‘দাদি, রেশমি কোথায়? ‘- মাটির ঘরের সামনে বসে থাকা রেশমির দাদিকে প্রশ্ন করল রিপন। অনেকটা পথ দৌড়িয়ে আসাতে হাপিয়ে গেছে রিপন, তাই এসেই ঘরের মেঝেতে বসে পড়েছে। বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে উত্তরের আশাই দাদির মুখখানার দিকে তাকাল। দাদি রিপনের দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইল।
‘ কি হল দাদি! বোবা হয়ে গেলে নাকি, আমার কথার জবাব দিলে না যে!’
‘ পানি খাবি?’
‘ আজিব তুমিও দাদি। জিগ্যেস করলাম, রেশমি কয়, আর তুমি বল পানি খাব কিনা। আমি কি তোমার কাছে পানি চাইছি? রেশমিকে চাইছি, দয়া করে দাদি রেশমিকে একটু ডেকে দাও না’
‘ পানি খাইতে বলছি, বিষ খাইতে বলি নাই। আর রেশমি তো পং্খীরাজ ঘোড় কি না যে উড়ে যাবে, সে আছে ঘরে’
‘ দাদি মাফ চাই তোমার কাছে, আমার ভুল হইছে তোমাকে বলা। পারলে রেশমিরে ডেকে দাও, সাথে পানি পাঠিয়ে দিও’
‘ আচ্ছা,ঠিক আছে। ডেকে দিচ্ছি। তোদের জ্বালায় কোনদিন যে মরে যায়, আল্লাহ জানে’
এই বলে দাদি ঘরের ভিতর চলে গেল। আর রিপন বারান্দায় উঠোনের দিকে মুখ করে বসে রেশমির আসার অপেক্ষায় রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পর রেশমি আসলো। এসে চুপচাপ রিপনের পিছনে দাড়িয়ে থাকলো। ডাকতে ভয় করছে রিপনকে, কে জানে আজ কি কারণে তাকে প্রয়োজন হল। রেশমি আসছে কি দেখার জন্য পিছন ফিরে তাকাতেই দেখিতে পেল সে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা এমন কেন, সবসময় ঘাবড়ে দেয়, মনে মনে ভাবছে রিপন। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে নয়তো রিপন একটা জমদুত যে এখনি তার জান কবজ করে নিয়ে যাবে।
‘ তুমি এসে দাঁড়িয়ে আছো, অথচ আমাকে ডাকলে না কেন?
‘ কিছু বলবেন আমাকে! আমার দেরি হচ্ছে, পড়তে বসেছিলাম। সামনে পরীক্ষা আমার। এই নিন পানি, দাদি আপনাকে দিতে বলেছে’
এমন উত্তরের জন্য মোটেও রিপন প্রস্তুত ছিলনা। হাত টেনে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে পানি শেষ করলো।
‘ কেমন আছ?’
‘ কেমন থাকতে পারি, তা অবশ্য আপনার অজানা না। আর যদি জানা না থাকে তাহলে জেনে নিন আমি ভাল আছি।’
কি ঝাজ মেয়েটার কথায়। এই মেয়েকে নিয়ে আর যাই হোক সংসার হবে না। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে যা বলতে এসেছে তা আর বলা হবেনা রিপনের। তাই নিজেকে কঠিন করার চেষ্টা করল রিপন। এমনিতেই রেশমির উপর রেগে আছে সে, তার উপর মেয়েটার ঝাঁঝালো কথা রাগের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
যদিও রেশমি রিপনকে ভীষণ ভয় পাই, তবুও সে তার ভীতিগ্রস্ত মনের অবস্থা রিপনকে দেখাতে চায় না। আর সে কারণেই রিপনকে শুরুতেই কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিল।
কি দিয়ে শুরু করবে, কিভাবে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না রিপন।
‘রেশমি, মাসুদের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?’- রিপনের এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে রেশমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। কি জবাব দিবে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মাসুদের সাথে কি সম্পর্ক তা যদি রিপনকে বলে, তা হলে সে সারাজীবনের জন্য রিপনকে হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু সে কোন কিছুর বিনিময়েও রিপনকে হারাতে চায় না। আবার অপমানের প্রতিশোধ নিতে হলে মাসুদের ব্যাপারটা বলতে হবে। কিন্তু সে যে রিপনকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, প্রতিশোধ কিভাবে নেবে তাহলে। ভালবেসেই প্রতিশোধ নেয়া যেতে পারে। এই ভেবে রেশমির ঠোটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল। হাসিটা ভালবাসার নাকি প্রতিশোধগ্রহণের বুঝা হয়ে উঠেনি । তবে এই ছোট হাসির ব্যাপারটা রিপনের চোখ এড়ায়নি।
‘কিছু বলছো না যে’- রিপনের প্রশ্ন
‘ মাসুদের সাথে কি সম্পর্ক তা আপনাকে বলতে যাব কেন, আর আপনি কে আমাকে এই প্রশ্ন করার।’- বেশ কঠিন হয়ে উত্তর দিলো রেশমি
‘ আমি তোমার কেউ না। তবুও জানতে চায়।’
‘ তার আগে বলুন, এই কথা আপনি কার কাছে শুনেছেন।’
‘আমি যার কাছ থেকেই শুনি, তা নিশ্চয় তোমার জানার বিষয় না।’
‘অবশ্যই বিষয়। আপনি আমার কোন কথা কারো কাছ থেকে শুনে এসে আমাকে বলবেন, আর আমি সব শুনে আপনাকে ঠিক ঠিক জবাব দিব, আপনাকে কে এই কথাগুলো বলবে তা জানতেও চাইব না, ভাবলেন কি করে আপনি। পেয়েছেন কি আপনি হ্যা। যা ইচ্ছে তা বলে যাবেন, আর আমি সবসময় তা সহ্য করে যাবো?’
রেশমির আগুনজ্বলা কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনলো, কিছু বললোনা। পাল্টা যুক্তির ইতিহাস থেকে উত্তর খুজে বেড়াচেছ রিপন।
রিপনের মত ছেলের উত্তর খুঁজে না পাওয়াটা বড়ই আশ্চর্যজনক। না কোনভাবেই রেশমিকে বুঝতে দেয়া যাবেনা।
‘আমি যার কাছ থেকে শুনেছি তার নাম বলা যাবে না। আর আমি ৩য় কোনো ব্যক্তিকে এই আলোচনায় আনতে চাইছি না।’
‘কি আশ্চর্য! আপনিই তো ৩য় ব্যক্তির কথা শুনে আমার কাছে ছুটে এসেছেন। ‘
রিপন চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। চলে যাবে এমন মুহুরতে রেশমি বলল
‘ কি, শুনে যাবেন না, আমার সাথে মাসুদের কি সম্পর্ক? ‘
‘ না, ইচ্ছে মরে গেছে’
‘ ও ভালো, ভালো। তবে আপনার ইচ্ছে মরে গেলেও, আমার ইচ্ছে মরেনি। আমার একটা উত্তর জানার ছিল। ‘
‘হুম, বল ‘
‘ আমি নাহয় বাদই দিলাম, আপনি এসব কার কাছ থেকে শুনেছেন বা কে আপনাকে বলেছে। কিন্তু, একটা বিষয় মাথায় আসছে না, হঠাত আমার ব্যাপারে আপনার এত আগ্রহ জন্মালো কেন?’
‘জানি না’
‘আচ্ছা, আপনি কি আমাকে ভালবাসেন? নাকি আপনার অপমানের মিশন এখনো শেষ হয়নি?’
রিপন নিশ্চুপ নিরুত্তর। খুব ইচ্ছে করছে বলতে হ্যা আমি তোমাকে ভালবাসি, সংকোচে বলতে পারলোনা।
‘ কি চুপ করে আছেন কেন? তাহলে আমি কি ধরে নিব, আপনি আমাকে আবার অপমান করার জন্য কোন পথ খুঁজে ফিরছেন। ‘
খানিকটা চুপ থেকে রেশমি আবার বলতে শুরু করলো-
‘ আমি আপনার কি এমন ক্ষতি করেছি যে আপনি আমাকে বারবার অপমান করে যাচ্ছেন। দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন।’
রিপন এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। অনেকটা চিতকার করে বলে উঠলো –
‘ আমি তোমাকে অপমান করছি? কোনদিনও না। ‘
‘ তাহলে কি করছেন? ভালবাসছেন নাকি?’
‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ ভালবাসি তোমাকে। ভালবাসি বলেই ছুটে এসেছি জানতে তোমার মনে আমি আছি কিনা। ‘
রিপন ভাবছে, ভুল করেনি তো সে। রেশমি যদি ফিরিয়ে দেয়! নিজের বিশ্বাসের প্রতি সুবিচার জানিয়ে রিপন এইবার খুব শান’ত কন্ঠে বলল-
‘ রেশমি আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে ভাল না বাসার অধিকার তোমার আছে। আমি তাতে কষ্ট পাবো না। আমার ভালবাসার কথা তোমাকে জানাতে পেরেছি, এতেই আমি সন্তুষ্ট, এই নিয়ে আমার মনের আর কোন অভিযোগ থাকবে না। যদি আমায় গ্রহণ না কর, তবে আমাকে ক্ষমা কর সেদিন তোমাকে অপমান করার জন্য। সেদিন যদি তোমাকে অপমান না করে গ্রহণ করতাম তাহলে আজ হয়তো আমার দিনটাই অন্যরকম হত ‘আর গ্রহণ করলে তো কোন কথাই নেই। প্রয়োজনে ভালবেসেই অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে নিতে পারবে।’
শেষাংশটি শুনে রেশমির হাসি পেল, বহু কষ্টে নিজেকে আটকালো। মনে মনে বলল, বাছাধন এইবার তো ধরা দিলে, পালাবে কোথায়। তোমাকে মনের এমন জায়গাই আটকে রাখব, চাইলেই তুমি হারাতে পারবে না। আর অপমানের প্রতিশোধ? শুধু তোকে ভালবাসবো, ভালবেসে যাব, এইটাই প্রতিশোধ, এইটাই তোর শাস্তি।
রেশমি মুখে কিছু বললোনা, রেশমির নিরবতা দেখে রিপন উল্টো ঘুরে হাটা শুরু করল। হাটতে হাটতে রিপন আশা করছে, রেশমি এইবুঝি তাকে ডাক দিয়ে বলবে আমিও তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু না, রেশমি ডাকলো না। আশাহত হয়ে রিপন কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে শুন্যের ‘শত আশা’ গান শুনতে শুনতে বাকি পথটুকু পাড়ি দিল।
রিপন এইমুহুরতে মাইশার সামনে বসে আছে। মাইশা সম্পর্ক এ রিপনের ফুফু হয়। বয়সের ব্যবধানে যদিও রিপন মাইশার বছর খানিকের বড়। তবুও রিপন মাইশাকে ফুফু বলেই সম্বোধন করে। রিপন তার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনায় তার ফুফুর সাথে শেয়ার করে, রেশমির ঘটনাও এর ব্যতিক্রম নয়।
‘ ফুফি, তোর কি মনে হয়, রেশমি আমাকে গ্রহণ করবে? ‘
‘ না, মনে হয় না। তুই রেশমিকে যে অপমানটা করলি, তাতে মনে হয় না, সে তোকে নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। আর করবেই বা কেন, তুই তো একদম ভরা মজলিশে সবার সামনে তাকে অপমান করলি। কি দরকার ছিল অপমান করার! ‘
মাইশা একটু খোঁচা দেয়ার চেষ্টা করল।
‘ আরে আমি কি ইচ্ছে করেই করেছি নাকি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, তাকে অপমান না করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু আমি তো ওকে ভালবাসি, তাই না’
‘ ভালবাসিস না ছাই! ভালবাসলে কি তুই তোকে লেখা রেশমির সব চিঠি পুড়ে ফেলতে পারতি? আহা! বেচারি কত কষ্ট করে তোকে চিঠি লিখল, আর তুই কিনা সব জ্বালিয়ে দিলি। আচ্ছা, তোরা পুরুষরা এত পাষাণ কেন বলতো।’
‘ হায়! হায়! কারে কি বুঝাইতে আসলাম, তোর কাছে আসছি আমার মনের দু:ক্ষ বুঝাতে, রেশমির দু:ক্ষ বুঝাতে না। তুই তো মেয়ে তাই মেয়েকেই সমর্থন করবি, স্বাভাবিক। আমার আর কেউ রইলো না রে।’
‘আরে না, থাকবে না কেন। রেশমি আছেনা?’
‘ আর থাকতে। থাকলে কি আর তোর কাছে আসি’
‘ তুই আসলেই একটা স্বার্থপর। এই নে, ধর’
মাইশা একটা ছোট প্যাকেট রিপনকে দিল।
‘ কি আছে এতে’
‘ খুলেই দেখনা কি আছে, দেয়ার সময় তো আমাকে আর বলে দেয়নি ভিতরে কি আছে! দেখ হয়তো কোনো অমুল্য রতন আছে।’
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে এপাশ ওইপাশ চারপাশ দেখল রিপন। নাহ, কারো নাম লেখা নেই তাতে। কি হতে পারে এই প্যাকেটে, খুলতে খুলতে একপশলা চিন্তা করে নিলো রিপন। প্যাকেট খুলছে তো খুলছেই কিন্তু খোলা শেষ হয়না। সেই সাথে হ্রদপিন্ডের ডিবডিব কম্পন ক্রমশ সমানুপাতিক হারে বেড়েই চলেছে। প্যাকেট খোলা অবশেষে সম্পন্ন হল। একটা ছোট চিরকুট, তাতে লেখা আছে-
‘ ভেবেছিলাম তোমাকে ফিরিয়ে দিব। আর বলব, পুড়িয়ে দেয়ার গান শোন। নিজের সাথে পারিনি কিংবা হেরে গেছি তোমার ভালবাসার কাছে। ভালবাসি। এর বেশি কিছু বলা মানে ন্যাকামি করা, আমি ন্যাকামি পছন্দ করি না। যদি সময় হয় তবে দেখে যেও, আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। সাথে চোখের জলকণার মূল্য দিয়ে দিও ভালোবেসে। ভালবাসি।’
গান বেজেই চলছে, ‘মাইলস’ এর ‘প্রিয়তমা মেঘ’।
দুই জোড়া চোখ মুখোমুখি, হেডফোনটা মাঝে শুধু সেতুবন্ধনের কাজ করে যাচ্ছে–
“তুমি ফুল নাকি প্রজাপতি, কি নামে ডাকি, রাতের আগুন জ্বলে, রাত জোনাকি, চোখেরি আলোয় আকা, পদ্দ পাতা জল, স্বপ্ন কাকণ বাজে, বাজে শতদল, প্রিয়তমা মেঘ, বৃষ্টি হয়ে ছুয়ে যাও প্রিয়তমা রোদ, ঊষ্ণতায় ছুয়ে দাও কোলাহলে কেন তুমি এসেছ, বসন্তে মাতাল, কেন ঘুম ভেঙ্গেছো, রুপালী আলো মেখে, হেসেছিল চাঁদ, স্বপ্ন আপন ভেবে, হেসেছিল রাত, প্রিয়তমা মেঘ, বৃষ্টি হয়ে ছুয়ে যাও, প্রিয়তমা রোদ, ঊষ্ণতায় ছুয়ে দাও।”
(সমাপ্ত)