হলুদ খাম

হলুদ খাম

– আব্বা কিন্তু ছেলে দেখতেছে আমার বিয়ের জন্য।

তনুর মুখে এই কথাটা ইফতি বহুবার শুনেছে। তাই আজ এই কথা শুনার পর তার খুব একটা মাথা ব্যাথা নাই। খানিক্ষণ চুপ থেকে ইফতি বলল

– আচ্ছা।
– আচ্ছা মানে? তোমার কোন ফিলিংস নাই আমার বিয়ের ব্যাপারে?
– না আছে, আসলে সত্যি বলতে কি ,নাই গো।
– কেন নাই?
– চার বছর ধরে শুনছি বিয়ে হবে বিয়ে হবে। বিয়ে তো হয় না। প্রথম যেবার শুনছিলাম একটু ভয় লাগছিলো এখন মনে হয় ভয় টয় পাওয়ার কিছু নাই। তুমি সব ম্যানেজ করে নিতে পারবা। আমার টেনশনের কিছু নাই।
– কিন্তু আব্বা এইবার খুব সিরিয়াস।
– আরে জান তুমি টেনশন কইরো না। আমাকেও টেনশন দিও না। চলো সামনে হাটি।

ইফতি খুব সাধারণ একটা ঘরের ছেলে। সে ঢাকায় একাই থাকে একটা মেসে। তার বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকে। বাবা ৩য় শ্রেনীর সরকারী কর্মচারী ছিলেন। এখন রিটায়ার্ড। ইফতির বড় বোনের বিয়ের সময় তিনি পেনশনের যে টাকা পেয়েছিলেন তার অর্ধেক খরচ করেছেন। এরপর কয়েকবার মেয়ের জামাই যৌতুক বাবদ খুচরা করে প্রায় ৩ লাখ টাকা কয়েকবারে নিয়েছে। টাকা না দিলে মেয়েকে নির্যাতন করে। প্রেম করে কিন্তু রাহেলার ( ইফতির বোন ) বিয়ে হয় নি। ইফতির বাবার কাছের বন্ধুর ছেলের সাথেই হয়েছিলো কিন্তু কেনো যেনো মেয়েটা বিয়ের পর থেকেই অশান্তিতে আছে। বারবার টাকা দিতে দিতে এখন আর তাদের কে টাকা দেওয়ার মত টাকা তাদের কাছে আর নাই। ইফতির মা সুরমা বেগম সারাদিন মেয়ের জন্য কাঁদে। ইফতি একটা চাকরি পেলে তারা রাহেলাকে ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে। ইফতি মেধাবী। ছোট থেকেই পড়াশোনা ছাড়া কিছুই যেনো সে বুঝে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ বছর হয়ে গেলো মাস্টার্স শেষ করেছে কিন্তু চাকরি বাজার এত খারাপ যে তার চাকরিটা হচ্ছে না। সে প্রতিদিন চেষ্টা করে। তার বাবা তাকে নিজের পেনশনের টাকা থেকে কিছু টাকা দিয়েছিলো ছোট ব্যবসা করতে কিন্তু আফসোস সে ব্যবসাটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। যে কোন সময় পাওনাদাররা তার ব্যবসার মালপত্র নিলামে তুলে দিবে। তনুর সাথে তার এক অনুষ্ঠানে পরিচয়। প্রায় ৬ বছর ধরে তারা সম্পর্কে আছে। তনু খুব ঠান্ডা স্বভাবের মেয়ে। দামী রেস্টুরেন্টে অথবা দামী গিফটের প্রতি তার কোন চাহিদাই নাই ইফতির কাছে। সে শুধু ইফতির চাকরি হওয়ার অপেক্ষায় আছে। পূর্বেও কয়েকবার সে তাকে বলেছিলো একবার তার বাসায় গিয়ে কথা বলতে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কিন্তু ইফতির খুব আত্মসম্মান। সে চায় না এই অবস্থায় সে কোন মেয়ের বাবার কাছে মেয়েকে বিয়ের জন্য চাইতে। সবকিছু মিলিয়ে ইফতি দারুন সমস্যায় আছে কিন্তু সে কোনভাবেই তা তনুকে বুঝতে দেয় না।

আজ তনু যখন বিয়ের কথা বলেছে সে ঠিকই মনে মনে ভয় পাচ্ছে কিন্তু তা ওকে বুঝতে দিচ্ছে না।
অনেক্ষন হাটাহাটি করার পর ইফতি ঠোঁটে একটা সিগারেট রেখে আগুন দিচ্ছে। এমন সময় তনু বলল

– আচ্ছা এই ঘোড়ার ডিমটা না খেলে হয় না?
– এইটা ঘোড়ার ডিম কেমনে হলো?
– মজা কইরো না। সিগারেট খাওয়া কমিয়ে দেও। টাকাও সাশ্রয় হবে।
– আচ্ছা আম্মা।
– আচ্ছা ইফতি তোমার ব্যবসা টার কি খবর?
– সত্য বলবো নাকি বলবো ভালোই হচ্ছে সব?
– খুব খারাপ অবস্থা না?
– হুম। যাকে পার্টনার নিয়েছিলাম সে বেঈমানী না করলে খারাপ হতো না খুব একটা। এতদিনে একটা ভালো পজিশন থাকতো।
– থাক মন খারাপ কইরো না। আমি দুই রাকাত নফল নামাজ মেনেছি, সাথে দুইটা নফল রোজাও। তোমার চাকরির জন্য।

ইফতি খুব অবাক হয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটাকে সে গত ৬ বছরে দুইটা তাতের শাড়ি আর কয়েক মুঠ চুড়ি আর মাঝে মাঝে রাস্তায় ফুচকা খাওয়ানো ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। অন্য প্রেমিকার মত সে এগুলা নিয়ে রাগও করে না। অনার্স ফাইনাল দেওয়া একটা মেয়ে চাকরি না পাওয়া ,ব্যবসায় লস খাওয়া ছেলের সাথে এখনো এখনো সম্পর্ক রেখেছে এটা মাঝে মাঝে ইফতির কাছে স্বপ্ন মনে হয়। এই মেয়ে আবার তার জন্য রোযাও রাখে। ইফতি মাঝে মাঝে বুঝে পায় না তনু কেন তাকে এত ভালোবাসে?

– তুমি একটাা পাগল তনু।
– জানি।
– চলো সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি একটু গোডাউনে যাই। দেখি টাকা পয়সার জন্য আজ কে কে লাইন দিয়ে আছে।
– তুমি চিন্তা কইরো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইফতি জানে কোন কিছুই ঠিক হবে না , হলেও অনেক সময় লাগবে তাও তনুর শান্তনা তাকে অনেক সাহস দেয়।

রিকশা নিয়ে ইফতি তনুকে নামিয়ে দিয়ে আসলো বাসা্র সামনে এরপর সে আর একটা সিগারেট ধরাতে নিয়ে ভাবলো সিগারেট খাওয়াটা আসলেই ছেড়ে দিবে। অনেক টাকা খরচ হয়ে যায় এর পিছনে। সিগারেটটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে সে ও রওনা হলো তার গোডাউনের দিকে।

পাওনাদারদের টাকা দিতে পারছে না। বাড়িতেও টাকা দিতে পারছে না। মেসের অনেক মাসের ভাড়া জমে গিয়েছে। বুয়ার বেতনও দিতে পারছে না। খুব ঝামেলায় আছে ইফতি কিন্তু এগুলা সে কাকে বলবে? কার সাথে বলে নিজে একটু হালকা হবে? সে অনেক চিন্তা করে। সবকিছু মিলিয়ে অনেক অনেক চিন্তা তার। এর উপর তনুর বিয়ের চিন্তা ………।

শুক্রবার যথারীতিতে তনু আর ইফতির দেখা হয়ই কিন্তু এই শুক্রবার তনু আসতে পারবে না। তাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। এর আগেও এসেছে কিন্তু তনু বিয়ে ভেঙ্গে দিতে প্রতিবারই সফল ছিলো। এইবারও আশাবাদী। ইফতি যদিও বলে সে এইব্যাপারে মোটেও চিন্তিত না কিন্তু তার কলিজায় তনুকে হারানোর ভয়টা অনেক ভয়াবহ।

তনুকে পাত্র পক্ষ দেখে গেলো। পূর্বের বিয়ে গুলো সে যেভাবে ভেঙ্গেছে সব গুলোই ছিলো সে তার বান্ধবীদের দিয়ে ফোন করিয়ে বলত তনু মেয়ে ভালো না। হেন তেন আরো কতকি। ছেলেরা আর বিয়ের জন্য কথা বাড়াতো না। এইবার ছেলের অথবা তার পরিবারের কারো নাম্বার তনু জোগাড় করতে পারলো না। তনুর বাবা মা আগের ঘটনার অভিজ্ঞতায় কিছুটা বুঝতে পেরেছে বিয়ে ভাঙ্গায় তনুর হাত আছে তাই তারা এইবার তাদের মোবাইলেও ছেলের ও তার পরিবারের নাম্বার রাখে নাই। যাতে তনু নাম্বার না পায়।

তনু ইফতিকে ফোনে জানালো। ইফতি তাকে শান্তনা দিতে বলল

– আরে বিয়ে হবে না।
– তাই যেন হয়। আমি আরো দুইটা নফল রোজা মানত করেছি যাতে বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।
– তুমি চিন্তা কইরো না। বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। তুমি কি এত সুন্দরী নাকি যে তোমাকে দেখে বেটা মজনু হয়ে যাবে?
– কিহ আমি সুন্দর না?
– না। হাহাহাহাহহাহাহাহা
– আচ্ছা ঠিকাছে আমি সুন্দর না।
– আপনি এখন ঘুমান ম্যাডাম। অনেক রাত হইসে। নাহলে অসুন্দর চেহারাটা আর অসুন্দর হয়ে যাবে।
– কাল দেখা করবা?
– না রে কাল পারবো না। ব্যবসাটা বোধহয় বন্ধই হয়ে যাচ্ছে। কাল পাওনাদারদের গোডাউনের ফার্নিচার বিক্রি করে কিছু টাকা শোধ করতে হবে। আরেকদিন দেখা করবো।
– আচ্ছা। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি আছি। চাকরির জন্য কোনও ইন্টারভিউ কল এসেছে?
– না আসেনি। আসলে তো তোমাকে জানাতাম।
– চিন্তা কইরো না কিন্তু তুমি। ঠিকমত খেয়েছো রাতে?
– হুম। আচ্ছা ঘুমাও।
– আচ্ছা।

ফোন কাটার পর ইফতি তার রুমমেট তারেককে বলল তার অফিসে কোন চাকরি আছে কিনা? তারেক তার নতুন রুমমেট। সে ইফতির একটা সিভি চেয়ে নিলো। ছেলেটা খুব ভালো সাধাসিধে। মাত্র দুইমাস ধরে সে ইফতির সাথে থাকে কিন্তু ইফতিকে সে খুব পছন্দ করে। ইফতির ৭ মাসের পাওনা বাসা ভাড়ার মধ্যে সে ৩ মাসের ভাড়া সে দিয়ে দিয়েছে। ইফতি নিতে চায় নি। তারেক ইফতিকে বলেছে চাকরি পেলে সব টাকা সুদে আসলে উসুল করে নিবে। এটা সে দুষ্টামি করে বলেছে। সে যে সুদ নিবে না তা ইফতি ভালো করেই জানে।
ইফতির ব্যবসা টা অবশেষে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। অনেকদিন যাবৎ তনুর সাথে দেখা নাই তার। তনুর বিয়ের ব্যাপারে নাকি বেশ তাড়াহুড়ো চলছে বাসায়। ফোন করে শুধুই কান্না করে। খুব বলে কয়ে ইফতিকে দেখা করার জন্য রাজি করলো তনু। পরদিন সন্ধ্যায় দুজন ফুলার রোডে দেখা করতে গেলো। ইফতিকে প্রায় ১.৫ মাস পর দেখছে তনু। গাল চাপা ভেঙ্গে গিয়েছে। পড়নের শার্ট টাও ইস্ত্রি করা না। গাল ভর্তি দাড়ি। তনু তার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল।

– ইফতি তোমার এই অবস্থা কেন?
– ঐ রাতে রাতে একটু জ্বর থাকে ইদানিং।
– ডাক্তার দেখাবে এখনি। চলো আমার সাথে।
– না না তেমন জ্বর না। ঠিক হয়ে যাবে।
– তুমি আমাকে ভালোবাসো ইফতি?
– এতদিন পর এই প্রশ্ন?
– না এমনেই। আমার বিয়ের ব্যাপারে তুমি এখন কিছুই জিজ্ঞেস করো না ইফতি। তুমি কি চাচ্ছো আমার বিয়ে হয়ে যাক?
– না তা কেন চাইবো?
– তাহলে?
– আমি জানি তুমি বিয়েটা ভাংতে পারবে তাই নিশ্চিন্তে আছি।
কিছুক্ষন কথা বলার পর ইফতি তনুকে বলল
– আজ একা চলে যাও কষ্ট করে। তোমাকে বাসায় নামিয়ে আবার ফিরে আসার ভাড়া আমার কাছে নাই।
– ভাড়া আমি দিবো। তুমি চলো আমার সাথে..

রিকশা করে ইফতি তনুকে বাসায় নামিয়ে দিতে যাচ্ছে। কোন সময়ই তনু এমন করে না আজ কেন যেনো বারবার ইফতির ঘাড়ে মাথা রাখছে। শক্ত করে হাত জড়িয়ে ধরছে। কি যেনো বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। ইফতি তনুকে নামিয়ে দেয় ওদের বাসায় ঢোকার মোড়ে। একদম গেইট পর্যন্ত নামিয়ে দেওয়াটা কখনো হয় নি তার। তনু নেমে গেলো। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিকশা ওয়ালার হাতে দিয়ে ইফতিকে বলল

– তুমি বাসায় চলে যাও। আমি তোমার বাসায় যাওয়া পর্যন্ত ভাড়া তাকে দিয়ে দিয়েছি।
– আচ্ছা।
তনু চলে গেলো। ইফতি তাকিয়ে রইলো। এত সুন্দর কেন তনু? এত সুন্দর করে কেউ কিভাবে ভালোবাসে? ইফতি তনুর চলে যাওয়া দেখছে। বুকের বাম দিকে হাত দিয়ে অনুভব করলো বুকে চিন চিন একটা ব্যাথা করছে তার। ৬ টা বছর ধরে এই মেয়েটাকে নিয়ে বাকি জীবন পার করার স্বপ্ন দেখেছে সে। এই স্বপ্ন কি আদৌ পূরণ হবে ? এভাবে আরো ৮/১০ দিন কেটে গেলো। ইফতি প্রতিদিন সকালে মেস থেকে বের হয়। কোনও দোকানে সেলস ম্যান হিসেবেও যদি কাজ পায় তাও অন্তত কিছুটা চলে। তাও সে পাচ্ছে না। একদিন সে মেসে ফিরে দেখলো সিঁড়ির মধ্যে তনু বসে আছে। চোখ মুখ লাল। ইফতি তনুকে দেখে একরকমের ভয় পেয়ে গেলো।

– কি হইসে তনু?
সিঁড়ি থেকে উথে দাঁড়িয়ে ইফতিকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো তনু। ইফতি গেইটের তালা খুলে কোনরকমে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে পানির গ্লাস হাতে দিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করছে তার কি হয়েছে?
– ইফতি বিয়েটা আমি ভাঙ্গতে পারলাম না। বিয়েটা ঠিক হয়ে গিয়েছে। আমি ব্যর্থ ইফতি।
বুকের চিনচিন করে ব্যাথাটা আরো বেশি লাগছে ইফতির। সে তনুর মাথায় হাত দিয়ে বলছে
– আরে পাগলি বিয়ে কি হয়ে গিয়েছে নাকি? এর মধ্যে দেইখো বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।

শান্তনা দিতে গিয়ে আজ ইফতি নিজেই কেঁদে ফেলল।

একটা বদ্ধ ঘরের মধ্যে দুইজন এর চোখে পানি। একজন হাউমাউ করে কাঁদছে আর একজন নীরবে।

ইফতি তনুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো

– আমি কি তোমাকে হারায়া ফেলবো তনু?

-না। তুমি এভাবে বলো কেন? তুমি আমাকে সাহস দেও যাতে আমি কিছু করতে পারি।

ইফতি তনুর হাত দুইটা তার চোখের সামনে ধরে ছোট বাচ্চার মত কাঁদতে লাগলো…

-আমি অক্ষম। আমি ব্যর্থ তনু। আমি কিছুই করতে পারছি না।

-তুমি শান্ত হউ। তুমিও চেষ্টা করো আমিও করি। অন্তত তুমি একবার বাসায় আসো। আমার বাসায় এসে একবার আব্বার সাথে কথা বলো প্লিজ।

-কি বলবো? বলবো যে আমি বেকার?

-ইফতি তুমি একবার কথা বলে তো দেখতে পারো।

-তনু আমার সাথে থাকলে তুমি কিছুই পাবা না। যখন আমার মত তিন বেলায় একবেলা খাবা তখন আমাকে আর ভালোবাসতে ইচ্ছা করবে না।

-বাস অনেক হইছে। ৬ বছর পর এই কথা শুনতে আমি এখানে আসি নাই।

-তুমি রাগ হয়ো না। বাস্তবতা এটাই।

-রাগ নাহ …রাগ না আমি। কি চাও তুমি? আমি অন্য কোথাও বিয়ে করি? তাহলে এসব ঢং করছো কেনো?

তনু গেইট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় ইফতি হাত টেনে ধরলো তনুর।

-তনু তুমি পরিস্থিতি বুঝতে পারছো না।

-হ্যাঁ পারছি। ভালোই পারছি। একটা কথা বলি আমার গায়ে যখন অন্য কোন পুরুষ স্পর্শ করবে তোমার গায়ে আগুন জ্বলবে। বলে দিলাম।

-এসব বলবা না আমাকে।

-একশ একবার বলবো। তোমাকে শুধু আমার বাসায় কথা বলতে বলেছি তাতেও তুমি রাজি না।

-আমি কোন মুখে যাবো তনু?

-আমার হাত ছাড়ো …

খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে তনু ইফতির হাত ছাড়িয়ে বলল

আজকের পর আর আমার সাথে তুমি যোগাযোগ করবে না। একেবারেই না।

-তনু তুমি একটু শুনো …

তনু কোন কথা না শুনে নিচে নেমে গেলো।
ইফতির হাত পা কাঁপছে। সেই সকাল থেকে একটা বনরুটি খেয়ে আছে … ক্ষুধা মন্দা কিছুতে তার শরীর কাঁপছে না। সে তনুকে হারিয়ে ফেলছে এই ভয়ে কাঁপছে। তারেক ঘরে ঢুকে দেখলো ইফতি ঘরের এক কোণায় বসে কান্না করছে। ইফতি তারেককে তনুর ব্যাপারে সব খুলে বলল।

– সবই শুনলাম ইফতি,কিন্তু চাকরি পাওয়া তো কঠিন। তুমি তো ইন্টারভিউ দিয়েছো আমার অফিসে। একটু তো সময় লাগবে চাকরি হতে।

-ভাই আমি মনে হয় এবার তনুকে হারায়া ফেললাম।

-আরে না সব ঠিক হয়ে যাবে।

-ভাই দুইটা সিগারেট কিনে দিবা আমাকে? আমার কাছে টাকা নাই থাকলে আমিই কিনতাম।

-হুম কিনে দিবো। চলো আজকে আমি বেতন পাইসি। আগে রাতের খাবার টা খাই।

ইফতি খুব করুন চোখে তারেক কে জিজ্ঞেস করলো

-তনুর কি বিয়ে হয়ে যাবে ভাই?

-কিছুই হবে না। খেয়ে এসে আমার ফোন থেকে ভাবীকে ফোন করবা। আর বলবা তুমি চাকরির ব্যবস্থা করছো… একটু সময় লাগবে। কিন্তু হবে।

-হবে তো ভাই?

-হুম হবে। চলো।

দুইজন রাতের খাবার খেতে হোটেলে চলে গেলো।

তনু বাসায় গিয়ে তার মাকে ইফতির ব্যাপারে সব বলে দিলো… কিন্তু কেউই রাজি না। কেউই তনুকে সাপোর্ট করলো না বরং তার মা বলল তনু যদি ইফতিকে না ভুলে তাহলে সে বিষ খেয়ে মরবে… ৩য় শ্রেনীর কর্মচারীর বেকার ছেলের সাথে প্রেম করা যায় কিন্তু ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখা পাপ।

কিন্তু তনুকে কেউ বললেই তনু ইফতিকে ভুলে যাবে? এত সস্তা প্রেম নিশ্চয়ই সে করে নাই।

রাতে খাবার খেয়ে ফিরে ইফতি ফোন করার আগে তনুই তাকে ফোন করলো

-হ্যালো।

-হুম বাসায় গিয়েছো?

-হুম। তুমি কিছু খেয়েছো?

-হুম।

-আমাকে মাফ করে দিও।

-কেন?

-আমি তোমাকে ঐভাবে ঐ অবস্থায় ফেলে এসেছি। আমার এভাবে আসাটা ঠিক হয় নি।

-তুমি ঠিকই করেছো। ৬ বছরে এই প্রথম আমাকে তুমি রেখে চলে গিয়েছো। আমার নিজেকে অনেক অসহায় লাগছিলো।

ইফতিকে নিয়ে করা তনুর বাড়ির মানুষের মন্তব্য যদি ইফতি জানতে পারতো হয়ত লজ্জায় আর কখনো মুখ তুলে তাকাতে পারতো না। আজ তনু বুঝতে পেরেছে ইফতি কেনো এখানে আসতে চাইতো না।

-আমাকে মাফ কইরো।

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর ইফতি ফোন কানে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সারাদিন না খাওয়া। রোদে রোদে হেটে একেক জায়গায় গিয়েছে। বাস ভাড়াটাও তার কাছে নাই ।ক্লান্ত শরীর।

সকাল বেলা ইফতির ঘুম ভাংলো সুরমা বেগমের ফোন পেয়ে। কাঁদো কাঁদো গলায়

-বাবারে …

-মা কি হইছে?

-রাহেলারে ওরা কিচ্ছু রাখে নাই রে বাবা। মাইরের দাগে আমার মেয়ের চেহারা চিনা যাইতাসে না বাবা।

– ঐ হারামজাদা আপারে মারছে?

-হুম অনেক মারছে। তোর আব্বা থানায় গেছে। আমি রাহেলারে নিয়া হাসপাতালে আসছি।
বাবা তুইও আইসা পর।

তারেকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে কোনরকমে ইফতি রওনা হলো গ্রামের দিকে।
সন্ধ্যায় তনু যখন ফোন দিলো ইফতিকে তখন ইফতি তাকে সব খুলে বলল।

ইফতির বিপদের কথা শুনে তনুর আর বলা হলো না তার শুক্রবারে কাবিন। এত কিছুর মধ্যে এই কথা বলে ইফতিকে আর চিন্তা বাড়ানোর কোন যুক্তি তনু পেলো না। রাহেলার শ্বশুরবাড়ির নামে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে এসব নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে ইফতির আরো ৩ দিন লেগে গেলো। এরমধ্যে সে তনু কে একবারও ফোন করতে পারে নি। তনুই ফোন করেছে খোঁজ নিয়েছে।

সমস্যা একটু ঠিক হবার পর বৃহঃ রাতে তনু ফোন করলো।

-হ্যালো।

-কি ব্যাপার তোমার গলার কি হয়েছে?

-কিছুনা। একটু ঠান্ডা লেগেছে।

-ঠান্ডা পানি খায়ো না।

-হুম। বাড়ির সবাই কেমন আছে?

-রাহেলাকে বাড়িতে এনেছি। সবাই পেরেশানিতে আছে অনেক।

-ইফতি …

-হুম বলো।

-আমি যদি এখন তোমার গ্রামের বাড়ি চলে আসি তাহলে কেমন হবে? আমাকে গ্রহণ করবে?

-মানে?

ফোনের ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস এর আওয়াজ …

-কাল আমার বিয়ে।

দুইদিকই চুপ হয়ে গেলো। কোনও কথার আওয়াজ নাই অনেক্ষণ যাবৎ …

-দুষ্টামি করছো। তাই না?

-নাহ। তোমার এত ঝামেলার মাঝে তোমাকে আর ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছিলাম না। তুমিই বলো কিভাবে বলতাম তোমার এত ঝামেলার মাঝে আমি? এত স্বার্থপর আমি?

ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছে ইফতি।

-জান শুনো না। শেষ একবার এই বিয়েটা ভাঙ্গো। আমি সব ঠিক করে দিবো। একটু সময় লাগবে। ধুর আমিও না আবোল তাবোল বলছি। তুমি বিয়ে করে ফেলো তনু। তুমি কান্না কইরো না। তুমি অন্য কোথাও ই ভালো থাকবা।

-ইফতি একটা কথা বলি?

-বলো। কিন্তু এটা বইলো না যে তুমি এখানে চলে আসতে চাইছো। আমি তোমাকে পাওয়ার লোভ সামলাতে পারবো না …

– ইফতি উপর আল্লাহ এই জনমে তোমার আমার কপালে কি লিখে রাখছে আমি জানি না। মরার পর আমি যদি আমার কোন পূন্যের কারণে বেহেশত পাই তাহলে আমি বেহেশতে তোমাকে ছাড়া এক পাও সামনে যাবো না বলে দিচ্ছি। কথা দেও তখন আমি শুধু তোমার হবো।

-তনু তুমি এভাবে বইলো না।

তনু কাঁদছে। আর ইফতির কান্না আওয়াজ বিহীন।
ফোনের একপাশে বাজছে বিয়ে বাড়ির গান। আরেকপাশে অন্ধাকেরর ঝিঝি পোকার আওয়াজ। ক্রমশ দুইজনের নিশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

আজ তনুর বিয়ে। ইফতি আজ সারাদিনে ঘর থেকে বের হয়নি। রাতে যখন সে বিছানায় শুয়ে অনুমান করছে যে তনুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে …তাকে তার স্বামী নিয়ে গিয়েছে নিজের শোবার ঘরে। শাড়ির একটা একটা সেফটিপিন খুলে তনুকে আদর করছে সে আউলিয়ে যাচ্ছে। সে আজ কিছুই ভাবতে পারছে না। তনুর কন্ঠ না শুনলে বোধহয় তার এখন দম আটকে আসবে। কিন্তু ফোন করা যাবে না। সে নিজে দুর্বল তাই বলে তনুকে দুর্বল করা তার মোটেও উচিৎ হবে না।
রাতে সুরমা বেগম যখন ইফতিকে খাবার জন্য ডাকতে আসলো ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দেখলো গা পুড়ে যাচ্ছে।

-বাবা ও বাবা কি হইছে তোর?

-মা আমার তনুর গায়ে অন্যের স্পর্শ পরছে মা … আমার গা পুড়াচ্ছে মা। মা গো আমার তনু অন্যের হয়ে গেলো মা।

ছেলের এমন পাগলামি কথা শুনে সুরমা দৌড়ে বের হলো ঘর থেকে সবাইকে ডাকতে।
ইফতির গায়ে এত জ্বর ছিলো যে সে তার মাকে কি বলছিলো তার মাথা কাজ করছিলো না।
আবোল তাবোল বকতেই আছে সেই তখন থেকে।

রাহেলা শরীর মুছিয়ে দিচ্ছে। ইফতির মা মাথায় পানি ঢালছে। চিন্তা অভাব ভালোবাসা হারানো মানুষটার চেহারা অনেক ভিন্ন আজ। ফ্যাকাশে একটা চেহারা। গাল ভর্তি দাড়ি। ভাঙ্গা চোয়াল। গর্তে ঢুকে যাওয়া চোখ। ঠোঁট গুলো শুকিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

সারারাত এক নাগারে সে বলেই চলেছে।
” তনু আমার গা পুড়াচ্ছে… ওকে সড়ায়া দেও নাহলে আমি ছাই হয়ে যাবো।”

ডাক্তার আনা হলো বাড়িতে … ঔষধ দিলো কিন্তু এক বিন্দুও জ্বর কমলো না দুইদিনে।
দুইদিন পরে ইফতিকে সবাই হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি করছে এমন সময় তারেক দৌড়ে আসলো হাতে একটা হলুদ খাম নিয়ে। খামের ভেতর ইফতির এপোয়েনমেন্ট লেটার।

লোকটা উচ্চস্বরে দৌড়ে এসে বলছে

-ভাই চাকরিটা হয়ে গিয়েছে তোমার।

ইফতি তাকাতে পারছে না। খুব ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে সে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।

হয়ত সে বলতে চেয়েছিলো ” হলুদ খামটা আসতে বড্ড দেরী করে ফেলল… আহারে বড্ড দেরী …”

সবার চোখের সামনেই ইফতি একবার বড় নিশ্বাস ছেড়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে।

তনুকে এই দুসংবাদ জানাতে তারেক যখন ফোন করলেন তনুর ফোনে, শুনতে পেলো

“তনু নামক মেয়েটা আরো ২ দিন আগে রাতে তাহাজ্জুদের নামাজে বসে সেজদা থেকে আর উঠে নি।
একটা ছোট্ট খুব সামান্য একটা ব্রেইন স্ট্রোক করেছে…

কিন্তু বাঁচতে পারে নি। ইফতি জানতেও পারলো না তার বিয়ে হয় নি। তার গায়ে অন্য কারো স্পর্শ লাগে নি। সেও ইফতির আগেই চলে গিয়েছে। হয়ত হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছে ইফতির জন্য।

হয়ত ঐ দুনিয়ায় বেকার ইফতির প্রেমের বিচ্ছেদ হবে না। একটা হলুদ খামের অপেক্ষা করতে হবে না। ”

ফোনের এপাশ ওপাশ দুইপাশেই স্বজন হারানো কান্নার আওয়াজ। তারেক চশমা খুলে চোখ মুছে ইফতির সামনে দাড়িয়ে বলছে

-উঠেন ভাই। আপনারে সিগারেট খাওয়ার টাকা দিবো। উঠেন।

দুইজনই হয়ত কোথাও থেকে বলছে ” আহারে হলুদ খাম তুমি বড্ড দেরি করে ফেলেছো”

আমাদের চারপাশে ইফতি অথবা তনু কারোরই কোন অভাব নাই। কিন্তু দেখি না আমরা। এরা মরে না। তনুরা দাঁত কামড়ে সংসার করে আর ইফতিরা যখন ভাবে তনুর শরীর থেকে একটু একটু করে তার স্বামী কাপড় সরাচ্ছে তখন তাদের ভেতরটা জ্বলে।

বেঁচে থাকুক ভালোবাসা মরনেরও পরে।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত