নীরা, হারিয়ে যেও না
আমাদের ছিল প্রতিদিন জন্ম বদলের দিন
আকাশে ভাঙা কাচের টুকরোর মতন আলো
বিপরীত দিগন্ত থেকে প্রবাসিনীর মতন দ্বিধান্বিত পায়ে
এগিয়ে এলে তুমি
সমস্ত শরীরময় শ্বেত হংসীর পালক, গলায় গুঞ্জাফুলের মালা
আমি ভয় পেয়েছিলুম
তখন তো বেড়াতে আসার সময় নয়, অনেকেই যাচ্ছে নির্বাসনে
তখন হিংসেয় জ্বলছে শহর, মানুষের হাতের ছুরি গেঁথে যাচ্ছে
মানুষেরই বুকে
রাস্তায় বসে লাশের আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছে ধর্ম
রক্তবমির মতন ওগরাচ্ছে দেশপ্রেম
আমি চিলেকোঠায় বন্দি, তোমাকে চিনতে পারিনি
তারপর আমি একটা ছোট নোটবুক নিয়ে লাফ দিয়ে উঠে গেলুম
নিবিড় নীলিমায়
তুমি তখন দক্ষিণেশ্বর ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে,
চোখের মণিতে নদী
নগরীতে প্রগাঢ় রাত্রির নির্জনতা, ঢং ঢং করে বাজছে
সমস্ত স্কুলের ঘণ্টা…
আমাদের ছিল প্রতিদিন জন্ম বদলের দিন
মনে আছে, তুমি গুহা মানবীর মতন সহসা কৈশোর ছিঁড়ে
খুব ভোরবেলায় শীতের নরম রক্তিম সূর্যকে আলিঙ্গনে, আদরে
জড়ালে
হরি ঘোষ স্ট্রিটের কদমগাছটি থেকে তখন টুপটুপ করে
ঝরে পড়ছে হীরের কুচি
দিনের প্রথম তীক্ষ ট্রাম বলতে বলতে গেল, জাগো, জাগো
রিভলভিং স্টেজের মতন উল্টোপাল্টা এই দুপুর, এই মধ্যরাত, এই
সন্ধ্যা
আমি তখন গলা ফাটাচ্ছি মিছিলে, নাক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত
চতুর্দিকে লকলক করছে খিদে
আঃ সেই মায়াময়, ভিখিরির, যযাতির খিদে
কুম্ভীপাক নরকের মতন পেট মোড়ানো খিদে
এক এক পলক দেখতে পাচ্ছি বারান্দায় ব্যাকুল মাতৃমূর্তি,
পাখির মতন চোখ
স্বপ্ন ছিল, দুনিয়ার সমস্ত মা-ই একদিন
সব কুচো কুচো বাচ্চাদের ধোঁয়া-ওঠা ভাত
বেড়ে দেবে
কলেজ স্ট্রিটের সেই বুলেট ও বিস্ফোরণ
তুমি বাস থেকে নামলে, তক্ষুনি সেই বাসে শুরু হলো
বারুদ উৎসব
এক দৌড়ে পার্কের রেলিং টপকে কে যেন দণ্ডির ভঙ্গিতে
শুয়ে পড়লো
ঘাসে মুখ গুঁজে।
আমাদের ছিল প্রতিদিন জন্ম বদলের দিন
তুমি রমণী ছিলে, নীরা হলে
আমি দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে সাজলুম ওষুধ-গুদামের কেরানি
জুতোর স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে, রাস্তার মুচির কাছে বসেছি
উবু হয়ে
কেউ চিনতে পারছে না, পিঠের দিকে সবাই অচেনা
কখনো আমিই মুচি, সে পথচারি
কখনো আমিই রাস্তা, লোকে হেঁটে যাচ্ছে আমার
বুকের ওপর দিয়ে
কখনো আমি নীরবতা, আমিই অস্থির গর্জন
তুমি অন্ধ বৃদ্ধকে পয়সা দিলে, শিয়ালদার ঘড়িটি থেমে গেল
ট্রেন থেকে নেমে এত মানুষ দৌড়চ্ছে, সবাই থমকে গেল
কয়েক মুহূর্ত
তারপরই ঝনঝন শব্দে শুরু হলো প্রচুর ভাঙাভাঙি টি
য়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় পুলিশ কাঁদছে, চীনেরা ভাই-ভাই মানলো না
ইস্তাহারের ধাক্কায় রাস্তা খোঁড়া গর্তে ছিটকে পড়ে অনেকেরই
পা মচকে গেল
তিনটে জ্যান্ত ছানা মহানন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে নর্দমায়
লাল চুলওয়ালা একদল সাহেব ফরাসি ক্যামেরায় তুলে নিয়ে গেল
সেই ছবি
তুমি পরীক্ষার হলে একা বসে রইলে, প্রশ্নপত্র এলো না
আমি নিচু হয়ে খুঁজছি ফুটো পকেটের খুচরো পয়সা
তুমি কুসুম সমারোহে গিয়ে পতাকার মতন উড়িয়ে দিলে আঁচল
আমি সারা সন্ধে শুয়ে রইলুম শ্মশানের পাশে।
আমাদের ছিল প্রতিদিন জন্ম বদলের দিন
সমস্ত ম্যাজিক দৃশ্যের ওপরেই এসে পড়ে শরীরের বিভা
কবিতার মধ্যে উকি মারে শরীর, কখনো তা ছায়া,
কখনো রক্ত মাংসের অবাধ্যতা
এক একবার ড়ুবে যায়, এক একবার মুখোমুখি এসে বসে
কালিদাসের ভ্রমর ছুঁয়ে দিল তোমার স্ফুরিত ঠোঁট
ঘাস ফুল হয়ে আমি তোমার নাভিমূলে জিভ রাখি
মদিগ্লিয়ানির নারীর মন তোমার রম্ভোরুতে ঝলমল করে জ্যোৎস্না
একবার আমি শিশু, তুমি চিরকালের জননী
একবার তুমি অতি বালিকা, এক স্বৈরাচারী রাজা
চেয়েছে তোমাকে
সমুদ্র প্রবল ঢেউ তুলছে আকাশের দিকে
আকাশ নেমে আসছে পাতালে
যোনিপদ্মের ঘ্রাণ নিচ্ছে এক তান্ত্রিক
অতৃপ্ত মহামায়া বলছে, আরো, আরো
ওঃ সেই খেলা, সেই হৃদয়ের উন্মোচন
বসন্ত বিছানায় লেখা হলো কত শত রতি-ইতিহাস
গলা জড়াজড়ি করে দুজনে জানলার ধারে নির্বসন বসে থাকা
গোধূলি কিংবা ভোর
আমার হাতে সিগারেট, তোমার চুলে হিরন্ময় চিরুনি
ভুলে যাওয়া পৃথিবী ফিরে আসছে একটু একটু করে, অন্তরীক্ষে
মৃদু কণ্ঠস্বর
গোধূলি কিংবা ভোর, আকাশে বিন্দু বিন্দু সাতরং জলের ফোঁটা
সেইদিকে তুমি চেয়ে রইলে, এখন কোথাও বিমান উড়ছে না
কীটসের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তুমি আনমনে বকুনি দিলে নিউটনকে
তন্মুহূর্তে আমার আবার জন্মান্তর ঘটে গেল
নীরা, আমাদের ভুল ভেঙে যায়, আমরা ফের বালি দিয়ে ছোট ছোট
দুঃখের ঘর বানাই
আমরা এখনো ন্যাংটো বাচ্চাদের মতন ছোটাছুটি করছি
সমুদ্র তীরে
মাঝে মাঝে কী চমৎকার আড়াল, শতাব্দীর ঝাউবন
আমি তোমাকে দেখতে পাই না, আমি তোমার নামে কলম
ড়ুবিয়েছি দোয়াতে
আমি তোমাকে ছুঁইনি, তুমি গর্ভিণী হরিণীর মতন মিলিয়ে গেলে
পাহাড় প্রদেশে
এক একটা ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিক চক্রবাল
জাদুদণ্ড ঘোরালেই স্বর্গ থেকে নেমে আসা বিদ্যুৎ লহরী
প্রোথিত হচ্ছে ভূমিতে
সব কিছুই শব্দের কাটাকুটি, পৃষ্ঠা উল্টে যাওয়া
করতলের আমলকিটি দেখে নিচ্ছি মাঝে মাঝে, সে-ও আমাকে দেখে
মিটিমিটি হাসছে
নীরা, তুমি সুদূরতম নৌকোয় একা, ছড়িয়ে দিয়েছে দুই ডানা
আমি দুরন্ত মেলট্রেনে বসে একটাও স্টেশনের নাম
পড়তে পারছি না
তুমি স্কুল কমিটির দলাদলি থেকে সরে গেলে দরজার আড়ালে
আমি দুপুরের পর দুপুর কাটিয়ে দিচ্ছি কাচ ঘেরা ঘরের চেয়ারে
অথচ কত নদী তীরের গাছের ছায়া খালি পড়ে আছে
যারা বিপ্লব এসে গেল বলেছিল, তারা লিখছে স্মৃতিকথা
আর যারা মুছে গেল, তারা বড় বেশিরকম মুছে গেল
লাল চুলওয়ালাদের ক্যামেরা এখনো ঘুরছে গলি-খুঁজির
আনাচে-কানাচে
কেউ আর ভালোবাসার কথা বলে না
মানুষের সভ্যতা ভালোবাসার কথা শুনলেই হাহা-হিহিতে ফেটে পড়ে
বাথরুমে মুখ ধুতে গিয়ে কেউ একা একা কাঁদে আর
জলের ঝাঁপট দেয়
নীরা, আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে, হারিয়ে যেও না
অনেক জন্ম বদল বাকি আছে, হারিয়ে যেও না
নীরা, অমৃত খুকী, হারিয়ে যাস নি!