রাজসভায় মাধবী
(একটি সংলাপ কাব্য)
(গৌড়বঙ্গের অধীশ্বর লক্ষ্মণসেন দেবের রাজসভা। রাজার দুপাশে বসে আছে কয়েকজন মন্ত্রী ও কবি। এদের মধ্যে আছে রাজার বাল্যসুহৃদ ও প্রতিপত্তিশালী মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র, প্রবীণ মন্ত্রী উমাপতিধর, রাজগুরু গোবর্ধন আচার্য এবং তিন সভাকবি: জয়দেব, শরণ ও ধোয়ী। রাজকার্যের বদলে এখন সভায় কাব্যচর্চা চলেছে।]
লক্ষ্মণসেন : ভ্রমর, ভ্রমর! কেন মনে হয় মানুষের চেয়ে
ভ্রমরেরা বেশি সুখী! বসন্ত পবনে যত কাব্যের ভ্রমর
আপনারা ভাসিয়ে দেন তারা সব আনন্দের মণি,
অতৃপ্ত মানুষ তবে ভ্রমরের নামে দেয় প্রাণের উপমা
ধোয়ী : অতৃপ্ত মানুষ! এই সাগর মেখলা পুণ্যভূমি—
বীরশ্রেষ্ঠ, প্রজাপূজ্য, দানশৌণ্ড রাজা যার অধীশ্বর
সে রাজ্যে তো অসুখী বা অতৃপ্ত মানুষ কেউ নেই
শরণ : একটি ভ্রুক্ষেপে আপনি জয় করেছেন গৌড়লক্ষ্মী, আর
নিতান্ত খেলার ছলে বিজিত কলিঙ্গদেশ, শুধু
অঙ্গুলি হেলনে ক্লিষ্ট চেদীরাজ, কাশী ও মগধ
আপনার পদসেবী, অভিমান-হৃত কামরূপ
নিদাঘ সূর্যের মতো আপনার তেজে দগ্ধ অবাধ্য, দুর্জন
মহারাজ, আপনার মুখে কেন অতৃপ্তির কথা?
জয়দেব : অতৃপ্তি তো রাজরোগ। এরই জন্য পররাজ্য জয়
স্বয়ং কেলিনায়ক যিনি, তাঁরও কণ্ঠে শোনা যায় রতি
হাহাকার
যে রাজা জঙ্গমহরি, তিনিও কি নন আরও যশের
ভিখারি
যিনি যাচকের কল্পদ্রুম, হায় নিজের যাজ্ঞা কি তাঁর
কখনো মিটেছে?
[বাইরে কিসের যেন কোলাহল। রাজা স্থির নেত্রে দ্বারের দিকে তাকালেন। হলায়ুধ মিশ্র হাঁক দিয়ে বললেন, দৌবারিক, দেখো তো!]
ধোয়ী : এই স্নিগ্ধ গঙ্গাদেশ, অসংখ্য কুসুম সুবাসিত
মধুলোভী অলিকুল পারিজাত বন ছেড়ে মেঘ হয়ে
আসে
ভূভারতে এরকম শান্তিময় দেশ আর দ্বিতীয় নেই
লক্ষ্মণসেন : আবার ভ্রমর! কবিবর, উপমায়, অলঙ্কারে
এই পতঙ্গটি নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে যেন!
দৌবারিক : রাজসন্দর্শন চায় এক গুচ্ছ নারী ও পুরুষ
মনে হয় তারা ক্ষুব্ধ…
ধোয়ী : ক্ষুব্ধ? এই শব্দটি কি সঠিক হলো হে, দৌবারিক?
