প্রথম বর্ষের ক্লাসের একুশ দিন চলে গেছে। একুশ দিন পর কেউ প্রথম ক্লাস করতে আসলে শিক্ষকরা তাকে লজ্জা দিবে এটাই তো স্বাভাবিক। রিমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আজাদ স্যার ওর দিকে তাকিয়ে বললেন,
 “তোমার কি বিয়ে হয়ে গিয়েছিল? নাকি বন্ধুর সাথে ঘুরতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলে? তা নাহলে তো একুশ দিন অনুপস্থিত থাকার কথা নয়।”
 স্যারের কথা শুনে ক্লাসের সবাই হো হো করে হাসতে লাগলো। কেউ কেউ শিসও দিলো। ব্যাক বেঞ্চের কিছু ছেলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গীও করলো। রিমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু সে বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে.. এই রুমের অক্সিজেনটুকু তার অভাব মেটাতে পারবে না। তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এতো বড় একটা মেয়ে ক্লাসে কাঁদছে। সেটা দেখতেও ভালো লাগে না। তাই সে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাঁদতে পারলো না।
 .
 শুভ ক্লাসে বসে বাড়ির কাজ করছিলো। গতকাল রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে বাড়ির কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি। হঠাৎ করে ক্লাসের সবার হাসার শব্দে সে চোখ তুলে তাকাল। শ্যামলা মত একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আশপাশ থেকে বিভিন্ন অশ্লীল মন্তব্য শুনে ঘটনার কিছুটা হলেও সে আঁচ করতে পারলো। তার খুব মন খারাপ হলো। কাউকে কাঁদতে দেখলে তার মন খারাপ হয়।
 .
 ক্লাস শেষে শুভ অপমান হওয়া মেয়েটির দিকে তাকালো। রিমা ব্যাগের সাথে মুখ লুকিয়ে আছে। হয়তো সে কাঁদছেও। শুভ বেঞ্চগুলোকে অতিক্রম করে রিমার দিকে এগিয়ে গেল। রিমার পাশে দাঁড়িয়ে তার বেঞ্চটা ধরে নাড়া দিলো। নাড়া খাওয়ার ফলে রিমু মুখ তুলে তাকাল। ওর চোখগুলো কেমন লাল হয়ে আছে। একটু একটু ফোলাও। শুভ নিশ্চিত হলো যে, মেয়েটা কাঁদছিল। শুভ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
 – তোমার নাম কী?
 – রিমা
 – ও আচ্ছা। আমার নাম শুভ। আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
 রিমার কাছে মনে হয়, সব ছেলেরাই একরকম। তারা শুধু মেয়েদের সাথে প্রেম করার জন্যই কথা বলে। সে আবার নিজেকে ব্যাগের সাথে মিলিয়ে নিলো। শুভ রিমার এই অদ্ভুত আচরণ দেখে কিছুটা অবাক হলো। এই প্রথম কোন মেয়ে তাকে অগ্রাহ্য করেছে। শুভ আর কোন কথা বললো না। মেয়েটার বোধহয় খুব মন খারাপ তাই কথা বলতে চাইছে না। শুভ আর দাঁড়াল না। নিজের জায়গায় চলে গেল। তার মনটাও খুব খারাপ। এই মন খারাপটা কেন হলো? রিমা তাকে অগ্রাহ্য করেছে এজন্য? নাকি এমনিই? সে মন খারাপের প্রকৃত কারণটা ধরতে পারছে না।
 .
 আজ আকাশের অবস্থা খুব বেশী ভালো না। যেকোন সময় ঝুম বৃষ্টি নেমে পরতে পারে। যদিও বর্ষাকাল তবুও যে পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে তাতে মনে হয় (বর্ষাকাল)² চলছে। শুভ ক্লাস শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিল। ততক্ষনে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।  বেকারী গলির রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলো রিমা রাস্তার পাশের টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিমার চুলগুলো ভিজে গেছে। কলেজ ড্রেসের অর্ধেকটাও ভেজা। রিমা আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির ফোঁটার নেমে আসা দেখছে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিগুলোকে ছুঁয়েও দিলো। শুভর মনে হলো, সে স্বর্গীয় কোন দৃশ্য দেখছে। টং দোকানকে তার একটি রাজপ্রাসাদ মনে হলো যার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাজকন্যা বৃষ্টিফোঁটাগুলোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। তার মোটামুটি দীর্ঘ এই জীবনে প্রথমবারের মতো কারো প্রেমে পরে গেল। নিজেকে আর জমাট বাঁধিয়ে রাখতে পারলো না। টং দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে একদম দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রিমা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। শুভ নিজের দিকে কাউকে কখনো এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেনি।
 .
 অন্যদিকে রিমার ভাবনাগুলোও শুভকে নিয়ে। সে ভাবছে- এই ছেলেটা তো খুব সুন্দর। ক্লাসে তেমন ভালো করে দেখা হয়নি। ছাতার নিচে দাঁড়ানো ভদ্র চেহারার ছেলেটিকে মোটা ফ্রেমের চশমায় ভালো মানিয়ে গিয়েছে। কি নাম যেন বললো? শুভ না? হুম, শুভই তো।
 .
 শুভ তার দিকে তাকিয়ে থাকা রিমার চোখের ওপর দুর্বল হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেমে পরে গেল। মনে মনে ভাবল, “এই আঁখি দুটি যেন মোরে দেখে জনম জনম।”
 শুভর ছাতার চারপাশ দিয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টির লম্বা রেখাগুলি তাকে চারপাশে ঘিরে রেখেছে। আজ সে বৃষ্টির কারাগারে বন্দী।
 .
 চায়ের কাপের টুং টাং শব্দে রিমা সম্বিত ফিরে পেল। এতক্ষন সে তাকিয়ে তাকিয়ে শুভকে দেখছিল? হায়!! কি লজ্জাস্কর ব্যাপার। রিমা মাথা নিচু করে ফেলল। বিষয়টা বুঝতে পেরে শুভও খুব লজ্জা পেল। অনেকক্ষন তারা মাথা নিচু করে রইল। কেউ কোন কথা বলছে না। নিশব্দ চারদিক। দুজনই মুচকি হাসছে।
 .
 শুভই নিরবতা ভঙ্গ করলো। রিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
 – বাসায় যাবে না?
 – হু, যাবো।
 – তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
 – বৃষ্টি
 – তো কী হয়েছে?
 – ছাতা
 – নেই?
 – না
 – আমার ছাতায় চলো আসো।
 রিমা আর কোন কথা বললো না। টুপ করে শুভর ছাতার নিচে ঢুকে পরলো।
 .
 রিমা আর শুভ এক ছাতার নিচে হাঁটছে। ছাতার আকৃতিটা খুব বেশী বড় না হওয়ায় দুপাশ থেকে বৃষ্টির ঝাটগুলো তাদের দুজনকেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। তারা বৃষ্টির ঝাট থেকে বাঁচতে পরস্পরের আরও কাছে চলে এলো। এত্তো বড় আকাশ আর পৃথিবীটা ক্রমেই ছোট হয়ে এল দুই মানব মানবীর মাঝে।
 .
 বাস স্টেশনে এসে রিমা বাসে উঠে গেল। বাসে উঠেও আজকের মুগ্ধতাটা তাকে ধরে রেখেছে। নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বললো, “অসাধারণ একটা দিন ছিলো।” শুভ এবং রিমা, দুজনেরই পরস্পরকে খুব ভালো লেগেছে। প্রেমে পরে গেছে একে অপরের। অথচ কেউই মুখ ফুটে বলেনি, “ভালবাসি”। কিছু ভালোবাসায় শুধু মুগ্ধতাগুলি ছড়িয়ে থাকে। সেখানে “ভালবাসি” বলাটা মুখ্য বিষয় নয়।
 .
 দিনগুলি কেমন করে যেন খুব দ্রুতই পার হয়ে যায়। এর মধ্যেই দুইটি আলাদা সত্ত্বার মাঝে জেগে ওঠে প্রেম। প্রতিদিনই তাদের কথা হয়। কথোপকথনে দেশ আর সমাজের গন্ডি ছাড়িয়ে মনোবিশ্লেষন ঢুকে পরে। খুব সাধারণ কোন সস্তা প্রেমকাহিনীর মতো মনে হতে পারে বিষয়টিকে। কিন্তু আসলে বিষয়টি তা নয়। প্রত্যেকটা প্রেমই একেকটা আলাদা দৃষ্টান্ত। এরা নতুন করে ভালবাসার জন্ম দেয়। নতুন করে ভালবাসতে শিখায়।
 .
 দীঘির পাড়ে কদম গাছের নিচে বসে আছে শুভ এবং রিমা। গত এক মাস ধরে তারা একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করেছে। নিজের অজান্তেই ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু কখনো বলা হয়নি, “আমি তোমাকে ভালবাসি”
 শুভ রিমার দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছে না। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। রিমু ফিসফিস করে বললো,
 – কী হলো? কিছু বলছো না যে? কেন ডেকেছ?
 – একটা কথা বলার জন্য
 – বলো
 – বলতে ইচ্ছে করছে না।
 – তাহলে থাক। বলার দরকার নেই।
 – না দরকার আছে। কিন্তু আমি বলতে পারছি না।
 – বলতে না পারলে জোর করে বলার কী দরকার?
 শুভ কোন কথা বললো না। চুপ করে রইল। তার মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেছে। আচ্ছা, রিমা কি তার মনের কথাটা বুঝতে পারছে না? তাহলে মনের মিল কিভাবে হবে?
 .
 শুভকে চুপ করে থাকতে দেখে রিমা ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে বললো, “ভালোবাসো তাইতো?”
 শুভ রিমার দিকে না তাকিয়ে বললো, “হু”
 রিমু বললো, “আমার হাতটা শুধু ধরো। একটু খানি জড়িয়ে রাখো। তোমার ভাবনাগুলো ইচ্ছে হলে আমায় দিতে পারো। আমার ভাবনাগুলো মন চাইলে নিয়েও নিতে পারো।”
 শুভ রিমার হাতটা শক্ত করে ধরল। আস্তে আস্তে বললো, “আমার আকঁড়ে ধরা সুখস্বর্গটা”
 রিমার চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো। তার মতো শ্যামলা একটি মেয়ে কারো স্বর্গ হতে পারে, এটা তার ভাবনায় ছিলো না। সে হয়তো জানে না যে, একজন শ্যামলবর্ণ মেয়ে ঠিক কতটুকু মায়াবতী হতে পারে। তারা তাদের আশেপাশের মানুষকে কী মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে?
 .
 রিমা তার মাথাটি শুভর কাঁধে নামিয়ে রাখলো। হাতে হাত রেখে আর কাঁধে মাথা রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে আরেকটি পবিত্র প্রেমের সূচনা হলো। এই প্রেমের বর্ণনা চলতে থাকবে জনম জনম। এর উপসংহারটা বোধহয় আর আসবে না। না আসাই ভাল। কাউকে কাউকে উদাহরণ হিসেবে বেঁচে থাকতে হয়। হয়তো আজ শতকোটি মাইল দূরে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার গাড়িতে বসে বসে দেবী আফ্রোদিতি শুভ আর রিমাকে দেখতে পাচ্ছে। তাঁর প্রেমের হালখাতায় আরো একটি নিখাঁদ ভালবাসার নাম যুক্ত হলো। যে প্রেমে কোন খাঁদ নেই। খাঁদহীন অত্যন্ত পবিত্র ভালবাসা। শুভ রিমার হাতদুটো আরো শক্ত করে ধরে রাখলো। এই শক্ত করে ধরে রাখাটাই কি হারানোর ভয় থেকে আসছে?
 .
 কদম গাছ থেকে তিনটি পাতা মাটিতে ঝড়ে পরলো। শীতকালে গাছেরা তাদের পাতা ঝড়ায় কিন্তু এই বর্ষায় কদম তার পাতা বিসর্জন দিলো কেন? বৃক্ষরাও হয়তো মনে রাখে প্রেমের কথা। অভিবাদন জানায় প্রেমিকযুগলকে। তারা হয়তো উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে পারে না। তারা জানায় নিরিবিলি অভ্যর্থনা। তিনটি পাতার ঝড়ে যাওয়াটা বোধহয় এটারই ইঙ্গিত দেয়। তারা বলতে চায়- ভালো থেকো রিমা-শুভ, ভালো থেকো তোমরা আর ভালো থাকুক তোমাদের ভালবাসা।
 
  
 Loading...
Loading...













