দুটি আহ্বান

দুটি আহ্বান

দুটি আহ্বান

ঠাণ্ডা ঘরে রিভলভিং চেয়ারে যে ধোপদুরস্ত মানুষটি
বসে আছে
টেবিলের নীচে তার খালি পা
গাঢ় ভুরু, কণ্ঠস্বরে প্রতিষ্ঠার স্ববিরোধ
চশমায় বিচ্ছুরিত ব্যক্তিত্ব, হাতের আঙুলে সিগারেট ধরার
অবহেলা
কেউ জানে না সকাল থেকে তার নিম্ন উদরে ধিকিধিকি ব্যথা
একটা আগুন, যা কিছুই পোড়ায় না, শুধু জ্বলে
একটা অন্যমনস্কতা, যা কোথাও যায় না, মনের চারপাশেই
ঘুর ঘুর করে
সে চোখ তুললে দুজন আগন্তুক, তখনই সে শুনতে পেল
রাত্রির সমুদ্রগর্জন!

সেদিন চাঁদ টেনেছিল সমুদ্রকে
সেদিন সমুদ্রের গর্ভ থেকে লাফিয়ে উঠেছিল এক
উচ্চাকাঙ্ক্ষী ঝিনুক
বাতাসে পূর্বপুরুষদের দীর্ঘশ্বাসের রলরোল
আকাশ নেমে আসে খুব কাছাকাছি, কয়েক লহমার জন্য
তখনই একটা বিদ্যুতের হাত, এক ঝলকের তীব্র বাসনা
ছুঁড়ে দিন একটা মালা
ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে দুলতে দুলতে
আসবে কিংবা ফিরে যাবে, একবার গভীরে, একবার তীরের দিকে
কখনো দীপ্ত, কখনো অন্ধকারময়
কখনো কৈশোর স্মৃতি, কখনো সব হারানোর মতন রক্তিম…
বালির ওপরে অন্ধকারে বসে আছে এক বালির মূর্তি
একটু আগে প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেছে তাই মানুষেরা সব ছাদের নীচে
চলে গেছে
দিগন্ত শুধু, একজনেরই জন্য
সিন্ধু সারসেরা ট্রি ট্রি ডাকছে
প্রেমের চেয়েও তীব্র, মাতৃস্নেহের মতন আদিম একটা টান
জীবন বদলের একটা মুহূর্ত
খিদে-তেষ্টা তুচ্ছ করা এক অধীর অপেক্ষা
সব কিছুই অন্য রকম হয়ে যেতে পারে, অন্য রকম, অন্য রকম
বালির স্তূপ ভেঙে উঠে দাঁড়ানো বোম ভাঙা শার্ট
আর ছেঁড়া চটি পরা, দাড়ি কামানো মুখ, একটি তেইশ বছর
সে কি বাল্মীকি না রত্নাকর এখনো
পেছন থেকে ভেসে আসছে কাদের ডাক, কারা তার জামা ধরে
টানছে
সে ছুটে যেতে গেল জলের দিকে
কোনো নারী তার সামনে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়ালো না
তবু সে শেষ মুহূর্তে ঘুরে গেল অন্য দিকে
সমুদ্রের মালা মিলিয়ে গেল, হাওয়ায় উড়ে এলো একটি
খয়েরি খামের চিঠি…
সেই পাহাড়ের কোনো কৌলিন্য নেই
চূড়ায় নেই মন্দির, সানুদেশে নেই নিসর্গ লোভীদের
ব্যস্ততা
নাম-না-জানা বনের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা সরু পথ
সেই পথ, সেই পাহাড় এতদিন তাকে ডেকেছিল
এমন ডাক আসে ঘুমের মধ্যে, এমন ডাক আসে আকস্মিক অপমানের
প্রতিশোধের মতন
কেউ বলেছিল কয়লা খনিতে কালো হয়ে এসো
কেউ বলেছিল, স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে ধুলো কুড়িয়ে আনো
কেউ বলেছিল চোখের জল দিয়ে ওষুধ বানাও
ভাঙো অরণ্য, বিষ মেশাও শিশুদের শরীরে
শব্দ ও অক্ষরের মধ্যে বুনে দাও চকচকে রুপোলি লোভ
নারীকে দেবীর আসন দাও, তারপর তার গর্ভপাত করো
বসে থেকো না, দৌড়োও, সবাই দৌড়োচ্ছে, পায়ে পা দিয়ে ফেলে দাও
সামনের জনকে
সেই রকম একদিন হঠাৎ সে নিমন্ত্রণ পেল
সবুজ শাওলায় ঢাকা লোমশ একটি পাথর অপেক্ষা করছে
তার জন্য
ঘোর অপরাহ্বে তার জন্য প্রতীক্ষা করেছে
পাহাড়ে হেলান দেওয়া এক টিলা
অভিমুখী পথুটিতে অনেক দিন কেউ যায় নি, তবু চিনতে
অসুবিধে নেই
দুপাশের বন তুলসীর ঝাড়ে বাল্য প্রেমের সৌরভ
প্রথম কোনো স্তন স্পর্শের মন কাঁপছে পৃথিবী
নভোলোকের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে নিস্তব্ধতা
সেই পাথরের বেদী, একটি নিঃসঙ্গ শিমুল গাছ তাকে কিছু দেবে
যা অন্য কেউ পায় নি
সে জানে, সে জানে, সে ছুটে যাচ্ছে
তবু যাওয়া হলো না
জুতোর পেরেকে রক্তাক্ত হলো তার পা, সে বসে পড়লো মাটিতে
তখনই সে শুনতে পেল পাতা খেলানো বাঁশির শব্দ
পা ক্ষত বিক্ষত হলে সামনে যাওয়া যায় না, পেছন ফেরা যায়
অনায়াসে
সেই বাঁশির সুরে দুলতে লাগলো তার মাথা
সে কবে পোষা সাপ হয়ে গেছে সে নিজেই জানে না…

চেয়ারটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে, চোখ থেকে চশমা খুলে
সে বললো, এখন সময় নেই, ব্যস্ত আছি, ব্যস্ত আছি
খুব ব্যস্ত…

গল্পের বিষয়:
কবিতা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত