দ্বিতীয় বাসরঘর

দ্বিতীয় বাসরঘর

আজ আমাদের বাসরঘর। প্রত্যেকের একটা স্বপ্ন থাকে এই রাত নিয়ে। আমিও ব্যতিক্রম নই। আমারও কিছু স্বপ্ন ছিলো আমার জীবন সাথী কে নিয়ে। কিন্তু তা হয়ত আর সম্ভব নয়। আমি চেয়েছিলাম একজন স্মার্ট, আধুনিক একটি মেয়ে। যে আমার সাথে পার্টিতে যাবে আড্ডায় বসবে। কিন্তু বাবা-মার পছন্দ রাখতে গিয়ে এমন কাউকে বিয়ে করে আনতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আগে কি আর জনতাম এই শহরেও এমন ক্ষ্যাত মার্কা পরিবার আছে.? বিয়ের আগে কিছুই জানতে পারিনি, বাসর ঘরে ঢোকার আগে সব জানলাম। আর ঢুকে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

আমি ঢুকতেই মেয়েটি সালাম করলো, একদম পায়ে হাত দিয়ে। আমি একদম হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবছি এ কেমন কথা.? বাসর রাতে কি স্বামীকে কেউ পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে.?
– এই কি করছো.? এভাবে পায় হাত দিয়ে সালাম করছো কেনো.? এমন ক্ষ্যাত কি আদোও আছে.?
-আপনি এভাবে বলছেন কেনো.?
-তো.? একটা ক্ষ্যাত কে কিভাবে বলবো.?
মেয়েটা কিছু বলতে পারলো না। সে হয়ত মনের ভূলেও চিন্তা করেনি এমন একটি বাক্য তাকে বাসর রাতে সুনতে হবে। মাথা নিচ দিক দিয়ে আছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম দুই ফোটা পানি মেঝেতে গড়াগড়ি করছে। সে কোনো তর্ক না করেই বলল,
-আমি তো নতুন কোথায় কি রাখা জানি না। যদি জায়নামাজ বের করে দিতেন.? আসলে এত ঝামেলার মধ্যে এশার নামাজ পড়া হয়নি।
-এখন কি কেউ নামাজ পড়ে.? আর এই রাতে কি শুরু করেছো কি হা.? (রাগের সুরে)
-প্লিজ দিন নইলে যে আমার ঘুমটাই হবে না। আমার ভিতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। আমার সঠিক জ্ঞান হওয়ার পড় ইচ্ছাকৃত
ভাবে কখনো নামাজ কাজা করিনি।
মেয়েটির কথা শুনে যেন আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি শুক্রবারই নামাজ পড়ি মায়ের বকা শুনে আর সে নামাজ কাজাই করেনি.? মনে মনে একটু মায়া হলো। আমার আলমারির ভেতরে জায়নামাজ ছিলো। দুই ঈদে ব্যাবহার করা হয়, তাছাড়া এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। তাই তাকে বের করে দিলাম। আর বলে দিলাম,
-আমাকে নামাজের কথা বলতে আসবে না। আর এইটা নিয়ে কানের কাছে প্যান প্যান ও করবে না।
-চলুন না একসাথে নামাজ পড়ি।
-এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার.? না করার পরেও বলছো কেনো.?
-আমার কাজ দীনের দাওয়াত দেওয়া, হেদায়েতের মালিক আল্লাহ্‌।
-এত কথা না বলে নিজের কাজ করো।

সে নামাজ পড়ছে আমি খুব মনোযোগী হয়ে দেখছি। মনে মনে ভাবছি, স্ত্রীরা দেরি করে স্বামীর জন্য আর আমি অপেক্ষা করছি বউ এর জন্য। কত স্বপ্ন ছিলো মাস্তি করবো নিজের বিয়েতে। অনেক লোকজন, আমার বন্ধু-বান্ধবি, অফিসের সহকর্মী আরো অনেকেই আসবে বিয়েতে। কত পরিকল্পনা ছিলো। সব বন্যার পানির মত ধুইয়ে নিয়ে গেলো। বিয়ে হলো বউ কেউ দেখলো না। লোকজনও বেশি ছিলো না। কাজী আর বাবা- চাচারা ছিলো। আরে হা বউ এর মুখ এখন পর্যন্ত দেখতে পারলাম না। এ কেমন বিচার.? সেই যে কচুকাটা এসে মুখে ঘোমটা দিয়ে আছে আর তোলার খবর নেই। মেয়েটা পারেও রে বাবা.!!! যদি সুন্দর হয় তবে দেখাতে নিয়ে যাবো আর ওদের জালাতন করে আসবো। কিন্তু শুনেছি বউ নাকি পর্দা করে, আমার বন্ধুদের সামনে তো দূরের কথা আমার দুই বছরের ছোট খালাতো ভাইয়ের সামনেও নাকি মুখ বের করবে না। এ আবার কি ধরনের ক্ষ্যাত মাইরি। মনে মনে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপর।

মেয়েটির ডাকে চিন্তার জগত থেকে বাস্তবে ফিরলাম। এতক্ষণে সেই ঘোমটা আর সামনে নেই। আমি তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। কেমন যেন অদ্ভুত মায়ায় পড়ে গেলাম মুহূর্তের মধ্যে। চোখে কি মায়া.!! যেন অতল সমুদ্রে আমি এক খন্ড পাথর হয়ে ডুবে চলেছি তার গভীর তলদেশে। শত চেষ্টা করেও যেন সেই মায়া কে উপেক্ষা করতে পারছি না আমি। মেয়েটি লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলো। আর সব কিছু যেন ঘটে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। আমার কাছে যেন মনে হচ্ছে যুগ যুগ হলো ডুবে চলেছি সেই অতল গহ্বরে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, পূর্ণিমার একখন্ড চাঁদ যেন আমার ঘরে চলে এসেছে। আমি তার রূপের বর্ণনা লিখে প্রকাশ করতে পারবনা। এর মধ্যেই সে খাটে বসে পড়লো। আমি খাটে গিয়ে তার সামনে বসলাম। হাতটা যেই স্পর্শ করতে যাব অমনি বলে দিলো,
-খবরদার আমার কাছে স্বামীর অধিকার খাটাতে আসবেন না।
-কেনো কি হলো.?
-বেনামাজির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা। (শান্ত সুরে)
-তাহলে আগে বোঝা উচিৎ ছিলো। এখন এই মুহূর্তে তুমি এসব বলছো কেনো.? (রাগের সুরে)
-শান্ত সুরে কথা বলছি বলে ভাববেন না আমি দুর্বল। আর রাগ আল্লাহ্‌ তা-আলা হারাম করে দিয়েছেন। আপনিও সংযত হোন। আর আমার সকল পছন্দ আমার বাবা-মা। তারা যেখানে বিয়ে দেবেন সেখানেই রাজি। প্রথমে আপনার সাথে বিয়ে দিতে মোটেই রাজি ছিলেন না। আর আপনার বাবা-মা আমাকে পছন্দ করেছে আর তাদের জোরাজুরিতে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আপনার বাবার বন্ধু আমার চাচা। চাচাও বাবাকে বলেছিলেন যেন বিয়ে দিয়ে দেয়। তাই এই বিয়েটা হয়েছে।
-আমারও পছন্দ বাবা-মার হাতে তাই আপনাকে না দেখে না জেনেই রাজি হয়ে গেছি। তো এখন আপনি কি চাচ্ছেন.?
-আমি চাই আমার স্বামী আল্লাহ্‌র রাস্তায় আসুক। রাসূলের সুন্নাত তার শরীরে দেখতে চাই।
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু ভাবছি, এই আধুনিক শহরে এমন কেউ কি আদৌ আছে.? হয়ত আমি এর যোগ্য না। কি ব্যবহার, কি সুন্দর কথা গুলি, কি নিষ্পাপ চাওয়া গুলো। আমি সত্যি তার সাথে বেমানান। ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এসে খাট থেকে নেমে গেলাম। তার কথা গুলোর অর্থ কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি। মেঝেতে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। মেয়েটিও শুয়ে পড়েছে। তার সব কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমের কোলে ঢোলে পড়লাম।

হঠাত কারো কান্নার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো কিন্তু ঘুমের ভাবটা এখনো আছে চোখে। ঘোড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৩:৩০ মিনিট। এত রাতে কে আবার ফুঁপিয়ে কান্না করে। একটু উঠে বসার পর দেখতে পেলাম এ আর কেউ নয় আমার বউ। জায়নামাজে বসে অঝোর ধারার বর্ষণ করছে। সে আমাকে দেখতে পারে ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলাম। একটু পর তার কান্না থেমে গেল। একটু পর ফজরের আযান হলো।
-এই যে শুনুন। ফজরের আজান দিচ্ছে নামাজে যান।
-পারবো না, খুব ঘুম পেয়েছে আমার। (জেগে আছি তবুও)
-দেখুন নামাজ প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। নামায না পড়া অনেক বড় একটা গুনাহর কাজ।
-দেখো এত জ্ঞান দিতে এসো না তো। যাও নিজের কাজ করো। (রাগের অভিনয়ে)
মেয়েটি কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। মনে মনে নিজেকে বলছি এমন না করলেও পারতাম। কি এমন হত তার কথা শুনলে.?

সকাল সকাল চা নিয়ে হাজির। পাশের টেবিলে রেখে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে চা তে মুখ দিতেই বুঝলাম এইটা মায়ের হাতের না। মায়ের হাতের চা-র স্বাদই যেন অন্যরকম যা অন্য কারো সাথে তুলনা চলে না। তবে এটাও যেন কম যায় না। তার আরো একটি গুনের দেখা মিললো। হঠাত মা এসে বলে গেলেন, বিকালে সুলতানাকে নিয়ে একটু বাহিরে যেতে। নতুন পরিবেশ একটু বাহিরে গেলে ভালো লাগবে। আর এখন খেতে আয়। ঘর থেকে বেরিয়ে দিখি বউ আমার অপেক্ষায় বসে আছে, টেবিলে বসে পড়লাম। বউ ভাত তরকারি প্লেটে তুলে দিচ্ছে। মা-বাবা,ছোট বোন আগেই খেয়ে আমাদের জন্য রেখে গেছে। তাকেও ভাত নিতে বললাম। সে নিজের প্লেটেও ভাত নিলো। আমি তার প্রথম খাওয়া দেখবো এই লোভ আর আটকে রাখতে পারলাম না। আমি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি এই আসায় যে কখন প্রথম এক লোকমা খাবার মুখে দেবে। কিন্তু আমার আসা ব্যর্থ করে আমাকে বলল শুরু করেন। আমি আর কোনো কথা না বলে চোখ নিচের দিকে দিয়ে খাবার মুখে দিলাম। বউ এর দিকে তাকিয়ে দেখি মুচকি মুচকি হাসছে আর ভাত খাচ্ছে। মনে মনে বলছি এই বেটি মনের কথা জানতে পেরে হয়ত এমন কাজটা করে ফেলল। পুরাই কচু কাটা।

বিকাল বেলায় বের হব বলে তাগাদা দিলাম সুলতানাকে। আমি একটা পাঞ্জাবি পড়েছি। সে রেডি হয়ে বেরিয়ে আসছে। কালো কুচকুচে একটা বোরকা পড়েছে, কালো হিজাব,পায়ে মোজা, সেই মায়াবী চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। বোঝাও যাচ্ছেনা ভেতরে মানুষ নাকি অন্য কিছু। শুধু চোখের দিকে তাকিয়েই আমি আবারো যেন ডুবে যাচ্ছি সেই অতল সাগরে। এভাবেও যে এত সুন্দর লাগে আগে খেয়াল করিনি। ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলাম বউ এর কাশির শব্দে,
-এহেম,এহেম.! যাবেন নাকি এভাবেই তাকিয়ে থাকবেন.?
-হ্যাঁ, চলো। (কিছুটা লজ্জিত হয়ে)
-এর আগে মেয়ে মানুষ দেখেন নি নাকি.?? হা করে তাকিয়ে আছেন যে।
-না মানে দেখেছি তবে এভাবে না।
-দেখার চেষ্টাও করবেন না। এখন চলুন আমার পছন্দের জায়গায় যাবো।
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। সে একটা চশমা পড়ে পিছু পিছু আসতে লাগলো। মনে মনে ভাবছি সব কিছইু নিয়ে এসেছে নাকি.? মা কে জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।

সুলতানার কথা অনুযায়ী একটা মাদরাসার কাছে আসলাম, পাশে দেখলাম এতিমখানা, তার আরেক পাশে খাবারের হোটেল। জায়গাটা সত্যি অনেক সুন্দর। পিচ্চি পিচ্চি ছেলেগুলো সালাম দিচ্ছে আমাকে আমিও উত্তর নিচ্ছি। মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলাম। সেই টুপি পড়া মাসুম বাচ্চা গুলোর মাথায় সাদা টুপি, সাদা জুব্বা, সাদা পায়জামা, কেউ কেউ আতর লাগিয়েছ। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। আমি একটু আগেও আতরের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু এখন এই আতরই লাগাতে ইচ্ছে করছে। এত সুন্দর সেই গন্ধ যা বলে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। বাড়ি থেকে এই মাদ্রাসায় আসতে ১০ মিনিট সময় লেগেছিলো। আর এখানেই যে এত মাধুর্য লুকিয়ে আছে জানা ছিলোনা। তাই হয়ত কবি বলেছেন,
‘দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু
হয় নাই দু চোক্ষু মিলিয়া
ঘর হতে শুধু দু পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।।’
আমাকে হোটেল থেকে কিছু খাবার কিনে আনতে বললো। আমি আমার সাধ্যমত কিছু কিনে নিয়ে আসলাম। তার হাতে তুলে দিতেই চলে গেলো সেই পিচ্চিদের কাছে। সবাইকে অল্প অল্প করে খাবার দিচ্ছে আর পিচ্চি গুলো কি আনন্দের সাথে সেগুলো খাচ্ছে। নিজের অজান্তেই এক চিলতি হেসে নিলাম। হঠাত আযানের শব্দ ভেসে আসলো কানে। এই মুহূর্তে এত সুন্দর লাগছিলো যা প্রকাশ করার মত শব্দ হয়ত আমার জানা নেই। সুলাতানা এসে ডাক দিলো যেন তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওনা দেই। আমি আযানের শব্দে এত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে অন্য দিকে কোনো খেয়াল ছিলোনা। সুলতানার কথায় সায় দিয়ে রিক্সায় তুলে দিয়ে বললাম তুমি যাও আমি একটু কাজ সেরে আসি, প্লিজ কিছু মনে করোনা। রিক্সায়য় তুলে দিয়ে মাদ্রাসার ভেতরে উকি দিয়ে দেখি পিচ্চি গুলো নামায পড়ছে। এত সুন্দর সেই দৃশ্য যদি কেউ দেখে থাকেন তবে বুঝতে পারবেন। আমি আর থাকতে পারছিনা, এত ছোট ছোট মানুষ এত সুন্দর করে নামাজ আদায় করছে আর আমি এত বড় হয়েও নামাজের সেই সৌন্দর্যটাকে আঁকড়ে ধরতে পারিনি। আমি মন দিয়ে নামায পড়া দেখলাম। তাদের সামনে পড়লে খুব লজ্জিত হবো এই ভয়ে সালাম ফেরার সাথে সাথে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। তখনো চোখের সামনে সেই নামায পড়ার দৃশ্য ভাসতে লাগলো।

বাড়িতে এসে কোনো কিছু না বলে সুলতানাকে ডাক দিলাম। মা বলল ঘরেই আছে। ঘরে গিয়ে সরাসরি তাকে বললাম,
-আমি কিভাবে ইসলামের পথে আসবো বলে দাও। আমি হয়ত বড় দেড়ি করে ফেলেছি আল্লাহ্‌ কি মাফ করবেন.?
-হা, অবস্যই। আল্লাহ্‌র কাছে খাটি মনে তওবা করলে সকল গুনাহ মাফ করে দেন। আপনি সেই মাদ্রাসার বড় হুজুরের সাথে কথা বলে দেখুন। নিশ্চয় কোনো রাস্তা দেখিয়ে দিবে, সেভাবে কাজ করলে ইনশাআল্লাহ্‌ আপনি ইসলামের শীতল ছায়া অনুভব করতে পারবেন।
-হা, আমি অবস্যই যাবো। তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি সত্যি আমি অনুতপ্ত আমাকে মাফ করে দাও।
-ছিহ.!! কি বলছেন। মাফ চাইছেন কেনো.? আল্লাহ আপনাকে যে সঠিক পথ দেখিয়েছেন এতেই অনেক। আল্লাহ্‌ আপনাকে কবুল করুক।
-ধন্যবাদ, আমাকে সেই মাদ্রাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কোনো কথা না বাড়িয়ে টুপি নিয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। মাদ্রাসায় পৌঁছে দেখি সবাই কোরআন পড়ছে। আবারো যেন হারিয়ে যাচ্ছি সেই মধুর সুরে। একজন হুজুর পড়া নিচ্ছে। আমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মাদ্রাসার বড় হুজুরের সাথে দেখা করতে চাই। সে পিচ্চিদের পড়তে দিয়ে আমাকে নিয়ে অন্য ঘরে গেলেন। সেখানে বসতে দিয়ে বললেন একটু পরেই আসবে আপনি একটু অপেক্ষা করুন। অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। একজন বয়স্ক লোক, মুখে সাদা দাঁড়ি, চুল গুলোও সাদা হয়ে গেছে বয়সের ভারে।
-আসসালামু আলাইকুম
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম
-আপনাকে কিছু বলার ছিলো যদি অনুমতি দেন।
-হ্যাঁ, বাবা বলো কি বলতে চাও।
আমার সম্পর্কে সকল কথা তাকে জানালাম আর এটাও বললাম কিভাবে আমি দীনের পথে আসবো। তিনি আমাকে বললেন তুমি এক চিল্লা বা চল্লিশ দিনের জন্য দীনের পথে বের হও। এর পর তুমি নিজেই বুঝতে পারবে কি করা তোমার উচিৎ আর কি বর্জন করা উচিৎ । আমি তার সাথে আরো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললাম। এবং সেখান থেকে এশার নামাজ পড়ে বাড়িতে আসলাম।

রাতে খাওয়া সেরে বিছানায় ঘুমাতে গেলাম তখনো বউ বলে দিলো যেদিন আপনি ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামায়েতর সাথে পড়তে পারবেন সেদিন থেকেই স্বামীর অধিকার পাবেন। আমিও তার কথা মেনে নিলাম তার কথা। মেঝেতে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। মন যেন মানছিলো না তাই এই সপ্তাহেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম মনে মনে।

সব কিছু ঠিকঠাক করে, বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম দীনের কাজে। ৪০ দিনের সফর। সেই মাদ্রাসায় একত্রিত হলাম অনেক কয়েক জন। এর মধ্যে আমার কিছু বন্ধুকেও রাজি করাতে পেরেছিলাম। বড় হুজুরের দায়িত্বে আমরা একই গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম দীনের খেদমতের উদ্দেশ্যে। অনেক কিছুই জানলেন এইবার আর কিছু জেনে নিন। আমাদের ছোট্ট একটা ব্যবসা আছে। এই কয়েক দিনের জন্য বাবার হাতে তুলে দিয়ে চলে আসলাম। এর আগে তিনিই দেখাশোনা করতেন। তাই খুব একটা দেড়ি করিনি দীনের কাজে বের হতে। সত্যি বলতে অনেক শান্তি পাচ্ছি মনের ভেতর। আমরা সময় মত পৌঁছে গেছি। কোনো সমস্যা হয় নি। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেই যে ভালোভাবে পৌঁছেছি। এর মধ্যে দেখতে দেখতে ৪০ টা দিন পেরিয়ে গেলো। আমি এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, তাহাজ্জুদের নামাজও পড়ি নিয়মিত। সেখানে থেকে এই অভ্যাস গুলো তৈরি হয়ে গেছে। দাড়িও রেখে দিয়েছি। এখন নামাজ পড়তে সত্যি অনেক ভালো লাগে। মনের মধ্যে একটা শীতল হাওয়া বয়ে যায়। আজান শুনলে আর মন মানে না। ছুটে যাই নামাযের জন্য। আজ সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। মনের মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করছে। অনেক দিন পর আবার পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছি।

আমাদের এলাকায় পৌঁছলাম যোহর নামাজের আগে। মাদ্রাসায় যোহরের নামায পড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়িতে পৌছে বাবা-মা কে সালাম দিলাম। তাদের সাথে কথা বলে সোজা ঘরে ঢুকেই সালাম দিলাম বউ কে। উত্তর না নিয়েই হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মুখে বড় দাড়ি, মাথায় টুপি, পাঞ্জাবির সাথে লুঙ্গি। সত্যি অবাক হওয়ার মতই কাহিনী। এত পরির্তন দেখে যেকেউ যে অবাক হবে এটাই স্বাভাবিক। -এহেম এহেম, আসসালামু আলাইকুম
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম
-কেমন আছো.?
-আলহামদুলিল্লাহ্‌, আপনি কেমন আছেন.?
-আলহামদুলিল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌র রহমতে ভালো।
আমি ব্যাগ রেখে তার সামনে দাড়াতেই বুকে আবিষ্কার করলাম আমার বউ কে। মেয়েটি অঝোর ধারায় কান্না করছে। মুখটা একটু উঁচু করে চোখের পানি মুছে দিলাম। গাল দুটি ধরে চোখে চোখ রেখে বললাম, এত পরিবর্তন তোমার মত স্ত্রী পাওয়াতেই সম্ভব হয়েছে। কথাটা বলেই কপালের মাঝ বরাবর ভালোবাসার চিহ্ন অংকন করে দিলাম। বউ লজ্জা পেয়ে আবার মুখ গুজে দিলো আমার বুকে ।

আজ আমার আগে সুলতানা খাবার খেয়ে ঘরে চলে গেলো। আমি নামাজ পড়ে একটু দেড়ি করে বাড়ি ফিরেছি। আর বাবা-মা খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে চলে গেছে। আমিও রাতের খাওয়া শেষ করে আমার ঘরে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি অবাক করা কান্ড। মেঝেতে খুব সুন্দর করে মোমবাতি জালানো। খাটে অনেক গুলো ফুল ছিটানো। সে আমার হাতে নতুন একটা পাঞ্জাবি বের করে বলল,
– এই নিন এইটা পড়ে নিন।
-এইটা কিসের জন্য.?
-আপনি দীনের কাজে চলে যাওয়ার পরে বাবা-মা-আমি আর পিচ্চি(ছোট বোন) দোকানে গিয়েছিলাম কেনা কাটা করতে। তাই আপনার জন্য এইটা কিনেছি। কেনো পছন্দ হয়নি.?
-হ্যাঁ, অনেক সুন্দর এটা। কিন্তু তোমার জন্য তো কিছু কিনতে পারিনি। তাই আমি একা একা পড়বো না। আর ঘর এত সুন্দর করে সাজিয়েছো কেন.?
-আমার কিছুই লাগবে না। আপনার ভালোবাসাই আমার জন্য যথেষ্ট। আর আজ আমাদের দ্বিতীয় বাসর ঘর তো তাই। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আর না বলি, আমার সাধ্য মত চেষ্টা করেছি সাজানোর জন্য।
-দ্বিতীয় বাসর.!!! (একটু খোঁচার ছলে)
লজ্জা পেয়ে চলে যেত লাগলো, হাতটা ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম কথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম.? লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না। অনুভব করলাম খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। আমিও আগলে নিলাম তাকে। শুরু হলো এক পবিত্র ভালোবাসা।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত