গল্পঃ জ্যোৎস্না স্নান
জান্নাতুল ফেরদৌস হ্যাপি
মানুষ প্রেম করলে অস্যংখ্য রোমান্টিক মুহূর্ত জীবনে আসে। কিন্তু আমার জীবনে প্রেম করা অবস্থায় কোন রোমান্টিক মুহূর্ত আসেনি। কারন আমি প্রেম করেছি একটা গাধার সঙ্গে। না, এটা কোন জন্তু গাধা না; এটা হলো আমার হিমু গাধা। ওর গাধামীর কয়েকটা ছোটখাটো উদাহরণ দিচ্ছি।
প্রথমেই আসি কবে হিমু থেকে গাধা হলো সেই ঘটনায়। ওর পুরো নাম হেমায়েত। আমি আদর করে ওকে হিমু ডাকা শুরু করলাম। আমাকেও আদর করে একটা নাম দিতে বললাম। অক্লান্ত মানসিক পরিশ্রম করে অবশেষে সাতদিন পর ফোন করে উৎফুল্ল হয়ে বলল, আদর করে আমার সুন্দর একটা নাম রেখেছে। আমি অত্যন্ত পুলকিত হলাম। যাক, অন্তত সাতদিন পর হলেও নাম তো রেখেছে। আমি গদগদ গলায় ঢঙ্গী ভঙ্গিতে বললাম, “কি নাম হিমু সোনা?”
– তোমার নাম রেখেছি শসা। তোমাকে শসা বলে ডাকবো।
বিনা মেঘে বজ্রপাত যেন আমার মাথায় পড়লো। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। কোন রকম নিজেকে কন্ট্রোল করে বললাম, “শসা মানে? এটা আবার কেমন নাম?”
গাধা টা অত্যন্ত যুক্তি দিয়ে বলল, “তুমি আদর করে হেমায়েত থেকে হিমু করেছো। তাই আমিও আদর করে তোমার নাম শসী থেকে শসা করলাম। কেন? তোমার পছন্দ হয়নি?”
রাগে দুখে আমার চোখ টলমল করছে। তবুও মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম, “হুম, পছন্দ হয়েছে।” চোখে কান্না নিয়েও মুখে হাসি ফোটানোর কারন হলো, গাধাটা কে খুব ভালোবাসি।
পরের ঘটনাটা বলি। ভ্যালেন্টাইনস ডে তে আমাদের দেখা হলো। ওর ডান হাতটা পিঠের পিছন দিকে লুকানো। বোঝাই যাচ্ছে হাতে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই আমার প্রিয় লালা গোলাপ। ভালোবাসা দিবসে এর চেয়ে বড় উপহার আর কিছু নেই। আমি হাসি দিয়ে ওর সামনে আমার দু’হাত পেতে বললাম, “দাও।”
ও চোখ দু’টো ছানাবড়া করে আমাকে বলল,
– তুমি জানো?
– হ্যা জানি
– কিভাবে জানো?
– আরে বোকা, এইদিনে সব মেয়েরাই বোঝে। এখন আর কথা না বাড়িয়ে দাও।
গাধাটা তার হাত থেকে যে জিনিসটা আমার হাতের উপর রাখলো তা দেখে আমি চমকে উঠলাম। আমার হাসিমাখা মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
– এটা কি??
– কলা
– কলা সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কলা কেন?
গাধাটা আবারো অত্যন্ত যুক্তি দিয়ে আমাকে বলল, “দেখো, আজকের দিনে একটা গোলাপের দাম পঁচিশ টাকা। আর এক হালি কলার দামও পঁচিশ টাকা। গোলাপটা কয়েকদিন পর শুকিয়ে গেলে তুমি ফেলে দেবে। কিন্তু কলা খেলে তোমার শরীরে উপকার হবে। এজন্য একটা গোলাপ না এনে তোমার জন্য এক হালি কলা এনেছি।”
ইচ্ছে করছিলো কলাগুলো গাধাটার মুখে ছুড়ে দিয়ে চলে আসি। কিন্তু পারিনি। কারন গাধাটা কে খুব ভালোবাসি।
তৃতীয় ঘটনা বলি। ধানমন্ডী লেকের পাড়ে বিকেলে দুজনে হাত ধরে বসে আছি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে কিছু মৃদু বাতাস বইছে। চমৎকার পরিবেশ। পরিবেশটা আরো রোমান্টিক করার জন্য আমি গাধাটা কে বললাম, “এই, একটা গান গাও না”
– আমি গান গাইবো?
– হ্যা, কেন?
– আমি তো গাইতে পারিনা।
– যা পারো তাতেই হবে। গাও না প্লীজ!
– তুমি বলছো?
– হ্যা। গাও।
প্রথমে কয়েক সেকেন্ড কাশি দিয়ে গলা ঝেরে নিলো। তারপর গান ধরলো-
এই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাড়িয়ে
এক মধ্য বয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে
খোকা ফিরবে…….
আমি ফ্যালফ্যাল করে গাধাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাসবো নাকি কাঁদবো নিজেই ঠিক করতে পারছি না। কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার অনুরোধে রোমান্টিক একটা সময়ে দেশাত্মবোধক গান গায় তা এই প্রথম দেখলাম। রাগে আমার শরীর জ্বলছে। সেদিনই গাধাটার সাথে সম্পর্ক শেষ করে চলে আসলাম। রাতে গাধাটা বারবার কল দিচ্ছিলো আর আমি কল কেটে দিচ্ছি। অবশেষে ৭৯ তম বারের কলটা রিসিভ করি। ফোনের ওপাশ থেকে গাধাটা হাউমাউ করে কাঁদছে। আমারও মনটা গেলো গলে। ভাবলাম প্রেম যখন করেছি, সে মানুষ হোক আর গাধাই হোক, বিয়ে তাকেই করতে হবে।
বিয়ের পর অনেক চেষ্টা করলাম গাধাটা কে পিটিয়ে মানুষ করার জন্য। কিন্তু কোন লাভ হলো না। আজ গাধার সাথে আমার বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলো। সন্ধ্যার পর গাধাটার জন্য হালকা সাজগোজ করলাম। যদিও জানি এসব নিয়ে গাধাটার কোন মাথা ব্যাথা নেই। তার প্রধান কাজ হচ্ছে অফিসে গাধার মত সারাদিন কাজ করে রাতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে মহিষের মত ঘুমানো। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কলিংবেল টিংটিং করে বেজে উঠলো। গাধাটা এলো বুঝি। দরজা খুলে দেখি গাধাটার দুই হাত পিছনে লুকানো। আমি মনে মনে আৎকে উঠলাম। কলা ছোট ফল বলে সেদিন একহাতে নিয়েই পিছনে লুকিয়েছিলো। আজ দু’হাতই পিছনে লুকানো কেন? তরমুজ-টরমুজ নিয়ে আসেনি তো গাধাটা? দেখা গেলো আমার হাতে প্রকান্ড এক তরমুজ দিয়ে বলবে, বিবাহ বার্ষিকীতে আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য সামান্য উপহার। আমি এমন কিছু আশংকা করে তাড়াতাড়ি ডাইনিং এর দিকে চলে যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার হাত খপ করে ধরলো। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি ওর বাম হাত দিয়ে আমার হাত ধরেছে আর ডান হাত পিছনে লুকানো। আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক, অন্তত তরমুজ জাতীয় কিছু নেই ওর হাতে। কিন্তু হঠাৎ করে আমার হাত এভাবে খপ করে ধরলো কেন বুঝলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ঠোঁটের কোণে দুষ্টু দুষ্টু হাসি ঝুলে আছে। আজ ওকে কেমন অন্য রকম লাগছে আমার। এমন তো কখনো দেখিনি ওকে। একটু মুচকি হেসে পিছন থেকে হাত সামনে এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ” নাও।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ওর হাতে লাল রঙের হার্ট আকৃতির একটা কুশন। এমন গিফট হিমু আনতে পারে তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার। আমি ওর হাত থেকে কুশন টা নিতেই ও আমাকে কোলে তুলে নিলো।
– এই, কি করছো? ছাড়ো। নামাও আমাকে।
– চুপ! কোন কথা না।
কোলে করেই বেডরুমে নিয়ে এসে নামালো আমাকে। বেডরুমে টেবিল ল্যাম্পের হালকা আলোয় ওকে কেমন অদ্ভুত লাগছে। ওর নাকটা আমার নাকের সাথে লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো, ” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে”
আমি কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এটা কি সত্যিই হচ্ছে? নাকি স্বপ্ন? হিমু নিরবতা ভেঙে বললো, ” এই, চলো, লাইটটা অফ করে আজ আমরা জ্যোৎস্না স্নান করি”
হিমু টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে দিলো। জানালার পর্দা সারানো। জানালা দিয়ে জোৎস্নার নীলচে আলো আমাদের গায়ে পড়েছে। হিমু আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি বারবার চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করছি। কেন যে চোখে পানি আসছে আমি নিজেই জানিনা। হয়ত গাধাটা মানুষ হয়েছে সেই আনন্দে। অথবা ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে জীবনে প্রথমবারের মত সুন্দর একটা সময় উপহার পেয়েছি সেই আনন্দে।
হিমু আমার ঘাড়ে আলতো করে আদর করছে। আমি ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললাম, ভালোবাসি।
চাঁদের আলোয় আমাদের জ্যোৎস্না স্নান হচ্ছে। এটাই হয়ত আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ জ্যোৎস্না স্নান।