প্রতিটি স্বাভাবিক রাতের মতই ঘুমাতে গিয়েছি সেই রাতে।
অবলীলায় বিছানায় এলিয়ে দিয়েছি ক্লান্ত শরীর।
অজান্তেই দুচোখ বন্ধ হয়ে গেছে ঘুমের শাসনে।
সেদিনের ঘুমেও আমি স্বপ্ন দেখেছি আগের মতই।
মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙ্গেছিল।
এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়েছি নিশ্চিন্তে।
আমি জানতাম না সেই রাতের পরের সকাল দেখা হবেনা আমার।
জানতাম না পরের দিনের সূর্যের আলো পড়বে আমার শবদেহে।
আমার আলোহীন চোখ সূর্য দেখবে কিন্ত দেখবেনা সূর্যের আলো।
যখন সকাল হলো আমার কানে ভেসে আসলো মুয়াজ্জিনের আজান।
আমার মায়ের ডাক পড়লো কানে।
বাবা ডাকছেন মসজিদে যাওয়ার জন্য।
আমার স্ত্রী সন্তান আর পাশের ঘরের স্বজনরাও জেগেছে সবাই।
ঠিক ফজরের নামাজের পর আবার মা এলেন ডাকতে।
আমি সবার সবকিছু দেখছি, শুনছি, অনুভব করছি।
শুধু হারিয়ে ফেলেছি উত্তর দেয়ার ক্ষমতা।
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়ানোর সামান্য শক্তিও আমার নেই।
একে একে সবাই আসছে আমার ঘরে আর কান্নাকাটি করছে।
সবাই বলছে আমি নাকি মরে গেছি।
মৃত্যু আমাকে আলিঙ্গন করেছে বলেই নাকি আমি অবশ, নিথর, স্তব্ধ।
আমিও ঠিক তখনি বুঝলাম আমি মৃত।
আর উঠতে পারবোনা নিত্যকার মত।
আমার ইহলীলা সাঙ্গ হয়েছে সেই রাতেই।
তারপর শুরু হলো বাড়ীতে শোকের মাতম।
আমার আত্মীয় স্বজনেরা আসতে থাকলো কাঁদতে কাঁদতে।
শোকের পাহাড় কাঁধে নিয়ে আমারই শিয়য়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আমার বাবা।
চোখ যেন তার পাথর হয়ে গেছে।
আমার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন মাটিতে।
সবকিছু বুঝছিলাম আমি কিন্তু কিছু করার ছিলনা।
আমার স্ত্রীর অসহায় বিধবা মুখ আর সন্তানদের ভগ্নদশা দেখে ডুকরে কাঁদছিলাম আমিও।
কেউই শুনতে পায়নি আমার কান্না।
তারপর কানে ভেসে আসলো কে যেন বলছে আমার জানাজা নামাজের মাইকিংয়ের কথা।
মাইকিং হলো।
মসজিদের মাইকে ঘোষণা হলো আমার বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতার সময়।
করিম চাচা নাকি আরো দুজন মিলে আমার কবর খুঁড়েছিলেন।
আমার বাবা নিজ হাতে আমাকে গোসল করিয়ে দিলেন সেই শৈশবের মত।
আমার মাথায় যখন পানি ঢালছিলেন তখন দেখেছিলাম পানির মগটা রেখে চোখের পানি মুছতেছিলেন বাবা।
তারপর কাফনের কাপড় পরিয়ে আমাকে ঢেকে দিলেন চির জনমের মত।
অনেক কেঁদেছিল তখন আমার পরিচিত সবাই।
তারপর আমার দাফন হলো।
আমি কবরস্থানে শুয়ে শুয়ে দেখছি তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা।
এখনো আমার মা রোজ মোনাজাতে আমার জন্য দোয়া করেন।
বাবা দোয়া করেন মাঝেমধ্যেই।
আমার ভাইবোনেরা ব্যস্ত থাকে খুব।
তারা আমার কথা মনে করে বিশেষ দিনগুলোতে কিংবা কোনো উপলক্ষ আর আড্ডায়।
বন্ধুদের মাঝেমধ্যে আমাকে স্বরণ করতে দেখি কোনো সমাবেশ কিংবা বিশেষ স্মৃতিচারণে।
প্রতিদিন কম হলেও একশোজন পরিচিত মানুষ আমার কবর ঘেষে হেটে যায়।
আমি তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে অপলক।
ওরা ভুলেও তাকায়না আমার দিকে কখনোই।
মাঝেমাঝে ভাবি এরা এতকিছু ভুলে গেলো কি করে!
গতকাল বিকেলে যে আমার কবরের পাশে গাছ লাগানোর জন্য মাটি খুঁড়তেছিল।
সেই ছেলেটা আমার প্রিয় ছাত্র ছিল।
ও যখন আমার কবরের পাশে আসলো তখন আমি ভেবেছিলাম ও বোধহয় আমার কবর যিয়ারতের জন্য এসেছে।
প্রায় আধাঘণ্টা ছিল সে সেখানে।
কিন্তু একবার ভুলেও তাকায়নি আমার দিকে।
দুঃখ হয়নি একটুও।
আমার ছেলেরাই এখন আমার কবর দেখে সালাম দেয়না।
নামাজে হাত তুলে দোয়া করেনা আমার জন্য।
অথচ আমি মুখিয়ে থাকি ওদের একটু দোয়ার জন্য।
কখনো কখনো ওরা কবরের পাশে এলে আমি চিৎকার করে বলি, খোকা শোন, আমি খুব বিপদে আছি রে।
আমার জন্য একটু নামাজে দোয়া করিস খোকা।
তোরা দোয়া করলে আমি কবরে শান্তি পাই।
ওরা শোনেনা আমার চিৎকার।
ওরা ভুলেও মসজিদেই যায়না।
কি না করেছি আমি ওদের জন্য?
জীবনে যত অনৈতিক উপার্জন করেছি তার সবগুলোই ওদের জন্যই করেছি।
অথচ ওরা আজ আমার দিকে তাকায়না পর্যন্ত।
অবশ্য এখন আমার আর দুঃখ হয়না।
গতকাল আমার মা দুনিয়া ছেড়ে আমার কাছে এসেছেন।
এই একজন মানুষ আমার জন্য রোজ কাঁদতেন বলেই আমি চেয়ে থাকতাম দুনিয়ার দিকে।
এই একজন মানুষ রোজ নামাজে দোয়া করতেন বলেই আমি প্রত্যেক ওয়াক্তে আনন্দ পেতাম।
এখন আর সেই সুযোগ নেই।
ঐ স্বার্থপর দুনিয়ায় ভুলেও তাকাবোনা কোনোদিন।
আমার মায়ের সাথে গল্পে কাটাবো অফুরন্ত সময়।
হয়তো আবার মায়ের কোলেই ঘুমাব সেই শৈশবের মত।
ঘুম পাড়ানির গান শোনাতে শোনাতে হয়তো আমার সাথেই ঘুমিয়ে পড়বেন মা।
হয়তো…..
গল্পের বিষয়:
কবিতা