স্বর্গীয় প্রণয়

স্বর্গীয় প্রণয়

আয়েশা সিদ্দিকা

মিহির দৌড়াতে দৌড়াতে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। দুই এক তলা না। ওকে উঠতে হবে এভাবে একদম ছয় তলাতে। নিচে যে একটা লিফট আছে টেনশানে তা ভুলে গিয়েছে সে। টেনশানের কারণ ছোট্ট একটা মেসেজ। হাসনা ঘণ্টা খানেক আগে মেসেজ দিয়েছে, “তুমি ব্যস্ত কী? বাবু খুব কাঁদছে। ফ্রী থাকলে বাসায় চলে এসো।”
পুরোপুরি না, কিছুটা এমনই এক মেসেজ এসেছিলো বছর দেড়েক আগে মিহিরের ফোনে। “শরীরটা ভালো না। একটু বাসায় আসবে?” মিহির এসে দেখে লেবার পেইনে ছটফট করছে হাসনা। আসতে দেরী করায় নানা জটিলতায় পড়তে হয়েছিলো হাসনাকে বেবীটা হওয়ার সময়। আসলে ওর এতটা যে খারাপ অবস্থা মিহির বুঝে উঠতে পারেনি। পরে অভিমান করে বলেছিলো, ‘আমাকে সরাসরি বলতে যে, তোমার কী অবস্থা তখন। তাহলে দেখতে কত তাড়াতাড়ি আসি!’
হাসনা মিষ্টি হেসে বলেছিলো, ‘এই গাড়ি ঘোড়ার ব্যস্ত শহরে ওভাবে আসতে নিয়ে যদি বিপদে পড়ো! তাই বলিনি।’
মিহির রেগে বলেছিলো, ‘তুমি সিনেমার নায়িকা নও, হাসনা! এতটা মহান না হলেও চলবে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করতাম বলোতো? কী হতো তখন?’
‘কী আর হতো! তোমার ঘরে একটা নতুন বৌ আসতো।’ বলে খিলখিল করে হেসেছিলো হাসনা।
কিন্তু মিহির এ কথায় খুব রেগে যায়। আর কড়া বারণ করে কখনও এমন বলতে।
এসব ভাবতে ভাবতেই হুমড়ি খেয়ে ছয় তলার ওদের ফ্লাটের কলিং বেল চাপে ও। ভেতরে বাচ্চার হালকা কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সে আওয়াজ গাঢ় হয়ে এগিয়ে আসে। হাসনা দরজা খুলে দাঁড়ায়। কোলে দেড় বছরের ছেলে হোসাইন। বিরতিহীন কেঁদে চলছে। মিহির ভালো করে তাকিয়ে দেখে শুধু তার রাজপুত্রই না, রাজরাণীর নয়ন থেকেও গড়াচ্ছে হিরকবিন্দু। সিঁড়ি ঘরের ১০০ পাওয়ারের বাল্বের আলোয় হাসনার নাকের ‘তারা পাথরের’ ছোট নাকফুল আর চোখের পানি দু’টোই চিকচিক করছে। আর ছেলে মায়ের কোলে চোখ বুজে কাঁদছে। হাসনার নাকটা লাল হয়ে আছে। অনেকক্ষণ কেঁদেছে সহজেই বোঝা যায়। ও ছেলের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘তুমি যাওয়ার পরপরই কান্না শুরু করেছে। ভেবেছি থেমে যাবে। কিন্তু থামেনি। তাই দুপুরে জানালাম তোমায়। খুব ভয় লাগছে আমার। কী হলো বাবুর?’ বলতে বলতেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে।
এমন সুন্দরতম দৃশ্য দেখে থমকে যায় মিহির। কান্নার দৃশ্য কখনও এত সুন্দর হয়? হিসেব মেলাতে পারে না ও। তবে ওর খুব ইচ্ছে করে হাসনার মাথাটা দু’হাতে কাছে টেনে লাল টুকটুকে নাকে ছোট্ট একটা চুমু আঁকতে। কিন্তু আপাতত ইচ্ছেটাকে দমিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘ছেলের সাথে যে ছেলের মাও কাঁদছে তা কিন্তু মেসেজে লেখা ছিলো না। তাহলে আমি আরও দ্রুত আসতাম!’ বলেই হা হা করে হাসে।
হাসনা দরজা লাগিয়ে ঘরে এসে ফ্যান ছাড়ে। মিহিরের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে টেবিলে রাখে। আর মিহির নানা কথা বলতে থাকে হোসাইনকে থামানোর জন্য।
‘কী রে ব্যাটা? এত কাঁদছিস কেন? কী হলো বলতো? মা মেরেছে? নাকি তোর বৌয়ের সাথে ঝগড়া করেছে? নাকি বলেছে তোকে বিয়ে দেবে না? সব খুলে বল আমায়। বিচার এখনি শুরু করবো। ও আব্বাজান, বাপজান এবার থামেন দেখি!’
ছেলেকে নিয়ে ঘরে পায়চারি করতে করতে ভারি কণ্ঠে কী বলে আর না বলে মিহির। কিন্তু পুত্র সাহেবের কোনোদিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। ওদিকে হাসনার চোখের ঝরনাও থামে না। নাড়ি ছেঁড়া ধনের এত কান্না কী কারো সহ্য হয়? রান্নাঘরে যেতে নেয় ও মিহিরের খাবার দেওয়ার জন্য। মিহির পেছন থেকে হাত টেনে ধরে বলে, ‘আচ্ছা মুশকিল! দু’জনের কান্না আমি একা কী করে থামাবো? এটা কিন্তু অন্যায়!’ বলে শার্টের এক কোনা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নাও। চোখ মোছো। রুমাল নেই পকেটে।’
বরের এমন পাগলামিতে হেসে ফেলে হাসনা। কঠিন সময়েও মানুষটার রসিকতা যায় না! চোখের পানি মুছতে মুছতে রান্নাঘরে চলে আসে। পিছু পিছু মিহিরও আসে। হাসনা বলে, ‘কত দোয়া দরূদ পড়ছি কোনো কাজ হচ্ছে না, জানো? তুমি খেয়ে নাও। তারপর বাবুকে ডাক্তারের কাছে নেই চলো। ওর কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলতেও তো পারে না।’ বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে।
মিহির এক হাতে ছেলেকে সামলিয়ে আরেক হাতে বৌকে ধরে বলে, ‘ওর কোথায় কষ্ট হচ্ছে না জানলেও তোমার কত কষ্ট হচ্ছে আমি জানি তা, হাসনা! কষ্ট কী আমারও কম হচ্ছে? কিন্তু প্লিজ তুমি কেঁদো না। চোখের পানি আমি সামলাতে পারি না। বাবুর সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্‌ পাক কোনো পরীক্ষা নিচ্ছেন হয়তো।’
‘হ্যাঁ তাই যেন হয়।’ বলে কাজে মন দেয় হাসনা। এর মাঝেই দেখে বাচ্চার কান্নার শব্দ থেমে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখে বাবার কাঁধে পরম ভরসায় মাথা গুঁজে ঘুমাচ্ছে হোসাইন। মিহির নিজের ঠোঁটে আঙুল ধরে ফিসফিস করে বলে, ‘শশশ! কথা বলো না। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে খোকন।’
হাসনা বলে, ‘দাও শুয়িয়ে দিয়ে আসি। আর কতক্ষণ কষ্ট করবে? তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও।’
মিহির বলে, ‘আহা হা! নিজে বোধহয় আরাম করছিলে সারাদিন! আমি নিজেই শুইয়ে দিয়ে আসছি।’ বলে বেডরুমে চলে আসে।
.
মিহির ফ্রেশ হতে হতে ডাইনিং এ খাবার আনে হাসনা। ওর প্লেটে ভাত তুলে দিতে যাবে তখনই মিহির এসে ওর হাত চেপে ধরে বলে, ‘আমাকে খাওয়ানোর এত তাড়া! সত্যি করে বলোতো সকালে কিছু খেয়েছিলে? নাকি সারাদিন না খেয়ে পুত্রের সাথে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছো?’
হাসনা চুপ হয়ে যায়। না খেয়ে থাকা একদম পছন্দ করে না মিহির। এখন কিছু বললেই ধমক খাবে একটা। তবুও মিনমিন করে বলে, ‘না মানে, আসলে ক্ষিধে ছিলো না আর টেরও পাইনি সেভাবে আর কী…’
‘চুপ! একদম চুপ। এখন আমারও ক্ষিধে পায়নি। যাও গোসল করে এসো। একসাথে খাবো।’ রেগে বলে মিহির।
হাসনা কিছু বলতে যাবে তখনি ও চোখ রাঙিয়ে তাকায়। হাসনা তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।
.
দ্রুত গোসল সেরে হোসাইনকে খাইয়ে দিয়ে এসে হাসনা দেখে নিজের প্লেটে সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে বসে আছে মিহির। ও নিজের প্লেট এগিয়ে নিতে গেলে সেটা টেনে নিয়ে রেখে দেয় মিহির। তারপর নিজের প্লেটে সুন্দর করে তরকারির সাথে ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, ‘আজ এক প্লেটেই দু’জন খাবো। এক হাতে।’ বলে প্রথম লোকমাটা তুলে হাসনার মুখের দিকে ধরে। হাসনার বুক ফেঁটে কান্না আসে। কোন পূণ্য এমন জীবনসঙ্গী দিয়েছে ওকে স্রষ্টা? যে মানুষটার উপর প্রতিটা মুহূর্তে প্রেমে পড়তে বাধ্য হয় ও! এত ভালো কেনো মানুষটা?
‘এইই! একদম কাঁদবে না কিন্তু এখন। ছিঁচকাঁদুনী একটা! হাঁ করো বড় করে।’ চোখ মুখ শক্ত করে বলে মিহির।
হাসনা মিহিরের কব্জি ধরে লোকমাটা মুখে নিয়ে প্লেটের দিকে হাত বাড়ায় মিহিরকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মিহির বাম হাতে হাসনার হাতটা ধরে বলে, ‘বলেছিলাম! এক প্লেটে, এক হাতে খাবো আজ।’
হাসনা বলে, ‘আমার বুঝি একটু খাওয়াতে ইচ্ছে করে না?’
‘জ্বী! ইচ্ছে করলে সেদিন শুধু আপনি খাওয়াবেন। আজ আমিই।’
বলে নিজের গালে আরেক লোকমা তুলে নেয়।
বর এক হাতে বৌয়ের হাত ধরে আরেকহাতে তাকে খাওয়াচ্ছে, সাথে নিজে খাচ্ছে। ভুবনের মধুরতম দৃশ্যগুলোর একটি ঘটছিলো যেন সেখানে!
.
খাওয়া শেষে মিহির বলে, ‘ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। বললো বাচ্চাকাচ্চার এমন হয় মাঝে মাঝে। তবে ঘুম থেকে উঠেও কান্নাকাটি করলে চেম্বারে নিতে বলেছে। টেনশন করো না।’
হাসনা মিহিরের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘তুমিও করো না।’
তারপর খুব ভরসায় বরের কাঁধে মাথা রাখে আর এমন একটা কাঁধ দেওয়ার জন্য মনেমনে কৃতজ্ঞতায় জানায় দয়াময়ের কাছে।
.
রাতে এশার নামাজ, খাওয়া দাওয়া আর সব কাজ শেষে হাসনা বিছানা করে ঘুমানোর জন্য। বারান্দা থেকে মিহির এসে বলে, ‘হাসনা দেখো, কী সুন্দর জ্যোৎস্না আকাশে! চলো একটু বারান্দায় বসি। তারপর ঘুমাবো।’
.
দু’টো চেয়ার আনে মিহির বারান্দায়। হাসনা ঘুমঘুম চোখে হোসাইনকে কোলে নিয়ে আসে। হোসাইন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে খুব হাসিখুশি আছে। তাই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আর প্রয়োজন পরেনি। মিহির ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসনাকে বসতে বলে। চঞ্চল ছেলেটা বাবার কোলে অস্থির হয়ে নড়াচড়া করে খেলতে থাকে।
ওরা তিনজনে বসে ভিজতে থাকে পূর্ণ পূর্ণিমায়। চাঁদের এমন অপরূপ শোভা দেখে দু’জনই একসাথে বলে ওঠে, ‘সুবহানআল্লাহ!’ তারপর কো ইন্সিডেন্স দেখে হেসে ফেলে।
হোসাইন ঝাঁপিয়ে মায়ের কোলে চলে আসে। হাসনা ছেলের কপালের কোনে অদৃশ্য টিপ আঁকতে আঁকতে বিখ্যাত সেই ছড়া কাটে,
‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা,
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।’
হোসাইন খুশিতে দু’হাতে তালি দিয়ে আধো বুলিতে বলে, ‘তাদ মামা!’
ওরা থামলে মিহির বলে,
‘আয় আয় চাঁদ শালাবাবু টিপ দিয়ে যা,
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা!’
হাসনা মিহিরের হাতে থাবা দিয়ে বলে, ‘ছেলের সামনে কী বলো এসব?’
‘কেনো? আমার ছেলের মামা আমার শালা হবে না?’ হাস্যজ্জ্বল মিহিরের জবাব। হাসনাও হেসে ফেলে বরের দুষ্টুমিতে।
মিহির বলে, ‘জানো? বিয়ের বায়োডাটায় তোমার নামের উপরই ক্রাশ খেয়েছিলাম আমি। হাসনাহেনা! আগে পিছে কিছু নেই। কী অদ্ভুত সুন্দর নাম। মনে মনে ভেবেছিলাম এমন নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করাই যায়। তারপর বাকিটা ইতিহাস!’
হাসনা খিলখিল করে হেসে বলে,’তাই?’
‘হুম। তুমি আমার সংসারকে সত্যিই হাসনাহেনা ফুলের মতো মিষ্টি সৌরভে ভরে দিয়েছো। জীবনে সর্বদা সৎ থাকতে চেষ্টা করার সুবাদেই হয়তো তোমাকে উপহার হিসেবে পেয়েছি। সারাটা জীবন এমন হাসিখুশি থেকো আমার বুকের কাছে।’ বলে দূরের চাঁদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মিহির।
দৃষ্টি সরিয়ে দেখে চেয়ারে মাথা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত হাসনা আর তার কাঁধে ঘুমন্ত হোসাইন। মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ ওদের দেখে দু’জনের কপালেই আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় ও। আর শুকরিয়া জানায় রাব্বুল আলামিনের কাছে। ওদের স্বর্গীয় প্রণয় দেখে আকাশের একলা চাঁদটা হিংসায় জ্বলে যায় যেন!

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত