সুস্থতা-অবসর : অবহেলিত দু-নিয়ামত

সচেতন না হলে অনেক মূল্যবান বিষয়েরও সঠিক মূল্যায়ন হয় না। আর যে বিষয়টিকে মূল্য দেওয়া উচিত, সময় মতো এর মূল্য দিতে না পারলে পরিণতি হয় দুঃখ ও মনস্তাপ। এজন্য হাতের নাগালে থাকা মূল্যবান বিষয়গুলো সম্পর্কে সজাগ সচেতন হওয়া কর্তব্য। অধিকারে আছে বলেই কি অবহেলা করতে হবে এবং যথেচ্ছা ব্যবহার করে বিনষ্ট করতে হবে?

হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এ বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। মানুষকে আল্লাহ যে নিয়ামতগুলো দান করেছেন সেগুলোর সঠিক ও যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নতি ও সফলতা অর্জন করা সম্ভব, আর তার অন্যথা হলে অবনতি ও ব্যর্থতা এই সহজ সত্যটাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতের সামনে তুলে ধরেছেন। এক হাদীসে এ ধরনের দু’টি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘দু’টি নিয়ামতের ব্যাপারে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। (অর্থাৎ এ দু’টি নিয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন না করার কারণে তারা কল্যাণবঞ্চিত।) নিয়ামত দু’টি হল ‘সুস্থতা’ ও ‘অবকাশ’।’

এ দু’টি বিষয়ে আল্লাহর তাআলার কত বড় দান তা খুব ভালোভাবে বুঝে আসে যখন এগুলো হারিয়ে যায়। অসুস্থ মানুষের পক্ষে সুস্থতার মাহাত্ম্য বোঝা সহজ। আর নানা অবাঞ্ছিত ঝামেলায় জর্জরিত হলে তখনই বুঝে আসে অবকাশের মূল্য। কিন্তু তখন বুঝে আসলেও কিছু করার থাকে না।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘সেদিন তোমরা আল্লাহ তাআলার নিয়ামতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’

হাদীসে শরীফে এসেছে- কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে তা হল, আমি কি তোমাকে একটি সুস্থ দেহ দেইনি? তোমাকে কি ঠান্ডা পানি দ্বারা পরিতৃপ্ত করিনি? অর্থাৎ এই নিয়ামত প্রহণ করে তোমার দায়িত্ব কতটুকু পালন করেছ? এই প্রশ্নের উত্তর মানুষকে দিতে হবে।

একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম শরীর আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। এ শরীর আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন তাঁর অসীম কুদরতের মাধ্যমে। এক ঘনান্ধকার স্থানে, মাতৃজঠরে। মহাকুশলী আল্লাহ এমনই নিপুণতায় মানবদেহ সৃষ্টি করেছেন, যতই মানুষ তা চিন্তা করে ততই অভিভূত হয়। মানুষের নিজের স্বত্তায় রয়েছে সৃষ্টিকর্তার পরিচয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘ভূ-পৃষ্ঠে রয়েছে বিশ্বাসীদের জন্য অনেক নিদর্শন। আর রয়েছে তোমাদের নিজ স্বত্তায়। এরপরও কি তোমরা দেখবে না?’-সূরা যারিয়াত : ২১

আল্লাহর পরিচয়, তাঁর জ্ঞান ও কুশলতার পরিচয় লাভের এত সহজ উপায় বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যদি আল্লাহর সঙ্গে পরিচিত না হওয়া যায় তবে এরচেয়ে বড় বঞ্চনা আর কী হতে পারে!

মানবদেহে যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন এবং যে নিপুণভাবে এগুলো কাজ করে যাচ্ছে তা এক মহাবিস্ময়। সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাযথভাবে কাজ করে গেলেই মানুষ পূর্ণ সুস্থ থাকে। আর কোনো অঙ্গের কাজ সামান্য ব্যাহত হলে মানুষ হয়ে পড়ে অসুস্থ। তার প্রয়োজনীয় কাজ-কর্মও তখন স্থগিত হয়ে যায়।

তাই সুস্থতা যেমন আল্লাহ তাআলার অপার কুদরতের নিদর্শন তেমনি তাঁর মহামূল্যবান নিয়ামত। আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন এই মহা নিয়ামতের হিসাব নেবেন।

অপর নিয়ামতটি হল অবকাশ। আল্লাহ তাআলা যখন কারো জীবন চলার মতো হালাল জীবিকার ব্যবস্থা করে দিলেন তখন আর পেরেশানী থাকার কথা নয়। শোকরগোযারী ও অল্পেতুষ্টির যে শিক্ষা ইসলাম দিয়েছে সেই শিক্ষার আলোকে মনমানস গঠিত হলে এ পরিমাণ জীবিকাই প্রশান্তির জন্য যথেষ্ট। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘সম্পদের প্রাচুর্য থেকে অমুখাপেক্ষিতা আসে না। এটা আসে হৃদয়ের প্রাচুর্য থেকে।’

পার্থিব ধন-সম্পদ সম্পর্কে যখন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ এ সত্যটুকু অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জিত হয় যে, এই ধন-সম্পদ জীবনের পরম লক্ষ্য নয়, জীবনধারণের উপকরণ মাত্র; তখন মানুষের চিন্তাভাবনা ও মনমানসে ভারসাম্য আসে। আর তা প্রভাব ফেলে তার কাজ-কর্মে। মানুষ তখন সম্পদের পিছনে ধাবিত হয় না; বরং সম্পদ ব্যবহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হয়। বস্ত্তত জীবনের লক্ষ্যউদ্দেশ্য সম্পর্কে অভ্রান্ত ধারণা মানুষকে চিত্তশালী করে। তখনই মানুষের পক্ষে প্রশান্তমনে আল্লাহর তাআলার ইবাদত-বন্দেগী ও ইতাআত-আনুগত্যে নিবেদিত হওয়া সম্ভব হয়। এই যে আত্মনিবেদনের সুযোগ এরই নাম অবকাশ। এই অবকাশ আল্লাহ তাআলার অতি বড় নিয়ামত। একে কাজে লাগিয়ে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারে। তবে আশঙ্কা থাকে, মানুষ যদি অসচেতন হয় কিংবা অবহেলা প্রদর্শন করে তাহলে এই মূল্যবান সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই হযরত রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে সাবধান করেছেন।

তো এই দুই নিয়ামত- সুস্থতা ও অবকাশকে কাজে লাগানোই হল সফলতার পথ। প্রশ্ন হল, কীভাবে এগুলোকে কাজে লাগানো যায়? এখানে এসে চিন্তা ও দৃষ্টির পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন হয়। কেননা, ভ্রান্ত চিন্তা জীবনের সকল কর্ম ও সাধনাকে অর্থহীন করে তুলতে পারে। হয়তো সারাজীবন সে মরিচিকার পিছনেই ছুটল। তার এই ছোটাটা অর্থহীন হল। যারা তাদের জীবন নাচ-গান করে কাটিয়ে দেয় তারা তো এ কাজটিকে খুব গুরুত্বের সাথেই গ্রহণ করে। গালভরা কথা আর তত্ত্ব ও বুলির ফুলঝুড়ি দিয়ে এর অর্থবহতা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব তো এক শ্রেণীর দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সবের জন্য কি একজন মানুষের গোটা জীবন নিবেদিত হতে পারে?

তাই চিন্তার পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন। মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য একটিই হতে পারে। তা হল, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন আর অনন্ত জীবনের সফলতা লাভ। এই এক লক্ষ্যে সফল হওয়ার প্রেরণা জাগ্রত হলে জীবনের সকল মহৎ কর্ম সুচারুরূপে সম্পাদিত হয়। কেননা, ইসলাম বলে আল্লাহর পথে চলেই তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। এককথায় সে পথটি হল ইসলাম। ইসলামের সঠিক ও ব্যাপক মর্ম কর্মে ও বিশ্বাসে ধারণ করে মুসলিম হতে পারাটাই হল মানব-জীবনের পরম লক্ষ্য। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি জ্বিন ও ইনসানকে সৃজন করেছি শুধু আমার ইবাদতের জন্য।’

কুরআনের এই একটি আয়াতই মানুষের চিন্তার মোড়, অতঃপর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। আর আল্লাহমুখী ও আল্লাহনিবেদিত মানুষের মাধ্যমেই রচিত হতে পারে একটি সুন্দর সমাজ, নিরাপদ পৃথিবী।

গল্পের বিষয়:
ধর্মীয়
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত