জীবনে প্রথমবার একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিলাম। মেয়েটা ছিলো অন্য সব সাধারণ মেয়ের মতোই কিন্তু তাঁর মাঝে কিছু একটা লুকায়িতও ছিলো। যা আমি বুঝতে পারতাম। যেন পাহাড়ের অন্তরে গুপ্তধন। চোখদুটোয় তারার আলো খেলা করতো।
গালদুটো পাঁকা আপেলের মতো আর নাকটা কলা পাতার মতো মোলায়েম। বড় ভাইয়ার সাথে তুই-তুকারি সম্পর্ক ছিলো বলে মেয়েটার কথা বলে দিয়েছিলাম। ব্যাস কাজ হয়ে গেলো! এখন মেয়েটা আমার ভাবী!
তাঁদের একটা মেয়েও আছে, নাম ইরা!
বুকটায় ছিনছিন ব্যথা হয় তখনই যখন ভাবী বলে— উদয় তোমার ভাইকে একটু ডেকে দাওতো। আমার নাকফুলটা পাচ্ছি না!
আমার সাথে বিয়ে হলে হয়তো বলতো— ওগো, আমার নাকফুলটা পাচ্ছি না, একটু খুঁজে দাওনা!
তখন হয়তো আমি খুঁজে দিয়ে নাকফুলটা নাকে লাগিয়ে দিতাম!
বেশিদিন হয়নি আমার ভাবীর শোক কেটেছে! তখন আমি টইটই-ছইছই একটা ছেলে। ঘোরাফেরা করেই সময় কাটতো। দিন দুনিয়ার কোনো চিন্তা আমার মাথায় ছিলো না। এমন সময় কপালে একটা অদ্ভুত মেয়ে টিক্কা নাড়ে!
সে আমার জীবনের প্রথম এবং সর্বশেষ প্রেমিকা!
নাম ছিলো অনুয়া!
নামটার মতো সেও ছিলো অন্যরকম একটা মেয়ে। সে দুইটা কাজ খুব বেশি করতো। এক বকবক, দুই বই পড়া৷
বই পড়া মেয়েরা বেশি কথা বলে না৷ কিন্তু ও বলতো। ওকে আমি পড়ুয়া বলেই ডাকতাম।
তবে ওর বকবক আমার কাছে ছিলো কোকিলের গলায় শ্রাবণের গানের মতো। ওর কথা আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম অবিরত।
রোজ প্রভাতের সূর্য উঠার আগে ওকে আমার জাগাতে হতো। একদিন কোনোভাবে ভুলে গেলেই অনেক শাস্তি দিতো। ও আমাকে সবধরণের গুরুত্বপূর্ণ দিনে বই উপহার দিতো। আর প্রতি জন্মদিনে এক ডজন করে বই।
আমিও ওকে অনেক বই উপহার দিতাম। আর ওর দেয়া বইগুলো আমি কাছের মানুষদের দিয়ে দিতাম। কারণ আমার বই বা গল্প পড়ায় তত মন ছিলো না।
কিন্তু গল্পের প্রতি ওর ভীষণ টান ছিলো, ভালোবাসা ছিলো। লেখকদের ও খুব পছন্দ করতো। সারাদিন দেখতাম ও লেখকদের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে খোঁজা-খুঁজ করতো। আমার এক বন্ধু ছিলো লেখক। একদিন ওর সাথে অনুয়ার পরিচয় করিয়ে দেই, অতঃপর মাত্র এক মাসের মাথায় আমি অনুয়ার আর আমার লেখক বন্ধুটার বিয়ের দাওয়াত পাই!
শুনেছিলাম তাঁরা মধুচন্দ্রিমায় গিয়েছিলো সুইজারল্যান্ডে! আমাকে ও বিয়ে করলে হয়তো সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যেতে পারতাম না মধুচন্দ্রিমায়, কিন্তু কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন তো ভালোবেসেই কয়েকবার নিয়ে যেতাম!
লোকে বলে প্রথম প্রেম ভুলা যায় না।
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। কারণ অনুয়ার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে আমি কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। নেশা-সহ মানসিকভাবে যেন জলে পড়ে যাই! আমার উদ্ভট আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে ঠাস করে আমাকে বিয়ে করিয়ে দেয় পরিবারের লোকেরা।
নতুন বৌয়ের আদর ভালোবাসায় সত্যিই আমি অনুয়াকে ভুলে যাই। নাম আনিকা হলেও কখনো আমাকে এনে-খা বলেনি! আমার জন্য রোজ রাত্তিরে খাবার নিয়ে বসে থাকতো। তারপর দুজন একসাথে খেতাম।
ক্ষুধা পেলেও আমি খেতাম না। খাবার টেবিলে ওর সাথে একটু বেশি সময় কাটানোর জন্যে। ওর হাতের রান্নার জবাব নেই। মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলো বিধায় নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, আর আমাকেও বাধ্য করতো।
ফজরের আযানের আগে আমার কপালে ওর ঠোঁটের স্পর্শে জাগিয়ে দিতো। আমাদের মধ্যে যে ঝগড়া হতো না, তাও একদম নয়৷ ও মাঝে মাঝে আমার উপরে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যেতো। রাগের কারণটা বেশিরভাগ সময় ছিলো নামাজ না পড়তে পাড়ায়৷
আমি ওকে আনতে যেতাম। আনিকা আমাকে দেখেই কেঁদে দিতো, অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখতো। আমাদের প্রথম সন্তান ছেলে হয়। তিন বছর পরে আবার একটা মেয়ে৷ দুজনের নাম নাফিজ ও জীনাত।
তারপর হঠাৎ একদিন জীনাতের কান্নায় ঘুম ভাঙলো। ওর তখন এক বছর বয়স প্রায়৷ চোখ খুলে দেখি আনিকা নেই! তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সবাই মনে করে আনিকাকে ভূতপ্রেত তুলে নিয়ে গিয়েছে নতুবা কেউ গুম করে ফেলেছে! কিন্তু আনিকা একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলো।
আমি ঐ চিঠির কথা কাউকে বলি না। ও লিখে গিয়েছিলো— সাত বছরের পুরনো প্রেমিকের হাত ধরে আমি পালাচ্ছি, আমাকে ক্ষমা করবেন!
আমি পরে জেনেছিলাম, ভদ্র-প্রেমিকেরও দুটো সন্তান ছিলো, সেও স্ত্রী সন্তানদের একা করে হাওয়া হয়ে যায়৷ আজও তাঁরা দুজন নিখোঁজ!
আমি এই কথাগুলো কাউকে বলি না৷ তাহলে মানুষ আমার ছেলেমেয়েদের নষ্টা মায়ের ছেলে-মেয়ে বলবে!
কলিজার দুই টুকরাকে নিয়েই আমার নতুন জীবন শুরু হয়। একটু একটু করে দুজন বড় হতে থাকে। নাফিজ একটু বেশিই কান্না করতো মায়ের জন্য। তাই ওকে সামলানো খুব সহজ ছিলো না।
একদিন শখ করে একটা ছোট্ট ফ্রিজ কিনে এনেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত ফ্রিজটা গোলাপী রঙের হওয়ায় ছোট বোন শ্বশুরবাড়ি নিয়ে চলে গেলো!
কখনো আমি নিজের পছন্দে মোবাইল কিনিনি! ছোট বেলায় মামা দিয়েছিলো, তারপর যথাক্রমে বাবা, ভাইয়া, অনুয়া, আনিকা ও ভাবী কিনে দিয়েছিলো। বাজারে কালো একটা ফোন দেখে খুব পছন্দ হয়েছিলো। কিনে বাড়ি আনতেই মা বললো— দে টিপে দেখি কেমন মোবাইল কিনছিস!
ব্যাস, নিয়ে নিলো!
কোনোদিন নিজে পড়ার জন্য বই কিনিনি। বইমেলা থেকে হুমায়ুন আহমেদের একটা বই বাড়িতে কিনলাম পড়বো বলে। বাড়িতে আসার মাঝপথেই এক ভাতিজি বললো— চাচা আমার না হুমায়ুন আহমেদ খুব পছন্দ!
হয়ে গেলো না কাহিনী খতম?
শখ করে একটা ঘড়ি কিনেছিলাম জীবনে প্রথমবার। সে ঘড়ি এখন নাফিজের বন্ধু পড়ে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসে!
প্রতি ঈদে আমাকে কেউ না কেউ পাঞ্জাবি দিতো। তা দিয়েই ঈদ করতাম। সে বছর নিজের জন্য নিজের পছন্দে নীল একটা পাঞ্জাবি কিনলাম। সে ঈদে গোসলখানা থেকে বেরিয়ে দেখি নাফিজ ইতিমধ্যেই পাঞ্জাবি পড়ে ঈদগাহ মাঠের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে!
বাড়ির পাশে একটা এতিমখানা ছিলো। এতিমখানার ছেলেপেলেদের একটা মেয়ে এসে পড়াতো। মেয়েটা যেমন ভদ্র তেমন মমতাময়ী। জীনাতকে বলার পরে বললো— ভাইয়াকে বিয়ে করিয়ে আমাদের বাড়িতে আনা যায়। আমি দেখেছি উনাকে। অনেক ভালো।
এই কথাটা আমি এক বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করি। চারদিন পরেই শুনি তাঁর ছেলের বিয়ে! আর মেয়েটাও আর ছেলেপেলেদের পড়াতে আসে না!
মিষ্টি আমার খুব পছন্দ। কিন্তু বাড়িতে মেহমানেরা যতো মিষ্টি আনে সব যায় জীনাতের পেটে! আমাকে একটাও দেয় না! বলে মিষ্টি না কী ডায়াবেটিসের জন্য ক্ষতিকর!
হঠাৎ একদিন জীনাতের বিয়ে হয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হলেও জীনাতেরও মত ছিলো। মেয়ে মানুষ ছাড়া ঘর প্রাণহীন দেহের মতো। কিছুদিন যেতেই নাফিজ বললো— বাবা বুয়ার রান্না আমার ভালো লাগে না। আমি একটা মেয়েকে চিনি, অনেক ভালো রান্না করতে পারে।
— বুয়া হিসেবে রেখে দে৷
— উফ বাবা, বুয়া না, বুয়া না।
— তাহলে কী?
— শিক্ষিকা সে।
এটুকু বলে চলে গেলো। আমার আর কী বুঝতে বাঁকি থাকে? এমনিতে ওকে এমনই একটা মেয়ে বিয়ে করাতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া আমি কোনো মেয়েকে ওর জন্য পছন্দ করলে সে মেয়ে অন্যের ঘরেই যাবে নিশ্চিত। তাই ভালো রান্না করা শিক্ষিকা মেয়েকেই বিয়ে করালাম। এই মেয়েও আবার জীনাতের মতো মিষ্টি পেলে আর কিছু লাগে না!
সেও কোনোভাবে আমাকে একটি মিষ্টিও দিবে না! পরশু বললো ঘুষ দিলে ভাবতে পারে৷ আর ওর জন্য শাড়ির চেয়ে বড় ঘুষ আর কিছু হতে পারে না। মেয়েটা শাড়ি পড়তে ভীষণ পছন্দ করে। একটা শাড়ি দিয়ে যদি মিষ্টি পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কী?
ওর জন্য পছন্দ করে একটা শাড়ি নিয়ে বাড়িতে ফিরে দেখি লোকজনেরা পুত্রবধূকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলছে! কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই অনেকে বললো রান্না করতে গিয়ে গ্যাস দুর্ঘটনায় সারা শরীর পুড়ে গিয়েছে!
এরপর থেকে ও আর শাড়ি পড়তে পারে না। সারাদিন হুইলচেয়ারে বসে থাকতে হয়। আমি আর মিষ্টি চাই না কারো কাছে। শপথ করেছি আর আমি নিজে কোনো কিছু পছন্দও করবো না।