রুপা একটা ফুল গাছের কাছে দাঁড়িয়ে হাত টা ব্রিজের উপর রেখে নীল সাদা আকাশ টা দেখতে লাগল। আকাশ টা আজ খুব পরিষ্কার। আবহাওয়া অন্য দিন থেকে অনেক পরিবর্তন। আমি রুপার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রুপা চমকে উঠল। রুপা বুকে থুঃথুঃ দিয়ে বলতে লাগল ” তুমি মানুষ টা দেখতে যত গাধা তার চাইতে তোমার আচার – আচরণ গাধার আচরণের চাইতে অনেক বাজে । ” আমি নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিচের দিকে একটা পিঁপড়া কে দেখতে পেলাম। পিঁপড়া টা ভাত নিয়ে তার আবাস্থলে যাচ্ছে। তার ছেলে মেয়ে কে খাওয়ানো জন্য। আমি ইচ্ছা করে পিঁপড়া টা আমার হাতে তুলে নিলাম। তারপর তার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। তার বাসা টা বেশি দূরে না আমার হাতে এক হাত দূরে হবে। রুপা মিনমিন করে চেয়ে বলে ” তোমার থেকে পিঁপড়ার বুদ্ধি অনেক বেশি। ”
— আমি তো বিদ্যাসাগর না। যে আমার বুদ্ধি হবে। আমি হিমু।
— আগের থেকে তোমার অনেক সাহস হইছে । আগে তো ঠিক মতো কথা বলতে পারতে না । এখন তো চটপট করে কথা বলতে পারো।
— তোমার মতো ডেঞ্জারাস মহিলা থাকলে কে কথা শিখতে পারবে না।
— কি বললে আমি ডেঞ্জারাস মহিলা? আমি কেঁদে দিব কিন্তু।
— তোমার চোখের পানি দিয়ে আমি তাজ মহলের পুকুর ভরিয়ে দিব।
— পুকুরে কি পানির অভাব আছে যে আমার চোখের পানি লাগবে?
— পুকুরে পানি নেই তো। তাই তোমার চোখের পানি দিয়ে ভরিয়ে দিব।
— ওলে আমার গুলুগুলু বাবুটা।
— একদম ঢং করবে না বলে দিলাম।
বসে বসে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম। প্রিয় মানুষ কাছে থাকলে সব কিছু ভালো লাগে।
আমি একটা হলুদ পাঞ্জাবি পড়লাম। কাঁধে একটা ব্যাগ। আমার সাথে রুপা। রুপা একটা শাড়ী পরল। আজ তো রুপার ছুটির দিন। চাকরী করলে এই একটাই সমস্যা। ছুটির দিন ছাড়া অন্য কোনো দিন বের হওয়া যায় না। আমি তো বেকার। তাই প্রতিদিন ঘুরতে পারি । আমার কপালে চাকরী নাই। তাইতো রুপার টাকায় চলি। রুপা আমাকে খুব ভালবাসে। তাইতো সব দুঃখ কষ্ট ভুলে আমার সাথে আছে। রুপা একটু হেঁটে দাঁড়াল। তারপর আমাকে বলল ” হাটতে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ”
— তাইলে কোথাও বসি?
— বসে কি করব। ভালো লাগছে না। মাথা টা ঘুরছে। একটু পানি খাব।
আমি আশেপাশে থাকিয়ে দেখলাম কোনো দোকান আছে কিনা । তারপর একটা দোকান দেখলাম। সেখানে গিয়ে একটা পানির বোতল কিনে আনলাম।
রুপাকে দিলাম। রুপা একটু একটু করে সব পানি খেয়ে পেলল। আমি রুপার দিকে থাকিয়ে আছি। রুপার কি হল? রুপা এমন করতাছে কেন? রুপা ঘুমিয়ে থাকার জন্য আমার কাঁধে মাথা রাখল। আমি কিছু বললাম না। রুপা নিরবতা পালন করে ঘুমিয়ে থাকল।
বিকালবেলা প্রকৃতি এক নতুন ভাবে সাজে। এই বিকালবেলা কত কাঁপল হারিয়ে যায়। এক নতুন দিগন্তে। আমি আর রুপা তাদের মধ্যে এসে হাজির হলাম। রুপা আমাকে নিয়ে পুকুরের কাছে বসল। আমি পুকুরের দিকে চেয়ে আছি। পুকুরে দুই টা হাঁস সাতার কাটছে। রুপা হেসে হেসে বলল ” হিমু চলো সাতার কাটতে শুরু করি। ”
— তোমার কি মাথা খারাপ? আমি যদি সাতার কাটি তাইলে আমার জ্বর হবে। তখন আমার সেবা কে করবে?
— ইশ! তোমাকে সেবা করে কি লাভ? তুমি কি ভালো ছেলে। তুমি একটা ফাজিল ছেলে।
— আমি ফাজিল। তাইলে যাও আমি কথা বলব না । তুমি আমাকে ফাজিল ছেলে বলছ।
— ঢং কর না। সারাদিন শুধু শয়তানি কর। চাকরীর কিছু হলো?
— না। আমার চাকরীর কোনো ব্যবস্থা হয় নি।
— ইশ! লজ্জা করে না । আমি কয় দিন তোমাকে চালাব। মা-বাবা আমাকে লজ্জা দেয়। আমি একটা বেকার ছেলের সাথে প্রেম করি। আমি আর পারছি না।
— কিছু দিন সময় দাও। একটা ব্যবস্থা করে ফেলব।
— ৭ দিনের সময় দিলাম। এর ভিতরে চাকরী একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
— আমি চেষ্টা করব।
একটা ক্লাব ঘরে গিয়ে বসলাম। সবাই টিভি দেখতে লাগলাম। আমার মন টা উদাস। আজ তিনদিন হলো চাকরীর কোনো ব্যবস্থা করতে পারে নি। কি করব চাকরী করতে গেলে ওই আগে বলে মামু আছে মামু। আমি উত্তরে বলি না। তখন অফিসাররা মুচকি হাসি দেয়। আমি লজ্জা পেয়ে চলে আসি।
একটা চায়ের অর্ডার দিলাম। গালে হাত দিয়ে চিন্তাজনক মুখ নিয়ে বসে থাকলাম। চারপাশে মানুষ জন্য কত আনন্দ করতে থাকল। তাদের মনে কত আনন্দ উল্লাস। শুধু আমার মনে কষ্টের চাপ।
৭ দিন পর রুপার কাছে গেলাম। রুপার কাছে গিয়ে মাথা নিচের দিকে করে তাকিয়ে রইলাম। রুপা আমাকে ধমক দিয়ে বলে ” চাকরীর কোনো ব্যবস্থা হলো?
— না। হয় নি।
— তাইলে আমার কাছে বসে আসো কেন? লজ্জা করে না। এই মুখ টা আমাকে দেখাছ। চাও আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাও।
আমি কিছু বললাম না। চলে আসলাম। চোখের পানি এক দুই ফোটা পরল। সেটা রুপা দেখে নি। তবে বুকের ভিতর অনেক কষ্ট হচ্ছে। কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। কোনো দিন রুপাকে ছাড়া থাকি নি। জানি না থাকতে পারব কিনা।
রাতে শুয়ে আছি। এমন সময় ভাবলাম রুপা কে একটা ফোন দেই। এমন সময় কারেন্ট নিয়ে গেল। আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। তবে আবার কারেন্ট চলে আসল। মনে মনে ভাবলাম রুপাকে ফোন দিলে রুপা অভিমান করবে। বলবে সরি। এই সাহস নিয়ে ফোন দিলাম। সাথে সাথে ঘরের টিকটিকি আওয়াজ দিল। রুপা প্রথম ফোন কেটে দিল। আবার দিলাম। রুপা ফোন টা ধরে আমাকে বলে ” গাধার গাধা তোকে বলছি না আমাকে ফোন না দিতে। দেখছিস কেটে দিচ্ছি তারপর আবার ফোন দিচ্ছিস। ফোন রাখ। ” রুপা ফোন কেটে দিল। আমি এক মিনিটের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম । এক মিনিট পর মশা আমাকে একটা কামড় দিল। আমার জ্ঞান ফিরে পেলাম। আমি ভাবতে লাগলাম রুপা কে আমার মুখ টা আর দেখাব না। তাই সিম রাস্তায় ফেলে দিয়ে অন্য একটা শহরে চলে গেলাম। যেখানে রুপা আর কোনো দিন পাবে না। তাই করলাম। ঢাকায় চলে আসলাম।
৩ বছর পর আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ডাবের পানি খেতে লাগলাম। এমন সময় দেখি রুপা দূরের সূর্য টা দেখতে লাগল। আমি চলে আসতে যাব। এমন সময় দেখি রুপা আমাকে দেখতে পেল। রুপা একটা দৌড় দিয়ে আমার কাছে চলে আসল। আমার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকল। আমি কোনো কথা বললাম না। রুপা আমার দিকে চেয়ে বলে ” কেমন আছো?
আমি কিছু বললাম না। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে দাঁড়িয়ে তাকলাম। রুপা আবার বলল ” আমার উপর তোমার এতো অভিমান?
— আমি কারো উপর অভিমান করে নি। আমি কারো উপর অভিমান করতে পারি না । সে অধিকার আমার নেই।
— আমার কথা তোমার মনে পড়ত না?
— তুমি আমার কে? যে তোমার কথা আমার মনে পড়বে। আমি একা ছিলাম। আমি একা আছি।
— আমি তোমার জানু ছিলাম না ?
— আমার কোনো জানু নেই।
— আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছো। ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া কর না।
— সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আমি বাসায় যাব।
— আমার কথা তোমার একটুও মনে নেই।
— না। তুমি কে ?
— আমার বুকে ব্যথা করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। একটু পানি খাব।
আমি আর অভিমান করে তাকতে পারলাম না । আমার হাতে ডাবের পানি টা দিয়ে দিলাম। রুপা খেয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি হাত নাচিয়ে বললাম ” গাধী টা ঠিক মতো করে ওষুধ খেতে পার না?
রুপার চোখে পানি। রুপা আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি রুপাকে বললাম আমি বাসায় যাব।
— আমাকে নিয়ে যাবে না?
— না।
— কেন আমাকে নিবে না? ও তোমার বুঝি নতুন গফ হইছে।
— আমার কোনো গফ নেই। আমি একা।
— আমি যদি আবার তোমার জীবনে আসতে চাই আমাকে ফিরে দিবে নাতো।
— বললাম তো। আমি তোমাকে ভালবাসি না ।
— আমি তোমাকে আজও খুব ভালোবাসি। বাবা তোমাকে পছন্দ করতেন না। কারণ তোমার চাকরী নেই।
তাই তোমাকে ভুলে যেতে বলেছিলেন। তাই তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি। পরে আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। কিন্তু তোমাকে খুঁজে পাই নি। প্রতিরাত তোমার জন্য কান্না করতাম। তোমাকে কোথাও খুঁজে পাই নি। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি কি এমন শান্তি পেলে।
— আমি কাউকে কষ্ট দেই নি। আমার আকাশ একা।
— মিথ্যা কথা। তোমার আকাশ দুই টা। একটা আমি।
— তুমি আমার আকাশ না।
— এবার কিন্তু আমি কেঁদে দিব। কি পাইছ। আমার কি কষ্ট হয় না।
— তাতে আমার কি?
— ঠিক আছে। এতো দিন আমি বোকার মতো তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আমি আর তোমার জন্য অপেক্ষা করব না। এখন আমি বাবার ইচ্ছা মতো ছেলে কে বিয়ে করব।
আকাশ টা মেঘাচ্ছন্ন ছিল। অবশেষে বৃষ্টি চলে আসল। রুপা একটা দৌড় দিল। দৌড় দিয়ে একটা চাউনি তে আশ্রয় নিল। আমিও দৌড় দিলাম। আমার পকেটে রুপার একটা ছবি। সে ছবি আমি অনেক যত্নে রাখছি। কোথাও হারিয়ে ফেলে নি। আমি পড়ে যাই। রুপার পায়ের কাছে ছবি টা চলে যায়। রুপা ছবি টা তুলে আমার দিকে চেয়ে কান্না করতে থাকে। আমি বোকার মতো করে অন্য দিকে চেয়ে আছি। রুপা রাগি মুখ নিয়ে বলল ” এই টা কার ছবি?
— আমি জানি না।
— মিথ্যা কথা কইবে না। এই ছবি তোমার কাছে কেন?
— ছবি টা কে আমি অনেক ভালবাসি।
— ছবির মানুষ কে ভালবাস না ?
— না।
— কেন ভালবাস না?
— ছবির মানুষ টা খারাপ। আমাকে শুধু কষ্ট দেয়।
— আর কোনো দিনও কষ্ট দিব না। বিশ্বাস করো।
— সত্যি দিবে না?
— হ্যা। দিব না।
— ভালবাসি তোমাকে।
— সেটা বলতে হবে না।