আজ আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।
আলো তখনো ভালো করে ফোটে নি। এখনো অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। আকাশে ক্ষীণ আলো-আঁধারিতে মন অন্যরকম হয়ে যায়। পৃথিবীর সবাইকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
আমি পৃথিবীর সবাইকে ভালোবেসে ফেল্লাম। আমার পাশের চৌকিতে বাকের সাহেব ঘুমিয়ে। অন্ধকারে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। তবু আমি নিশ্চিত জানি তিনি একটি কুৎসিত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছেন। মুখের লালায় তাঁর বালিশ ভিজে গেছে। লুঙি উঠে গেছে কোমরে। তাতে কিছু যায় আসে না। আজ আমার চোখে অসুন্দর কিছু পড়বে না, বাকের সাহেবকেও আমি ভালোবাসব।
বৎসরের অন্য দিনগুলি আজকের মতো হয় না কেন?—-ভাবতে-ভাবতে আমি সিগারেট ধরালাম। হিটার জ্বালিয়ে চায়ের কেতলি বসিয়ে দিলাম। সমস্ত ব্যাপারটা ঘটল নিঃশব্দে। তবু বাকের সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি জড়ানো গলায় বললেন, চা হচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ।
আজ এত ভোরে উঠলেন যে, ব্যাপার কী? শরীর খারাপ নাকি?
জি না। চা খাবেন বাকের সাহেব?
দেন এক কাপ।
এই বলেই মাথা বের করে তিনি নাক ঝাড়লেন। নাক মুছলেন মশারিতে— কী কুৎসিত ছবি। আজ চমৎকার সব ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করলাম বাকের সাহেব নামে এ ঘরে কেউ থাকে না এবং এটা যেনতেন ঘরও নয়। এটাই হচ্ছে মহিমগড়ের রাজবাড়ি এবং আমি এসেছি মহিমগড়ের রাজকন্যার অতিথি হয়ে। আর আমিও কোনো হেজিপেজি লোক নই। আমি একজন কবি। আজ সন্ধ্যায় মহিমগড়ের রাজকন্যাকে আমি কবিতা শোনাব।
মঞ্জু সাহেব।
জি বলুন।
এরকম লাগছে কেন আপনাকে কিছু হয়েছে নাকি?
না, কী হবে?
দেখি, একটা সিগারেট দেন দেখি।
বাকের সাহেব তাঁর সাপের মতো কালো রোগী হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। একটা সিগারেট দিলাম। অথচ আমি নিশ্চিত জানি, বালিশের নিচে তাঁর নিজের সিগারেট আছে। বাকের সাহেব নিজের সিগারেট কমই খান। আহ, কী সব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভাবছি। আজ আমি একজন অতিথি-কবি। আমার চিন্তাভাবনা হবে কবির মতো। আমি নরম স্বরে ডাকলাম, বাকের সাহেব।
জি।
আজ আমার কেন জানি বড় ভালো লাগছে।
ভালো লাগার কী হল আবার?
বার্কের সাহেব বড়ই অবাক হলেন। তার কাছে আজকের দিনটি অন্য সব দিনের মতোই। সাধারণ। ক্লান্তিকর। আমি মৃদুস্বরে ডাকলাম, বাকের সাহেব।
বলেন।
আজ আমার জন্মদিন।
তাই নাকি?
জি। এগারোই বৈশাখ।
আম-কাঁঠালের সিজনে জন্মেছেন রে ভাই।
এই বলেই বাকের সাহেব চায়ের কাপ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আজ আমি রাগ করব না। চমৎকার একটি সকালকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। সন্ধ্যাবেলা যাব নীলুদের বাড়ি। সন্ধ্যা হবার আগে পর্যন্ত শুধু ওর কথাই ভাবব।
বাকের সাহেব বাথরুম থেকে ফিরে এসে বললেন, পাইখানা কষা হয়ে গেছে ভাই।
আমি শুনেও না-শোনার ভান করলাম। আজ আমি অসুন্দর কিছুই শুনব না। আজ আমার জন্মদিন। আজ নীলুদের বাসায় যাব এবং তাকে গোপন কথাটি বলব।
ঝড় হোক। বৃষ্টি হোক। কিংবা প্রচণ্ড টর্নেডো হোক। কিছুই আসে যায় না। আজ সন্ধ্যায় আমি ঠিকই যাব নীলুদের বাসায়। নীলুর বাবা হয়তো বসে থাকবেন বারান্দায়। তিনি আজকাল বেশিরভাগ সময় বারান্দাতেই থাকেন। অপরিচিত কাউকে দেখলে কপালের চামড়ায় ভঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান। আমার দিকেও তাকাবেন। আমি হাসিমুখে বলব, নীলুফার কি বাসায় আছে? ওর সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। আমি উত্তেজিত অবস্থায় ঠিকমতো কথা বলতে পারি না। কথা গলায় আটকে যায়। কিন্তু আজ আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আজ কথা বলব অভিনেতাদের মতো।
চা শেষ করেই বাকের সাহেব ঘুমুবার আয়েজন করলেন। গল টেনে বলেন, নটা পর্যন্ত ঘুমাব। তারপর উঠে নাশতা খেয়ে আবার ঘুম। ছুটির দিনের ঘুম কাকে বলে, দেখবেন। ম্যারাথন ঘুম। হা-হা-হা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এল। বারান্দায় এসে দেখি আলো ফুটছে। আকাশ হালকা নীল। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। গোপন কথা বলার জন্যে এরচে সুন্দর দিন অর হবে না।
সকাল এগারোটায় টেলিফোন করলাম। নীলুকে টেলিফোনে কখনো পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেল। নীলু কিশোরীদের মতো গলায় বলল, কে কথা বলছেন?
আমি মঞ্জু।
ও, মঞ্জু ভাই। আপনি কেমন আছেন?
ভালো। তুমি কেমন আছ নীলু?
আমিও ভালো।
কী করছিলে?
পড়ছিলাম। আবার কী করব? আমার অনার্স ফাইনাল না?
ও তাই তো। আচ্ছা শোন নীলু, তুমি কি আজ সন্ধ্যায় বাসায় থাকবে?
থাকব না কেন?
আমি একটু আসব তোমাদের ওখানে।
বেশ আসুন।
একটা কথা বলব তোমাকে।
কী কথা।
গোপন কথা।
আপনার আবার গোপন কথা কী?
নীলু খিলখিল করে হাসতে লাগল। কী সুন্দর সুরেলী হাসি। কী অদ্ভুত লাগছে শুনতে।
হ্যালো নীলু।
বলুন শুনছি। আজ সন্ধ্যায় আসব।
বেশ তো আসুন। রাখলাম এখন। নাকি আরো কিছু বলবেন?
না, এখন আর কিছু বলব না।
নীলু রিসিভার নামিয়ে রাখার পরও আমি অনেকক্ষণ রিসিভার কানে লাগিয়ে রইলাম।
মাত্র এগারোটা বাজে। আরো আট ঘণ্টা কাটাতে হবে। কোথায় যাওয়া যায়? কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। নিউমার্কেটে কিছুক্ষণ হাঁটলাম একা একা। এবং একসময় দামি একটা শার্ট কিনে ফেললাম। অন্যদিন হলে শার্টের দাম আমার বুকে বিধে থাকত। আজ থাকল না। দামের কথা মনেই রইল না।
দশটি ফাইভ ফাইভ কিনলাম এ্যালিফেন্ট রোড থেকে। অন্তত আজকের দিনটিতে দামি সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। নীলুর জন্য কিছু-একটা উপহার নিয়ে গেলে হয় না? কী নেয়া যায়? সুন্দর মলাটের একটা কবিতার বই। সেখানে খুব গুছিয়ে একটা কিছু লিখতে হবে যেমন, নীলুকে দেখা হবে চন্দনের বনে। বইটি দেয়া হবে ফিরে আসার সময়। নীলু নিশ্চয়ই আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবে। তখন বলব, নীলু, আজ কিন্তু আমার জন্মদিন। নীলু বলবে, ওমা আগে বলবেন তো?
আগে বললে কী করতে?
কোনো উপহার টুপহার কিনে রাখতাম।
কী উপহার?
কবিতার বইটই।
আমি তো কবিতা পড়ি না।
না পড়লেও বই উপহার দেয়া যায়। ঠিক এই সময় আমি মোড়ক খুলে বইটি হাতে দিয়ে অল্প হাসব। হাসতে-হাসতেই বলব, আমি তোমার জন্য একটা কবিতার বই এনেছি নীলু।
সন্ধ্যাবেলা আকাশে খুব মেঘ করল। এবং একসময় শোঁ-শোঁ শব্দে বাতাস বইতে শুরু করল। নীলুদের বারান্দায় পা রাখামাত্র সত্যি-সত্যি ঝড় শুরু হল। কারেন্ট চলে গেল। সমস্ত অঞ্চল ডুবে গেল অন্ধকারে। নীলু আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এসেছেন? ভিজে গেছেন দেখি। আসুন, ভেতরে আসুন। কী যে কাণ্ড করেন? কাল এলেই হত।
বসার ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। একজন বুড়োমতো ভদ্রলোক বসে আছেন। তার পাশে বিলু। বিলু আমাকে দেখেই হাসিমুখে বলল, স্যার ভূতের গল্প বলছেন। উফ যা ভয়ের। তারপর স্যার বলুন।
নীলু বলল, দাঁড়ান স্যার আমি এসে নেই। চায়ের কথা বলে আসি।
নীলু চায়ের কথা বলে এল। একটা তোয়ালে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, মাথা মুছে ফেলুন। তারপর স্যারের গল্প শুনুন। প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স। বানানো গল্প না।
তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল নীলু।
দাঁড়ান গল্প শুনে নেই।
আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
তাই নাকি?
কৃষি ব্যাংকে একটা চাকরি হয়েছে। ফিফথ গ্রেড অফিসার।
বাহ্ বেশ তো। আসুন এখন গল্প শুনুন।
নীলু আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল–স্যার ইনি হচ্ছেন আমার বড়ভাইয়ের বন্ধু। যে ভাই ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে থাকেন তার।
নীলুর স্যার বললেন, বসুন। আমি বসলাম। ভদ্রলোক সঙ্গে-সঙ্গে গল্প শুরু করলেন : পথ-ঘাট অন্ধকার। শ্রাবণ মাস। আকাশে খুব মেঘ করেছে। আমি আর আমার বন্ধু তারাদাস পাশাপাশি যাচ্ছি। এমন সময় একটা শব্দ শুনলাম। যেন কেউ একজন ছুটতে-ছুটতে আসছে। তারাদাস বলল, কে? কে? তখন শব্দটা থেমে গেল।
ভদ্রলোক ভালোই গল্প করতে পারেন। নীলু-বিলু মুগ্ধ হয়ে শুনছে। নীলু একটা শাড়ি পরেছে। পরার ভঙ্গিটির মধ্যে কিছু একটা আছে। তাকে বিলুর চেয়েও কমবয়স্ক লাগছে। যেন সিক্স-সেভেনে পড়া বালিকা শখ করে শাড়ি জড়িয়েছে।
গল্প শেষ হতে অনেক সময় লাগল। নীলু উঠে গিয়ে চা নিয়ে এল। আমি বললাম, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।
নীলু অবাক হয়ে বলল, একবার তো বলেছেন।
কী বললাম?
কৃষি ব্যাংকে চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহ যাচ্ছেন।
এ কথা না। অন্য একটা কথা।
ঠিক আছে বলবেন। দাঁড়ান স্যারের কাছ থেকে আরেকটা গল্প শুনি। স্যার আরেকটা গল্প বলুন।
ভদ্রলোক গল্প বলার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে তার দ্বিতীয় গল্প শুরু করলেন। গল্প হতে-হতে অনেক রাত হয়ে গেল। বৃষ্টিও কিছুটা কমে এসেছে। নীলু ব্যস্ত হয়ে তাদের ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলল।
আমি স্যারের পাশে বসলাম। নীলু হালকা গলায় বলল, আবার আসবেন মঞ্জু ভাই।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই বিলুর স্যার বললেন, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন? আমি তার জবাব দিলাম না। ভূতে বিশ্বাস করি কি না করি তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি পরশু দিন চলে যাব। অনেকদিন আর ঢাকায় আসা হবে না। আর এলেও গোপন কথা বলার ইচ্ছা হবে না হয়তো। বিলুর স্যার বললেন, পৃথিবীতে অনেক স্ট্রেঞ্জ ঘটনা ঘটে বুঝলেন মঞ্জু সাহেব, নাইনটিন সিক্সটিতে একবার কী হয়েছে শুনেন …।
আরেক দিন শুনব। আজ আমার মাথা ধরেছে।
আমাদের এদিকেও বাতি নেই। অন্ধকার ঘরে বাকের সাহেব শুয়ে আছেন। আমাকে ঢুকতে দেখেই ক্লান্ত স্বরে বললেন, শরীরটা খারাপ করেছে ভাই। বমি হয়েছে কয়েকবার। একটু সাবধানে আসেন, পরিষ্কার করা হয় নাই।
সব পরিষ্কার করে ঘুমুতে যেতে আমাদের অনেক রাত হল। বাইরে আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাকের সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ঘুমালেন নাকি ভাই?
জি না।
আপনার জন্মদিন উপলক্ষে এক প্যাকেট সিগারেট এনেছিলাম। গরিব মানুষ, কী আর দিব বলেন।
বাকের সাহেব অন্ধকারে এগিয়ে দিলেন সিগারেটের প্যাকেটটি। আমি নিচু স্বরে বললাম, একটা কথা শুনবেন?
কী কথা?
গোপন কথা। কাউকে বলতে পারবেন না।
বাকের সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আজ বোধহয় পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যে গোপন কথাটি বলা হয় নি সেটি আমি বলতে শুরু করলাম। আমার ভালোই লাগল।