ওই ছেমড়ি কই যাস?
অবনী চমকে তাকায় ৷ দেখে তার সামনে এক বয়স্ক মহিলা ৷ গায়ে ছেড়া শাড়ি, এলোমেলো জটা ধরা ময়লা চুল, এমনিতেই কালো তার ওপর গায়ে ময়লার আস্তরণ ৷
‘ওই ছেমড়ি আমারে একটা শাড়ি দিবি? লাল শাড়ি?’ মহিলা অবনীর দিকে এক পা এগিয়ে আসে ৷
পাশ থেকে এক রিকশাওয়ালা বলে উঠল- ‘আফা, ওয় পাগল, ওর কথা শুইনেন না, আপনে যান ৷
অবনী মহিলার থেকে দূরে গিয়ে হাঁটা শুরু করে ৷
‘ডরাইসে, আমারে ডরাইসে! হেহেহে, ওই যাইস না খাড়া!’
অবনী পেছনে তাকালো না আর ৷ এই এলাকায় নতুন সে, দুদিন আগেই এসেছে, আর প্রথমদিন রাস্তায় বেরিয়েই এই ঘটনা ৷
প্রায় এক সপ্তাহ পর আবার একদিন অবনী রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে, পাগলীটা এসে ওর হাত প্রায় জাপটে ধরল ৷ একদিনেও সে বেশ কয়েকবার পাগলীটাকে দেখেছে কিন্তু দূর থেকে ৷ আজ সামনাসামনা পড়ে যাওয়ায় সে বেশ ভয় পেয়ে গেল ৷ ‘দে না, ছেমড়ি একটা লাল শাড়ি দে!’
অবনী হাতটা ছাড়াতে গেলে মহিলা ওর হাত আরো জোরে জাপটে ধরল ৷
‘আজকে ছাড়মু না, দিতেই হইব লাল শাড়ি ৷’
পাগলীর চেঁচামেচিতেই আশেপাশে বেশ কিছু মানুষ জড় হল, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, কেউ আবার এগিয়ে এল সাহায্য করতে ৷ বকে ধমকে অবনীর হাতটা ছাড়িয়ে নিল পাগলীর থেকে, পাগলীটাকে টেনে নিয়ে গেল ৷
এরপর রমজান মাস শুরু হয়ে গেল, অবনীদের বাড়িতে ইফতারে প্রায়ই একে তাকে দাওয়াত করা হয় ৷ হঠাৎ অবনীর মনে হল, সে-ও পাগলীটাকে কিছু খাওয়াবে ৷ পরদিন বাসার দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল ৷ দারোয়ান বলল- ‘লাভ নাই আপা, ওরে অনেকেই খাইতে টাইতে দেয় মাঝে মাঝে, ওইগুলা নেয় না ৷’
‘কেন?’
‘পাগলের কামকাজ, ওয় খালি ময়লা টোকাইয়াই খায় ৷ ওরে খাওন দিলে রাস্তার ভিক্ষুক পোলাপাইনগুলা নিয়া খায় ৷’
অবনী তবু একদিন পাগলীটাকে খাবার দিয়ে এল, পাগলীটা রাস্তায় শুয়ে ছিল ৷ অবনী একটা পলিথিনে ইফতার নিয়ে রেখে এল ওর পাশে ৷ বলল- খেয়ে নেন ৷ পাগলীটা ছুয়েও দেখল না ৷ বরং চেঁচিয়ে বলল- ‘ছেমড়ি যা এইখানতে, এডিও নিয়া যা! খাওনের আমার অভাব আছে? ফকির আমি?’
অবনী পরে দারোয়ানকে আবার জিজ্ঞেস করেছিব পাগলীটার কথা ৷ দারোয়ান জানাল- পাগলী এমনই ৷ খাবার নেয় না ৷ ও মানুষের কাছে শুধু একটা লাল শাড়ি চায় ৷
‘কেন?’
‘যতদূর শুনসি, গায়ের রং কালো দেইখা বিয়া হইতো না ওর ৷ বয়স হইয়া যাইতাসিল, এইদিকে পাত্র পায় না ৷ শেষে একটা লোক রাজি হয় কিন্তু অনেক টেকাপয়সা, জিনিসপাতি যৌতুক চাইসিলো, ওর ভাইয়ে দিব কইয়াও দিতে পারে নাই ৷ তাই বিয়ার দিন জামাই বিয়া না কইরাই গেলো গা ৷ কত যে কথা শুনতে হইসে ওইদিন ৷ তারপর থেইকাই নাকি পাগল হইয়া গেসিলো ৷ গরিব ভাই আর কয়দিন পালব? বাইর কইরা দিসে, তারপর থেইকা রাস্তায় ৷ লাল শাড়ি পইরা বিয়া বইব এই কথা কইয়া বেড়াইতো সারাদিন, এই জন্যই লাল শাড়ি চাইয়া বেড়ায় ৷’
কিছুদিন পর ঈদের শপিং করতে গিয়ে অবনী কি মনে করে পাগলীটার জন্য একটা লাল শাড়ি কিনে ফেলল ৷
ঈদের দুইদিন বাকি, সে এ কদিনে পাগলীটা অনেক খুঁজেছে শাড়িটা দেবে বলে, কিন্তু পায় নি ৷ অাজ অনেক খুঁজে কয়েক গলি পরে পাগলীটাকে রাস্তায় শুয়ে থাকতে দেখল ৷ শাড়িটা নিয়ে এসে পাগলীটার কাছে দাঁড়াল ৷ পাগলীটাকে অন্যরদিনের চেয়ে আরো দুর্বল লাগছে, চোখ লাল, ঠোঁটটা আরো কালচে আর ফ্যাকাসে ৷ অবনী পাগলীটার কাছে উবু হয়ে ডাকল, তারপর পাগলীর হাতে শাড়িটা ধরিয়ে দিল ৷ পাগলীটার চোখ শাড়িটা দেখে চকচক করে উঠল ৷ পাগলী শাড়িটা জাপটে ধরল বুকে, ‘আমার লাল শাড়ি! আমার লাল শাড়ি! এইবার আমি বিয়া করুম ৷’
অবনীর চোখে পানি এসে যাচ্ছিল তাই সে তাড়াতাড়ি চলে এল সেখান থেকে ৷
ঈদের দিন, সকালবেলা অবনী ঘুরতে বেরোচ্ছিল ৷ বাসার একটু সামনে গিয়েই দেখল একটা জটলা ৷ অবনী যাবে না যাবে না করেও কৌতুহলী হয়ে জটলার দিকে এগোল ৷ ভিড় ঠেলে একটু গিয়ে দেখল, রাস্তায় পাগলীটা শুয়ে আছে ৷ তার মুখের কাছে কয়েকটা মাছি উড়ছে ৷
অবনীর বুকটা ধক করে উঠল ৷ পাগলীটাকে দেখে মনে হবে ঘুমাচ্ছে কিন্তু তার শোয়ার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে- পাগলীটা আর বেঁচে নেই ৷ অবনী তবু এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা ধরল, দেখল ঠান্ডা নিস্তেজ হাত, জমে গেছে ৷ তার মানে অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে ৷ হয়তো কাল রাতেই ৷ কেউ টেরও পায় নি!
অবনী এতক্ষন খেয়াল করেনি, এখন ভাল করে তাকিয়ে দেখল, পাগলীটার গায়ে সেই লাল শাড়িটা যেটা অবনী সেদিন দিয়েছিল, আর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ৷ অবনী উঠে পড়ল সেখান থেকে, সরে আসতে লাগল ৷ তখন শুনতে পেল, পেছন থেকে কেউ বলছে- ‘পাগলীর সাধটা তবু পূরণ হল ৷ বিয়ে হয়নি কিন্তু অন্তত লাল শাড়িটা পড়া হল ৷ বোধহয় এর জন্যই বেঁচে ছিল এতদিন ৷’