রাত প্রায় দশটা বাজে। তবুও এখনই ঘুমিয়ে গেছে সুমাইয়া। ঘুমানোর অবশ্য কারণ আছে। প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় জায়েদ ওর জন্য কিছু না কিছু নিয়েই আসে। অথচ আজ খালি হাতে এসেছে। খালি হাত দেখেই গাল ফুলিয়ে বসে ছিলো সুমাইয়া। এই দেখে জায়েদ অবশ্য বলেছিলো যে কাজের চাপে আসার সময় কিছু আনার কথা ভুলে গেছে। মাফও চেয়েছিলো। তবুও সুমাইয়া মুখ গোমরা করে বসেছিলো। জায়েদ সুমাইয়ার রাগ না ভাঙিয়েই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে টিভি দেখতে বসে যায়। আর এতে আরও রেগে না খেয়েই শুয়ে পড়ে সুমাইয়া। তারপর ঘুমিয়ে যায়।
দশটা চল্লিশ বাজে প্রায়।
জায়েদ রুমে এসে দেখে দেখে সুমাইয়া এলোমেলো ভাবেই শুয়ে আছে। মিটমিটিয়ে হাসে জায়েদ। তারপর সুমাইয়াকে পাজকোলা করেই বাইরে নিয়ে আসে। রিক্সা আগে থেকেই রেডি হয়েই ছিলো গেটে। জায়েদ সুমাইয়াকে নিয়ে উঠতেই ড্রাইভার চালাতে শুরু করলো। অনেক সুন্দর জোছনা রাত। আকাশ একদম পরিষ্কার। এই শহরটা তেমন জনবহুল না থাকায় এই রাতেই লোকজন অনেক কম। পিচঢালা হাইওয়ে দিয়ে চাঁদের রুপালী আলোয় এগুচ্ছে রিক্সা। সুমাইয়ার ঘুম অনেক গাঢ়। এখনো ভাঙেই নি। জায়েদের কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে আছে ও। হালকা বাতাসে ওর চুলগুলো বারবারই জায়েদের মুখে এসে ঝাপটা দিচ্ছে। এতে বিরক্ত না হয়ে আরও ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে জায়েদ।
প্রায় এক ঘন্টার পথ পাড়ি দেয়ার পর রিক্সাটি শহর ছেড়ে একটা নির্জন লোকালয়ে এসে থামে। রিক্সা থামতেই জায়েদ বলে,
–মায়া, এই মায়া চোখ খুলো।(সুমাইয়াকে জায়েদ আদর করে সংক্ষেপে মায়া বলে ডাকে)
নড়েচড়ে আরও ভালো করে কাত হয়ে শোয় সুমাইয়া। জায়েদ আবার ডাক দেয়,
–এই মায়া ওঠো।
–উমমমমমমম……
–উমমম উমমমম না করে জলদি উঠো তো। বলেই সুমাইয়াকে ধরে ঝাকায় জায়েদ। আর ঘুম ভেঙে পিটপিট করে তাকায় সুমাইয়া। তারপর হাই তুলে বলে,
–এতো রাতে ডাকছো কেন?
–ভালো করে তাকিয়ে দেখো চারদিকে। বলেই মিটিমিটি হাসে জায়েদ।
জায়েদের কথা শুনে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সুমাইয়া।
–এটা কোথায়? আমি তো রুমে ছিলাম!
–হে হে৷
–কত সুন্দর চাঁদের আলো! আমরা কোথায় এখন? অবাক হয়ে সুমাইয়া বলে।
–চলো হাঁটি দু’জনে।
–এখন! এখানে?
–হ্যাঁ। এখানেই।
–চলো।
জায়েদ সুমাইয়ার হাত ধরে নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করে। কিছু পথ হাঁটার পরই আনন্দ আর অবাক হয়েই একটু জোরেই বলে সুমাইয়া,
–জায়েদ, এটা নদী! আমরা নদীর পাড়ে চলে এসেছি! দেখো নদীর পানিতে কি সুন্দর চাঁদের আলো পড়েছে।
জায়েদ কোনো কথা বলে না। শুধু মিটমিট করে হাসে। দু’জনে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। বালির ভিতর দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগছে সুমাইয়ার। কিছুদূর হাঁটার পর সুমাইয়া দেখে সামনেই একটা ছোট্ট ছাউনি ওয়ালা ডিঙি নৌকা বাঁধা। নৌকার ভেতরে অনেকগুলো হারিকেন নিবুনিবু করে জ্বলছে। নৌকা দেখেই সুমাইয়া জায়েদকে আবদারের সুরে বলে,
–এই, চলো না নৌকাতে উঠি।
–উঠবে? এত রাতে!
–তুমি তো আছোই। চলো না প্লিজ।
–আচ্ছা চলো।
জায়েদের কথায় বড্ড খুশি হয় সুমাইয়া। তারপর দৌড়ে ও নৌকার কাছে গিয়ে হতাশ হয়ে বলে,
–নৌকার মাঝি কই? আমাদের নিয়ে কে যাবে?
–এখন তাহলে কি করবো?
সুমাইয়া কোনো কথা বলে না। তবে মনটা খারাও করে ফেলে। এই দেখে জায়েদ বলে,
–মাঝি নেই তো কি। চলো আজ আমিই তোমাকে নিয়ে ঘুরবো।
–সত্যি বলছো!
–হ্যাঁ রে বাবা, সত্যি বলছি।
খুশিতে ফিক করে হেসে দেয় সুমাইয়া। জায়েদ হাত ধরে ওকে নিয়ে নৌকায় ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে নৌকা বাইতে থাকে। সুমাইয়া মুগ্ধ হয়ে নদীর পানিতে পড়া চাঁদের আলো দেখছে। বৈঠার ঢেউয়ে পানিতে চাঁদের আলোর যেন তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে।
জোছনা রাতের নদীর এত সুন্দর হয়! ভাবে সুমাইয়া। এক সময় নৌকাটা অনেকদূরে চলে আসে। জায়েদ বৈঠা রেখে সুমাইয়ার কাছে এসে বসে। তারপর বলে,
–পাগলি, চোখ টা বন্ধ করো তো।
–কেন- কেন? চোখ কেন বন্ধ করবো?
–আরে বাবা করোই না।
–না, আগে বলো কি করবে।
–ধাক্কা দেবো তোমায়। করো বলছি।
–তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো জায়েদ। এটা করতে পারবে না।
–তাহলে বন্ধ করো।
–আচ্ছা বাবা করলাম। এখন বলো।
–আমি না বলা অবধি চোখ খুলবে না কেমন?
–আচ্ছা ঠিক আছে।
জায়েদ এই সুযোগে ছউনির ভেতর গিয়ে প্যাকেট থেকে কেকটা বের করে সুন্দর করে সাজিয়ে চারদিকে মোমবাতি লাগিয়ে দিলো। তারপর বললো,
–এই যে মহারানী এবার চোখ খুলুন।
সুমাইয়া চোখ খুলেই অবাক। এই মাঝ নদীতে এত রাতে এভাবে!
–শুভ জন্মদিন পেয়ারি মায়া।
হাসতে হাসতে বললো জায়েদ।
–তুমি এসব! কবে, কি করে করলে?
–কেন খুশি হওনি?
–হই নি মানে! অনেক খুশি আমি। এই মাঝ নদীতে এত সুন্দর একটা সময়ে এভাবে তুমি আমার জন্মদিনের উইশ করবে আমি ভাবতেও পারি নি জায়েদ।
–তা এখন বুঝলে তো যে তোমার বরটা ভাবনার থেকে বেশিই করতে পারে।
সুমাইয়া জায়েদকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–সেটা কি বলতে।
–হয়েছে এবার কেক টা কাটো তো।
–হু কাটি।
সুমাইয়া ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিলো।তারপর কেক কাটলো। জায়েদ সুমাইয়াকে খাইয়ে দিলো।তারপর দু’জনে একে অপরকে মাখিয়ে দিয়ে অনেক মজা করলো।
সুমাইয়া কখনোই ভাবতেও পারে নি যে জায়েদ কখনও ওকে এত সুন্দর একটা রাত উপহার দেবে। এ রাতটা যে ওর জীবনের সব’চে সুন্দর একটা রাত।
রাত প্রায় তিনটা। পুরো শহর একদম চুপচাপ। জোছনা রাত। হাইওয়ে দিয়ে শুধুমাত্র একটি রিক্সাই হয়তো চলছে। জায়েদের হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে আছে সুমাইয়া৷ আর জায়েদ সুমাইয়ার খোলা চুলের অবাধ্য ঝাপটাতে নিজেকে বারবার হারাচ্ছে।
জায়েদের বুকে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ভাবছে সুমাইয়া,
জায়েদকে ভালোবেসে এতটুকুও ভুল করি নি। কত সুন্দর ভাবে আমাকে হাজার উপায়ে ভালোবাসে। এটাইতো সুখ।
ঘরে এসে মোবাইলটা হাতে নেয় সুমাইয়া৷ হোম বাটনে চাপ দিতেই সেই নাম্বার থেকে দেয়া মেসেজ টা চোখে পড়ে ওর। গত আট বছর ধরেই ওর জন্মদিনে এই নাম্বার থেকে এই মেসেজ টাই আসে। সুমাইয়া বিরক্তি নিয়ে প্রতিবারের মতোই মেসেজটা ডিলিট দিয়ে জায়েদের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়।
সেই অবহেলিত মেসেজ টায় লেখা ছিলো,
ছোট্ট একটা আকাশ,
দিলাম এক টুকরো নীল।
কালো মেঘের ভেলায় দিলাম,
কোমল শুভ্রঝিল।
সেই ঝিলেতে ভাসিয়ে দিলাম,
রঙিন যত দিন।
শুনতে কি পাও, বলছি তোমায়,