তারা প্রার্থী হতে পারে, এই রাজ্যে ক্ষুব্ধ কেউ নয়
হলায়ুধ মিশ্র : আসুক দুজন প্রতিনিধি, যুগ্ম নারী ও পুরুষ।
অন্যেরা দূরত্বে থাক…
[সভাস্থলে মাধবী ও কঙ্কের প্রবেশ। মাধবী আলুলায়িত কুন্তলা, ফুরিতধরা, একবস্ত্রা। তার চক্ষুদুটি কিছুক্ষণ আগে অধৌত হবার কারণে এখন অত্যুজ্জ্বল। তপ্তকাঞ্চনবর্ণা এই সদ্য যুবতীটি বিবাহিতা। সঙ্গের লোকটি তার ভাই, সে রক্তাম্বর পরিহিত। পুরুষটি রাজা ও অন্যদের অভিবাদন জানালো, নারীটি রইলো অধোবদনে।]
হলায়ুধ মিশ্র : যা কিছু বলার আছে, সংক্ষেপে বলো
কঙ্ক : সসম্মান পুরঃসর নিবেদন এই, মহারাজ,
দক্ষিণ নগরবাসী সার্থবাহ সম্প্রদায় প্রতিভূ আমরা
এসেছি নিতান্ত বাধ্য হয়ে সুবিচার প্রত্যাশায়
আপনার গুণ গান মনস্বী ও নিঃস্বগণ সমস্বরে গায়
আপনার বাক্য যেন স্বর্ণসম সুদৃঢ়, সুন্দর
ন্যায় ও অন্যায় আছে তুলাদণ্ডে, হে দীনপালক…
রাজা : সুবিচার? কিসের বিচার?
কঙ্ক : বিদ্যুল্লেখার মতো নিষ্কলঙ্ক, তেজস্বিনী, এই যে বালিকা
আমারই সহোদরা, এর দুভার্গের কথা কী করে যে
বলি।
ঐ যে সুপ্রাচীন মহামন্ত্রী, তিনি তো জানেন সব
[কঙ্ক রাজসভার এক প্রান্তে উপবিষ্ট প্রবীণ মন্ত্রী উমাপতিধরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলো।]
রাজা : জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ উমাপতি, আপনি কি চেনেন এঁদের?
উমাপতি : বিলক্ষণ চিনি, মহারাজ, জলপ্রপাত তাড়িত
অরণ্য প্রাণীর মতো এরা এসেছিল একদিন।
অন্যায়ের প্রতিকার প্রার্থনায়
রাজা : আপনার কাছে এসেছিল? তবে সেই তো যথেষ্ট
আপনি কি দেননি বিধান?
উমাপতি : দিইনি, পারিনি দিতে এমনও ঘটনা কিছু ঘটে
বিচারকও বিচারপ্রার্থীর মতো অসহায় হয়
রাজা : ঠিক বোধগম্য যেন হলো না কথাটা। দোষী অথবা
নির্দোষ
বেছে নিতে ভুল হয় আপনার মতো এত প্রাজ্ঞ
মানুষেরও?
উমাপতি : ভুল নয়, মহারাজ, দ্বিধা
রাজা : দ্বিধা?
শরণ : আহা, বিচারপ্রার্থীরা যদি সশরীরে উপস্থিত
ওদের স্বমুখে তবে শোনা যাক সমুদয় কাহিনী বর্ণন
ধোয়ী : ঠিক ঠিক
রাজা : তোমরা নির্ভয়ে বলল, কী বিচার চাও
কঙ্ক : মহারাজ, ভগিনীর দুর্ভাগ্যের কথা এত সজ্জন সমীপে
বর্ণনা করার মতো শব্দশাস্ত্রজ্ঞান নেই, যদিও আমার…
যদিও আমার…
বক্ষ ফেটে যেন এক নাগরূপী মহাক্ষোভ মুক্তি পেতে
চায়
রাজা : শান্ত হও
হলায়ুধ মিশ্র : শান্ত হও, নাগরিক, সুস্থির নিশ্বাস নাও আগে
গোবর্ধন আচার্য : বরং প্রতিবাদিনী নিজেই বলুক তার কথা
শরণ : ঠিক ঠিক
ধোয়ী : এই রমণীরই মুখে শোনা যাক কী তার কাহিনী
[মাধবী ধীরে মুখ তুলে তাকালো, কিন্তু তার মুখে কোনো কথা ফুটল না।]
রাজা : শুভমস্তু, হে কল্যাণী,
কী জন্য এসেছো, বললো, অসঙ্কোচে বলো
ধোয়ী : রাজার প্রসন্নদৃষ্টি ধন্যা তুমি, বলো
জয়দেব: দৃষ্টোসি তুষ্টা বয়ম
শরণ : উপস্থিত সভাসদ সবাই উদগ্রীব
গোবর্ধন আচার্য : কে তুমি, রমণী, অগ্রে পরিচয় দাও
মাধবী : হে রাজন, সমুদয় গুণিজন, আমি এক বণিক দুহিতা
সিংহেন্দ্রদত্তের কন্যা, পুস্তপাল অচ্যুতভদ্রের পুত্রবধূ
প্রবাসে আছেন স্বামী দীর্ঘকাল
গোবর্ধন আচার্য : অচ্যুতভদ্রের পুত্র? বসুশিব? সে তো বহুদিন
নিরুদ্দেশ
মাধবী : নিরুদ্দিষ্ট নন, তাঁর সপ্তডিঙা ফেরেনি এখনো
অজ্ঞাত সন্ধানী তিনি দূরতর দ্বীপে ভ্রাম্যমাণ
নতুন বাণিজ্য বস্তু নিয়ে ফিরবেন
রাজা : স্বামী নিরুদ্দেশে, এই নবীন বয়সে তুমি একা
কঙ্ক : না, না, মহারাজ, একা নয়, পিত্রালয়ে
এবং শ্বশুর কুলে অনেক আত্মীয়বন্ধু আছে
আমাদের ভগিনীটি বড় আদরের
ধোয়ী : তোমার ভগ্নীকে নিজ মুখে বলতে দাও
রাজা : তুমি চাও, রাজসৈন্য, রণতরী ছুটে যাক তোমার
স্বামীর কুশল সন্ধানে?
মাধবী : সেজন্য আসিনি, মহারাজ
আমি ঠিকই জানি তিনি ফিরবেন, কথা দেওয়া
আছে।
রাজা : তবে?
মাধবী : রমণীর অধিকার আছে কি না সসম্মানে জীবন যাপনে
এসেছি সে কথা জানতে। এই রাজ্যে নারীর মর্যাদা
যদি কেউ কেড়ে নেয়, সেই পাবে রাজ অনুগ্রহ?
রাজা : অলীক, অদ্ভুত প্রশ্ন। সনাতন ধর্ম অনুসারে
এ রাজ্য শাসন হয়, যদি কেউ অপর নারীকে
লোলুপ দৃষ্টিতে দেখে, তপ্ত তৈলে তার দুই চোখ
চির অন্ধকার হবে, এরকমই রয়েছে বিধান।
মাধবী : লোলুপ দৃষ্টিতে শুধু নয়, মহারাজ, এক প্রবল পুরুষ
প্রতিদিন নখ আর দন্ত দিয়ে ছিঁড়ে নিতে চায়
আমার সন্ত্রম।
রাজা : সে কি! কে সে নরাধম? এই রাজ্যে কে আছে এমন
ধোয়ী : এ যে অসম্ভব
উমাপতি : নাম বলল, হে মাধবী, স্পষ্টাক্ষরে, মুক্ত কণ্ঠে বলো
মাধবী : মহারাজ…
রাজা : বলো সে পাপীর নাম, পূর্বাহ্নেই অভয় দিয়েছি
মাধবী : প্রোষিতভর্তৃকা আমি, মহারাজ, তবু নই নিঃস্ব অসহায়
ভাই বন্ধু পরিজন, আছে আরও বহুতর স্নেহের
আড়াল
কাব্য-সঙ্গীতের সুধা ভরে রাখে নিজস্ব সময়
কখনো আকাশ দেখি, দূর বনানীর রেখা চক্ষু টেনে
নেয়
এই সব নিয়ে বেশ সুখে থাকা
একা একা গড়ে তোলা নিজস্ব ভুবন
একি কোনো অপরাধ?
রমণীর একাকিত্বে সুখ ভোগে নেই অধিকার?
উমাপতি : যে তোমার নিজস্ব ভুবনখানি মত্তহস্তীসম
বারবার দলে দিয়ে যায় তার পরিচয় দাও
মাধবী : নদীতে অবগাহনে সুখ ছিল, এক দর্পী পুরুষের হাত
কেড়েছে নদীর পথ, নদীও আমার দুঃখ জানে
অলিন্দে দিগন্ত রেখা…সেখানেও মূর্তিমান বাধা
আমার সঙ্গীত সাধা প্রতিদিন ভাঙে এক লোভীর
চিৎকারে
এমন কি রাজপথে প্রকাশ্য দিনের মধ্যে বাহু চেপে
ধরে ক্ষ
মতান্ধ এক যুবা আমাকে আঁধার দিকে নিয়ে যেতে চায়
রাজা : কে সে নরাধম? তার আয়ু আমি কেড়ে নেবো এক
লহমায়
নাম বলো
মাধবী : সকলেরই পরিচিত সেই নাম, শ্রীমান কুমারদত্ত,
তিনি…
রাজা : শ্রীমান কুমারদত্ত! অর্থাৎ..অর্থাৎ…
উমাপতি : আপনার নিজের শ্যালক, মহারানী বল্লভার প্রিয় ভ্রাতা
সুতরাং মহারাজ, এবার বুঝবেন, আমি সব কিছু জেনে
জনতার সাক্ষ্য নিয়ে, তবু কেন বিচারে হয়েছি অপারগ
রাজা : এ যে অবিশ্বাস্য! এ যে নিতান্ত সুদূরতম স্বপ্নেরও
অতীত
বীরশ্রেষ্ঠ, ন্যায়শীল, ধীমান কুমারদত্ত এরকম পাপী?
না, মন্ত্রী উমাপতি, অবশ্যই কিছু ভ্রান্তি ঘটেছে
কোথাও
কিছুতে কুমার নন, অন্য কেউ, অবয়বে কুমার সদৃশ!
উমাপতি : অন্তত পঞ্চাশজন স্বচক্ষে দেখেছে, তারা কুমারকে
চেনে
কঙ্ক : যদি অন্য কেউ হতো, অন্য কোনো কুলাঙ্গার, তবে
নিজ হাতে
এক খগাঘাতে তার মুণ্ড ছিন্ন করে এনে
দিতাম চরণে, মহারাজ
হলায়ুধ মিশ্র : প্রসীদ, প্রসীদ! ওহে সার্থবাহ, বিস্মৃত হয়ো না
রাজার সম্মুখে তুমি কথা বলছো
কঙ্ক : সদ্যোজাত সারণীর মতন পবিত্র এই ভগিনী আমার
সে জানে না কপটতা, অনৃত ভাষণ
জয়দেব : হে কমলাননা নারী, হে বরবর্ণিনী, আরও মন খুলে
বলো
তোমার বাক্যের রঙে দীপ্ত এই রাজসভা, এ যেন
সাগরে
দিগন্ত মায়ার আলো, সহসা মরুতে নীপকন
হে সুন্দরী বলল দেখি, কাব্যপ্রিয়, ধীমান, কুমার
সে কি শুধু তস্কর, দস্যুর মতো লোভী?
প্রণয় রহস্য বড় গুঢ়, তার মর্ম শুধু দুজনায় বোঝে
তোমার মুখের জ্যোৎস্না, ওষ্ঠের অমিয় দেখে
মুনিঋষিরাও
বিচলিত হতে পারে, কুমার তো সামান্য মানুষ!
শরণ : কুমার কি কামবশে তোমার শরীর স্পর্শ করেছে?
অথবা
রচেছে বন্দনা, স্তুতি? সে তো কিছু দোষণীয় নয়
ধোয়ী : যেন সশরীর রতিপতি, সুপুরুষ বহু ললনার প্রিয়
ধীমান কুমারদত্ত প্রণয় কলায় সুনিপুণ, তার প্রতি
তোমার এমন ক্রোধ স্বাভাবিক নয়. তবে, সুন্দরী,
তুমি কি
পুর্ব কোনো প্রতিশ্রুত স্মরণ-বেদনা নিয়ে এসেছো
এখানে?
উমাপতি : বাঃ বাঃ চমৎকার? অতি চমৎকার, হে মহান
রাজকবিগণ
সম্মুখে রয়েছে এক কাতর হরিণী, এক দুঃখদগ্ধ নারী
অপমান বিষে যার সর্বাঙ্গে বিষম জ্বালা, পাণ্ডুর কপোল
তার হৃদয়ের হাহাকারে বুঝি কবিদের করুণা জাগে
না?
আপনারা শুনতে চান রসালো প্রণয় গল্প, অথবা নতুন
রচনার বিন্দু বিন্দু উপাদান খুঁটে খুঁটে নিতে চান বুঝি?
জয়দেব : (স্বগত) আগে রূপ,শরীরের রহস্য কাহিনী, পরে মর্মের
সন্ধান
প্রথমেই মন নিয়ে টানাটানি যে করে সে মুর্খ, কবি
নয়!
রাজা : কে সঠিক অনাচারী, পুনরায় ভেবে বলো
নারী শাস্তির যে যোগ্য তার কিছুতে নিস্তার নেই এই
গৌড়ভূমে
মাধবী : যদি মিথ্যা বলে থাকি…
জিহ্বা যেন শতখণ্ড হয়ে খসে পড়ে
যদি মিথ্যা বলে থাকি….
বাক হোক রুদ্ধ, চক্ষে নিবে যাক জ্যোতি
যদি মিথ্যা বলে থাকি…
জননীও ভুলে যাবে এ কন্যার কথা
মহারাজ, শুধুমাত্র রাজ অনুগ্রহ বলে বলী যে পুরুষ
নারীকে লুণ্ঠনযোগ্য মনে করে, সে রয়েছে এ
রাজপ্রাসাদে
দুঃশীল কুমারদত্ত, আর কেউ নয়!
উমাপতি : মহারাজ, দীপ্তিময় এ নারীর প্রতিটি অক্ষর সত্য
[হঠাৎ সভাস্থলে পাটরানী বল্লভার দ্রুত প্রবেশ]
বল্লভা : মিথ্যা! মিথ্যা! এইসব কথা
মিথ্যার কুটিল জাল…
রাজা : এ কী, মহারানী!
এই রাজসভা মধ্যে…না, না, ফিরে যাও
সামান্য এ রাজকার্য দ্রুত সেরে আমি যাব তোমার
সন্নিধে
বল্লভা : সামান্য এ রাজকার্য? চেড়ীর বর্ণনা শুনে এসেছি
এখানে
আপনি সরলমতি, ক্ষমাশীল, সে সুযোগে ষড়যন্ত্রীগণ
সর্বনাশ করে দিত আমার আড়ালে!
রাজা : না না, সেরকম কিছু নয়। এ তো দৈনন্দিন বিচারের
সভা
কিসের বা ষড়যন্ত্র? মান্যগণ্য সভাসদ আছেন এখানে
বল্লভা : আপনি নীরব হয়ে শুনুন আমার কথা, আমি সব জানি
মহাষড়যন্ত্রী ঐ যে উমাপতিধর মন্ত্রী, আর এ কুলটা
এই দুই কালসর্প…
উমাপতি : আমি ষড়যন্ত্রী? মহারাজ, আচম্বিতে সভাস্থলে
এরকম পরিহাসও রুচিযোগ্য নয়
বল্লভা : সাধু সাজছেন! ভেবেছেন বুঝি পূর্বকথা কিছু মনে
নেই?
আপনি প্রাচীন ঘুঘু, স্বর্গবাসী মহামতি বল্লাল সেনের
আমল থেকেই জানা গেছে আপনার মতি গতি, সে
সময়
ছিলেন আমার স্বামী যুবরাজ, দিবানিশি রাজার সম্মুখে
করেননি যুবরাজ-নিন্দা, তাঁকে সিংহাসন বঞ্চিত করার
দেননি কি কুমন্ত্রণা?
উমাপতি : আরে ছি ছি, সব ভুল জেনেছে, বিপরীত জেনেছেন,
রানী,
সে সময় বর্তমান মহারাজ যৌন চাপল্যে কিছুদিন
ছিলেন বিপথগামী, শস্ত্রে কিংবা শাস্ত্রে ছিল অনাসক্তি
ঘোর
যে কারণে দুরন্ত অশ্বের মুখে বন্ধু টেনে এঁটে দিতে
হয়
সে জন্যই ওঁর সংযমের জন্য উপদেশ দিয়েছি
পিতাকে সিংহাসন অন্যে পাবে, এরকম কথা আমি কদাচ
ভাবিনি।
বল্লভা : তখন ভাবেননি, তবে আজ ভাবছেন, তাই এই
রমণীকে
কল্পিত কাহিনী দিয়ে, আবেগে সাজিয়ে এনেছেন
সভাস্থলে
উমাপতি : এ নারীর স্পষ্ট এক অভিযোগ আছে
বল্লভা : কুচক্রে বপন করা, স্বার্থলোভী শয়তানের মস্তিষ্ক প্রসূত
সে সব রটনা
উমাপতি : শত শত নাগরিক সাক্ষ্য দেবে!
বল্লভা :প্রজা-বিদ্রোহের হীন, কুটিল চক্রান্ত! সব জানা হয়ে
গেছে
এ জগতে অর্থবশ কে নয়? অর্থের লোভে মিথ্যা
সাক্ষী কত!
আর এই পাপীয়সী, রঙ্গময়ী বারনারী, সর্বাঙ্গে নরক
মিথ্যা হাসি কান্না যার নিত্যসঙ্গী, মিথ্যা অঙ্গভঙ্গি অস্ত্র
যার
তার কথা শুনে কেউ বিচলিত হয় যদি
কঙ্ক : সাবধান! সাবিত্রীর মতো পুণ্যশীলা
সীতাসমা সাধ্বী এই ভগিনী আমার
তার নামে যদি কেউ অপবাদ দেয়, তবে তিনি যেই
হোন, আমি তাঁকে
হলায়ুধ : মূঢ়, দুরে সরে যাও, রাজেন্দ্রাণী কথা বলছেন
রাজা: রানী, এইখানে এসে বসো, অপর পক্ষের কথা কিছু
শুনি
বল্লভা : পরন্তপ, এই সব কটুকথা শোনাও বিষম ভুল, পাপ
এই দেহ পসারিনী কী কথা জানাতে চায় তাও আমি
জানি
মাধবী : সামান্য বণিকবধূ আমি, মহারানী, অতি গুণবান স্বামী
পেয়েছি অনেক ভাগ্যে…
বল্লভা : চুপ চুপ! শুধু কি বণিকবধূ, বারাঙ্গনা, বারবধূ তুই
মাধবী : আমার স্বামীর মতো এ জীবনে আর অন্য পুরুষ দেখিনি
বল্লভা : তোর নষ্ট স্বভাবের জন্য তোর স্বামী দুঃখে নিরুদ্দেশে
গেছে।
পুরুষ-শিকারি তুই, ভেবেছিস ফাঁদ পেতে, ছলাকলা
দিয়ে
আমার ভাইকে পাবি? তবে শোন, শত শত অনূঢ়া
রূপসী
কুমারদত্তের শুধু ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ব্যর্থ হয়ে আছে
তুই কে রে, পদনখধূলি!
মাধবী : আপনি যা বললেন, তাতে কোনো সত্য নেই
বল্লভা : সত্য, সত্য, আমি যা বলেছি তা-ই ধ্রুব সত্য, এই শেষ
কথা
মাধবী : শুধু বুঝি রানীদেরই সত্যে আছে পূর্ণ অধিকার?
বল্লভা : কাম-পূতি গন্ধ-মাখা, বন্দর-উচ্ছিষ্ট ভোজী, দূর হ! দূর
হ!
রাজা : হুঁ, এবার বোঝা গেল। ছলাকলা পটীয়সী এই ধুরন্ধরী
কুমারদত্তের নামে কলঙ্ক লেপন করে আমারই সুনাম
নষ্ট করতে চেয়েছিল, শাস্তি এরই প্রাপ্য। তবু এবারের
মতো
ক্ষমা করা গেল!
যাও নারী, গৃহে যাও, সুসংবৃত হও!
গোবর্ধন আচার্য : কেমন বিচার হলো? সাক্ষ্য প্রমাণাদি কিছু দেখাই
হলো না
হলায়ুধ মিশ্র : চুপ! রাজারানী কথা বলছেন, অন্য কারো অধিকার
নেই
মাধবী : মহারানী, আমার প্রণম্যা আপনি, শুধু এই জিজ্ঞাসা
আমার না
রী হয়ে নারীত্বকে ধুলোয় লুটোতে দেখে কখনো
আপনার
হয় না একটুও খেদ?
নারী নির্যাতনে যদি নারীর ভূমিকা এত নির্মম, নির্দয়
হয়, তবে প্রতিকার চেয়ে আর কার কাছে যাবো?
ভ্রাতৃস্নেহে অন্ধ আপনি, তবু তো আমারই মতো
আপনিও নারী
বল্লভা : ফের তোর ছোট মুখে বড় কথা? দূর হ! দূর হ!
মাধবী : যাবো, তবে তার আগে আরও একটি সরল প্রশ্নের
সদুত্তর পেতে চাই, যে-দেশের রাজকন্যা ছিলেন
একদা
সে দেশে কি বহু বল্লভার ছড়াছড়ি? সে দেশের
রমণীরা
পুরুষের সামান্য ইঙ্গিত পেলে শরীরের সব খুলে
দেয়?
পরস্ত্রী-বারস্ত্রী কোনো ভেদ নেই, সেই দেশে নারী ও
পুরুষ
সকলেই স্বেচ্ছাচারী? আপনিও কি যেথা সেথা শয্যা
পেতেছেন
পুরুষের অহঙ্কার তুষ্ট করবার অভিলাষে?
বল্লভা : ওরে পিশাচিনী, তোর এত স্পর্ধা? তবে এই মুহূর্তেই
শমন সদনে যাবি তুই
[বল্লভা মাধবীর চুলের গুচ্ছ মুঠিতে ধরে তাকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করতে লাগলো। ক্রুদ্ধ কঙ্ককে সরিয়ে নিয়ে গেল প্রহরীরা। গোবর্ধন আচার্য একটি খন্তা তুলে মারতে গেলেন মহারানীকে, তাঁকে বাধা দিল হলায়ুধ মিশ্র। অন্যান্য সভাকবিরা নির্বাক। রাজার চিবুক তাঁর বুকে ঠেকেছে।]
মাধবী : মারো, আরো মারো, দেখি তুমি হিংস্রতায়
কত দূর যেতে পারো
বল্লভা : আজ তোর শেষ! যদি ইষ্টনাম কিছু থাকে সেই জপ
কর
চেড়ী, চেড়ী
অগ্নি নিয়ে আয় এই বেশ্যাটাকে জীয়ন্তে
পোড়াবো
মাধবী : যদি না পোড়াও
আমি প্রায়োপবেশনে প্রাণ বিসর্জন দেবো
এই রাজসভা আজ কিছুতে যাবো না ছেড়ে, যদি না
সম্মান ফিরে পাই
এই রাজসভা আজ মৃত্যু গন্ধে ধন্য হয়ে যাবে
যে শরীরে পুরুষের লোভ সেই রক্ত মাংস
পোকা পতঙ্গের খাদ্য হবে
যে সমাজ রমণীর দেহটাই চেনে শুধু, হৃদয় চেনে না
সেখানে বাঁচতেও ঘৃণা হয়! আমি এতকাল ভেবেছি
আমার কত কিছু আছে, এই আকাশের নীল আলো,
নদীর সঙ্গীত
বৃষ্টিস্নাত দিনের সুষমা, অসীম নক্ষত্রলোক, বৃক্ষছায়া…
হঠাৎ বুঝেছি আজ পুরুষের কাম-প্রেম-আদেশ বা স্তু
তি
এর চেয়ে আর কিছু প্রাপ্য নেই নারীর জীবনে!
বল্লভা : প্রতিহারী!
এই প্রগল্ভাকে নিয়ে যাও, দুরে নগর প্রান্তের
পরিখায় ছুঁড়ে ফেলে দাও
মাধবী : পরিখায় কেন, পয়ঃপ্রণালীর গর্ভে কিংবা অতল
সাগরে
মৃত্যু যেখানেই হোক, মৃত্যু শুধু মৃত্যু, তার অন্য রূপ
নেই
শুনে রাখো শেষ কথা
যে-দেশে নারীরা শুধু খাদ্য আর ভোগ্য, পুরুষের
ইচ্ছাদাসী
সে দেশে বাঁচার কোনো সাধ নেই, এই রাজ্য রাজধানী
যাবে
কালগ্রাসে
যে রাজত্বে জননী ও জায়া ভগ্নী, স্বাধীনা নারীর নেই
স্থান
সেই রাজা কোনো দিন প্রতিষ্ঠা পাবে না, তার শিরে
বজ্রপাত হবে!
গোবর্ধন আচার্য : ছেড়ে দাও, হলায়ুধ, যদি আর এক দণ্ড থাকি
এ পাপ পুরীতে
নিঃশ্বাসের বিষে মরবো, ভ্রাতঃ, ছেড়ে দাও
হলায়ুধ মিশ্র : যাও, নগরীর বাইরে চলে যাও
[এই সময় কুমারদত্তের প্রবেশ। ঈষৎ স্খলিত কণ্ঠে সে মাধবীর নাম ধরে ডেকে উঠলো]
কুমারদত্ত : মাধবী, মাধবী, কোথা তুমি প্রাণাধিকে
মাধবী : ষোলো কলা পূর্ণ হতে এটুকুই বাকি ছিল, এসো হে
কুমার
শরীর চেয়েছে, নাও
সহস্র চোখের সামনে, প্রহরী বেষ্টিত হয়ে, সগৌরবে
নাও
তোমার স্পর্শের বিষে সেই মুহূর্তের আগে উড়ে যাবে
প্রাণ
কুমারদত্ত : শরীর তো নয় শুধু, মাধবী, তোমাকে আমি আরও
বেশি কিছু
মনে ভাবি, কল্পনা ঐশ্বর্যময়ী তুমি,
শব্দ-বর্ণ-গন্ধ মেখে সন্ধ্যার নির্জনে
তোমার সঙ্গীত সুধা, তোমার মাধুর্য, সব পেতে চাই
বল্লভা : কুমার, এখানে নয়, প্রহরীরা এ দুষ্টাকে শাস্তি দেবে
তুমি চলো বিশ্রামের কক্ষে, হাত ধরো
কুমারদত্ত : এ রমণী রত্নটিকে সঙ্গে নিয়ে যাবো
বল্লভা : না, না
কুমারদত্ত : কেনই বা না না বলছো? নিতে হবে, পেতে হবে,
আমার বাসনা
প্রত্যাখ্যান পছন্দ করে না
বল্লভা : কুমার, আমার সঙ্গে চলো দাঁড়াও!
রাজা : বল্লভা, এ কী বিপরীত রীতি, তুমি ভ্রাতাকে
দেখেই
আমাকে উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছো
কুমারদত্ত : দিদি, এই জরফ্গবটি আর কতদিন?
বল্লভা : চুপ, ওরে চুপ
রাজা : দৌবারিক, দ্বার রুদ্ধ করো
কঠিন শৃঙ্খলে বাঁধো এই অপরাধ কর্মী প্রমত্ত যুবাকে
বল্লভা : এ কী কথা, মহারাজ? এ রকম রক্ত চক্ষু, স্বেদময় মুখ
আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ঠিক নয়, শান্ত হোন! আমি
উপস্থিত
রয়েছি এখানে, তবু কুমারের অঙ্গ স্পর্শ করার সাহস
কার আছে?
কে এমন দুঃসাহসী…
রাজা : আমি! যদি বাধা আসে, তবে নিজ হাতে তরবার
ধারণ করতেই হবে। এই যুবতীর অভিশাপ বাক্য
শুনে
আতঙ্কে কম্পিত বুক। রানী, তুমি, সত্য বটে প্রেয়সী
আমার
তার চেয়ে প্রিয়তর এই দেশ, এই যুদ্ধ দীর্ণ মাতৃভূমি
কোনো ক্রমে ধরে আছি, সহসা এ নির্যাতিত নারীর
ক্রন্দনে
কেঁপে উঠলো সিংহাসন, মনে হলো পায়ের তলায়
চোরাবালি
চতুর্দিকে হাহাস্বর, আকাশে অশুভ ছায়া, প্রলয়-ইঙ্গিত
শুনি যেন অশ্বধ্বনি, ধেয়ে আসে বুঝি মহাকাল…
ওঠো হে মাধবী, তুমি শুধু নারী নও, তুমি বিশ্বের
মানবী
তুমি মাতা-কন্যা-প্রিয়া, উঠে এসো, দুই চক্ষু থেকে
মুছে ফেল অশ্রু ও অনল
ঐ পাপীর শাস্তি আমি নিজে দেবো, আজ ওর বক্ষের
শোণিতে
তোমার ললাটে আমি এঁকে দেবো জয়ের কুঙ্কুম,
দৌবারিক
ওকে নিয়ে এসো—
মাধবী : থাক থাক মহারাজ, রক্তপাতে প্রয়োজন নেই
রক্ত সন্দর্শনে তৃপ্ত হয় যে রমণী, সে কখনো
প্রকৃত মানবী নয়, আমি প্রতিহিংসাপরায়ণা নারী নই
কুমার তো কেউ নয়, সহস্রের একজন, আমার সমূহ
অভিমান
ছিল আপনার প্রতি, যেখানে বিচার অন্ধ, স্বজন
নির্দোষ
সেই গ্লানি মুক্ত করেছেন, আপনি ধন্য, আর কিছু
প্রার্থনীয় নেই
রাজা : তুমি এই পরস্ব লোভীকে ক্ষমা দিতে চাও?
মাধবী : ওকে দিন বনবাস। কিছুদিন প্রকৃতির সবুজ সেবায়
অন্তর পবিত্র হোক, মুছে যাক চক্ষের কলুষ
যার এই ধরণীর প্রতি প্রেম নেই, সেই মানুষ কখনো
নারীর প্রেমিক হতে পারে?
উমাপতি : স্বস্তি, স্বস্তি! হৃদয়বৃত্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ যে করুণা
হে মাধবী, তুমি তা জেনেছে
সমবেত স্বর : শান্তি, শান্তি, শান্তি, শান্তি!