পশ্চিম আকাশে সূর্যটা লাল আভা ধারণ করছে।তাওহীদ শহরের কোলাহল ছেড়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে গাড়ি চালাচ্ছে।পশ্চিম আকাশে গোধূলি ভেসে ওঠে।তার হৃদয়ের মাঝে অন্যরকম এক অনুভূতি জাগে।এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে, এক মনে গোধূলির আভা দেখে যাচ্ছে।তাওহীদ যেন ধীরে ধীরে এক স্বপ্নের পাতায় হারিয়ে যাচ্ছে।
.
রাত হয়ে যায়, ঝি ঝি পোকারা ডাকা শুরু করে দেয়।চারপাশ থেকে বিভিন্ন ধরণের অদ্ভুদ শব্দ তার কানে ভেসে আসতে থাকে।মনের অজান্তেই এই শব্দের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে থাকে।
.
তাওহীদ বাসা থেকে রাগ করে বেড়িয়ে এসেছে, এখন তার রাগ-টা একটু কমেছে, কিন্তু অভিমান-টা রয়ে গেছে।তাই ঠিক করে আজ বাসায় আর ফিরবে না, সারা রাত রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে কাটাবে, রাতের সৌন্দর্য দেখে-দেখে সময় পাড় করে দিবে।এভাবেই অজানা পথে নিজেকে হারাবে।
•
বিয়ে বাড়ি, বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।লাইটের আলোক সজ্জায় বাড়িটা ঝলমল করছে।ফারাহ চুপচাপ তার রুমে বসে আছে।সে পালানোর জন্য একটা সঠিক সময় খোঁজছে।কিন্তু সময়টা পাবে কিনা! সে জানে না।কিছুক্ষণ পর তার মামী এসে বলে
.
– বধূ সাজে ফারাহ মাকে কত সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে আকাশ থেকে কোনো পরী নেমে এসেছে।
– ফারাহ শুকনো একটা হাসি দেয়।
– আবিরের বাবা কাজী সাহেব তো এখনও আসলো না, উনি কখন আসবেন?
– এই তো আর ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগবে।
– ফারাহ মা তুমি একটু অপেক্ষা কর আমি এখনেই আসছি।
– মাথা নেড়ে সায় দেয়।
.
ফারাহর মনে ঝড় বইছে।এই ঝড়টা তখনেই থামবে যখন সে পালাতে পারবে।ফারাহ চিন্তা করছে, এই জায়গা থেকে কিভাবে পালাবে? হঠাৎ আবির এসে বলে
.
– এই নে বোরকা তাড়াতাড়ি পড়।তোকে এখনেই পালাতে হবে।
কথাটা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।মুচকি হাসি দিয়ে আবির বলে
– এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো?
তাড়াতাড়ি কর পরে সময় পাবি না।
– হু
– আমার সাথে চল রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসছি।
– মাথা নাড়ায়।
আবির ও ফারাহ দৌড়াচ্ছে।দৌড়ের মাঝে আবির মায়ের কুটনীতির সব কাহিনী- ফারাহকে বলতে থাকে।
.
– ফারাহ! ফারাহ! কোথায় তুমি? দরজাটা খুল।
– কিন্তু রুম থেকে কোনো কথা আসে না।
তারপর দরজা ভেংগে রুমে ডুকে দেখে, ফারাহ রুমে নেই।দ্রুত সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে, কিন্তু কোথাও ওকে পায়নি।আবিরকেও খুঁজে তাকেও পাওয়া যায়নি।তারা মনে করে আবির ফারাহকে পালাতে সাহায্য করেছে।তাই তাড়াতাড়ি মেইন রোডের দিকে পা বাড়ায়।
.
– সব তো শুনলি! আমার বান্ধবীকে সব বলা আছে।তুই কয়েকটা দিন তার কাছেই থাক কেমন!
– ঠিক আছে।কিন্তু তুমি মামীকে কি বলে বোঝাবে?
– ঐটা আমার উপর ছেড়ে দে।তাদেরকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না।
– চুপ থাকে।
– তাদেরকে থামানোর জন্য; আমি এখানেই থাকলাম।তুই স্টেশনে গিয়ে বাসে করে চলে যাহ।
– ঠিক আছে।
•
তাওহীদ অজানা পথে গাড়ি চালিয়েই যাচ্ছে।হঠাৎ রাস্তার পাশে দেখে ফারাহ দৌড়ে আসছে।সে কি মনে করে গাড়ির গতিটা কমিয়ে দেয়।হঠাৎ ফারাহ হোচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়।তাওহীদ ব্রেক চেপে গাড়ি থেকে নেমে কাছে গিয়ে দেখে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
.
এখন সে কি করবে? ভেবে পাচ্ছে না।হঠাৎ বোতলের পানির কথা মনে হয়, তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসে।কিন্তু পানি কোথায় দিবে? নাক-মুখ তো পর্দা দিয়ে ঢাকা।পর্দার উপর দিয়েই পানির ছিটা দেয়।কয়েক বার দেওয়ার পর ফারাহর জ্ঞান ফিরে।ফারাহ আস্তে আস্তে ওঠে বসে।তাওহীদ বলে
.
– আপনি হোচট খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
তাওহীদের কথায় হুশ ফিরে।ও নরম সুরে বলে
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাকে সাহায্য করার জন্য।
.
ফারাহর কণ্ঠটা ওর কাছে এতো চিকন আর মধুর মনে হয়েছে।যেটা তাওহীদ বলে বোঝাতে পারবে না।তার সব কিছু কেমন যেন থমকে দাঁড়ায়।
.
– এই যে! এই যে!
– হ্যাঁ
ফারাহর কথায় বাস্তবে ফিরে আসে।তাওহীদ লজ্জায় পড়ে যায়।ফারাহও অস্বস্থিবোধ করতে থাকে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারাহ বলে
– আপনি কি ঢাকায় যাচ্ছেন?
আবার মনে মনে সে বলে, ধ্যাত আমার মাথায় কিছু নেই।চিনি না, জানি না, উনাকে আমি এইটা কি বলে ফেললাম?
– এখন ঢাকায় যাচ্ছি না, তবে আজকেই ঢাকা ফিরব।
– মানে? আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না।
– আজ সারা রাত রাস্তায় ঘুরে-ঘুরে কাটাব, সকালে ঢাকা যাব।
.
তাওহীদের এমন কথা শুনে অবুঝ বাচ্চার মতো তাকিয়ে থাকে।কিন্তু আপসোস! তাওহীদ দেখতে পাচ্ছে না।কারণ ওর মুখ তো পর্দা দিয়ে ঢাকা।কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারাহ বলে
– হঠাৎ এরকম ইচ্ছার কারণ?
– আমাকে যদি বিশ্বাস করেন।তাহলে গাড়িতে উঠতে পারেন।তারপর না হয় এই ইচ্ছার কাহিনীটা শুনে নিবেন।
– কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে।
•
– আবির! তুই এখানে? ফারাহ কোথায়?
– জানি না।
– কিহ!
– হ্যাঁ, ফারাহ কোথায় আমি জানি না।
– তাহলে এখানে একা একা কি করছিস?
.
– ফারাহর রুমে গিয়ে দেখি ও নেই।যখন রুম থেকে বের হয়ে আসব তখন এই চিঠিটা দেখি।তাই তাড়াতাড়ি তাকে ধরতে এসেছিলাম।কিন্তু পারলাম না।
.
চিঠিটা হাতে নিয়ে লিখাটা পড়ে
– মামী আমি আমার পছন্দের মানুষের কাছে চলে যাচ্ছি।আপনার কথাটা আমি রাখতে পারলাম না।পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
.
লেখাটা পড়ে ফারাহর মামী স্তব্ধ হয়ে যায়।উনার এতো দিনের আশা – ভরসা সব নষ্ট হয়ে গেল? এক দৃষ্টিতে লেখাটার দিকে তাকিয়েই থাকে।
•
অজানা পথে গাড়ি চলছে।একজন চিন্তায় ভাসছে।একজন ড্রাইভিং করছে।হঠাৎ তাওহীদ বলে
– আপনার নামটা জানা হলো না।
মৃদু হেসে ফারাহ বলে
– আমি ফারাহ রহমান।আপনার নামটা?
মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বলে
– আমি তাওহীদ রহমান।
.
ফারাহ রাতের প্রকৃতি দেখছে মাঝে মাঝে আড় চোখে তাওহীদের দিকে তাকাচ্ছে।তাওহীদ এক মনে ড্রাইভিং করেই যাচ্ছে।
•
রাত যত গভীর হচ্ছে তাওহীদের মায়ের চিন্তা ততো বাড়ছে।কারণ ছেলে যে, রাগ করে বাসা থেকে বের হয়েছে।তাওহীদের বাবা টিভিতে খবর দেখছিল।কাছে গিয়ে উনাকে বলেন
.
– এই যে শুনছেন!
– হ্যাঁ, শুনছি বল
– ছেলেটা রাগ করে বিকেলে বের হয়েছে।এখন পর্যন্ত তার আসার কোন নাম নেই।একবার ফোন করে দেখতেন।
– কেন তুমি ফোন করতে পারো না? ছেলেটা কি শুধু একা আমার? তোমারও হয় না? একবার ফোন করে দেখতে, ছেলেটা কোথায় আছে।
.
– এই হচ্ছে আপনাকে নিয়ে সমস্যা- সব কিছুতেই ভুল ধরবেন।একবারও কি ভুল ধরা ছাড়তে পারেন না?
– সত্য কথা বললে সবারেই গা জ্বলে।উনি কিছুই তো করবেই না।আবার বলাও যাবে না।
– কিহ! আমাকে কি বললেন?
.
– না কিছু বলেনি; তোমার গুণ গেয়েছি।ফোন দিয়েছিলাম তোমার ছেলের ফোন বন্ধ।
– ছেলের যে রাগ-অভিমান কখন বাসায় ফিরে কে জানে!
– চিন্তা করো না, রাগ কমলেই চলে আসবে।আর যদি রাগ না কমে তাহলে বন্ধুদের বাসায় থেকে যাবে।
.
আবার তাওহীদকে ফোন দেন।কিন্তু তখনও তার ফোন বন্ধ বলে।উনি আবার খবর দেখায় মন দেন।আর মা! বিষণ্ণ মনে বেলকনির চেয়ারে গিয়ে বসেন।
•
আঁকা-বাঁকা পথে গাড়ি চলছে।ফারাহ মুগ্ধ নয়নে রাতের প্রকৃতি দেখে যাচ্ছে।তার মনের মাঝে এক ভালো লাগা কাজ করছে।হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে, তার চোখ দুটো আটকে যায়।ও দেখে যে, পুকুরের পানির মাঝে শত শত তাঁরারা খেলা করছে।
.
পুকুরের পাশের গাছ-গাছালি পাড় হয়ে হাজার হাজার জোনাকিরা পুকুরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।আবার পুকুরের এক পাশ থেকে অপর পাশে পানির উপর দিয়েই ভেসে আসছে যাচ্ছে।ফারাহ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তাওহীদকে বলে
.
– এই যে! গাড়িটা একটু থামান তো
– কেন?
– ঐদিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।
– —
.
তাওহীদ চোখ ফিরাতেই থমকে যায়।মুগ্ধ নয়নে প্রকৃতির এই রুপ দেখতে থাকে।গাড়ি থেকে নেমে কখন যে ওদের সাথে মিশে গেল বুঝতেই পারলো না।কতক্ষণ এই ঘোরের মাঝে ছিল কারো জানা নেই।ফারাহ বলে
.
– কি সুন্দর দৃশ্য তাই না?
– হ্যাঁ।
– আমার জীবনে এমন একটা দিন আসবে ভাবতেই পারছিনা।
.
– তাওহীদ মুচকি হাসি দেয়।
– দেখেছেন তাঁরারার সাথে জোনাকিরা কেমন করে লুকোচুরি খেলছে।
– হ্যাঁ, হৃদয় ছোঁয়া দৃশ্য।
•
আবিরের মা এক দৃষ্টিতে ফারাহর রুমটার দিকে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন
.
– ফারাহ আমাদের এভাবে ঠকাতে পারলো! আমরা কি তার খারাপ চেয়েছিলাম?
ফারাহর মামা বলে
– ঠকিয়েছে বেশ করেছে।তার খারাপ চেয়েছিল না তো কি করছিলে? তার সম্পত্তির লোভে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলে।
– কিহ! আপনি আমাকে এই কথাটা বলতে পারলেন?
– বলেছি বেশ করেছি।ও পালিয়ে যাওয়াতে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।
.
উনি কিছু বলতে পারছেন না।চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন।বাবার সাথে তাল মিলিয়ে আবির বলে
.
– বাবা ঠিক কথায় বলেছে, ভুল কিছু তো বলেনি।তোমার সম্পত্তির প্রতি এতো লোভ কেন মা?
.
– বাবা! তুইও আমাকে এই কথাটা বলতে পারলি? আমি তোর ভালোর জন্যই এই কাজটা করতে চেয়েছিলাম।
– মা! এটাকে ভালো কাজ বলে না।এটাকে লোভী বলে, স্বার্থপর বলে।
– তুমি ওর সাথে এতোদিন অভিনয় করে আসছ তাই না? কিন্তু উপর ওয়ালার খেলা কারো বোঝার ক্ষমতা নেই।
– এখন সব দোষ তো আমার! তাই না? যে যেভাবে পারছেন বলছেন।
– চুপ কর আর একটা কথাও বলবে না।জানি না, মেয়েটা কিরকম ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছে? কেমন ঘর পেয়েছে?
•
– এই যে! এখনও কি বসেই থাকবেন নাকি খেতে চলবেন?
– ছেলের চিন্তায় আমার কিছুই ভাল লাগছে না।উনি আছেন খাওয়া নিয়ে।
– তোমার ছেলে যেখানেই আছে ভালো আছে।তাকে নিয়ে এতো চিন্তা করার কিছু নেই।
.
– আপনি খেয়ে নিন আমার খেতে ইচ্ছা করছে না।
হাত ধরে টানতে টানতে বলেন
– তোমাকে ছাড়া আমি কোনদিন খেয়েছি? চল খেতে চল।
– উনি আর না করতে পারেননি।
•
রাতের আঁধারে তাওহীদ ড্রাইভিং করে চলছে।ফারাহর মনে অন্যরকম এক ভাল লাগা কাজ করছে।হঠাৎ তাওহীদ বলে ওঠে
– অল্প সময়ের মাঝে কতকিছু ঘটে গেল তাই না?
– হ্যাঁ, আমার সব কিছু কেমন যেন কল্পনা মনে হচ্ছে।
অল্প সময়ের জন্য দুজন চুপ হয়ে যায়।তাওহীদ আবার ফারাহকে বলে
.
– একটা কথা বলব?
– বলেন
– আপনি দৌড়ে আসছিলেন কেন?
ফারাহ একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করে
– আমি যখন ছোট তখন আমার বাবা-মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।তারপর থেকে আমি মামা-মামাীদের কোলে মানুষ।বড় হওয়ার পর মামী উনার ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
.
কারণটা হলো আমার বাবার সম্পত্তি।তাই আমাকে বাধ্য হয়ে পালাতে হলো।
– তাওহীদ শুনে যাচ্ছে।ফারাহ আবার বলতে শুরু করে
– আমার ভাগ্যটা ভাল ছিল।কারণ মামাতো ভাই এই বিয়েতে রাজি ছিল না।শুধু তাই নয় সে আমাকে পালাতেও সাহায্য করে।
– সত্যিই এই দিক দিয়ে আপনার ভাগ্যটা ভাল ছিল।
– ফারাহ মুচকি হাসি দেয়।
.
আবার দু’জন চুপ হয়ে যায়।তাওহীদ উদাস মনে গাড়ি চালাচ্ছে।মনের অজান্তেই ফারাহর কথা মনে আসছে।মনে মনে বলে, ফারাহর মতো মেয়ে যদি আমার বউ হতো তাহলে জীবনটা ধন্য হয়ে যেত।অল্প সময়ে যতটুকু বুঝলাম মেয়েটা অনেক ভালো।কিন্তু তাকে নিয়ে আমি কেন ভাবছি? সে তো কখনও আমার হবে না! আর আমি না মেয়েদেরকে দেখতে পারিনা? কিন্তু এখন!
•
কিছুক্ষণ পর ফারাহ বলে
– একটা কথা বলতে লজ্জা করছে।কথাটা আপনাকে কিভাবে যে বলি!
– কি যে বলেন না! লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
– আসলে কি জানেন তো আমার ক্ষুধা পেলে সহ্য করতে পারিনা।
– ইস! এই কথাটা তো আপনাকে আমার বলার ছিল।আমি খুবই দুঃখিত।
– না না, এ কি বলছেন?
– আসার সময় দোকান থেকে শুকনো খাবার কিনে রেখেছিলাম, ঐগুলো চলবে?
– মাথা নাড়ায়।
– গাড়িটা সাইড করছি হাত-মুখ দুয়ে নিন।
.
গাড়ি থেকে নামতেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন পুলিশের গাড়ি চলে আসে।এক পুলিশ অফিসার বলে
– কি ব্যাপার! এতো রাতে আপনারা এখানে কি করছেন?
তাওহীদ ভয়ে চুপসে যায়।সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।তাদের পরিচয়েই বা কি দিবে? বুঝতে পারছে না।তাওহীদ কিছু বলার আগেই ফারাহ বলে ওঠে
– দেখতেই পারছেন কি করছি।আর আপনার কি মনে হয়? আমরা কোনো খারাপ কাজে বের হয়েছি! নাকি খারাপ কাজ করে এসেছি?
.
– সেটা বলছি না।কিন্তু মধ্য-রাতে আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? আর আপনাদের পরিচয়টা দিন।
– একটা জরুরী ফোনে আমরা স্বামী-স্ত্রী ঢাকা যাচ্ছি।যদি ফোনটা না আসতো তাহলে মধ্য-রাতে কষ্ট করে ঢাকা যাওয়ার কোনো মানে হয়?
– ঠিক আছে।বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।সাবধানে যাবেন পথে সমস্যা হলে ফোন দিবেন।
– অবশ্যই।
.
তাওহীদ কিছু সময়ের জন্য বোকা হয়ে যায়।মনে মনে বলে, ফারাহ এটা কি বলল!
পুলিশের কাছে কি পরিচয় দিল? কিন্তু আমরা কি এই বাঁধনে আবদ্ধ?
– এই যে! আপনি পুলিশের কাছে মিথ্যা কথা বললেন কেন?
– এছাড়া কি করার ছিল? অন্যকোনো পরিচয় দিলে তো ধরে নিয়ে যেত।
– ছোট মাথা তো তাই কিছু ডুকে না।
– মুচকি হাসি দেয়।
•
ফারাহ হাত-মুখ দুয়ে নিচ্ছে।এই প্রথম তাওহীদ ওর মুখটা দেখতে পেয়েছে।হঠাৎ তার হৃদয়ের মাঝে একটা মুচড় অনুভব করে।ফারাহ খেতে-খেতে বলে
.
– আপনার কাহিনীটা জানা হলো না! হঠাৎ এরকম ভাবনা আপনার মাথায় কেন আসলো?
– আমি বাসা থেকে রাগ করে বের হয়েছি।কারো বাসায় যাওয়া হলে নানা রকম প্রশ্ন করতে পারে।তাই এই ভাবনাতে চলে আসলাম।
.
– কিন্তু কেন?
মুচকি হাসি দিয়ে বলে
– বিয়ের জন্য।বাসা থেকে বিয়ে করার জন্য আমাকে চাপ দিচ্ছে।
.
– হাহাহাহা, কেউ বিয়ের জন্য ঘর ছাড়া হয়, কেউ বিয়ে না করার জন্য ঘর ছাড়া হয়।তা আপনি বিয়ে করবেন না কেন?
– বর্তমান সময়ের মেয়ে গুলোকে খুব ভয় করে।কে ভাল? কে মন্দ? বোঝা যায় না।তাই ঠিক করেছি আর বিয়েই করব না।
.
– এই যে! বিয়ে করবেন না ভাল কথা! কিন্তু আমি মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েদের অপমান সহ্য করব না।
– সেটা আপনার ব্যাপার।কিন্তু সত্যটা আপনাকে মানতেই হবে।এই যে অশালীন পোশাক পড়ছে, আবার অনেকে অনেক কিছু করছে।তখন কোন মেয়েকে ভাল মনে হবে?
.
– ঠিক বলেছেন।কিন্তু সবাই তো এরকম না।ভালও তো আছে।
– হ্যাঁ, তা ঠিক।এই যে তাদেরকে দেখে রাস্তায় শিস বাজায় তাদের কি ভাল লাগে? নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, এটাও কি ভাল লাগে?
– এসব মেয়েদের কে বোঝাবে? যখন নিজের সব কিছু হারায় তখন আত্মহত্যা করে, না হয় জীবন্ত লাশ হিসেবে বাঁচে।
.
– এই টাইপ মেয়েদেরকে আমার একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে।তারা কতজনকে বিয়ে করবে? একজনকে নাকি বহুজনকে?
– এজন্য মেয়েদের দোষ দিলেই চলবে না।পশ্চিমা দেশের কালচার আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও তার জন্য দায়ী।যদি একটা কঠিন নিয়ম থাকতো তাহলে এসব পোশাক পড়ে তাদের বাসা থেকে বের হতে বুকটা কাঁপতো।আর যারা অন্যায় কাজ করছে তারাও ভয় পেত।
.
– একদম ঠিক বলেছেন।কিন্তু এই নিয়ম কখন চালু হবে কে জানে!
– আর একটা কথা মনে রাখবেন, ভালর মাঝে যেমন খারাপ থাকে।তেমনি খারাপের মাঝে ভাল থাকে।
•
পূর্ব আকাশে সোনালী আলো ওঠে।তাওহীদ ঘুম ঘুম চোখে ড্রাইভিং করছে।এক অজানা আকর্ষণে বার বার ফারাহকে আড় চোখে দেখছে।মনের মাঝে এক অজানা ভাল লাগা ভিরছে। আর ফারাহ! গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে।হঠাৎ হর্নের প্রচন্ড শব্দে ফারাহর ঘুমটা ভেংগে যায়।গাড়ির হর্ন বাজতেই রহমত গেইট খুলতে খুলতে বলে
.
– ভাইজান, সারারাত কোথায় ছিলেন? জানেন! আপনের জন্য খালাম্মা কত টেনশন করছে?
– ——-
ফারাহকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে, বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে।
– খালাম্মা তাড়াতাড়ি আসেন ভাইজান আসছে।
.
তাওহীদের মা নিচে নেমে কান্না সুরে বলতে থাকেন
– খোকা তুই সারারাত কোথায় ছিলি? তোর ফোন বন্ধ ছিল কেন? জানিস তোকে কতবার ফোন দিয়েছে! তোকে আর বিয়ে করার কথা বলব না।তবুও তুই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাস না।
– চুপ করে থাকে।
.
ছেলের খেয়ালে পড়ে এতক্ষণ ফারাহকে লক্ষ করেনি; ফারাহকে দেখে অবুঝ শিশুর মতো তাকিয়ে থাকে।
.
– ফারাহ, আমার মা।
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি
সালাম শুনে রহমত বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
– ওলাইকুম আসসালাম।
– এখন কোনো প্রশ্ন করো না।পরে সব বলছি।
কথা না বাড়িয়ে তাওহীদকে যেতে দেয়।উনি জানেন কিছু বললে আবার চলে যাবে।
•
ফারাহ ঘুরে ঘুরে তাওহীদের রুমটা দেখছে।মনে মনে বলে, বর্তমান সময়ে এমন ছেলেও আছে? আমাকে চিনে না, জানে না, সাহায্য করল।সারাটা রাত আমার সাথে ছিল। কিন্তু একবারও খারাপ চোখে তাকায়নি; খারাপ কিছু করার চেষ্টা করেনি।অল্প সময়ে যা বুঝলাম উনার জীবনে যে আসবে সে ভাগ্যবতী হবে।আনমনে আরও না না রকম কথা ভেবেই চলেছে।
.
তাওহীদ ঘুমিয়ে পড়েছিল।ঘুম থেকে ওঠে ফারাহকে বলে
– আপনি রেস্ট নিয়েছেন?
– হ্যাঁ।
-চলেন নাস্তা করবেন।
– হু।
.
চুপচাপ সবাই নাস্তা করছে।তাওহীদ কি বলে! তা শোনার জন্য ওর বাবা-মা অপেক্ষা করে আছে।নাস্তা সেরে সোফায় গিয়ে বসে।
– বাবা ও হচ্ছে ফারাহ।
– আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
– ওলাইকুম আসসালাম।
– গতকাল রাস্তায় তার সাথে আমার পরিচয় হয়।
তারপর বাবা-মাকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলে।
.
ফারাহ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘলা আকাশ দেখছে।এমন সময় তাওহীদের মা এসে বলে
– ফারাহ!
– জ্বি আন্টি
– তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।কথাটা তুমি কিভাবে নিবে আমি জানি না।
-আমি কিছু মনে করব না, আপনি বলেন।
.
– তাওহীদের বয়সে কোনো মেয়ের জন্য কখনও এতোটুকু করেনি; অল্প সময়ে যা বুঝলাম- তাওহীদ তোমার কথা মানে।আর আমাদের বিশ্বাস তুমি তাকে নতুন একটা জীবন দিতে পারবে।তাই আমি ও তোমার আঙ্কেল চাই তুমি এই ঘরের মেয়ে হয়ে থাক।
.
– ফারাহ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
– যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে আমরা জোর করব না।সবটা তোমার খুশি।
•
ফারাহ ছাদে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের সূর্যটাকে দেখছে, মনে মনে তাওহীদের মায়ের কথাগুলো ভাবছে।
.
ফারাহকে কোথাও না পেয়ে ছাদে যায়।তাওহীদ দেখে, ফারাহ মনমরা হয়ে শেষ বিকেলের আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।তার বুকের মাঝে একটা কষ্ট অনুভব করে।
.
– একা একা ছাদে কি করছেন?
– এই তো সূর্যাস্ত দেখছি; কিছু বলবেন?
একটু সময় নিয়ে তাওহীদ বলে
– মা আমাকে সব বলেছে, আপনি মায়ের কথায় কষ্ট পেয়েছেন তাই না?
.
– না না কষ্ট পায়নি।এটা আপনার ভুল ধারণা।
– মা এমন একটা কান্ড করবে আমি ভাবতেই পারিনি।আপনি কোথায় উঠবেন? ঐটা আমার মনে ছিল না।তা না হলে আপনাকে এমন অবস্থায় পরতে হতো না।
– আপনি শুধু শুধু বিষয়টা অন্যভাবে নিয়ে যাচ্ছেন।আমি কিছুই মনে করেনি।
.
– আমি মাকে না করে দিচ্ছি; এই বিষয়ে যেন আর কোনো কথা না বলে(কথা বলতে তার গলাটা ধরে।কারণ মনের অজান্তেই যে তার মনে ওকে জায়গা দিয়ে ফেলেছে)
.
– অল্প সময়ে তাওহীদ কখন যে ওর হৃদয়ের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে।ফারাহ নিজেই বলতে পারে না।ওর এমন কথা শুনে খুব কষ্ট পায়।
দুজনেই বিষন্ন মনে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে।
•
ক্রিং ক্রিং ক্রিং
– হ্যালো কে বলছেন?
– আবির ভাইয়া, আমি ফারাহ।
– ফারাহ তুই কোথায়? আমার বান্ধবীর বাসায় যাসনি কেন?
– এক আপন মানুষের বাসায় আছি।তাই ওখানে যাওয়া হয়নি।
– বুঝলাম না।
– সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলে।
– তাহলে তুই এখন কি করবি?
– মামা-মামীকে বল আমরা আসতেছি।
•
দুই পরিবার এক সাথে বসে আছে।তাওহীদ ও ফারাহর বিয়ের দেনমহরের কথা চলছে।ফারাহর সাথে বিয়ে হচ্ছে! তাওহীদের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।
.
– আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারছি।ফারাহ মা আমাকে তুই ক্ষমা করে দে।
– মামী তুমি এইটা কি বলছ? সন্তানের কাছে মায়ের অপরাধ থাকতে পারে?
.
ফারাহকে ধরে কেঁদে ফেলে।
.
তাওহীদের বাবা বলে
– বেয়াই সাহেব সব কিছুই যখন রেডী; আমরা চাচ্ছিলাম বিয়ের কাজটা আজকেই সেরে ফেলতে।যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।
– না না আমাদের কোনো আপত্তি নেই।কি বল আবিরের মা?
– আমিও তাই বলি দেরী করার প্রশ্ন হয় না।
– আলহামদুলিল্লাহ
– আবির কাজী সাহেবকে খবর দে।
হাসি-আনন্দে তাদের বিয়ের কাজ শেষ হয়।
•
দু’জন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।তাওহীদ বলে
– আমাকে বিয়ে করলেন কেন?
– এটা কোনো প্রশ্ন হলো? আপনার বিয়ের বয়স হয়েছে, আমারও বিয়ের বসয় হয়েছে, তাই তারা বিয়ে দিয়েছে।
.
– বুঝলাম।কিন্তু আমাকে বিয়ে না করলেও পারতেন! আমার থেকে আরও অনেক ভালো ছেলে পাইতেন।
– কিন্তু আপনার মতো বদ ছেলেকে পাইতাম না।মেয়ে বিরোধী ছেলে পাইতাম না।
.
– ও(মন খারাপ করে) ঠিক কথাই বলেছেন।
– তা নয়তো কি? ২৪ ঘন্টার মাঝে একটা মেয়ের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।এখন মেয়েটা আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না।তাই আপনাকে বিয়ে না করে থাকতে পারলো না।
.
কথাটা বলে লজ্জায় হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফেলে।তাওহীদ হাতটা সরিয়ে বলে
– লজ্জাবতী বউ! এভাবে লজ্জা পেলে চলবে? ভালোবাসার কথা কে বলবে?
– এখনও ভালোবাসার কথা বলতে হবে?
– তাওহীদ যা বোঝার বোঝে নিয়েছে।
দু’জন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
.
রাতের আকাশে চাঁদের সাথে তাঁরারা ভালোবাসা বিনিময় করে।রাতের আঁধারে জোনাকিরা গাছের সাথে ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে।তাওহীদ ও ফারাহর হৃদয়ের মাঝে ভালোবাসার জোয়াড় বাড়তে থাকে।
গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক