আমি আবির।ভ্রমন আমার খুব প্রিয়।তবে সব থেকে প্রিয় ট্রেন ভ্রমন।যখন ট্রেনটা মাঠের মধ্যো দিয়ে যায় চারিদিকে সবুজের সমারোহ দেখে হৃদয়টা জুড়িয়ে যায়।মনে হয় কোটি টাকা খরচ করেও সে সৌন্দর্যেররূপ কোথাও পাওয়া যাবেনা।আর এজন্য জানালার পাশে বসি।
–
জয়দেবপুর থেকে দিনাজপুর আসতেছিলাম।দুর্ভাগ্যক্রমে রাতের ট্রেনে উঠতে হয়।মনটা খুব খারাপ।সবুজ মাঠ আমি দেখতে পাবোনা।সৌন্দর্যপিপাসু মনের তৃষ্ণাও মিটবে না।জানালার পাশে সিট তবুও মন বিষন্ন!ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে হুইসেল দিচ্ছে বারবার।এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে এক বৃদ্ধ বস্তার মধ্যে কিছু জিনিস পত্র নিয়ে আমার পাশে এসে বসলো।লোকটাকে দেখে কেমন যেন মায়া মায়া লাগছে।শীতের দিন অথচ পরনে একটা লুঙ্গি আর গাঁয়ে হাফ হাতা একটা পাতলা শার্ট।কাঁপছে লোকটা।মনে হচ্ছে খুব গরিব।লেখকেরা বুঝতে পারে মানুষের কষ্ট।অনুধাবন করতে পারে কে ভালো কে মন্দ।আরমান ভাইয়া আমাকে কিছু কাপড় দিয়েছে বাড়ির জন্য।আমার বড় ভাই আরমান।ফুটপাতে কাপড়ের দোকান করে গাজিপুরে।লোকটার দিকে একটা টাউজার বাড়িয়ে দিলাম। “চাচা এটা পড়ে নেন।তা না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
–
“না বাবা থাইক।কিচ্ছু হইবো না।এমনে পুরো শীত চইলা গেলো,আর এহনতো শীত কম।”
তাও জোরাজুরি করে পড়ায় দিলাম।
–
যাই হোক আমার কাছে টাকা ছিল কিছু।ভাইয়ার সঞ্চয়ে জমার জন্য দিয়েছে।তাই ঘুমও আসতেছে না।ভ্রমনে এমনিতেই ঘুমাই না।তারপর আবার পকেটে টাকা।কাউকেই বিশ্বাস নাই আজকাল।সবাই ভদ্র মানুষের মুখোশ পড়ে থাকে।সুযোগ বুঝেই আসল রূপের কাজটা সেরে ফেলে।ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চোখ ধাঁধানো সবুজ ক্ষেতের মাঝে দিঘির জলের ঝিকিমিকি নাচ আমার দৃষ্টি স্থীর করলো।সে সৌন্দর্যের বর্ণনা নেই।অমায়িক সে রূপ।চমকে উঠলাম এখনতো রাত তবে আমি দিনের আলো দেখতে পাচ্ছি কেনো!আমি স্বপ্নের মধ্যে আছি নাকি?আমার পকেটে টাকা আছে আমার তো ঘুমোলে চলবে না!পাশে তাকালাম ওহহ বৃদ্ধ লোকটা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।তাহলে!চিমটি কাটলাম নিজেকে,এতো জরে চিমটি কাটছি যে নিজেই আউউউউউউউইই করে চিৎকার দিছি।সবাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।পাশের বৃদ্ধ লোকটাও জেগে উঠে বলছে, “কি হয়েছে বাবা আপনের?”
–
“বাবা” ডাক টা এভাবে শুনবো বুঝতে পারিনি!যেন পিতৃস্নেহের সকল ভালোবাসা তাতে মেশানো।বাবা,বাবা গো,যেনো হৃদয়ের গভীর থেকে আসে সে ডাক।
আমি বললাম কিছুনা চাচা।এমনি স্বপ্ন দেখছিলাম।চাচা শুনে উৎসুক দৃষ্টি দিলো আমার দিকে।আমি সে দিকে লক্ষ্য না করে জানালার পাশে তাকালাম আবার।
–
হঠাৎ যেনো আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো।এই শীতেও কি বৃষ্টি নামবে নাকি?আসলেই মায়ের কথা ঠিক সময়গুলো বদলে গেছে।সময় অসময়ে দুর্যোগ আসে!আমি কালো মেঘ দেখার জন্য একটু হেলে দেখতে চাইলাম আকাশটা।যা দেখলাম,তাতে মুগ্ধময়।আমার বিষন্ন মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো।সে বিধু এতো উজোলা গো।যে কারো মন কেঁড়ে নেবে ক্ষনিকের মধ্যে।পাগল করে দেবে তার প্রেমে।এতো রূপও কি কারো হয় গো।যে রূপের ছটা নেই।শুধু আলো আর আলো।সে আলো কি আমার হবে,যে আলোয় প্রেম আছ।।
পাশের বৃদ্ধকে প্রশ্ন করলাম চাচা আজকে চাঁদটা দেখেছেন অনেক সুন্দর।
–
“ওসব স্বার্থপর হুন্দর জিনিস আমগো লাইগা না বাবা।” বিস্মিত হলাম!কিন্তু চাঁদের সৌন্দর্যের কাছে আমার এ বিস্ময় কিছুইনা।ফেসবুকে পোষ্ট দেওয়ার জন্য লগ ইন করলাম।ঢুকেই দেখি সবার পোষ্টে আজকের চাঁদ।এটা নাকি “সুপার মুন”।প্রায় ৬৮ বছর পর যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি আজ।ভীষণ সুন্দর সে চাঁদ।যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে,আর মিটিমিটি হাসছে।সে হাসি ভোলার নয়,আমার স্বপ্নের নীলার মতো।এমন সময় কিছু অপরিচিত মানুষের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠে।দেখা হয়নি তবুও মাইক্রোফোনে শোনা কন্ঠে সে মুখের ছবি এ হৃদয় এঁকে ফেলে যত্নে।ফোন দেই সাদিয়া আপুকে।বলে দেই আজকের চাঁদের হাসির কথা।মনে করিয়ে দেই তার প্রিয়জনকে এ চাঁদ দেখানোর কথা। এসব কিছুতেও একটা আনন্দ আছে,যেটা নিজেরও অজানা।থাক না অজানা!জীবনে কিছু কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো।
–
ততক্ষণে টিকিট চেকার চাচার সাথে ঝগড়া শুরু করেছে টিকিট নিয়ে।বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠার জন্য।আমি টিকিটের বদলে কিছু টাকা দিয়ে টিটিকে বিদায় করলাম।
–আচ্ছা চাচা আপনি কি করেন?
–বাবা আমি হাতে তৈরি হরেক রকম জিনিস রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করি।যেমন ছোট ছোট পোলাপাইনগো খেলনা,বাঁশের পাখা,বাঁশের ফুলদানি আরও অনেক জিনিস।
–দিনে কতো টাকা ইনকাম হয়?
–২০০-২৫০টেহা।মাঝে মাঝে ৫০টেহাও হয়তো না।
–পরিবারে কে কে আছে?
–এহন তোমার চাচি আর আমি।
–ছেলে-মেয়ে নাই??
–থাইকাও নাই বাবাগো!একটা পোলা আর একটা মাইয়া ছিল।কষ্ট কইরা লেখা-পড়ান শিখাইলাম।ভিটা-মাটি বিক্রি করে বড় পোলাডারে ঢাহা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াইলাম।পড়া-লেহাই ফাস্ট ছিলো।সরকারে বিদেশ পাঠাইলো।প্রথম প্রথম টেহা দিতো।সুখেই কাঁটছিল দিন।মনে করলাম মাইয়াডারে ডাক্তার বানামু।কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই টেহা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।হেয় আর খোঁজ খবরও নিতো না! মাইয়াডা মেট্টিক পাশ করলো।স্কুলে হকলের মধ্যে ফাস্ট হইলো।কিন্তু বাবাগো কলেজে ভর্তি করার মতো টেহা ছিলো না আমার কাছে।তাও অনেক কষ্টে ভর্তি করাইলাম।তবে বই,খাতা কিইন্না দিবার পারি নাই!বাবাগো ক্ষুধার জ্বালা বড় কঠিন!একবেলা খাইয়া,দুবেলা অনাহারে থাকার যন্ত্রনা ভুলবার পারিনাহ বাবাগো!এই ক্ষুধার জ্বালা নিয়া কি পড়া-লেহা হয় বাবা!?
মাইয়াডারে আর ডাক্তার বানাইতে পারি নাই।বিয়া দেই,একটা সুন্দর পোলা দেইহা।কোম্পানিতে চাকরি করে জামাই।কিন্তু মাইডার কফালে সুখ হইলোনা!৯০হাজার টেহা ডিমান্ড হয়,কিন্তু আজও সবটা দিবার পারিনাই।মাইয়াডারে সবসময় মারে জামাই,শ্বাশুড়ী টেহার জন্য!
–
কথাগুলো বলতে বলতে চোখের রুক্ষ পাতাগুলো ভিজে মোলায়েম হয়ে গেল বৃদ্ধের।আমার চোখের জল বা কই রাখি।ও কষ্টরে তুমি কার!সে কি কেবলি অভাগার?
–আচ্ছা চাচা চাচি কেমন আছে?
–হুমমমমম ভালা।
–আর এই জিনিসপত্রগুলো কখন তৈরি করেন?
–বাবাগো এগুলো তোমার চাচি তৈরি করে আর আমি বিক্রি করি।
–আচ্ছা চাচা সারাদিনে ঘুড়ে বেড়াতে কষ্ট হয়না?
–আরে বাবা এই বয়সে তো কষ্ট হইবোই।কিন্তু ছোট ছোট পোলাপাইনগুলা পিছে পিছে আসে বলে আমারে এই বাঁশিটা দেন,আমি ঐটা নিবো।যখন ওদের মা-বাবা কিনে দেয় তখন পোলাপাইনের খুশি দেইহা খুব ভালা লাগে গো বাবা।
–কতদিন ধরে এই ব্যবসা করছেন?
–এই ছয়-সাত বছর হবে।আগে সেলাই এর কাজ করতাম।
–এখন করেন না কেনো?
–বাবা গো এখন চোখ আর সয়েনা,সুইয়ের ফুটোয় সুতোও ঢুকেনা।(হাসি)
–(মজা করে)আচ্ছা চাচা,চাচীর একা এসব তৈরি করতে কষ্ট হয়।আর একটা বিয়ে করলেই তো পারতেন।
–বাবাগো ৩৯ সের এ কি মণ হয়?আমারতো একটাই মন।পুরো মনটাই দিয়ে দিছি ওরে।
আমি অবাক হয়ে যাই!এই বৃদ্ধ বয়সেও চাচার ভালোবাসায় এতটুকু খাদ নেই।অনেক মজার মানুষ একটা।৬২/৬৩বছর বয়সেও কি কারো এতো ভালোবাসা থাকে?যদি থাকে তবে সে ভালোবাসার ছোয়া আমি নিতে চাই।
সামনে স্টেশনে ট্রেন থামলো চাচা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে “বাবাগো সুখি হও” দুআ দিলো।খুব জোরাজুরি করেছিল উনার বাসায় একটা দিন থাকার জন্য।দেখিয়ে দিলো স্টেশনের পাশেই টিনের চালার বাড়িটা।”সময় করে একদিন আইসো বাবা”।
–হুমমম আচ্ছা।
এসব মানুষের মন এতো বড় হয়!প্রকৃত পক্ষে এদেরকে কি গরিব বলা যাবে?আমি যদি গরিব বলি তবে পাপ হবে।সে পাপে আমার অমঙ্গল হব।চাচা বিদায় জানিয়ে নেমে গেলো।ট্রেন ছাড়লো ঝনঝনা ঝন শব্দে।
–
চাঁদটা নেই এখন রাতের আকাশে।চারিদিকে অন্ধকার।এ অন্ধকারে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে।ঘুমঘুম ভাব হঠাৎ কানে বেঁজে ওঠে ‘বাবা,বাবাগো’ চমকে উঠি।অদ্ভুত!অপরিচিতো মানুষগুলো কেমন যেনো নিজের অজান্তেই মনের এক কোণে ঠাই বসে যায়।চাইলেও সরানো যায়না।এ বাঁধন যে মায়ার।সে মায়া কেমন গো,তা কি আমি দেখিতে পাবো!?
সময় পার হয়ে যায়।বর্ষা আসে প্রকৃতির মাঝে।কয়েকটা বর্ষাও চলে যায় টিনের চাঁলে ঝমঝমানি দিয়ে।সময়ের সাথে সৃতির পাতায় ঢাকা পড়ে ‘বাবা,বাবাগো’ ডাকটা।
আমার বড় আপু খুব অসুস্থ।চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়।আমি যাই সাথে।কয়েকদিনের ভেতরেই সুস্থ হয়ে উঠলো আপু।তারপর বাড়ির পথে যাত্রা শুরু ট্রেনে।আজ আর রাতে নয়,দিনের ঝকঝকা আলোয়।সে দিনের চাঁদের কথা মনে পড়ে যায় খুব মিস করি সে চাঁদের হাসি।যে হাসি গুদুমগাদুম(মোটাসোটা টাইপ)শিশুর মুখেই মানায়।
হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় “বাবা,বাবাগো” চির পরিচিতো সে ডাক।আরেকবার দে হাক!ট্রেন যখন চাচার বাড়ির কাছের রেল স্টেশনে থামে,নেমে পড়ি।আপুকে বলি এখানে পরিচিত বন্ধুর বাসায় থাকবো আজ।
–আচ্ছা থাকো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল কে হাতছানি দিয়ে ডাকছে হলদে লাল সূর্যটা।এগিয়ে গেলাম টিনের চালাটার দিকে।অনেকদিনের পুরোনো মরিচা ধরে ফুটো ফুটো হয়ে গেছে টিনগুলো।জল আর অক্সিজেন ও বুঝেনা নাকি চাচার কষ্ট!
–
আমি দরজার কাছে না যেতেই এক বৃদ্ধাকে কাঁধে নিয়ে চাচা বেরিয়ে আসছেন।সালাম দিয়ে,পরিচয় দিলাম।চিনলো কি না বুঝলাম না! শুধু আড় চোখে আমার দিকে আরেকবার তাকালো।তারপর ছলোছলো চোখে বৃদ্ধ চাচা বৃদ্ধাকে নিয়ে সামনে হাঁটা শুরু করলো।আমি কয়েকবার ডাকলাম পেছন ফিরে তাকালো না।আমি ঐ পথে তাকিয়ে থাকলাম। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম জানিনা।
আমার সামনে একটা মধ্য বয়স্ক লোক এসে বললো “কে তুমি বাবা?আগে তো কখনো দেহিনি তোমাকে!তুমি কি শুভ?”
আমি সব বললাম।লোকটাকে বললাম “শুভ কে?”
–শুভ ঐ বৃদ্ধের একমাত্র পোলা।সেই যে গেলো বিদেশ পড়া-লেহা করতে আর মা-বাবারও খোঁজ নিলো না পোলাডা।পড়া কফাল বেচারার,কষ্ট হইরা পড়া-লেহা করাইয়া কি হইলো বলো তো!?বাপ-মায়রে যদি এমন কষ্ট করার লাগবো পোলারে মানুষ কইরা,তয় পড়া-লেহা করনের কি দরকার?বইনে খুব অসুস্থ(বৃদ্ধার স্ত্রী)। অথচ ভাইয়ে কতো ভালোবাসে বইন রে,সব সময় কোলে-পিঠে করে রাখে।
মধ্যবয়স্ক লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম “বৃদ্ধ চাচা চাচীকে পিঠে করে কোথায় নিয়ে গেলো?”
–সামনে বাজারে।বাজারে ভিক্ষা করে যা পায় তা খেয়ে কোন মতে দিন পার করে।
–
আঘাত পেলাম!প্রচন্ড সে আঘাতের ধাক্কা সহ্য করা যায়না।মনকে বোঝাতে গেলে,চোখ আর বাঁধা মানেনা।আজব পৃথিবী!অদ্ভুত তার নিয়ম!যে আশায় সন্তানকে মানুষ করলো,সে আশাতে লাথি মেরে সুখে থাকে সন্তান!ইচ্ছে করছিলো বৃদ্ধ চাচার ছেলেকে পেলে ইচ্ছে মতো পিটাইতাম।নিজে কোটি টাকার মালিক অথচ নিজের বাবা-মা বাজারে ভিক্ষা করছে।এর থেকে করুণ বেদনার ছবি বিধাতার সৃষ্টি পৃথিবীতে আর কি হতে পারে!”
বাজারে যাই।দেখা হয় চাচার সাথে।চাচীকে সালাম দেই।চাচীর পায়ের ধুলো নিতে গিয়ে চাচী কেঁদে ফেলে।মাথা ছুঁয়ে দেয় আমার।জড়িয়ে বুকে নেয় আমাকে।সে কি ভালোবাসাগো,কি করে বুঝাই!মনে হয় তার ছেলে শুভকে ফির পেয়েছে।চোখেও যেনো সুখের তৃপ্তির সে জল।হোটেলে একসাথে দুপুরে ভাত খাই।অনেকটা সময় কাটাই তাদের সাথে।সূর্যটা পশ্চিম আকাশে নেই।কিন্তু সন্ধার পূর্ব মহূর্তে আকাশটা ঝকঝকা হলদে ভাব নিয়েছে।আজ যেনো আকাশটাও হাসছে।
বৃদ্ধ চাচীকে বললাম “আপনার শেষ ইচ্ছে কি চাচী আম্মা?
–আমার শুভ রে একটি বারের লাইগা দেহা বাবা।
আমি চমকে যাই,কি মানুষরে ভাই!যে ছেলে এক যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরও অসোহায় মা- বাবার খোঁজখবর নেয়না!আর সেই ছেলেকে একটি বার দেখার জন্য জনম দুখিনী মায়ের বুকটা আজও শুণ্য।তবে কি এটাই ভালোবাসা?যদি তাই হয় তবে পবিত্র ভালোবাসাকে সালাম জানাই।খরচের জন্য কিছু টাকা দিয়ে রাতের ট্রেনেই উঠে পড়ি।আমি ছাত্র মানুষ।মাসের শেষের দিনগুলোতে অভাব দরজায় কড়া নাড়ে।পকেটে ঠাটা পড়ে।তাও এই মানুষগুলোর খুশি,আমার মনে তৃপ্তি যোগায়।আসল সুখটা কোথায় জানেন?অসোহায় মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর মাঝে।
–
আজ আর আকাশে সুপার মুন নেই।আমার মনের আকাশেও মেঘ জমে।সে মেঘ উড়ানোর মতো বাতাস প্রকৃতির মাঝে নেই।চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে।
মনের মাঝে ভাবনা উদয় হয়।বিষন্নতা ভর করে তাতে।বিষন্নতার ঘর কাটাতে চোখ খুলে ফেলি।জানালার দিকে তাকাই,শুধু অন্ধকার।আজ বিরক্তিকর ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোর ডাক খুব মনে পড়ছে।ট্রেনের ঝনঝনানি তাও ভুলিয়ে দেয়।দূরের শহরে সোডিয়ামের বাতিগুলো চোখে ধরে।মিটিমিটি সে আলো অন্ধকারে ভালোই লাগে।
দিনাজপুরে মেসে আসি।রাতে ঘুম আসে আসে এমন সময় বারবার একটি কথা মনে পড়ে “আমার শুভ রে একটা বারের লাইগা দেহা বাবারে।”ঘুম আসেনা ঘুম আসেনা,
একলা জেগে রই,
চাচী ও চাচী তোমার ভালোবাসা এই!”
–
মনের মাঝে খটা দেয় চাচীর সে চাওয়া।কেমন করে সে ছেলেরে পাবো খুঁজে,মায়ের আশা পুরে দেবো
যদি খোদা চায়।বর্ষা আসে বর্ষা যায়।কিন্তু সুপার মুন আসেনা আকাশে,মা ফিরে পায়না তার শুভ রে।
স্নেহের সে বাঁধনের টানে শীতের ছুটিতে কিছু কাপড় নিয়ে ছুটে যাই বৃদ্ধ চাচার ঘরে।কবি সুফিয়া কামালের শীতের বেদনা যে এতই কঠিন।তা কেবলি আজ বৃদ্ধ চাচাই বুঝতে পারছে।চাচীর আশা অপূর্ণই রয়ে গেলো।দেখা হলোনা শুভকে।চাচার ঘর থেকে সব শুভ যেনো হারিয়ে গেছে,রেখে গেছে অশুভ কিছু বেদনা।
চাচী অপারে পাড়ি দিলো,একলা চাচারে ছেড়ে।ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে যায়,মনের আকাশে এক ডালি বেদনার মেঘ জমিয়ে।সে মেঘে শুধু বৃষ্টি হয় অঝর ধারায়।সে বৃষ্টির বর্ষা কাটেনা।
চাচীকে দাফন করা হলো।সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে রেখে চলে আসলো একে একে।চাচা কবরের পাশে বসে রইলো একা।পাশে গেলাম,কাঁধে হাত রাখলাম।তাকালো আমার দিকে।নাহ আমি পারছিনা সে চোখে চোখ রাখতে, চাচা জড়িয়ে ধরলো।হুহু করে কেঁদে উঠলো।
সে কান্না থামানোর ভাষা অজানা।এ কান্না থামাতেও নেই।
–
আমি শুভ নামের অশুভ মানুষটাকে খুঁজার জন্য নেটে,ফেসবুকে সার্চ দেই সে নামে।ফেসবুকে সে নামে অনেক আইডি পাই তার মধ্যে সন্দেহজনক কিছু আইডিতে রিকুয়েস্ট দেই।হুমমম একসেপ্ট করে অনেকে।কথা হয় তাদের সবার সাথে।তার মধ্যে একজনের সাথে কথা হয়,যে জাপানের সার্জিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক।কথা হয়,বন্ধুত্ত্ব হয়।অনেক অন্তরঙ্গ বন্ধু।উনার মাসিক বেতন ১৮ লক্ষ টাকা।
একটি মাত্র সন্তান।বউ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার।
কথা বলে জানতে পারি সুখি নন ড.শুভ।
আমি প্রশ্ন করি কেনো সুখি নন?
উত্তরে খুব অবাক হই।তিনি বলেন “মা-বাবা দেশে থাকেন।খোঁজ নেওয়া হয়না।আমার বউ জাপনের নাগরিক।আমার একটা সন্মানের ব্যাপার আছে।আমার বউ আমাকে দেশের কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেয়না।”
–
অবাক না হয়ে পারলামনা।কেমন মানুষরে ভাই সন্মান দেখে!বউয়ের অজুহাত দেয়!অদ্ভুত!সে চাইলেও পারতো বাড়তি টাকা পাঠাতে।আর সন্মান!!সেটা কি তার আছে!!!
বললাম ‘যাই হোক ভাই দেশে আসেন।আপনার বাবা খুব অসুস্থ।’
কিন্তু সময় মতো আসেনি দেশে।চাচাও শীতের বিষন্নতায় শুভ, শুভ, করে পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে।