নীলুর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো কোন এক ঘুরি ঘুরি বৃষ্টির দিনে। আমি অবশ্য নিশ্চিত না যে সেই দিন বৃষ্টি হচ্ছিলো। কথাটা নীলু নিজেই বলতো। প্রতিবছরের একটা দিন আমাদের মধ্যে এই বিষয় টা নিয়ে নানা মতভেদের সৃষ্টি হতো। আমিও নীলুর কথা মেনে নিতাম বাধ্য ছেলের মত। আমি যথাযথই ভোলামোনা একটা ছেলে, অন্য দিকে নীলু বেশ বুদ্ধিমান। সারাদিন বইয়ের সামনে বসে থাকতে থাকতে অল্প বয়সেই চশমার সাহায্য নিতে হয়েছে। চেহারার তিন ভাগের একভাগ চশমার কালো ফ্রেমেই ঢাকা থাকে। নাহ্ এই ১০ বছরে সরাসরি অবশ্য ওর চোখের দিকে খুব একটা তাকানোর সাহস হয় নি। ওর সাথে কথা বলার সময় মাটির দিকেই থাকিয়ে থাকি। একটু ভীতু না না একটু নাহ্ একটু বেশিই ভীতু। ওর চোখের দিকে তাকানোটা হাতে গোনা।
ও যখন অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতো চুপটি করে ওকে দেখে নিতাম আবার আমার দিকে তাকাতেই চোখটা সরিয়ে নিতাম। আমার এই লুকোচুরিতে একটা মৃদু হাসি দিতে যা মাটির মাটি তাকিয়েও টের পেতাম। মেয়েটার একটা বিশেষত্ব টের পেতাম সেটা হলো একটু বেশিই তারাতারি কথা শেষ করা। ওর কথাটা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। একটু চুপ করে থাকলেই চোখের সামনে দুই আঙ্গুলের তুরি মরে বলতো-
“এই যে নীল সাহেব বোবা হয়ে গেলেন নাকি?”
“ওম কই নাতো আমি তো শুনছি।”
“শুধু কি শুনলেই হবে? কথা বলতে হবে না?”
“হুমমম তবে তোমার কথা শুনছি।”
“ভালো লাগে?”
ওর প্রশ্ন শুনে খানিকটা অবাক হতাম তারপর বলতাম-
“হুমম।”
“শুধু কি শুনলেই হবে? আমার বুঝি নীল সাহেবের কথা শুনতে ইচ্ছা করে না?”
“কি বলবো?” বোকার মতই প্রশ্নটা করে ফেলতাম।
“কিছু না বলেন সেটা কোন সমস্যা না কিন্তু যখন আমার কাছে আসেন কাধে করে গিটারটা তো আনতে পারেন নাকি? নাকি সেটাও খুব ভারী লাগে? ”
“নাহ্। আসলে…”
কথাটা শেষ করতে দিতো না কারন নীলু জানতো বরাবরের মত একই কথা বলবো যে গিটারের একটা তার কাটা। কিন্তু নীলু জানতো কথাটা সত্যি নয়। “আচ্ছা গিটারের তারটা কবে ঠিক হবে?” বলেই ফিক করে একটা হাসি দিতো।
কোন উওর না দিয়ে চুপ করে থাকতাম। শেষ বার গিটার এনেছিলাম যখন নীলুর ২৪ তম জন্মদিন ছিলো। এখন নীলুর বয়স প্রায় ২৭। বয়সের একটা বড় ফারাক আমার আর নীলু মধ্যে। প্রায় ৪ বছরের। বয়সের দিক দিয়ে এবং ভালোবাসার দিক দিয়েও নীলুর এগিয়ে। অনেক বার চেষ্টা করেছি ভালোবাসার দিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু বার বারই ব্যর্থ। তবুও আমাকে জিতিয়ে দিয়ে নিজে হেরে যাওয়াও নীলুর ভালোবাসার আরেকটা জয়। বুঝতাম কখনোই পাল্লা দিতে পারবো না।
“কি এখনো বসে থাকবেন নাকি উঠবেন?”
ওর কথা শুনে ওর দিকে না তাকিয়ে পশ্চিমাকাশের দিকে তাকানো আমার প্রতিবারের রুটিন। বরাবরের মত আজও সূর্যটা লাল আকার ধারন করেছে।
বিয়েটা কয়েক বছর আগেই হয়ে গেলেও পারতো। প্রথম যখন আমাদের সম্পর্কটা শুরু হয় তখন নীলুকে বিয়ে এবং ওকে চালানোর দুইটার মধ্যে কোন ক্ষমতায় আমার ছিলো না। কিন্তু ২২ কোটায় পা দিতেই একটা চাকরির নাগাল পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু নীলু রাজি হয় নি বিয়েতে। কারণ তার ইচ্ছা সম্পর্কের এক যুগ পূর্ন যেইদিন হবে ঠিক তার ১ দিন পর বিয়েটা হবে। আমিও বাধ্য ছেলের মত মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম আমার কথার দামটা নীলু দিবে না এটাও ভালোবাসার আরেকটা দিক। এই ১০ বছরে কয়েক ডজন ঘটককে বাড়ির সদর দুয়ার থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। তেমন টি আমিও।
হাঁটছি উদ্দেশ্য আমি বাসে উঠে বাসার দিকে আর পাশের গলিটা দিয়ে নীলু তার বাসার দিকে। পাশাপাশি তবেও একহাত ফাকা মাঝখানে। অন্য সব যুগলদের মত হাতে হাত রেখে না। হুমম নীলুই মাঝে মাঝে হাতটা ধরে আবার কেন যেন ছেড়েও দেয়। হঠাৎই নীলু একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-
“আবারও কালো শার্ট?”
ওর প্রশ্নটা শুনে একটু হেসে দিলাম। এই হাসিতেই নীলুর প্রশ্নের উওর খুজে নিলো। “এই দিয়ে কতটা হলো?”
“বেশি না ১৭ টা।” সাথে সাথেই উওর দিলাম।
“এটা বেশি না? তুমি জানো আমার বাবা সেই দিন কি বলেছে?”
বাবার কথা শুনে একটু আটকে গেলাম তারপর বললাম, “কি?”
“বলেছে তুমি নাকি একটা শার্টই পড়ে আসো।” বলেই হেসে দিলো। এটা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু না।
কলেজে যখন যেতাম তখন একটা মেডাম বলতো,
-“নীল শোন।”
– জ্বি মেডাম।
– একিই শার্ট প্রতিদিন পড়ে আসো কেন? এটা কি তোমার খুব পছন্দের?
উওরটা আমার দিতে হয় নি নীলুই পাশ থেকে বলে দিয়েছিল… “মেডাম নীল সাহেবের একটা না একি রকম ৫ টা।”
মেডাম কথাটা শুনে হাসেছিলো। নীলু কিছু বলতেই আগে নীল সাহেব যোগ করে নিতো। শুনতে বেশ ভালোই লাগতো। চায়ের টোংয়ের কাছে আসতেই মোয়াজ্জিমের আজন কানে ভেসে আসলো। সামনের গলি দিয়ে দুই বাড়ি পার হলেই নীলুর বাসা। চলে যাবে এমনি সময় পিছনে তাকালো চোখে একটা প্রশ্ন প্রতিবারের মত এই সময়টা করে। আজকে প্রশ্নটা না শুনেই বললাম-
“এইবার নিয়ে আসবো।”
উওরটা শুনে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। দুইটা বাড়ি পার হয়েই পিছনে থাকালো। একটু থমকে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারা দিয়ে ডাকলো। আগপাছ না দেখেই গলির ভিতরে ডুকে গেলাম। কাছে যেতেই বরাবরের মত কানের কাছে মুখটা আনলো, ফিসফিস করে বললো-
“ভালোবাসি নীল সাহেব।” বলেই বাড়ির ভিতরটাতে গেলো।
আজকেও উওর শুনার অপেক্ষা করলো না। ঠিক যেমন টা স্কুলে থাকতেও করে নি। যখন আমি সবে ১৩।
স্কুল এন্ড কলেজের ১০ এ। প্রতিবারের মত কবিতাপাঠের আয়োজন করা হয়েছে। বড় একটা হল রুমে ২০০ জনের সমবেশ। নিজের লেখা কবিতা পাঠে আমি ব্যস্ত। মঞ্চ থেকে নামতেই একটা চশমা চোখে দেওয়া মেয়ে এসে বললো- “এই পিচ্চি ছেলে তোমার চোখ দুটো আমাকে দিবে? ”
কথা টা শুনেই তাকালাম মুখের দিকে সেইদিনই ভালো ভাবে তাকিয়েছিলাম ওর মুখের দিকে।
“এই পিচ্চি ওমন করে তাকাও কেন? লজ্জা করে না?”
চোখটা নামিয়ে নিয়েছিলাম সেইদিন।
“বাব্বা লজ্জাও আছে দেখছি, সে যাই থাক চোখ দুটো কিন্তু আমার চাই, আর সাথে তোমার কবিতা।”
কোন কথা না বলেই চলে এসেছিলাম। ক্লাস করা অবস্থায় পাশের সিটের বন্ধুটা বলেছিলো, অধরা আপু ডেকেছে বলেই হাত দিয়ে সেই মেয়েটিকে দেখিয়ে দিয়েছিলো।
ক্লাস শেষে যেতেই বলেছিলো,
“নাম কি?”
“জ্বি নীল।”
“আমার নাম নীলু।”
“কিন্তু ও যে বললো অধরা? ”
“হুমমমম আগে ছিলো এখন নীলু তোমার নামের সাথে মিলিয়ে।”
“জ্বি।”
” মনে থাকবে? বলো তো কি নাম?”
“জ্বি নীলু।”
“এই সম্মান দিচ্ছো না কেন? আমি কিন্তু তোমার ১ ব্যাচ এগিয়ে।”
“সরি আপু”
“হুমমমম এখন আপুই বলো তবে ২ বছর পর নীলু বলতে পারবে।” সেইদিনের কথাটার মানে বুঝেছিলাম না। সেইদিনই কালো ডাইরিটা নিয়েছিলো সেটা আজও নীলুর কাছেই আছে। ২ বছর পিছিয়ে গেলো নীলু। সেইদিনের পর আর বেশি কথা হয় নি। মাঝখানে অনেক দিন দেখাও মিলে নি। ইন্টার ১ম বর্ষে প্রথম ক্লাশেই দেখলাম নীলু সামনের সিটে বসা। পরে জানতে পারি ২ বছর নষ্ট করেছে লেখাপড়ার জীবন থেকে। তখন নীলু বলেই ডাকতাম।
একদিন কানে কানে বললো, “এই যে নীল সাহেব সেই প্রথম দিন থেকেই ভালোবাসি”
সেইদিন উওর দিতে পারি নি তার আগেই বললো, আজ না ঠিক ১২ বছর ১ দিন পর উওর টা নিবো। তারপরই এতোটা বছর কেটে গেলো। শার্টের ১৭টাই কালো আর বাদবাকী ১০টা নীল আর সাদা। এই দশটা নীলুর দেওয়া প্রতিবছরে একটা করে। রুমে এসে আগের নীলুর নয়টা শার্টের সাথে এটাও রেখে দিলাম।
কেটে গেলো আরও দুই বছর। সাথে আলমারিতে একটা নীল আরেক টা সাদা শার্ট যোগ হয়েছে।
বাড়ি জুড়ে বিয়ের আমেজে মেতে আছে সবাই। নীলুকে নিয়ে আসলাম বউ করে। বাসর ঘরে একটু দেরিতেই গেলাম গিয়ে দেখি মেয়েটার হাতে গিটার, সাথে একটা কালো শার্ট না এটা হাতে না গায়ে দিয়ে আছে। রুমে যেতেই আমার দিকে আরেকটা কালো শার্ট এগিয়ে দিয়ে বললো, “নীল সাহেব আজকে এটা পড়ে নিন।”
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। চলুন এবার সারারাতে পাওনা মিটিয়ে দিবেন। এক হাতে আমার হাত অন্য হাতে গিটারটা।
ছাদের উপরে এসে বললো, “গিটার বাজান, আর সুরে সুরে ভালোবাসি বলেন।”
গিটারটা হাত থেকে নিয়ে কানের কাছে গিয়ে বললাম, “এই বারো বছরে যা বলতে পারি নি আজ সেটা বলবো। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।”