১.
‘দোস্ত, তোর কি হয়েছে, এইভাবে পাগলের মতো হাটছিস কেন? মেইন সড়কের সাইড ধরে একা একা হেটে যাচ্ছে আরিদ। আমার ল্যাংটা কালের দোস্ত। কাছে গিয়ে ডাক দিলাম। আমি ডাক দেওয়াতে যেন ভূত দেখেছে
‘আরে পারভেজ তুই? কতকাল পরে দেখা। কোথায় থাকিস?
‘বাদদে আমার কথা, মরি নাই বেঁচে আছি এইতো বেশ। তোর খবর কি?
‘খবর আর তেমন কি? তোর মতোই। নীলা তো ডিভোর্স চাচ্ছে। আমি এত করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম বুঝলো তো নাই, উলটো আমিই পাগল, হেন তেন আরো কত কি বলল।
‘হালা, এই কয়দিনে বিয়েও করা হয়ে গেছে? আবার ডিভোর্সও?
‘হ দোস্ত, হাছা কইতাছি।
‘কেন, ডিভোর্সে কি মধু আছে? ডিভোর্স পেলেই মজা আর মজা?
‘কি জানি, মাস’খানেক আগে এক মাসের বেতনের টাকায় একটা এনড্রয়েড ফোন কিনে দিলাম। হের সপ্তাহ’খানেক পর থেকেই ওর মাঝে পরিবর্তন হতে থাকে। আগের মতো ভালো করে কথাও বলেনা। সবসময় ফেসবুকে থাকে। ইদানিং কার সাথে যেন রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে।
‘নীলার মনে হয় অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে।
‘ধ্যাত্তেরি, বাদদে ওর প্রতি আমার খুব বিশ্বাস আছে। এমনটা ও করবেনা।
‘এই তুই বাসায় যা, আমার বাস ছেড়ে দিবে। টিকেট কাটা রয়েছে।
‘আচ্ছা ঠিক আছে,
ওহ, একটা কথা, তুই বাড়ি যাবি কবে? কিভাবে জানি টপিকটা চেঞ্জ করলাম। কারণ যে মেয়ে নিজে থেকে ডিভোর্স চায়, সে মেয়ের উপর কিভাবে বিশ্বাস থাকে? আরিদ পাগলটার জন্যও একটু খারাপ লাগছে।
‘যেতে তো মন চায়, কিন্তু…
‘কি কিন্তু? নীলা?
‘না মানে, বলছিলাম..
‘ধ্যাৎ, তোরে না কইছি কিছু গোপন রাখবিনা। নীলা যেহেতু ডিভোর্স চাচ্ছে দিয়ে দে। যে যেতে চায়, তাকে ধরে রেখে লাভ নাই।
‘না বলছিলাম, বাবা, মা কি…….
‘কি কস বেটা, তুই জাস্ট বাড়ি যাবি আর কোন কথা নাই। যদি পারতাম একসাথেই যেতাম। আমি টিকিট ক্যানসেল করবো?
‘আরে না, যাবো। তুই চিন্তা করিস না।
‘তোর উপর কেমনে বিশ্বাস রাখি? এতকাল কোথায় ছিলি? অন্তত একটা ফোনও দিতে পারতি। চল, তোদের কাজ সেরে একসাথে বাড়ি যামুনে।
.
মঝে মাঝে কাউকে সৎ উপদেশ দিলে সেটা কেউ গ্রহণ করে না। অল্প কয়েকজন গ্রহণ করে। তার মধ্যে আরিদ একজন। বাবা মায়ের ২য় সন্তান। বড় একটা বোন ছিল বছর ছ’য়েক আগে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে পরপারে চলে যায়। বাবার ঘামে ভেজা কষ্টের টাকায় ঢাকার এক স্বনামধন্য কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেছে। পাশ করার পরপরই চাকরিও পেয়ে যায়। সেখানেই এক সুন্দরি ললনাকে বিয়ে করে স্থায়িভাবে থাকা শুরু করে। ভুলতে শুরু করে নারির সম্পর্ক। ভুলে যায় রক্তের সম্পর্ক। যে বাবার ঘামের বিনিময়ে অর্জন করা টাকায় পড়াশোনা করে এত বড় হয়েছে, সেই বাবা পড়ে থাকে অনাদরে, অবহেলায়। যে মায়ের পেটে দশমাস দশদিন মায়ের দেহের আহার খেয়ে বেঁচে ছিল, একটু একটু করে বড় হয়েছে ভুলে যায় সেই মায়ের দূধের ঋণ।
‘ছার নামেন। খোকসা চইলা আইচি। হেল্পারের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
নেমে হাটা দিলাম। এইতো মাত্র ১০ মিনিটের হাটা পথ। পরিচিত অনেক বন্ধুদের সাথেই দেখা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কতদিন দেখিনা। কি হৃদয়াতিক অনুভূতি। আমার সাথে থাকা আরিদ যেন এক চিরিয়াখানার বিলুপ্তপ্রায় জন্তু। সবাই কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। সকলের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে আরিদকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। আরিদকে বাড়ি পাঠিয়ে চলে আসলাম নিজের বাড়ি।ওহ একটা কথা, আরিদ আর নীলার ডিভোর্স করিয়ে দিয়েছি। আমার নিজেরও একটা অভিযোগ আছে, যে মেয়ে তার স্বামীকে তার রক্তের সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত করে, সে মেয়ে আর যাই করুক ভালবাসতে জানেনা।
.
২.
বিকাল পৌনে পাঁচটা, ঈদের নামাজ পড়ে বাড়িতে একটু শান্তির ঘুম দিচ্ছিলাম। এমন সময় হারামি দোস্তটার ফোন।
‘দোস্ত কই তুই?
‘বাড়িতে শুয়ে আছি। কি হইছে রে, বউ ফিরে আসছে নাকি?
‘ধুর হালা, খালি কথা পেচাস। মোড়ের ওপর আয়, কথা আছে।
‘থাক আসছি।
মোড়ে গিয়ে দেখি আরিদ আর মামুন বসে আছে। মামুনও লেংটা কালের দোস্ত। গ্রামেই থাকে। আমাকে দেখেই বলল,
‘দোস্ত, তুই আরিদকে ফিরিয়ে আনতে পারলি, ইমরান কোথায়? ওর জন্য কিছুই করতে পারলি না?
ব্যস্ততম ঢাকা শহরে সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত থাকে। কারো দিকে তাকানোর সময়ও থাকে না। এতদিনে ইমরানের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কোথায় থাকে, কি করে, বেঁচে আছে কিনা, সেটাও জানা নেই। যে ইমরান সবসময় ছায়ার মতো সঙ্গি হয়ে থাকতো সেই আজ উধাও। নিজেকে এই মুহূর্তে বড্ড অসহায় লাগছে।
‘দোস্ত ক্ষমা করে দিস। ওর কোন খোজ পায়নি। আর আমি নিজেই তো মাঝে মাঝে হারিয়ে যাই। নিজেকেই খুজে পাই না।
‘কার কাছে ক্ষমা চাস? ওদের বাড়ি গিয়ে দেখ। রাগের সাথে মামুনের তীক্ষ্ণ জবাব।
‘কিরে বাড়িতে আবার কি হয়েছে?
‘আমি জানিনা, মামুনই ভালো জানে। চল ওদের বাড়িতে একটু যাই।
‘আচ্ছা চল।
ইমরানদের বাড়িতে চৌকির উপর বসে আছি। মাথার উপরে সিলিং ফ্যানটা মৃদু শব্দ করে ঘুড়ছে। সামনের টেবিলের উপর রাখা কাচের প্লেটে ভাজা আর মুড়ি। বড্ড অবাক হলাম। ঈদের দিন ভাজা আর মুড়ি? ………
‘আমাগোর জীবনে ঈদ নাই। বাপগো কার লাইগা ছেমই রানবো? ইমরাইন রে কতকাল দুই চোহে দেহি নাই। নারির ধন অাছিলো। ইমাইনের বাপ কোন দোষডা করছিলো? কও বাপ, তুমরাই কও।
এই দূঃখিনি মাকে কি বলে শান্তনা দেবো, কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। শান্তনা দেওয়াটাও হয়তো অপরাধ। শুধু শুধু মিছে শান্তনা। একবার অনুভব করে দেখি, এই জায়গায় যদি নিজের গর্ভধারিনী মা হতো? কেমন হতো সেই গর্ভধারিনী মায়ের আহাজারি?
‘বাপগো, ইমরাইনের বাপ এত টেহা কুন থেইকা পাবে? পোলাডা কইলো মডরছাইকেল কিনে দিতি। না পাইয়া শহরে গ্যালো। আর আইলো না। তুমরা যদি পারো, আমার যক্ষের ধনরে ফেরায়া আইনো। মাঠের জমি-যাতি বেইচা মডরছাইকেল কিনে আইনা দিচ্ছি।
এই বলে কাঁদতে থাকে ইমরানের মা। এই মুহূর্তে ইমরানরে কাছে পাইলে আলু ছেনা বানাইতাম। আমাদের চোঁখেও পানি। আমরা, ইমরানেরা, এক নিষ্ঠুর মানব জাতির এক নিষ্ঠুর প্রজন্ম। না, মানব জাতি নিষ্ঠুর না, নিষ্ঠুর এই বর্তমান প্রজন্ম। আমাদের দূর্বলতা দেখানো যাবেনা। এই মুহূর্তে চোঁখ থেকে লোনা পানি ঝরে পরতে পারে। তাই চলে আসলাম ইমরানদের বাড়ি থেকে।
দু’হাতে চোঁখ মুছে পণ করলাম, যেভাবেই হোক ইমরানকে ফিরিয়ে আনবোই। যেভাবেই হোক একজন মাকে, তার বুকের ধন তার বুকে ফিরিয়ে দিবোই। অন্তত একজন মাকে তার সন্তানের দেখা দিবো। অন্তত একজন মায়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটাবো।