ভালোবাসার সুখপাখি

ভালোবাসার সুখপাখি

‘নাহিদ’ – সুদর্শন আর একেবারেই পাগলাটে একটা ছেলে। সারাদিন কাধে একটা গীটার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভার্সিটির সবাই ওকে গীটার-বয় বলেই ডাকে। নেকা মেয়ে গুলা যেন নাহিদ বলতেই অজ্ঞান। অথচ দুই চক্ষে সহ্য হয়না ছেলেটাকে আমার। বি.বি.এ -৩য় বর্ষের ছাত্রী আমি। নাহিদ আমার ১বছর এর সিনিয়র। কোন কথাবার্তা ছাড়াই ও হঠাৎ একদিন আমকে প্রপস করে বসলো। কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেলাম। পেছন ঘুর ঘুর করে বিরক্ত করার ছেলে ও না। কোথা থেকে যেন আমার নাম্বারটা যোগাড় করেছে। প্রতিদিন রাতে শুধু একটা করে মেসেজ করত কখনো ফোন করেনি। কোন রিপ্লাই না দিয়ে শুধু ওর মেসেজ গুলো পড়তাম প্রতিদিন। ব্যাপারটা ধীরে ধীরে ভাল লাগতে শুরু করলো। মনের আড়ালেই কখন ভাল লাগার বীজ বপন করে বসে আছি বুজতেই পারিনি। পরপর তিনদিন ওর কোন মেসেজ না পেয়ে কেমন যেন অস্থির লাগছিল।

পরদিন ভার্সিটিতে মনে মনে ওকে খুজতে থাকলাম। হঠাৎ দেখি সিমির খুব কাছাকাছি বসে ওকে গান শোনাচ্ছে। বুকের ভেতর চেপে থাকা আগুনটা যেন এবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। কিছু চিন্তা না করেই সবার সামনে বলে দিলাম ওকে ভালবাসার কথা। সাথে সাথে একটা মুচকি হাসি দিয়ে পেছন থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে দিল। খানিকটা অবাক হলাম। পরে জানতে পারলাম মেসেজ না করা, আমাকে জেলাস করা, পুরোটাই সাজানো ছিল। আর তার প্রধান হাতিয়ার ছিল আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী সিমি। চোখের জলটা থামাতে পারলাম না। সবার সামনেই কেদে দিলাম। একটা কান্না মানুষকে এতটা সুখ দিতে পারে জীবনে প্রথম অনুভব করলাম। শুরু হল ভালবাসার আকাশে কষ্ট সুখের সাত রঙ মিশিয়ে একি স্বপ্ন দুটি হৃদয় দিয়ে আঁকা। ও আমাকে সুখ পাখি বলে ডাকে। ওর পাগলামি গুলা যেন একি সাথে আমকে কাদাই আবার হাসাই। অদ্ভুত একটা অনুভুতি। আমকে নিয়ে ওর গান।

স্বপ্নের ভেলায় চড়ে তারার দেশে যাওয়া। হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজা। মাঝ রাতে আমকে দেখার নাম করে আমার বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে থাকা। ক্লাস ফাকি দিয়ে মুভি দেখতে যাওয়া। একই স্বপ্ন হাজার বার ভেঙ্গে নতুন করে গড়া। সব কিছু মিলিয়ে যেন আমার একটা পৃথিবী সুখের স্বর্গ ও। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। ওর বি.বি.এ শেষ হল আর আমি ৪র্থ বর্ষে উঠলাম। যে ভয়টা বুকের ভেতর সব সময় কাজ করত সেটাই হল। আমার আর নাহিদ এর সম্পর্কের কথাটা বাসাই জানা জানি হয়ে গেল।

আব্বু আম্মুর ইচ্ছের বাইরে আপু পালিয়ে গিয়ে তার ক্লাস-মেট সোহেল ভাইয়াকে বিয়ে করেছিল। ওদের ৪বছর এর রিলেশন বিয়ের এক বছরের মাথাই ছাড়াছাড়ি। এ ব্যাপারটাই যেন আমার স্বাধীনতার একমাত্র ঘাতক। সাময়িক ভাবে আমার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ। ফোনটাও আব্বুর কাছে। এক কথায় বন্দি আমি। আপুর ব্যাপারটার পর আব্বু অনেক অসুস্থ হয়ে পরেছিল এখনো সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আব্বুর ইচ্ছের বাইরে কিছু বলা মানে তাকে মৃত্যুর পথে একধাপ এগিয়ে নেয়া। কিছুই বলতে পারলাম না। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক করলো আব্বুর ব্যবসায়ী বন্ধু রাজ্জাক আঙ্কেলের ছেলে সুমন এর সাথে। নিঃশব্দে কাদা ছাড়া কিছুই যেন করার নেই আমার।

এদিকে নাহিদ পাগল এর মত চেষ্টা করছে আমার সাথে যোগাযোগ করার। কোন উপায় না পেয়ে সিমিকে আমার বাসায় পাঠালো খোজ নেবার জন্য। মানুষটা আমাকে অন্ধের মত ভালবাসে। এত বড় অন্যায় কি করে করবো আমি। কি করে কাদাবো এই মানুষটাকে। ঠিক করলাম পালিয়ে যাব। সবাইকে ফাকি দিয়ে অনেক কষ্ট করে বাসা থেকে বেরও হলাম। কিন্তু আপুর চলে যাওয়ার পর আব্বু আম্মুর কষ্ট লজ্জা সব কিছুর ছবিটা চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠলো। পারলাম না। একটা ফোন ফ্যাক্স এর দোকান থেকে কাদতে কাদতে নাহিদ কে সরি বলে অর্ধেক রাস্তা থেকেই আবার বাসাই ফিরে আসলাম। এসে দেখি প্রত্যাশা অনুরূপ বাসার সবাই চুপচাপ বসে আছে। যে আব্বু আমকে কোন দিন ধমক দিয়ে কথা বলিনি সে আব্বু আমার গায়ে হাত তুললো। সারা রাত কাদলাম। কান্নাই যেন একমাত্র সঙ্গী এখন। না পারছি আব্বু আম্মুকে কষ্ট দিতে না পারছি নাহিদকে কাদাতে।

পরদিন সকালে রাজ্জাক আঙ্কেল এর একটা ফোন আমার জীবনটাতে একই সাথে মুক্তি আর পঙ্গুত্ব দান করলো। ডাক্তার এর মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী আমি কোনদিন মা হতে পারবো না। বিয়েটা ভেঙ্গে গেল। কাঁদবো না মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলব বুজতে পারলাম না। শুধু স্থব্দ হয়ে থাকলাম। নাহিদ এর সামনে দাঁড়ানোর মত মুখ আমার নেই। সিমির মাধ্যমে ও সব কিছু জানলো। আর সব জেনে শুনেই ওর আব্বুকে দিয়ে আবারও বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল আমার বাসাই। প্রথম বার ফিরিয়ে দিলেও এবার আর পারল না। কারণটা সহজ। আব্বু আম্মু স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা লজ্জিত হয়ে নাহিদ এর এক আকাশ সমান ভালবাসার কাছে হার মানল। পাওয়া না পাওয়াই আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের আর সুখের দিন এটা।

পরদিন নাহিদ এর অনুরোধেই আব্বু আম্মুর অনুমতি নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গেলাম । কথা বলার শক্তিটা যেন হারিয়ে ফেলছি। কাপতে কাপতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও কাছে এসে আমার হাত ধরে বলল- আমি শুধু তোমাকে চাই হেনা আমার আর কিচ্ছু দরকার নেই বিশ্বাস করো আমার শুধু তোমাকে হলেই চলবে। বল আমকে আর কখনো ছেড়ে যাবা নাতো ?উত্তরে কিছুই বলতে পারলাম না। বুক ফেটে কান্না এলো। ওর এই সীমাহীন ভালবাসার কাছে আমি খুবি নগণ্য। কোথাই রাখবো ওর এতোটা ভালবাসা। কি দিয়ে শোধ করবো আমি। সুখের কান্নাটা আর থামাতে পারলাম না। চোখের সামনে থাকা স্বর্গটার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাদলাম। ও হাত দিয়ে চোখের জ্বল টুকু মুছে দিল। ওকে হয়তো বাবা হবার সুখটা কোন দিনও আমি দিতে পারবো না। তবে আমার শেষ নিঃশ্বাসটা পর্যন্ত এক বিন্দু কষ্ট পেতে দিবো না ওকে। তাতে আমার মরন হলেও হাসতে হাসতে মেনে নেবো সেই মরণটাকে। আমি ভালবাসি নাহিদ। অনেক বেশি ভালবাসি তোমাকে। বাজে ছেলে!

(৫) ক্লাস এ ঢুকেই মিথিলার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কারন তখনো কেউই এসে পৌঁছায়নি। শুধুমাত্র রাতুল পিছনের টেবিলটাতে একা বসে আছে। এই ছেলেটাকে মিথিলা একদমই পছন্দ করে না। ক্লাসের সবচেয়ে অমনোযোগী , বাজে ছাত্র হিসেবেই রাতুল পরিচিত । আর দেখতেও কেমন জানি অগোছালো। মাথার চুলগুলো উসকো-খুসকো । পরনের কাপড় গুলোও অপরিষ্কার । মিথিলাকে দেখলেই ছেলেটা কেমন জানি হা করে তাকিয়ে থাকে । এই কারনে ছেলেটাকে মিথিলার আরও বেশি অপছন্দ ।

বিকেলবেলা মিথিলা তার বান্ধবী লগ্নের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে জানতে পারলো যে তাদের ক্লাসের রাতুল , সুজয়ের কাছে মার খেয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। মিথিলা , সুজয়কে খুব ভাল করেই চেনে । আগে প্রায়ই রাস্তায় মিথিলাকে বিরক্ত করতো । বখাটে ছেলেরা তো মারামারি করবেই , এটাই তো স্বাভাবিক । তাই , রাতুলের মাথা ফাটানোর ব্যাপারটা মিথিলার মনে একটুও ছেদ ফেলল না । মিথিলা মন খারাপ করে কলেজের বারান্দায় দাড়িয়ে আছে । আজকে ওর পরীক্ষাটা খুবই খারাপ হয়েছে । পাশ করতে পারবে বলে মনে হয় না । এত চিন্তার কারন ছিল না যদি এটা নির্বাচনী পরীক্ষা না হয়ে সাধারণ কোন পরীক্ষা হতো । কিন্তু , নির্বাচনী পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলে তো সে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারবে না । পরের দিন কলেজে গিয়ে মিথিলা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল । কারন, গত রাতে নাকি শর্ট-সার্কিট এ আগুন লেগে ওদের পরীক্ষার খাতা পুড়ে গেছে ।

তাই গতদিনের পরীক্ষাটা আবার অনুষ্ঠিত হবে । এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই মিথিলার ক্যান্সার ধরা পড়ল । ধীরে ধীরে রোগটা সারা দেহে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করল । কিন্তু , অপারেশন করতে যে পরিমাণ টাকা দরকার তা জোগাড় করাটা মিথিলার পরিবারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না । শেষ পর্যন্ত ধার-দেনা করে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা সংগ্রহ করে অপারেশন করা হল । আল্লাহের রহমতে এবং সবার দোয়ায় মিথিলা সুস্থ হয়ে উঠলো । সুস্থ হওয়ার কিছুদিন পরে মিথিলার কাছে একটা চিঠি আসে । চিঠিটা ছিল এইরকম : প্রিয় মিথিলা, কলেজে যে দিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সে দিন থেকেই তোমাকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি । কিন্তু, একটা বখাটে ছেলের ভালবাসাকে তুমি কোনদিনই মেনে নেবে না । তাই , ভেবেছিলাম লুকিয়ে যতটা ভালবাসা যায় ততটাই ভালবাসবো ।

সুজয় যে দিন লোক ভাড়া করে এনেছিল তোমাকে কিডন্যাপ করার জন্য , সে দিন ওদের সাথে মারামারি করেছিলাম শুধু তোমাকে বাঁচাবো বলে। লগ্নের কাছে জানতে পেরেছিলাম, তোমার নির্বাচনী পরীক্ষায় রসায়ন পরীক্ষাটা খুব খারাপ হয়েছিল । তাই, সে দিন রাতেই কলেজের অফিসে তালা ভেঙ্গে ঢুকে খাতা পুড়িয়ে দিয়েছিলাম শুধু তোমার মুখে একটু হাসি দেখব বলে। কিন্তু , দারোয়ানের কাছে ধরা পরে গিয়ে ছয় মাসের জেল হল। কলেজেরই ছাত্র কাজটা করেছে বলে ব্যাপারটা শর্ট-সার্কিট এ আগুন লেগেছে বলে চালিয়ে দেয়া হল। তাই আর এইচ.এস.সি পরীক্ষাটা দেয়া হল না। জেল থেকে বের হয়ে শুনলাম, তুমি ক্যান্সার এ আক্রান্ত।

টাকার অভাবে তোমার অপারেশন হচ্ছেনা জেনে কোন উপায় না দেখে নিজের কিডনি বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করলাম শুধু তোমায় ভালবাসি বলে । আজ আমি জীবনের শেষ পর্যায় এ এসে উপস্থিত হয়েছি । আমার অবশিষ্ট কিডনিটা অনেক আগে থেকেই নষ্ট ছিল ।এখন অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে । ডাক্তার বলেছে, আর খুব বেশি দিন বাঁচবো না । তাই মারা যাওয়ার আগে ভাবলাম ,সেই কথাটা বলে যাই । যে কথাটা আজো তোমায় বলতে পারিনি । আমি তোমাকে ভালবাসি মিথিলা । অনেক ভালবাসি । ভাল থেকো । ইতি, তোমাদের ক্লাসের সবচেয়ে বাজে ছেলে রাতুল মিথিলার চোখ দিয়ে পানি পড়তে পড়তে চিঠিটা ভিজে গেল…. অপ্রকাশিত ভালবাসা!

(৬) আমি জীবনে যে ভালবাসিনি এমন না, আমিও একদিন ভালবেসেছিলাম । অনেক ছোট থাকতে। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি । মোটামুটি দুষ্টুও ছিলাম বটে। দুষ্টামি করার সকল উপায় ভালভাবেই জানা ছিল আমার। স্কুল জুড়ে দুষ্টামিতে আমার নাম ছিল হিটলিস্টে। ক্লাস ফাকি আর স্কুল পালানো ছিল আমার খুব পছন্দের। তবে মেয়েদের ব্যাপারে ছিলাম খুবই ভদ্র। এই ধরনের দুষ্টামিতে যখন হচ্ছিলোনা, তখন বন্ধুরা বলল একটা প্রেম কর। তারপর তারা একটা মেয়েও পছন্দ করে দিল। দেখলাম মেয়েটা সত্তিই অনেক সুন্দর।বেশ লম্বা। মেয়েটাকে আমি আগেও অনেকবার দেখেছি, কিন্তু এভাবে কোনদিন ভাবিনি। সেদিন অনেক আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। দেখলাম সারাদিন শুধু মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছি। তখন থেকেই বুঝতে শুরু করলাম ভালবাসা কি।

সেদিন রাতে ঘুম একদমই হচ্ছিলনা। পরদিন স্কুলে গেলাম, আর তাকে দেখলাম নতুন করে। মনে হল শুধু এই স্কুলে না, সে যেন পৃথীবিতে সবার চেয়ে সুন্দর। সত্তিই ভালবেসে ফেললাম তাকে। স্কুলে সবসময় তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। তাকে দেখলে আমার বুকে অন্যরকম একটা অনুভুতির সৃষ্টি হতো। নিজের অজান্তেই আমার মুখের কোনে অদ্ভুত একটা হাসি খেলে যেত। খুব ইচ্ছা হতো তাকে আলতো করে একটু ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু তার মুখোমুখি হলে তার চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না, মাথা নিচু করে ফেলতাম। আমার মনে আছে সেদিন থেকে আমি আর একদিনও স্কুল কামাই করিনি। তখন মনে হতো শুক্রবারেও ক্লাস হলে খুব ভাল হতো। দুষ্টামি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। দুষ্টামিতে হিটলিস্টে থাকা ছেলেটি হটাৎ এত ভদ্র হয়ে গেলো এটা নজর এড়ালনা কারোরই, এড়ালনা তারও। ভালবাসার কথা সরাসরি বলতে পারলাম না তাকে, অবশ্য আমার অবস্তা দেখে তার একবিন্দুও বুঝতে বাকি ছিলনা, সে বাপারে আমি ছিলাম নিশ্চিত। ব্যাপারটা বললাম ওর এক বান্ধবীর কাছে, যে আমাদের এলাকাই থাকে। ও শুনে হাসল আর বলল সাকিলা সব জানে।

সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম আমি। ও দুঃখিত, মেয়েটার নাম সাকিলা। যেহেতু তখন মোবাইলের এত প্রচলন ছিলনা সেহেতু আমাদের ভেতর কথা আদান-প্রদান করে দিত তার ওই বান্ধবী। এভাবে কেটে গেল কিছুদিন, হঠাৎ দেখলাম সে একদিন স্কুলে আসতে দেরি করছে,, ভাবলাম ওতো দেরি করে স্কুলে আসেনা। ওর বাসাটা ছিল স্কুলের পাশেই, চলে গেলাম ওদের বাসার পাশে। ওখানে দেখা হল আমার এক বন্ধুর সাথে, জিজ্ঞেস করলাম শাকিলা দের বাসা কোনটা রে। যে বাসার পাশে দাড়িয়ে ছিলাম আমি জানতাম না ওটাই সাকিলাদের বাসা। সাকিলা জানালা দিয়ে বলল দাড়াও আমি আজ স্যারের সাথে সব বলে দেব। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম কারন আমার আব্বুই স্কুলের হেডমাস্টার । ও যখন স্কুলে আসলো তখন তো ভয়ে আমার অবস্তা খারাপ।

আমার অবস্থা দেখে ও হেসে ফেলেছিল সেদিন। কিন্তু ও কিছুই বলল না । আমাদের ব্যপারটা স্কুলে তখনও আমার বন্ধুদের ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু জীবনের প্রথম প্রেম তাই নিজেকে আমি আর বেশিদিন কন্ট্রোল রাখতে পারলাম না, সবাইরে বলে বেড়াতাম। কেন জানি খুব আনন্দ লাগত সবাইকে বলতে। কেউ যদি ওর প্রশংসা করত, ওকে সুন্দর বলতো, তাহলে আমার খুব আনন্দ লাগত। অল্প কিছুদিনের মধ্যে জেনে গেল স্কুলের সমস্ত স্যার ম্যাডাম আর ছাত্ররা। আমার ছোট বোনও ওকে খুব পছন্দ করত, একদিন ভাবি বলেও ডেকেছিল। অনেক ভালবাসতাম তাকে, শুধুই বাসতাম না এখনও ভালবাসি আগের মত অনেক অনেক ভালবাসি। ওকে নিয়ে কবিতা লিখতে যেয়ে আব্বুর হাতে ধরাপড়ে মার খেয়েছি একদিন। একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার সাথে ওর সরাসরি এর মধ্যে একটা কথাও বলা হয়নি। দেওয়া হয়নি ১৪ ফেব্রুয়ারিতে একটা ভালবাসার লাল গোলাপ। কখনো সামনে দাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলতে পারিনি সাকিলা আমি তোমাকে আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসি।

আমার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন এখন তোমাকে নিয়ে ঘর বাধা। তবু জানতাম ও আমাকে ভালবাসে। এভাবে ওকে ভালবেসে আমার প্রতিটা দিন সপ্নের মতই সুন্দর কাটছিল। কিন্তু ভালবাসা সবার জন্য না এই সত্যটা প্রমানিত করার জন্য বাস্তবতা আমার এতদিনের সাজানো সপ্নকে এক রাত্রেই ভেঙ্গে দিল। আমাকে করে দিল খুব একা । প্রতি বৃহস্পতিবারের মত কোন এক বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে ফেরার সময় হলো মন খারাপ যে তাকে একটা দিন দেখতে পারবনা। শনিবার স্কুলে গেলে কিছু মেয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো সাকিলা বিয়ে করলো আমাদের একটু জানালও না। আমি শুনে অস্তির হয়ে গেলাম। কি করব ভাবতে পারলাম না।

পরে যখন জানতে পারলাম এটা সত্যি !!!!!!! তখন মনে হল আমি অনেক চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছিনা। ঠিক ঐদিনই খেয়েছিলাম জীবনের প্রথম সিগারেট। তারপর এমনও সময় গেছে একটানা ৪-৫ দিন সূর্যের আলো দেখিনি। একাকী একটা ঘরে তাকে নিয়ে আমার লিখা কবিতা গুলো পড়তাম। কারও সাথে মিশতাম না, সবসময় একা থাকতাম। অবশ্য এর জন্য তার কোন দোষ নেই।

ওইদিন তার ফুফুকে দেখতে এসে তাকে পছন্দ করে ফেলে বরপক্ষ। ঘটনাক্রমে তার আব্বুও রাজি হয়ে যাই। শুনেছি সে নাকি অনেক কেঁদেছিল ওইদিন, কিন্তু কেও শোনেনি তার ওই কান্না। অবশ্য প্রতিবেশীরা অনেক বুঝিয়েছিল তার আব্বুকে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। শুনেছিলাম ছেলেটা খুব ভাল পরিবারের এবং ভাল একটা চাকরী করে। তায়ই হয়তো সুযোগটা হাতছাড়া করেনি। তবে ও ঠিকই ভালবেসেছিল আমাকে। ওর বিয়ের তিনদিন পর আমাকে অবাক করেদিয়ে ও স্কুলে এসে আমাকে ডেকে পাঠাল একটা ক্লাস রুমে, আমি যেয়ে দেখি শুধু ও আর ওর বান্ধবী। আমরা তিনজনই চুপকরে আছি, হঠাৎ ও বলল আমি একেবারে চলেএসেছি আমাকে বিয়ে করতে পারবে???

আমি এই কথাটার কোন সঠিক উত্তর খুজে পেলাম না। নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম না। নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই চমকে উঠেছিলাম সেদিন। যাকে এত ভালবাসি তাকে এভাবে ফিরিয়ে দিলাম!!!!!!!! না কথাটা বলেই মাথাটা নিচু করে নিয়েছিলাম। একদিকে আমার চোখের জল যেন না দেখতে পায়, আর তার সামনে মাথা উঁচু করার মত সাহস সেদিন আমার ছিলনা, তাই সেদিন আমার না শুনে তার মুখের অবস্থা কেমন হয়েছিলো সেটা দেখতে পারিনি। জানিনা সেদিন সে আমাকে ভুলবুঝেছিল কিনা???? তবে তাকে সেদিন না বলার কারন, তার আগে এক যাইগায় বিয়ে হওয়াটা না। তখন আমি সবেমাত্র নাইনে পড়তাম, তখন আমি যদি তার কথায় রাজি হয়ে তাকে কথা দিতাম, আর যদি সে আমার দেওয়া কথাতে বুক বেধে আমার জন্য অপেক্ষা করত, তখন ওটা আরও খারাপ হতো। হয়তো আমার ছোটবেলাই না বুঝে দেওয়া কথাটার কোন মূল্য দিতনা এই সমাজ, আমার পরিবার।

তারপর সে আর ফিরে যায়না তার স্বামীর কাছে। আমাদের স্কুলেই আবার পড়ালেখা করতে থাকে। দেখতে দেখতে কেটেযাই আরও অনেকদিন। প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্তেও লজ্জায় আর আগের মতোকরে তাকাতে পারিনি তার ওই সুন্দর মুখটির দিকে। যে মুখের দিকে তাকালে একদিন আমার হৃদয় ভরে যেত। তারপর থেকে লুকিয়ে সেই মুখের দিকে তাকালে কষ্টে হৃদয়টা বের হয়ে আসতো, অদ্ভুত হাসির বদলে লাল হয়ে যেত দুই চোখ।

বিষয়টা এখানেই থেমে থাকেনি। যেহেতু আমার আব্বু ছিল হেডমাস্টার সেহেতু আমার জন্যই তাকে স্কুলটা ছেড়ে পাশের একটা স্কুলে ভর্তি হতে হয়। তারপর থেকে আর কোন মেয়ের এমনকি কোন ছেলের সাথে আর বন্ধুত্ব করিনি। একা থাকতে পছন্দ করতাম একা একা ঘুরতাম। কারো সাথে মিশতাম না। অধিকাংশ সময় একা বিছানাই শুয়ে তারে নিয়ে লিখা কবিতা গুলো পড়তাম। আমার রুমে আর কাওকে ঢুকতে দিতাম না। মাধ্যমিক পাশ করে একটা কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে শিরিন নামের একটা মেয়েকে ভাললাগলো, কিন্তু ভালবাসতে ভয় পেতাম।

অল্পকিছুদিনের মধ্যে মেয়েটা বুঝেগেল ব্যপারটা। হলো বন্ধুত্ত তারপর ভালবাসা। কিন্তু সাকিলার জাইগাটা অন্যকেও দখল করবে এটা মেনেনিতে পারিনি আমি। অবশ্য শিরিন আমাদের ভালবাসাটা গড়াতে গড়াতে অনেকদূর নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি কোনদিনই তাকে সাকিলার যাইগায় বসাতে পারিনি। নিজের হাতে নষ্ট করেছি আরেকটি ভালবাসা। এখন অবশ্য নিজেকে অনেকটা কন্ট্রোল করতে শিখেছি। নতুন করে কষ্ট পাওয়ার ভয়ে আর কোনদিন কাওকে ভালবাসতে পারিনি। তবুও এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমাকে ভুল বুঝে ভুলে যেওনা সাকিলা, আমি এখনও তোমাকে আগের মত ভালবাসি।

পাঁচ বছর পর হটৎ দুইমাস আগে দেখা হয়ে গিয়েছিল ওর সাথে, কথাও হয়েছিল কয়েকটা। বুঝলাম এখনও ভালবাসে আমায়। কিন্তু কতটা সেটা বুঝার মত ক্ষমতা আমার মত অপরাধীর নেই। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো তখন। আমি সত্যিই অপরাধী, তা নাহলে এমন একটা নিস্পাপ ভালবাসা থাকতে অন্যকোথাও সম্পর্ক করি কিভাবে। আমাকে ক্ষমা করে দিও সাকিলা। ভাল থেকো।।। আর জেনে রেখ আমি এখনও তোমাকে সেই নাইনে পড়া তাসিন এর মতই ভালবাসি। সে পরে বিয়ে করেছে কিনা???? না সে এখনও বিয়ে করেনি। ও ২০১৩ তে উচ্চমাধ্যমিক দেবে।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত