ফেসবুক খুলেই নিউজফিডে দুজনের ছবি চোখে পড়ল নায়লার । দুজন পুরুষ কিম্ভুতকিমাকার মুখ বানিয়ে তাকিয়ে আছে ।এদের একজন হল নায়লার অফিসের কলিগ শফিক – আরেকজনকে চিনতে পারলনা ।শফিক একটা বান্দর টাইপের ছেলে- সারাক্ষণ ফাজলামি করা ওর স্বভাব। কিন্তু অফিসের কাজে আবার খুব সিরিয়াস। ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ ধরনের নেচার ওর । নায়লা স্ক্রল করে পরের নিউজ ফিডগুলো দেখতে থাকল।
–
এই জুন মাসেই কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে এখানে । আজ সন্ধ্যে থেকে আবার টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দেশে থাকলে এই রকম বৃষ্টিতে সুযোগ পেলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে গল্পের বই নিয়ে পড়ে থাকতে নায়লা খুব ভালবাসে। সেইসাথে পাশে যদি থাকে ধোঁয়া ওঠা গরম চা –তাহলে সময়টা তরতর করে পার হয়ে যায়। দিন সাতেকের জন্য একটা ওয়ার্কশপে প্রথমবারের মত ব্যাংককে এসেছে সে। এই কদিন খুব ব্যস্ততা ছিল-প্রতিদিনই ওয়ার্কশপ শেষে মিটিং, ডিনার সেরে রুমে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত নটা – এরপর সোজা ঘুম। আজই একটু ফ্রি টাইম। ব্যাংককের চাওপ্রায়া নদীর ধার ঘেঁসে একটা হোটেলে থাকছে নায়লা আর টিম- এখানেই ওয়ার্কশপ হচ্ছে । নায়লা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল । হোটেলের ৩ তলার রুমের জানালা দিয়ে নদীটি দেখা যাচ্ছে। কি যে সুন্দর লাগছে নদীটিকে সেইসাথে তার ছোট ছোট ঢেউ! কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে নায়লা তাকিয়ে রইল সেদিকে। বাইরে ঘুরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে- কিন্তু টিপ টিপ বৃষ্টির জন্য আলসেমিও লাগছে ।কাল ঢাকা ফিরে যাবে। শহর দেখার সময় নেই। মিটিং কনফারেন্স, ওয়ার্কশপে আসলে প্রতিবার এমনই হয় – শহর দেখার সময় থাকে না- প্লেন থেকে নেমে হোটেল এরপর মিটিং – মিটিং শেষে একটা বিকেল পাওয়া যায় কখনো সখনো –এরপর সোজা এয়ারপোর্ট ।
–
একা থাকলেই কত ভাবনা যে মনে এসে জড়ো হয় নায়লার! নাজমার মার কথা মনে এল।নাজমার মা নায়লার বাড়িতে কাজ করে-
– এই নাজমার মা তোমার বাড়িতে কে কে আছে ?
– এই আমি আর আমার মাইয়া নাজমা
– তোমার স্বামী কই?
– স্বামী নাই। হেয় মারপিট করত- একবার মাইরা আমার মাথা ফাটায়ে দিল। খালি যৌতুক নিবার জন্য মারত। তাই সালিশ বসাইয়া তালাক নিসি ।
– মানুষ কিছু বলে না তোমাকে?
– বলুক আফা- মাইনষের কথা হুনলে জীবন চলে না! মাইনষেতো আমাগো বসায়া ভাত দেয় না। অই মাইনষেগোর খারাপ কথা হুইন্না আমাগো কি হইব? সারাদিন খাইট্টা আমাগো ভাত আমাগোই যোগাড় করতে হয়-খারাপ স্বামীর চাইতে নাই স্বামী অনেক শান্তির।
–
নায়লা ভাবছিল, পরিবারের অমতে বিয়ে করাতে কত কথাই না শুনতে হয়েছিল তাকে। মা –বাবা প্রথম দিকে মেনে নেয়নি। শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা তার গায়ের রঙ, চেহারা নিয়ে এখনো তাকে কষ্ট দেয়। তাও শ্বশুরবাড়ির মানুষের সাথে খুব মানিয়ে চলার চেষ্টা করে নায়লা। পড়ালেখায় খুব ভাল ছিল সে। আর মামুন সাধারণ।কিন্তু মামুনকে এত ভাল লাগত! মামুন যখন হাসত – মনে হত এই হাসিমুখটি দেখার জন্য বিনিময়ে নায়লা সব কিছু করবে। বিয়ের পরপরই নায়লা বেশ ভাল চাকরি পেয়ে গেল। তখনও মামুন বেকার।বেতনের টাকা জমিয়ে জমিয়ে মামুনের হাতে তুলে দিলে মামুন কম্পিউটারের একটা ব্যবসা শুরু করে। এরপর কেমন করে যেন একটা সময়ে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল- মামুন সারাদিন খালি টাকা টাকা করত। নায়লা যথাসাধ্য জোগাড় করে মামুনের হাতে তুলে দিত ।এখন মনে হয় মামুনই ইচ্ছা করে এই দূরত্ব তৈরি করেছিল। শুধু টাকার প্রয়োজন হলেই মামুন তার সাথে ভাল ব্যবহার করে। নায়লা টের পায় ইদানিং মামুনের অনেক টাকা হয়েছে – এত টাকার উৎস কি তা নিয়ে কিছু জানতে চাইলেই বলে- “মেয়েমানুষের এত জানার কি আছে? কালা কুৎসিত গায়ের রঙ- খারাপ চেহারা -সুরত।এই কালা মাগি নিয়া কোথাও বের হইতে ইচ্ছা করেনা ।অফিসে গিয়া- বিদেশ গিয়া পুরুষ মানুষের সাথে রংঢং করতেসস – তাই কর্- আমার টাকার খোঁজ নিতে হবে না।“
–
– আমি যখন এতই খারাপ তোমার কাছে – তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? বিয়ের আগে তো ঠিকই ঘুরতে? আর তুই তুকারি কর কেন?
– তুই তুই এর যোগ্য তাই তুই তুকারি করি। প্রেম- বিয়ে করসিলাম টাকার জন্য – অইখানেও ঠক টাকাও ঠিকমত পাইলাম না, ফকিন্নির জাত!
–
ইদানিং গায়েও হাত তুলছে মামুন- কয়েকদিন আগে এত জোরে ধাক্কা দিল যে বিছানার কোনায় লেগে চোখের তলায় কালশিটে পড়ে গেল। অফিসে যেই ওকে দেখে চমকে উঠে – লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনা- কে কি ভাববে! সবাইকে বলেছিল হঠাত করে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বিছানার কোনায় ধাক্কা লেগে এমনটি হয়েছে ।
–
এইসব ভাবতে ভাবতে মন খারাপ যখন চরমে উঠেছে তখন শফিকের ফোন –
-নায়লা আপা কি করেন?
-কিছুই না!
-চলেন ঘুরে আসি
-কোথায় ?
-এদিক সেদিক
-বৃষ্টি হচ্ছে না?
-এইটুকু বৃষ্টি -চলেননা!
-আচ্ছা তুমি লবিতে অপেক্ষা কর- আমি আসছি ১০ মিনিটে।
–
হোটেল থেকে বের হয়ে তারা হাঁটতে শুরু করল। ফুটপাথে সারি সারি খাবারের দোকান থেকে থাই খাবারের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে । কত দেশ বিদেশের নানা ধরণের মানুষ দোকানগুলোতে ভিড় করেছে। বিক্রেতাদের মধ্যে বেশিরভাগই মেয়ে – এত মেয়ে দোকান চালাচ্ছে দেখে নায়লার ভালই লাগল। নায়লা বলল, শফিক চল একটা স্কাই ট্রেন নিয়ে ট্যুরিস্ট এলাকা সুকুম্ভিতে চলে যাই । এর মধ্যে বৃষ্টিও থেমে গেছে।
–
সুকুম্ভিতে বেশ একটা রমরমা ভাব- হোটেল- রেস্তরাঁ, মাসাজের দোকানগুলোতে লোকে লোকারণ্য ।আরও কিছুদুর হাঁটতে হাঁটতে তারা নানাপ্লাজায় চলে আসল। অনিন্দ্য সুন্দরী “লেডি বয়”রা নাইট ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে– এরা এত নিখুঁত “মেয়ে” যে বোঝার উপায় নেই যে- এরা মেয়ে নয়!
–
নায়লা চারিদিক দেখতে দেখতে হাঁটছিল- হঠাৎ একজন লোক সামনে এসে ভাঙা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল- “মাদাম, নিড সামওয়ান ? আই হাভ ক্যাটালগস – ইউ ক্যান চুজ “ বলেই মুহূর্তের মধ্যে পুরুষ আর নারীদের ছবি বের করে দেখানো শুরু করল । নায়লা ঘটনার আকস্মিকতায় থ’ খেয়ে গেল -কোনমতে বলল,”সরি – আই ডোন্ট নিড এনিওয়ান, থ্যঙ্কইউ ।”
–
পিছনে তাকিয়ে দেখে শফিক এক নাইট ক্লাবের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে।
এই শফিক – শফিক!
শফিক এক দৌড়ে নায়লার কাছে এল-
-আচ্ছা আপু, মামুন ভাইও কি ব্যাংককে এসেছেন?
-নাহ্ ও তো ঢাকায়।
– আমি যে দেখলাম এই ক্লাবের ভেতরে ঢুকেছেন?
নায়লা হেসে দিল-
– আচ্ছা চল- ভিতরে গিয়ে তোমার ভুল ভাঙ্গাই।
–
ক্লাবের ভেতরে উচ্চস্বরে গান বাজছে- নাচ চলছে- ভেতরে গিয়ে নায়লা হতভম্ব হয়ে গেল। এটা যে স্ট্রিপ ক্লাব! শফিক নায়লাকে দেখাল- এক কোনায় মামুন বসে আছে! সাথে কে? এক লেডিবয়কে বগলদাবা করে মামুনই যে বসে আছে!
নায়লার বুকের ভেতর একসঙ্গে হাজার হাতুড়ি পিটাচ্ছে- গলা শুকিয়ে কাঠ- এত প্রতারণা তার সঙ্গে! এত প্রতারনা! আর কিচ্ছু চিন্তা না করে নায়লা সরাসরি মামুনের সামনে এসে দাঁড়াল ।
–
ভূত দেখার মত চমকে উঠল মামুন – এরপর সামলে নিয়ে বাঁকা হাসি আর অদ্ভুত চেহারা করে বলল – এইখানে তুমি কি করছ নায়লা?
-আমি জানতে চাই তুমি কবে ব্যাংককে এসেছ, এখানে কি করছ?
– তা তোমাকে আমার জবাবদিহি করতে হবে নাকি?
– হ্যাঁ হবে
– আর একটা কথা বললেই একদম বের করে দিব – এই নাইট ক্লাবে আমার শেয়ার আছে । ঐ শফিক্কা শালারে আনছিস ওর সাথে দূর হয়ে যা !
–
হাতাহাতি- মারামারি কিছু একটা হয়েই যেত আজ যদি শফিক সঙ্গে না থাকতো- শফিক তাকে টানতে টানতে ক্লাব থেকে বের করে নিয়ে আসল । এরপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হোটেলের দিকে – সারা পথ নায়লা অঝোরে কাঁদল –
হোটেলে ফিরে শফিককে বিদায় দিয়ে সোজা চাওপ্রায়া নদীর ধারে এসে দাঁড়াল নায়লা। নিজেকে খুব ঘৃণা হচ্ছে তার। সংসারে অ্যাডজাস্টমেন্টের নামে নিজেকে ছোট করতে করতে কোন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে সে ! এত বড় চাকরি করে , এত টাকা বেতন পেয়ে মানুষের চোখে তথাকথিত ‘স্বাবলম্বী’ হয়েও তার যে কোন আত্মমর্যাদা নেই – যা নাজমার মায়ের আছে । সে যে একজন মানুষ- তা যেন ভুলেই গিয়েছিল। তাই দিনে দিনে তিলে তিলে একটি নষ্ট সম্পর্ক যা প্রতিদিন তাকে চুরমার করে দিয়েছে- তাকেই সে আঁকড়ে থেকেছে। মামুনের দেয়া প্রতিটি আঘাতে সেই তীব্র ভালবাসা তো কবেই বিন্দু থেকে প্রায় নাই বিন্দু হয়েছে।কেন সে শুধু ভেবেছে মামুনকে ছেড়ে দিলে মানুষ কি বলবে, সমাজ কি বলবে?
–
অনেকক্ষণ কাঁদল নায়লা। নদীর পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ওর মন শান্ত হয়ে এল। আস্তে আস্তে পানিতে পরম মমতায় হাত ডুবিয়ে নায়লা ফিসফিস করে বলল- চাওপ্রায়া নদী- তুমি সাক্ষী- মামুন আজ থেকে আমার জীবনে অতীত হয়ে গেছে । সে আর কোনদিনও আমার মর্যাদাকে নষ্ট করতে পারবে না- আমি প্রতিজ্ঞা করছি আজ থেকে আমি আমার মর্যাদা রক্ষা করবই । আমার নষ্ট ভালবাসাকে দূরে -বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে যাও, নদী। ঠিক এইসময় চাঁদের আলো কি চমৎকার ভাবেই না পড়ল চাওপ্রায়া নদীর বুকে! নদীর পানি সে আলোতে ঝিকমিক করছে । নায়লা অনুভব করল -ঢেউগুলো তার সমস্ত অপমান- লাঞ্ছনাকে দূরে বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক