বৃদ্ধা আঙ্গুল

বৃদ্ধা আঙ্গুল

টিউশনি শেষ করে ৩য় তলা থেকে ২য় তলায় আসতে একটা হালকা মিউজিকের শব্দ আসলো। আর যে মিউজিকটা বাজচ্ছিল এটা আমার প্রিয় গানের তালিকায় প্রথম স্থানে আছে। “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখ, তোমার মনেরও মন্দিরে ” এই রবীন্দ্র সংগীতটাই। তাছাড়া মনে হচ্ছে ভিতরে কেউ নৃত্য করছে। আর রবীন্দ্র সংগীতের সাথে নৃত্য আমার খুব ভাল লাগে। ইচ্ছা হচ্ছিল একটু দেখার জন্য কিন্তু অপরিচিত বলে আমার ইচ্ছাটা পূরণ না করে নিচে চলে আসলাম।

নিচ তলায় আসতেই আমার সাইকেলের পাশে একটা লেডিস সাইকেল রাখা দেখে একটু অবাক হলাম। কারন আগে কখনো এমনটা ঘটে নি। এটা কার সাইকেল জানার ইচ্ছা না রেখে আমার সাইকেলটা বের করে আনতে গেলাম। কিন্তু লেডিস সাইকেলটা আমার সাইকেলের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো। আমি তারাতারি আমার সাইকেলটা বের করে লেডিস সাইকেলটা তুলে আগের জায়গায় রাখলাম। কিন্তু খেয়াল করলাম সাইকেলের বেলটা ভেঙ্গে গেছে। এখন তো পড়লাম মহা মুশকিলে। যদি এটা ঠিক না করি তাহলে যার সাইকেল সে খারাপ ভাববে। প্রথমে ভাবলাম চলেই যাই তারপর ভাবলাম অপেক্ষা করি কিন্তু আমার আরেকটা টিউশনিতে যেতে হবে। তখনই আমায় একটা বুদ্ধি আসলো। আমি আমার হাতের খাতা থেকে একটা কাগজ কেটে লেখলাম ” দুঃখিত আমার কারনে আপনার সাইকেলের বেল ভেঙ্গে গেল। দয়া করে রাস্তায় সাবধানে সাইকেল চালাবেন। ” এটা লিখে ভেঙ্গে যাওয়া বেলের সাথে কাগজটা লাগিয়ে দিয়ে আমি চলে গেলাম।

টিউশনি শেষ করে একটু ভার্সিটিতে আসলাম তবে উদ্দেশ্য ক্লাস করার নয় বরং লাইব্রেরী থেকে কিছু বই বাসায় নিয়ে যাবো বলে। কিছু দরকারী বই পছন্দ করে কাউন্টারে এসে দেখি একটা নতুন মেয়ে বসে আছে। আমিও বই গুলো নিয়ে গেলাম।আর আমি মেয়েটাকে বললাম….
— এই যে শুনছেন
— জ্বী বলুন।
— এই তিনটা বই বাসায় নিয়ে যেতে চাই।
— ও তাহলে আপনার ডিপার্টমেন্ট আইডি কার্ড ও লাইব্রেরী কার্ডটা দেখি।
— সরি আসলে আজ বাসা থেকে আনতে মনে নেই।
— কিন্তু আমি তো আপনার পরিচয় না জেনে বই দিতে পারি না।
— আসলে আমি এখান থেকে সব সময় বই নেই তো। আর আপনার আগে যে কাউন্টারে বসে ছিল ওনি আমায় চিনে।

— আগে যে বসতো ওনি আপনাকে চিনে কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না।
–দেখুন পরশু দিন আমার হাইড্রোলিক্স পরীক্ষা আর বইটা আজ নিয়ে যাওয়া আমার খুব প্রয়োজন।
— তবু আমি নিয়মের বাইরে কাউকে বই দিতে পারবো না।
— আচ্ছা ঠিক আছে।

আগের জায়গায় বই গুলো রেখে চলে আসলাম। এখন কি করা যায়? ভাবতে ভাবতে লাইব্রেরী ভবন থেকে বের হয়ে সাইকেল স্ট্যান্ডের কাছে আসলাম। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় যে সেই সকালের সাইকেলটা আমার পাশেই। কিন্তু বেলটা ঠিক করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আবার আরেক সমস্যা হয়ে গেল। আমি আমার সাইকেলটা নিতে গিয়ে আগের বারের মত ওর সাইকেলটা ফেলে দিলাম। কিন্তু তখন তো কেউ দেখে নি বরং এখন সাইকেল স্ট্যান্ডের দায়িত্বে থাকা লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।এবার চেয়ে দেখি ওর সাইকেলের প্যালেড পরে গেছে। আমি আগের বার মতই আমার খাতা থেকে একটা কাগজ কেটেঁ লেখে দিলাম ” আজ একটু কষ্ট করে হেটেঁ বাসায় যান আর মাফ করে দিবেন “। আমি কাগজটা প্যাডেলের সাথে লাগিয়ে দিয়ে আমার সাইকেল নিয়ে চলে আসলাম।

প্রায় দুইদিন পর আমার হাইড্রোলিক্স পরীক্ষা শেষ করে পরীক্ষার হলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। কারন অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। এমনিতেই আমি আজ লেট করে পরীক্ষা দিতে এসে ছিলাম। কিন্তু অনেকই পরীক্ষা দিয়ে চলে গেছে। আর বৃষ্টিটা শুরু হবে প্রায় ৫ মিনিট হলো।

আমার পাশে এসে একটা মেয়েও দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখি এইটা লাইব্রেরীর কাউন্টারে থাকা মেয়েটা। আমার দিকে অবশ্য তাকিয়েছে। আমি আমার পরীক্ষা ফাইল থেকে আমার আইডি কার্ড বের করে ওর মুখ বরাবর ধরলাম….

— এটা কি হচ্ছে?
— আপনার জন্য আজ আমার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?
— কেন আমি আপনার কি করলাম?
— গত পরশু দিন আমি লাইব্রেরী থেকে বই আনতে চাইলে আপনি আমার আইডি কার্ড দেখতে চেয়েছেন।কিন্তু তখন আমার সাথে না আইডি কার্ড ছিল না আর না লাইব্রেরী কার্ড ছিল। যদি একটু বিশ্বাস করে আমায় বইটা দিতেন তাহলে আজ আমার পরীক্ষাটা খারাপ হতো না।
— দেখেন ওইটা একটা নিয়ম ছিল যে কারো আইডি কার্ড এবং লাইব্রেরী কার্ড ছাড়া বই দেওয়া যাবে না।
— হুমম, আচ্ছা যাই হোক, আপনি এখন বাসায় যাবেন কেমন করে? বৃষ্টি তো কমার কোন লক্ষণ দেখছি না।
— এটাই ভাবছি। তাছাড়া এখন আমার বাসায় যাওয়াটা দরকার আর সাথে করে সাইকেলটাও আনি নি।
— এই যে ধরুন আমার ছাতা।
— কিন্তু আপনি যাবেন কি করে?
— আমি সাইকেলও এনেছি আর ছাতাও এনেছি। সাইকেল চালানোর সময় তো আর ছাতা মাথায় দিয়ে হাটতে পারবো না তাই আপনি নিয়ে যান।
— ওকে কিন্তু ফেরত দিবো কিভাবে?
— আপনি তো লাইব্রেরী একাউন্টে বসবেনই। তখন না হয় ছাতাটা নিয়ে নিবো।
— আরে আমি তো একদিনের জন্য ওইখানে বসেছিলাম। আসলে ওই কাউন্টারে আমার বাবা কাজ করে। ওনি অসুস্থ বলে আমি বসে ছিলাম।এখন তো আমার বাবাই বসে।
— ও আচ্ছা। তাহলে শোনোন, আমি রাজ আর আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৪র্থ সেমিস্টারে পড়ি। এবার তো ছাতাটা দিতে কোন সমস্যা হবে না।
— মোটামোটি হবে না। আচ্ছা তাহলে আমি আসি।
— আচ্ছা ভাল থাকবেন।
মেয়েটি ছাতাটা খুলে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলো। হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে দিলো আর আমার দিকে ফিরে তাকালো। তাই বললাম…
— কি হলো?
— আমি নিত্তিয়া আর ফুড ডিপার্টমেন্টে ১ম সেমিস্টারে পড়ি।

আমি শুধু মুচকি হাসলাম আর নিত্তিয়াও একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। আর আমি অপেক্ষায় রইলাম কখন বৃষ্টিটা একটু হালকা হবে আর আমি বাসার দিকে পা বাড়াবো।

বসে থাকতে থাকতে ঘুমে ধরে যাচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি মোটেও কমছে না তাই বাধ্য হয়ে হেঁটেই সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেলটা নিয়ে বাসার দিকে রওনা নিলাম। বাসায় পৌঁছে দেখি আমি পুরো ভিজে গেছি। আমার ছোট বোন তাম্মি এসে আমার সামনে দাঁড়ালো আর আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখলো…

— কিরে এমন করে কি দেখছিস?
— কেমন যেন একটা সন্দেহ সন্দেহ গন্ধ আসছে?
— ডাক্তারের কাছে গিয়ে তোর নাক দেখিয়ে আয়।
— আরে ধ্যাত, যে ছেলে গত ৪ বা ৫ বছরে একবারও বৃষ্টিতে ভিজে নি সে আজ ভিজে বাসায় আসছে।
তখনই মা আমার সামনে আসলো..
— কিরে রাজ বাবা তুই না ছাতা নিয়ে গেছিলি বাসা থেকে।
— আসলে ছাতাটা…
— আসলে ছাতাটা একটা সুন্দরী মেয়েকে দিয়ে দিছে। মেয়েটি হয়ত বাসা থেকে ছাতা আনে নি। (তাম্মি বলল)
— ওই তুই চুপ করবি। আসলে হয়েছে কি মা? একটা মেয়ের বাসায় যাওয়ার খুব প্রয়োজন ছিল আর বৃষ্টির কারনে বাসায় যেতে পারছিল না তাই আমি আমার ছাতাটা দিয়ে দিছি।
— আচ্ছা বেশ করেছিস।এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে, আমি তোর খাবার দিচ্ছি।
— আচ্ছা ।

মা রান্না ঘরে চলে গেল আর আমি আমার রুমের দিকে পা বাড়ালাম। তখনই পিছন থেকে বলে উঠলো…

— ভাইয়া মেয়েটার নাম কি রে?
— তুই যাবি এখান থেকে নাকি তোকে এখন বৃষ্টিতে ভিজিয়ে আনবো।
— ওকে যাচ্ছি তবে মনে রাখিস তুই যাকে পছন্দ করবি, সে যদি আমার পছন্দ না হয় তাহলে মেয়ে রিজেক্ট।
— হুমম মনে থাকবে এবার যা তো।
তাম্মি হাসতে হাসতে চলে গেল। সবাই যে আমাকে নিয়ে কি ভাবে না?

এভাবে কয়েকটা দিন চলে গেল। এর মাঝে আর নিত্তিয়ার সাথে দেখা হয় নি আর আমার ছাতা পাওয়াও হয় নি। একদিন ভাবলাম ওর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খুঁজ নেই কিন্তু যদি কিছু ভাবে তাই আর যাই নি।
একদিন ভার্সিটির একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিত্তিয়াকে খুজচ্ছিলাম। কেন খুঁজতে ছিলাম এর উত্তর আমার জানা ছিল না?হঠাৎ পিছন থেকে কেউ বলল….
— কাউকে খুঁজচ্ছেন বুঝি?
— হুমম( পিছনে না তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললাম)
— ও তাহলে ছাতাটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন। অন্তত রোদ লাগবে না।
— হুমম। ( পিছনে না তাকিয়েই ছাতা নিলাম)

আরে আমাকে সত্যি সত্যি ছাতা দিলো কে? আর এই ছাতাটাও তো আমার। পিছনে তাকাতেই দেখি নিত্তিয়া হাসতেছে। আমি একটু অবাক হয়ে মাথা চুলকাতে লাগলাম।

— কাউকে খুঁজতে কেউ এতোটা অন্য মনস্ক হয়ে যায় আজ দেখলাম। তা কাকে খুঁজচ্ছেন?
— তেমন কাউকে না?
— দেখুন কিছু কিছু কথা সবাইকে বলতে নেই আর সেই কথা বন্ধুদের কাছে লুকাতে নেই।
— বাব্বা এত্তো তারাতারি আমায় বন্ধু ভেবে নিলেন।
— একদমই না।
— তাহলে?
— তাহলে আমার সাথে কি একটু সাইকেল ঠিক করে যেখানে ওইখানে যেতে পারবেন?
— হুমম কিন্তু কেন?
— আসলে আমার সাইকেলটা ঠিক করাতে দিয়ে আসছিলাম।
— তাহলে চলেন।

আমি নিত্তিয়ার পাশে হেঁটে চলেছি আর আমার সাইকেলটা হাত দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। আকাশটা খুব মেঘলা হয়ে আছে হয়ত বৃষ্টি আসতে পারে। অনেক কথা বলতে বলতে সামনে যেতে লাগলাম। এক পর্যায় দোকানে চলে আসলাম। নিত্তিয়া তার সাইকেলটা নিয়ে আসতেই আমি একটা অদ্ভুত আকারের শক খেলাম। নিত্তিয়া বার বার প্যাডেল চালিয়ে দেখতে লাগলো কাজ করছে কি না? তখন আমি বললাম….

— বাহ্ সাইকেলটা তো বেশ সুন্দর।
— হুমম কিন্তু সুন্দরের কদর সবাই করতে পারে না।
— কেন?
— একটা ফাজিল লোক আমার সুন্দর সাইকেলটার বেল আর প্যাডেল ভেঙ্গে দিছে। জানেন ভেঙ্গে দেওয়ার পর আবার চিরকুট দিয়ে লেখে দিছে আমি যেন ঠিক করে নেই।
— ও আচ্ছা যাই হোক,ওরে মাফ করে দিয়েন।
— ওরে করবো মাফ তাও আমি। ওর কপালে বউ জুটবে না দেইখেন।
— আরে আরে এমন কথা বলে না।
— কেন বলবো না?
— কারন লোকটা ছেলে না হয়ে কোন মেয়েও তো হতে পারে?
— এটা কোন মেয়ে না কারন যেদিন আমার বেল ভাঙ্গছিল তখন আমি ওইখানের প্রতিটা ঘরে খুঁজ নিয়ে দেখেছি কোন মেয়েই সাইকেল চালায় না। তাই এটা পাক্কা ছেলে।
— তাই বলে এতো বড় একটা কথা বলবে।
— আপনি সাথে আছেন বলে এখনো কিছু বলছি না? না হলে…
— না হলে আর কিছুই না কারন ছেলেটা আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
— কোথায়? দেখছি না( ও আমার সামনে পিছনে দেখতে লাগলো?)
— এই যে আমিই।
— কী?(একটা শক খেয়ে)
— হুমম
— ও এখন কি হবে?
— কিছুই না। যা বললে হয়ত তাই হবে।
— আরে এটা কেমন করে হয়? আচ্ছা আপনার কনিষ্ঠা আঙ্গুলটা দেন তো।
— কেন?
— আরে দেন তো।
— এই যে দেখো।

নিত্তিয়া সাথে সাথে ওর কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে আমার আঙ্গুলে লাগালো। আবার আমার বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ওর বৃদ্ধা আঙ্গুলে টান দিলো।

— এটা কি হলো??
— আরে ছোট থাকতে শুনছিলাম যদি কাউকে ভুল করে কিছু কথা বলে ফেলো তাহলে তার সাথে আড়ি করে আবার বন্ধুত্ব করে নাও। দেখবে যা হবে শত্রুর হবে কিন্তু বন্ধুর কিছু হবে না।
— ও কে বলছে এই থিউরি আর কিভাবে শত্রু বানালেন আবার বন্ধুও বানালেন?
— এই যে আমার কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে আপনার কনিষ্ঠা আঙ্গুলে দাগ কাটলাম তখন আমরা শত্রু হয়ে গেলাম আর বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে দাগ কেটে বন্ধু হয়ে গেলাম। আর এটা আমি ছোট থাকতে আমার বান্ধবীদের থেকে শিখেছি।
— হা হা হা আপনি বেশ মজার মানুষ তো।
— হাসবেন না একদম। কারো মন খারাপে বেশি হাসলে দাতঁ পরে যায়।
— ও তো আপনার মন খারাপ হলো কেন?
— আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন নি তাই।
— ও আচ্ছা। এবার চলেন বাসার দিকে পা বাড়ানো যাক।
— চলেন।

এখন দুইজনেই যার যার সাইকেল চালিয়ে যেতে লাগলাম। রাস্তা একদম খালি। বাতাসে নিত্তিয়ার চুল গুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। বড্ড ভাল লাগছে ওরে। ওর সব চেয়ে ভাল লাগলো শিশু সুলভ আচরণটা। আর তখনই ঝুম বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। আমরা সাইকেল থামিয়ে একটা গাছের নিয়ে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু প্রথমে মাথায় বৃষ্টি না পড়লেও এখন পরছে। একটু দূরে কিছু ছোট ছোট বাচ্চা কাদায় লাফালাফি করছে। আমি নিত্তিয়াকে দেখাতে নিত্তিয়াও দৌড় দিলি ওদের দিকে। আরে ও কি করছে? কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো নিত্তিয়া বাচ্চাদের সাথে কাদায় লাফালাফি করতে লাগলো। বেশ লাগছিল দেখতে। আমি দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, নিত্তিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে আর আমায় ডাকছে। এক পর্যায় বৃষ্টি কমে আসে আর ও চলে আসে। আমার সামনে এসে বাচ্চাদের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

— কি হলো? এখন চুপ করে আছেন কেন?
— বাসায় গেলে বাবা বকা দিবে। কাদায় কি অবস্থা করেছি?
— শুধু বাবাই বকবে, মা বুঝি কিছু বলবে না।
— আমার মা নেই, আমি ছোট থাকতেই মারা যায়।
— সরি আমি জানতাম না।
— হুমম এখন পা কোথায় পরিষ্কার করবো?
— সামনেই একটা পুসকুনি আছে। চাইলে ওখানের সিঁড়িতে বসে হাত পা পরিষ্কার করে নিতে পারেন।
— তাহলে চলেন।

তারপর নিত্তিয়া পা পরিষ্কার করার পর ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে আসলাম।

এভাবে দিন গুলো ভালোই কাটছিল আর নিত্তিয়ার প্রতি এক প্রকার মায়ায় জড়িয়ে যেতে লাগলাম। একদিন রাতে আমার মোবাইলে অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোন আসলো।

— হ্যালো কে বলছে?
— আপনি নিশ্চয় রাজ বলছেন।
— হুমম কিন্তু আপনি?
— পরিচয় দিবো না, পারলে চিনে নেন।
— আপনি নিত্তিয়া।
— কীভাবে বুঝলেন?
— ১. গলার আওয়াজ ২. কথার ধরন আর ৩. অপরিচিত তেমন কেউ আমায় ফোন দেয় নি।
— বাব্বা কত্তো বুদ্ধি।
— এইসব বাদ দেন, এবার বলুন আমার নাম্বার আপনি পেলেন কোথায়?
— আপনিই আইডিয়া করে নিন।
— যদি আইডিয়া করে নিতে পারতাম তাহলে প্রশ্নটা করতাম না।
— তাও ঠিক। আজ বাবা লাইব্রেরীর একটা ফাইল বাসায় আনছিল। সেটা দেখতে গিয়ে আপনার নাম আর নাম্বার পেয়ে যাই।
— ও এই জন্যই ফোন দিলেন।
— কেন? ফোন দেওয়ার আরো কারন আছে বুঝি?
— আমি কি তা বলছি। তো কাল তো ভালবাসা দিবস। কোন স্পেশাল প্ল্যান আছে নাকি?
— হুমম আছে।
— শুনি তো আপনার প্ল্যানটা।
— কালকে আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো। আমার সব থেকে প্রিয় জায়গা। যেখানে গেলে কখনো মন খারাপ হয় না। যেখানে গেলে সকল অনুভূতি তুচ্ছ মনে হয়।

