এক বছরের রাজা

এক বছরের রাজা

এক শহরে একজন বড় ব্যবসায়ী ছিল। সে দেশ বিদেশে মালামাল বিক্রি করত। তার ছিল অনেক দাস। তার বাড়িতে ছিল তার স্ত্রী আর তার এক ছোট ছেলে। সেই ছেলে ছিল খুব জেদী। যা বলত তা সে করেই ছাড়ত। একদিন সে তার বাবার সাথে নদীর তীরে গেল। তার বাবা ছিল চিন্তিত কেননা সেই নদী দিয়ে তার জাহাজ মাল নিয়ে আসছিল। আর সেই ছেলে জেদ ধরল তার বাবা তার সাথে নদীর তীরে খেলা করত বলে। কিন্তু তার বাবা বলল তোমার সাথে এখন খেলার সময় নয়, আমি পারবনা। একথা বলার সাথে সাথে ছেলেটি নদীতে ঝাঁপ দিল।

সেই ব্যবসায়ী হয়ে পড়ল খুব চিন্তায়। সে তার গোলাম দাসদের বলল এই কে আছিস আমার ছেলেটাকে কেউ বাঁচাও। কোন গোলাম রাজি হলনা সেই নদীতে ঝাঁপ দিতে কেননা সেই নদী ছিল খুব বড় আর ¯্রােত বয়ে চলছিল। এর মধ্যে এক দাস তার কাপড়খুলে নদীতে ঝাঁপ দিল এবং নিজের জীবন ঝুঁকিতে রেখে সে তার মনিবের ছেলেকে উদ্ধার করল। সেই বড় লোক ব্যবসায়ী সেই দাসের প্রতি খুব খুশি হলো এবং বলল তুই আমার কাছে কি চাস, বল। সে বলল আমি আপনার গোলাম। আপনি আমার মনিব।

আমি আপনারে কাছে কিছুই চাইনা। ব্যবসায়ী বলল আমি তোমাকে আযাদ করে দিলাম। এর সাথে তোমাকে এক জাহাজ ভর্তি মাল দিলাম, তুমি বিদেশ গিয়ে সেই মালামাল বিক্রি করে নতুন করে জীবন শুরু কর। এরপর সেই গোলাম যাত্রা শুরু করল জাহাজ নিয়ে নতুন দেশের উদ্দেশ্যে। যখন মাঝ সমুদ্রে এসে পড়ল তখন সমুদ্রে শুরু হলো বিশাল ঝড় আর তুফান। কিছুক্ষণ পর সবকিছু ঝড়ের অতলে ডুবে গেল। সেই গোলাম একটি কাঠের উপর উঠে বসল অজ্ঞান অবস্থায় আর ঢেউয়ের সাথে গিয়ে পৌছল এক জঙ্গলের তীরে। কিছুক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরলে দেখল তার একদিকে সমুদ্র অন্যদিকে জঙ্গল তাই সে জঙ্গলের দিকে রওয়ানা হলো কোন এক নতুন পথের উদ্দেশ্যে। এক পর্যায়ে এসে সে দেখল জঙ্গলের অদূরে একটা বড় শহর আর একটা রাজপ্রসাদ, সে একটু শহরের দিকে আগালে দেখতে পেল বিশাল দলবল বেঁধে অনেক মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে এইসব কিছু দেখে সে ভয় পেয়ে গেল।

লোকজন এসে তার কাছে পৌছালে সে দেখতে পেল সব লোকজন তাকে রাজার সম্ভাষনে ডাকছে আর বলছে ‘জয় মহারাজের জয়’ এসব বলে কিছু লোক তার গলায় মালা পড়িয়ে দিল। সেই গোলাম লোকটি নিশ্চুপ হয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখছিল আর মনে মনে হাসছিল আর বলছিল তার রবকে যে মাবুদ সবই তোমার কৃপা। সেই লোকজন মালা পড়িয়ে যখন রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেল আর তাকে ভিতরে নিয়ে রাজার পোষাক পরিয়ে আনল এবং রাজ সিংহাসনে বসাল। পরিস্থিতি কিছুটা নিরব হলে তাদের প্রবীন ২জন লোককে বললে সেই গোলাম যে এখন রাজা হয়ে রাজসিংহাসনে বসে আছে। সে বলল তোমাদের কি হয়েছে কেনই বা তোমরা আমাকে রাজা বলে ডাকছ? তখন একজন প্রবীন লোক বলে উঠল যে আমরা মানুষ না। আমরা এখানে অনেক কাল ধরে বসবাস করে আসছি।

আর আমরা অনেক দোয়া করেছি আল্লাহর কাছে যে আমাদের একজন মানুষ রাজা দিন। তিনি আমাদের ডাক শুনেছেন। আর আমরা মানুষদের খুবই বুদ্ধিমান মনে করি। তাই প্রতি বছর আমরা একজন করে মানুষ আসে আর প্রতিবছর একজন করে মানুষ রাজা পাল্টাই। এ বছরের শুরুতে আপনি এসেছেন তাই আমরা আপনাকে এক বছরের রাজা হিসাবে গ্রহণ করেছি। তখন সেই রাজারূপী গোলাম বলল এক বছর পর তোমরা সেই মানুষ রাজাকে কি কর? তখন প্রবীন লোকটি বলল আমরা তখন সেই রাজাকে তার আগের অবস্থায় তথা সে যেই পোষাক পড়ে এসেছিল যেই একবছর আগের পোষাকে তাকে মরুভূমির দেশে ফেলে রাখা হয়। যেখানে সামান্য খেজুর গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। এসব কথা শুনে নতুন রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি নতুন রাজা হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন রাস্তা খুঁজতে লাগলেন যাতে করে একবছর পর তাকে কোন কষ্ট করতে না হয়। আর অন্য দিকে তিনি তার জীবন খুবই আরাম আয়েশে কাটাতে লাগলেন।

একদিন তিনি কয়েকজন জ্ঞানী লোকদের ডেকে এনে জানতে চাইল যে আমার আগের রাজারা কিভাবে তাদের জীবন চালিয়েছিল। তখন তারা বলল মহারাজ আপনার আগের সেই রাজারা ছিল খামখেয়ালী, আর বিলাশী, তারা তাদের ১ বছরের জীবন খামখেয়ালী আর আরাম আয়েশে কাটিয়েছিল। কিন্তু রাজা মহাশয় আমরা আপনাকে খুবই পরিশ্রমী ও কর্তব্য পরায়ন মনে হচ্ছে। আমরা আশা করব আপনি তাদের মতো হবেন না। অপর দিকে রাজা তার একবছর পরের জীবন কিভাবে কাটাবে সেই কাজগুলো গোপনে গোপনে পরিকল্পিত ভাবে করতে ছিলেন। দেখতে দেখতে এক বছর পেরিয়ে গেল। সেই লোকেরা রাজার এক বছর পূর্ণ হওয়ার শেষ দিন রাজার সেই এক বছর আগের পুরাতন কাপড় এনে বলল। রাজা মহাশয় আপনার সময় শেষ। আপনাকে আপনার সেই মরুভূমিতে রেখে আসতে হবে।

রাজা বললেন আমার একটা অনুরোধ রইল আপনাদের কাছে এই যে আপনারা আমাকে যে মরুভূমিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন তা একবার দেখে আসতে হবে। সেই ভীনরাজ্যের বাসিন্দারা রাজি হলো যে তারা যাবে। রাজা তার পুরাতন কাপড় পড়ে রওয়ানা হলো মরুভূমি পথে চলতে চলতে তারা এসে পৌঁছল সেই মরুভূমিতে। এসে দেখে এখানে কোন মরুভূমির কোন চিহ্নমাত্র নেই রয়েছে সবুজ গাছগাছালী, ফসলের মাঠ আর বড় বড় বাড়ি ঘর। আর একটা রাজপ্রসাদ যেন নতুন এক দেশ ।

ভীনরাজ্যের বাসিন্দারা জানতে চাইল যে এসব কি করে হলো। তখন সেই এক বছরের রাজা বললেন যখন তোমরা আমাকে বললে যে আমার আয়ু তথা আমার মেয়াদ একবছর। তখন আমি চিন্তা করতে লাগলাম। এক বছর পর আমার কি হবে, তখন থেকে গোপনে গোপনে লোক পাঠিয়ে আমি এই মরুভূমিতে কাজশুরু করে দেই। বিদেশ থেকে মালামাল এনে এবং লোক লাগিয়ে সাজাতে থাকি সেই মরুভূমিকে। বাড়ি ঘর গাছপালা শহর তৈরী করাতে থাকি আমার লোকজন দিয়ে এবং মানুষদের সেই শহরে থাকতে দেই। ফলে জনশুন্য থেকে হয়ে যায় লোকালয়। লোকজন ও তাদের জীবিকার জন্য কাজ শুরু করে দেয়। এসব শুনে তারাও সেই একবছরের রাজাকে বাহবা দিতে লাগল। এদিকে এই শহরের নতুন মানুষেরা এসে তাদের রাজাকে মালা দিয়ে গ্রহণ করল। এভাবে এক বছরের রাজা হয়ে গেলেন চিরজীবনের জন্য রাজা।

তাই বলি আমরা যদি আমাদের এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে আমাদের চিরস্থায়ী জীবনটা ঐ খামখেয়ালী এক বছরের রাজাদের মতো না করি। বরং ঐ গোলাম ছিল যে লোকটি পরে এক বছরের রাজা হয়েছিল তার মতো হই, যে ঝড়-ঝাপটার মধ্য দিয়ে তার জীবনের কিনারে এনে মহাপরীক্ষার মধ্যে পরে ছিল এক বছরের রাজা হয়ে এবং তার শেষ জীবনের চিন্তাটাও সে করেছিল ফলে সেই পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বাকি জীবনের সুখের ব্যবস্থা করেছিল।
এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আখেরাত চিরস্থায়ী। সেই আখেরাতের পূঁজি আমাদের এই দুনিয়াতে করতে হবে এবং দুনিয়ার যা পূজি করব তাই হবে আমাদের আখেরাতের সম্বল।

গল্পের বিষয়:
ধর্মীয়
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত