বৃত্র-সংহার : প্রথম খণ্ড – প্রথম সর্গ
বসিয়া পাতালপুরে ক্ষুব্ধ দেবগণ,-
নিস্তব্ধ, বিমর্ষভাব, চিন্তিত, আকুল,
নিবিড় ধূমান্ধ ঘোর পুরী সে পাতাল,
নিবিড় মেঘডম্বরে যথা অমানিশি।
যোজন সহস্র কোটি পরিধি বিস্তার–
বিস্তৃত সে রসাতল, বিধূনিত সদা
চারিদিকে ভয়ঙ্কর শব্দ নিরন্তর
সিন্ধুর আঘাতে স্বতঃ নিয়ত উত্থিত।
বসিয়া আদিত্যগণ তমঃ আচ্ছাদিত
মলিন নির্বাণ যথা সূর্য ত্বিষাম্পতি,
রাহু যবে রবিরথ গ্রাসয়ে অম্বরে;
কিংবা সে রজনীনাথ হেমন্ত-নিশিতে
কুজ্ঝটিমণ্ডিত যথা হীন দীপ্তি ধরে,
পাণ্ডুবর্ণ, সমাকীর্ণ পাংশুবৎ তনু–
তেমতি অমরকান্তি ক্লান্ত অবয়বে।
ব্যাকুল বিমর্ষভাব ব্যথিত অন্তর
অদিতি-নন্দনগণ রসাতলপুরে,
স্বর্গের ভাবনা চিত্তে ভাবে সর্বক্ষণ–
কিরূপে করিবে ধ্বংস দুর্জয় অসুরে।
চারিদিকে সমুত্থিত অস্ফুট আরাব,
ক্রমে দেববৃন্দ-মুখে বহে গাঢ় শ্বাস,–
ঝটিকার পূর্বে, যেন বায়ুর উচ্ছ্বাস
বহে যুড়ি চারিদিক্ আলোড়ি সাগর।
সে অস্ফুট ধ্বনি ক্রমে পুরে রসাতল
ঢাকিয়া সিন্ধুর নাদ গভীর নিনাদে;
কহিলা গম্ভীর স্বরে–শূন্যপথে যেন
একত্র জীমূতবৃন্দ মন্দ্রিল শতেক–
মহাতেজে সুরবৃন্দে সম্ভাষি কহিলা–
“জাগ্রত কি দানবারি সুরবৃন্দ আজ?
জাগ্রত কি অস্বপন দৈত্যহারী দেব?
দেবের সমরক্লান্তি ঘুচিল কি এবে?
উঠিতে সমর্থ কি হে সকলে এখন?
হা ধিক্! হা ধিক্ দেব! অদিতি-প্রসূত!
সুরভোগ্য স্বর্গে এবে দনুজের বাস!
নির্বাসিত সুরগণ রসাতল-ভূমে,
দেব-নাসিকায় বহে সঘন নিশ্বাস,
আন্দোলি পাতালপুরী, তীব্র ঝড়বেগে।”
দেব-সেনাপতি স্কন্দ উঠিয়া তখন
অবসন্ন, তেজঃশূন্য, অশক্ত, অলস।
“দুর্বিনীত, দেবদ্বেষী দনুজ প্রবেশে
পবিত্র অমরধাম কলঙ্কিত আজ
অজয় অমর শূর স্বর্গ-অধিকারী
দেববৃন্দ স্বরভ্রষ্ট পড়িয়া পাতালে,
ভ্রান্ত কি হইলা সবে? কি ঘোর প্রমাদ।
চিরসিদ্ধ দেবনাম খ্যাত চরাচরে,
‘অসুর-মর্দন’ আখ্যা–কি হেতু হে তবে
অবসন্ন আজি সবে দৈত্যের প্রতাপে?
চিরযোদ্ধা,– চিরকাল যুঝি দৈত্য সহ
জগতে হইলা শ্রেষ্ঠ সর্বত্র পূজিত
আজি কিনা দৈত্যভয়ে ত্রাসিত সকলে
আছ এ পাতালপুরে অমরা বিস্মরি!
কি প্রতাপ দনুজের কি বিক্রম হেন,
শঙ্কিত সকলে যাহে স্ববীর্য পাসরি?
কোথা সে শূরত্ব আজি বিজয়ী দেবের
শতবার রণে যায় দনুজ দলিয়া।
ধিক্ দেব! ঘৃণাশূন্য অক্ষুব্ধ হৃদয়ে
এতদিন আছ এই অন্ধতম পুরে।
দেবত্ব, ঐশ্বর্য, সুধা, স্বর্গ তেয়াগিয়া,
দাসত্বের কলঙ্কেতে ললাট উজলি।
ধিক্ হে অমর নামে, দৈত্যভয়ে যদি
অমরা পশিতে ভয় এতই পরাণে,
অমরতা পরিণাম পরিশেষে যদি
দৈত্য-পদাঙ্কিত পৃষ্ঠ চির-নির্বাসন!
বল হে অমরবৃন্দ–বল প্রকাশিয়া
এইরূপে চিরদিন থাকিবে কি হেথা?
চির-অন্ধতম পুরী এ পাতাল-দেশে,
দনুজের পদচিহ্ন ললাটে আঁকিয়া?”
কহিলা পার্বতী-পুত্র দেব-সেনাপতি।
দেবগণ বিচলিত করিয়া শ্রবণ,
কাঁপিতে কাঁপিতে ক্রমে সক্রোধ-মূরতি,
নাসারন্ধ্রে বহে শ্বাস বিকট উচ্ছ্বাসে।
যথা দগ্ধগিরি-স্রাব উদ্গিরণ আগে,
অগ্নির ভূধরে ধূম সতত নির্গমে,
বন জলকম্প, ঘন কম্পিত মেদিনী;
পার্বতী-নন্দন বাক্যে সেইরূপ দেবে।
তুলিয়া সুপৃষ্ঠে তূণ, পাশ শক্তি ধরি,
উঠিয়া অমরবৃন্দ চাহি শূন্যপানে,
পুনঃ পুনঃ খরদৃষ্টি নিক্ষেপি তিমিরে,
ছাড়িতে লাগিল ঘন ঘন হুহুঙ্কার।
সর্বাগ্রে অনলমূর্তি–দেব বৈশ্বানর,
প্রদীপ্ত কৃপাণ করে উন্মত্ত স্বভাব
কহিতে লাগিল দ্রুত কর্কশ-বচনে,
স্ফুলিঙ্গ ছুটিল যেন ঘোর দাবাগ্নিতে।
কহিল, “হে সেনাপতি! এ মণ্ডলী মাঝে
কোন্ ভীরু আছে হেন ইচ্ছা নহে যার
অমর-নিবাস স্বর্গে উদ্ধারিতে পুনঃ?
পুনঃ প্রবেশিতে তায় স্ববেশ ধরিয়া?
দানবে যুঝিতে আর কি ভয় এখন?
ভীরুতার হেতু আর আছে কি হে কিছু?
অমরের তিরস্কার সম্ভব যতেক
ঘটেছে দেবের ভাগ্যে দৈব-বিড়ম্বন।
স্বর্গ-অধোদেশে মর্ত, অধোদেশে তার,
অতল গভীর সিন্ধু–তাহার অধোতে,
অন্ধতম পুরী এই বিষম পাতাল,
তাহে এবে দৈত্য-ভয়ে লুক্কায়িত সবে।
দুঃখে বাস–ধূমময় গাঢ়তর তমঃ
মুহুর্তে মুহুর্তে ঘন ঘন প্রকম্পন,
সিন্ধু-নাদ শিরোপরি সদা নিনাদিত
শরীর-কম্পন হিমস্তুপ চারিদিকে।
এ কষ্ঠ অনন্তকাল যুগ-যুগান্তরে
ভুঞ্জিতে হইবে দেবে থাকিলে এখানে,
যতদিন প্রলয়ে না সংহার-অনলে
অমর-আত্মার ধ্বংস হয় পুনর্বার।
অথবা কপটি হয়ে ছদ্মবেশ ধরি
দেবের ঘৃণিত ছল ধূর্ততা প্রকাশি,
ত্রিলোক-ভিতরে নিত্য হইবে ভ্রমিতে
মিথ্যুক-বঞ্চকবেশে নিত্য পরবাসী।
নিরন্তর মনে হয় কাপট্য প্রকাশ
হয় পাছে কারও কাছে চিত্ত জাগরিত,
বিষম দুঃসহ চিন্তা ঘৃণা লজ্জাকর
সতত কতই আরো হৃদয়ে যন্ত্রণা।
সে কাপট্য ধরি প্রাণে জীবন-যাপন
শরীর-বহন আর, দুর্গতির শেষ;
বরঞ্চ নিরয়-গর্ভে নিয়ত নিবাস
শ্রেয়স্কর শতগুণ জিনি সে শঠতা।
অথবা প্রকাশ্যভাবে হইবে ভ্রমিতে
চতুর্দশ লোক-নিন্দা সহি অবিরত,
শত্রু-তিরস্কার অঙ্গে অলঙ্কার করি,
কপালে দাসত্ব-চিহ্ন করিয়া লাঞ্ছিত!
যখন ভ্রুকুটি করি চাহিবে দানব,
কিংবা সে অঙ্গুলি তুলি ব্যঙ্গ উপহাসে
দেখাইবে এই দেব স্বর্গের নায়ক,
শত নরকের বহ্নি অন্তরে দহিবে!
অথবা বর্জিত হয়ে দেবত্ব আপন
থাকিতে হইবে স্বর্গে–মার আছে যথা
অসুর-উচ্ছিষ্ট গ্রাসি পুষ্ট-কলেবর,
অসুর-পদাঙ্ক-রজঃ ভূষণ মস্তকে।
তার চেয়ে শতবার পশিব গগনে
প্রকাশি অমর-বীর্য সমরের স্রোতে
ভাসিব অনন্তকাল দনুজ-সংগ্রামে,
দেবরক্ত যতদিন না হইবে শেষ।
অমর করিয়া সৃষ্টি করিল যে দেবে
পিতামহ পদ্মাসন–সুমনস্ খ্যাতি,
ব্রহ্মাণ্ড ভিতরে যারা সর্ব গরীয়ান্,
অদৃষ্টের বশে হায় তাদের এ গতি!
দেবজন্ম লাভ করি অদৃষ্টের বশ,
তবে সে দেবত্ব কোথা হে অ-মর্ত্যগণ?
দেব-অস্ত্রাঘাতে নবে দানব-বিনাশ,
সে দেববিক্রমে তবে কিবা ফলোদয়?
নিয়তি স্বতঃ কি কভু অনুকূল কারে,
দেব কি দানব কিংবা মানব-সন্তান?
সাহসে যে পারে তার কাটিতে শৃঙ্খল,
নিয়ত কিঙ্কর তার শুন দেবগণ!
ধর শক্তি, শক্তিধর, হও অগ্রসর,
জাঠা, শক্তি, ভিন্দিপাল, শেল, নাগপাশ,
সুরবৃন্দ সুরতেজে কর বরিষণ,
অদৃষ্ট খণ্ডন করি সংহার অসুরে।”
কহিলা সে হুতাশন সর্ব-অঙ্গে শিখা
প্রজ্বলিত হৈল তেজে পাতাল দহিয়া,
অগ্নির বচনে মত্ত আদিত্য-সকলে
ছুটিল হুঙ্কার শব্দে পুরী রসাতল।
একেবারে শত দিকে শত প্রহরণে,
কোটি বিজলীর জ্যোতি খেলিতে লাগিল।
পাতালের অন্ধকার ঘুচায়ে নিমেষে
দেখাইল চারিদিকে জ্যোতির্ময় দেহ।
তখন প্রচেতা মর্ত্যে বরুণ বিখ্যাত
উঠিল গম্ভীরভাব, ধীর মূর্তি ধরি,
পাশ-অস্ত্র শূন্যপরে হেলাইয়া যেন,
উন্মত্ত জলধিজল প্রশান্ত করিল।
দেখিয়া প্রশান্তমূর্তি দেব প্রচেতার
নিস্তব্ধ অমরগণ, নিস্তব্ধ যেমন
স্নিগ্ধ বসুন্ধরা, যবে ঝটিকা নিবারে
ত্রিরাত্রি ত্রিদিবা ঘোর হুহুঙ্কার ছাড়ি।
কহিলা প্রচেতা ধীর গম্ভীর বচন;–
“তিষ্ঠ দেবগণ ক্ষণকাল শান্তভাবে
হেন প্রগল্ভতা কভু নহে ত’ উচিত,
এ ঔদ্ধত্য অল্পমতি প্রাণীরে সম্ভবে।
যুদ্ধে দৈত্য বিনাশিয়া স্বর্গ উদ্ধারিতে
অনিচ্ছা কাহার দৈত্যঘাতী দেবকূলে?
কে আছে নারকী হেন দেব-নামধারী
দ্বিরুক্তি করিবে হেন পবিত্র প্রস্তাবে?
তথাপি প্রতিজ্ঞা-বাক্য-উচ্চারণ আগে
উচিত ভাবিয়া দেখা ফলাফল তার;
সামান্যেরও উপদেশে শুভপ্রদ কভু,
জ্ঞানীর মন্ত্রণা কভু না হয় নিষ্ফল।
কি ফল প্রতিজ্ঞা করি বিফল যদ্যপি?
সর্বজন-হাস্যাস্পদ হয়ে কিবা ফল?
অসিদ্ধ-প্রতিজ্ঞ লোক অনর্থ প্রলাপি
নমস্য জগতে, কার্যে সুসিদ্ধ যে জন।
অনেক মহাত্মা বাক্য কহিলা অনেক,
কার্যসিদ্ধি নহে শুধু বাক্য-আড়ম্বরে,
কোদণ্ড-নির্ঘোষ কর্ণে প্রবেশের আগে,
শরলক্ষ্য ধরাশায়ী হয় শরাঘাতে।
দেব-তেজ, দেব-অস্ত্র, দেবের বিক্রম,
বার বার এত যার কর অহঙ্কার,
এতদিন কোথা ছিল অসুরের সনে
যুঝিলে যখন রণে করি প্রাণপণ?
কোথা ছিল সে সকল যবে দৈত্য শূল
নিক্ষেপিল সুরবৃন্দে এ পুরী পাতালে?
সমর্থ কি হয়েছিলা করিতে নিস্তেজ
দুর্জয় বৃত্রের হস্ত দেব-অস্ত্রাঘাতে?
অস্ত্র সেই, বীর্য সেই, সেই দেবগণ,
অক্ষুণ্ণ, অসুরও সেই সুপ্রসন্ন বিধি
এখনো রক্ষিছে তারে অনিবার্য তেজে,
কি বিশ্বাসে পুনঃ চাহ পশিতে সংগ্রামে?
ভাগ্য নাই! ভাগধেয় মূঢ়ের প্রলাপ?
সাহস যাহার সদা সেই ভাগ্যধর।
তবে কেন ইন্দ্রবাণ-তেজঃ দুর্নিবার
অক্ষত শরীরে দৈত্য ধরিল বক্ষেতে?
কেন ইন্দ্র সুরপতি সর্বরণজয়ী
দনুজমর্দন নিত্য শূলের প্রহারে
অচেতন রণস্থলে হইলা আপনি,
চেতন-বিরতি যার নহে ক্ষণকাল?
কেন বা সে ইন্দ্র আজি নিয়তির ধ্যানে,
সঙ্কল্প করিয়া দৃঢ় করিয়া মানসে,
সুমেরু-শিখরে একা কাটাইছে কাল,–
কেন সুরপতি বৃথা এ ধ্যানে নিরত?
দেবগণ, মম বাক্য অকর্তব্য রণ
যতদিন ইন্দ্র আসি না হয় সহায়;
অগ্রে কোন দেবতায় করুন উদ্দেশ,
পশ্চাৎ যুদ্ধ-কল্পনা হবে সমাপিত।”
বরুণের বাক্যে সূর্যদেব ত্বিষাম্পতি
উঠিলা প্রখরতেজা–কহিলা সবেগে–
“বক্তব্য আমার অগ্রে শুন সর্বজন,
ভাবিও সে বৈধাবৈধ বাঞ্ছনীয় শেষে।
ত্রিজগতে জীবশ্রেষ্ঠ নির্জর অমর,
অদিতি-নন্দনগণ চির আয়ুষ্মান্
অনশ্বর দেববীর্য, শরীর অক্ষয়,
সর্বকালে, সর্বলোকে প্রসিদ্ধ এ বাদ।
অসুর অচিরস্থায়ী অদৃষ্ট অস্থির,
চঞ্চল দানবচিত্ত রিপু-পরবশ;
মন্ত্রী মিত্র কেহ নহে চির-আজ্ঞাবহ;
জয়োৎসাহ প্রভুভক্তি অনিত্য সকলি
সর্বকালে সর্বলোকে জান তথ্য এই,
দুরন্ত দানব তবে কত কাল সবে
দুর্বার সমরক্ষেত্রে সুরবীর্যানল,
কত কাল রণে দৈত্য সে রণে তিষ্ঠিয়া?
মম ইচ্ছা সুরবৃন্দ, দুরন্ত আহবে,
দহে সে দানবকুল ভীম উগ্রতেজে,
যুগে যুগে কল্পে কল্পে নিত্য নিরন্তর
জ্বলুক গগনব্যাপী অনন্ত সমর
জ্বলুক দেবের তেজ অমরা ঘেরিয়া,
অহোরাত্র অবিশ্রান্ত প্রখর শিখায়;
দহুক দানবকুল দেবের বিক্রমে
পুত্রপরম্পরা ঘোর চিরশোকানলে।
চিরযুদ্ধে দৈত্যদল হইবে ব্যথিত,
না জানিবে কোন কালে বিশ্রামের সুখ,
নারিবে তিষ্ঠিতে স্বর্গে দেব-সন্নিধানে,
হইবে অমর-হস্তে পরাস্ত নিশ্চিত।
অদৃষ্ট এতই যদি সদয় দানবে,
কোন যুগে নাহি হয় যুদ্ধে পরাজিত,
ভুঞ্জুক অদৃষ্ট তবে তিক্ত আস্বাদনে
চিরযুদ্ধে সুরতেজে দানব দুর্মতি।
ধিক্! লজ্জা! অমরের এ বীর্য থাকিতে
নিষ্কণ্টকে স্বর্গভোগ করে বৃত্রাসুর!
সুখে নিদ্রা যায় নিত্য দেব উপেক্ষিয়া–
স্বর্গ-বিরহিত দেব চিন্তায় ব্যাকুল!
নাহিক বাসব হেথা সত্য বটে তাহা,
কিন্তু যদি পুরন্দর আরো বহুযুগ
প্রত্যাগত নাহি হন, তবে কি এখানে
এইভাবে রবে সবে চির-অন্ধকারে?
চল হে আদিত্যগণ প্রবেশি শূন্যেতে,
দৈত্যের কণ্টক হয়ে অমরা বেষ্টিয়া
দগ্ধ করি দৈত্যকুল, যুগ-যুগকাল,
যুদ্ধের অনন্তবহ্নি জ্বালায়ে অম্বরে।
স্বর্গের সমীপবর্তী পর্বত-সমূহে
শিখরে শিখরে জানি শস্ত্রধারিবেশে
সুশাণিত দেব-অস্ত্রে নিত্য বরিষণে
দনুজের চিত্তশান্তি ঘুচাই আহবে।”
কহিলা এতেক সূর্য, ঝটিকার বেগে
চারিদিক্ হতে দেব ছুটিতে লাগিল,
উত্থিত বালুকা যথা, যখন মরুতে
মত্ত প্রভঞ্জন রঙ্গে নৃত্য করি ফেরে।
কিংবা যথা যবে ঘোর প্রলয়ে ভীষণ,
সংহার-অনলে বিশ্ব হয়ে ভস্মাকার
উড়ে অন্তরীক্ষপথে দিগন্ত আচ্ছাদি,
তেমতি অমরবৃন্দ ঘেরিলা ভাস্করে।
সকলে সম্মত শীঘ্র উঠি ব্যোমপথে,
বেষ্টিয়া অমরাবতী অরাত্রি অদিবা,
চিরসমরের স্রোতে ঢালিয়া শরীর,
দেবনিন্দাকারী দুষ্ট অসুরে ব্যথিতে।
বৃত্র-সংহার : প্রথম খণ্ড – দ্বিতীয় সর্গ
হেথা ইন্দ্রালয়ে নন্দন-ভিতর
পতিসহ প্রীতিসুখে নিরন্তর,
দানব-রমণী করিছে ক্রীড়া।
রতি ফুলমালা হাতে দেয় তুলি,
পরিছে হরিষে সুষমাতে ভুলি,
বদন-মণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া।।
মদন-সজ্জিত কুসুম-আসন,
চারিদিকে শোভা করিছে ধারণ,
বিচিত্র সৌন্দর্য সুরভিময়।
হাসিছে কানন ফুলশয্যা ধরি
স্থানে স্থানে মৃত্তিকা-উপরি
কতই কুসুম-পালঙ্ক রয়।।
কত ফুল-ক্ষেত্র চারিদিকে শোভে,
মুনি ভ্রান্ত হয় কান্তি হেরি লোভে,
রেখেছ কন্দর্প করিতে খেলা।
বসন্ত আপনি সুমোহন বেশ,
ফুটাইছে পুষ্প কত সে আবেশ,
হয়েছে অপূর্ব-শোভার মেলা।।
দানব-রমণী ঐন্দ্রিলা সেখানে,
শোভিতে মোহিত বিহ্বলিত প্রাণে
ফুলে ফুলে ফুলে করিছে কেলি।
করিছে শয়ন কভু পারিজাতে,
মৃদুল মৃদুল সুশীল বাতে,
মুদিলা নয়ন কুসুমে হেলি।।
বসিছে কখন অনুরাগভরে,
ইন্দ্রিরা-কমল-পর্যঙ্ক-উপরে,
দৈত্যপতি হাসে পারশে বসি।
হাসে মনসুখে ঐন্দ্রিলা সুন্দরী,
রতিদত্ত মালা করতলে ধরি,
বসনবন্ধন পড়িছে খসি।।
মূর্তিমান্ ছয় রাগ করে গান,
রাগিণী ছত্রিশ মিলাইছে তান,
সঙ্গীত-তরঙ্গে পীযূষ ঢালি।
স্বরে উদ্দীপন করে নবরস,
পরশ, আঘ্রাণ, সকলি অবশ,
শ্রবণ-ইন্দ্রিয়-ব্যাপৃত খালি।।
ভ্রমে রতিপতি সাজাইয়া বাণ,
কুসুম-ধনুতে সু-ঈষৎ টান,
মুচকি মুচকি মুচকি হাসি।
নাচে মনোরমা স্বর্গ বিদ্যাধরী,
কন্দর্প-মোহন বেশ-ভূষা পরি,
বিলাস-সরিৎ-তরঙ্গে ভাসি।।
এইরূপে ক্রীড়া করে দৈত্য সনে,
দৈত্যজায়া সুখে নন্দন কাননে,
বৃত্রাসুর সুখে বিহ্বল-প্রায়।
ধরি অনুরাগে পতি-করতল,
কহে দৈত্যজায়া নয়ন চঞ্চল,
হাব ভাব হাসি প্রকাশ তায়–
“শুন দৈত্যেশ্বর, শুন শুন বলি,
বৃথা এ বিলাস বৃথা এ সকলি,
এখন(ও) আমরা বিজিত নয়
বিজিত যে জন, বিজয়ী-চরণ,
নাহি যদি সেবা করিল কখন,
সে হেন বিজয়ে কি ফলোদয়।।
“তুমি স্বর্গপতি আজি দৈত্যেশ্বর,
আমি তব প্রিয়া খ্যাত চরাচর,
ধিক্ লজ্জা তবু সাধ না পূরে।
কটাক্ষে তোমার আশুপ্রাপ্য যাহা,
তব প্রিয় নারী নাহি পায় তাহা,
তবে সে কি লাভ থাকি এ পুরে?
“স্বয়ংবরা হয়ে করেছি বরণ,
হেরিয়া তোমাতে মহেন্দ্র-লক্ষণ,
ইচ্ছাময়ী হব হৃদয়ে আশ।
সে ইচ্ছা যখন ধরিবে হৃদয়,
তখনি সফল হবে সমুদয়,
জানিব না কারে বলে নৈরাশ।।
“ত্যজি নিজকুল গন্ধর্ব ছাড়িয়া,
বরিলাম তোমা যে আশা করিয়া,
এবে যে বিফল হইল তাহা!
নিষ্ফলা বাসনা হৃদয়ে যাহার,
কিবা স্বর্গপুরী, কিবা মর্ত্য আর,
যেখানে সেখানে নিয়ত হা হা!!
কিবা সে ভূপতি, কিবা সে ভিখারী,
কাঙ্গালী সে জন যেখানে বিহারী,
প্রাণের শূন্যতা ঘুচে না কভু।
পতিত্বে বরণ করিয়া তোমায়
তবু সে বাসনা পূরিল না হায়,
আমার(ও) এ দশা ঘটিল তবু।।
ভাল ভেবে যদি বাসিতে হে ভাল,
সে বাসনা পূর্ণ হ’ত কত কাল,
সহিতে হ’ত না লালসা জ্বালা।
ভালবাসা এবে কিসে বা জাগাই,
দিয়াছি যা ছিল, সে যৌবন নাই,
ভালবেসে বেসে হয়েছি আলা।।
ইন্দ্রাণী যদি সে করিত বাসনা,
না পূরিতে পল পূরিত কামনা,
মরি সে ইন্দ্রের লয়ে বালাই।
প্রণয়ী যে বলে প্রণয়ী ত’ সেই,
না চাহিতে আগে হাতে তুলে দেই,
সে প্রণয়ে এবে পড়েছে ছাই।।”
বলিয়া নেহারে পতির বদন,
আধ ছল-ছল ঢলে দু-নয়ন,
অভিমানে হাসি জড়ায়ে রয়।
শুনি দৈত্যেশ্বর বলে ধীরে ধীরে
“কি বলিলে প্রিয়ে বল শুনি ফিরে,
প্রেয়সী নারীর এ দশা নয়?
কি দোষে ভর্ৎসনা করিছ আমায়,
না দিয়াছি কহ কিবা সে তোমায়,
অদেয় কিবা এ জগতী-মাঝ?
দিয়াছি জগৎ চরণের তলে,
কৌস্তভ যেমতি মাণিকমণ্ডলে,
তুমিই তেমনি নারীতে আজ।।
কে আছে রমণি তুলনা ধরিতে,
বিভব ঐশ্বর্য গৌরব খ্যাতিতে,
তোমার উপমা কাহাতে হয়?
আর কি লালসা বল তা এখন
আছে কিবা বাকী দিতে কোন্ ধন,
কি বাসনা পুনঃ হৃদে উদয়?”
কহিলা ঐন্দ্রিলা–“দিয়াছ যে সব,
জানি হে সে সব বিভব-গৌরব,
তবু সর্বজন-পূজিতা নই।
মণিকুলে যথা কৌস্তভ মহৎ
নারীকুলে আমি তেমতি মহৎ,
বল দৈত্যরাজ হয়েছি কই?
এখনও ইন্দ্রাণী জগতের মাঝে,
গৌরবে তেমনি সুখেতে বিরাজে
এখনও আয়ত্ত হ’লো না সেহ।
স্বর্গের ঈশ্বরী আমি সে থাকিতে,
কিবা এ স্বরগ কিবা সে মহীতে,
শচীর মহত্ত্ব ভুলে না কেহ।।
রতিমুখে আমি শুনিনু সেদিন,
সুমেরু এখন হয়েছে শ্রীহীন,
শচীর সৌন্দর্য দেহে না ধরি।
ইন্দ্রাণী যখন আছিল এখানে,
অমর-সুন্দরী সকলে সেখানে,
থাকিত হেমাদ্রি উজ্জ্বল করি।।
শুনেছি না কি পরমা রূপসী,
বড় গরবিনী নারী গরীয়সী,
চলনে গৌরব ঝরিয়া পড়ে।
গ্রীবাতে কটিতে স্ফারিত উরসে,
কিবা সে বিষাদ কিবা সে হরষে,
মহত্ত্ব যেন সে বাঁধে নিগড়ে।।
শচীরে দেখিব মনে বড় সাধ,
ঘুচাইব চক্ষু-কর্ণের বিবাদ,
আমার চিত্তের বাসনা এই।
থাকিবে নিকটে শিখাবে বিলাস,
ধরিব অঙ্গেতে নবীন প্রকাশ,
ভুলাতে তোমার শিখাবে সেই।।
আসিবে যথেক অমর-সুন্দরী,
শচী সঙ্গে অঙ্গে দিব্য বেশ ধরি,
অমর-কৌতুক শিখাবে ভালো।
এই বাঞ্ছা চিতে শুন দৈত্যপতি,
শচী দাসী হবে দেখিবে সে রতি,
হয় কি না পুনঃ সুমেরু আলো।।”
শুনে বৃত্রাসুর ঈষৎ হাসিয়া,
কহিল ঐন্দ্রিলা-নয়নে চাহিয়া,
“এই ইচ্ছা প্রিয়ে হৃদে তোমার?”
বলিয়া এতেক দানব-ঈশ্বর,
কন্দর্পে ডাকিয়া জিজ্ঞাসে সত্বর,
“কোথা শচী এবে করে বিহার?”
কহিলা কন্দর্প মুখে চির-হাসি
“অমরা বিহনে এবে মর্ত্যবাসী,
নৈমিষ-অরণ্যে শচী বেড়ায়।
সঙ্গে প্রিয়তমা সখী অনুগত,
ভ্রমে অরণ্যেতে দুঃখেতে সতত,
না পেয়ে দেখিতে সুমেরু-কায়।।
কষ্টে করে বাস শচী নরলোকে,
ইন্দ্র, ইন্দ্রালয়, ইন্দ্রত্বের শোকে
অন্তরে দারুণ দুঃখহুতাশ।”
শুনি দৈত্যপতি কহিলা, “সুন্দরি,
পাবে শচীসহ শচী সহচরী,
অচিরে তোমার পূরিবে আশ।।”
ঐন্দ্রিলা শুনিয়া সহর্ষ হইলা,
অধরে মধুর হাসি প্রকাশিলা,
পতিকর সুখে ধরে অমনি।
হাসিতে হাসিতে কন্দর্প আবার,
ধনুকে ঈষৎ করিল টঙ্কার,
শিহরে দানব দৈত্যরমণী।।
পুনঃ ছয় রাগ রাগিণী ছত্রিশ,
গীত-বৃষ্টি করে ভুলে আশীবিষ,
নব নব রস বিভাস করি।
পুনঃ সে ইন্দ্রিয় অবশ সঙ্গীতে,
অসুর-অসুরী শুনিতে শুনিতে,
চমকে চমকে উঠে শিহরি।।
কভু বীর-রসে ধরিছে সুতার,
দানব উঠিছে করি মার মার,
আবার সমরে পশিছে যেন।
অমর নাশিতে ধরিছে ত্রিশূল,
আবার যেন সে অমরের কুল,
বিনাশে সংগ্রামে ভাবিছে হেন।।
কখন করুণা-সারিতে ভাসিয়া
চলেছে ঐন্দ্রিলা নয়ন মুছিয়া,
কখন অপত্য-স্নেহেতে ভোর।
যেন সে কোলেতে হেরিছে কুমার,
স্তনযুগে স্বতঃ বহে ক্ষীরধার,
এমনি ত্রিদিব-সঙ্গীত ঘোর।।
কভু হাস্যরস করে উদ্দীপন,
কোথায় বসন কোথায় ভূষণ,
ঐন্দ্রিলা উল্লাসে অধীর হয়।
ক্ষণে পড়ে ঢলি পতির উৎসঙ্গে
ক্ষণে পড়ে ঢলি ফুলদল-অঙ্গে,
উৎফুল্ল বদন লোচনদ্বয়।।
অমনি অপ্সরা হইয়া বিহ্বল,
চলে ধীরে ধীরে তনু ঢল-ঢল,
নেত্র করতল অলকা কাঁপে।
ঈষৎ হাসিতে অধর অধীর,
অঙ্গুলি-অগ্রেতে অঞ্চল অস্থির,
টানিয়া অধরে ঈষৎ চাপে।।
চারিদিকে ছুটে মধুর সুবাস,
চারিদিকে উঠে হরষ-উচ্ছ্বাস,
চারিদিকে চারু কুসুম হাসে।
খেলে রে দানবী দানবে মোহিয়া,
বিলাস-সরিৎ-তরঙ্গে ডুবিয়া,
প্রমোদ-প্লাবনে নন্দন ভাসে।।
বৃত্র-সংহার : প্রথম খণ্ড – তৃতীয় সর্গ
উঠিছে দানবরাজ নিদ্রা পরিহরি
ইন্দ্রালয়ে, শশব্যস্তে নানাদ্রব্য ধরি,
দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ ছুটিয়া বেড়ায়,
গৃহ পথ রথ অশ্ব সত্বর সাজায়;
সাজায় সুন্দর করি পুষ্পমাল্য দিয়া,
গবাক্ষ গৃহের দ্বার শোভা বিন্যাসিয়া;
উড়ায় প্রাসাদ-চূড়ে দানব-পতাকা–
শিবের ত্রিশূল-চিহ্ন শিবনাম আঁকা।
ঘন করে শঙ্খধ্বনি; ঘন ভেরীনাদ;
চারিদিকে স্তব্ধ শব্দ ঘন ঘোর হ্রাদ।
শিখরে শিখরে বাজে দুন্দুভি গভীর,
ঘন ঘন ধনুর্ঘোষে গগন অস্থির।
ইন্দ্রালয় বিলোড়িত দানবের দাপে;
জয়শব্দে চরাচর মেরুশীর্ষ কাঁপে।
বাসবের বাসগৃহ গগন যুড়িয়া,
হিমাদ্রিভূধর তুল্য আছে বিস্তারিয়া।
স্ফটিকের আভা তায় ফুটিয়া পড়িছে,
হিমানীর রাশি যেন আকাশে ভাসিছে।
দ্বারদেশে ঐরাবত হস্তী সুসজ্জিত,
সসজ্জিত পুষ্পরথ দ্বারে উপস্থিত।
ইন্দ্রপুরীশোভাকর সভার ভবন,
কুবের সাজায় আনি বিবিধ ভূষণ,
সারি সারি মণিস্তম্ভ সাজাইয়া তায়,
সাজাইছে পুষ্পদাম চন্দ্রাতপ-গায়।
হায় রে সে ইন্দ্রাসন বসিত যাহাতে
বাসব অমরপতি, রাখিছে তাহাতে
মন্দার-পুষ্পের গুচ্ছ করিয়া যতন,
দানব আসিয়া ঘ্রাণ করিবে গ্রহণ।
ইন্দ্রের মুকুট দণ্ড আনি দ্রুতগতি
রাখিছে আসন পার্শ্বে ভয়ে যক্ষপতি,
সভাতলে বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুত করিয়া
তটস্থ কিন্নরগণ দেখিছে চাহিয়া।
আতঙ্কে প্রবেশ-দ্বারে;–বিদ্যাধরী যত–
উর্বশী মেনকা রম্ভা ঘৃতাচী বিনত–
বসন-ভূষণ পরি সকলে প্রস্তুত,
কেবল নর্তন বাকী বাদন-সংযুত।
সমবেত সভাতলে করি যোড়কর,
অপ্সরা, কিন্নর, যক্ষ, সিদ্ধ, বিদ্যাধর।
সমবেত দৈত্যবর্গ সুদীর্ঘ শরীর–
হেনকালে শঙ্খধ্বনি হইল গম্ভীর;
অমনি সুযন্ত্রে বাদ্য বাজিল মধুর;
অমনি অপ্সরা-পায়ে বাজিল নূপুর;
পূরিল সুধার ঘ্রাণে সভার ভবন;
বহিল অমরপ্রিয় সুরভি পবন।
প্রবেশিল সভাতলে অসুর দুর্জয়;
চারিদিকে স্তুতিপাঠ জয় শব্দ হয়।
ত্রিনেত্র, বিশালবক্ষ, অতি দীর্ঘকায়,
বিলম্বিত ভুজদ্বয়, দোদুল্য গ্রীবায়
পারিজাত-পুষ্পহার বিচিত্র শোভায়।
নিবিড় দেহের বর্ণ মেঘের আভাস;
পর্বতের চূড়া যেন সহসা প্রকাশ,
নিশান্তে গগনপথে ভানুর ছটায়!–
বৃত্রাসুর প্রকাশিল তেমনি সভায়।
ভ্রুকুটি করিয়া দর্পে ইন্দ্রাসন ’পরে
বসিল, কাঁপিল গৃহ দৈত্য-দেহভরে।
মন্ত্রীরে সম্ভাষি দৈত্য কহিলা তখন;–
“সুমিত্র হে! ভীষণেরে করহ প্রেরণ
অচিরে অবনীতলে, নৈমিষ-কাননে;
ভ্রমে শচী সে অরণ্যে সুররামা সনে;
আসুক স্বরগপুরে অমরী সকলে,
যে বিধানে পারে কহ আনিতে কৌশলে।
কৌশলে না সিদ্ধ হয় প্রকাশিবে বল;
ঐন্দ্রিলা অভিলাষ করিব সফল।
বড় লজ্জা দিয়া কাল ঐন্দ্রিলা আমারে–
শচী ভ্রমে স্বতন্তরা না সেবি তাহারে।
সুমিত্র, সত্বর কার্য কর সম্পাদন,
ভীষণে নৈমিষারণ্যে করহ প্রেরণ।”
দৈত্যেন্দ্র-বচনে মন্ত্রী কহিলা সুমিত্র;–
“মহিষী-বাঞ্ছিত যাহা কিবা সে বিচিত্র!
আজ্ঞা তব শিরোধার্য দনুজের নাথ,
নৈমিষ-অরণ্যে দৈত্য যাবে অচিরাৎ।
নিবেদন আছে কিছু দাসের কেবল,
আদেশ পাইলে পদে জানাই সকল।।”
দৈত্যেশ কহিলা–“মন্ত্রি, কহ কি কহিবে,
অবিদিত বৃত্রাসুরে কিছু না থাকিবে।।”
কহিল সুমিত্র, “তবে শুন দৈত্যনাথ,
অমর পশিছে স্বর্গে করিতে উৎপাত;
কহিলা প্রহরী যারা ছিলা গত নিশি,
দেখেছে দেবের জ্যোতিঃ প্রকাশিছে দিশি।
অতি শীঘ্র বোধহয় দেবতা সকল,
রণ-আশে প্রবেশ করিবে স্বর্গস্থল।
এ সময় ভীষণেরে প্রেরণ উচিত
হয় কি না দৈত্যপতি ভাবিবে বিহিত,
সামান্য বিপক্ষ নহে জান দৈত্যপতি,
কঠোর সে অমরের যুদ্ধের পদ্ধতি।
দিবারাত্রি ক্ষণকাল নহিবে বিশ্রাম,
দুর্দম বিক্রমে সবে করিবে সংগ্রাম,
যত যোদ্ধা দানবের হবে প্রয়োজন,
এ সময়ে উচিত কি ভীষণে প্রেরণ?”
শুনিয়া হাসিলা বৃত্রাসুর দৈত্যেশ্বর
কহিলা, “প্রলাপ না কি কহ মন্ত্রিবর?
আসিবে সমরে ফিরে অমর আবার;
এ অযথা কথা মন্ত্রি রচিত কাহার?
দানবের ভয়ে স্বর্গ পৃথিবী ছাড়িয়া,
লুক্কায়িত আছে সবে পাতালে পশিয়া!
সাধ্য কি দেবের পুনঃ হয় স্বর্গমুখ,
যাক্ কত কাল আরো ঘুচুক সে দুখ।
দৈত্যের প্রহার অঙ্গে যে করে ধারণ,
ফিরিবে না যুদ্ধে আর কখন সে জন।
বৃত্রাসুর থাকিতে, সে সৈন্য দেবতার
স্বর্গের দিকেও কভু চাহিবে না আর।
বোধ হয় প্রতিহারী, রক্ষক যাহারা,
অন্য কিছু শূন্যপথে দেখেছে তাহারা–
হয় কোন উল্কা কিংবা নক্ষত্র-পতন,
নিদ্রাঘোরে শূন্যপরে করেছে দর্শন।”
কহিলা সুমিত্র, “দৈত্যপতি, অন্যরূপ
বলিলা প্রহরিগণ, কহিয়া স্বরূপ।
গগনমার্গেতে দেব-অঙ্গের আভাস
দেখিয়াছে স্থানে স্থানে জ্যোতির প্রকাশ।
রক্ষক-প্রধানে ডাকি জিজ্ঞাসা করিলে,
বিদিত হইবে সর্ব স্বকর্ণে শুনিলে।”
দৈত্যেশ-আদেশে আসে রক্ষক-প্রধান
দাঁড়াইল সভাস্থলে পর্বত-প্রমাণ।
কহিলা দানবপতি, “কহ, হে ঋক্ষভ,
কি দেখিলা গত নিশি কিবা অনুভব?”
কহিলা ঋক্ষভ দৈত্য, “শুন দৈত্যনাথ,
ত্রিযামা রজনী যবে হেরি অকস্মাৎ,
দিকে দিকে চারিধারে ঈষৎ প্রকাশ,
জ্যোতির্ময় দেহ যেন উজলে আকাশ!
নক্ষত্র উল্কার জ্যোতিঃ নহে সে আকার;
জানি ভাল দেব-অঙ্গ-জ্যোতি যে প্রকার।
ভ্রম না হইল কভু ক্ষণকাল তায়,
চিনিলাম দেব-অঙ্গ-জ্যোতি সে আভায়।
ফুটিতে লাগিল ক্রমে ক্রমে দশদিকে,
যতক্ষণ অন্ধকার অংশুতে না মিশে।
দেখিলাম কত হেন সংখ্যা নাহি তার,
উঠিছে আকাশ-প্রান্তে ঘেরি চারিধার;
বহু দূরে এখন (ও) সে জ্যোতির উদয়–
দেবতা তাহারা কিন্তু কহিনু নিশ্চয়!”
বৃত্রাসুর জিজ্ঞাসিলা ঘুচাতে সন্দেহ
“ইন্দ্রের কোদণ্ডনাদ শুনিলা কি কেহ?
ইন্দ্র যদি সঙ্গে থাকে অবশ্য সে ধ্বনি
শুনিতে পাইত স্বর্গে সকলে তখনি!”
কহিলা ঋক্ষভ, “অন্য দানব যতেক,
ইন্দ্রের কোদণ্ডধ্বনি না শুনিলা এক!”
তখন দানব-ইন্দ্র বৃত্রাসুর কয়–
“দেবতা আসিছে সত্য কিবা তাহে ভয়?
একবার অস্ত্রাঘাতে পাঠাই পাতাল,
এইবার একেবারে ঘুচাব জঞ্জাল।
ইন্দ্র সঙ্গে নাই, যুদ্ধে পশিছে দেবতা,
বাতুল হয়েছে তারা কি ঘোর মূর্খতা!
সঙ্কল্প করিনু অদ্য শুন দৈত্যকুল,
সঙ্কল্প করিনু হের স্পর্শিয়া ত্রিশূল–
সূর্যেরে রাখিব ক’রে রথের সারথি,
চন্দ্র সন্ধ্যামুখে নিত্য যোগাবে আরতি,
পবন ফিরিবে সদা সম্মার্জনী ধরি,
অমরার পথে পথে রজঃ স্নিগ্ধ করি।
বরুণ রজক-বেশে অসুরে সেবিবে,
দেবসেনাপতি স্কন্দ পতাকা ধরিবে,
নির্ভয়ে সকলে নিজ নিজ স্থানে যাও,
সুমিত্র, নৈমিষারণ্যে ভীষণে পাঠাও।”
কহিয়া এতেক বৃত্রাসুর দৈত্যপতি,
সভা ভাঙ্গি সুমেরুর দিকে কৈলা গতি।
এখানে ত্রিদিব জুড়ে ছুটিল সংবাদ,
স্বর্গপুরী পূর্ণ করি হয় সিংহনাদ।
বাজিল দুন্দুভিধ্বনি শিখরে শিখরে,
কোদণ্ড-টঙ্কারে যেন গগন শিহরে।
প্রাচীরে প্রাচীরে উড়ে দৈত্যের পতাকা,
শিবের ত্রিশূল-চিহ্ন শিবনাম আঁকা।
মহা কোলাহলে পূর্ণ হৈল সর্বস্থল,
সাজিল দানবসাজে দানব সকল।
বৃত্রাসুর-পুত্র বীর রুদ্রপীড় নাম,
সুধন্য দানব-কুলে, দেখিতে সুঠাম।
ভূষিত ললাটদেশ, বিশাল উরস,
বাল্যকাল হ’তে যার অসীম সাহস,
সজ্জিত মাণিকগুচ্ছ কিরীট-শীরষে,
দেবতা আসিছে যুদ্ধে শুনিয়া হরষে,
সুমিত্রের করে ধরি, কত সে উল্লাস,
উৎসাহ-হিল্লোলে ভাসি করিল প্রকাশ,
মহাযোদ্ধা বৃত্রপুত্র, পূর্বের সমরে,
লভিলা বিপুল যশঃ যুঝিয়া অমরে।
আবার আসিছে যুদ্ধে দেবতা সকল,
শুনিয়া উৎসাহে মত্ত হৈলা মহাবল।
চলিলা মন্ত্রীর সহ আপন আলয়ে,
আন্দোলিয়া নানা কথা যুদ্ধের বিষয়ে।
স্বর্গদ্বারে দ্বারে চলে দৈত্য মহারথী,
হর্যক্ষ বিপুলবক্ষে পূর্বে কৈলা গতি।
ঐরাবণী বল যার ঐরাবণ প্রায়,
পশ্চিমে চলিলা বেগে নদী যেন ধায়।
শঙ্খধ্বজ দৈত্য–যার শঙ্খের নিনাদে
অমর কম্পিত হয়–উত্তর আচ্ছাদে।
দক্ষিণেতে সিংহজটা–সিংহের প্রতাপ
চলিলা দুর্ধর্ষ দৈত্য ভয়ঙ্কর দাপ।
স্বর্গের প্রাচীর ক্রমে দৈত্য কোটি জন–
ভীষণ–নৈমিষারণ্যে করিলা গমন।