অনেকটা দৌড়ে দৌড়েই সিড়ি দিয়ে নামলাম। গেইটের তালা খুলতে গিয়ে দেখি আমার হাতে চাবি নেই। ধ্যাত্তেরি! তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চাবি আনতেই ভুলে গেছি। আসলে যা যত দ্রুত করতে চাই তা করতেই বেশী দেরী হয়। এখন আবার চাবির জন্য চারতলায় উঠতে হবে।একবার সিড়ি দিয়ে উঠতেই আমার জান বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয় এখন তো দুইবার যেতে হবে। বান্দরনী গুলা চাবির কথা একবার মনে করিয়ে দিলোনা পর্যন্ত। সারাক্ষণ বালক বন্ধু নিয়ে ব্যস্ত তারা। আমার ইচ্ছে করছে ওদের দুইজনের গালে চারটা চড় বসিয়ে দেই। হারামী গুলা নিজের ফোনের ব্যালেন্স তো শেষ করেছে আবার আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর আমার ফোনের ব্যালেন্স ও শেষ করেছে। এই মাত্র আম্মুর সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ কল কেটে গেলো। আবার যখন কল দিলাম তখন ও পাশ থেকে জানান দিলো যে আমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ,দয়া করে যেন রিচার্জ করি। আমিতো বড়সড় মাপের টাশকি খেলাম। বলে কি? কালকেই তো দেখলাম ছাপ্পান্ন টাকা আছে। অথচ এখন দেখি ব্যালেন্স শূন্য। কোমরে হাত দিয়ে চোখ গরম করে ওদের দিকে তাকালাম। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা। কেউই স্বীকার করেনা। রান্নঘর থেকে এক বাটি শসা হাতে বের হয়ে আকলিমা বললো “আমি ভাই কাউকে ফোন দেই নাই। তোদের দুলাভাই নিজেই আমার ফোনে কল করে”। এবার লামিয়ার দিকে তাকালাম।লামিয়া বললো
-আমি শুধু দুই সেকেন্ড কথা বলছি। লাভ ইউ বলার আগেই বাবুর ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলো। আর আমার ফোনেরও ব্যালেন্স ছিলোনা। তাই তোর ফোন থেকে কল করে লাভিউ বলেই কেটে দিয়েছি। তুইতো জানিসই কল কাটার আগে আমার মুখ থেকে লাভিউ না শুনলে বাবুর ঘুম আসেনা
-ন্যাকামী বন্ধ করবি লামিয়া? তোর ফোনে ব্যালেন্স থাকে কোনদিন? তোকে আজ পর্যন্ত কখনোই রিচার্জ করতে দেখিনি। আর দুই সেকেন্ডেই ছাপ্পান্ন টাকা শেষ হয়ে যায়?
– তুই অদিতিকে জিজ্ঞেস কর। দ্যাখ ও কথা বলছে কিনা
– হারামীটা তো নাচতে নাচতে তার গুন্ডা মার্কা বয়ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে চলে গেলো। দেখি তোর ফোন দে। আম্মুর সাথে আমার ইম্পর্টেন্ট কথা আছে
-বললাম তো আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই। ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স ও নাই। তুই ইমার্জেন্সি নে না।
-নিতে পারলে কি আর বসে থাকতাম? তোরা দুইটা মিলে ইমার্জেন্সি টাও শেষ করছিস।
বাসার সামনের মোবাইল রিচার্জের দোকান টা বন্ধ। শুক্রবার দিন এই সময়টায় সব দোকান বন্ধ থাকাই স্বাভাবিক। সবাই দোকান বন্ধ করে জুমার নামাজ পড়তে যায় এই সময়। তবুও যদি কোন দোকান খোলা থাকে সেই উদ্দেশ্যে একটু সামনে এগুতে থাকলাম। সূর্যের আলোর কারণে আমি ঠিক মতো তাকাতে পারছিলাম না। তাকাতে হচ্ছে কপাল ভাঁজ করে চোখ কুচকে। রোদের উত্তাপ এতোই বেশী যে আমার মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি শুকিয়ে শুটকি হয়ে যাবো।
মাঠের ডান পাশেই একটা রিচার্জের দোকান খোলা আছে। দোকানদার লোকটা দোকানের শার্টার বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিলো তখনই আমি দূর থেকে ডেকে বললাম দোকান যাতে বন্ধ না করে। লোকটা খানিকটা অবাক হয়েই আমার দিকে তাকালো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ তাড়ায় আছে। মসজিদে গিয়ে নামাজ ধরতে হবে তাকে। সে আসলে দোকানদার লোকটা না, দোকানদার ছেলেটা। তার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম
-আপনার কাছে পঞ্চাশ টাকার জিপি কার্ড আছে?
-জিপি কার্ড সম্ভবত শেষ। আর এখন তো আমাকে মসজিদে যেতে হবে। নইলে জামায়াত ধরতে পারবোনা।
-আমার আর্জেন্ট লাগবে।
-তাহলে নাম্বারে ফ্লেক্সি করে দেই?
আমি আজ পর্যন্ত কখনোই ফোন নাম্বার দিয়ে রিচার্জ করিনা। কারণ এখান থেকে খুব সহজেই নাম্বার চুরি হয়। এখন অবশ্য আশেপাশে কেউ নেই যে নাম্বার বলার সময় শুনে শুনে কিংবা খাতা দেখে চুরি করবে। কিন্তু দোকানদার ছেলেটাকেও বিশ্বাস কিসের? রাত বিরাতে সেওতো ফোন দিয়ে জ্বালাতে পারে। আমি বললাম
-না থাক, আমার কার্ডই লাগবে।
আজ বাসার পাশের সব দোকান খোলা থাকলেও কোথাও কার্ড পেলাম না। একসাথে সব দোকানেরই কার্ড শেষ হয়ে গেলো? এরা কি মেয়েদের ফোন নাম্বার পাওয়ার জন্য ইচ্ছে করেই কার্ড রাখেনা নাকি? খুঁজতে খুঁজতে মাঠের পাশের সেই দোকানটায় এসে অবশেষে পেলাম। কার্ড দেয়ার সময় ছেলেটা একটাবার আমার দিকে তাকালোনা পর্যন্ত। ব্যাপারটা আমার জন্য বেশ অপমানজনক।
বাসার সামনের দোকান গুলোতে কার্ড পাওয়া যায় সম্ভবত কিন্তু আমি পাঁচমিনিট হেঁটে এসে এই ছেলেটার কাছ থেকেই কার্ড নেই। সাধারণত রিচার্জের দোকানদার গুলোর চেহারা খুব একটা সুন্দর হয়না কিন্তু এই ছেলেটার চেহারায় কেমন জানি মায়া আছে। গায়ের রং শ্যামলা যাকে বলে মিষ্টি রং। ছেলেটা আমার দিকে একবারের বেশী তাকায় না কেন এটা আমার কাছে অনেক বড় একটা রহস্য! নাকি সে কোন মেয়ের দিকেই তাকায়না? বান্ধবীদেরকে দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে একে। এখনকার দিনে এতো ভালো ছেলে আছে নাকি? আর রিচার্জের দোকানের ছেলেগুলোতো মেয়েদের দেখলেই তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এই ছেলে ব্যাতিক্রম।
পরীক্ষার ফল পেলাম। এই ছেলে কোন মেয়ের দিকেই একবারের বেশী তাকায়না। হ্যাঁ হুঁ ছাড়া কথাও বলেনা। যদি জিজ্ঞেস করি “বিশ টাকার জিপি কার্ড আছে” সে আছে বা নাই বলবে।মাঝে মাঝে সেটাও বলেনা। থাকলে ড্রয়ার থেকে কার্ড বের করে দেয় আর না থাকলে মাথা নেড়ে জানায় যে কার্ড নেই।
আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝলাম না। এই ছেলে আমার দিকে তাকায় না কেন? মাঠের সামনে দিয়ে যাওয়া আসার সময় অন্যান্য পোলাপাইন কত কথা বলে সেগুলো কানেই তুলিনা অথচ এই ছেলে কিছু বলেনা বা তাকায়না দেখে আমার কাছে কেমন জানি লাগছে। সে আমার দিকে তাকাতেই হবে এবং আমার সাথে কথা বলতেই হবে এইটা আমার কাছে কেন জানি বাধ্যতামূলক মনে হচ্ছে। আমার প্রতি তার কোন ইন্টারেস্ট নেই দেখে তার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট বেড়ে গেলো। এইটা নারী চরিত্রের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য।
ছেলেটাকে নিয়ে কেন জানি ভাবতে লাগলাম। কোন ছেলেকে নিয়ে কখনো মনের মধ্যে এরকম ভাবনা আসবে তা ভাবতেও পারিনি। কত সুন্দর,স্মার্ট,ধনী বাবার ছেলেইতো পিছু পিছু ঘুরছে, প্রপোজ করছে।তাদেরকে নিয়ে তো কখনো ভাবিনি। কি সুন্দর সাবলীল ভঙ্গিতে না বলে দিয়েছি তাদেরকে।
অথচ এই ছেলের প্রতি আমার আগ্রহের সীমা নেই। আমার প্রতি তার আগ্রহ নেই বলেই কি তার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ছে? প্রকৃতির এ কোন নিয়ম?তার নাম কি, কতদূর পড়াশোনা করেছে,বয়স কত, এসব জানার জন্য আমার প্রচুর আগ্রহ। আমি যে তার দোকানে প্রায়ই যাই আমার প্রতি কি তারও কোন আগ্রহ তৈরী হয়েছে?হয়তোবা হয়েছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা। সেও নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। আমার সম্পর্কে তাকে জানাতে হবে।কিন্তু নিজে থেকে গিয়েতো আর হুটহাট বলে ফেললে হয়না। কিভাবে জানাবো? হ্যাঁ! কিছুদিন আগেই তার দোকানে কম্পিউটার আর প্রিন্টার দেখলাম। সিভি বানানোর নাম দিয়ে তাকে আমার সম্পর্কে সব জানাতে হবে। তাই করলাম।আমার নাম তাকে দুবার বলতে হয়েছে। একবার বলার পর সে বললো “কি নাম বললেন?” আমি বললাম “সায়ামী জান্নাত”। কাউকে আমার নাম দুবার বলা এইটা নতুন কিছুনা কারণ একবার বললে কেউ বুঝেনা। দ্বিতীয় বার বলার পরে বেশ অবাকই হয় কারণ আমার নামটা একেবারেই আনকমন নাম। আমি আমার নাম ছাড়া আর কোথাও শুনিনি এই নাম। সায়ামী নামের অর্থ কি তাও জানিনা আমি। অনেকদিন অর্থ দেখবো দেখবো করে আলসেমী করে আর দেখাই হলোনা। আমার বন্ধুরা আমাকে চেতানোর জন্য “সোয়ামী ” বলে ডাকে আমাকে। আমার আরও অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিলো যেমন আমার হাইট পাঁচ দশমিক তিন, আমরা দুই ভাই এক বোন, আমার বাবার বিশাল বড় চাল ডালের ব্যবসা ইত্যাদি। কিন্তু এইসব সিভিতে লাগবেনা বলে বাড়তি কিছুই বলতে পারিনি।
আমি ফেইসবুকে খুব একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট চেক করিনা। কিন্তু ওকে আমার নাম বলার পর থেকে ডেইলি চেক করি নতুন কেউ রিকোয়েস্ট দিয়েছে কিনা আর তার প্রোফাইলে ওর ছবি কিনা। কিন্তু বারবার হতাশ হই।
রাতে ওদের কথা বলা দেখলে আমারও ইচ্ছে জাগতো ওর সাথে কথা বলার। কোনভাবে এর কাছ থেকে তার ফোন নাম্বার টা নেয়া যেতো যদি? তার টা নেয়া সম্ভব না।আমার টাতো তাকে দিতে পারি। আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম। আমি বলার আগেই ও ড্রয়ার খুলতে নিচ্ছিলো তখনই আমি বললাম “লোড নিবো, নাম্বার লিখুন আপনি”। যাক! নাম্বার টা দিয়ে আসলাম। আমার প্রতি যদি তার মায়া থাকে তাহলে সে নিশ্চয়ই ফোন করবে। এতোদিন ধরে তার দোকানে যাই নিশ্চয়ই আমার প্রতি তার একটু হলেও ভালোলাগা তৈরী হয়েছে। আর তার প্রতি আমার ভালোলাগা দিনদিন সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আচ্ছা আমার প্রতি তার ভালোলাগা তৈরী হোক এটা কেন চাচ্ছি আমি? আমি কি তার প্রেমে পড়েছি? এই বিষয়টাকেই কি প্রেমে পড়া বলে?
আমি প্রতিদিন তার দোকানে যাই আর দশটাকা করে রিচার্জ করি। সে কখনো বলেনা “ডেইলি দশ টাকা করে নেয়ার কি দরকার? একসাথে অনেকটাকা রিচার্জ করলেইতো পারেন।” তাকে এতোবার আমার নাম্বার বলেছি যে তার নিশ্চয়ই মুখস্থ হয়ে গিয়েছে এতোদিনে। আজকে নাম্বার বলার সময় প্রথম দুইটা ডিজিট বলতেই ও আমাকে থামিয়ে দিলো।ব ললো “লোড শেষ,আপনি কার্ড নিয়ে যান”। আমি বুঝলাম না ও হঠাৎ থামিয়ে দিলো কেন আমাকে? পাশে দাড়ানো ছেলেটাকি আমার নাম্বার নিচ্ছিলো আর এটা ও চায়নি বলেই কার্ড দিলো আমাকে? কি জানি।
আজকে দোকানে যাওয়ার পর আমি কি মনে করে যেন বলেই ফেললাম “আচ্ছা আপনি আপনার ফোন নাম্বার টা আমাকে দিন। আমার যদি কখনো রিচার্জ করার দরকার হয় তাহলে আমি আপনাকে ফোন করে জানাবো। ডেইলি ডেইলি আর আসতে পারবোনা আর তাছাড়া রাত বেশী হয়ে গেলেওতো আসা পসিবল না। আপনাকে কল দিলেই আপনি আমার নাম্বারে টাকা পাঠিয়ে দিবেন।”
বাসায় এসে ওর নাম্বার পাওয়ার আনন্দের সংবাদ টা ওদের তিনজনকে দেয়ার পর তিনজনই আমাকে গাধী বললো। বললো এতো ঘন ঘন যে রিচার্জ করি ও তো ভাববে যে আমার বয়ফ্রেন্ড আছে আর তার সাথে কথা বলার জন্যই আমি এতো বেশী রিচার্জ করি। কথাটা মন্দ বলেনি।
আমি সবসময় ওর ফোন বা মেসেজের অপেক্ষা করতাম। অথচ কখনোই ফোন আসতোনা। মাঝে মাঝে ফোন বেজে উঠলে কত আশা নিয়ে দৌড়ে যাই কিন্তু পরে দেখি গ্রামীণফোন থেকে আমাকে গান শোনানোর জন্যই ফোন দিয়েছে। আমার প্রতি জিপির এমন ভালোবাসা দেখে মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় জিপির সাথেই প্রেম করি। না চাইতেই সারাদিন কত সুন্দর সুন্দর মেসেজ পাঠায়। সেদিন দেখলাম নায়লা নাইমের সাথে দেখা করার সুবর্ণ সুযোগের মেসেজ পাঠিয়েছে। আমি মেয়ে মানুষ বলে এই সুবর্ণ সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলাম না। রিংটোনের আওয়াজ শুনে ভাবি ও বুঝে ফোন করেছে কিন্তু শেষে নিরাশ হই। ওর নাম্বারের জন্য আলাদা রিংটোন সেট করলাম যাতে বুঝতে পারি এইবার সত্যি সত্যিই ও ফোন করেছে।কিন্তু ফোন করার নাম গন্ধও নেই। আমি মাঝে মাঝে রিচার্জের জন্য ফোন দিলে সে হ্যালো বলে কত টাকা দিতে হবে তা জানতে চায় এর বেশী কিছুই বলেনা। কি জানি,ওর মনে হয়তো সেরকম কিছুই নেই।
বৈশাখের এক তারিখ। বিকেল বেলা শাড়ি পড়ে আমরা চারজনই ঘুরতে বের হলাম। আমাদের মধ্যে নিয়ম আছে যে জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবস, ভালোবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, এইডস দিবস, শিশু দিবস , হ্যান দিবস ত্যান দিবস যতো দিবস আছে এই দিবসগুলোতে কেউই কারও বয়ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা বা ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনালাপ করতে পারবেনা। দিবসগুলো আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে উদযাপন করবো। নইলে দেখা যাবে দুইজন দুইদিকে চলে যাবে, একজন সারাদিন কানের সাথে ফোন ধরে রাখবে আর আমি বলদের মতো বসে থাকবো।তা হয় নাকি?
সন্ধ্যার একটু পরে বাসায় ফেরার পথে দেখি মাঠে ছোট খাটো কনসার্টের মতো হচ্ছে। ওর দোকানে বসার জন্য চেয়ার বা বেঞ্চ কিছুই নেই। অনেক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে দেখে পাশের দোকান থেকে চেয়ার এনে বসার ব্যবস্থা করে দিলো। ওদের তিনজনের দায়িত্ব হলো ও আমার দিকে কয়বার তাকায় আর কতক্ষণ তাকায় তা গুনে দেখা। আমি ঠিক করেছি ওর দিকে তাকাবোনা। কিন্তু কালো শার্টে ওকে এতো ভালো লাগছে যে না তাকিয়েও পারছিনা। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে , তখন ঘুরে ওর দিকে তাকালেই দেখি যে ও সামনের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা মেয়েদের নাচ দেখছে। ওরা তিনজন ওকে শুনিয়ে এখন আমাকে নিয়ে কথা বলছে। কথায় কথায় ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমি এখনো সিংগেল, বেশ ভালো রান্না করতে পারি, ভালো ছবিও আঁকতে পারি, বউ হিসেবে আমার মতো আর দ্বিতীয় মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ সমস্ত কথা ওর কানে যাচ্ছে কিনা কে জানে?
রাত নয়টার দিকে বাসায় ফিরলাম। সারাদিন বাইরে ঘুরঘুর করে চরম মাত্রায় ক্লান্তি লাগছে। বাসায় ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। অন্যান্য বিশেষ দিনে আমি সারারাত ওর ফোনের অপেক্ষা করতাম। ভালোবাসা দিবসের সময়তো ধরেই নিয়েছিলাম যে ও আমাকে ফোন করে উইশ করবে কিন্তু করেনি। ওর প্রতি আমার অনুভূতি গুলো ও কি বুঝতে পারেনা? এতোটাই অবুঝ ও! আজকে আর সেইরকম কোন আশাই রাখলাম না। সব আশা বাদ দিলাম আমি। ঘুম লেগে আসছে চোখে তখন মনে হলো ফোন বাজছে। এটা নতুন কিছুনা,ওর ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সারাদিন আমার ফোনের রিংটোনটা আমার কানে বাজতে থাকে। এটাও হয়তো আমার বিভ্রম।তাই আর উঠে গেলাম না। চিন্তা করলাম ওকে নিয়ে আর ভাববোনা। যা হওয়ার নয় তা নিয়ে ভাবার কি দরকার টা কি? আমি ওকে নিয়ে এতো ভাবি, এতো কল্পনা করি অথচ তার কোন হেলদোল নেই। শুধু শুধুই এয়ারপোর্টে দাড়িয়ে জাহাজের অপেক্ষা করছি। সব জল্পনা কল্পনা মুছে ফেলতে হবে।
আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে অদিতি ফোনটা রিসিভ করলো। রিসিভ করে কথা বলেই উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে আমার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে উঠে বসালো। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম।কে ফোন করেছে? বাড়ি থেকে নয়তো? কারও বিপদ হয়নিতো। অদিতি গিয়ে আকলিমা আর লামিয়াকেও ডাকলো। তারপর তিনজনকে বারান্দার দিকে যেতে দেখলাম। আমি তখনো ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বসে আছি। বারান্দা থেকে তিনজনই হাসি মুখে ফিরে এসেছে । আমাকে জিজ্ঞেস করলো
-তোর পার্স কই?
আসলেই তো! আমার পার্স কই? বাসায় আসার সময় হাতে কেবল মোবাইলটাই ছিলো। আমি বললাম
-পার্স কই ? আমি তো জানিনা। কোথায় ফেলে আসছি? ও শীট! আমার টাকা, আইডি কার্ড সব ওটার ভেতরে। এখন কোথায় পাবো?
আমার কথা শুনে ওরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। এরা আসলেই হারামী। আমার পার্স হারানোটা এদের কাছে এতো আনন্দের বিষয় হয়ে গেলো? তিনজন মিলে আমাকে টেনেটুনে বারান্দায় এসে দাড় করালো। তার মানে এতক্ষণ যা দেখছি সবই স্বপ্ন? নইলে ও আমার বাসার সামনে আমার পার্স হাতে দাড়িয়ে থাকবে এটাতো সম্ভব না। শয়তানটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছি আর সে কিনা স্বপ্নে এসেও হানা দিচ্ছে।ধুরর,ঘুমুবোইনা আর। আকলিমা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো “কিরে, নিচে গিয়ে পার্স টা নিয়ে আয়”। ধাক্কা খেয়ে আমার হুঁশ এলো। তার মানে এটা স্বপ্ন নয়! আমি ওর দোকানেই পার্স ফেলে এসেছি আর সেইটা দিতেই আমার বাসার সামনে এসেছে। তারমানে ওইসময় ও সত্যি সত্যিই ফোন করেছে। তাড়াহুড়ো করে অদিতির গলায় ঝুলানো ওড়না টান দিয়ে কোনমতে গায়ে জড়িয়ে দৌড় দিলাম। লামিয়া পেছন পেছন চাবি নিয়ে নামছিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ও আমার হাতে পার্সটা দিয়ে বললো “ভালো করে দেখবেন সব ঠিক ঠাক মতো আছে কিনা? আমি এখন আসি”। ওকে এভাবে আসতে দেখে আমি এতোটাই অবাক হয়েছি যে ওকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেছি। আমার হয়ে লামিয়াই ওকে ধন্যবাদ দিলো।
বাসায় ফিরে আমি পার্স হাতে বসে রইলাম। আমার মাথায় কিছুতেই আসছিলোনা যে ও এতো রাতে কেন আসলো? কালকে সকালেওতো পার্সটা দিতে পারতো। ওরা আমাকে বললো পার্স খুলে সব আছে কিনা দেখার জন্য কিন্তু আমি কোন প্রয়োজন মনে করলাম না। পার্সটা বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
এরপর থেকে ওর দোকানে যতোবার যেতাম ও আমার দিকে কেমন যেন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতো। মনে হতো যেন ও আমার কাছ থেকে কিছু একটা জানতে চাচ্ছে। আমি ঠিক বিষয়টা বুঝে উঠতে পারলাম না। হঠাৎ করে তার এমন পরিবর্তন কেন? সে আমার কাছে কি জানতে চায়? যা জানার জিজ্ঞেস করলেইতো পারে। একদিন বলেও ফেলেছিলাম “কিছু বলবেন?” সে বললো “জিনা”।
আমার পার্সটা খুঁজে পাচ্ছিনা। পাশের রুম থেকে ওরা তিনজন দৌড়ে এসে আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুই বুঝলাম না। এরা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? এইদিকে আমি পার্স খুঁজে পাচ্ছি না । পার্সের টেনশনে আমি শেষ। আকলিমা বললো
-সায়ামীর বাচ্চা সোয়ামী, তুই এতো খারাপ এইটা ভাবতে পারি নাই।
-মানে? কি বলিস এইসব?
অদিতি আমার দিকে তেড়ে এসে বললো
-আমাদেরকে জানালে কি হতো? আমরা কি তোর ফ্লেক্সিওয়ালার দোকান থেকে টাকা না দিয়েই রিচার্জ করতাম?
-আমার ফ্লেক্সিওয়ালা মানে?
-চিরকুট আদান প্রদান করে প্রেম করো। তলে তলে এতোদূর আর আমরা কিছুই জানিনা।
-কিসের প্রেম? কিসের চিরকুট?
এরা এসব কি বলছে? কার সাথে চিরকুট আদান প্রদান করছি? আমি আমার পার্সের টেনশনে বাঁচিনা আর এরা কিনা! লামিয়া বললো
-চিরকুট মানে বুঝোনা তুমি? এইটা কি? এইটা আমাদেরকে দেখালো কি হতো?
এতক্ষণ লামিয়ার হাতের দিকে আমার নজর পড়লো। ওর এক হাতে আমার পার্স আর এক হাতে নীল রঙের একটা ছোট্ট কাগজ। পার্সটা দেখে যতোটা শান্তি লাগছে চিরকুটটা দেখে ততোটাই অবাক হচ্ছি।
-এটা আমার পার্সে ছিলো? কি লেখা আছে এতে?
-ঢং করবিনা বলে দিচ্ছি।
-আমি সত্যিই জানিনা। আমিতো এটা দেখিই নাই।
-আসলেই দেখিস নাই?
-খোদার কসম। আমি দেখিনাই।
“শাড়িতে আপনাকে অনেক বেশী সুন্দর লাগে তা কি আপনি জানেন? চোখে চোখ পড়ার ভয়ে আমি আপনার দিকে ঠিক মতো তাকাতে পারিনা। আপনি কি এটা জানেন আপনিই সেই মেয়েটা যাকে আমি এতোদিন মনে মনে খুঁজছি?
সিফাত”
চিরকুটটাতে এইটুকুই লেখা ছিলো। সিফাত ছেলেটা কে? দোকানদার ছেলেটা নয়তো? আমি সিওর হতে পারছিনা কিছুতেই। ওরা তিনজন হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর যে ওই ছেলেটাই সিফাত। একটা কাজ করা যায়। ছেলেটাকে একটা কল করে তার নাম জিজ্ঞেস করা যায়। এতো রাতে তাকে ফোন দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হবে? সে কি ভাববে? তার নাম যদি সিফাত না হয় তাহলে? অনেক ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি বের করলাম সবাই। সরাসরি নাম জিজ্ঞেস করলে সে নাও বলতে পারে তাই একটু পেঁচিয়ে বলতে হবে। আমি কথা বললে ছেলেটা চিনে ফেলতে পারে তাই অদিতি ওর নাম্বার থেকে কল দিলো। ছেলেটা কি বলে সেটা সবাই শোনার জন্য লাউডস্পিকার অন করে আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। শেষ মুহুর্তে ছেলেটা কল রিসিভ করলো। অদিতি বললো
-হ্যালো সিফাত বলছেন?
-জি বলছি। আপনি কে বলছেন?
-আমি আপনার শালী
এতটুকু বলেই অদিতি কল কেটে দিলো। আমাকে ঘিরেই তিনজন হৈচৈ করে নাচা শুরু করলো। খুশিতে আমার চোখ ভিজে এলো। আমি আরও কয়েকবার চিরকুটটা পড়ে দেখলাম। কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিলোনা। কখন দিলো এই চিঠিটা? সেদিন পার্সের ভেতর রেখে দিয়েছিলো মনে হয় । এতোবার পার্স টা খুললাম অথচ একবারও দেখলাম না কেন? ওরা আমাকে বললো এবার আমার নাম্বার থেকে ফোন দিতে কিন্তু আমি কল দেইনি। চিরকুটের জবাব চিরকুটেই জানাবো। আকলিমা বললো “এবার আর ট্রিট মিস হবেনা। বেশী কিছু করতে হবেনা খালি আমাদের সবার ফোনে একশো করে রিচার্জ করে দিতে বলবি”। ওর সাথে তাল মিলিয়ে অদিতি বললো “যাক বাবা,আমাদের আর চিন্তা কি? দুলাভাইয়ের দোকান থেকে ফ্রিতে রিচার্জ করবো”। আমি বললাম “আমি ওকে নিষেধ করবো ও যেন আর রিচার্জের দোকান না চালায়। নইলে তোরা দুইদিনেই তার ব্যবসার লাল বাত্তি জ্বালাবি। তোদের না হয় লজ্জা নেই কিন্তু তার তো আছে। বেচারা লজ্জায় পড়ে না ও করতে পারবেনা।” আমার কথা শুনে তিনজনই টাশকি খেয়ে তাকালো।লামিয়া চিৎকার করে বললো “চিন্তা কর অবস্থা টা। এখন থেকেই সে তার জামাইয়ের ব্যবসার উন্নতির কথা ভাবছে? জামাই পেয়েই আমাদেরকে পাত্তাও দিচ্ছেনা? জামাই বউ দুইজনেই কিপটা। তার রিচার্জের দোকান আছে সে চাইলে সারারাত সারাদিন ফোনে কথা বলতে পারে। সে চিরকুট পাঠালো?আর আমাদের সায়ামী আপাও বসে গেলেন চিঠি লিখতে।”
আমি চিরকুট লিখতে বসলাম। কলম কামড়ে বসে আছি। কি লিখবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। শেষে লিখলাম
“না জানালে জানবো কি করে? আমার তো আর অলৌকিক ক্ষমতা নেই। কিংবা আমি সাধু সন্ন্যাসী ও না যে চোখ বন্ধ করলেই সব দেখবো আর মনের কথা বুঝতে পারবো।
সায়ামী”
অদিতিকে দিয়ে চিরকুট টা পাঠালাম। বিনিময়ে ওকে দশটাকা দিতে হবে। এই ডিজিটাল যুগে দশটাকার বিনিময়ে ওরা তিনজনই পিয়নের দায়িত্ব পালন করতে রাজী হয়েছে। এক একদিন একেকজন যাবে আর তাকে আমি দশটাকা করে দিতে হবে। প্রথম কয়দিন দিবো এরপর বাদ। অদিতি আসার সময় আরেকটা চিরকুট নিয়ে আসলো। তাতে লেখা
“মনের কথা বুঝতে হলে অলৌকিক ক্ষমতা থাকা লাগেনা। বুঝে নিতে হয়। আপনি কি আমাকে বলেছেন আপনার মনের কথা? আমি তো ঠিকই বুঝে নিয়েছি।”
“হুম বুঝলাম আপনি অনেক কিছুই বুঝেন। তবে একটু দেরীতে বুঝলেন এই হলো সমস্যা। আর একটু দেরী করলেই তো ট্রেন মিস করতেন।”
“হাহাহা। আমি এতোটাও বোকা না। সময় বুঝেই সব কিছু করি। আমি এও জানি আপনি আমাকে মনে মনে গাধা গরু ভেবেছেন। এখন বুঝতে পারছেনতো কে গাধী?”
“আপনি আমাকে গাধী বললেন? আমি রাগ করেছি। আরও একটা কারণ আছে রাগ করার। আপনি আমাকে এখনো আপনি করে বলছেন। এরপরের বার আপনি করে বললে আমি কিন্তু আপনাকে ভাইয়া ডাকবো বলে দিলাম।”
এভাবেই আমাদের কথা হতো। ডেইলি একটা করে এইরকম ছোট ছোট চিরকুট দিতাম আমরা। এক চিরকুট যে কয়বার করে পড়েছি তার হিসেব নেই। কখন চিরকুট হাতে পাবো, তাতে কি লেখা আছে এটা জানার জন্য অস্থির হয়ে থাকতাম সারাদিন। প্রতিদিন যদিও দেখা হতো তবুও কোন কথা বলতাম না সামনাসামনি। কেবল একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে একটু করে হাসতাম। আজকে আমাদের দেখা করার দিন। আমি জানিনা সামনাসামনি আমি ওর সাথে কি কথা বলবো! বুকের ভেতরটা কেমন জানি ঢিপ ঢিপ করছে। ভয়ে নাকি চিন্তায় বুঝতে পারছিনা। আজিব! ওকে আমি ভয় পাবো কেন? আমি ওকে বিশ্বাস করি। ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আসছি।