প্রেমের গল্প – শ্যামল ছায়া

প্রেমের গল্প – শ্যামল ছায়া

খুটখুট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

কয়েক মুহূর্ত সে নিশ্বাস নিতে পারল না, দম আটকে এল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে রহিমার এরকম হয়। আজ একটু বাড়াবাড়ি হল, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ, ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে যাচ্ছে। রহিমা ভয় পেয়ে ভাঙা গলায় ডাকল, মজিদ মিয়া, ও মজিদ মিয়া।

মজিদ শেষপ্রান্তে থাকে। এত দূরে গলার আওয়াজ পৌঁছানোর কথা নয়। তবু রহিমার মনে হল মজিদ বিছানা ছেড়ে উঠেছে, দরজা খুলছে শব্দ করে! এই আবার যেন কাশল। রহিমা চিকন সুরে দ্বিতীয়বার ডাকল, ও মজিদ মিয়া ও মজিদ।

কিন্তু কেউ এল না। মজিদ তাহলে শুনতে পায় নি। চোখে পানি এসে গেল রহিমার। হাঁপাতে-হাঁপাতে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর একসময় হঠাৎ করে ব্যথাটা মরে গেল। নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। একটু আগেই যে মরে যাবার মতো অনুভুতি হয়েছে তাও পর্যন্ত মনে রইল না।

নিঃশব্দে খাট থেকে নেমে এল রহিমা। বালিশের নিচ থেকে দেয়াশলাই নিয়ে হারিকেন ধরাল। খুব আস্তে অনেকটা সময় নিয়ে দরজার খিল খুলল। রাতের বেলা ঝনঝন করে দরজা খুললে মজিদ বিরক্ত হয়। বাইরে বেশ শীত, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। কার্তিক মাসের শুরুতেই শীত নেমে গেছে এবার। বাঁ হাতে হারিকেন উঁচু করে ধরে পা টিপেটিপে মজিদের ঘরের পাশে এসে দাঁড়াল রহিমা। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে মজিদ এখনো জেগে। বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উবু হয়ে শুয়ে বই পড়ছে। ঘরের মেঝেতে আধ-খাওয়া সিগারেটের আস্তরণ। কটু গন্ধ আসছে সিগারেটের। রহিমা কোনো সাড়া শব্দ করল না। চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপতে লাগল।

রহিমা ভেবে পায় না এত রাত জেগে কী পড়ে ছেলেটা। পরীক্ষার পড়া তো কবেই শেষ হয়েছে। রহিমা অনেকক্ষণ হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে তার যখন ঝিমুনি এসে গেল তখন মৃদু গলায় ডাকল, ও মজিদ মিয়া।

মজিদ বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, ঠিক করে ডাকো মা। কী সবসময় মিয়া মিয়া কর।

রহিমা একটু অপ্রস্তুত হল। (মজিদকে মজিদ মিয়া ডাকলে সে রাগ করে কিন্তু রহিমার একটুও মনে থাকে না) রহিমা বলল, শুয়ে পড় মজিদ।

তুমি ঘুমাও গিয়ে। ঘ্যানঘ্যান করো না।

রহিম মৃদু গলায় বলল, জানালা বন্ধ করে দেই? ঠাণ্ডা বাতাস।

মজিদ সে-কথার জবাব দিল না। বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগল। রহিমা তবুও দাঁড়িয়ে রইল। তার ঘুমুতে ইচ্ছে করছিল না। কে জানে আবার হয়তো ঘুম ভেঙে যাবে, দম বন্ধ হয়ে যাবার কষ্টটা নতুন করে শুরু হবে। মজিদ রাগী গলায় বলল, যাও না মা, দাঁড়িয়ে থেকো না।

রহিমা জানালার পাশ থেকে সরে এল। মজিদকে তার ভয় করে। অথচ জন্মের সময় সে এই এতটুকুন ছিল। রাতদিন ট্যা-ট্য করে কাঁদত। মজিদের বাবা বলত, এই ছেলে বাঁচবে না গো, এর বেশি মায়া করলে কষ্ট পাবে।

ছিঃ ছিঃ কী অলক্ষুণি কথা। বাপ হয়ে কেউ এরকম বলে? লোকটার ধারাই এমন, কথার কোনো মা-বাপ নাই।

রহিমা এসে শুয়ে পড়ল। ঘুমুতে তার ভালো লাগে না। তাই ঘুম তাড়াতে নানা কথা ভাবে। রাত জেগে ভাববার মতো ঘটনা তার বেশি নেই। ঘুরেফিরে প্রতি রাতে একই কথা সে ভাবে। যেন সে একা একা একটি সাজানো ঘরে বসে আছে। হইচই হচ্ছে খুব। মনটা বেশি ভালো নেই। ভয়-ভয় করছে এবং একটু কান্না পাচ্ছে তার। এমন সময় বড়ভাবী মজিদের বাবাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই বললেন,নাও তোমার জিনিস। এখন দুজনে মিলে ভাব-সাব কর। এই বলে বাইরে থেকে খুট করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। নতুন শাড়ি পরে জড়সড় হয়ে বসে আছে রহিমা। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। কী বলবে তা-ও ভেবে পাচ্ছে না। এমন সময় কী কাণ্ডটাই না হল। কথাবার্তা নেই হড়হড় করে লোকটা বমি করে বিছানা ভাসিয়ে ফেলল। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে রহিমা তাকে এসে ধরল। ভাবতে-ভাবতে চোখ ভিজে উঠে। আহা নতুন বউয়ের সামনে কী লজ্জাটাই না পেয়েছিল লোকটা। কতদিনকার কথা অথচ মনে হয় এই তো সেদিন।

অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে রহিম উঠে বসল। পানের বাটা থেকে পানি বের করল। সুপুরি কাটুল ফুচি-ফুচি করে। পান মুখে দিয়ে আগের মতো চুপি-চুপি মজিদের জানালায় উঁকি দিল। না এখনো ঘুমায় নি। রহিমা মজিদের কোনো ব্যাপারই বুঝতে পারে না। লেখাপড়া না-জানা মূর্খ বাপ-মার ছেলে যদি বৃত্তিটুত্তি পেয়ে পাস করতে-করতে এম.এ. পাস করে ফেলে তাহলে সে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।

একসময় মজিদের চোখ গিয়ে পড়ে জানালায়। এ কী মা, এখনো ঘুরঘুর করছ? ঘুমাও না কেন?

যাই বাবা যাই।

রহিমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। বারান্দায় এসে বসে রইল একা একা। আধখানা চাঁদ উঠেছে। আলোয় আবছাভাবে সবকিছু নজরে পড়ে। রাতের বেলা একলা লাগে তার। বুকের মধ্যে হু-হু করে। দিনের বেলাটা এতটা খারাপ লাগে না। ঘরের কত কাজকর্ম আছে। কাজের লোক নেই। তাকেই সব করতে হয়। সময়টা বেশ কেটে যায়। বাসার কাছেই মাইকের দোকান আছে একটা। তারা সারাদিনই কোনো গানের সিকিখানা, কোনো গানের আধাআধি বাজায়। বেশ লাগে।

মজিদের বাবারও গান ভালো লাগত। এক-একবার গান শুনে চেঁচিয়ে বলেছে, ফাঁস ক্লাস, ফাঁস ক্লাস। মজিদের বাপ লোকটা আমোদ-আহ্লাদের বড় কাঙাল ছিল। বদনসিব লোক। আমোদ-আহ্লাদ তার ভাগ্যে নাই। কোনোদিন হয়তো জামাটামা পরে খুশি হয়ে গেছে সিনেমা দেখতে। ফিরে এসেছে মুখ কালো করে। হয় টিকিট পায় নি, নয়তো পকেট মার গেছে। কোনো বিয়ের দাওয়াতটাওয়াত পেলে হাসিমুখে গিয়েছে কিন্তু খেতে পায় নি কিছু। তার খাওয়ার আগেই খাবার শেষ হয়ে গেছে। নিজের ছেলেটা যখন লেখাপড়া শেষ করেছে, চাকরিবাকরি করে বাপকে আরাম দেবে, তখনি কথা নেই বার্তা নেই বিছানায় শুয়েই শেষ। রহিমা রান্নাঘর থেকে বলেছে পর্যন্ত— অসময়ে ঘুমাও কেন? চা খাবে, চা দিব?

রহিমা সেই মন্দভাগ্য লোকটার কথা ভেবে নিশ্বাস ফেলল। এমন খারাপ ভাগ্যের লোক আছে দুনিয়ায়ঃ মরণের সময়ও যার পাশে কেউ রইল না। মজিদের তখন কোনো খোঁজ নেই। কোথায় নাকি গিয়েছে মিটিং করতে। তার বাপকে কাফন পরিয়ে খাটিয়ায় তুলে সবাই যখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে উঁকি দিয়েছে তখন মজিদ নেমেছে রিকশা থেকে। বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে?

আহা লোকটা সারাজীবন কী কষ্টটা না করল। কী কষ্ট! কী কষ্ট! মেকানিকের আর কয় পয়সা বেতন? বাড়ির জমিজমা যা ছিল বেচে পড়ার খরচ চলল মজিদের। এত কষ্টের পয়সায় পড়ে আজ মজিদের এই হাল। সন্ধ্যা নামতেই বন্ধুরা আসে। মিটিং বসে ঘরে। ট্রেড ইউনিয়ন, মৎস্য সমবায় সমিতি, হেনো তেনো। ছিঃ।

মজিদের মাথায় কিসের পোকা ঢুকেছিল কে জানে। মজিদের বাপকে রহিমা কত বলেছে, ছেলেকে এসব করতে মানা কর গো, কোনোদিন পুলিশে ধরবে তাকে। মজিদের বাপ শুধু বলেছে— বুঝদার বিদ্বান ছেলে, আমি মুর্খ মানুষ, আমি কী বলব?

রহিমার শীত করছিল, সে ঘরের ভেতর চলে গেল। অন্ধকার ঘরে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা লাগল কিসের সঙ্গে। পিতলের বদনা ঝনঝন করে গড়িয়ে গেল কতদূর? মজিদ ঘুম-জড়ানো স্বরে বলল, কে কে?

আমি।

আর কোনো সাড়াশব্দ হল না। রহিমা যখন ভাবছে আবার শুয়ে পড়বে কি না, তখনি শুনল মজিদ বেশ শব্দ করে হাসছে। কী কাণ্ড। রহিমা ডাকল, ও মজিদ মিয়া।

কী?

হাস কেন?

এমনি হাসি। ঘুমাও তো, ফ্যাসফাঁস করে না।

না, মজিদকে রহিমা সত্যি বুঝতে পারে না। শুধু মজিদ নয়, মজিদের বন্ধুদের ও অচেনা লাগে। ঠিক সন্ধ্যাবেলায় তারা আসে। চোখের দৃষ্টি তাদের কেমন-কেমন। কথা বলে থেমে-থেমে, নিচু গলায় হাসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে তাদের আলাপ। সিগারেটের ধোয়ায় ঘর আচ্ছল হয়ে যায়। পাশের রইসুদ্দীনের চায়ের স্টল থেকে দফায়-দফায় চা আসে। কিসের এত গল্প তাদের? রহিমা দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে চেষ্টা করে।

না ইলেকশন হবে না। পরিষ্কার বুঝতে পারছি।

কিন্তু না হলে আমাদের করণীয় কী?

শেখ সাহেব কী ভাবছেন তা জানা দরকার।

শেখ সাহেব আপস করবেন। সাফ কথা।

সাদেক বেশি বাড়াবাড়ি করছে। একটু কেয়ারফুল না হলে …

রহিমার কাছে সমস্তই দুর্বোধ্য মনে হয়। তবু রোজ দরজার সঙ্গে কান লাগিয়ে সে শোনে। আর যদি কোনোদিন শিখা নামের মেয়েটি আসে তবে তো কথাই নেই। রহিমা জেঁকের মতো দরজার সঙ্গে সেঁটে থাকে। শিখা আসে লম্বা একটি নকশীদার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে। একটুও সাজগোজ করে না, তবু কী সুন্দর লাগে তাকে। সে হাসতে-হাসতে দরজায় ধাক্কা দেয়। ভেতর থেকে মজিদ গম্ভীর হয়ে বলে, কে কে? (যদিও হাসির শব্দ শুনেই মজিদ বুঝতে পেরেছ কে, তবু তার এই ঢংটা করা চাই-ই।)

আমি, আমি শিখা।

অগ্নিশিখা নাকি?

না, আমি প্রদীপশিখা।

বলতে-বলতে মেয়েটা হাসিতে ভেঙে পড়ে। দরজা খুলে মজিদ বেরিয়ে আসে। মজিদের চোখমুখ তখন অন্যরকম মনে হয়। দেখেশুনে রহিমার ভালো লাগে না। কে জানে শিখাকে হয়তো পছন্দ করে ফেলেছে। হয়তো এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করে রেখেছে অথবা মজিদের বপি সুতাখালীর ঐ শ্যামলা মেয়েটির সঙ্গে মজিদের বিয়ে দেবে বলে কী খুশি (টাঙ্গাইলের লালপাড় একটি শাড়িও সে দিয়েছে হাসিনা নামের ঐ ভালোমানুষ মেয়েটিকে। রহিমা মেয়েটিকে দেখে নি, শুনেছে খুব নরম মেয়ে আর ভীষণ লক্ষ্মী)। আহা মজিদের বাপ বেচারা বিয়েটা দিতে পারল না! আহা!

রহিমা কতবার দেখেছে শিখ এলেই মজিদ কেমন অস্থির হয়ে উঠে। শুধু-শুধু হো হো করে হাসে। চায়ের সঙ্গে খাবার আনতে নিজেই উঠে যায়। কথাবার্তার মঝিখানে ফস করে বলে, আজ আর ইলেকশন-ফিলেকশন ভালো লাগছে না। আজ অন্য আলাপ করব। ঘরে যারা থাকে তারা উসখুস করলেও আপত্তি করে না। শুধু হাসি নয়, গানটানও হয়। শিখা মেয়েটি মাঝে-মাঝে গান গায় তার জন্য সবাইকে খুব সাধ্যসাধনা করতে হয়। খুব অহংকারী মেয়ে)।

রহিমা বুঝতে পারে না এত রাত পর্যন্ত মেয়েমানুষ কী করে আড্ডা দেয়। মজিদের বাপ এইসব দেখেও কোনোদিন কথা বলে নি। শুধু বলেছে— বুঝদার বিদ্বান ছেলে, আমি কী করব?

মজিদের বাপ লোকটাও কী কম বুঝদার ছিল? চুপ করে থাকলে কী হবে, দুনিয়ার হাল অবস্থা ঠিক বুঝত। রহিমার কতবার মনে হয়েছে পড়াশুনা করতে পেলে এই লোকটাও বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যাবেলা ইংরেজিতে গল্প করত। নসিবে দেয় নি। ইমানদার লোক বদনসিব হয়।

রহিমা আবার বিছানা ছেড়ে উঠল। বাতি জ্বাললি। একা একা অন্ধকার ঘরে ভালো লাগে না। যুদ্ধের পর তেলের যা দাম হয়েছে। কে আর সারারাত বাতি জ্বালিয়ে রাখবে? ঐ ঘরে মজিদ আবার ঘুমের মধ্যে খুকখুক করে কাশছে। নতুন হিম পড়েছে। রহিমা কতবার বলেছে জানালা বন্ধ করে ঘুমুতে। কিন্তু মজিদ কিছুতেই শুনবে না। বন্ধ ঘরে তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। মজিদের বাপেরও এরকম বদঅভ্যাস ছিল। মাঘ মাসের শীতেও জানালা খোলা রাখা চাই। একবার তো খোলা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার শার্ট আর গেঞ্জি নিয়ে গেল। শার্টের পকেটে ছয় টাকা ছিল। কী মুশকিল। শেষপর্যন্ত মজিদের বাপ ছোট এক শার্ট গায়ে দিয়ে কারখানায় গেছে। আহ একটা শর্ট ছিল না লোকটার। কম বেতনের চাকরি। তার উপর পয়সা জমানো নেশা। খুব ধুমধাম করে মজিদের বিয়ে দিবে সেইজন্যে পাই পয়সাটিও জমিয়ে রাখা।

শিখা মেয়েটির সঙ্গে মজিদের পরিচয় না হলে সুতাখালীর ঐ মেয়েটির সঙ্গে কত আগেই মজিদের বিয়ে হয়ে যেত। আর বিয়ে হলে কি বউ ফেলে যুদ্ধে যেত মজিদ? কোনোদিন না। গ্রামের মধ্যে বউ নিয়ে লুকিয়ে থাকত কিছুদিন। তারপর সব ঠাণ্ডা হলে ফিরে আসত সবাই।

কিন্তু সেরকম হল না। শিখা মেয়েটি বাহারি ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে আসতেই থাকল। আসতেই থাকল। আর দিনদিন সুন্দর হতে থাকল মেয়েটা।

তখন খুব গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। মজিদের ঘরে দিনরাত লোকজনের ভিড়। আগের মতো শিখা মেয়েটির তীক্ষ্ণ হাসি শোনা যায় না। রহিমা বুঝতে পারে খুব খারাপ সময়। দেশের অবস্থা ভালো না। কিন্তু দেশের অবস্থা দিয়ে রহিমা কী করবে? সে শুধু দেখে তার নিজেরই কপাল মন্দ। মন্দ কপাল না হলে কি মজিদ তার বাপকে বলে— দেশের অবস্থা খুব খারাপ। কী হয় বোঝা যাচ্ছে না। তোমরা গ্রামে চলে যাও।

মজিদের বাপ বলেছে, তুই গেলে আমরা যাব।

আরে কী বল পাগলের তো। আমি কী করে যাই? আমার কত কাজ এখন। তোমরা কবে যাবে বল? আমি সব ব্যবস্থা করে দেই।

মজিদের বাপ সে-কথার জবাব না দিয়ে ফস করে একটা বিড়ি ধরিয়েছে আর মজিদ হঠাৎ করে প্রসঙ্গ পাল্টে নিচু গলায় বলেছে, শিখাকে বিয়ে করলে তোমাদের আপত্তি নেই তো বাবা?

মজিদের বাপ একটুও অবাক না হয়ে বলেছে, কবে বিয়ে?

সে দেরি আছে। তোমাদের অপিত্তি আছে কি না তাই বল।

না, আপত্তি কিসের জন্যে? বিয়েটা সকাল-সকাল করে ফেললেই তো ভালো। হয়। টাকার জন্যে ভাবিস না তুই। তোর বিয়ের টাকা আলাদা করে পোস্টাপিসে জমা আছে।

ছেলের বিয়ে দেখে যেতে পারল না। রহিমা যখন রান্না ঘরে ডাল চাপিয়ে খোঁজ নিতে এসেছে লোকটা চা-টা কিছু খাবে কিনা তখনি জেনেছে সব শেষ। সব আল্লার ইচ্ছা।

তারপর তো যুদ্ধই শুরু হল। গ্রামের বাড়িতে রহিমাকে রেখে মজিদ উধাও। কত উড়ো খবর কানে আসে। কোথায় নাকি একশ মুক্তিবাহিনীর ছেলে ধরা পড়েছে। কোথায় নাকি চারজন মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে মিলিটারি পুড়িয়ে মেরেছে। রহিমা শুধু মন্ত্রের মতো বলেছে, মজিদের হায়াৎ ভিক মাংগি গো আল্লাহ। তুমি নেকবান। হাসবুনাল্লাহে নিয়ামুল ওয়াকিল নেয়ামুল মওলা ওয়া নিয়ামুন নাসির। রহিমার রাতে ঘুম হয় না। জেগে-জেগে রাত কাটে। সেই সময়ই অসুখটা হল। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মনে হয় মৃত্যু বুঝি এসে বসেছে বুকের উপর।

যুদ্ধ থেমে গেল। মজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে হাসিমুখে একদিন দরজার সামনে এসে ডাকল, মা আমি মরি নাই গো। দেখ বেঁচে আছি।

অসুখটা তখন খুব বাড়ল রহিমার। ক্রাচের খটখট শব্দ তুলে মজিদ যখন এক পায়ে হেঁটে বেড়ায় তখন রহিমার বুক ধড়ফড় করে। কী কষ্ট, কী কষ্ট। সে মজিদের মতো ভাবতে চেষ্টা করে, একটি স্বাধীনতার কাছে এই ক্ষতি খুব সামান্য।

মজিদ বলে না কিছু, কিন্তু রহিমা জানে শিখার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সেই ছেলেটি নিশ্চয়ই মজিদের মতো ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটে না।

স্বাধীনতার কাছে এই ক্ষতি খুব সামান্য। রহিমা মজিদের মতো ভাবতে চেষ্টা করে। কিন্তু রহিমা মজিদ নয়। জীবন তার সুবিশাল বাহু রহিমার দিকে প্রসারিত করে নি। কাজেই তার ঘুম আসে না।

শেষরাতে যখন উঁদ ডুবে গিয়ে নক্ষত্রের আলোয় চারদিক অন্যরকম হয়, তখন সে চুপি-চুপি মজিদের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাঙা গলায় ডেকে উঠে, ও মজিদ মিয়া, ও মজিদ মিয়া। সেই ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে মজিদের ঘুম ভাঙে না। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করবার জন্যেই হয়তো শেষরাতের দিকে তার গাঢ় ঘুম হয়।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত