প্রেম

আমরা ঘুমায়ে থাকি পৃথিবীর গহ্বরের মতো ,-
পাহাড় নদীর পারে অন্ধকারে হয়েছে আহত
একা- হরিণীর মতো আমাদের হৃদয় যখন !
জীবনের রোমাঞ্চের শেষ হলে ক্লান্তির মতন
পাণ্ডুর পাতার মতো শিশিরে শিশিরে ইতস্তত
আমরা ঘুমায়ে থাকি !- ছুটি লয়ে চ’লে যায় মন !-
পায়ের পথের মতো ঘুমন্তেরা প’ড়ে আছে কত,-
তাদের চোখের ঘুম ভেঙ্গে যাবে আবার কখন !-
জীবনের জ্বর ছেড়ে শান্ত হয়ে রয়েছে হৃদয় ,-
অনেক জাগার পর এইমতো ঘুমাইতে হয় ।

অনেক জেনেছে ব’লে আর কিছু হয় না জানিতে ;
অনেক মেনেছে ব’লে আর কিছু হয় না মানিতে;
দিন- রাত্রি- গ্রহ- তারা- পৃথিবী- আকাশ ধ’রে-ধ’রে
অনেকে উড়েছে যারা অধীর পাখির মতো ক’রে,-
পৃথিবীর বুক থেকে তাহাদের ডাকিয়া আনিতে
পুরুষ পাখির মতো ,- প্রবল হাওয়ার মতো জোরে
মৃত্যুও উড়িয়া যায় !- অসাড় হতেছে পাতা শীতে,
হৃদয়ে কুয়াশা আসে,- জীবন যেতেছে তাই ঝ’রে
পাখির মতন উড়ে পায়নি যা পৃথিবীর কোলে –
মৃত্যুর চোখের’পরে চুমো দেয় তাই পাবে ব’লে !

কারন, সাম্রাজ্য – রাজ্য- সিংহাসন – জয়-
মৃত্যুর মতন নয় ,- মৃত্যুর শান্তির মতো নয় !
কারন , অনেক অশ্রু – রক্তের মতন অশ্রু ঢেলে
আমরা রাখিতে আছি জীবনের এই আলো জ্বেলে !
তবুও নক্ষত্র নিজে নক্ষত্রের মতো জেগে রয় !-
তাহার মতন আলো হৃদয়ের অন্ধকারে পেলে
মানুষের মতো নয়,- নক্ষত্রের মতো হতে হয় !
মানুষের মতো হয়ে মানুষের মতো চোখ মেলে
মানুষের মতো পায়ে চলিতেছে যত দিন ,-তাই ,-
ক্লান্তির পরে ঘুম,- মৃত্যুর মতন শান্তি চাই ১

কারণ , যোদ্ধার মতো – আর সেনাপতির মতন
জীবন যদিও চলে ,- কোলাহল ক’রে চলে মন
যদিও সিন্ধুর মতো দল বেঁধে জীবনের সাথে ,
সবুজ বনের মতো উত্তরের বাতাসের হাতে
যদিও বীণার মতো বেজে ওঠে হৃদয়ের বন
একবার-দুইবার- জীবনের অধীর আঘাতে ,-
তবু- প্রেম- তবু তারে ছিঁড়ফেড়ে গিয়েছে কখন !
তেমন ছিঁড়িতে পারে প্রেম শুধু !- অঘ্রাণের রাতে
হাওয়া এসে যেমন পাতার বুক চ’লে গেছে ছিঁড়ে !
পাতার মতন ক’রে ছিঁড়ে গেছে যেমন পাখিরে !

তবু পাতা – তবুও পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে,
বনের শাখার মতো – শাখার পাখির মতো হয়ে
হিমের হাওয়ার হাতে আকাশের নক্ষত্রের তলে
বিদীর্ণ শাখার শব্দে – অসুস্থ ডানার কোলাহলে ,
ঝড়ের হাওয়ার শেষে ক্ষীণ বাতাসের মতো বয়ে,
আগুন জ্বলিয়া গেলে অঙ্গারের মতো তবু জ্বলে
আমাদের এ জীবন ! – জীবনের বিহ্বলতা সয়ে
আমাদের দিন চলে,- আমদের রাত্রি তবু চলে;
তার ছিঁড়ে গেছে ,- তবু তাহারে বীণার মতো ক’রে
বাজাই ,- যে প্রেম চলিয়া গেছে তারি হাত ধ’রে !

কারণ , সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে
প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি;- তাই রাখিয়াছে ঢেকে
পাখির মায়ের মতো প্রেম এসে আমাদের বুকে !
সুস্থ ক’রে দিয়ে গেছে আমাদের রক্তের অসুখ !-
পাখির শিশুর মতো যখন প্রেমেরে ডেকে ডেকে
রাতের গুহার বুকে ভালোবেসে লুকায়েছি মুখ,-
ভোরের আলোর মতো চোখের তারায় তারে দেখে !-
প্রেম কি আসেনি তবু ? –তবে তার ইশারা আসুক!
প্রেম কি চলিয়া যায় প্রানেরে জলের ঢেউয়ে ছিঁড়ে !
ঢেউয়ের মতন তবু তার খোঁজে প্রাণ আসে ফিরে !

যত দিন বেঁচে আছি আলেয়ার মতো আলো নিয়ে ,-
তুমি চ’লে আস প্রেম, – তুমি চ’লে আস কাছে প্রিয়ে !
নক্ষত্রের বেশি তুমি, – নক্ষত্রের আকাশের মতো !
আমরা ফুরায়ে যাই ,- প্রেম তুমি হও না আহত !
বিদ্যুতের মতো মোরা মেঘের গুহার পথ দিয়ে
চ’লে আসি ,- চ’লে যাই ,- আকাশের পারে ইতস্তত !-
ভেঙে যাই ,- নিভে যাই ,- আমরা চলিতে গিয়ে গিয়ে !
আকাশের মতো তুমি ,- আকাশে নক্ষত্র আছে যত ,-
তাদের সকল আলো একদিন নিভে গেলে পরে,-
তুমিও কি ডুবে যাবে, ওগো প্রেম, পশ্চিম সাগরে !

জীবনের মুখে চেয়ে সেইদিনো রবে জেগে ,- জানি
জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি ,-
ঘুমন্ত ফুলের মনো নিবন্ত বাতির মতো ঢেলে
মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায় ,- তুমি তারে জ্বেলে
চোখের তারার’পরে তুলে লবে সেই আলোখানি !
সময় ভাসিয়া যাবে ,- দেবতা মরিবে অবহেলে ,-
তবুও দিনের মেঘ আঁধার রাত্রির মেঘ ছানি
চুমো খাবে !- মানুষের সব ক্ষুধা আর শক্তি লয়ে
পূর্বের সমুদ্র ওই পশ্চিম সাগরে যাবে বয়ে !

সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন !
সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি ,- তোমার আসন
সকল স্থলের’পরে,-সকল জলের’পরে আছে !
যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে
হে প্রেম তোমার ! – যেইখানে শব্দ নাই তুমি আলোড়ন
তুলিয়াছ !- অঙ্কুরের মতো তুমি,- যাহা ঝরিয়াছে
আবার ফুটাও তারে !- তুমি ঢেউ ,- হাওয়ার মতন !
আগুনের মতো তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে !
আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ চুমি
আমার বুকের’পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি !

জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন
তুমি আছ ব’লে প্রেম,- গানের ছন্দের মতো মন
আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ ব’লে!
হৃদয় গন্ধের মতো –হৃদয় ধূপের মতো জ্ব’লে
ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন !
ওগো প্রেম ,-বাতাসের মতো যেই দিকে যাও চ’লে
আমারে উড়ায়ে লও আগুনের মতন তখন !
আমি শেষ হব শুধু , ওগো প্রেম , তুমি শেষ হলে !
তুমি যদি বেঁচে থাকো ,- জেগে রবো আমি এই পৃথিবীর’পর,-
যদিও বুকের’পরে রবে মৃত্যু ,- মৃত্যুর কবর !

তবুও ,- সিন্ধুর জল-সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো বয়ে
তুমি চ’লে যাও প্রেম ;- একবার বর্তমান হয়ে ,-
তারপর , আমাদের ফেলে যাও পিছনে –অতীতে,-
স্মৃতির হাড়ের মাঠে ,- কার্তিকের শীতে !
অগ্রসর হয়ে তুমি চলিতেছ ভবিষ্যৎ লয়ে –
আজো যারে দেখ নাই তাহারে তোমার চুমো দিতে
চ’লে যাও !- দেহের ছায়ার মতো তুমি যাও রয়ে ,-
আমরা ধরেছি ছায়া ,-প্রেমেরে তো পারিনি ধরিতে !
ধ্বনি চ’লে গেছে দূরে ,- প্রতিধ্বনি পিছে প’ড়ে আছে ;-
আমরা এসেছি সব ,- আমরা এসেছি তার কাছে !

একদিন-একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা !
একরাত- একদিন করেছি মৃত্যুর অবহেলা ।
একদিন-একরাত ;- তারপর প্রেম গেছে চ’লে ,-
সবাই চলিয়া যায় ,- সকলের যেতে হয় ব’লে
তাহারো ফুরাল রাত !- তাড়াতাড়ি প’ড়ে গেল বেলা
প্রেমেরও যে !- একরাত আর একদিন সাঙ্গ হলে
পশ্চিমের মেঘে আলো একদিন হয়েছে সোনেলা !
আকাশে পুবের মেঘে রামধনু গিয়েছিল জ্ব’লে
একদিন ;- রয় না কিছুতে তবু ,- সব শেষ হয় ,-
সময়ের আগে তাই কেটে গেল প্রেমের সময় !

একদিন- একরাত প্রেমেরে পেয়েছি তবু কাছে !-
আকাশ চলেছে ,- তার আগে আগে প্রেম চলিয়াছে !
সকলের ঘুম আছে- ঘুমের মতন মৃত্যু বুকে
সকলের ;- নক্ষত্রও ঝ’রে যায় মনের অসুখে ;-
প্রেমের পায়ের শব্দ তবুও আকাশে বেঁচে আছে !
সকল ভুলের মাঝে যায় নাই কেউ ভুলে-চুকে
হে প্রেম তোমারে !-মৃতেরা আবার জাগিয়াছে !-
যে ব্যথা মুছিতে এসে পৃথিবীর মানুষের মুখে
আরো ব্যথা-বিহ্বলতা তুমি এসে দিয়ে গেলে তারে ,-
ওগো প্রেম ,- সেই সব ভুলে গিয়ে কে ভুলিতে পারে !

গল্পের বিষয়:
কবিতা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত