প্রত্যাশা

প্রত্যাশা

শুনছো আজ তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হবে না।প্লিজ মন খারাপ করো না।

তোমাকে কি বলেছি আমি মন খারাপ করছি?

না, তা অবশ্য বলো নাই, তবে আমারও খারাপ লাগছে বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া হয়নি। নিশ্চুপ হয়ে রইলো সায়ন্তি,মাথা নিচু করে বললো, মন যেদিন চায় সেদিন নিয়ে যেও।

বোঝার বাকি রইলো না মেয়েটার মনটা খারাপ করে দিয়েছি কথাটা বলে। আমিও না…

ধ্যাত সায়ন্তির মন খারাপ হলে আমারও ভালো লাগে না, সারাটি দিন বাজে ভাবে কাটে।কিন্তু কখনোই তা প্রকাশ করিনি তার কাছে।প্রকাশ করলে হয় তো বোঝতো আমিও কতটা চাই সায়ন্তিকে।

শুনছো! গেলাম কিন্তু।তুমি খেয়ে নিও, আজ একটু তাড়া আছে।হয় তো ফিরতেও দেরি হবে।নিজের খেয়াল রেখো বুঝেছো?

কথাগুলো বলে প্রায় বাসা থেকে বেরুলাম, পিছন হতে দৌঁড়ে এসে সায়ন্তি বললো।

তুমিও নিজের খেয়াল রেখো। আর হ্যাঁ সময় মতো লাঞ্চ করে নিও।তোমার প্রিয় খাবার পুঁটিমাছ রান্না করেছি আজ।

ওহ্ তাই নাকি! খুব ভালো। আচ্ছা দেরি হয়ে গেলো বলে, আমি যাই। বলেই ঘর থেকে সোজা হাঁটা ধরলাম। ওদিকে সায়ন্তি পিছন হতে অপলকে চেয়ে আছে।

ইদানীং সালমান খুব ব্যস্ত, তবে আগে এই ব্যস্ততার মাঝেও কতো ভালোবাসতো সায়ন্তিকে।শত কাজের ফাঁকেও টুক করে ফোন করে খোঁজখবর রাখতো সায়ন্তির।সেইদিনগুলোর কথা আজও মনে পড়ে, আর মনে পড়লেই চোখ ঝরে পানির ফোঁটাগুলো টপটপ করে নাক বেয়ে কাপড়ের সাথে মিশে যায়।

যখন সালমানের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো! গ্রামে থাকতো ও, আমিও গ্রামেই থাকতাম অবশ্য।মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখা হয় সালমানের সাথে।মামাতো ভাই এর ফ্রেন্ড, সেও সেদিন বেড়াতে এসেছিলো মামাতো ভাই রাব্বির খাতিরে। আমিও গিয়েছিলাম অনেকদিন পর। সেদিন বিকালে রাব্বি আমি আর ছোট মামার ছেলে রনি সালমান সবাই মিলে মামার বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট খালের পাড়ে ঘুরাঘুরি করতে গিয়েছি। হঠাৎ রাব্বি সালমানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো।

-একটা গান গাও তো।
-তুই কি পাগল দোস্ত?
-আরে গা তো এতো তর্ক ভালো লাগে না -তুই না একটা পাগল।দেখছিস এখানে অচেনা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আর তুই আমাকে এদের সামনে লজ্জায় ফেলতে চাইছিস তাই না?
-আরে ন্যাকামো করো না। কলেজে যখন মেয়েদের সামনে গলা ছেড়ে গাও তখন বুঝি লজ্জা করে না?
-ধুর! তুই না, ধ্যাত আরে ওরা তো একই কলেজের বন্ধু তাই লজ্জা করে না।কিন্তু। আমি ওদের দুজনের কথা মন দিয়ে শুনছি, তবে এমন ভাব ছিলো যেনো কিছুই জানি না।
সায়ন্তি :গেয়ে ফেলুন। লজ্জার কিছুই না, আমরা আমরাই তো।
রাব্বি :হ দোস্ত গা, চারপাশের পরিবেশটা দেখ! কতো সুন্দর মনে হয় তোর গান শুনার জন্য এমন পরিবেশ প্রকৃতি নিজেই তৈরি করে রেখেছে এখন।
সালমান :পাম দেওয়া হচ্ছে বুঝি?
সায়ন্তি :আচ্ছা গেয়ে ফেলুন না। লজ্জা কিসের? সালমান তখন গান গেয়ে শুনালো। সেদিন বিকেলটাও ছিলো বেশ চোখে পড়ার মতোই।গোধূলির সব রং আমাদের মাথার উপরে ছেয়ে গেছে। আর সালমানের মন কাড়া সুর সত্যিই মুগ্ধ করেছে আমাকে।

গানটা শেষ করেই সালমান চলে এলো বাড়িতে। এর আগে কখনোই সালমানকে দেখনি “কথা হয়নি তবে একদিনের এই গান শুনে মনে হচ্ছিলো গানের বাক্য দ্বারা আমাকে কিছু একটা বোঝানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে যা হয় তো আমার বোঝার ক্ষমতার বাহিরে।

এর পরে মামার বাড়ি থেকে চলে আসি পরেেদিন সকালে।সালমান যদিও বিকেলেই চলে গিয়েছিলো।

একদিন রাতে বারান্দায় পড়তেছি। হঠাৎ অচেনা নাম্বারে ক্রিং ক্রিং শব্দে আমার পড়ার ঘোর ভেঙে গেলো। কলটা রিসিভ করতে মন চাইছিলো না, একে তো অচেনা নাম্বার তার উপর এতো রাতে যদি ফোন রিসিভ করি কথা বলার শব্দ যদি আব্বার কানে যায়! তাহলে সব শেষ আমার।সোজা বিয়ে দিয়ে দিবে। তার পরেও অজানা কোনো আকর্ষণ আমাকে ফোনটার স্কিন থেকে চোখ সরাতে দিচ্ছে না। বলছে ফোনটা ধর তুই। তিনবার ফোন আপনা আপনিই কেটে গেলো চারবারের সময় রিসিভ করে জানতে চাইলাম কে? ওপাশ থেকে সালাম দিলো। জবাব দিয়ে বললাম আপনি কে?

-পরিচয় দিলে হয় তো চিনবেন তবে এতো রাত্রে বিরক্ত করার জন্য আন্তরিক দুঃখিত।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি কে কার কাছে ফোন করেছেন তা তো বলুন।
-আমি ফোনটা আপনার কাছেই করেছি।
-ওহ্ তাই নাকি? তো কেন করছেন?

এমন সময় আব্বার ডাক। সায়নি মা, ফিসফিস করে কার সাথে কথা বলছো?

-আব্বা কই? কারো সাথেই না।বই পড়ছি। ওহ্ আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে মা, মন দিয়ে পড়ো। এবার যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তো বিয়ের পিরিতে বসতে হবে। আ

ব্বা পাশের রুম থেকে বলছিলেন কথাগুলো সব সময় আমার উপর কড়া নজর তার।শাসন ভালোবাসা সব দিয়ে ভরপুর করে রেখেছেন আমাকে।

আব্বার কথা শুনার পরেই ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম। পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছি। কিন্তু মনটা বার বার ফোনে কথা বলা শেষ করতো না পারার দোষারূপ করছে আমাকে।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোচিং যাবো।ফোন হাতে নিয়ে দেখি ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। বাংলায় লেখা।

সুপ্রভাত কোনোদিন কেউ আমাকে এমন কথা আগে বলেনি।আজ এই প্রথম কথাটা পড়েছি।মনে মনে বেশ খুশি হলেও প্রকাশ করছি না।চেক করে দেখলাম নাম্বারটা ঠিক গতরাতে ফোন করা নাম্বারটা।

এর পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথাবার্তা হতো নাম্বার পিছনে থাকা অজানা ছেলেটির সাথে। বন্ধুত্ব অবশ্য হয়নি তবে বেশ খেয়ারিং সোয়ারিং হতো দুজনের মধ্যে। অজানা টানেই হয় তো আমিও কয়েকবার ফোন করতাম। আস্তে আস্তে ছেলেটিকে ভালো লাগতে লাগলো আমার।একদিন সে তার পরিচয় দেয়। পরিচয় জানার পর আরও খুশি আমি। এটা সেই ছেলে যার গান শুনে আমি মুগ্ধপাগল প্রায়।

একদিন হঠাৎ সালমান আমাকে প্রোপোঝ করে। আমি থমকে গেলাম মুহুর্তে কারণ এটা আমার জায়গা থেকে অসম্ভব ছিলো। আমার পরিবার কখনোই রাজি হবে না। ওদিকে সালমানেরও বিয়ের কথাবার্তা চলছে।তাই সে একদিন আমাকে বললো সে নাকি প্রেম করবে বিয়ের পর। প্রোপোঝ গ্রহণ না করার কারণ জানতে চেয়েছিলো আমার কাছে। আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম আমার পরিবার কখনোই এসব মানবে না। যদি বিয়ে করতে চায় তো আমার বাবার সাথে কথা বলতে পারে।আমি অবশ্য রাজী ছিলাম সালমানকে বিয়ে করতে।

এর একমাস পর সালমান একদিন তার বাবাকে নিয়ে আসেন আমাদের বাড়ি।অবাক হয়ে গিয়েছি আমার আর সালমানের বাবার খাতির দারি দেখে।তারা নাকি বন্ধু ছিলেন এক সময়। যদিও সময়ের কারণে তাদের দেখা হয় না তেমন।ওদিকে তাদের কথাবার্তা ফাইনাল।আমাদের বিয়ে পাক্কা সেদিন রাতে সালমানের সাথে অনেক কথা হয়। উপর ওয়ালার কি রহমত। এতো সহজেই আমাদের বিয়েটা হচ্ছে।যদিও পরিবারের কেউই জানতো না আমার ফোনের আলাপনের কথা।বিয়ে পাক্কা হওয়ার পর অবশ্য সালমানের সাথে কথা বলতে বাঁধা আসেনি। দিন তারিখ ঠিক করে গিয়ে ছিলো সালমানের বাবা সে মোতাবেক আমাদের বিয়েও হলো।

বিয়ের মাসতিনেক পর সালমান আমাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে। এখানে সে একটা বেসরকারি কম্পানিতে চাকরি করে। প্রায় দুবছর হলো আমাদের সংসার জীবণ, সুখ দুঃখ সব মিলিয়ে খুব ভালো সময় কাটছে আমাদের। কিন্তু ইদানীংকালে সালমানের আচরণ পাল্টে গেছে। আগে অফিসে যাওয়ার সময় কতো রকম বাহানা ধরতো।বলতো একটু আদর করে দাও।তোমার আদর ছাড়া অফিসে মন বসে না। আরো কতো কী।

কিন্তু এখন আর এমন বলে না।বায়নাও ধরে না।নিজে নিজে চলে যায় আমার একটুও খেয়ার করে না আগের মতো।

প্রতিশুক্রবার আমাদের শহরটা ঘুরা ফেরার কথা তো সে প্রায় ভুলেই গেলো। অনেকদিন হলো সে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুই না। বিয়ের পর থেকে নাকি আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুই না, ওর মনে হয় মাথাটাও গেছে।কতো ঘুরেছি। এসব ভাবলে চোখের কোণে পানি চলে আসে।

অপলকে চেয়েছিলো সালমানের দিকে, তার যাওয়া দেখছিলো যদি একবার পিছন ফিরে দেখে সে অপেক্ষা। কিন্তু নাহ্! ফিরে দেখেনি। তবে কি সে আগের মতো ভালোবাসে না আমাকে? সায়ন্তির মনে হাজারো প্রশ্ন জাগছে। হয় তো বাসে না। ঘরে অনেক কাজ বাকি যাই করতে হবে। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল একটা ফোনও করলো না সালমান। খেয়েছি না কি করছি একটা ফোন করে অন্ততপক্ষে জানতে পারতো।

আচ্ছা আমিই করে দেখি একটা ফোন। সালমানের নাম্বারে ফোন করলো সায়ন্তি। রিং পড়ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। বেশ কবার ফোন করার পরেও সে ফোন রিসিভ করছে না। খারাপ লাগছে বেশ।সারাটা দিন ওর জন্য চিন্তা করি অথচো সে একটুও সময় পাই না কি আমার ফোনটা ধরতে? ফোনটা রেখে দিয়ে সায়ন্তি বিছানাতে শুয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে।হঠাৎ টুক করে ফোনে শব্দ মেসেজ এসেছে।

সালমানের মেসেজ। লেখা আছে। বিরক্ত করো না তো।কাজে আছি। আর কিছুই লিখে নাই।আমি কি বিরক্ত করেছি? মনে মনে ভাবছিলো সায়ন্তি। আবারও কাঁন্না। এতো ব্যস্ত ক্যান তুমি? একটুও কি সময় হয় না তোমার এই পাগলীটার জন্য।যাকে তুমি এতো ভালোবাসতে। তাকে কেন এখন এতো অবহেলা করছো? মনে মনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে সায়ন্তি সালমানের কাছে।

রাত প্রায় বারোটা এখনো ফিরেনি সালমান, তার জন্য বসে আছে সায়ন্তি।সালমান এলে দুজন এক সাথে খাবে বলে। টক টক শব্দে বাহির থেকে কে যেন ডাকছে। তাড়াহুড়া করে দরজা খুলে দিলো সায়ন্তি। সালমান এসেছে। ব্যাগটা সায়ন্তি তার হাতে নিয়ে সালমানকে জিজ্ঞাস করলো কিছু লাগবে কি না। সালমান চুপ,কোনো কথা বলছে না। হয় তো ক্লান্ত তাই।

সায়ন্তি :আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি খাবার দিচ্ছি।

তার পরেও নিশ্চুপ সালমান। হয় তো অবহেলা করছে সায়ন্তিকে। সালমান ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেয়ে শুয়ার রুমে চলে গেলো। কিন্তু একবারও জানতে চাইলো না সায়ন্তি খেয়েছে কি না। যে মেয়েটা না খেয়ে এতোরাত পর্যন্ত তার জন্য বসে আছে এক সাথে খাবে বলে! তাকে কি বলা উচিত ছিলো না? জানার উচিত ছিলো না খেয়েছে কি না? আগে তো এমন ছিলো না! যতো রাতেই ফিরতো না কেন, আমাকে সাথে নিয়েই খেতো।তাহলে এমন কেন? এখন কি দিনে দিনে আমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সালমান? আগে দরজাটা খুলে দিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরতো, আরো কতো কথাই বলতো সারাদিন অফিসে কি করেছে না করেছে, লাঞ্চ কখন করেছে, কেন দেরি করে লাঞ্চ করেছিলো। কিন্তু এখন তো এসব বলে না। তার জড়িয়ে ধরাও মিস করছি আমি।

সেদিন আর খেলো না সায়ন্তি। গিয়ে শুয়ে পড়লো সালমানের পাশে। হয় তো অফিসে ভীষণ চাপ ছিলো।কাজ করেছে ভীষণ।তাই। সালমানের রাতের আবদারও কমে যাচ্ছে এখন।আগে রাত হলেই আমাকে সাজতে বলতো। বলতো চলো আজ আবার নতুন করে বাসর রাত করব।পাগল বলতাম তখন সালমানকে, পাগল বললে সেও আমাকে পাগলী বলে হাত ধরে সোজা নিয়ে যেতো ছাদে।জোসনা দেখবে বলে। শহরের ছাদে উঠে পুরো শহরটাকে দেখতাম দুজন।আর এখন? সে আমাকে একটু মন থেকে স্পর্শও করে না। অনেকদিন হলো সালমানের স্পর্শ পাই না। তবে কি বয়সের সাথে সাথে মানুষের চাহিদাও পাল্টে যায়? তবে কি যৌবণটাই সব কিছু?

মাত্রই তো দুবছর হলো।এক্ষুনি সে এতো অবহেলা করছে বাকি জীবণটা কিভাবে কাটাবো ওর সাথে? আমি কি সালমানকে ছেড়ে চলে যাবো? জানি না কি করব।তবে অনেক ভালোবাসি, অনেক, হয় তো ছেড়ে যাবো না।ওর সাথে এভাবেই কাটাবো বাকি জীবণ। সেও হয় তো তার অবহেলার ঘোর কাটিয়ে উঠবে একদিন।

আমিও সেদিনের অপেক্ষা করব। মনে মনে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সায়ন্তি। হয় তো একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব। সেদিনের প্রতিক্ষায়। নাকি রয়ে গেলো অপ্রকাশিত ভালোবাসা! কারণ সালমান তো আগে এমন ছিলো না। জানি না কি।তবে প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত দুটোই কষ্ট দিচ্ছে সায়ন্তিকে।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত