১) প্রকান্ড একটা থাবা সুপ্তির পিঠ বরাবর নেমে আসছে। সে প্রবল বেগে চোখ বন্ধ করে দাঁত কামড়ে শক্ত হয়ে বসলো। মুহুর্তের মধ্যে তার পিঠটা যেনো ঝলসে গেলো! আগুনের হলকার মতো জ্বলতে লাগলো তার পিঠে। কাঁদবেনা কাঁদবেনা করেও হাউমাউ করে সাড়ে ৪ বছর বয়েসী সুপ্তি নারকীয় কান্না জুড়ে দিলো। কান্না দেখে তার মা আরও দাঁতমুখ খিচিয়ে তাকে বকতে আরম্ভ করলো।
– শুওরের বাচ্চা! আর কতো জ্বালাবি আমাকে? তোর বাপ তোকে না নিয়ে আমার কাধে ফেলে গেলো কেনো? এতো মারি, মরিস না ক্যান!
– আম্মু ! আম্মু, অনেক ব্যাথা !
– শুওরের বাচ্চা, ঢং করিস? আর একটাবার কাঁদলে বাথরুমে লাইট অফ করে দরজা বন্ধ করে রাখবো! চুপ কর হারামজাদী! সুপ্তি দৌড়ে রিমা খালার কাছে যায়। সে খুব চেষ্টা করেও কান্না আটকিয়ে রাখতে পারছেনা। তার বুক যেনো ফেঁটে যাবে! রিমা খালা তাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় হাঁটতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে সুপ্তি ঘুমিয়ে গেলো। সুপ্তি আর সুপ্তির আম্মু এক রুম ভাড়া নিয়ে রিমা খালাদের সাথে থাকে। রিমা খালা তাকে প্রচন্ড আদর করে। আম্মু যখনই গায়ে হাত তুলে কিংবা চোখ লাল করে ডাকাত সর্দারনির মতো করে গালাগালি করে, তখন সে রিমা খালামনির কাছে এসে ঘুমিয়ে পরে।
২) তখন সবেমাত্র চন্দ্র ইডেনে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছে। চারিদিকে যতদুর চোখ যায়, গাদা গাদা মেয়ে ! হলে মেয়ে, ক্যান্টিনে মেয়ে, পুকুরপাড়ে মেয়ে! জগতজোড়া শুধু মেয়ে আর মেয়ে ! একটাসময় মুড়ি যেমন নেতিয়ে যায়, চন্দ্রও নেতিয়ে গেলো। মুড়ির সাথে চন্দ্রর অবশ্য একটা পার্থক্য আছে! মুড়ি একবার নেতিয়ে গেলে ওভেনে দিলেও আর কুড়মুড়ে হয়না। কিন্তু এমন কিছু একটা ঘটলো এবং চন্দ্র শুধু কুড়মুড়েই না, মুড়মুড়ে, চুড়চুড়ে এবং ঝুড়ঝুড়েও হয়ে গেলো ! চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো, তার চোখের সামনে অতি রুপবান এক পুরুষ দাঁড়িয়ে! আগের ক্লাসের ঘুম তাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চোখ মেলে তাকালো সে!
কী অপরূপ ভঙ্গীতে কবিতাবৃত্তি করছে! কি অদ্ভুত সুন্দর কন্ঠস্বর! “রবার্ট ব্রাউনের মনের কষ্ট ছিলো একটাই। সে তার স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবেসে কিছু উপহার দিতে চেয়েছিলেন। দান্তে যেমন তার প্রেমিকাকে বিমুর্ত ভালোবাসাময় ছবি এঁকে দিয়েছিলেন তেমনি তিনিও তার স্ত্রীকে দিতে চেয়েছিলেন কোনো এক অভুতপুর্ব উপহার। কিন্তু, তিনি বিমর্ষ, কারণ তিনি তো একজন কবি! হাজার চেষ্টা করেও তিনি মুর্ত কোনো চিত্র-কলা তার স্ত্রীকে উপহার দিতে পারবেন না। তিনি পারবেন কিছু চ্ছত্র উপহার দিতে।
তিনি তখুনি লিখলেন, This of verse alone, one life allows me; Verse and nothing else have I to give you. Other heights in other lives, God willing: All the gifts from all the heights, your own, love. চন্দ্র “হা” করে স্যারের কথা গিলছে। এরকম একটা মানুষ যদি পার্কে গাছের নীচে বসে কোলে মাথা রেখে কবিতা শোনাতো, খুব কি ক্ষতি হতো?
সে তো মেয়ে লক্ষ্মী, এরকম চমৎকার একটা মানুষকে জীবনসঙ্গী পাবার অধিকার নিশ্চয়ই তার আছে! মনে মনে ঐদিনই সে “মামুন” নামের সেই সুদর্শন পুরুষের চোখে মুখে সহস্রাধিক চুমু নামক সিল এঁটে দিয়েছে। বেশ কিছু টাকা খাইয়ে বান্ধবীদেরকে মামুন স্যারের কাছে ব্যাচে পড়তে রিকোয়েস্ট করবার জন্য সে রাজী করালো। এরপর আর কী! ব্যাচে পড়া, স্যারের নাম্বার নেয়া। তবে স্যার লোক ভালো, প্রথম দুই সপ্তাহ সে বুঝতেই পারেনি যে চন্দ্র আসলে পড়া বোঝার জন্য ফোন দেইনি! দশ-বারো মিনিট কথা বলেই স্যার ফোন রেখে দিতেন, তার নাকি বেশীক্ষন ফোনে কথা বললে মাথা ধরে। কেমন গ্রাম্য কথা! কয়েক মাসের মধ্যেই চন্দ্র টের পেলো কলেজের নিদেন পক্ষে অর্ধশত ছাত্রী শয়নে স্বপনে শুধু মামুন স্যারকে দেখতে পায়। তাদের এই স্বপ্ন চন্দ্রের দুঃস্বপ্নে পরিনত হলো। একদিন সাহস করে দেখা করার জন্য বললো চন্দ্র।
– স্যার, আমি চন্দ্র। – কেমন আছো মিস মুন?
– জ্বী ভালো। স্যার, আমি একটু ঝামেলায় পরেছি, আপনি কি আধা ঘন্টার মধ্যে রবীন্দ্র সরোবরে আসতে পারবেন?
– মনে হয় পারবো! আজকে আর ক্লাস নেই। তুমি কি ওখানেই আছো? তাহলে আমি আসছি।
– আমি আছি। আপনি আসুন। হালকা শীতের মধ্যেও চন্দ্র ব্যাপকভাবে ঘামাচ্ছে। একটা ডাব শেষ করে আরেকটা ডাবে একটু পর পর স্ট্র লাগিয়ে চুমুক দিচ্ছে। সেই চুমুকে চুক-চুক করে শব্দ হচ্ছে।
– কি ব্যাপার মিস মুন? এতো টেনশন করছো কেনো? সামনে টার্ম পরীক্ষা নিয়ে? চন্দ্র কেমন একটা যেনো হাসি দিলো! চোখ দুটো অসহায়, ঠোঁট দুটো একটু নীচের দিকে। হাসি না বলে এটাকে “চিসি” বলা যায়। হা করে হাসলে হাসি আর চিমসিয়ে হাসলে চিসি!
– স্যার, আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।
– বলে ফেলো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি কামড়াইনা! হা হা হা ! কৌতুক শুনে চন্দ্র ভড়কিয়ে গেলো! যা বলবে বলে ভেবেছিলো, তাও ভুলে গেলো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো, ঠোটের উপরেও কিছুটা ঘাম জমে গিয়েছে। টিস্যু দিয়ে সে ঘাম মুছতে লাগলো। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসতে লাগলো।
যা হবার হবে ভেবে সে চোখ বন্ধ করে স্যারের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে লাগলো – My love is as a fever, longing still For that which longer nurseth the disease, Feeding on that which doth preserve the ill, Th’ uncertain sickly appetite to please. My reason, the physician to my love, Angry that his prescriptions are not kept, Hath left me, and I desperate now approve Desire is death, which physic did except. Past cure I am, now reason is past care, And frantic-mad with evermore unrest; My thoughts and my discourse as mad men’s are, At random from the truth vainly expressed. For I have sworn thee fair, and thought thee bright, Who art as black as hell, as dark as night. চন্দ্র ভয়ে কাঁপছে, সে চোখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা। যদি চোখ খুলে দেখে মানুষটা নেই? সে কি করবে তাহলে? কে যেনো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখে মামুন স্যার হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন।
– কবিতাটা কার, বলতে পারও?
– মনে হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের।
– হুম, উনার ১৪৭ তম সনেট এটি। খুব চমৎকার, সময় পেলে এটার অর্থটা বুঝিয়ে দেবো। এখন যাই, পড়াশুনা করো ঠিক মতোন, কেমন? চন্দ্র’র সব কেমন যেনো আউলে যায়! শুন্য দৃষ্টিতে দেখে স্যার চলে যাচ্ছেন! তার খুব ইচ্ছে করে খামচে তাকে ধরে রাখতে, সে পারেনা। পা দুটো অবশ হয়ে আসে তার। সে বসে পরে। নিজেকে খুবি অসহায় মনে হতে থাকে তার। মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কতোক্ষন কেঁদেছে মনে নেই, সে শুনতে পায় কে যেনো কবিতা পড়ছে
– এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন! বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা- দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি, কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটি স্নিগ্ধ রাত? সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি, সহজে ভুলিনা কিছু- না-বলা কথায় তন্ত্রে তনুতে পুড়ি, যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি। ( রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ) চন্দ্র স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। মামুন তার গালে হাত দিয়ে বললো, “শুধু ইংরেজী কবিতা জানলেই কি হবে? বাংলায় কি কবিতা নেই নাকি? বোকা মেয়ে, আসো চোখটা মুছে দেই। ”
৩) প্রতিদিন রাতে এই সময় বাইরে দুইটা কুকুর তুমুল ঝগড়া করে। সুপ্তি খুবই ভয় পায়! পাশেই আম্মু শুয়ে আছে, কিন্তু আম্মুকে জড়িয়ে ধরতেও ভয় পায়। আম্মু যদি বকা দেয়। সে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষন পরে সে অনুভব করে তার আম্মু তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। তারও খুব কান্না পেতে লাগলো, কিন্তু সে কাঁদলোনা। তার এখন ৫ বছর বয়স প্রায়, সে যথেষ্ট বড় হয়েছে। আর বড় বাচ্চাদের কান্না করা মানা, রিমা খালামনি বলেছে। সে খুব করে আম্মু’র আদর নিতে লাগলো।
৪) ২ মাসের মাথায় চন্দ্র আর মামুন বিশাল ঘটা করে বিয়ে করে ফেললো। বিয়ে নিয়েও একটা কাহিনী হতে হতেও হয়নি। চন্দ্র’র বাবা-মা’র খুবি টেনশন, মাস্টার মানুষ বিয়ের পরে চন্দ্র অবাক হতে হতে একসময় অবাক হওয়া ব্যাপারটা পানশে হয়ে গেলো! একটা মানুষের মাথায় কতো হাজার কবিতা থাকতে পারে! বিয়ের পরে প্রতিটা দিন রাতে একটা করে নতুন কবিতা, বাংলা-ইংরেজী যে কোনো ধরণের কবিতা! মামুন তাকে খুব সুন্দর একটা নাম দিলো, “চন্দ্ররানী” !
১ বছরের মাথায় এক ঐতিহাসিক শুক্রবারে পৃথিবীর বুকে সদর্পে চিৎকার দিয়ে উপস্থিতি জানান দেয় এক শিশু, তার নাম সুপ্তি। রান্না-বান্না, সুপ্তিকে সামলানো আবার ক্লাস করা – ৩ মিলিয়ে চন্দ্রর অবস্থা বেগতিক প্রায়। তবুও কোথায় যেনো একটা তৃপ্তি লুকিয়ে আছে। ভালোই লাগে তার। এদিকে মামুনও মেয়ের টানে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে পরে, ঘরের কাজ-টাজ ও করে। এক কথায়, সুপ্তি এসে যেনো ওদের জীবনটাকে অনেকখানি রাঙ্গিয়ে দিলো। সুপ্তির বয়স প্রায় দেড় বছর। আধো আধো কথা বলা শিখছে। তার বাবা তাকে বিভিন্ন উপায়ে ভাষা শিক্ষা দেবার প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে্ খুব একটা লাভ হচ্ছেনা।
– চন্দ্ররানী !
– কি বল!
– তোমার মেয়ে তো মা ঠিকই বলে। বাবা বলেনা কেনো, কাহিনী কি?
– মেয়ে তো আর তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট হয়নি, হয়েছে আমার মতো গাধী। এই জন্য! এইটুকুন বাচ্চা যে মাম, মা আরও হাবিজাবি বলতে পারে, এটাই তো বেশী!
– কথা সত্য! রাগ হচ্ছো কেনো চন্দ্ররানী! এদিকে এসো, কানে কানে একটা কথা বলি! চন্দ্র এগিয়ে গেলো, মামুন কানে কানে বললো, “I’m Romeo, will you be Juliet? We can share a bond we’ll never forget” বলে গালে একটা চুমু খেলো। চন্দ্র আলগা রাগ দেখিয়ে চলে যেতে লাগলো। “চন্দ্ররানী আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?” মামুন চন্দ্রকে ডাক দিলো। চন্দ্র পানি এনে দেখে সুপ্তি তার বাবার কলার ধরে টানছে আর আধো আধো বুলিতে “বাওয়া বাওয়া” বলে ডাকছে। চন্দ্র’র হাত থেকে গ্লাস পরে গেলো। সে আড়ষ্ট পায়ে ছুটে গেলো মামুনের কাছে। মামুন বেঁচে নেই।
৫) – সুপ্তিসোনা – উ !
– তোমার বাবা কোথায় তুমি কি জানো ?
– (সুপ্তি প্রবল বেগে এদিক ওদিক মাথা নাড়ায়)
– বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করেনা?
– কলে তো!
– আম্মুকে বলোনা কেনো বাবা এনে দিতে?
– আম্মু আমাকে উননেক মালবে! আম্মু অনেক লাগ! চন্দ্র অফিসে যাবার আগে সুপ্তিকে রিমির কাছে রেখে যায়। রিমি আর সুপ্তি মিলে কতো যে গল্প করে! সুপ্তি রিমি খালামনিকে খুবি ভালোবাসে। তার বিপদ-আপদের বন্ধু রিমি খালামনি! মামুন মারা যাবার পরে প্রচন্ড ভেঙ্গে পরে চন্দ্র। মানষিকভাবেও অসুস্থ্য হয়ে পরে। এভাবে হঠাত করে স্ট্রোক করে মামুনের মৃত্যু সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলোনা। এইটুকুন বাচ্চা নিয়ে সে উঠেছিলো তার মার বাসায়। সেখানে ভাইদের যাচ্ছে তাই ব্যবহারে শেষে একটা চাকুরী যোগার করে অফিসের পাশেই এক রুম ভাড়া নেয় সে। এর মধ্যে চন্দ্রকে শত শত বার বুঝিয়েছে রিমি, যে সুপ্তির একজন বাবা দরকার। চন্দ্র কোনো কথাই কানে নেয়না।
– চন্দ্র, আমি তো তোমার জন্য বলছিনা।
– ভাবী, আমাকে রুমটা ভাড়া দিয়ে আপনি অনেক উপকার করেছেন। এক্কেবারে খোদার কসম করে বলছি। কিন্তু এর মানে এই না, আমার সব কিছু ভাড়া নিয়েছেন। আমার জীবন আমি বুঝবো।
– মামুনকে ভালোবাসো, সেটা বুঝলাম। কিন্তু এটা কেমন ভালোবাসা? তোমার ভালোবাসার নিদর্শন সুপ্তি বাচ্চাটা কেনো তোমার জন্য কষ্ট পাবে? তার দোষটা কি? বলো?
– ভাবী, আমি মামুনের সাথে বেঈমানী করতে পারবোনা। চন্দ্র গটমট করে উঠে যায়। এভাবে বহুবার বৈঠকে বসা হয়েছে, বহুবার গটমট করে উঠেও গিয়েছে। মাঝে দিয়ে চন্দ্রের মেজাজ খারাপ থাকায় সুপ্তি বেচারী ইচ্ছে মতো মার খেয়েছে।
৬) চন্দ্র এসি’র দিকে তাকালো। এসি বন্ধ। এম.ডি স্যারের রুমে তাও শীত শীত করছে।
– চন্দ্র, ভালো আছেন?
– জ্বী, ভালো আছি স্যার।
– আপনি কি ভয় পাচ্ছেন বা টেনশন করছেন? প্লীজ, টেনশন করবেন না। আমি এমনি কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছি। বহুদিন ধরে এখানে কাজ করছি, সবার সাথে কথা-বার্তা হয়না। খোজ-খবর নেয়া হয়না, তাই ভাবলাম কথা-বার্তা বলি কিচ্ছুক্ষন।
– জ্বী, খুবি ভালো আইডিয়া স্যার।
– তো, আপনার মেয়ে কেমন আছে?
– সে ভালো আছে।
– স্কুলে যায়?
– না, আগামী বছর স্কুলে দিবো ভেবেছি। এখনও খুবি ছোটো, স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেনা।
– ওহ! এখনকার বাচ্চারা খুবি ফাস্ট, ঠিক হয়ে যাবে। তো চন্দ্র, লাঞ্চের ব্যবস্থা কি?
– আমি স্যার বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করি। বাসা পাশেই আমার।
– আজকে আপনি আর আমি একসাথে লাঞ্চ করবো। কিছু জরুরী কথাও আছে, সামনের ম্যাগাজিনের প্রজেক্টটা নিয়ে ডিস্কাস করতে চাই।
– জ্বী, আচ্ছা স্যার। আধো আলো আধো অন্ধকার একটা রেস্টুরেন্টে সাদাত আর চন্দ্র লাঞ্চ করছে। চন্দ্র সম্ভবত আঁচ করতে পারছে সাদাত সাহেবের ব্যাপারটা।
– চন্দ্র, তোমার স্বামী মারা গেছেন প্রায় বছর খানেক হয়, আমি যদ্দুর জানি।
– হুম – তো, আর বিয়ে টিয়ে করলেনা যে?
– না করাটা কি পাপ হয়েছে?
– আমি দুঃখিত। আমি আসলে, এভাবে বলতে চাইনি। আমি আসলে তোমার মেয়ে, সুপ্তির জন্য বলতে চেয়েছিলাম। – আমি সুপ্তির মা, আমি ভালো করেই জানি ওর কি দরকার আর কি দরকার নেই। ঠিক না স্যার?
– চন্দ্র, তুমি অযথাই রাগ হয়ে যাছো। কিছু কথা বলি, শুনো।
– বলুন।
– ছোটোবেলা থেকে আমি খুব মা ন্যাওটে। মা’র হাতে খাওয়া থেকে শুরু করে, গোসল করে মা’র কোলে ঘুমানো। মানে ২৪টা ঘন্টা মা। আমি যখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, তখনও আমার মা আমার পিঠ ডলে দিতেন। মা যা চেয়েছে, যেমন করে চেয়েছেন আমি সবসময় সেভাবেই চলার চেষ্টা করেছি। আজ আমি এতো বড় অফিসের এম.ডি, বিশ্বাস করো, আমার কোনো যোগ্যতা নেই! আমার মা না থাকলে জীবনেও এই পর্যন্ত আসতে পারতাম না। – আচ্ছা। – আমার মা মারা যান দু বছর আগে, তার ভাগ্য খারাপ তিনি ছেলের বৌ দেখে যেতে পারেন নি। তবে, আমি তার পছন্দ জানি। খুব ভালো করে। আমার মা’র পছন্দ ছিলো এমন বৌ যে কিনা আমাকে বুঝবে, সংসারের প্রতি টান থাকবে, আর সবাইকে অনেক ভালোবাসবে। আম্মার চাওয়া এইটুকুনই ছিলো।
– জ্বী। – বাকি কথা গুলো বলতে আমি খুবি বিব্রত বোধ করছি। আমি প্রায় ১৫মাস যাবত এই অফিসের ইনচার্জে আছি। শুরু থেকেই আমি তোমাকে লক্ষ্য করেছি। বিশ্বাস করো, আমি তোমার মধ্যে প্রতিটা জিনিস দেখেছি, যা আমার মা চেয়েছিলেন। আর সত্যি বলতে কি, আমার চাওয়াও ঐটুকুই!
– স্যার, আমি আজ উঠি? – চন্দ্র।
– ভালো থাকবেন স্যার।
৭) সুপ্তি এখন যে চকলেটটা খাচ্ছে সেটার নাম “ক্যাডবারি ফিঙ্গার্স”। ব্যাপক মজা। দুই হাত আর গাল চকলেটে মাখামাখি। চন্দ্রর মেজাজ এমনেই খারাপ, আরও খারাপ হয়ে গেলো! চটাশ করে এক চড় লাগিয়ে দিলো সুপ্তির গালে! সুপ্তি টলমল চোখে রিমা খালামনির কাছে চলে গেলো। তিনদিন অফিসে না যাওয়াতে সাদাত সাহেব নিজেই বাসায় এসে পরেছেন। এসেছেন ভালো কথা, শ’খানেক চকলেট এনেছে সুপ্তির জন্য। সুপ্তির সাথে সে কি খেলা! আর যাওয়ার নাম নেই! এখন তো সপ্তাহে দুই-তিনদিনই এসে পরেন। চন্দ্র’র চিন্তা এখন একটাই, একজন বিধবার কাছে একজন লোকের এভাবে আসা যাওয়া, এলাকার মানুষ দেখলে কি বলবে? রিমা ভাবীর ডাকে চন্দ্র’র চিন্তায় ছেদ পরলো।
– চন্দ্র – বলেন ভাবী।
– লোকটা কি তোমাকে পছন্দ করে?
– বাদ দেন তো ভাবী
– আমি কোনকালেই তোমার ভাবী ছিলাম না চন্দ্র। পারলে এরপর থেকে আর ভাবী না ডেকে বেটি বা অন্য কিছু ডেকো। ভাবী হলে আমার কথার কিছুটা হলেও দাম দিতে জীবনে।
– ভাবি, আমি দুঃখিত।
– লোকটা কি তোমাকে পছন্দ করে? বিয়ে করতে চায়?
– হ্যাঁ
– তোমার সমস্যা কোথায়?
– এটা কি বললেন ভাবি? আমি মামুনের স্ত্রী। টাকার লোভে আরেকজনের গলায় ঝুলে পরবো?
– চন্দ্র, মামুন বেঁচে নেই। যে মানুষটা নেই, তার জন্য কেনো সুপ্তিকে কষ্ট পেতে হবে? হয় সুপ্তিকে বাবা এনে দাও আর না হয় সুপ্তিকে ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও। ছোট্ট একটা বাচ্চা। না পেয়েছে বাবা, না পেয়েছে মা! সকাল-সন্ধ্যা অফিস করে আসো, ক্লান্ত হয়ে ঠিকমতো বাচ্চাটাকে কোলেও নিতে পারওনা। আদর করোনা। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। তোমার নিজের জীবনটা জটিল করেছো, ভালো করেছো। তাই বলে মেজাজ খারাপ হলে সুপ্তির গায়ে হাত তুলবে কেনো? এটা কোথাকার আইন?
– ভাবী আমাকে মাফ করেন। প্লীজ !
– তোমার যা মন চায় করো।
৮) চন্দ্র চাকরি আর বাসা দুটোই ছেড়ে দিয়েছে। ঢাকার শেষ মাথায় সে আর তার মেয়ে দিব্যি সুখে আছে। ভুল বললাম বোধ হয়, সুপ্তি দিব্যি সুখে আছে, চন্দ্র নয়। ছয় মাস হলো বাসা বদলিয়েছে, প্রতিটা দিন সাদাত সাহেব সন্ধ্যার পরে সুপ্তির জন্য এটা-ওটা নিয়ে আসেন। খুবি সস্তা উপায় মন গলানোর, কিন্তু চন্দ্রর মন গলেনা। মন না গললেও যে জিনিসটা ইদানিং সারাটাদিন গলে তা হলো মেঘ! কথা নাই বার্তা নাই, ধুম করে বৃষ্টি। তাও কেমন বৃষ্টি? এই বৃষ্টির কোনো মা-বাপ নেই। এটাকে Cats and Dogs না বলে Orphanage rain বললে ভালো মানাবে! চন্দ্র এদিকে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছে। সন্ধ্যার পরে স্কুলের ছেলে-মেয়েদের হোমওয়ার্কের খাতা নিয়ে বসেছে চেক করবার জন্য। এমন সময় দরজায় নক করার শব্দ শুনে সে কিছুটা চমকে গেলো। এই বৃষ্টির মধ্যে কে আসবে? সুপ্তি পাশেই খাতায় আকি-ঝুকি করছে পেন্সিল দিয়ে। অর্ধেক পেন্সিল তার হাতে, বাকি অর্ধেক পেটে ! চন্দ্র দরজা খুলে দাঁড়ায়, দেখে সাদাত সাহেব পুরাই কর্ক-সিক্ত তথা কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে! হাতে বিরাট এক ব্যাগ, যা কিনা অতি অবশ্যই সুপ্তির জন্য আনা খাবার দাবার!
– একটু বসি ভেতরে? বাইরে ঝুম বৃষ্টি! – আসুন।
– একটা টাওয়েল দিতে পারবে?
– পারবো। সাদাত সাহেব সোফায় বসেন। সুপ্তি এক দৌড়ে সাদাত সাহেবের কোলে। সাদাত সাহেব সুপ্তিকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন। – ধরুন, টাওয়েল। এই সুপ্তি, ছাড়ো উনাকে!
– থাকুক না।
– না, থাকা লাগবেনা। আপনি এইসব কেনো এনেছেন? আপনাকে কতোদিন নিষেধ করেছি আমি? মনে করে দেখুন তো! – চন্দ্র, আমি তো এগুলো সুপ্তির ……..
– আর একটা কথা বলবেন না। সুপ্তি আপনার কে? এতো দরদ দেখানোর কিছু নেই তো! সে এতিম না, তার মা আছে। আর দয়া করে আসবেন না। আমাদের মাফ করেন।
– চন্দ্র, তুমি কি আমাকে কোনোদিনই ভালো ….
– আপনি আসতে পারেন। রাত ৩টায় হঠাত চন্দ্রের ঘুম ভেঙ্গে যায়। খুব অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। চারিদিক কেমন নীলচে ধোয়াশায় পুর্ন। এর মধ্যে মামুন ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষীকিতে কেনা খয়েরী রাজশাহী সিল্কের পাঞ্জাবীটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে সে চন্দ্রকে ডাকছে। চন্দ্র ছুটে গেলো মামুনের কাছে। পরম ভালোবাসায় বুকে টেনে নেয় তাকে। উষ্ণ মমতায় আকড়ে ধরে রাখে তাকে। প্রশস্ত বুকে জায়গা খুজে নেয় সে।
– চন্দ্ররানী – বলো। – কবিতা শুনবে?
– হুম। গ্রীষ্মের উষর মরুর তপ্ত রোদের মতো ঝালাপালা রকমের ভালোবাসতে চাই। গাল বেয়ে গড়িয়ে পরা বর্ষার ঝমঝম বৃষ্টিরুপী প্রেমাম্বুর আমি আমাতে নিতে চাই, বড় ভালোবাসতে চাই। মাঘ মাসের শীতে নীল হয়ে যাওয়া ঠোট ফেঁটে বিন্দু কয়েক রক্তের ন্যায় ভালোবাসতে চাই। আর বসন্তের মিষ্টি বিকেলে পাগলাটে হাসি শুধু আমি দেখতে চাই শুধু ভালোবাসতে চাই। চন্দ্র স্বপ্নের মাঝেই যেনো সম্বিত ফিরে পায়, মামুনের কন্ঠ তো এমন না!
চন্দ্র উপরে তাকায়, সাথে সাথে যেনো ছিটকে দূরে সরে যায় সে! এটা তো মামুন নয়, সাদাত সাহেব! এইটুকু দেখেই সে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে যায়। প্রচন্ড পানির পিপাসা ধরে তার। সুপ্তিকে শুইয়ে রেখে সে উঠে বাইরের ঘরে আসে পানি খেতে। পানি খেতে খেতে হঠাত সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। চোখ বড় বড় হয়ে যায় চন্দ্রের!
সাদাত সাহেব এই তুমুল বৃষ্টিতে এখনও দাঁড়িয়ে সেই ব্যাগ হাতে। চন্দ্র আর নিজেকে সংবরন করতে পারলোনা, দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। এক ছুটে গিয়ে সাদাত সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। বৃষ্টির পানি সে অমুল্য একুয়াস হিউমারকে সযত্নে মুছে নিতে লাগলো।
– চন্দ্ররানী
– হুম
– তুমি মামুনকে ভালোবেসেছিলে, মামুনকেই ভালোবেসো। শুধু আমাকে একটু ভালোবাসতে দিও তোমাকে। আমার এইটুকুই চাওয়া। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে ভালোবাসলেই আমার ভালোবাসা পাওয়া হয়ে যাবে, বিশ্বাস করো! চন্দ্র বোবার মতো শুধু মাথা নাড়ে আর শক্ত করে সাদাতকে জড়িয়ে ধরে রাখে। মেঘের ওপাশে থাকা অস্তিত্ব যেনো বৃষ্টির বেগ আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিলেন। ভালোবাসার অম্বুরধারায় পুর্ন হোক এ সংসার।
সুপ্তি জানালার শিক ধরে তার খুব প্রিয় একটা কবিতা সুর করে গাইতে লাগলো – From that first meeting, who would believe Such a strong romance would start When we are together all I need Is in my arms, in my heart