গ্রামের নাম বাড়ন্তী । আদর্শ একটি গ্রাম । স্কুল, মাদ্রাসা, হাসপাতাল সবই আছে এই গ্রামে ॥ ছোট ছোট বাচ্চারা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ে । একই সাথে খেলা করে । তারা সবাই খুব আপন ।
ঠিক তেমনি ছিল মধ্যবিত্ত ২ পরিবারের ছেলে মেয়ে রাহুল ও থিয়া । ছোট বেলা থেকেই একসঙ্গে খেলা করা, মাদ্রাসায় পড়া, স্কুলে যাওয়া । থিয়ার বাবা সম্পর্কে রাহুলের দূর সম্পর্কের চাচা হয় । সেই সুবাদে রাহুল হয় ভাতিজা । চাচা ভাতিজা সম্পর্কের কারণে ছোট্ট রাহুল সব সময় থিয়াদের বাড়িতে যেতো । থিয়ার বাবা মা চাচা চাচিও রাহুলকে খুব আদর করতো । থিয়ার চাচি রাহুলকে দুষ্টুমি করে বাবা ডাকতো ।
থিয়া আর রাহুল তখন ক্লাস ফাইভে পড়তো । দুজন একই স্কুলের শিক্ষার্থী । থিয়ার কথা বলা, হাসি সব কিছুই রাহুলের ভালো লাগতো । ছোট্ট রাহুল যদিও বুঝতে পারতো না ভালোবাসা কি তবুও সে থিয়াকে অনুভব করতো । থিয়াও রাহুলকে দেখলে কেমন যেন করতো । তাদের মনের মধ্যে যে ক্ষুদ্র ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল তা তারা বুঝতে পারে নি ।
একদিন রাহুল থিয়াকে স্কুলে বলে,
— এই থিয়া শুনো।
— কি?
— তোমার সাথে কিছু কথা আছে ।
— কি কথা বলো ।
—এই নাও ।
— এটা কি?
— বাড়িতে গিয়ে পড়ে দেখো । কিন্তু কেউ যেন না দেখে ।
— ঠিক আছে ।
রাহুলের কাছ থেকে চিঠিটি নিয়ে ক্লাসে চলে গেল থিয়া । স্কুল ছুটির পর থিয়া বাড়িতে গিয়ে রাহুলের দেওয়া চিঠিটা পড়তে শুরু করলো ।
“থিয়া”
আমি জািন আমি আজ যে কথা তোমাকে বলবো তা শুনার পর তুমি আর আমার সাথে কখনোই কথা বলবে না । কিন্তু এছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা নেই । আমি আর পারছি না সহ্য করতে । আমি তোমাকে ভালোবাসি । একথা আমি আর মনের ভেতর রাখতে পারছি না । আমাকে ক্ষমা করো । তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো
ইতি
“রাহুল”
রাহুলের চিঠিটি পড়ে থিয়া অবাক হয় নি । বরং ছোট্ট থিয়ার চোখে আনন্দের অশ্রু চলে এলো । কারণ সেও যে রাহুলকে ভালোবাসে । লজ্জায় ছোট্ট থিয়ার গাল গুলি লাল হয়ে যায় । রাহুলের চিঠিটির জবাবে সেও চিঠি লিখে । আর সেই চিঠিটি যত্ন করে তার স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে ।
পরদিন সকালে ——–
— এই রাহুল?
— হ্যাঁ বল ।
— কাল কি দিয়েছিলে ওটা আমাকে?
— ইয়ে মানে
— (মুখ ভার করে ) এই নাও তোমার উত্তর ।
রাহুল কাঁপা কাঁপা হাতে থিয়ার কাছ থেকে চিঠিটা নেয় । থিয়াও চিঠিটি দিয়ে রাগ দেখিয়ে ক্লাসে ঢুকে যায়।
স্কুল ছুটির পর রাহুল বাসায় এসে সবার চোখের আড়ালে গিয়ে চিঠিটি খুলে । চিঠিটি খুলে রাহুল পড়তে শুরু করে ।
“রাহুল”
তোমার চিঠিটি পেয়ে আমি অবাক হই নি । কারণ আমি জানতাম তুমি এমনই কিছু দিবে । আমি অনেক ভেবে দেখলাম আমার পক্ষে সম্ভব নয় । কারণ আমিও তোমাকে ভালোবাসি । তোমাকে ফিরিয়ে দেই কি করে বল? তাই তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম । আমি তোমাকে ভালোবাসি ।
ইতি
“থিয়া”
থিয়ার উত্তরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় রাহুল ॥ ছুটে যায় থিয়াদের বাড়িতে । থিয়াদের বাড়িতে ঢুকতেই থিয়ার চাচি রাহুলকে বলে,
— কি গো বাবা? এবার দেখি মেয়েকে আম কাঁঠাল দিলে না?
—- দিবো দিবো ।
— আসো এখানে বসো । থিয়া আমার বাবার জন্য কিছু নিয়ে আয় তো ।
কিছুক্ষণ পর থিয়া প্লেটে করে কিছু ফল নিয়ে এলো রাহুলের জন্য । ছোট্ট রাহুল তখন দুচোখ ভরে থিয়াকে দেখতে লাগলো । হালকা হলুদ রঙের ফ্রগ পড়া পায়ে রূপার নূপুরের ঝুম ঝুম শব্দ ১২ বছরের রাহুলকে মুগ্ধ করে দেয় । অন্য মনস্ক হয়ে পড়ে রাহুল । কারো কোনো কথা যেন তার কানে যাচ্ছে না ।
থিয়ার মা রাহুলকে ধাক্কা দিতেই রাহুল বাস্তবে ফিরে আসে ।
— কি হয়েছে?
— না চাচি কিছু না ।
— এতক্ষণ ধরে আমরা ডাকছি তোমাকে । তুমি শুনতে পাওনি?
— না মানে,,,, আমি আসি চাচি ।
দ্রুত সেখান থেকে চলে যায় রাহুল । সেদিন থেকেই শুরু হয় স্বপ্নের পথে চলা তাদের দুজনের । থিয়াদের আত্মীয় ও পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় রাহুল যখন তখন থিয়াদের বাড়ি নানা অজুহাতে থিয়ার সাথে দেখা করতে চলে যেত । আর স্কুলে তো তাদের দেখা হচ্ছেই।
থিয়ার দাদি শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন । রাহুল তার হাত খরচের টাকা থেকে থিয়ার দাদিকে ঔষধ কিনে দিত । এ সব কিছুই ছিল রাহুলের ফন্দি । থিয়ার সাথে এতো দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার পরও তাদের মধ্যে চিঠি আদান প্রদান হতো ।
দেখতে দেখতে এসএসসি পরীক্ষা চলে আসে । যথারীতি পরীক্ষাও শুরু হয় । রাহুল আর থিয়া পরীক্ষা দেওয়ার পর বাড়ি ফেরার আগে নদীর ধারের কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করে ।
পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট বের হয় । রাহুল আর থিয়া দুজনেই গোল্ডেন এ প্লাস পায় । কিন্তু রাহুলদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ । তাই রাহুল পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল
লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে রাহুল ইলেকট্রিকের কাজ শুরু করে । আর থিয়া কলেজে ইন্টারে ভর্তি হয় । কিন্তু তাদের ভালোবাসার কোনো কমতি হয় নি । বরং রাহুলের তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা দেখে থিয়ার রাহুলের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় ।
ক্লাস ফাইভ থেকে ইন্টার পর্যন্ত রাহুল আর থিয়ার ভালোবাসার ৭ বছর পূর্ণ হয় । এদিকে তারা ২জনই ১৮ বছর পার করে । তাই তারা ঠিক করলো তারা কোর্ট ম্যারেজ করবে । কিন্তু কিভাবে? কে সাহায্য করবে তাদের? অনেক ভেবে চিন্তে তারা গেল তাদের স্কুলের মৌলানা স্যারের কাছে । সব শুনে মৌলানা স্যার তাদের সাহায্য করবেন বলে কথা দেন ।
তারপর তারা গেল থানায় । থানা থেকেও বলা হয় এখন কোর্ট ম্যারেজ করলে কোনো সমস্যা নেই ।
তারপর তারা সাংবাদিকের কাছে গেল । সাংবাদিকরা বলে কোনো সমস্যা হলে জানাতে । তারা সাহায্য করবে ।
সবার কাছ থেকে আস্থা পেয়ে অবশেষে মৌলানা স্যারকে সঙ্গে নিয়ে কোর্টে যায় রাহুল আর থিয়া । সেখানে গিয়ে তারা কোর্ট ম্যারেজ করে । তাদের কোর্ট ম্যারেজের কপি গুলি রাহুল থানায়, সাংবাদিক ও মৌলানা স্যারকে দেয় । রাহুল আর থিয়ার ইচ্ছে ছিল থিয়ার ইন্টার এর রেজাল্ট বের হওয়ার পর তারা তাদের বিয়ের কথা সবাইকে জানাবে । তার আগে নয় ।
কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না ।কথায় আছে ঘরের শত্রু বিভীষন । যে মৌলানাকে তারা বিশ্বাস করে বিয়ের সাক্ষী করেছিল সেই মৌলানাই তাদের বিয়ের খবর সবার কানে পৌঁছে দিতে শুরু করলো ।সেই গ্রামের মেম্বার সাব্বিরের ভাতিজি ছিল সেই স্কুলের একজন শিক্ষিকা । মৌলানা প্রথমে উনাকেই খবরটি দেয়। কিন্তু তিনি তা বিশ্বাস করেন নি ।বিশ্বাস না করে উনার চাচাকে বিষয়টি জানান তিনি । মেম্বার সাব্বির বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেননি । তিনি ভেবেছিলেন মৌলানা মিথ্যা বলছেন ।
শেষ মেষ মৌলানা নিজেই মেম্বার সাব্বিরের বাড়িতে এসে সব খুলে বলে । সব শুনে মেম্বার সাব্বির বলেন,
— আপনি জানলেন কিভাবে রাহুল আর থিয়া বিয়ে করেছে?
—- আসলে মেম্বার সাহেব, আমি কোর্টে একটা কাজে গিয়েছিলাম । সেখানে গিয়ে দেখি রাহুল আর থিয়া কোর্ট থেকে বেরুচ্ছে । আমি কোর্টের ভেতর গিয়ে বললাম, “আচ্ছা যে ছেলে মেয়ে ২জন এসেছিল তাদের কাজ কি হয়ে গিয়েছে? আমার তাদের সাথে আসার কথা ছিল । কিন্তু আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে ন কাজ যদি হয়ে যায় তাহলে আমাকে একটা কপি দিতে পারবেন? ”
এভাবে মিথ্যা বলে আমি কোর্ট থেকে কপি এনেছি।
— তাহলে তো বিষয়টি থিয়ার বাবাকে জানাতে হয় ।
—মেম্বার সাহেব দয়া করে আমার নাম বলবেন না । যদি কেউ আমার নাম জানতে পারে তাহলে আমার চাকরি চলে যাবে সাথে আমাকে এই গ্রামও ছাড়তে হবে ।বলবেন আপনি কোর্টে গিয়ে দেখেছেন ।
— আচ্ছা ঠিক আছে ।
তারপর মেম্বার সাব্বির থিয়ার বাবাকে সব জানায় । সব শুনে থিয়ার বাবা বলেন,
— সব কিছুর মুলে আপনি মেম্বার সাহেব । আমার মেয়ে কখনোই এমন করতে পারে না ।
একথা বলেই থিয়ার বাবা বাড়িতে চলে যান। এরপর শুরু হয় মহা তান্ডব । সম্পূর্ণ গ্রাম জেনে যায় থিয়া আর রাহুলের বিয়ের কথা । থিয়ার বাবা সম্পূর্ণ দোষ দেন রাহুলের ॥ রাহুল ও তার বাবা মাকে গালাগাল করেন থিয়ার বাবা ।
এমন অবস্থায় থিয়ার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান রাহুলের বাবা ॥ তিনি বলেন বিয়ে যখন হয়েই গিয়েছে তখন সেটিকে সামাজিক ভাবে মেনে নেওয়া ভালো । কিন্তু থিয়ার বাবা এ বিয়ে মানেন না । তিনি রাহুলের বাবাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন।
এদিকে সবাই সবকিছু জেনে যাবার পর থিয়া আর রাহুল খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে । খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয় তারা । থিয়ার পরিবার থিয়াকে খুব আদর যত্ন করতে থাকে । রাহুলের বিরুদ্ধে বুঝাতে থাকে ।
রাহুলের বাবা থিয়ার বাবাকে বুঝাতে চেয়েছেন যে সম্পর্কটা থিয়াও করেছিল । কিন্তু থিয়ার বাবা কোনো কথা শুনেন নি । তাই রাহুলের বাবা রাহুলের টেবিলের ড্রয়ার ভেঙে ৭ বছর সম্পর্কের ৩৪৫টি চিঠি বের করেন । যার সব গুলি থিয়ার হাতের লেখা ।
চিঠি গুলি প্রকাশ হওয়ার পর রাহুল আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে ॥ তার মনে ভয় হয় থিয়া তাকে ভুল বুঝবে।কারন থিয়া বলেছিল এই চিঠি যদি কখনো প্রকাশ পায় তাহলে সে আর রাহুলের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না । কি করবে রাহুল ভেবে পায় না ।
রাহুলের অসুস্থতার কথা শুনে পাশের বাড়ির একটি মেয়ে রাহুলকে দেখতে আসে । রাহুল মেয়েটিকে আপু ডাকতো । মেয়েটি রাহুলকে দেখতে এলে রাহুল মেয়েটিকে একটা চিঠি দেয় । দিয়ে বলে,
— আপু তুমি এই চিঠিটি থিয়াকে দিও । থিয়া আমাকে ভুল বুঝবে ।
রাহুলের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে মেয়েটি থিয়াকে দেখতে থিয়াদের বাড়ি যায় । থিয়ার রুমে যখন কেউ ছিল না মেয়েটি তখন থিয়ার হাতে চিঠিটি দেয় । চিঠিটি নিয়ে থিয়া বিছানার উপর রেখে বালিশ বুকের নিচে দিয়ে চিঠিটি পড়তে লাগলো । থিয়ার চোখের পানি চিঠির উপর টপ টপ করে পড়ছে। আর থিয়া নিরবে চোখের পানি ফেলে চিঠিটি পড়ছে ॥ এমন সময় থিয়ার ফুফু এসে উপস্থিত । তিনি ছুঁ মেরে থিয়ার সামনে থেকে চিঠিটি নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন । আর মেয়েটিকে বললেন,
—- এই মেয়ে । তুমি কি রাহুলের পিয়ন হয়ে এসেছো নাকি আমার ভাতিজিকে ভুল বুঝানোর জন্য? বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে ।
— হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি । আর কোনো আসবো না তোমাদের বাড়ি ॥ সব দোষ শুধু রাহুলের একার । তোমাদের মেয়ে যেন ধোঁয়া তুলশি পাতা ।যত্তসব ।
এই বলে মেয়েটি বেরিয়ে যায় । আস্তে আস্তে থিয়া সুস্থ হয় । থিয়া সুস্থ হতেই থিয়ার ফুফু আর বাবা থিয়াকে জোর করে কোর্টে নিয়ে যায় রাহুল কে ডির্ভোস দেওয়ানোর জন্য । গাড়িতে থিয়া বার বার জ্ঞান হারায় ।তারপরও তারা তাকে কোর্টে নিয়ে যায় ।খবর পেয়ে পাগলের মতো কোর্টে ছুটে যায় রাহুল ॥ কিন্তু তার কাছে টাকা না থাকায় সে কোনো উকিলের সাহায্য নিতে পারে না । কোর্টের দরজায় মাথা খুটে খুটে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে রাহুল । কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না । থিয়াকে দিয়ে ডির্ভোস দিয়ে দিল থিয়ার বাবা ও ফুফু ।
ডির্ভোসের পর থিয়া আর রাহুল আবারও খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে ।তখন সেই মৌলানা তাদের দেখতে আসে । মৌলানা রাহুলকে সান্ত্বনা দেয় আবার থিয়াকেও সান্ত্বনা দেয় । এভাবে চলতে চলতে মৌলানা তাদের দুজনের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠে । তাদের বন্ধু হয়ে আবার তাদের দুজনের সম্পর্ক গড়ে দেয় মৌলানা । তবে সেটা ২ পরিবারের অজান্তেই । থিয়া কলেজের পড়া শেষ করে একটি প্রাইমারি স্কুলের টিচার হলো । আর রাহুল ইলেকট্রনিকের কাজ করে । কারণ টাকার জন্য তার পড়াশোনা হয় নি ।
এদিকে মৌলানার সাথে রাহুলের এতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় যে একজন আরেক জনকে ছাড়া কিছু বুঝে না । মৌলানা কোনো সমস্যায় পড়লে রাহুলের কাছে আসে । একদিন মৌলানা রাহুলকে বলে স্কুলের কোয়ার্টারে তার থাকতে খুব কষ্ট হয় । অন্য কোথাও চলে যাবে । এটা শুনে রাহুল বলে সে তাকে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে । ফ্যান লাইট সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিবে । অন্য কোথাও মৌলানাকে যেতে হবে না । মৌলানাও মহা আনন্দে হাসপাতালে থাকতে শুরু করলো ।
থিয়া স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তায় রাহুল থিয়ার সাথে প্রতিদিন দেখা করে । আর তাদের সাহায্য করে তাদের খুব ভালো বন্ধু মৌলানা । এভাবে কেটে যায় ২/৩ বছর ॥ একদিন রাহুল জানতে পারে তাদের কোর্ট ম্যারেজের কথা মেম্বার সাব্বির নয়, মৌলানা ফাঁস করেছে ।
এটা জানতে পেরে রাহুল উঠে পড়ে লাগে মৌলানাকে শাস্তি দেবার জন্য । প্রথমে রাহুল মৌলানাকে তার দেওয়া ফ্যান লাইট সব হাসপাতাল থেকে খুলে আনে । তারপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানায় যে হাসপাতালে অবৈধ ভাবে বাসস্থান গড়ে তুলেছে মৌলানা । এটা শুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৌলানাকে হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দেয় । এনিয়ে রাহুল আর মৌলানার মাঝে খুব ঝগড়া হয় ।গ্রামের সবাই রাহুলকে জিজ্ঞাসা করে সে কেন মৌলানার সাথে এমন করছে? জবাবে রাহুল বলে “মৌলানাকে জিজ্ঞাসা করুন ” । মৌলানাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে “আমি কিছু জানিনা “। এভাবে মৌলানাকে পদে পদে হেস্তা করে রাহুল ।
এদিকে ডিভোর্সের পর আরও ৭ বছর পার হয়ে যায় । সাত বছর পর থিয়া রাহুলকে বলে তাদের বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। রাহুলও থিয়ার কথা মতো গ্রামের বিশেষ বিশেষ মানুষদের দিয়ে প্রস্তাব পাঠায় । কিন্তু থিয়ার বাবা মানে না । এভাবে কেটে যায় আরও ৩টা বছর ॥ তারপর একদিন রাহুল থিয়াকে বলে,
—দেখো থিয়া, আমাদের সম্পর্কের ৭ বছর পর আমরা কোর্ট ম্যারেজ করলাম । কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় না থাকায় ১ সপ্তাহের বেশি তা গোপন রইল না । আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেল । এরপর পার হলো আরও ১০টা বছর । তোমার বাবার কাছে বার বার প্রস্তাব পাঠিয়েছি । কিন্তু তিনি মেনে নেননি । তুমি বলো কি করবে? পালাবে আমার সাথে?
— দেখো রাহুল আমি এভাবে পালাতে পারবো না । আমাকে সময় দাও।
— সময়??? ১৭টা বছর পার হয়ে গিয়েছে থিয়া । আর কত সময় চাও তুমি???
— প্লিজ রাহুল । আমাকে ভাবার সময় দাও ।
সেখান থেকে রাগ করে রাহুল বাড়িতে চলে আসে । বাড়িতে মন মরা হয়ে বসে থাকতে দেখে রাহুলের চাচাতো ভাই টিপলু তাকে জিজ্ঞাসা করে,
— রাহুল ভাই কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?
— কিছু না ।
— আরে বল না কি হয়েছে?
তারপর রাহুল সব খুলে বলে । সব শুনে টিপলু বলে,
— চল তুলে নিয়ে যাই । তারপর যা ভাগ্যে আছে দেখা যাবে ।
— না না, এটা কেমন কথা?
— দেখো প্রেম করেছ ভয় পাওনি । আর এখন ভয় কিসের?? আমি আছি। কাল যা হবার হবে ।
— যদি ব্যর্থ হই?
— আল্লাহ ভরসা । এটা পবিত্র প্রেম । আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন । কাল তৈরি থেকো ।
— ঠিক আছে ।
পরদিন বিকেলে থিয়া স্কুল থেকে ফেরার পথে যেখানে দাঁড়িয়ে রাহুলের সাথে দেখা করতো সেখানে রাহুল ও টিপলুর ছোট ভাই টপসি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল । আর টিপলু মোটরসাইকেল নিয়ে কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে।
স্কুল ছুটির পর থিয়া বাড়িতে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করল । হাঁটতে হাঁটতে যেই থিয়া গাড়ির কাছে এলো অমনি রাহুল টান দিয়ে গাড়িতে তুলেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। থিয়াকে তুলে নিতেই স্কুলের বাচ্চারা চিৎকার করে বলতে লাগলো “আমাদের ম্যাডাম কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে “।
এদিকে টিপলু আর টপসি গাড়ি আর মোটরসাইকেল এমন ভাবে চালানো শুরু করলো যে, কোনো বাধা ওদের আটকাতে পারবে না । সামনে যে পড়বে সেই মরবে ।
এদিকে থিয়ার বাবার কাছে সঙ্গে সঙ্গে খবর পৌঁছে যায় যে থিয়াকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যাচ্ছে । থিয়ার বাবা তখন ছিলেন বাজারে । বাজার থেকে ডিম, মুরগি আর মুড়ি কিনে বাড়িতে ফিরছিলেন । থিয়াকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে তিনি নিজের বাইসাইকেল নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন । যাতে উনাকে দেখে গাড়ি থেমে যায় ।
কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন টিপলু মোটরসাইকেল নিয়ে পাগলের মতো ছুটে আসছে । তার পেছনে গাড়িটাও। থিয়ার বাবা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তিনি ভেবেছিলেন টিপলু উনাকে দেখলে মোটরসাইকেল থামাবে ।কিন্তু না । উনার ধারণা ভুল । টিপলু আর টপসি মোটরসাইকেল আর গাড়ি এনে উনার উপর দিয়ে তুলে দিচ্ছিল । নিজেকে বাঁচাতে থিয়ার বাবা পাশের জমিতে লাফ দেন । লাফ দিয়ে জমিতে পরার সঙ্গে সঙ্গে থিয়ার বাবার হাত থেকে মুরগি ছুটে যায় আর মুরগিটা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে লাফাতে থাকে। ডিম সব ভেঙে যায় ॥ মুড়ি ছিটকে পড়ে চারিদিকে ।
এদিকে রাহুল, টিপলু,টপসি থিয়াকে নিয়ে গা ঢাকা দেয়। আজ এর বাড়ি তো কাল অন্যের বাড়ি। টিপলু ছিল খুব বুদ্ধিমান ছেলে। সে থিয়ার পা জড়িয়ে ধরে বলে,
— এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আজ থেকে তুমি আমার আপামনি। আমি তোমার ছোট ভাই। রাহুল ভাইয়ের বাবা মা তোমাকে কিছু বললে আমি তাদের জবাই করে ফেলবো। তুমি আমাদের বিপদে ফেলো না। আমরা তোমাদের ভালো চাই।
— ঠিক আছে ছাড়।
— না আগে কথা দাও তুমি আমাদের বিপদে ফেলবে না।
— আচ্ছা কথা দিলাম। পা ছাড় এখন।
— এখন তো তোমাদের বিয়ে দিতে হবে। তোমরা এখানে থাকো।আমি ব্যবস্থা করি।
কিছুক্ষণ পর টিপলু আর টপসি কাজী আর বিয়ের শাড়ি নিয়ে উপস্থিত হলো।ঘরোয়া ভাবে তখন সেখানে রাহুল আর থিয়ার বিয়ে হলো।
অপর দিকে থিয়ার বাবা থানায় টিপলু, রাহুল ও তাদের পরিবারের নামে মামলা করে। এখবর পেয়ে রাহুল আর টিপলুর পরিবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। থিয়ার বাবা বলেন এসব কিছু মেম্বার সাব্বির করাচ্ছেন।উনি এর শেষ না দেখে ছাড়বেন না।থিয়া আর রাহুলদের তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে পুলিশ। থানায় মেম্বার সাব্বির রাহুল ও থিয়াকে ফোন করেন।সবাই তাদের অনুরোধ করে চলে আসতে। কিন্তু তারা মানে না। থিয়া তার বাবাকে বুঝায়। বলে সব মেনে নিতে। কিন্তু থিয়ার বাবা বলেন,
— আমার মেয়েকে আমি গলায় বেঁধে রাখবো। তার আয় আমি খাবো। বিয়ে না হলে সমস্যা নেই।
এভাবে কেটে যায় ১মাস।১মাস পর রাহুল তার পরিবারের সবাইকে বুঝিয়ে বলে। তারপর পুলিশের চোখ এড়িয়ে তারা অনেক কষ্টে রাহুল আর থিয়ােক নিয়ে কোর্টে যায়।সেখানে আবার বিয়ে হয় তাদের।
রাহুল আর থিয়াকে বিয়ে দিয়ে সকাল বেলা বাবা মা বাড়িতে আসেন।আর সেদিন বিকেলে টিপলু আর টপসি মিলে থিয়া আর রাহুলকে নবদম্পতির রুপে সাজিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। রাহুলের বাবা মা থিয়াকে বরণ করে ঘরে তুলে নেয়। কিন্তু কাহিনী এখানেই শেষ নয়।
রাহুলের পরিবার থিয়াকে বউ হিসেবে মেনে নিলেও থিয়ার পরিবার রাহুলকে জামাই হিসেবে মেনে নেয় নি।
পরদিন সকালে থিয়ার বাবা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু কাজ করছিলেন । এমন সময় রাহুল থিয়াকে তার মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুলের পথে রওনা হয়েছে। এটা দেখেই থিয়ার বাবা দ্রুত বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন।
রাহুল যেই মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরুলো সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত গ্রামের লোক বলতে লাগলো
“””দেখ দেখ, রাজপুত্র তার ঘোড়ায় করে রাজকন্যা নিয়ে যাচ্ছে”””
বীরের মতো রাহুল তার শ্বশুর বাড়ি মানে থিয়াদের বাড়ির সামনে দিয়ে থিয়াকে নিয়ে স্কুলে গেল।
থিয়া এভাবে পালিয়ে বিয়ে করায় থিয়ার বাবা তার ছোট মেয়ের আর কোথাও বিয়ে হবে না ভেবে ২ বিয়ে করা এক বয়স্ক লোকের সাথে ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। এবং রাহুলদের দেখিয়ে দেখিয়ে তিনি মহা ধুম ধামে ছোট মেয়ের বিয়ে দেন।
থিয়ার বোনের বিয়ের ৩ মাস কেটে যায়।কিন্তু তখনো ২ পরিবার এক হলো না। থিয়া দেখে তার মায়ের কষ্ট। কিন্তু সে নিরুপায়। কিছুই করতে পারবে না থিয়া। বাবা মাকে পেতে হলে তাকে রাহুলকে হারাতে হবে। আর রাহুলকে পেতে হলে বাবা মা কে হারাতে হবে।
তারপর একদিন থিয়া টিপলুকে বলে
— তুই তো বলেছিলি সব ঠিক করে দিবি। ২ পরিবারকে মিলিয়ে দিবি। তাহলে এখন চুপ করে আছিস কেন???
— ঠিক আছে আপামনি। চিন্তা করো না।ব্যবস্থা করছি।
সেদিন বিকেলে টিপলু মেম্বার সাব্বিরের বাড়ি যায়। সব শুনে তিনি বলেন,
—আমরা তো অনেক বার ভাই সাবকে বুঝিয়েছি। কিন্তু তিনি তো মানতে রাজি হননি। আচ্ছা শেষ চেষ্টা করে দেখি তবুও।
পরদিন সকালে মেম্বার তার বাড়িতে গ্রামের সব মুরব্বিদের নিয়ে মিটিংএ বসেন। সেখানে রাহুল থিয়া ও তাদের পরিবারও ছিল।
অনেক কান্নাকাটি, ক্ষমা চাওয়ার পর থিয়ার বাবা বলেন,
—আমি তাদের মেনে নিবো। কিন্তু একটা শর্ত॥ আমি আমার মেয়েকে আমার বাড়ি থেকে আবার বিয়ে দিবো রাহুলের সাথে। যদি রাজি না থাকেন তাহলে আমি চললাম।
থিয়ার বাবার প্রস্তাবে সবার রাজি হলো।তারপর আবারও ধুমেধামে তাদের বিয়ে হলো।