গল্প: তাকে পাওয়ার গল্প
লেখা: তানজিনা তানিয়া
তূর্য হচ্ছে এমন একজন মানুষ যে টিনএজ বয়সেই আমার মনের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। ফেলেছিল বললে বোধহয় একটু ভুলই হবে। এখনও ফেলে আছে। ওর প্রতি এডিক্টেড হয়েছিলাম ওর খেলা দেখে। যদিও ওকে প্রথম দেখেছিলাম অানন্দ মোহনের মাঠে। আমাদের বাসার সামনের মাঠটাতে ক্রিকেট খেলত তূর্য। রোজ বিকেলেই মাঠে ক্রিকেট খেলা হত। ক্রিকেট আমার পছন্দের খেলা বলে বেলকনিতে বসে রোজ খেলা দেখতাম। তূর্য ভাইয়া ছিল অলরাউন্ডার। পুরো টিমের সেরা খেলোয়াড়। ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা ছিল আমার প্রিয় ক্রিকেটার। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন মাশরাফির প্রতি এত এডিক্টেড ছিলাম যে সবাইকে বলে বেড়াতাম আমি বড় হয়ে মাশরাফিকে বিয়ে করব। সবাই আমার কথা শুনে হাসত।কেউ কিছু বলত না।কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম যে ম্যাশ বিবাহিত সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। এরপর ভাল লাগত সাকিব আল হাসানের খেলা।তখন আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি যে, সাকিবের সাথে আমি সাকিব ডায়িং এ ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করব। কিন্তু বিয়ের পর তো এই ছেলেটা শিশির শিশির করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলল । যেন শিশির ছাড়া পৃথিবীর আর কোন মেয়ে মেয়েই না। হুহ! এরপর থেকে শপথ করেছি যে, আর কারো সাথে জীবনেও কোনদিন ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করব না।
এরপর পিচ্চি হিটার মুশির এত ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, সারা
রুমে মুশফিকের ছবি টাঙিয়ে রেখেছিলাম।
.
কিন্তু সেও বিয়ে করার পর মন ভেঙে গিয়েছিল।
পরবর্তী এট্রাকশান ছিল নীল চোখের সাব্বির। কি ব্যাটসম্যান মাইরি!
কিন্তু বাংলাদেশ টিমে মোস্তাফিজের আগমনের সাথে সাথেই সাব্বিরের প্রতি আমার আগ্রহ কমতে থাকে।যখন যার প্রতি ফিদা হয়ে যেতাম তখন শুধু সারাক্ষণ তার কথাই ভাবতাম। আমার এসব পাগলামো নিয়ে সবাই হাসাহাসি করত ।
.
এতকিছুর পর হঠাৎ আমি চেঞ্জ হয়েছিলাম তূর্যের প্রেমে পড়ে। যখন তূর্য আমার চোখে পড়লো, আমি নিয়মিত প্রতি বিকেলে ওকে আর ওর খেলা দেখতে শুরু করলাম। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে এতদিন টিভির পর্দায় দেখা ক্রিকেট খেলোয়াড়দের প্রতি আমার যে আকর্ষণ ছিল সেটা নিছকই একজন ক্রিকেট প্রেমীর তার প্রিয় খেলোয়াড়ের প্রতি যে আকর্ষণ থাকে সেটা। ওগুলো শুধুই ভালোলাগা। যদিও অস্বীকার করছিনা যে, আমি ওদের ডাই হার্ড ফ্যান ছিলাম বলেই ওদের নিয়ে নানা কিছু কল্পনা করতাম।
কিন্তু বিশ্বাস করুন পাঠক,তূর্যকে দেখার পর থেকে আমার আর কাউকে ভাল লাগত না।এমনকি বাংলাদেশ টিমের খেলা পর্যন্ত দেখা ছেড়ে দিয়েছি আমি গত এক বছর ধরে।
.
এইতো কয়েক মাস আগে আমার চাচাতো বোন খুব কাছের বন্ধু মীম এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলল
-তানিয়া তুই আজকে বাংলাদেশের খেলাটা
দেখ।আমি নিশ্চিত তুই মিরাজের উপর ক্রাশ না খেয়ে থাকতে পারবি না।ওর কথা শুনে ওকে এতো বকেছিলাম যে, ও রাগে আমার সাথে এক সপ্তাহ কথাই বলে নি।তূর্য আমার মনের ভেতর লতার মত জড়িয়ে গেছে। ওর পাশে আমি কাউকে কল্পনাই করতে পারি না। আর কল্পনা করতে চাইও না।আমি ওকে ততটাই ভালবাসি; চাতক যতটা বৃষ্টিকে, ঝর্না যতটা নদীকে আর ভ্রমর যতটা মধুকে ভালবাসে। আমি চাই তূর্য আমার ভ্রমর হোক। না না ঠিক ভ্রমর না, আমি ওকে এত ছোট একটা প্রাণী বানিয়ে রাখতে চাইনা। আমি চাই ও আমার আকাশ হোক আর আমি পাখি হয়ে ওর বিশাল বুক জুরে উড়ে বেড়াবো । ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। তার মধ্যে একটা স্বপ্ন হচ্ছে যে ওকে আমি প্রতিদিনই অপরিচিত সব নাম্বার থেকে ফোন দিবো যেন ও ফোনটা ধরেই জিজ্ঞাসা করে বলে যে
-কে বলছেন?
তখন যেন আমি মিষ্টি করে হেসে বলতে পারি যে
-আমি তোমার বাবুই পাখি। আমি তোমার বাবুই পাখি বলছি তূর্য।
বাবুই পাখি আমার খুব প্রিয় পাখি।তাই আমি তূর্যর আকাশে চিরকাল বাবুই পাখি হয়ে থাকতে চাই
.
যা হোক তূর্যর সাথে প্রথম দেখা থেকে শুরু করে আজকে পর্যন্তর গল্পটা বলি।
ওকে প্রথম দেখেছিলাম আনন্দমোহন কলেজের মাঠে। আন্টির সাথে আমি আর মীম রোজ বিকেলে ঝালমুড়ি খেতে খেতে আড্ডা দিতাম ওখানে। হঠাৎ একদিন তূর্য ওর
কয়েকটা বন্ধু নিয়ে আমাদের থেকে একটু দূরে বসলো। ওর হাতে একটা গীটার। ওরা বসে কিছুক্ষণণ হাসাহাসি আর দুষ্টুমি করল।তারপর তূর্য গীটার বাজাতে বাজাতে “ওরে নীল দরিয়া” গানটা গাইল । ওর গানের গলার কোন জুড়ি নেই। অসম্ভব সুন্দর গায় ছেলেটা।
.
তারপর একদিন আবিষ্কার করলাম যে,আমাদের বাসার সামনে রোজ বিকেলে যে টিমটা ক্রিকেট খেলে। তূর্যও ঐ টিমে আছে। খুব ভাল খেলে ও। ব্যাট ও বল হাতেও একজন অলরাউন্ডার।
.
আস্তে আস্তে রোজ তূর্যকে দেখতে দেখতে ওর প্রেমে পড়ে গেলাম। একদিন বিকেলে প্রতিদিনের মত বসে খেলা দেখছিলাম।তূর্য ব্যাট করছিল। হঠাৎ একটা বল এসে তূর্যর কপালে লাগলো । আমি কোন কিছু না ভেবেই দৌড়ে ফ্রিজ থেকে আইসবক্স , একটা পানির বোতল আর একটা নাপা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে গিয়ে হাজির হলাম তূর্যর কাছে। ওকে ঘিরে রাখা সবার ভিড় ঠেলে গিয়ে তূর্যর কপালে বরফ লাগিয়ে দিলাম আর ওকে নিজ হাতে ট্যাবলেট খাইয়ে দিলাম। সবাই হয়ত আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।কিন্তু আমার একবারও মনে হচ্ছিল না যে আমি নির্লজ্জের মত কিছু করছি।
.
ব্যাপারটা হয়ত ওখানেই শেষ হয়ে যেত যদি না আমি পরদিন স্কুলে গিয়ে আমার ক্লাসমেট তুষারকে স্কেল দিয়ে আঘাত করে ওর হাত কেটে না ফেলতাম।তুষারের করা বলেই তূর্য
ব্যব্যথা পেয়েছিল। আমার কেবল মনে হচ্ছিল তুষার অসতর্কতাবশত বল করেছিল বলেই তূর্য ব্যথা পেয়েছে।তাই ওকে সামনে পেয়ে, “তূর্য ভাইয়াকে ব্যথা দিয়েছিস কেন?” বলেই স্কেল দিয়ে দু-ঘা বসিয়ে দিলাম। একবারও মনে হয়নি যে ওটা অনিচ্ছাকৃত একটা দুর্ঘটনা ছিল মাত্র।
অতঃপর ও আমার বাবা মায়ের কাছে বিচার নিয়ে গিয়েছিল। আর আমি যে তূর্যকে বরফ লাগিয়ে দিয়েছিলাম সেটাও বলে দিয়েছে। মা আমাকে আচ্ছামত বকেছে। বাবাতো থাপ্পর দিতে চেয়েছিলেন। কি মনে করে যেন পরে আর দেন নি। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে থাপ্পর দিলে আমি কেঁদে কেঁদে সর্দি জ্বর বানিয়ে ফেলব। তাছাড়া বাবা একটু বেশিই আদর করেন তো তাই মায়ের চেয়ে বাবার শাসনে বেশি কাঁদি।
.
একদিন রিকসা করে স্কুলে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ দেখি তূর্য সাইকেলে করে আসছে।ওকে দেখেই মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চেপে গেল।রিকসাওয়ালাকে দ্রুত ভাড়া দিয়ে বিদায় করে দিয়ে তূর্যর রাস্তা আটকে দাঁড়ালাম।অার বললাম রিকসাওয়ালার নাকি কি তাড়া আছে তাই আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমাকে যেন একটু স্কুলে পৌঁছে দেয়। প্রথমে একটু আমতা আমতা করলেও পরে রাজি হল। আমি তো আনন্দে নাচতে নাচতে সাইকেলের সামনে বসলাম। ও আমাকে নিয়ে সাইকেলে করে যাচ্ছিল আর আমি ওর পারফিউমের গন্ধ নিচ্ছিলাম প্রাণ ভরে।
.
পুরো রাস্তা আমি অনেক বকবক করলাম।কিন্তু তূর্য কোন কথা বলল না। স্কুলে এসে নামলাম। রাস্তা যে এত দ্রুত কিভাবে শেষ হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। ইচ্ছে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ ওকে নিজের কাছে ধরে রাখি। তাই ছল করে বললাম আইসক্রিম খাব কিন্তু টাকা নেই। তূর্য কোন কথা না বলে কেবল একটা আইসক্রিম কিনে এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে লাগলো।
আমি বাহানা করে বললাম
-একা দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে আন ইজি ফিল হচ্ছে। আপনি একটু দাঁড়ান না। ও এবারও কিছু না বলে কেবল প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্যদিক চোখ ঘুড়িয়ে দাঁড়ালো। ও কিছু না বললেও আমি বুঝলাম যে ও দাঁড়াবে।
.
আমি আইসক্রিম খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম।
জিৎ’র মত খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে।অনেকটা ফর্সা। চেহারাটা অনেক কিউট।
আইসক্রিম খাওয়া শেষে ও সেদিন চলে গেলো।
আমি শুধু ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলাম।কারণ ও যখন আইসক্রিম কিনছিল তখন আমি ওর সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে ওর তিনটা বই থেকে একটা বই চুরি করে রেখে দিয়েছি।যাতে ওর সাথে অতি দ্রুত আবার দেখা হয়।
.
প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল কিন্তু বইয়ের খোঁজে একবারও তূর্য আমার কাছে এলো না। আর আসবেই বা কেন? ও কি আর জানে যে বইটা আমার কাছে?
.
স্কুলে যাচ্ছিলাম।ওমনি দেখি তূর্য ওর কয়টা বন্ধুর সাথে বসে গলির মুখে আড্ডা দিচ্ছে। আমি গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম।ওর সব কয়টা বন্ধু আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ও মনে হয় কিছুটা লজ্জা পাচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম
-তূর্য ভাইয়া আপনার একটা বই ঐদিন যাবার সময় ফেলে গিয়েছিলেন। বইটা আমার কাছে আছে। আপনি বিকেলে গিয়ে একবার নিয়ে আইসেন। তূর্য কিছু না বলে কেবল মাথা ঝাঁকালো।
.
বিকেল বেলা বই হাতে নিয়ে বেলকনিতে অপেক্ষা করছি। অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পরও তূর্য এলো না। মেজাজটা পুরোটা খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছে হাত পা ছুঁড়ে ছোট বাচ্চাদের মত কান্না করি।
.
প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল তূর্যকে স্কুলে যাওয়ার পথেও দেখিনা। আর বইতো নিতে আসলই না। খোঁজ নিয়ে জানলাম তূর্যদের বাসা আমাদের বাসা থেকে দুইটা বাসা পরেই।
তূর্যকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আর ওর বইটাও ফেরৎ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। তাই কিছুটা জড়তা নিয়েও ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম।
.
ভয়ে ভয়ে কলিংবেল চাপলাম।সৌভাগ্যবশত তূর্যই দরজাটা খুললো। যদিও আমার খুশি হবার কথা ছিল কিন্তু হলাম না। কারণ ওর প্রায় একটা বিশাল ব্যান্ডেজ করা। সেই সাথে কপালেও ব্যান্ডেজ। মুহুর্তেই আমার চোখে মুখে আতংকের ছাপ নেমে এল। আমি নিজের সীমানা ভুলে গিয়ে নরম হাতে ওর কপাল ছুঁয়ে দিয়ে বললাম
-তূর্য ভাইয়া!আপনার কি হয়েছে?
-না না তেমন কিছু না।হালকা অ্যাক্সিডেন্ট।
আমার চোখে জল টলমল করে উঠল ।আমি ওর পায়ের কাছে বসে ওর পায়ে হাত বোলাতে লাগলাম।আর বলতে থাকলাম
-একটু দেখে সাইকেল চালাতে পারেন না?কতটা ব্যথা পেয়েছেন।
ওমনি একজন ভদ্র মহিলা আমাদের দিকে আসতে আসতে কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললেন
-কত বলেছি একটু দেখে শুনে চলিস!।শুনেছি মেষ রাশির ছেলেদের নাকি প্রচ্ছন্ন বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
তার উপর
মেয়ে মানুষের খপ্পরে
পড়েই আজ এ অবস্থা………….। আমারতো এ কথা শুনে গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো। একটু আগে যে পায়ে আর কপালে আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম ইচ্ছে হচ্ছে ওর ঐ পায়ে আর কপালে সজোরে আঘাত করে বলি যে,
-এই ছেলে! তুমি বুঝনি আমি তোমাকে ভালোবাসি? তুমি আমাকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে!
দুঃখে আমার কান্না চলে আসছিলোো প্রায়……..।
.
তূর্য ওর মাকে থামাতে চাচ্ছিলো কিন্তু ওর মা ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-জানো মা কি হয়েছে? কোন মেয়ের কাছে নাকি ওর একটা বই ছিল। সেদিন আমি ওকে বাজারে পাঠিয়েছিলাম। বাজার করে আসতে আসতে বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছিলো। ও বাজারের ব্যাগ কোনমতে রেখে বলল ঐ মেয়েটা নাকি ওর জন্য বইটা নিয়ে অপেক্ষা করছে।ও না গেলে নাকি মেয়েটা কষ্ট পাবে। সেই মেয়েটার কাছ থেকে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বই আনতে গিয়েই আমার ছেলেটার এই অবস্থা হয়েছে রাস্তায়।
.
আমারতো উনার কথা শুনে পুরাই মাথা হ্যাং। কৌশলে হাতে থাকা বইটা পেছন লুকানোর চেষ্টা করলাম। যদি তূর্যর মা জানতে পারে যে মেয়েটা আমি তাহলে আমার খবর আছে আজ। তূর্যর দিকে তাকিয়ে দেখি ও নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে আর আমতা আমতা করছে।
.
এবার তূর্যর মা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিলেন।তারপর বললেন
-এই যা তুমি আসতেই তোমার সাথে বকবক
শুরু করলাম।তুমি নিশ্চয়ই তূর্যের ছাত্রী?
তো মা তুমি এত দেরী করে এলে কেন?ওর অন্যান্য ষ্টুডেন্টরা ওকে এক্সিডেন্টের পরদিনই দেখে গেছে। ওর ষ্টুডেন্টের গার্জিয়ানরাও এসেছিল। ওরা তো প্রতিদিনই ফোন করে খোঁজ নেয়।
তূর্য কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চাচ্ছিলো। সম্ভবত এটাই বলতে চায়ছিলো যে, আমি ওর ছাত্রী না। কিন্তু ওর মা ওকে আবারো ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
.
আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমতা আমতা করে বললাম
-ইয়ে না মানে আমি খবর পাইনি আন্টি।
-ওহ।তাই বলো।
.
সেদিন কোনমতে তূর্যদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। ওর মা সামনে থাকায় বইটা আর দিতে পারলাম না।
খুব খারাপ লাগছিলো এটা ভেবে যে, আমার দুষ্টুমির জন্যই এখন তূর্যকে ভুগতে হচ্ছে। যা হোক বাসায় এসে অন্তত একটা জিনিস তো জানতে পারলাম যে, তূর্য টিউশনি করায়। ওকে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় কাছে পাওয়ার একটা উপায় পাওয়া গেলো।
.
বাবাকে তূর্যের এত্তগুলো প্রশংসা করে ওকে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দিলাম
। অাজ তূর্য প্রথম পড়াতে আসবে আমাকে। মনটা বেশ ফুরফুরে। কি পরিমান শয়তানি যে করব তার সাথে সেইটা আল্লাহ মাবুদই জানেন। তূর্য কল্পনাও করতে পারবে না যে ও কিরকম বদমায়েশ মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রতিদিনকার মত সকালে খবরের কাগজের রাশিফলে চোখ বুলাচ্ছি। ওমনি দেখি আজ নাকি মেষ রাশির ছেলেদের প্রেমের প্রস্তাব পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।আর সেই প্রস্তাবটা নাকি মোবাইল ফোনে পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমার তো মেজাজ গরম হয়ে গেলো।
যে ভাবেই হোক তূর্যর থেকে মোবাইল ফোনটা হাতাতে হবে আজ।
.
তূর্য এসে আমাকে পড়াতে লাগলো। ও আমাকে অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করছে।আমি শুধু হ্যাঁ না তে জবাব দিচ্ছি।আমি তো ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছি ওর ফোনটা নেওয়ার জন্য।
হঠাৎ ওর একটা ফোন এলো ।ও ফোনটা রিসিভ করল।যেহেতু ও আমার কাছেই ছিল আর ফোনের ভলিউমটা হাই ছিল তাই ও পাশের কলার যে একজন মেয়ে সেটা বুঝতে আমার সমস্যা হল না।
.
ও পাশের কথা তো আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। শুধু তূর্যরগুলো শুনছিলাম।
তূর্য বলছিলো,
-হ্যালো কে?
ও মুনা? কি ব্যাপার এতদিন পর হঠাৎ মনে পড়লো? হ্যাঁ আমিও তোমার নাম্বার অনেক খুঁজেছি। সেই যে এইচ এস সি পরীক্ষার সময় দেখা হয়েছিল আর তোমার সাথে কন্টাক্ট হয়নি। কি বললে?জরুরী কথা
বলবে আমার সাথে। হ্যাঁ বলো। সমস্যা নেই।
.
না আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি প্রপোজটা করে ফেললো এক টানে ফোনটা তূর্যর কান থেকে নিয়ে সুইচ অফ করে দিলাম। তূর্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখে হাজারো প্রশ্ন। ও কিছু বলে উঠার আগেই আমি বলে উঠলাম
-আপনি এখন আমাকে পড়াচ্ছেন না?পড়ানোর সময় ফোনে কথা বলা নিষেধ।
তূর্য আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখে যেন রাজ্যের কৌতুহল।ও মনে হয় বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, আমি ওর সাথে এটা করতে পারি। যা হোক আমার ওসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। আমার কাজ হচ্ছে আজকের মত ওর প্রপোজ ঠেকানো। আমার ভালবাসার মানুষকে অন্য কেউ “আই লাভ ইউ” বলবে! নো! ইটস ইমপসিবল।
.
তূর্য স্বাভাবিক হয়ে আবার আমাকে অঙ্ক করাতে লাগলো। অঙ্ক করানো শেষে যখন ছুটি দিয়ে চলে যাবে তখন ও সেলফোনটা চাইল আমার কাছে। আমি বললাম
-ফোন রাত বারোটার পর এসে নিয়ে যাবেন।
-হোয়াট! বারোটার পর আসব কেন?
-কারন আজকে আপনার মোবাইলের মাধ্যমে প্রপোজ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বারোটার পর আজকের দিন শেষ হয়ে যাবে আর তখনি আপনাকে আপনার ফোন ফেরৎ দেয়া হবে।
-আমি প্রপোজ পেলে তোমার সমস্যা কি?
এবার আমার জিহ্বায় কামড় পড়ল ।এটা কি বলে ফেললাম? এখন কি জবাব দিবো ?ক্ষনিকের মধ্যেই আমার নিজের মনে সাহস সঞ্চার করলাম। ঝটপট করে বলতে গিয়েও তোতলিয়ে বললাম
-আ-আ-আমার কি না মানে?
আপনি এখন প্রেম শুরু করলে আপনার ষ্টুডেন্টদের মন দিয়ে পড়াবেন না। আর আমিও তো আপনার একজন ষ্টুডেন্ট, তাইনা?
-তুমি বেশি পেকে গেছো। তোমাকে কে বলল যে, আজ আমি প্রপোজ পাব?
-আপনি মেষ রাশির না?
-হুম।
-পত্রিকায় দেখেছি আজ মেষ রাশির ছেলেরা
প্রপোজ পাবে। তাও আবার ফোনে পাবার সম্ভাবনা বেশি।
-এসব ফালতু ব্যাপার বিশ্বাস কর তুমি?
-করব না কেন? একশোবার করি। ওসব মনিষীরা লেখে।
.
সকাল থেকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি আর নাকের পানি এক করে ফেলেছি। কারণ হচ্ছে তূর্য নাকি আমাকে আর পড়াবে না।
সেদিন তর্ক করে ফোনটা আমি রেখেই দিয়েছিলাম আমার কাছে আর রাতে যখন ওর আপা ফোন দিয়েছিল, নাম্বারটা সেইভ ছিল না। আমি তো মেয়ে কন্ঠ পেয়েই যা তা বলা শুরু করে দিলাম।এতে তূর্যকে ওর বোন কি না কি বলেছে।আর তারই ফলস্বরুপ তূর্য আমাকে আর পড়াবে না। বাবাকে অনেক বলে তূর্যকে আবারো ম্যানেজ করালাম। কিন্তু শর্ত হচ্ছে ওর সাথে অতিরিক্ত কোন কথা বলা যাবে না ও দুষ্টামি করা যাবে না।
আমি তাতেই রাজি হলাম। কিন্তু বদমায়েশ কি আর ভাল হয়? কিছুদিন ভাল যাওয়ার পর আমি আবারো শয়তানি শুরু করলাম। একদিন শাড়ী পরে এসে তূর্যর সামনে বললাম
-তূর্য! দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে?
তূর্য আমার কথা শুনে লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। ওকে এভাবে দ্রুত বসা থেকে উঠতে দেখে আমি ভয় পেয়ে বুকে একটু থুতু দিলাম। তূর্য বললো
-আমি না তোমার স্যার হই?
এবারও জিহ্বায় কামড় দিলাম। সারাক্ষণ মনে মনে তূর্য তূর্য বলি তো তাই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। যা হোক আমি অপরাধীর মত বললাম
-সরি স্যার।
তূর্য শুধু “ইটস ওকে” বলেই অঙ্ক বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। আমি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তূর্যর মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি হালকা করে কাশি দিলাম। তাতেও কাজ হচ্ছেনা।অতঃপর ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম,
-স্যার, দেখুন তো আমাকে দীপিকার মত লাগছে না?
-দীপিকা কে? তোমার কোন বান্ধবী?
-সেকি স্যার! আপনি দীপিকা কে চেনেন না? বলিউডের হিরোইন।
-আমি বলিউডের মুভি দেখি না।
-স্যার বি টি ভি দেখেন?
-হুম।
-ঐ যে স্যার, বিটিভিতে লাক্সের একটা বিজ্ঞাপন দেয় না লাল ড্রেস পড়া, ঐটাই দীপিকা। এবার বলুন আমাকে দীপিকার মত লাগছে না?
-ঐ বিজ্ঞাপনেতো মেয়েটা শাড়ী পরে নি। ঐ মেয়েটার শাড়ী পরা কোন পিক থাকলে দেখিও। তারপর বলবনে তোমাকে দীপিকার মত লাগে কিনা। এখন পড়তে বসো।
মনে মনে তূর্যকে একগাদা বকা বকতে বকতে গাল ফুলিয়ে পড়তে বসলাম।
.
তূর্যর কাছে বাকি যে কয়টা দিন পড়েছি অনেক দুষ্টুমি করেছি। ও আর কোনদিন কিছু বলেনি। আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। তূর্যর সাথে এক মাস আগে দেখা হয়েছিল। আমার ভেতরে খুব জ্বালা যন্ত্রনা হচ্ছিলো ওর জন্য। ওর সাথে এত দুষ্টুমি করলাম, ও কি একবারও বুঝতে পারে নি যে ওকে ভালবাসি। ওকে কি আমি এভাবে হারিয়ে ফেলব? কয়েকটা মাস ওর পেছনে লেগে ছিলাম।
ওর ক্রিকেট খেলা দেখার শুরু থেকে প্রাইভেট পড়া পর্যন্ত কত কিই না করেছি ওর সাথে! ওর কি বুঝা উচিৎ ছিলনা যে আমি ওকে ভালোবাসি!
.
তূর্য এখন আর আমাদের বাসার সামনে ক্রিকেট খেলতে আসেনা। আনন্দমোহনের মাঠে যাই যদি ও আসে! কিন্তু না, ও আসে না। ওর জন্য বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো। ওদের বাসায় গিয়েছিলাম একদিন, ওকে পাই নি। আরেকদিন আর যাওয়ার সাহস পাইনি। ওর ফোন নাম্বারটায় কল দিয়েও পাচ্ছিলাম না ওকে। ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মোচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম ওর বিরহে।
.
আমার এস এস সি’র রেজাল্ট বের হয়েছে আজ। আমি জি পি এ ফাইভ পেয়েছি।কিন্তু তবুও আমার মধ্যে কোন আনন্দ নেই।বুকে যে তূর্যকে হারানোর হাহুতাশ!
আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম যখন বাবা বললেন
-তূর্যদের বাসায় তুই নিজে গিয়ে মিষ্টি দিয়ে আয়।
.
আমি অনেক্ষণ ধরে তূর্যদের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছি। বাসায় কাজের বুয়া ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই শপিং এ গিয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই নাকি ফিরে আসবে। কিছুক্ষন পর শুধু তূর্য একা বাসায় ফিরলো। ওকে এতদিন পর দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। বুকের ভেতর অনেকদিন ধরে জমা থাকা হাহাকারকে দমিয়ে রাখতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম আর বলতে লাগলাম
-তুমি পারলে এভাবে কষ্ট
দিতে? তুমি কখনও বুঝতে পার নি যে ভালোবাসি?
-তুমি কি কখনো বলেছো? জানব কিভাবে?
ওর বাহুডোর থেকে উঠে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ও দুষ্টুমি করে হাসছে।
আমার ভয়ংকর তাকানো দেখে ও এবার নিজ থেকেই আমাকে বাহুডোরে জড়ালো। তারপর আস্তে আস্তে ফিসফিসিয়ে বলল
-কষ্ট আমিও কম পাই নি।তবুও ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল কোন মেয়ে নিজ থেকে ভালবেসে অামাকে যেদিন প্রপোজ করবে সেদিনই অামি প্রেমে জড়াবো। অামার সেই ইচ্ছা অাজ পূর্ন হয়েছে।