সাত সকালে বৌয়ের হাওমাও করে কান্নায় বুকটা ধাড়াস করে উঠলো। বুক টিবটিব করতে লাগলো ভয়ে। খাট থেকে নেমে উঁকি মেরে তাকিয়ে বললাম।
— “কাঁদছো কেন? ডিম ভাজতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছো?”
— “আমার নতুন কেনা স্যান্ডেলগুলা নাই। কোন হারামি জানি চুরি করেছে।” কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো মীরা।
— “আহ অতি সুসংবাদ মানে খুব দুঃখজনক একটা ঘটনা ঘটলো। অফিসে লেট হয়ে যাচ্ছে। জলদি একটা ডিম পোচ দিতে পারবে?”
— “আমি আমার নতুন কেনা বারশ টাকার দামের জুতার শোকে কষ্ট পাচ্ছি আর তুমি ডিম পোচ খেতে চাচ্ছো? আজ ঘরে অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল।” সোজা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো মীরা।
মফিজের দোকানে বাসি রুটি চা’য়ে ভিজিয়ে খেতে ভাবতে লাগলাম জুতা চুরি করতে কে আসলো? এলাকায় গরু ছাগল চুরি হয়। সেদিন আমার নতুন কেনা লুঙ্গীটাও চোর মহাশয় চুরি করেছে। তাই বলে জুতাচুরি? জুতাচুরি কেন হয়না সেটা নিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়েছে।
কলেজে পড়ার সময় আমি মামার বাসায় থাকতাম।মামা ছিলেন জাঁদরেল কলেজ শিক্ষক। বেশ কয়েকদিন চুরি করার পর একদিন রাতের বেলা চোর ধরা পড়লো। চোরেও তো গরম লাগে। গরমের দিন, গরমে অতিষ্ট হয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি খাওয়ার জন্য চোর যেই না ফ্রিজ খুললো সেই শব্দে মামী এসে হাতেনাতে চোর ধরলেন। তারপর ঝাঁটাপেটা করতে লাগলেন। চোর তখন বলতে লাগলো “হায় কপাল, ঠান্ডা পানি খাইতে গিয়া মাইর খাইতেছি।” মামী এরপর দারোগাদের মতন জেরা করতে লাগলেন….”বল হারামজাদা, একসপ্তাহ আগে বাহির থেকে তুই জুতা চুরি করিসনি?” চোর তখন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,”ইতা কিতা কই আম্মা। চোর হইবার পারি। মাগার আমারও তো একটা ইজ্জত আছে। জুতা চুরির মতন এমুন ছুডু কাম মজিদ চোরা করেনা”।
সেই থেকে আমার ধারনা হয়েছিল। চোরেরা আর যাই চুরি করুক অন্তত জুতা চুরি করবেনা। তাদেরও তো একটা ইজ্জত আছে। যা হোক, সেদিন অনেক সাধনা করে মীরার রাগ ভাঙ্গালাম। সকালবেলা। মীরা বেশ খুশি খুশি হয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো,”অ্যাই শোননা। তোমার জুতাগুলোও চুরি হয়ে গেছে। হাঃ হাঃ হাঃ”
বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে দৌড় দিয়ে দরজার বাহিরে গিয়ে দেখলাম সত্যি জুতা গায়েব। মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেলো। মীরার বাবার মতন কিপ্টুস আমাকে জুতাগুলা উপহার দিয়েছিল। শশুরের চিহ্নটাও চোর নিয়ে গেলো। জিদ চেপে গেলো। আজ আর রক্ষা নেই চোরের।
রাতে মীরার আরেক জোড়া নতুন জুতা দরজার বাহিরে রেখে বসে আছি। দরজার ফুটো দিয়ে তাকিয়ে খোদার নাম জপতেছি৷ কারন মীরার জুতাকে টোপ হিসেবে ব্যাবহার করতেছি৷ বাই মিসটেক জুতা যদি অাবারো চুরি হয় মীরা ডাইরেক্ট অামাকে জুতাপেটাও করতে পারে৷ রাত কেটে যাচ্ছে, চোরের কোন পাত্তা নেই৷ মীরা একবার এসে সন্দেহমাথা স্বরে জিজ্ঞাসা করলো ”চোর বেশ মোটাসোটা বডিবিল্ডার হয়? তোমাকে যদি উল্টো মাইর লাগায়?”৷ বেশ ভাব নিয়ে জবাব দিলাম, ”তোমার বরও কম না৷ সালমান খান স্টাইলে এমন প্যাদানি দিবো যে চোর বাপের নামই ভুলে যেতে পারে”৷ মীরাকে কনফিডেন্স নিয়ে বললেও ভেতরে ভেতরে অামারো কিঞ্চিৎ টেনশন হচ্ছিলো৷ অামি যে হরদম কুকুরের তাড়া খেয়ে দৌড় লাগাই৷
কখন দরজার পাশেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম জানিনা৷ হটাৎ বাহিরে খসখস শব্দশুনে তাকিয়ে দেখলাম মোটকা হাদ্দাদ সাহেব সন্তর্পনে অামার দরজার সামনে পাক্কা চোরের মতন উঁকিঝুঁকি মারতেছে৷ তারপর অালগোছে মীরার সাধের জুতাজোড়া বগলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো৷ ”তবে রে শয়তান প্রতিবেশি, অামার পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হয়ে অামার জুতা চুরি?”, মাথা গরম হয়ে গেলো৷ বের হয়ে হাত চেপে ধরলাম৷
—- ‘একি হাদ্দাদ সাহেব৷ শেষমেষ অামার বাসার জুতা চুরি করতে লাগলেন যে?’
—- ‘ভাই ভাই অাস্তে কথা বলেন৷ বলতেছি বলতেছি৷ বিষয়টা হলো যে অামার বৌয়ের জন্য এই চুরি চামারিতে নামতে হলো’৷ অার্তনাত করে উঠলেন হাদ্দাদ সাহেব৷
—- ‘চুরি করেন অাবার দোষ ভাবীর ঘাড়ে দিচ্ছেন?’ সন্দেহমাখা স্বরে জিজ্ঞাস করলাম৷
—- মাসে যা বেতন পাই তা দিয়ে বাসাভাড়া, খাওয়াদাওয়া অার বাচ্চাদের খরচ তো চলে যায়৷ কিন্তু অাপনার ভাবীর শপিংয়ের খরচ তো উঠেনা৷ প্রতি সপ্তাহ বায়না ধরে ”ওগো অামার ময়নাপাখি, অমুক ভাবী সিল্কের শাড়ী কিনছে, তমুক ভাবী রূপার গহনা বানাইছে৷ অামারে কিনে দিবা না বেবী?”
—- ‘ভাবী অাপনাকে ময়নাপাখী অার বেবী ডাকে?’
—- ভাই এইসব অালাপ বাদ দেন, দুঃখের কাহিনী শুনেন৷ প্রতি সপ্তাহে নয়া শাড়ী, নয়া গহনা দিতে দিতে অামার হালুয়া টাইট রে ভাই৷ এরপর অারো অাছে৷ ”নতুন একটা ফাস্টফুডের দোকান খুলছে বেবী, চল অাজ অামরা সেখানের খাবার টেস্ট করবো৷” ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে মানিব্যাগটারে ফাঁকা করে অাসে৷শেষ হয় নাই অারো অাছে, ভ্যালেন্টাইন ডে গিফট, ম্যারেজ ডে গিফট, প্রথম দেখা হয়ার দিন গিফট, প্রথম প্রপোজ করার দিন গিফট, প্রথম চুমু খাবার দিন গিফট৷ এত এত গিফট দিতে দিতে অাজ অামি বাধ্য হইয়া জুতা চুরিতে নামলাম৷ অাপনাগোর জুতা নিয়ে মুচির কাছে বেচি৷ হু হু করে কাঁদতে লাগলেন হাদ্দাদ সাহেব৷
হাদ্দাদ সাহেবের কাহিনী শুনে দুঃখে অামারো চোখে পানি চলে এলো৷ মীরার জুতজোড়া দান করে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম ”অামি কবে জুতা চুরিতে নামবো?”, অাজকাল মীরাও হাদ্দাদ সাহেবের বৌয়ের মতন এটা ওটা চাওয়া শুরু করেছে৷ হায় হায়৷