— জায়গাটা কোথায়?
— গেলেই বুঝবে। কাল ১০ টায় ভার্সিটির সামনে চলে আইসেন।
— ওকে।

সকালে সাইকেলটা নিয়ে ভার্সিটির দিকে চলে গেলাম। ভার্সিটি গিয়েই নিত্তিয়াকে ফোন দিলাম। ৫ বার ফোন দেওয়ার পরও ফোন ধরে নি। খুব রাগ হচ্ছে এখন।

— ৫ বার ফোন দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলেন বুঝি।

পিছন থেকে কেউ বলল। পিছনে তাকিয়ে দেখি নিত্তিয়া মুচকি হাসছে।

— ফোন ধরছিলেন না কেন?
— দেখতে চাইছিলাম কারো জন্য অপেক্ষা করার ক্ষমতা আপনার কতটা আছে?
— তো কি দেখলেন?
— বলবো না। এখন চলনে।
— হুম কিন্তু আপনি সাইকেল আনেন নি।
— না আজ আপনার সাইকেলে চড়বো।
— ওকে পিছনে বসো।
— হুমম

নিত্তিয়া আমার পথ বলে দিচ্ছিল কোথায় যাবো? আমিও সেই ভাবে যেতে লাগলাম। এক পর্যায় নিত্তিয়া বলল…

— ওই থামান তো।
— কেন?
— আরে থামান না।
— ওকে।
— শুনেন এখানে থেকে ডানে মোড় নিয়ে সোজা গেলে একটা স্কুল পাবেন। ওই স্কুলে চলেন আর হ্যা আমি পিছনে নয় বরং বাকিটা রাস্তা সামনে বসে যাবো।
— কেউ কিছু বললে?
— কারো কথায় আমার বয়েই গেল।
— ওকে।

নিত্তিয়ারে সামনে বসিয়ে সাইকেল চালানোর অনুভূতিটা অসাধারন ছিল। আমার হার্টবিটের আওয়াজ যেন আমি নিজেই শুনতে পারছিলাম। স্কুলের ভিতরে সাইকেল নিয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে এখানে আজ কোন অনুষ্ঠান।আর স্কুলটার নাম হলো “আমরা সবাই রাজা শিল্পকলা স্কুল”। স্কুলের নামটা খুব ভাল লাগলো। নিত্তিয়াকে দেখে সকল ছেলে মেয়েরা দৌঁড়ে আসলো। সবার মাঝে নিত্তিয়াকে অন্যরকম স্পেশাল লাগছিল। তারপর সবাইকে ক্লাসে পাঠিয়ে নিত্তিয়া আমার সামনে আসলো। আমি বললাম…

— ওদের সাথে আপনার পরিচয়টা কেমন করে?
— আমি এখানে নাচ শিখাই।আর এখানে সকল শিশুই এতিম।জানি না ওদের মাঝে আসলে আমি নিজেকে ফিরে পাই।
— ঠিক বুঝলাম না।
— আসলে আমিও এতিম। যাকে আমি বাবা ডাকি ওনি আমায় এই স্কুল থেকে নিয়ে যায়। জানেন রাজ এখানে প্রতিটা

বাচ্চার সাথে মিশলে মনে হয় আমি তো একা নই। আমার মত হাজারও মানুষ আছে। আমরা সবাই একটা পরিবার।

— হুমমম বুঝলাম তো আজ কি স্কুলে কোন অনুষ্ঠান আছে?
— হুমম সাংস্কৃতিক নৃত্য পরিবেশন অনুষ্ঠান।
— ও স্পেশাল মনে হচ্ছে। ভালবাসার দিনে এমন একটা অনুষ্ঠান যা কল্পনা করা যায় না। এসে খুব ভাল লাগছে।
— আচ্ছা রাজ কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করবো?
— মনে করলে কি প্রশ্ন করবেন না?
— আচ্ছা ভালবাসা বলতে আপনার কাছে কি?
— বাব্বা কঠিন একটা প্রশ্ন করলেন তো। ভালবাসা বলতে “খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে হালকা হাওয়ায় এলোমেলো চুলে

প্রিয় মানুষটার অপেক্ষা। ভালবাসা মানে একটি গানের লাইন”আমার স্মরনে শুভ সিন্দুরও একটি বিন্দু একোঁ তোমার ললাট চন্দনে”। ভালবাসা মানে “এক পলক চাহনি দেখার জন্য কয়েক প্রহর অপেক্ষা করা”।

— বাব্বা আপনি তো পুরু রবীন্দ্রনাথের ভক্ত।
— হুমম বলতে পারেন।
— হুমম এখন চলেন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।
— হুমম চলেন।

আমি নিত্তিয়ার পিছু পিছু যাচ্ছি কিন্তু বার বার নিত্তিয়ার দিকেই চোখ যাচ্ছে। একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। আমি নিত্তিয়ার সাথে বসে অনুষ্ঠান দেখতে লাগলাম।

এক পর্যায় সবাই জোর করলো নিত্তিয়াকে নাচার জন্য। আমার দিকে তাকিয়ে নিত্তিয়া আর কিছু বলল না।
একটু পর নিত্তিয়া নাচতে শুরু করলো। ” ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে” এই গানে নাচতে ছিল। যেদিন আমি নিত্তিয়ার সাইকেলের বেলটা ভেঙ্গে ফেলছিলাম ওই দিন দুতলায় এই গানে কাউকে নাচতেছিল মনে হচ্ছিল। তাহলে সেটাই কি নিত্তিয়া ছিল। আমি নিত্তিয়ার মাঝে নিত্তিয়াকেই হারিয়েই ফেলে ছিলাম।

নাচ শেষ করে একটু পর নিত্তিয়া আমার সামনে আসলো। তখন নিত্তিয়াই বলল….
— রাজ সাহেব তো কেমন লাগলো?
— বলতে পারবো না শুধু মনে হচ্ছিল আমি কোথাও হারিয়ে গেছি।
— একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে তো!!!
— সমস্যা নেই। আচ্ছা নিত্তিয়া একটা কথা বলবো?
— হুমম বলেন।
— আপনাকে কি আপনি থেকে তুমি ডাকতে পারি?
— হুমম তবে…..

তখনই আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। নিত্তিয়াও কথা থামিয়ে দিলো। ফোনে তাকিয়ে দেখি সঞ্চিতা ফোন দিছে।

— হুমম সঞ্চিতা বলো।
— কখন আসবে তুমি?
— এই তো তোমরা একটু ওয়েট করো আমি এক ঘন্টায় আসছি।

আমি ফোনটা রাখতেই নিত্তিয়া বলে উঠলো…

— সঞ্চিতা কে?
— হয় কিছু একটা।
— হুমম চলেন এখন বাসায় যাই।
— নিত্তিয়া তুমি আমায় কিছু বলতে চেয়ে ছিলে?
— না তো কিছু না।

নিত্তিয়া কথাটা বলেই অন্য দিকে তাকালো। ওর আবার কি হলো? ও সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি পিছন থেকে ওর হাতটা ধরলাম।

— নিত্তিয়া এই হাতটা ধরার সুযোগ কি সব সময় পেতে পারি?
— (ও কোন কথা না বলে মাথা নাড়ালো)
–এই যে পাগলী সঞ্চিতা আমার রিলেটিভ।
— হুমম।

আমি আর কথা না বলে নিত্তিয়ার কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে আমার কনিষ্ঠা আঙ্গুলো দাগ কাটলাম। এখন নিত্তিয়া আমার দিকে তাকিয়ে রাগে ফোঁসতে লাগলো।এবার আমি আমার বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ওর বৃদ্ধা আঙ্গুলে দাগ কাটলাম। এবার ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম। সামনে হাটতে লাগলাম।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত