আমি বসে আছি, পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। নেহা। চুপচাপ বসে নাই, ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাদছে। চোখের পানিতে কাজলগুলো গালে লেপ্টে গেছে। আমি হাতে টিস্যু নিয়ে বসে আছি। টিস্যু টা ওর হাতেও দিচ্ছিনা, ওর গালে লেপ্টে যাওয়া কাজল গুলোও মুছে দিচ্ছিনা।
–
এটা ওর নতুন কান্না নয়। পুরনো কান্না। পরিচিত কান্না। অনেক আগে থেকে এই কান্নাটা দেখে আসছি।
এটা কোন কষ্টের নয়, সুখেরও নয়। ইচ্ছে কান্না। ইচ্ছে হয়েছে কাঁদছে, যখন আবার থামতে ইচ্ছে হবে, তখন থেমে যাবে। আমার কাজ হচ্ছে, বসে বসে ওর কান্না দেখা। কিছু বলতে পারবো না। বললে আরো জোরে কাঁদবে। হাউমাউ করে কাঁদবে। লোক জড়ো হয়ে যাবে।
আমি এগুলো চাইছিনা, তাই চুপ আছি।
–
কান্না থামে। কিছুক্ষন নিরব থেকে, “চল” বলে হাঁটতে শুরু করে। আমি পিছু চলি।
–
ওর চাওয়ায় নড়চড় হওয়ার সুযোগ নেই। নাহলে মূষলধারে কান্না চলবে। আমিও মেনে চলি। সুক্ষ্মভাবে মেনে চলি।
এখনও মেনে চলছি। আমার হাতে থাকা টিস্যুটা নিয়ে চোখ মুছে। আমি দাড়িয়ে থেকে ওর অশ্রুভেজা চোখটা দেখি। চোখ মুছা শেষ হয়। আয়না বের করে। কাজল গুলো ঠিক করতে থাকে।
–
আমি হা করে চেয়ে থাকি নেহার চোখের দিকে। নেহার চোখগুলো ইংরেজ কবি শেলীর চোখ কেও হার মানাবে। শেলীর চোখের চেয়েও সুন্দর, মায়াবী। নেহার চোখের প্রত্যেকেটা পাপড়ি যেনো একেকেটা মায়াজাল। ঐ চোখে তাকালেই মায়াজালে আটকা পড়তে হবে। এ জালের সুতাগুলো বড্ড শক্ত আর মজবুত। চাইলেও বের হওয়া সম্ভব নয়। আমিও আটকা পড়েছি। বের হতে পারছিনা। নেহার দিকে তাকিয়ে আছি, এটা নেহা টের পায়।
–
– কিরে, অমন হা করে তাকিয়ে আছিস কেনো?
– তোর চোখ দেখছি।
-কেনো, আমার চোখের আবার কি হয়েছে?
-তোর চোখগুলো অনেক সুন্দর।
-সুন্দর হলেই কি তাকিয়ে থাকতে হবে?
-হুম, এত সুন্দর কিছুকে না দেখলে অন্যায় হবে।
–
পাগলিটা একটু মুচকি হেঁসে বলে, ঠিক আছে, তাকিয়ে থাক। আমি তাকিয়ে রই।
–
একটু পর নেহাকে বাসায় পৌছে দিয়ে চার মাথার মোড়ে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। কলেজের একটা সুন্দরী মেয়ে । আমার সাথে দেখা করতে চায়। মেয়েটার নাম মিতু। এই মেয়েটাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি। আমাদের ক্লাসেরই। কিন্তু ও আমার সাথে দেখা করবে, এমনটা কখনো ভাবিনি। তাছাড়া ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছাও আমার নাই। তবুও, নিজে থেকে যেহেতু কথা বলতে চায়, তাই এই অপেক্ষা।
–
আমি আর মিতু বসে আছি। কেউ কিছু বলছিনা। একদম চুপচাপ। আমি স্বাভাবিক আছি, তবে মিতু বেশ ইতস্তত বোধ করছে। ওর চোখে মুখে আগের সেই চাঞ্চল্য ভাব টা আছেই। সাথে আগের অনেক কিছুই পরিবর্তনহীন দেখা যাচ্ছে। তবে কিছু একটা দৃষ্টির আড়ালে। আমি খুব গভীর ভাবে ওকে দেখছি। খুজছি ১ বছর আগের মিতু আর এখনকার মিতুর মাঝে পার্থক্য।
–
১ বছর আগে… …
কলেজ লাইফের শুরুর দিকে।
–
মধ্যদুপুর। প্রচন্ড গরম। একটুও বাতাস নেই। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। কলেজ থেকে বেরিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। গরম টা বেশী হওয়াই ঘামে ভিজে গেছি। এই গরমে দু এক গ্লাস পানি খেলে মন্দ হয় না। এই ভেবে রাস্তার পাশে একটা টং দোকানে দাড়ালাম। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছিলো। চা খেলে ক্লান্তি ভাবটা দূর হয়ে যায়। এই ভেবে এক কাপ চা নিয়ে খেতে শুরু করি। অর্ধেক কাপ খাওয়া শেষ, ক্লান্তি দূর হচ্ছে। কিন্তু তৃষ্ণা মিটছে না। মনে পড়ল, পানি খাওয়া হয়নি। ঐ অবস্থাতেই ঢকঢক করে দু গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম।
–
অর্ধেক চা ওয়ালা কাপ টা নিয়ে আবার বসলাম। চায়ে চুমুক দিতে যাবো তখনি একটা হাসি ভেসে আসলো। অপূর্ব মিষ্টি একটা হাসি! আমার মন উতলা হয়ে উঠে হাসি টাকে দেখার জন্য। হয়তবা আমার মনটা এমন কোন হাসির অপেক্ষায় ছিলো এতোদিন। আমার চুমুক দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। বড্ড অদ্ভূত হাসি। অপরুপ হাসি। হাসি টা একদম ঠোঁটের কোনে। মেয়েদের চোখে মায়া থাকে, চুলে মায়া থাকে। কিন্তু ঠোঁটের কোনে মায়া থাকে, এটা হয়ত এই হাসিটা না দেখলে অজানায় থেকে যেতো।
–
মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, চা খেতে খেতে কি কেউ পানি খায়?
–
লজ্জায় মাথা টা নিচু করে ফেললাম। আসলেই তো, এটা কি কোন সিস্টেম? চা খেতে খেতে কি কেউ পানি খায়? তাও আবার একটা সুন্দরী মেয়ের সামনে? নিজেই নিজেকে দু চারটা গালি দিয়ে উঠে চলে এলাম।
–
পরেরদিন, কলেজে যাচ্ছি। হঠাত্ কেউ একজন “আধুনিক চা খোর” বলে ডাক দেয়। পিছনে ফিরে দেখি সেই মেয়েটা। মেয়েটার কাছে যাই। জানতে পারি ও আমাদের ক্লাসেরই। মাত্র কদিন হয়েছে কলেজে পা রেখেছি। সেই হিসাবে কারো সাথে পরিচয়ও হয়নি। মিতুর সাথে গল্প হয়। দিনের পর দিন আমার আর মিতুর সম্পর্কটাও অনেক গভীরে চলে যায়। একে অপরকে ভালোবেসে ফেলি। সবকিছুই ঠিক ছিলো।
–
কিন্তু, একদিন মিতুকে একটা ছেলের সাথে ঘুরতে দেখি। আমার খারাপ লাগে। পরদিন মিতুকে বলি, অন্যে কোন ছেলের সাথে যেনো না ঘুরে।
–
মিতু বলে, ওরা তার ফ্রেন্ড। আমি তবুও নিষেধ করি। কোন প্রকার ছেলে ফ্রেন্ড যেনো না থাকে। কিন্তু মিতু শোনে না। বরং আমি অবহেলিত হতে থাকি। রাত গুলো নির্ঘুম কাটে। মাঝে মাঝে বালিশের কোনাটা ভিজে যায়। পরে আবার ও নিষেধ করি।
–
বলেছিলো, একজন কে সে ভালোবেসে ফেলেছে। আমার সাথে সম্পর্ক রাখাটা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। সেদিন আমি কিছু বলিনি, চুপচাপ চলে আসি ওর সামনে থেকে।
–
সেদিনই নেহার সাথে দেখা হয়। পার্কে মন খারাপ করে বসে ছিলাম। হঠাত্ কারো কান্না শুনতে পাই। পার্কের মধ্যে এভাবে কখনও কাউকে কাঁদতে দেখিনি। আমি ওর পাশে গিয়ে বসি। জানতে চাই কাঁদছে কেনো?
নেহা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, ওটা নাকি ইচ্ছেকান্না। ইচ্ছে হয়েছে তাই কাঁদছে।
–
ওর কান্নায় যদি আমার কোন সমস্যা হয়, তাহলে আমিও যেনো কান্না করি। মনের অজান্তেই সেদিন ফিক করে হেসে উঠেছিলাম। শত মন খারাপ ওর একটা কথাতেই ভালো হয়ে যায়। তখন থেকে নেহার সাথে বন্ধুত্ব হয়, আর মিতুর চ্যাপ্টার ক্লোজ।
–
কিন্তু একবছর পর কালকে হঠাত্ ফোন দিয়ে বলে, আমার সাথে দেখা করবে। আমিও দেখা করতে রাজি হই।
কিন্তু ও যেমন ইতস্তত বোধ করছে, তাতে বুঝা যাচ্ছে আজকে ও কিছু বলতে পারবে না।
–
নিজে থেকেই কথা শুরু করি। অনেক গল্প হয়। মিতু আগের সবকিছুর জন্য সরি বলে। এবং সে আর এমন কোন রিলেশনে জড়াবে না, ছেলেদের সাথে মিশবে না ইত্যাদি। সবকিছু ভূলে ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে চায়। আমি হ্যাঁ বাচক মাথা নেড়ে উঠে আসি।
–
পরের দিন ক্লাসে…
মিতু আমার পাশে বসে। যেখানে নেহা বসত। কিছু বলতেও পারিনি। কিভাবে উঠে যেতে বলব, সিট তো কারো রেজিস্ট্রী করা নয়। একটু পর নেহা আসে। দেখে আমার পাশে মিতু বসা। চুপচাপ দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বলি, আজকের দিন টা পিছনে বসতে। নেহা অন্য সিটে বসে। ক্লাস শেষ হয়, মিতু আমাকে নিয়ে কলেজের পেছনে একটা গাছতলায় নিয়ে যায়। অনেকক্ষন গল্প হয়। এর ফাঁকে নেহা বাসায় চলে যায়।
–
রাতে মিতু ফোন দেয়, শুরু হয় গল্প। তবে অধিকাংশ গল্পই হয় পড়াশোনা নিয়ে। অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে কথা হয়। কথা শেষ করে দেখি মিসডকল। নেহা ফোন দিয়েছিলো। ততক্ষনে রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। এত রাতে নেহা জেগে থাকবে না। তাই কল ব্যাক করিনি। পরদিন ক্লাস রুমে ঢুকতে যাবো, এমন সময় নেহাও ঢুকছে। দেখলাম চোখ গুলো ফুলে আছে। আমি কিছু না বলে ক্লাসে ঢুকি। হঠাত কেউ আমাকে টেনে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখি মিতু।
ওদিকে নেহা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে পিছনে চলে গেলো।
–
বুঝতেই পারলাম, নেহা একটু রাগ করেছে।
–
সকাল সন্ধা সবসময় মিতু আমার পিছনে পড়ে আছে। কলেছে থাকলে সবসময় পাশে বসে থাকে। নাহলে টেনে নিয়ে কোথাও ঘুরতে চলে যায় নাহলে ফোন তো আছেই।
–
নেহার খোজ নেয়ার সময়ই হয়না। এভাবে প্রায় চার পাঁচদিন কেটে যায়। সকালে নেহাকে ফোন দিই, ফোনটা রিসিভ হয় না। নেহার কেউ নেই। নানার বাসায় থাকে। আমিই একমাত্র সঙ্গী। ওর ভালোমন্দ সবকিছূতেই আমি। কদিন থেকে পাগলিটাকে সময় দেওয়া হয়নি, সে রাগেই হয়ত ফোন ধরছে না।
–
কলেজের গেটে এসে দাঁড়িয়ে আছি। নেহার সাথে দেখা করতেই হবে। একটা মেয়ে এসে আমাকে বলে, ভাইয়া একটা কথা বলার ছিলো।
–
জানতে চাইলাম, কি কথা?
মেয়েটা বলল, মিতু আপনার সাথে কেনো ঘুরছে জানেন?
-আমরা ফ্রেন্ড, তাই…
-জ্বি না। সামনে এক্সাম। আর মিতুর যেসব ছেলে ফ্রেন্ড আছে, তারা সবাই গোবর মার্কা। আপনি একটু ভালো স্টুডেন্ট, আপনার থেকে হেল্প পাবে তাই আপনার সাথে ঘুরছে।
–
মেয়েটার কথা শুনে আমি একটু অবাক হই। বিশ্বাস ও করি। কারন মিতু সবসময় পড়া নিয়েই গল্প করে। আবার অন্য ছেলেদের সাথেও ঘুরতে দেখছি। অনেকক্ষন দাড়িয়ে থাকি। মাথাটা ঠান্ডা করি।
–
একটু পর নেহার ফোন আসে, রিসিভ করেই বলি কোথায় আছিস?
-প্রতিদিন যেখানে থাকি।
–
আমি তাড়াহুড়া করে আসি আমাদের প্রিয় জায়গা পদ্মপুকুরের পাড়ে। দেখি ও বসে আছে। সাদা সবুঝ মিশ্রিত একটা পোশাক গায়ে। পাশে গিয়ে বসি। এটা ওটা জিজ্ঞাসা করি, কোন উত্তর নেই। বুঝায় যাচ্ছে ও এখন কান্না করবে। কয়েকদিন থেকে ওর কান্না শোনা হয়নি।
–
যেমন ভাবা তেমন কাজ। কান্না শুরু। আমি পকেট থেকে টিস্যু বের করে হাতে নিই।
অপেক্ষা করি কখন কান্না থামবে। কিন্তু কান্না থামছে না। বরং কান্নার গভীরতা বাড়ছে। অশ্রুফোটা গুলো একটা একটা করে পড়তেই আছে । গভীর দৃষ্টিতে ওকে দেখলাম, আজকে চোখে কাজল দেয় নি। তবুও চোখের নিচে কালো হয়ে আছে।
–
আমার বুকের বাম পাশটা মোচড় দিয়ে ওঠে। নেহার কান্নায় কষ্ট ভেসে আসছে। এই কান্না আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এটা আমার খুব পরিচিত। যখন মিতু আমাকে ছেড়ে অন্য ছেলেদের সাথে ঘুরতো, তখন আমি কাঁদতাম। এভাবেই কাঁদতাম। এই কান্না প্রচন্ড কষ্টের। একটুও তফাত নেই।
–
আমার বুঝতে দেরি হয়নি। আমি মিতুর সাথে ঘুরার কারনে ও কষ্ট পেয়েছে। আমার ভাবনার ঘোর না কাটতেই দেখি ও কান্না থামিয়ে দিয়েছে। একটা ডায়েরি আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘চিনতে পারছিস? তোর দেওয়া ডায়েরিটা। বলেছিলি, কেয়ামত হয়ে গেলেও লিখে শেষ করতে পারব না। দেখ, মাত্র চার পাঁচদিনেই শেষ করে ফেলেছি রে।’
আমি যেন বাকপ্রতিবন্ধি হয়ে গেছি। কি বলব? কিছুই বুঝে আসছে না। নেহা ডায়েরিটা আমার হাতে দিয়ে চলে যায়।
–
পৃষ্টা উল্টাচ্ছি। প্রতিটা লাইনে কষ্টের ছোয়া। প্রতিটা লাইন তীব্র যন্ত্রনায় ভরা। ডায়েরির শেষ লাইনটা ছিলো, “তোর অবহেলা গুলো আর সহ্য করতে পারছিনা রে” ।
–
আমার চোখ দিয়ে কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আমি দৌড় দিলাম। নেহাকে খুঁজতে। কোথাও না পেয়ে ওর বাড়ি গেলাম। বাড়ির দরজায় পা দেয়ার আগেই কিছু শব্দ আমার কানে আসছে।
–
কান্নার আওয়াজ। অনেক মানুষ একসাথে কাঁদছে। চিত্কার করে কাঁদছে। ডুকরে ডুকরে হাউমাউ করে কাঁদছে। এ কান্না আমার পরিচিত নয়। এটা অপরিচিত কান্না। এ কান্না টা শুনে আমার অনেক ভয় করছে। এত মানুষ একসাথে কেনো কাঁদছে? আমার জানা দরকার। দরজা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখি সাদা সবুজ মিশ্রিত পোশাকে কেউ একজন মাটিতে পড়ে আছে।