পৃথিবী। উনি বয়স্ক মানুষ উনার সাথে খারাপ ব্যবহার করনা কখনো। উনি কিছু বললে অামাকে বলবে। সেদিন রাতে ফাইজান শায়লাকে ধরে শুয়ে থাকে অার ভাবতে থাকে “অবশেষে অামি তাহাকে পাইলাম।
শায়লা একসময় পরিবারের সবার প্রিয় হয়ে উঠে। এমনকি ফাইজান শায়লার ঝগড়া হলেও সবাই শায়লার পক্ষ নেয়। বেচারা ফাইজান একা পড়ে যায়।

বিয়ের প্রায় দুবছর পর তাদের একটি মেয়ে হয়।শায়লা অতিরিক্ত দূর্বল হওয়ার কারণে হওয়ার কারণে কিছু জটিলতা দেখা দেয়। রক্তের প্রয়োজন পড়ে। যদিও ফাইজানের বন্ধু ‌মেনন একাই দু ব্যাগ রক্ত দিয়েছে। বাবা হওয়ার অানন্দে হাসপাতালের বেলকনিতে দাড়িয়ে কাদঁছিল। সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে ফাইজান শায়লার কাছে এসে বসে।
হাত ধরে বলে, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
: মা হওয়াটা অানন্দের বিষয়।
– তুমি অামাকে জীবনের সেরা উপহার দিয়েছো অাজ।
: পাগল কান্না বন্ধ করো মেয়েদের মত।
৫ দিন পর শায়লাকে বাসায় নেয়া হল।
মেয়ের নাম রাখা হল ‘মেহের’ যা দুজনে বিয়ের অাগেই ঠিক করে রেখেছিল।
সবাই অনেক খুশি।

শায়লা অাগের মতই ঘুমপাগলী অার ফাইজান নিশাচর। যেন পেচাঁ অার দোয়েল পাখির সংসার।
এখনো রাতে ঘুমাতে পারেনা ফাইজান। বেলকনির খোলা দীর্ঘ করিডোর দিয়ে চাঁদের অালো পড়ছে শায়লার মুখে। সে ভেবে পায়না অাকাশের চাঁদটা বেশি সুন্দর নাকি তার ঘরের চাঁদটা? চাঁদের অালো শায়লার মুখে পড়ছে নাকি শায়লার মুখের উজ্জলতা চাঁদের গায়ে পড়ছে? বেলকনিতে বসেই ভাবতে থাকে তার অার শায়লার পুরনো দিনগুলির কথা।

মনে প্রশ্ন জাগে, “কি হতো সেদিন যদি হার মেনে ফিরে যেতাম?”
মৃদু হেসে সব উড়িয়ে দিয়ে শায়লার পাশে শুয়ে পড়ে ফাইজান।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত