অনেকদিন আগের কথা। একদিন হযরত ঈসা সিরিয়ার পথে যেতে যেতে একটা মানুষের মাথার খুলি পড়ে রয়েছে দেখতে পেলেন। সেই খুলিটার সঙ্গে কথা বলবার জন্য তাঁর খেয়াল হলো। তিনি তখনই খোদার দরগায় আরজ করলেনঃ হে প্রভু আমাকে এই খুলির সঙ্গে কতা বলবার শক্তি দাও।
খোদা তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। হযরত ঈসা খুলিকে বললেনঃ হে অপরিচিত কঙ্কাল, তোমাকে যে কথা জিজ্ঞাসা করবো, তার ঠিক ঠিক উত্তর দাও।
বলবার সঙ্গে সঙ্গে ঈসা শুনতে পেলেন, পরিস্কার ভাষায় সেই খুলিটা ‘কলেমা শাহাদাত’ পাঠ করলো।
ঈসা জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি পুরুষ না স্ত্রী?
খুলি উত্তর করলোঃ পুরুষ।
ঈসা বললেনঃ তোমার নাম কি?
খুলি উত্তর করলোঃ জমজম।
ঈসা আবার জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি আগে কি ছিলে?
খুলি উত্তর করলোঃ আমি আগে বাদশাহ ছিলাম!
ঈসা বললেনঃ বটে। তোমার জীবনে কি কি কাজ করেছিলে?
খুলি উত্তর করলোঃ আমি আগে একজন বাদশাহ ছিলাম। ধন-দৌলত, লোক-লস্কর আমার এত বেশি ছিলো যে, দুনিয়ার বাদশাহরা তা দেখে অবাক হয়ে যেতো। তারা আমাকে খুব ভয় আর সম্মান করতো। আমি কিন্তু কারো ওপর কোন অত্যাচার করতাম না। গরীব-দুঃখীদের সাধ্যমতো দান করতান। সমস্ত দিন নিজের কাজে ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু ভুলেও কখনো খোদার নাম মুখে আনতাম না। এমনি করে অনেকদিন আমি বাদশাহী করেছিলাম। একদিন দরবারে বসে কাজ করছি, এমন সময় হঠাৎ আমার মাথা ব্যথা হলো। যন্ত্রণা ক্রমে বাড়তে লাগলো। কিন্তু যন্ত্রণা ক্রমে অহস্য হয়ে উঠলো। যেখানে যত বড় হেকিম ছিলো, চিকিৎসার জন্য তাদের সকলকে ডাকা হলো। কিন্তু কিচুতেই কিছু হলো না। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়তে আরম্ভ করলাম। এমন সময় হঠাৎ একটা আওয়াজ আমার কাণে ঢুকলো। কেহ যেন চিৎকার করে বলছেঃ জমজমের প্রাণ বের করে দোজখে ফেলে দাও। সেই সঙ্গে সঙ্গে এক বিকট মূর্তি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। উঃ, কি ভীষণ তার চেহারা! দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর কি হলো আমার মনে নেই। যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো তখন দেখলাম প্রাণ নিয়ে যাবার জন্য আজরাইল একা আসেনি –তার সঙ্গে আরো অনেক ফেরেশতা এসেছে। তাদের কারো হাতে লোহার ডাণ্ডা, কারো হাতে শিক, কারো হাতে তলোয়ার। সমস্তই আগুনের পোড়ান জবাফুলের মতো রাঙ্গা। তারা সেই সমস্ত দিয়ে আমাকে সেঁকা ও খোঁচা দিতে লাগলো। আমি যন্ত্রনায় চিৎকার করে বলতে লাগলামঃ ওগো তোমরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমায় মেরো না। আমায় ছেড়ে দাও। আমার ভাণ্ডারে যত ধন-দৌলত হীরা-জহরৎ আছে সব তোমাদের দেবো। এই কথা শুনে তাদের মধ্যে একজন লোহার মতো শক্ত হাতে আমার গালে একটা চাপর দিয়ে বললোঃ রে নাদান! খোদা কারো ধন-দৌলতের পরোয়া করে না।
যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে কাতরভাবে তাদের মিনতি করে বললামঃ ওগো তোমরা আমায় ছেড়ে দাও। তার বদলে আমার বংশের প্রত্যেক আমি খোদার নামে কোরবানী করবো। এই বলে তাদের দয়ার ভিখিরী হয়ে কাতর নয়নে তাদেরদিকে চেয়ে রইলাম। তারা দাঁত কড়মড় করে ধমকে দিয়ে বললোঃ রে বেয়াদব! খোদা কি ঘোষখোর?
আজরাইল তখন ফেরশতাদের বললেনঃ আর দেরী করো না, এখনই এর প্রাণ বের করে দোজখে ফেলে দাও।
তারপর তারা আমার প্রাণ বের করে নিয়ে গেলো।
তারপর কি হলো আর জানবার ক্ষমতা রইলো না। হঠাৎ মনে হলো যেন আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে। চোখ খুললাম। আমি কোথায় আছি প্রথমে বুঝতেই পারলাম না। অন্ধকার, চারিদিকে ঘন অন্ধকার –আলো নেই, বাতাস নেই। এই অবস্থা আমার অসহ্য হয়ে উঠলো, ক্রমে বুঝতে পারলাম যে আমাকে কবর দেওয়া হয়েছে আর সেই কবরের মধ্যে যেন হাজার ফেরেশতা এক সঙ্গে চিৎকার করে বলছেঃ রে নাদান! আমরা তোর প্রাণ বের করে নিয়ে গিয়েছিলাম পুনরায় তোর দেহের মধ্যে প্রাণ দিয়েছি। এখন এই কাফনের কাপড়ের উপর লেখ, দুনিয়ায় তুই কি কি কাজ করেছিস।
জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা করেছি সব আমার মনে স্পষ্ট জাগতে লাগলো। আমি এক এক করে অল্প সময়ের মধ্যে লিখে ফেললাম।
তারপর ফেরেশতারা ভয়ানক গর্জন করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ বল তোর খোদা কে?
আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর করলামঃ তোমরাই আমার খোদা। আমি অন্য খোদা জানি না। তোমরা আমাকে রক্ষা করো।
এই কথা শুনে তারা ভয়ানক রেগে গেলো। লোহর ডাণ্ডা দিয়ে আমাকে বেদম প্রহার আরম্ভ করলো। তারপর মনে হতে লাগলো, কবরের মাটি চারিদিক থেকে যেন আমাকে পিষে ফেলবার চেষ্টা করছে। ক্রমে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। মাটি চিৎকার করে বলতে লাগলোঃ রে বেঈমান! শত শত বৎসর আমার পিঠের উপরে বাদশাহী করে কত অত্যাচার করেছিস আর খোদার না-ফরমানী করেছিস তাই তোর এই শাস্তি। এই কথা বলে মাটি আমার হাড়গুলোকে গুঁড়ো করে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগলো।
অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছি এমন সময়ে কতকগুলি ভীষণ-মূর্তিজীব আমাকে ধরে ওপরে নিয়ে গেলো। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাবলাম, খোদা মেহেরবানি করে আমাকে মাফ করবেন। কিন্তু সে ভরসা শূন্যে মিলিয়ে গেলো যখন দেখলাম তারা আমাকে ধরে নিয়ে গেলো আর একজন লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা বিকট চেহারার লোকের কাছে। সে লোকটা ভীষণ চিৎকার করেবলে উঠলোঃ এই কমবখতকে (হতভাগ্যকে) আগুনের শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলো, তারপর পায়ের দিক থেকে উল্টো করে ছিড়ে ফেলো।
তারা কখনই প্রভুর হুকুম তামিল করতে আরম্ভ করলো। এরপর তারা আমাকে পচা দুর্গন্ধময় একটি কূপের মধ্যে ফেলে দিলো।
ক্ষুধায়, পিপাসায় আর অসহ্য যন্ত্রণায় হৃদপিণ্ড যেন বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। আমি কাতরভাবে তাদের বললামঃ দোহাই তোমাদের, আমাকে এক পাত্র পানি দাও।
ফেরেশতারা কিসের রস এনে আমাকে খেতে দিলো। চোখ বুঁজে সেই রস মুখের মধ্যে ঢেলে দিলাম। উঃ কি বিশ্রী দুর্গন্ধ? মনে হতে লাগলো এ জিনিস না খাওয়াই আমার পক্ষে ভাল ছিলো! চিৎকার করে বলতে লাগলামঃ কে আছ, আমায় এক পাত্র পানি দাও, পিপাসায় আমার প্রাণ যায়।
সেই কাতরোক্তি শুনে অপর একজন ফেরেশতা এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। মনে ভরসা হলো, এইবার বুঝি বেঁচে গেলাম। চোখ বুঁজে এক নিঃশ্বাস সবটুকু পান করলাম। উঃ এ যে আরো কটু ও দুর্গন্ধ! সমস্ত অন্তরটা জ্বলে যেতে লাগলো। নাক, মুখ, চোখ, কান এমন কি লোমের গোড়া দিয়ে পর্যন্ত দুর্গন্ধ বের হতে লাগলো। আমি চিৎকার করতে লাগলামঃ তোমরা এমন তিল তিন করে যাতনা দিয়ে আমাকে না মেরে যা করবার একেবারেই করে ফেলো। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
তারা কেউ আমার কথা গ্রাহ্য তো করলোই না বরং আমার সেই অবস্থা দেখে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে লাগলো। আমি যতই যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগলাম, ততই তারা হো-হো করে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে একজন ভীষণদর্শন ব্যক্তি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। তার ভয়াবহ আকৃতি দেখে আমার বুক শুকিয়ে গেলো। সে তার বিষ-মাখানো লম্বা নখে আমাকে গেঁথে শূন্যে সোকরাৎ নামক এক পাহাড়ে নিয়ে গেলো। সেই পাহাড়ে সাতটা কূপ। প্রত্যেক কূপ থেকে বিষাক্ত গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। প্রত্যেক কূপে হাজার হাজার বিষাক্ত সাপ ও বিছা পরস্পর কামড়া-কামড়ি করছে আর তাদের মুখের বিষ-নিঃশ্বাসের এই ধুম নির্গত হচ্ছে। ফেরেশতারা আমার চুল ধরে সেই কূপের মধ্যে ফেলে দিলো। সাপ-বিছারা চারিদিক থেকে আমাকে কামড়াতে আরম্ভ করে দিলো। জ্বালায় চিৎকার করতে লাগলাম।
তারপর তারা আমাকে এক পুকুরের কাছে নিয়ে গেলো। সে পুকুরে পানি নেই, শুধু পুঁজ, রক্ত ও বিষে ভলা সেই পুকুর। আমার চুল ধরে সেই পুকুরের মধ্যে জোর করে তারা ডুবিয়ে রাখলো। যতই ওপরে উঠার চেষ্টা করি, ততই তারা জোর করে আমাকে চেপে ধরে রাখতে লাগলো। এই রকম করে এক কূপ থেকে আর এক কূপে এবং এক পুকুর থেকেআর এক পুকুরে হাজার বার ডুবিয়ে হাজার বার তুলে একশত বছর ধরে আমাকে কষ্ট দিলো।
তারপর আজ হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন কাকে বলছে, যে পথে হযরত ঈসা যাচ্ছেন সেই পথে জমজমকে দোজখ থেকে তুলে ফেলে দাও। দুনিয়াতে সে অনেক ভাল কাজও করেছিলো। অন্নহীনকে অন্ন এবং বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করেছিলো! সে আজ তার পুরস্কার পাবে। সে খোদার নাম একবারও মুখে আনেনি বলে যে পাপ করেছিলো তার শাস্তি পুরোমাত্রায় ভোগ করবার পর আবার দুনিয়াতে যাবে।
ঈসা জিজ্ঞাসা করলেনঃ জমজম তুমি আমার কাছে কি চাও?
জমজম বললোঃ তুমি খোদার কাছে এই প্রার্থনা করো, তিনি যেন আমার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে আমাকে পুনরায় পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন।
ঈসা দুই হাত তুলে জমজমের জন্য খোদার কাছে আরজ করলেন। তারপর বললেনঃ জমজমের হাড় মাংস সমস্ত একত্র হয়ে পুনর্জীবন লাভ করুক।
বলতে না বলতে একটি সুদর্শন যুবক মাটি থেকে দাঁড়িয়ে হযরত ঈসাকে সালাম করলো।
গল্পের বিষয়:
ধর্মীয়