আমার পাশে যে মেয়েটি শুয়ে আছে তার নাম ফারিয়া। ফারিয়া আর আমার বিয়ের বয়স দশ বছর। আমাদের কোল জুড়ে একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে যার নাম তাবাসসুম। ফারিয়া আর আমার সাংসারিক জীবনে কোন কিছুর অভাব ছিলোনা। অভাব তখন থাকে যখন প্রয়োজনের থেকে বেশী আবদার করা হয়। পৃথিবীতে একদল মানুষ রয়েছে যারা অল্পতেই সন্তুষ্টি খুজে পায়। ফারিয়া সেই দলের মানুষ। কখনো নিজ থেকে নিজের জন্য কিছুই চায়নি, যা পেয়েছে তাই নিয়ে জীবন চালিয়ে যায়। আজকাল ফারিয়ার কথা বার্তায় অনেক রহস্য খুজে পাই আমি, এর কারন আমার জানা নেই। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম, সে কিছু একটা জেনেছে, যা আমি তাকে কখনো জানাইনি। প্রায় সে আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, আপনার মন ভালো আছে? ভালো আছেন আপনি?
প্রশ্নটা বড্ড অদ্ভুত মনে হয় আমার কাছে। সারা দিন রাত আমি ফারিয়ার সাথেই থাকি, যখনই কথা বলি হাসি মুখে কথা বলি। তার সাথে অনেক খুনসুটি কাজেও মেতে থাকি। কখনো বাহিরে ডিনার, কখনো কোম পরিকল্পনা ছাড়াই তাকে নিয়ে ঘুড়তে চলে যাই। ফারিয়াও আমার এসব পাগলামি খুব পছন্দ করে। এর আগে সে প্রায় বলতো, তোমার মত সুখী মানুষ আর দেখিনি। কিন্তু আজকাল ফারিয়া সেই কথা না বলে আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করে আমি ভালো আছি কিনা?
আমি কখনো ফারিয়াকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনা। আমি যদিও বলি আমি ভালো আছি ফারিয়া আমার এই কথা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস না করার পেছনে দুটি কারন রয়েছে, একটি কারন ফারিয়ার অতিত আরেকটি কারন আমার অতিত। বারান্দায় গিয়ে বাহিরের আবহাওয়া দেখছিলাম, নির্জন রাস্তা চারিপাশে শুধুই রয়েছে শুন্যতা। আকাশের দিকে তাকালে, অর্ধেক চাঁদ দেখা যায়। আকাশে অর্ধেক চাঁদ তখন দেখা যায়, যখন না থাকে পুর্নিমা না থাকে আমাবষ্যা। মাসের মধ্যভাগে এমন চাঁদ দেখা যায়। আমার কাছে পুর্নিমা আর আমাবস্যা এই দুই চাদের থেকে এই অর্ধ চাঁদ অনেক আপন মনে হয়।
একটা সময় ছিলো যখন আমার জীবন সম্পুর্ন আমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে ছিলো। আর ফারিয়ার জীবন ছিলো পুর্নিমার আলোয় আলোকিত। হঠাৎ করে সময় তার মোড় ঘুড়ালে ফারিয়ার জীবন পুর্নিমা থেকে আমাবস্যায় পরিনত হয়। আমার পড়ালেখা বেশী দূর ছিলো না, সরকারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত ফ্রিতে পড়েছিলাম। আমার বাবা মা নেই, জন্মের কয়েক বছর পরেই লঞ্চডুবিতে মা বাবা স্রোতের ধারায় হারিয়ে যায়, আমি সেদিন কিভাবে বেচে ছিলাম তা আল্লাহ ভালো জানে। বেচে ছিলাম, কিন্তু জীবনের প্রতিটি মোড় আমাকে অতিষ্ট করে তুলেছিলো, বার বার মনেতে বাসনা জাগিয়ে দিতো, একবার মরেই সব হিসেব শেষ করে দিতে। কিন্তু খুব ভিতু প্রকৃতির মানুষ ছিলাম বলে মরতে পারিনি। তখন জীবন বাচাতে শাহেদ ভাইয়ের হোটেলে বেয়ারার কাজ করতে লাগলাম। তিনবেলা খাবার আর মাসে কিছু টাকা সে আমাকে দিতো। তাই নিয়েই জীবন চলছিলো আমার। শাহেদ ভাইয়ের দোকানে থেকেই কিভাবে যে জীবনের এক যুগ পার করে দিয়েছিলাম, সেটাও জানা নেই। শুধু বুঝেছিলাম সময়ের ধাক্কাতে আমি বড় হয়ে গেছি, মুখে দাড়ি মোছ গজিয়েছে, এখন একজন পুরুষ হয়ে উঠেছি আমি।
একদিন আমি হোটেলের কাজ শেষ করে রাত প্রায় দশটার দিকে তেজগাও রেললাইন এরর পথটি ধরে আমার বস্তিতে ফিরে যাচ্ছিলাম। এত রাতে রেললাইনে কোন মানুষজন থাকেনা, কিছু বস্তির ছেলে থাকে যাদের উদ্দেশ্য সৎ হয়না। এরা প্রায় নেশায় ডুবে থাকে, এরা অন্য জগতের মানুষ। সমাজ জগত এদের ত্যাজ্য করেছে সমাজ তাদের মেনে নেয়না, তাই তারা সমাজের বিরুদ্ধে কাজ করে যায়। আমি প্রায় বস্তির কাছাকাছি চলে এসেছিলাম, কিন্তু কি মনে করে যেন ফারুক ভাইয়ের দোকানে দাঁড়ালাম। যখন এই দাড়ানোর কোন উদ্দেশ্য ছিলো না তাই ফারুক ভাইকে চা দিতে বললাম। ফারুক ভাই গরম চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি তা হাতে দিয়ে হালকা ফুঁ দিতে দিতে চুমুক দিতে লাগলাম। এরই মধ্যে লেভেল ক্রসিং রুম থেকে বেলের আওয়াজ আসতে লাগলো, এর মানে ট্রেন আসবে দুই পাশের বেরিকেড পড়ে গেলো। যাওয়া আসার গাড়িগুলো অপেক্ষা করছিলো ট্রেন চলে যাবার। আমি সেখানে দাড়িয়েই চা খাচ্ছিলাম। কিছুক্ষন পর ট্রেন চলে গেলো। বেড়িকেড উঠে গেলে থেমে থাকা গাড়িগুলো চলে যেতে লাগলো। এরপর আমার নজর পড়লো একটি মেয়ের উপর, মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দর। আমি রুপ দেখছিলাম, এরই মধ্যে নজর পড়লো তার চোখের উপর, মায়াভরা চোখদুটো জ্বলে ভরে উঠেছে তার। ক্ষনে ক্ষনে তার চোখ বেয়ে জলের স্রোতধারা বইছে। সে তার মুলায়ম হাতে একটি টিস্যু ধরে রেখেছে যা দিয়ে বার বার চেষ্টা করে যাচ্ছে চোখের পানির আবছা দাগ পরিষ্কার করার।
সে ধীর পায়ে রেললাইনের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো উত্তরের দিকে। এত রাতে সেদিকে কোন মেয়ে যাবে কেন, আমার মাথায় প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো। সেদিকে বস্তির ছেলেরা নেশার আসর বসায়, জায়গাটা মোটেও সুবিধার নয়, কিন্তু আমার মনে বখাটে ছেলেপেলের চিন্তা থেকে যে চিন্তা বেশী মাথায় ঘুরছিলো, সে কাঁদছে তাহলে কি সে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। মনেতে প্রশ্নটা আসতেই আমি তার পিছু নিলাম, এক সময় সে রেললাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলো, আমি তাকে এড়িয়ে সামনে গেলাম, তখনো সে কাদছে। আমি আবার ধীর পায়ে হেটে তার পাশাপাশি দাড়ালাম তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ফেললাম, “মরতে এসেছেন। আমিও অনেকবার এসেছিলাম পারিনি, অনেক ভিতু কিনা তাই হয়ত।” সে আমার দিকে একবার তাকালো কোন কথা না বলে আবার সামনের দিকে হাটতে শুরু করলো।
আমিও তার পিছু ছাড়লাম না, তার পেছন পেছন যেতে বলতে লাগলাম, “ট্রেনে মরা খুবই সহজ এক ঝাটকায় মরে যাবেন, কোথাও মাথা ছিটকে পড়বে, কোথাও হাত পা, আর নারি ভুরি ট্রেনের নিচে এক মিশে যাবে, আপনি একদম বুঝতেই পারবেন না আপনি মরে গেছেন” এবারো সে কিছু বললো না সামনের দিকে হাটতে লাগলো। আমি খুব ভালো করেই জানি এই রাস্তায় আর এক ঘন্টার আগে কোন ট্রেন আসবে না, তাই এখনো তেমন জোর দেইনি। কিছুক্ষন হেটে যাবার পর আবার বলতে লাগলাম “গোলায় ফাসি দিয়েও মরা যায়, এতে দুই রকম ভাবে উপকার হয়, এক আপনি মরে গেলেন আর দুই আপনার চোখ দিয়ে কেউ নতুন ভাবে দুনিয়া দেখতে পারবে, হার্ট দিয়ে কেউ নতুন ধুকধুক শব্দ শুনতে পারবে, কিডনি দিয়ে একজন নতুন জীবন খুজে পাবে। তা ছাড়া কলিজা, লিভার সব কিছুতেই কারো না কারো জীবন বেচে থাকবে, আপনি একা মরে গিয়ে যদি আরো দশজন মানুষের জীবন বাচাতে পারেন তবে হয়ত আত্মহত্যার অপরাধে আল্লাহ আপনাকে জাহান্নাম না দিয়ে জান্নাত ও দিতে পারে। আর ট্রেনের নিচে মরলে সবকিছুই ভেস্তে যাবে, তাই আমার মন বলছে হয়ত গোলায় ফাসি দিয়েই মরা ভালো।” আমাত কথা শেষ হতে সে আমার দিকে তাকালো, আর খিলখিল করে হেসে উঠলো, মেয়েটির হাসিতে যেন এক যাদু আছে আমি অবাক হয়ে তার হাসি দেখছিলাম। হাসি থামিয়ে সে বলতে লাগলো, “আপনি কি আমাকে একটু কাদতে কাঁদতে মরতে দিবেন না?”
০- আপনি কাদলে মোটেও ভালো লাগেনা, হাসতে হাসতে মরে যান না, আমার দেখতে ভালো লাগবে।
— তার মানে আমি যদি হাসতে হাসতে মরি তবে আপনি খুশি।
০- হ্যা সেরকমই, তবে আরো ভালো লাগবে যদি একবার জানিয়ে দিতেন মরতে কেন চান।
— আপনাকে আমি চিনিনা জানিনা, আমি কেন আমার কথা আপনাকে বলবো?
০- এই রোড দিয়ে এখন কোন ট্রেন আসবে তা বলতে পারেন?
— না তা পারবো কি করে?
০- দেখুন কোন ট্রেনের নিচে আপনি মরতে যাচ্ছেন সেটা জানেন না, তারপরেও মরতে এসেছেন ট্রেনের নিচে আর আমাকে না চিনলে কথাগুলো কি বলা যায়না। তাছাড়া আপনি একবার মরে গেলে আমিও এই কথাটি ভুলে যাবো যেভাবে ট্রেন ভুলে যাবে তার নিচে কেউ আত্মহুতি দিয়েছিলো।
— বুঝতে পেরেছি আপনি আমার কথা না শুনে ক্ষ্যান্ত হবেন না।
মেয়েটি কিছুক্ষন চুপ করে রইলো, তারপর রেললাইন এর উপর বসে পড়লো, আমি তার থেকে খানিকটা ব্যবধান রেখে বসলাম। এখন সে বলতে লাগলো, “গত তিন বছর ধরে আমার একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো, তার সাথে আমার বিয়ে ছাড়া সব কিছুই হয়েছে, যার কারনে আমি এখন গর্ভবতী হয়ে পড়েছি। এখন সে আমাকে বিয়ে করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আর আমি আমার গর্ভের নিষ্পাপ সন্তানকে হত্যা করতে পারছিনা, আর সমাজের কাউকেও জানাতে পারছিনা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমিই আমার জীবন শেষ করে দিবো। ভালোবাসায় প্রতারনার শিকার হয়ে যে কষ্ট বুকেতে রয়েছে, তার থেকে দ্বিগুন কষ্ট আমার মত নষ্টা মেয়েকে সমাজ কোনদিন মেনে নিবে না। এটাই কারন।
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনলাম, তারপর তাকে বললাম, আপনি তাহলে আপনার গর্ভের সন্তান কে খুন করতেছেন আর নিজেও আত্মহত্যা করছেন তাইতো। সে আমার কথায় সায় দিয়ে শুধু “হুম” বললো। আমিমি আবার বলতে লাগলাম, আচ্ছা আপনি কি সন্তানটাকে জন্ম দেওয়ার পরে মরতে পারেন না। তাকে জন্ম দিয়ে আমার কাছে দিয়ে যাবেন, তারপর না হয় আপনি আত্মহত্যা করলেন, আমি তাকে মানুষ করলাম। সে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো, তারপর বলতে লাগলো এটা কি সম্ভব নাকি?
— হ্যা এটা সম্ভব, হাসপাতালে আপনার স্বামীর নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দিলেন তাহলেই হলো। সন্তান আমার কাছে আসা মাত্রই আপনি মুক্তি তখন মরে যাইয়েন।
সে কি যেন ভাবলো, তারপর বলতে লাগলো, এত সহজ না বিষয়টা আমার বাবা একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সে হাসপাতালে গেলে কোন না কোন ভাবে সবাই জেনে যাবে। তখন আমি একটু থমকে রইলাম, পরে বলতে লাগলাম, তাহলে ঢাকার বাহিরে গিয়েও তো করা যেতে পারে সেখানে আপনার বাবাকে কেউ চিনবে না। আমার কথা শুনে কোন এক ভাবনায় ডুবে গেলো, তারপর বললো কিন্তু যাবো কোথায়?
০- আমার এক পরিচিত আপা আছে যে গাজীপুর থাকে আপনি চাইলে সেখানে গিয়েও থাকতে পারবেন।
— সে কি রাজী হবে?
০- আমি বললে সে কখনোই ফিরিয়ে দিবে না।
— আপনি সিউর তো?
০- ৩০০% সিউর আমি।
ঠিক আছে তাহলে আমি এই বাচ্চাটাকে জন্ম দিয়ে তারপর মরবো। কথাটি বলে সে হাটতে লাগলো। আমিও তার সাথে সাথে হাটতে লাগলাম। আবার সেই লেভেল ক্রসিং এর সামনে আসতেই বেল বাজতে শুরু করলো, ট্রেন আসবে। কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ শুনতে পেলাম। ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে সবে ঢাকায় ফিরেছে, আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসিতে বলতে লাগলাম, আজকে মরলে আপনি চট্টগ্রামের ট্রেনে মরতে পারতেন। আমার কথা শুনে সে হেসে দিলো। হাটতে হাটতে তার নাম জেনে নিলাম। মেয়েটির নাম ফারিয়া। আমার কাছে সে মোবাইল নাম্বার চাইলে আমি তা দিতে পারলাম না, কারন আমার মোবাইল ছিলো না। তাই আমি যে হোটেল এ কাজ করি তার ঠিকানা দিয়ে তাকে রিক্সায় তুলে দিলাম।
ফারিয়াকে বিদায় দিয়ে আমি আমার বস্তির দিকে রওনা হলাম। ফারিয়া কে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে সরিয়ে আনতে পেরে আমার মাথার বোঝাটা হালকা হয়ে গেছে। আমার জন্য এই রেললাইনের পথেই কোন এক নাম না জানা ট্রেনের নিচে আত্মহুতি দিয়েছিলো শায়লা নামের মেয়েটি। আজ ফারিয়াকে যেভাবে বাচিয়েছি সেভাবে যদি শায়লা কে বাচাতে পারতাম তাহলে আমি হয়ত আরেকটু সুখ পেতাম।
শাহেদ ভাইয়ের হোটেলে কাজ করার প্রায় ৯ বছর পরের ঘটনা। রোজ আমাদের দোকানে বিকেল বেলা একটি মেয়ে আসতো। সে প্রতিদিন দুটো সিংগারা আর দুটো পুড়ি কিনে নিয়ে যেত। এই আইটেম ছাড়া তাকে আমি কখনো কিছু কিনতে দেখিনি। একদিন দুদিন তিনদিন চোখাচোখি তেই শায়লাকে আমার ভালো লেগেছে প্রতিদিন ঘড়ির কাটা পাচ এ এসে থামলেই আমার চোখ যেন চাতক পাখি হয়ে যেত। ছটফট করতো সেই মেয়েটিকে দেখার জন্য। মেয়েটির সাথে এখনো আমার কোন কথা হয়নি, কথা বলার সাহস ও পাচ্ছিনা। কিন্তু আজ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি যে করেই হোক আজ কথা বলবো। মেয়েটি যথাসময়ে হোটেলে আসলো আমি আগেই তার জন্য সিংগারা আর পুড়ি প্যাকেট এ ভরে রেখেছিলাম সে আসতেই আমি ছুটে গেলাম তার সামনে। বুকটা তখন আমার ১০০ এর স্পিডে ধুকধুক করছিলো, হৃদয় যেন বুক ফেটে বের হয়ে আসতে চায়। মৃদু ভয় আর এক রাশ আশা নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার নাম কি? মেয়েটি কেমন যেন বিরক্তির চোখে তাকালো, আমি ভয়ে চুপসে গেলাম, মুহুর্তেই আবার তার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে মুচকি হাসি হাসতে লাগলো, আর বলতে লাগলো, “নাম জেনে কি হবে আপনি সিংগারা পুড়ির মত করে নাম একটা দিলেই পারেন। ” মেয়েটির কথা শুনে তার দিকে এক নজরে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। মুখে কোন কথা বলতে পারলাম না, সে আবার বলতে লাগলো, “কি হলো কিছু বলছেন না কেন?
— না আসলে কি বলবো ভাবছিলাম।
০- বেশী ভাবতে হবে না। আমার নাম শায়লা, আমি গার্মেন্টস এ কাজ করি।
— ওহ আচ্ছা।
০- ঠিক আছে আজ তাহলে যাই আবার কাল কথা হবে।
আমি মুখে কোন কথা না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালাম। তারপরেই শায়লা চলে গেলো। শায়লার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন বাসার সামনে চলে আসলাম বুঝতেই পারলাম না। শায়লার কথা স্বরন হলেই আমি চোখের কোনে জলের আভাস পাই। চোখে হাত দিয়ে পানি মুছে বাসায় ঢুকে সোজা খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন ফারিয়া আমার দোকানে আসলো। একজন আরেক জনের সাথে কথা হতে লাগলো, সে কবে গাজীপুর যাবে সব বিষয় নিয়ে কথা হতে লাগলো। এখন প্রতিদিন ফারিয়ার সাথে আমার কথা হয়। সে একজন কাস্টমার সেজে দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে আর সুযোগ বুঝে কথা বলে। এভাবেই এক মাস কেটে গেলো আমাদের। সে তার গর্ভের সন্তানের অস্তিত্ব বুঝতে শুরু করেছে, এখন তার ঢাকায় থাকা উচিত না বলে আমাকে জানালো। আমিও নাজমা আপার সাথে সব কথা বার্তা বলে তাকে গাজীপুর নেবার ব্যবস্থা করলাম।
আগামী সপ্তাহে ফারিয়াকে নিয়ে গাজীপুর যাবো। তাকে সেখানে রেখে আমি চলে আসবো। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি আর ফারিয়া গাজীপুর চলে গেলাম। তাকে নাজমা আপার কাছে রেখে চলে আসার সময় খুব খারাপ লাগছিলো। জানিনা এ খারাপ লাগার কারন কি ছিলো ফারিয়ার চোখেও আমি খারাপ লাগার আভাস দেখতে পেলাম। কিন্তু এই নির্মম পরিস্থিতির কাছে আমরা সত্যিই অসহায় ছিলাম।
ফারিয়া আমার জন্য একটি মোবাইল এনেছিলো যেন আমি তার সাথে কথা বলতে পারি। সে যখন আমাকে মোবাইল টি দিলো, আমার আনন্দ মোবাইল পেয়ে নয়, তার সাথে কথা হবে এটা ভেবেই আনন্দিত হয়েছিলাম। দেখা না হলেও মুঠোফোনে দুজনের কথা হবে ভাবতেই ভালো লাগছিলো। সেই ভালো লাগার আবেশ কে সাথে নিয়েই ঢাকার পথে পা বাড়ালাম। ঢাকা আসার পথেই ফারিয়া কয়েকবার ফোন করেছে। অল্প স্বল্প কথা বলে ফোন কেটে দিতো আবার পরে ফোন দিতো।
দেখতে দেখতে আরো কয়েকমাস কেটে গেলো, এর মধ্যে ফারিয়ার সাথে দু একবার দেখা হয়েছে। আর আমাদের কথা এখন মুঠোফোনেই হয়ে থাকে। এখন ফারিয়ার জন্য আমার বেশ চিন্তা হতে লাগলো। তার ডেলিভারী তারিখ খুবই নিকটে এই মাসের যেকোন সময় সে সন্তান জন্ম দিবে।
একদিন সকালে নাজমা আপা ফোন দিয়ে বললো ফারিয়ার শরীর অনেক খারাপ হয়েছে আমি যেন গাজীপুর চলে আসি। নাজমা আপার কথা শুনে শাহেদ ভাইকে জানিয়েই আমি গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মাঝপথে কয়েকবার নাজমা আপার সাথে কথা হয়েছে কিন্তু ফারিয়ার সাথে কথা হয়নি। মাথায় এক চিন্তা আর মনেতে ভয় বসে রয়েছে। যেমন তেমন করে গাজীপুর পৌছালাম। আপার থেকে হাসপাতালের ঠিকানা জেনে নিয়ে সেখানে গেলাম, শুনলাম ফারিয়া এখনো অজ্ঞান হয়ে আছে। সে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা ফারিয়া সুস্থ আছে যে কোন সময় তার জ্ঞান ফিরে আসবে। কেন জানি খুব আননন্দ লাগছিলো মনের ভিতর। আসল বাবা না হলেও এই শিশু মেয়েটি এক সময় আমাকে বাবা বলে ডাকবে ভাবতেই মনেতে আনন্দ বয়ে যায়। আমি ফারিয়ার মেয়েকে দেখতে গেলাম। তাকে দেখে মনেতে শায়লার কথা মনে পড়ে গেলো শায়লা এমন একটি মেয়ের মা হতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে পারেনি তার রাগ আর অভিমান কে মানিয়ে নিতে, চলে গেছে অনেক দূরে। সেই থেকে আমিও প্রতিজ্ঞা করেছি কোনদিন কাউকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখবো না আর বিয়েও করবো না।
আমি ফারিয়ার মেয়েকে কোলে নিয়ে কয়েকটা চুমু দিলাম। তারপর আবার দোলনা তে রেখে দিলাম। এরই মধ্যে ফারিয়ার জ্ঞান ফিরেছে। সে তার মেয়েকে দেখার জন্য বেকুল হয়ে গেছে। মেয়েকে বুকে পেয়ে ফারিয়া যেন নতুন এক পৃথিবী কে পেলো। একের পর এক চুমু দিয়ে গেলো সে, পরে যখন শিশু বাচ্চাটি কেঁদে উঠলো ফারিয়ার তার বুকের কাপড় সরিয়ে শিশুটিকে দুধ খাওয়াতে লাগলো। অমনি শিশু মেয়েটির কান্না থেমে গেলো।
আমি এমন মা মেয়ের টান দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো, আমার মাও হয়ত আমি কান্না করলে এভাবে বুকের দুধ খাইয়ে আমার কান্না থামাতো। চোখের মাঝে গরম গরম ভাব অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম আমি এখনি চোখের জল ছেড়ে দিতে পারি। তাই যত্রতত্র করে চলে গেলাম ওয়াশরুম এ।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে, আমি অপেক্ষাগার রুমে গিয়ে বসলাম। সেখানে বসতেই শায়লার স্মৃতি আবার মাথা নাড়া দিয়ে উঠলো। সেদিনের পর থেকে শায়লার সাথে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগলো। শায়লা আমার জীবনের প্রথম প্রেমের আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। আমাদের দুইই গরীবের প্রেমে সুখের অভাব ছিলোনা। কিন্তু একটু ভুল বোঝাবুঝি তে শায়লা আমাকে ছেড়ে চিরদিনের মত চলে গেলো।
আমার মনে আছে সেদিন শুক্রবার, আমি কাজ শেষ করেছিলাম দুপুরের মধ্যেই। বাসায় হেটে যাচ্ছিলাম। তখন আমি শায়লাকে আসতে দেখলাম, সে একটি ছেলের হাত ধরে হেটে আসতেছে, এই দৃশ্যটি দেখেই বুকের মাঝে যন্ত্রনা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। আমি শায়লার পথ আকড়ে দাড়ালাম, আমাকে দেখে শায়লা ছেলেটির হাত ছাড়িয়ে নিলো। আমার চোখ জলছে রাগে এবং কষ্টে চোখ হয়ত জোয়ালামুখীর মত অগ্নিগিরি হয়ে ঝড়ে পড়বে। তখন শায়লা আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো, আমি সে কথা না শুনে তাকে চড় বসিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। আর বলে দিলাম সে যেন কোনদিন আমাকে তার মুখ না দেখায়।
তারপর শায়লা আমাকে অনেকবার মানাতে চেয়েছে কিন্তু আমার রাগের কাছে তার মিনতি হার মানতে বাধ্য হয়েছে। তখন আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাদের বস্তিতেই ফাতেমা নামের একটি মেয়ে ছিলো তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেদিন শায়লা এই কথা জানতে পারলো, সেদিনেই সে আত্মহুতি দিলো প্রেমের নামে এই রেললাইন ট্রেনের নিচে। পরে তার একটি চিঠি আমার হাতে এসেছিলো, যে চিঠিতে সারা শব্দ জুড়ে প্রকাশ পেয়েছে সে আমাকে শুধু আমাকেই ভালোবাসে। আর সে আমাকে অন্যের হতে দেখতে পারবে না তাই সে চলে গেলো অনেক দূরে।
ফারিয়া কে বাসায় নিয়ে আসা হলো। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী সন্তান কে অন্তত ছয় মাস মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, তাই ফারিয়ার আত্মহত্যার তারিখ আরো ছয় মাস পেছনে গেলো। আমার তারিখ পিছিয়ে যাওয়াতে আমি ফারিয়ার চোখে ক্ষোভ বা অভিমান দেখিনি দেখেছি আনন্দিত হবার উচ্ছাস।
ফারিয়া তার সন্তানের খুব যত্ন নিতে লাগলো নাজমা আপার বাসা থেকেই। দেখতে দেখতে পাচ মাস কেটে গেলো। আমি তার কাছে গিয়ে মরলাম, “আর এক মাস পর তুমি মরে যাবে তোমার মনের আশা পুরন করে নাও। তখন ফারিয়া আমার দিকে রাগ চোখে তাকালো আর বলতে লাগলো “আমি কেন মরবো তুমি মরে যাও, আমি আমার মেয়েকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা। ” আমি মৃদু হাসি দিয়ে বললাম, “মেয়েতো আমার আর আমাদের চুক্তির কথা ভুলে গেছো”
— চুক্তির খেতা পুড়ি আমি, আমি মরতে চাইনা আর এবার বাচতে চাই নতুন করে।
আমি আর কোন কথা বললাম না, মুচকি হাসি নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম। কিন্তু একটু খারাপ লাগছিলো মেয়েটি কখনো আমাকে বাবা ডাকবে না এইভেবে।
কয়েকদিন পর ফারিয়া সিদ্ধান্ত নিলো সে বাড়ি ফিরবে তার মেয়েকে নিয়ে। আমি আর ফারিয়া তার বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে ঢুকতেই ফারিয়ার উপর ঝর এসে পড়লো। সবাই তাকে অপমানজনক কথা বলতে লাগলো, এই সন্তানের বাবা কে যখন সবাই জানতে চাইলো ফারিয়া আমার নাম বলে দিলো। সবাই আমাকে ঘৃনার চোখেই দেখলো, ফারিয়ার মত এত বিত্তশালী মেয়ে কি করে একজন হোটেল বেয়ারার সাথে, ছিঃ ছিঃ করতে লাগলো সবাই। ফারিয়া আর অপেক্ষা না করে আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।
বাহিরে এসে ফারিয়া আমাকে বললো, “আমি অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি তোমাকে বিয়ে করবো। তাছাড়া আমি তোমাকে ভালোবেসেও ফেলেছি, জানি তুমি আমার মত মেয়েকে কখনো আপন করবে না, আমি জোর ও করবো না। আমাকে একটু থাকার ব্যবস্থা করে দাও, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোনভাবে জীবন চালাবো এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।
ফারিয়ার কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাছাড়া আমিও ফারিয়াকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু এভাবে সব হবে বুঝতে পারিনি, জানিনা আমি কি করে আমার প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলাম, এবং ফারিয়াকে জীবন সংগী করতে রাজী হলাম।
পরের দিনেই আমরা বিয়ে করলাম এবং নতুন জীবন শুরু করলাম। কিন্তু ফারিয়া আমাকে হোটেলে কাজ করতে দেয়নি, আমি পড়ালেখা জানতাম না কিন্তু ফারিয়া অনেক শিক্ষিত ছিলো। সে একটি দোকান ভাড়া নিলো এবং মুদি দোকান দিলো এই টাকা সে তার গহনা বিক্রি করে গুছিয়েছিলো। আমাকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি করালো। এবং সে নিজে পড়াতে লাগলো। বছর পাচের ভিতর আমি শিক্ষায় কম বেশী এগিয়ে গেলাম। এই পাচ বছরে আমাদের চারটি দোকান হয়েছে, সেখানে কর্মচারীও অনেক আছে। ধীরে ব্যবসা শিক্ষায় সব দিকেই এগিয়ে যেতে লাগলাম এখন এই তেজগাঁও এলাকায় আমাদের দুজনের অসংখ্য দোকান রয়েছে কাওরান বাজারেও আছে পাইকারি দোকান।
সেখান থেকে আমার ডায়রী লেখার সখ হয়েছে, আমি কখনো ফারিয়াকে শায়লার কথা বলিনি। কিন্তু আমি লিখেছিলাম তা ডায়রীতে। ফারিয়া সেই ডায়রী পড়েই জেনেছে আমার অনেক গোপন কথা যেগুলো জানার পর ফারিয়া বুঝতে পারছিলো আমি সত্যিই ভিতর থেকে ভালো নেই। আজও শায়লার সেই দুর্বিষহ স্মৃতি আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়।
বারান্দায় দাড়িয়েই সব ইতিহাস এক পলকে দেখে যেতে লাগলাম। আমার জ্বালানো সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। কখন যে ফারিয়া পেছনে এসে দাড়িয়েছে বলতে পারবো না। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো “তুমি কি ভালো আছো?” কথাটি শুনে দশ সেকেন্ড চুপ করে রইলাম আর ভাবলাম, এমন স্ত্রী এমন ভালোবাসার মানুষ কাছে থাকতেও যদি আমি ভালো না থাকি তবে পৃথিবীর কোন পুরুষ ভালো থাকবে?
আমি ফারিয়াকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলাম। কপালে একটি চুমু দিয়ে বললাম, হ্যা আমি অনেক ভালো আছি।।