মিতুর সাথে আমার যখন দেখা হলো তখন ঠিক রাত। ও আমাকে দেখেই কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো “ছ্যাচড়া কোথাকার। এখানে কি?” ওর কথা শুনে আমি ব্যাক্কল টাইপের হাসি দেই আর অনুধাবন করি ও আমার ছাত্রী থেকে কেমন করে বউ হয়ে গেলো। আমি বললাম “তোমার মুখে কিছু আটকায় না? শেষ পর্যন্ত এখানেও। মইরা যাবো তোমার পাশে না থাকলে।” ও আমার কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। আমি জানি আমি শেষে যে সস্তা লাইনটা বলেছি সেটা আমার মুখে মানায় না।এমন কথার জন্য মিতুকে মানায়। মিতু আমার কথার ঠিকঠাক প্রত্যুর না দিয়ে চোখ গুলো বড় বড় করে বললো “এই খবরদার তোমার সাথে যে রাগ করে এখানে চলে আসছি আব্বা আম্মা যেন জানতে না পারে।আমি আব্বা আম্মারে কিছু জানাই নি।” আমি চুপ করে মাথা নেড়ে বুঝাই ঠিকাছে কিছু বুঝতে পারবে না। কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি আমার শ্বশুর শাশুড়ি ব্যাপারটা ঠিকি বুঝেছে।আমি অনুধাবন করে মিতুকে কেন যেন কখনো বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি না তার অন্তমিলের কথা। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তার ভিতরে দুইটা ছায়ার ছাপ।এই দুইটা ছায়াকে নিয়ে আমি যত ভেবেছি ততবারই ব্যর্থ হয়েছি। রাতে হঠাৎ করেই যখন আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় আমি অন্ধ কবির মত তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি এই মুখটাতে কত মিথ্যে আবেগ লুকিয়ে আছে।কিন্তু এই আবেগ গুলো আমি স্পর্শ করতে পারি না বা সে আমাকে এগুলো বুঝতে দেয় না।সে আমার চুপ থাকা দেখে বললো “আব্বা আম্মা ভিতরের রুমে আছে।দেখা করে ফ্রেশ হয়ে নাও।তারপর টেবিলে আসো খেতে দিচ্ছি।” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।ওর এমন মায়ামায়া কথা শুনে মনে হচ্ছে ও আামার উপর কোন অভিমান করেনি কোন রাগ করেনি।আমার ভিতরটা ধক করে ওঠে। আমি শুধু মুখ দিয়ে হুম জাতীয় আওয়াজ করে বুঝালাম আচ্ছা।
ভিতরের রুমে গিয়ে শুশুর শ্বাশুড়িকে যখন সালাম করলাম তখন শ্বাশুড়ি আম্মা বললো “বাইচা থাকো বাজান।শরীর ভালো? চাকরি কেমন চলে?” আমি একটা হাসি দিয়ে বলি “আপনাদের দোয়ায় সব ভালো। আপনারা কেমন আছেন?” শ্বশুর মশাই পান চিবাতে চিবাতে বললো “হুনো বাজান মিথ্যা কথা বলবা না।তোমাদের মাঝে যে একটু পেয়ার মহব্বতের রাগ চলতাছে হেইডা আমি আমার মেয়ের মুখ দেইখা বুঝছি।সব সময় আলগা পিরিত দেখাইবা না।মেয়ে মানুষ মাথার উপর ওঠে কিছু না বললে। তোমার শ্বাশুড়িরে দেখো। ” আমি শুধু নিরবে হাসলাম শ্বশুর মশাইয়ের কথা শুনে। কিন্তু অপরপাশে আমার শ্বাশুড়ি আম্মা মুখ গোমড়া করে মনে মনে যে শ্বশুর মশাইয়ের চৌদ্দ গুষ্টির নাম উদ্ধার করতেছে সেটা উনাকে দেখেই অনুমান করতে পারছি।এর একটু পরেই শ্বশুর বললো “মিতুর মা তুমি আমারে গালি দিছো?” শ্বাশুড়ি আম্মা মাথা নেড়ে বললো “তওবা তওবা আপনারে গালি দিমু ক্যান আমি?” আমি একবার শ্বশুরের দিকে তাকাই আর একবার শ্বাশুড়ির দিকে তাকাই কিন্তু কিছু বলতে পারি না। অবশ্য অন্যদের কথার মাঝে প্রবেশ করতে কেন যেন আমার মন সায় দেয় না। শ্বশুর মশাই পানের পিচকি ফেলে বললো “মিতুর মা তুমি যে আমার উপর মাইন্ড খাইছো সেটা আমি জানি। মাইন্ড খেয়ে আমাকে মনে মনে গালি দিছো সেটাও বুঝছি। তোমাকে আগেও বলছি মনে মনে কিছু বলবা না। তুমি যখন সরাসরি আমাকে কিছু বলো তখন আমার কিছু হয়না। কিন্তু মনে মনে যখন বলো তখন বুকে ব্যথা লাগে।আর এমন করবা না। আমার কথা গুলো তোমাদের কাছে ঝাল হতে পারে।তবে এটা সত্য আমার নিজের থেকেও তোমাদের বেশি ভালোবাসি।” আমি নিস্তব্ধ হয়ে উনার কথা অনুভব করছি। কথাটা আমার কাছে অনেক সত্য মনে হয়। মানুষটা খুব সাদা সিধে কিন্তু ভিতরটা অনেক বড়। তেমন উচ্চবিলাশিতা উনার মাঝে আমি কখনো দেখিনি। এমন না হলে আমার মত একটা ছেলের সাথে কি করে মিতুর বিয়ে দিতে পারে?
ফ্রেশ হয়ে খাবার খাওয়ার পর একটু বসতেই মিতু কঠিন করে আমাকে বললো “আব্বা তোমাকে তখন কি বলছে?” আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম “তোমার ঠ্যাং বেশি লম্বা হয়ে গিয়েছে।টাইট দিতে বলেছে।আমাকে এইভাবে একা যেন ফেলে না আসো।” মিতু চুপ করে রইলো আমার কথা শুনে।চুপ করেই তার লজ্জা লজ্জা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আমি জানি মিতু কখনো আমাকে একা ছাড়বে না।একা ছাড়ার মত ও মেয়ে না। আমি তার লজ্জা লজ্জা চোখের দিকে ভালো করে তাকাই।অনুধাবন করি সে যখন আমাকে তার করে নেওয়ার জন্য চাইলো তখন এই লজ্জা লজ্জা চোখ দুটো কি কেপে উঠেছিল? মিতুকে যখন আমি পড়াতাম তখন সে সবে মাত্র অনার্সের প্রথম বর্ষের শেষের দিকে। আর আমি মার্ষ্টাস শেষ করে চাকরির জন্য এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে টিউশিনি করে বেড়াচ্ছি। মিতুকে পড়ানোর আগে আমি একজনকে ভালোবাসতাম। এই ভালোবাসাটা হয়তো আমার জন্য ছিল না। সেই অনার্স অধ্যায়ের জীবনের শুরু থেকে লাবিয়া নামের চমৎকার মেয়েটাকে আমি ভালোবাসতাম। তাকে যখন আমার ভালো লাগার কথা প্রথম জানালাম সে কিছুই না বলে শুধু হেসেছিল।আমি উদ্ভেগপূর্ণের মত তাকিয়ে সেই হাসির অর্থ খোজার চেষ্টা করেছিলাম।কিন্তু আফসোস সেই হাসির অর্থ আমি বুঝতে পারিনি।এরপর কয়েকটা মাস কেটে গেছে। একদিন সে আমাকে বললো “জাহেদ আমাকে নিয়ে কবিতা লিখবি?” আমি তাকে জানাই আমি কবিতার ক এই জিনিসটাই বুঝিনা।তোকে কবিতায় মুগ্ধ করবো কিভাবে?” পরে তাকে কবিতা দিয়ে মুগ্ধ করতে না পারলেও আমার ভিতরে ভয়ংকর ভালোবাসার যে ছায়াটা ছিল সে ছায়ার মাঝে আমি তাকে ভালোবাসার গল্প শোনাতাম। আমার ভালোবাসার গল্প। এরপর ওর সাথে আমি দুবছর প্রেম করেছিলাম।কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের সম্পর্কের কোন নাম দিতে পারিনি।শুভ্রমাখানো রোদ্রের নীল আলো আর কুয়াশার উম্মাদ করা সৌন্দর্যটা যেন আমি হারাতে লাগলাম। একদিন হুট করে এসে আমাকে বললো “আমাকে নিয়ে পালাতে পারবি?” আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, ভাবলাম সে আমার সাথে মজা করছে।আমার চুপ থাকা দেখে সে বললো “কি ভয় পাইছিস?” আমি কিছু বলতে পারি না।পুরো সময়টায় নিস্তব্ধ হযেছিলাম।
এর কয়েকদিন পরই ওর বিয়ে হয়ে যায়। আমি কিছু করতে পারিনি।সত্য বলতে কি আমি ভয় পেয়েছিলাম তবে নিজেকে নিয়ে নয় লাবিয়াকে নিয়ে।আমার বুঝার উচিৎ ছিল আমার মত ছেলে কি করে এমন ভালোবাসার গল্প শুনাতাম। কি করে এমন ভালোবাসার স্বপ্ন আঁকার আশা দেখাতাম?এই স্বপ্ন আকাঁর রং তুলি কি আমার কাছে ছিল? যার কেউ নেই। মা বাবাকে হারিয়েছি সেই ছোট বেলা থেকে। আমার বাবা মা ছিলেন ডাকাত দলের সদস্য।বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রামে তারা ছদ্মবেশে বসবাস করতো।গ্রামে কার কেমন অবস্থা সেগুলো জেনে তাদের সর্দারকে জানিয়ে দিত।পরে সেই গ্রামে রাতের অন্ধকারে চলতো ডাকাতি। বিষয়টা একসময় অন্য এক গ্রামে যখন জানাজানি হয়ে গেলো ঐ গ্রামের লোকেরা আমার মা বাবাকে বাঁচতে দেয়নি। আমি তখন অনেক ছোট। হাউমাউ করে সারাদিন কাঁদতাম।আমার দু চোখে এমন জলের স্রোত দেখে রহিমা বেগম কি বুঝতে পেরেছিল আমি জানি না। আমাকে তার সন্তান মনে করে বুকে টেনে নিয়ে বললেন “আমার বাচ্চাটা কাঁদিস ক্যান?” আমি তারপরও কাঁদতাম। উনার স্বামী আর ছেলে নদীতে লঞ্চ ডুবে মারা গিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে আমি উনার ছেলের মত উনার কাছে বড় হলাম।কিন্তু ভালোবাসা বড় অসহায়। এই ভালোবাসা আমাকে নিয়ে খেলতে বড় আনন্দ পায়। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে আমার পালিত মা রহিমা বেগম আমাকে ফোন করে বললেন “বাবারে, আমার স্বামী আর ছেলেটা আমাকে কিছুদিন ধরে ঘুমের মাঝে ডাকে। আমার ছেলেটা বলে “আম্মা তুমি কবে আইবা আমাদের কাছে? বাজান তুমি কি কষ্ট পাইবা আমি ওদের কাছে গেলে?” আমি তখন কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম “আমি তোমাকে যাইতে দিব না মা। আমাকে ছেড়ে তুমি যাবা না কথা দাও। আমি একেবারেই একা হয়ে যাব।”
কিন্তু আমার পালিত মা কথা রাখেননি। আমি অনুভব করলাম আমার জীবন থেকে সব আলো হারিয়ে গেছে একেবারেই হারিয়ে গেছে। এই হারিয়ে যাবার মাঝে আলোটা কখনো আমি আর খুজে পাই না। যেখানে আলো খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানে লাবিয়াকে কোন সাহসে বলবো “মেয়ে চলো পালিয়ে যাই?” এরপর আমি আর কখনো লাবিয়াকে এমন করে চাইনি। কেমন করে চাইবো? অন্যের সম্পত্তি চাওয়া যে খুব অন্যায়। তারপর কি করে আমার জীবন চলছিল আমি কিছুই উপলব্দি করতে পারিনা। এমন জীবন চলার মাঝেও মার্ষ্টাস শেষ করে মিতুকে পড়ানোর একটা দায়িত্ব পাই। আমি তখন মিতুদের এলাকায় ব্যাচেলর থাকতাম।কিন্তু মিতুকে চিনতাম না। দিন যায় মাস যায় মিতুকে পড়ানোর দায়িত্বটা ঠিকঠাক মত করতে লাগলাম। একদিন মিতু আমাকে বললো “একটা কথা বলি?” আমি মাথা নেরে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। মিতু কিছুটা সময় নিয়ে বললো “আপনি নাকি একজনকে ভালবাসতেন?” কথাটা শুনে আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।আমার চোখ ছলোছলো করে। তারপর খুব গভীর হয়ে বললাম “হ্যাঁ” ঐদিন মিতুকে আমি পড়াইনি।শুধু ঐদিন না, এর পরের দুইদিনও আমি মিতুকে পড়াতে যাইনি।দুইদিন পর মিতুকে যখন পড়াতে গেলাম ওর মনটা আমি মেঘলা আকাশের মত বিষন্ন দেখেছিলাম। পড়ার মাঝখানে সে আমাকে ইতস্তত হয়ে বলেছিল “পড়াতে আসেন নি কেন দুদিন? আমি আর আপনাকে এমন কথা বলবো না।কষ্ট পেয়েছেন?” এরপর আরও একটা বছর কেটে যায়। আর এদিকে আমি চাকরির জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করি। এই সমাজটা অনেক নিষ্টুর। চাচা মামা না থাকলে সহজে চাকরি পাওয়া যায় না।একদিন বিকেল বেলার সময় মিতুকে যখন পড়াতে গেলাম তখন দেখলাম মিতু চুপচাপ বসে ছিল।আমাকে দেখেই সে তার আব্বাকে বলতে লাগলো “আব্বা উনাকে বলে দেন আমি আজকে পড়বো না। মন ভালো নেই।”
মিতুর বাবা বললো “ক্যান আম্মা তোমার মনের আবার কি হইছে?” মিতু বললো “আপনার মেয়ে যে বড় হইছে সেটা আপনি কি বুঝেন? রাস্তা দিয়ে আসলে বদমাইশ ছেলেরা ড্যাব ড্যাব চোখে তাকায় থাকে” মিতুর বাবা মিতুর মায়ের দিকে তাকায়।মিতুর মা কান্নার সুরে মিতুর মাথায় হাত বুলিযে বললো “আমার মেয়েটারে কে কি বলছে?” আমি চুপ হয়ে থাকি। কি হতে চলছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মিতু বললো “এখনো কেউ কিছু বলে নাই। কিন্তু বলতে কতক্ষন? আপনার মেয়ের বয়স হইছে না? বয়স হলে বিয়ে দিয়ে অন্যের উপর দায়িত্ব দিযে দিতে হয়। আমাকে নিয়ে আপনারা কত চিন্তা করেন। আপনাদের চিন্তা দেখে আমার আর ভালো লাগে না আব্বা।” কথাটা শুনেই সবাই অবাক হয়ে রয়েছিলাম।আমাদের অবাক হয়ে থাকা দেখে মিতু আবার বললো “বিয়ের জন্য জানি পাত্র খুঁজতে আপনাদের অনেক কষ্ট হবে।এই কষ্ট টুকুও যেন আপনাদের না হয় সেজন্য যদি বলেন মাষ্টারকে বিয়ে করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যে কবুল বলে নিব আব্বা।” আমার তখন কি রকম অনুভুতি হয়েছিল আমি জানি না। আমি পুরো বলদ হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে কাশতে কাশতে আন্টিকে বলেছিলাম “এক গ্লাস পানি দিবেন?” রাত্রে যখন নিরবতা ছড়িয়ে পড়ে আমি প্রায় চিন্তা করি মিতু আমার মত ভালোবাসাহীন একটা মানুষকে এমন করে কেন চাইলো? এই চাওয়ার পূর্ণ মর্যাদা আমি কখনো দিতে পারবো? একজন মেয়ে হয়েও এমন সাহস নিয়ে আমাকে চাইলো। আমার ভিতরে কি এমন ভালোবাসা দেখলো যা মিতুকে আচ্ছন্ন করেছিল? আমি আজও তা বুঝে উঠতে পারিনা।
গতকাল অফিস থেকে ফেরার পথে ফেলা আসা ভয়ংকর চাপা কষ্টের সাথে সম্মুখীন হয়েছিলাম আমি।কত বছর পর লাবিয়ার সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখেই সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো তারপর বললো “কেমন আছেন?” ওকে দেখে বুকের ভিতর যতটা চাপ অনুভব করলাম তারচেয়ে বেশি চাপ অনুভব করলাম কেমন আছেন শব্দটা শুনে।সময়ের সাথে সাথে মানুষও পরিবর্তন হয়ে যায়।বর্তমান নিয়ে বাঁচতে চায়।অতীতকে ভুলতে চায়। বললাম “ভালো আছি। তোমার সাথে আবার দেখা হবে ভাবিনি।তার ছোট্ট মেয়েটাকে দেখে বললাম “এটা তোমার মেয়ে? কি নাম? তোমার মত হযেছে দেখতে। স্কুলে ভর্তি করিয়েছো?” সে কিছু বলেনা শুধু আমার দিকে তাকিয়েছিল তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “বিয়ে করেছেন?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। সে খুব ভালো বলে শব্দ উচ্চারন করে। তার মেয়ে বলে “উনি কে আম্মু?” আমি যেই বলতে চেয়েছিলাম তোমার আম্মুর বন্ধু।কিন্তু তার আগেই লাবিয়া আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললো “তোমার মামা।”
আমি এই কথার কি প্রত্যুত্তর দিব বুঝতে পারিনি।খানিকটা সময় ঝিম মেরে ছিলাম আর আমার আঁকা আয়না গুলোকে অনুভব করে বুঝলাম আয়না গুলোতো কবেই হারিয়ে গেছে এখনতো এই ছোট্ট মামনিটার মামাই হই তবে এই আঁকা আয়ানা গুলো মাঝে মাঝে বুকের ভিতর এসে এমন করে ছ্যাত করে উঠে কেন? যে আয়না গুলো হারিয়ে গেছে।এই আয়না গুলোর এতো সাহস কেন? তারপর বাসায় আসার পর আমার চেহারার এমন বিষন্নতা দেখেই মিতু জানতে চাইলো “কি হয়েছে?” আমি তাকে কিছু বলিনা।কিন্তু সে কেমন করে যেন বুঝে ফেলে বললো “কি প্রাক্তনের কথা মনে পড়ছে? আমি তারপরও কিছু বলিনা। রাত্রে ঘুমানোর সময় কিন্তু ঠিকি বললাম ব্যাপারটা। বলার পরই কেমন যেন হালকা হালকা লাগছিল।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মিতু পাশে নেই। একটা চিঠি দেখলাম “আমার ভালোবাসা তোমার প্রাক্তনকে ভুলাতে পারিনি।এই বিশাল আকাশের মাঝে আমার স্বপ্নগুলো হয়তো বিশাল না। এক সময় আমি ভাবতাম এই ছোট ছোট স্বপ্নগুলো দিয়ে আমি কবিতা লিখবো।একটা নতুন ভালোবাসার কবিতা।কিন্তু দেখো কবিতার মানুষটাই আধাঁরে তলিয়ে যায়।একটা মেয়ে হয়ে বাবা মার কাছে নিজের ভিতরের লাজ শরম উপেক্ষা করে তোমাকে চাইলাম।তাতে কি হলো? আচ্ছা আমাদের ভিতরের কবিতা গুলো এমন কেন জাহেদ?”
আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে চায়। আমি জানি না মিতু, আমাদের ভিতরের কবিতা গুলো এমন কেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মেয়েটা রাত থেকেই আমার উপর অভিমান করে আছে।আর এই অভিমানেই তার বাবার বাড়ি চলে আসছে। আমি ছাগলের মত বসে বসে ভাবতে ভাবতেই মনে হলো একবার মিতুকে জিজ্ঞেস করি “মিতু তুমি আমাকে এমন করে কেন চাইলে?” আমি কথাটা যতবার বলেছি ততবার চুপ করেছিল। যেই আমি কথাটা বলতে যাব দেখি মিতু নেই। আমি উঠে জানালাটা খুলে দেই। এই রাতের রুপালি চাঁদের আলো জানালা দিয়ে প্রবেশ করে একটা রুপালি স্নিগ্ধ ছড়িযে দেয়। তাকিয়ে দেখি মিতু দরজার বাহিরের সিড়িতে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। ওদের এই বাড়িটাতে আসলে ভয়ংকার একটা ভালো লাগা কাজ করে। বিশেষ করে বৃষ্টির দিন। টিনের চালের ঝুম ঝুম শব্দ। রাতের বেলা উঠোন থেকে চাঁদ দেখার অনুভুতি। আমি আর কিছু না ভেবে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ওর মায়ামায়া চেহারার দিক তাকিয়ে বলি “অভিমান কমছে?” সে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় যার অর্থ আলগা পিরিত দেখাও? ব্যাটা গেলি।আমি ওর তাকানো দেখে হাসি। আমি ওর হাত ধরে বলি “আমার এই এক জীবনে তুমি ছাড়া আর কে আছে বলো তো? এমন মন খারাপ থাকা কি মানায়?” সে তারপরও চুপ করে রইলো। তার চুপ থাকা এমন বিষন্ন মন দেখে আমার মনটার মাঝেও বিষন্নতার ছোয়া লাগে।
আমি আকাশের দিকে তাকাই। এই রাত্রির আকাশের চাঁদটাকে কিছুক্ষন পর পর মেঘ ঢেকে দেয়। মিতু আমার দিকে তাকিয়ে বললো “এই মুখ এমন করেছো কেন? তোমার ধৈর্য্য শক্তি এতো কম কেন হ্যাঁ? অভিমান ভাঙ্গাতে গিয়ে নিজেই মন খারাপ করে ফেলছে। ” এবার আমি চুপ করে থাকি। আমি জানি এই মেয়েটা আমাকে কতটা চায়। মাঝে মাঝে আমার খুব খারাপ লাগে। প্রায় অনুধাবন করি একদিন মিতুকে বলবো মিতু তুমি আমাকে যত ভালোবাসো আমি তার থেকেও বেশি তোমাকে ভালোবাসতে শিখেছি। কিন্তু আমি পারি না প্রতিবারই ব্যার্থ হই আর আমার চিন্তা ভুল প্রমানিত হয় এবং মনে মনে বলি মিতু তুমিই আমাকে বেশি ভালোবাসো। এমন ভালোবাসার জন্য আমার মায়া হয়। আমার চুপ থাকা দেখে মিতু আমার হাত আলতো করে ধরে বললো “আকাশের চাঁদটাকে দেখো না।” আমি একটু গভীর হয়ে বললাম “আমার চোখের সামনে এমন চাঁদকে উপেক্ষা করে কি করে আকাশের চাঁদকে দেখি বলো তো? আকাশের চাঁদকে কিছুক্ষন অন্তর অন্তর মেঘে ঢেকে দেয়। কিন্তু আমার সামনে বসা চাঁদটাকে মেঘে ঢেকে দেয় না। এমন চাঁদের সৌন্দর্যের দৃশ্য আমার চোখে না এঁকে আকাশের চাঁদ দেখার ইচ্ছা নেই মিতু।” মিতু আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। আমি তার চোখের কোনে জল দেখি। সে মুখ ওপাশ করে চোখ মুছে বললো “এমন করে লাবিয়াকে পটিয়েছিলে তাই না?” আমি একটু হাসলাম কিন্তু কিছু বললাম না। সব কথার প্রত্যুত্তর দিতে হয় না। মাঝে মাঝে চুপ করে থাকতে হয়। আমি চুপ করেই আমার ভয়ংকর সুন্দর ভালোবাসার চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম…