ফোনটা বাজছে।
আমার মোবাইল না , মায়ের মোবাইলটা।
কাছে গিয়ে নামটা দেখলাম কে ফোন দিয়েছে। এই নাম্বারটা আমার মোবাইলেও সেভ করা আছে, H.H. দিয়ে সেভ করা ।মানে জানেন কি ? হবু হাজবেন্ড! ওহো ! নামটা তো চেন্ঞ্জ করা দরকার আজ ।আজ থেকে তো আর হবু থাকছে না !আজই তো আমাদের বিয়ে !
ঠিক একমাস পাঁচ দিন আগে নিজেকে আবিষ্কার করলাম পাত্রপক্ষের সামনে ।ছেলে তখনো এসে পৌঁছেনি ।লজ্জ্বায় অবস্থা খারাপ আমার ।পাঁচ মিনিটের মাথায়ই উপরের ও নিচের পাটি মিলিয়ে বারোটা দাঁত বের করা হাসি মুখে নিয়ে পাত্রর আগমন ঘটলো ।লজ্জ্বায় তখন বেসম্ভব রকম খারাপ অবস্থা ।বারংবারং “ধরণী তুমি দ্বিধা হও,আমি তার মধ্যে প্রবেশ করি” বলার পরও খুব সম্ভবত বিল্ডিংটার কথা বিবেচনা করে নিচে থেকে কোন সাড়া পেলাম না ।অতঃপর মাথা নিচু করে চেয়ারেই বসে রইলাম আর মাঝে মাঝে টুকটাক কথার সাড়া দিচ্ছিলাম ।
সে আবার বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ।সবার সাথে কথা বলছে ।এরই মাঝে একটা লাইন কানে প্রবেশ করলো,”ছেলে মেয়ের তো একা কথা বলতে দেয়া উচিত্ ,নিজেদের ব্যাপার বুঝে নিক ।”এটা শুনে সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেরুদন্ডের কশেরুকার আর মাথার উপর-নিচ-উপর-নিচ মুভমেন্টের মাধ্যমে সাড়া দিলো আর আমার জান কেড়ে নিলো। আলাদা হলাম দুজন ।এবার সে আমাকে বাঁচিয়ে দিলো ।হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো,”এই আমার কার্ড ,যা বলার ফোন করে বলবেন ।”যাক !শান্তি !না হলে পিছনে দুই পক্ষের আত্মীয় স্বজন রেখে তার সাথে কথা বলতে হলে নিশ্চিত লজ্জ্বায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইন্ঞ্চি থেকে দুই তিন ইন্ঞ্চি খাটো হয়ে যেতাম আমি।
বাসায় এসে তো মর জ্বালা !ছেলের প্রশংসায় বাসা গমগমে অবস্থা !কি বেকায়দা! এতদিন তো যে প্রস্তাবই আসুক,বহুবিদ খুঁট বের করে সেটাকে আগেই একেবারে ধাক্কা দিয়ে বাবা মায়ের মাথা থেকে বের করে দিতাম।এই প্রথম পাত্রপক্ষের সামনে গেলাম ,ভেবে রেখেছি এসে একটা বিহিত করে ফেলবো ।কিন্তু এই ছেলের কি খুঁত বের করা যায় যখন সেই চিন্তায় মাথার নিউরনগুলোকে কাজ ভাগ করে দিতে যাবো ,ওমা !নিউরনেরা দেখি কেউ রাজি না এই ছেলের প্রব্লেম বের করতে ।নিজের মনকে এই ব্যাপারটা কি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলায় মন সোজা জানিয়ে দিলো ,”রাখো তোমার তদন্ত কমিটি !বাপ মায়ের মুখে হাসি দেখছো !না করবা ক্যান !সারা জীবন তো চিল্লায়া আসছো বাবা মা যা বলবে তা ই করবা ।তাইলে এখন সমস্যার কি দেখলা ?বাপ মা তোমার পিছে যেমনে আঠার মতো লাগছে আইজ হোক কাইল হোক ,বিয়ে তোমারে দিবোই !তাইলে এই ছেলে তো ভালোই !”এ কি বলে আমার মন !মনকে ফের জিজ্ঞেস করলাম ,”তাইলে রাজি হবো নাকি বিয়েতে ?”মন বলে ,”আবার জিগায় !”টাশকিত আমি !
পরদিন দুই পরিবারের পজিটিভ মত বিনিময় শেষ ।আমাকে যখনই কেউ জিজ্ঞেস করতে আসছে ,তখনই প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যেটাই হোক ,লাজুক ভাব মুখে এনে বলে দিয়েছি ,”বাবা মা যেটা বলবে আমি তাতেই রাজি !”ছেলে ঐদিকে বলল আমার সাথে একবার কথা বলে সব ফাইনাল করবে ।ফোন এলো কথা হলো প্রথম কথা ঘরের বাইরে বাকিদের উদ্বিগ্ন পায়চারী অতঃপর খানিক পরে রুমের দরজা খুলে যাওয়া সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি গলায় মালা পরার চূড়ান্ত মত প্রদান করা তার ঠিক আটদিনের মাথায় আমার আর্শীবাদ(এনগেজমেন্ট) হয়ে যাওয়া ।
এর মাঝে ওর সাথে আমার কথা হয়েছে খুবই কম ।আমরা প্রাগৌতিহাসিক পদ্ধতিতে কেউ কাউকে চেনা, জানা ,বোঝা সব বিয়ের পরের জন্য তুলে রেখেছি ।কথাও তাই সামান্যই হয়েছে ।তবে একদিন বের হয়েছিলাম দুজন ।একটা বিষয়ে একমত হয়েছিলাম যে বিয়ের আগের স্মৃতি বলতে কিছুই যে থাকছে না !একটাদিন অন্তত বের হই ।একটা দিনকে অনেক স্মরণীয় করে রাখি ।বাসায় মত নিয়ে অন্যরকম একটা অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় আমি দাঁড়াতেই পাশ কেটে একটা বাইক দুই হাত দূরে গিয়ে থেমেছিল ।বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন ,সত্যি কথা হলো সেই একদিনের পর তো তাকে আর দেখিনি, আমি চেহারাই ভুলে গেছিলাম ।সেও বোধহয় কনফিউজড ছিল,তাই সামনে দাঁড়িয়েও ফোন দিলো !বুঝেন অবস্থা !আমাদের নাকি তখন আর আঠারো দিন পরে বিয়ে !তারপর সেই বাইকে করে সারাটাদিন ঘুরে বেড়ানো ,লান্ঞ্চ ,নদীর পাড়ে একটুখানি নিজেদের চেনানো আর মন্দিরে গিয়ে একসাথে সব শুভ হবার প্রার্থনা করেছিলাম সেদিন ।
ফিরে আসি বর্তমানে ।মা ফোন রিসিভ করে তার হবু মেয়ের জামাই এর সাথে কথা বলছে ।কান পেতে আছি কয়টায় রওনা হবে এটা শুনতে ।ঐ পাশের মানুষটি কি জানে যে শুধু একটাদিন কাছ থেকে দেখে অথবা একটু ফোনে কথা বলেও এই বিয়ের সব আয়োজন ,আমাদের হিন্দু বিয়ের এতসব রীতি এই কদিনে যা আমাকে করতে হয়েছে তাকে নিয়ে আমার নতুন জীবনটা শুরু করার জন্য ,সেই প্রতিটা রীতিনীতি পালনের সময় তাকে নিয়ে যে অনুভূতি মনে উঠে এসেছে সেটা একত্রে জমাট বেঁধে বিয়ে নামক বন্ধনের আগেই ভালোবাসা নামক একটা বাঁধনে আলতো করে জড়িয়ে দিয়েছে ওকে আমার মনের সাথে !!!প্রতিটা সানাইয়ের শব্দ যে তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে !!!ঢাক-ঢোলের শব্দ যে আমার হৃদয়েও বাজছে ,তারও কি একই হাল ???
বিয়ের রাত ।বধূ সাজে বসে আছি ।আয়নায় বারবার দেখছি নিজেকে ।এ কি আমি !!!বিয়ের লাল শাড়ি, গহনা, মাথায় জড়ানো লাল ওড়না ,বিয়ের বাজনা ,নিমন্ত্রিতদের ভীড় ,উত্সাহ নিয়ে সবার কনে দেখতে আসা সব মিলিয়ে এত আবেগের সংমিশ্রণে বরং একটা শীতলতার আবেশ মন জুড়ে ।আজ শুধু আমাকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাস সবার মাঝে,আজ শুধু আমাকে ঘিরে উত্সবের দিন ।আজ শুধু আমার দিন ,ওহো না ,আমাদের দিন।
হঠাত্ বাজনা দ্বিগুন জোরে বাজতে লাগলো ।বুঝতে পারলাম বরপক্ষের আগমন হয়েছে ।এবার বরপক্ষের সবাই ঘিরে রাখলো আমায় ।এতদিনের চির পরিচিত দিদি ,মাসী ডাকের সাথে সাড়ম্বরে নতুন এসে জুটে গেলো বৌদি ,মামী ডাকের ফোয়ারা ।নিয়ে যাওয়া হলো বিয়ের আসরে আমায় ,পাত্র ইতোপূর্বেই উপবিষ্ট সেখানে ।চারদিকে দুইপক্ষের সব আত্মীয় স্বজনের উল্লাস !এক একবার মালা বদল আমার জীবনটাকে বদলে দিচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছি আমি ।মেয়ে থেকে বউ হয়ে যাচ্ছি ,হচ্ছি পূত্রবধূ ,বৌদি ।নতুন পরিচয়ে আবির্ভূত হচ্ছি ।শুভদৃষ্টিতে শুধু একটা পলক দৃষ্টি ফেলে লজ্জ্বায় মাথা নিচু করে ফেলেছিলাম ।অগ্নিকে সাক্ষ্মী করে যখন তার হাত ধরে সাতপাক ঘুরি ,ভিডিওর তারে পা জড়িয়ে হালকা হোচট খাওয়ার সময় ধরে রাখা হাতটা ও আরো শক্ত করে চেপে ধরেছিল ।তখন প্রথম মনে হলো সারাটা জীবন এভাবে আমাকে আগলে রাখতেই এই হাত ধরা শুরু আমাদের ,শুরু একসাথে পথ চলা ।সিঁথিতে যখন ও সিঁদুর রাঙিয়ে দিচ্ছিলো ,চোখ বন্ধ করে দৃঢ় করে নিচ্ছিলাম সিঁথির রঙটাকে জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাথার প্রতিজ্ঞা ।সাড়ে তিন ঘন্টা পর যখন বিয়ে শেষ হলো ,ওর পাশে এনে বসালো আমাকে ফটোসেশনের জন্য ,এত মানুষের মাঝে ঘাড়টা কাত করে আস্তে করে বললো ,”প্রথমবার ভালোবাসি বলার জন্য এর চেয়ে সুন্দর মূহুর্ত আর আসবে না ,তাই বলেই ফেলি মনের কথাটা-LOVE YOU সমা” ।ফুল ভলিউমে তখনো বাজছে,
“লাজে রাঙা হলো কনে বউ গো”