আমারই চেতনার রঙে

যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর

ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’

-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।

আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে; পাখিডাকা ছায়াঢাকা গ্রাম যাকে বলে। আর ছেলেবেলা বলতে দশ বছর বয়েস পর্যন্ত। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটা ঠিক সেভাবে চোখে পড়ে নি সে বয়েসে। তাই যখন শহরে গেলাম পড়তে, গ্রামের সবুজ নয়, বরং গ্রামের মানুষগুলো আর অলস দুপুরের জন্য মন খারাপ হতো। আমার সব সময়েই মনে হয় অলস দুপুর ব্যাপারটা একেবারে গ্রামের নিজের জিনিস। গ্রামের সকাল শুরু হয় শহুরে সকালের অনেক আগে; ঘড়ির কাটায় নয়, মোরগের ডাকে। তাই গ্রামের দিনগুলো হয় লম্বা। শহুরে বাবুরা যতক্ষণে বাস-ট্যাক্সি ঠেঙ্গিয়ে অফিসে গিয়ে পৌঁচ্ছুচ্ছেন, ততক্ষণে গ্রামের কর্মঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। তাই দুপুরের আগেই একপ্রস্থ কাজ শেষ করে জিরিয়ে নেয়া যায়। গ্রামের কাজ দু’বেলা: সকালে আর বিকেলে। আর দুপুরবেলা শুধুই দুপুরবেলা: গোসল, খাওয়া, তারপর গাছের ছায়ায় আড্ডা বা পাটি বিছিয়ে ঘুম। গ্রামে কাউকে বলতে শুনি নিঃ রেখে দে, এ কাজটা দুপুরে করবো। গ্রামের দুপুর মানেই আমার কাছে অলস দুপুর।।

পল্লীর কোল থেকে আলো ঝলমলে শহরে সরে আসা (প্রচলিত অর্থে) একটু ভালো করে বাঁচবার জন্য। অল্প কয়েকজন হয়তোবা আসে জীবনকে আরেকটু ভালো করে বুঝবার জন্য। দশ বছর বয়েসে বেরিয়ে শহরে শহরে কাটিয়ে দিলাম গত বিশটা বছর। যতই সময় পেরুচ্ছে, ততই গ্রামে ফিরে যাবার ইচ্ছে তীব্রতর হচ্ছে: আমার চিরচেনা মল্লিকাবনে। শহরে পূজির মেলা পকেট ভারি করার একটা আশ্বাস দেয় বটে, কিন্তু শহর মনকেও ভারি করে দেয় বড়ো। পূজি নিয়ে কাড়াকাড়ির মধ্যে একটু অলস দুপুর খুঁজে নিয়ে মনের ভেতরে ঘুরে আসার অবসরটুকু শহরে মেলে না। অথচ আমি বিশ্বাস করি সেই মানসিক ভ্রমণেই সুখের নিবাস।।

আমার সবসময়েই মনে হয়েছে সুখের বিস্তার একমুখী: অন্দর থেকে বাহিরে। “পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে”। বৈষয়িক বৈভব, সম্মান, এমনকি একের পর এক সাফল্যও মনে সুখ আনতে পারে না যদি না সে নিজেকে সুখী মনে করেঃ সুখী হবার সিদ্ধান্ত না নেয়। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও সুখ আসলে একটা মানসিক সিদ্ধান্ত। জাগতিক অর্জনের সাথে আকাঙ্ক্ষা যদি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাহলে সুখ হয়ে থাকে কুহকিনী। আমাদের কী আছে তার উপর সুখের মাত্রা নির্ভর করে না, নির্ভর করে আমরা আরো কতটা চাই তার উপর। তাই যে মুহুর্তে মনের সাথে “আমি সুখী” এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপোষ করা যায়…সেই মুহুর্তেই দশদিকে সুখের বাতাস বইতে শুরু করে। অন্তত আমার অহর্নিশি এমন হয়।

পড়ছিলাম জীবনানন্দের কবিতা “বলিল অশ্বথ সেই”। কবিতাটি এক অর্থে সাদামাটা; খুব সহজ চিত্রকল্প; অন্তত মহাপৃথিবী পর্যায়ে জীবনানন্দের অন্যান্য কবিতা থেকে বেশ সহজ মনে হয় প্রথম পড়ায়। প্রথম স্তবকটা এরকমঃ

“বলিল অশ্বত্থ ধীরে: ‘কোন দিকে যাবে বলো-

তোমরা কোথায় যেতে চাও?

এতদিন পাশাপাশি ছিলে, আহা, ছিলে কত কাছে:

ম্লান খোড়ো ঘরগুলো-আজও তো দাঁড়ায়ে তারা আছে;

এই সব গৃহ মাঠ ছেড়ে দিয়ে কোন দিকে কোন পথে ফের

তোমরা যেতেছ চলে পাইনাকো টের!

বোঁচকা বেঁধেছ ঢের,-ভোলো নাই ভাঙা বাটি ফুটা ঘটিটাও;

আবার কোথায় যেতে চাও?”

সুতরং, শুরুটা একটি অশ্বত্থ গাছের সাথে কথোপকথন দিয়ে। জীবনানন্দীয় বিচারে খুব একটা অভিনব কিছু নয়। পেঁচা, নক্ষত্র এবং আকাশের সাথে কবির কথোপকথনে আমরা অভ্যস্ত। মনে পড়ে নিরালোক কবিতার কথা

“অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে সন্ধ্যার আকাশ– এই রাতের আকাশ;

এইখানে ফাল্গুনের ছায়া মাখা ঘাসে শুয়ে আছি;

এখন মরণ ভাল,– শরীরে লাগিয়া রবে এই সব ঘাস;

অনেক নক্ষত্র রবে চিরকাল যেন কাছাকাছি।

কে যেন উঠিল হেঁচে,– হামিদের মরখুটে কানা ঘোড়া বুঝি!

সারা দিন গাড়ি টানা হল ঢের,– ছুটি পেয়ে জ্যোৎস্নায় নিজ মনে খেয়ে যায় ঘাস;

যেন কোনো ব্যথা নাই পৃথিবীতে,– আমি কেন তবে মৃত্যু খুঁজি?

‘কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?’– চাপা ঠোঁটে বলে কৌতুকী আকাশ।”

সত্যি বলতে বলিল অশ্বত্থ সেই কবিতার সাথে নিরালোক কবিতার বেশ ভাবগত মিল আছে। দু’টি কবিতাই বলছে নিজের ভেতরের আকংখার আরো গভীর নিশানা বের করতে। অশ্বত্থ গাছটি যেমন প্রশ্ন করছে, “আবার কোথায় যেতে চাও?” আকাশ তেমনি চাপা ঠোঁটে প্রশ্ন করছে, “কেন মৃত্যু খোঁজো তুমি?”

সুতরাং ব্যাপারটা এখানে প্রকৃতির সদা শান্ত-তৃপ্ত বনাম মানবিক সদা অত্রৃপ্ত ্মন্ত্রের। পথপ্রান্তে মহাকালের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি দেখেছে ঢের…সে জানে মানবের চিরন্তন নিরূপম যাত্রার আদ্যেপান্ত…

‘পঞ্চাশ বছরও হায় হয়নিকো-এই-তো সেদিন

তোমাদের পিতামহ, বাবা, খুড়ো, জেঠামহাশয়

-আজও, আহা, তাহাদের কথা মনে হয়!-

এখানে মাঠের পারে জমি কিনে খোড়ো ঘর তুলে

এই দেশে এই পথে এই সব ঘাস ধান নিম জামরুলে

জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্খার বেদনার শুধেছিল ঋণ;

দাঁড়ায়ে-দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যে,-মনে হয় যেন সেই দিন!

‘এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?

সেই পথে আরও শান্তি- আরও বুঝি সাধ?

আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?

তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্খার ঘর!”

শেষের কয়েকটি পংক্তিতে বিদগ্ধ অশ্বত্থ ঘোষণা করে, এই চলে যাওয়া নিষ্ফল: স্থানাঙ্ক পরিবর্তনে আকাঙ্ক্ষা, জীবনের পিপাসা মিটবে না।

“যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর

ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’

-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।”

জীবনের চিরায়ত যে বিপণ্ণ বিস্ময় তার সাথে ভৌগলিক সীমারেখা বা আর্থিক প্রাচুর্যের সম্পর্ক সামান্যই। অশ্বত্থের কাছ থেকে আমরা এর চেয়ে বেশি জ্ঞান কিছু পাই না। তবে নিরালোকের আকাশ আর নক্ষত্র কিন্তু আরো উদার…তারা সমাধান বাতলে দিচ্ছে…

“ঝাউফুলে ঘাস ভরে– এখানে ঝাউয়ের নীচে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে;

কাশ আর চোরকাঁটা ছেড়ে দিয়ে ফড়িং চলিয়া গেছে ঘরে।

সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে কোন্‌ ঘরে যাব!

কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই,- চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে শান্তি আমি পাব?

রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্‌ পথে যাব ?

‘তোমারই নিজের ঘরে চলে যাও’– বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে–

‘অথবা ঘাসের ‘পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালবেসে;”

সুতরাং সে-ই আবার নিজের কাছে ফিরে আসা। নিজের কাছে, প্রকৃতির কাছে। এদিক দিয়ে মহাপৃথিবীর জীবনানন্দ রাবীন্দ্রিক দর্শনের থেকে হয়ত খুব দূরে ননঃ

“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শিষের উপরে

একটি শিশিরবিন্দু।”

সপ্তাহান্তের বিরল অবসরে মহাপৃথিবী আর রূপসী বাংলার পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হয়, বরিশাল ছেড়ে কলকাতাতে চাকরি খুঁজে বেড়ানো মধ্যবয়েসী জীবনানন্দকে ছেলেবেলার জীবনানন্দ বড্ড উৎপাত করতো। সেই উৎপাতের সারাৎসারে জীবনানন্দের যে উচ্চারণ তা প্রায়শ আমারই মর্মযাতনার বর্ণরূপ হয়ে কানে বাজে।।

গল্পের বিষয়:
কবিতা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত