অগ্নিপুরুষ: ২.৯-১৩ বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস

অগ্নিপুরুষ: ২.৯-১৩ বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস

২.৯-১৩ বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস

০৯.

বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।

উদ্ধৃতিটা জানা আছে ডন বাকালার, এর সত্যতাও চাক্ষুষ করেছে সে। কিন্তু বন্দুকের একটা টার্গেট তো থাকতে হবে! নিজেকে তার সেই ভারোত্তোলনকারীর মত লাগল, তোলার মত কিছু পাচ্ছে না যে।

হতাশা আর নৈরাশ্য ভয়টাকে হৃষ্টপুষ্ট করে তুলল। বেরলিংগার ছিল ডান হাত, তার কূটনীতির একটা হাতিয়ার। বেরলিংগার খুন হওয়ায় একেবারে নিরস্ত্র, অসহায় লাগছে নিজেকে। ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু ট্যানডন আর বোরিগিয়ানোর চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। ডেস্কের ওধারে বসে টান টান। পরিবেশ থেকেই যা বোঝার বুঝে নিচ্ছে তারা। ডন বাকালার ভয় আর অসহায় বোধ হতভম্ব করে তুলেছে তাদেরকে, গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে তারা।

কিন্তু তবু বাকালা তাদের বস্। যা কিছু আছে তাদের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, সম্পদ, উচ্চাশা–সবই বাকালার ক্ষমতার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা। তাদের অন্য, কোন গতি নেই।

নির্দেশগুলো মন দিয়ে শুনছে তারা। ভিলা কোলাসির সিকিউরিটি আরও জোরদার করতে হবে। দুদিন আগে হলে বসের এই নির্দেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিত না। ভিলা কোলাসি বিশাল কোন ব্যাপার নয়, ছয়জন সশস্ত্র গার্ডের পাহারা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু আতুনি বেরলিংগারের মৃত্যু, মৃত্যুর ধরন, তাদের একটা চোখ। খুলে দিয়েছে। আরেকটা চোখ খুলেছে ডেস্কে পড়ে থাকা মোটাসোটা ডোশিয়েটা। একজন লোক সম্ভব-অসম্ভব, কত বিচিত্র কৌশলে ধ্বংস সাধন করতে পারে, কি ভয়ঙ্কর প্রত্যয় নিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে যে-কোন মাপের প্রতিরোধ ব্যবস্থা, ওই ডোশিয়ে না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন। ধ্বংস, বিনাশ, হত্যা আর রক্তপাত নিয়েই তাদের কারবার, কিন্তু এই লোকের তুলনায় তারা যেন এখনও মায়ের কোলে পড়ে দুধ খাচ্ছে।

বাইরে পাঁচিল, তার ওপাশে আরও দুশো মিটার জায়গায় ফ্লাডলাইটের আলো। চাই। আশেপাশে যত বিল্ডিং আছে সব কেনা শেষ, এবার ওগুলোকে বুলডোজার। দিয়ে মাটির সঙ্গে সমান করে দিতে হবে। ভিলার ভেতর প্রতি ইঞ্চিতে টহল পার্টির পা পড়বে, পালা করে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় থাকবে ওরা। নিউ ইয়র্ক থেকে যে চারজন এক্সপার্ট গেরিলা এসেছে, প্রত্যেক টহল পার্টির সঙ্গে ওদের একজন করে থাকবে। কুকুর জোড়া আজই এসে পৌঁছুবে, ভিলার সবার গন্ধ নিতে দেয়া হবে ওগুলোকে। যার গন্ধ চিনতে পারবে না, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। ফেলবে তাকে। সব মিলিয়ে বিশ বাইশ জন বডিগার্ড, তিন শিফটে কাজ করবে। ওরা। গেটে দুজন গার্ড থাকবে, তাদের একজন হবে মার্কিন গেরিলা। ভিলার গেট থেকে আধ কিলোমিটার দূরে একটা রোডব্লক থাকবে। তল্লাশি ছাড়া কোন। গাড়ি ওই রোডব্লক পেরোতে পারবে না। রোডব্লকে ছজন লোক থাকবে, দুজন। গাড়ি সার্চে এক্সপার্ট। কোন গাড়ি ভিলার ভেতর ঢুকতে পারবে না। অন্য কোন। ডন বা তাদের প্রতিনিধি ভিলায় ঢুকতে চাইলে, আধ ঘন্টার ভেতর একজনের বেশি ঢুকতে পারবে না, তাদের প্রত্যেককে নিখুঁতভাবে সার্চ করতে হবে কাপড়চোপড় খুলে নিয়ে। তারা ভিলার ভেতর ঢুকলেও, বাকালার সঙ্গে দেখা। করার জন্যে খাস কামরায় বা কামরার কাছাকাছি তাদের নিয়ে আসা যাবে না– যদি না বাকালা অনুমতি দেয়। পাচিলের ভেতর পঁচিশটা ফলের গাছ রয়েছে, সব কেটে ফেলতে হবে।

এবার পরিস্থিতির আরেক দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা। সিসিলিতে ঢোকার প্রতিটি পয়েন্টে কড়া নজর রাখতে হবে। নগণ্য জেলেদের গ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি পোর্ট, প্রতিটি এয়ারস্ট্রিপ, প্রতিটি ট্রেন আর প্রতিটি রাস্তায় সশস্ত্র লোক থাকবে। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই আটক করতে হবে, বাধা দিলে গুলি। প্রতিটি ফেরিতে, প্রতিটি ফেরিঘাটে লোক চাই।

বাকালার বুলেট আকৃতির মাথায় খাড়া হয়ে আছে চুল, চোখ কুঁচকে কর্কশ গলায় জানতে চাইল, পুলিস? কারাবিনিয়ারি? এখনও তারা কিছু করছে না?

একে করা বলে না, জবাব দিল ট্যানডন। বেরলিংগার খুন হবার পর রোমে। নামমাত্র রোডব্লক দেখা গেছে–তা-ও ঘন্টা কয়েক পর। পুলিসকে সর্তক থাকতে। বলা হয়েছে, বাঙালিটার চেহারার বর্ণনাও পেয়েছে তারা। কিন্তু তার আসল পরিচয় প্রকাশ করেনি, ফটোও ইস্যু করেনি।

বাস্টার্ডস! খেঁকিয়ে উঠল বাকালা। বানচোত গুগলিটার শয়তানি বুদ্ধি এসব। আমাদের বিপদে খুব মজা পাচ্ছে শালারা। বাস্টার্ডস!

আজ সকালে পালার্মোয় পৌচেছে সে, বোরিগিয়ানো বলল।

সাথে পাধানি, আর সেই নিয়াপলিটানটা, বাকলা দাঁতে দাঁত চাপল। বাস্টার্ডর্স! ওই শালা রেমারিকটাকে কোনভাবে ধরে আনা যায় না?

বোরিগিয়ানো দ্রুত মাথা নাড়ল। হিলটনের একই স্যুইটে তিনজন রয়েছে, রেমারিককে মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করে না ওরা। ওকে ধরে আনতে হলে গুগলি আর পাধানিকে মারতে হবে।

তা সম্ভব নয়, প্রশ্নই ওঠে না, তীব্র প্রতিবাদ জানাল ট্যানডন। পুলিসের গায়ে হাত দেয়া মানে গোটা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা–একবার শুরু হলে তার আর শেষ নেই।

চেহারায় অনিচ্ছার ভাব নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল বাকালা। গুগলিও ব্যাপারটা বোঝে।

বোঝে বলেই তো এই সুযোগে খোঁচা দিচ্ছে, বলল বোরিগিয়ানো। সে পালার্মোয় বসে থাকলে কি হবে, তার লোকেরা সারা দেশ জুড়ে আমাদের ঘাটিতে হানা দিচ্ছে। জেরা করার জন্যে এমনকি গামবেরিকেও নিয়ে গিয়েছিল ওরা। নার্ভাস বোধ করছে সে।

পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে গুগলি, বলল ট্যানডন। উত্তরে আর. রোমে। বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। আমাদের লোকদের মধ্যে গুজব ছড়াচ্ছে গুগলি, তাদের মাথা কাটা গেছে, অথচ প্রোটেকশন দেয়ার জন্যে নেই কেউ।

সামনের দিকে ঝুঁকে ডোশিয়েটা খুলল বাকালা। রানার একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি খুঁটিয়ে দেখল। ঠোঁট, জিভ, টাকরা, গলা, সব শুকিয়ে গেছে তার। ছবির ওপর টোকা দিয়ে বলল, এ লোক মারা না যাওয়া পর্যন্ত সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। মুখ তুলল সে, উদাত্ত আহ্বান জানাবার ভঙ্গিতে বলল, একে যে খুন করবে, তার কোন অভাব থাকবে না–জীবনের সমস্ত সাধ বিনা আয়াসে ভোগ। করতে পারবে সে। আমি তাকে সাত রাজার সম্পদ দান করব। বুঝতে পারছ তোমরা?

নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল ট্যানডন আর বোরিগিয়ানো।

আমার এই ঘোষণা প্রচার করে দাও, নির্দেশ দিল বাকালা। ওদের জন্যে আরও একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ডোশিয়ে থেকে রানার ছবিটা বের করে ডেস্কের উপর ছুঁড়ে দিল সে। কাল সকালের সবগুলো কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় এই ছবিটা দেখতে চাই আমি।

প্রথমে সামলে উঠল ট্যানডন। ডন বাকালা! ওরা তাহলে পুরো ঘটনাটা জেনে ফেলবে–সেটা কি চাই আমরা?

শেষ পর্যন্ত জানবেই ওরা, গডফাদার বলল। এরইমধ্যে প্রায় সবটা জেনে। ফেলেছে। শুধু গুগলি আর তার ডিপার্টমেন্ট চেপে রেখেছে বলে পুরোটুকু ফাস হতে দেরি হচ্ছে। ছবিটার দিকে আরেকবার তাকাল সে। শালার চেহারায়। বৈশিষ্ট্য আছে, চোখ দুটো দেখ, কাটা দাগগুলো দেখ–দেখলেই চিনতে পারবে মানুষ। আমাদের নিজেদের লোক থাকবে রাস্তাঘাটে, কয়েক হাজার তাদের চোখকে ফাঁকি দেবে কিভাবে? সবখানে ছবিটা পৌঁছুতে এক দিন লাগবে। আমাদের হয়ে কাগজগুলোই করবে কাজটা।

আপনি ওকে হিরো বানিয়ে ছাড়বেন, সাবধান করে দিয়ে বলল ট্যানডন।

হিরো মারা যাবে, ধমকের সুরে বলল বাকালা। মরা লোককে বেশিদিন মনে রাখে না কেউ।

এ-প্রসঙ্গে আর কোন আলোচনা হল না। ট্যানডন বলল, এই শালা বাঙালির বস যে নির্দেশ দিয়েছে…

বাকালা বাধা দিয়ে বলল, সেটা তার কাছে পৌঁছায়নি। রোমে গুগলিকে নিয়ে গিয়েছিল রেমারিক, কিন্তু দেখা পায়নি তার।

আমি আশা করেছিলাম, বলল বোরিগিয়ানো। সি. আই. এ. যখন শালার ওপর খেপে আছে, ওর পরিচয় ফাস হয়ে যাবার পর ওরাই আমাদের হয়ে কাজটা করে দেবে। কিন্তু এখন দেখছি…

ইটালিতে আমরা বিপদে পড়েছি দেখে গোটা মার্কিন প্রশাসন আনন্দে বগল বাজাচ্ছে, বলল বাকালা। কংগ্রেস আর সিনেটের কিছু প্রভাবশালী সদস্য চাপ দেয়ায় সি. আই. এ. কর্মসূচী পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। ওরা আশা করছে ওদের কাজ আমরাই করে দেব, আর আমরা যদি খতম হয়ে যাই তাহলে তো আরও ভাল।

ইনফরমেশন আরও একটা আছে, গম্ভীর সুরে বলল ট্যানডন। পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার জানা যায়নি, তবে আভাস পাওয়া গেছে, প্রয়োজনে বাঙালিটাকে যুক্তরাষ্ট্রে লুকিয়ে থাকার সুযোগ দেয়া হবে–আনঅফিশিয়ালি। আরও গুজব, বিশ্ব ব্যাংক নাকি কি একটা প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়ে আছে, লোকটা কোথায়। জানতে পারলেই…

গুজব নয়, বলল বাকালা। ওপর মহল থেকে নির্দেশ পেয়ে সি. আই. এ.-ই ব্যবস্থাটা করেছে। প্রস্তাবটা সরাসরি সি. আই. এ. দিলে গ্রাহ্য না-ও হতে পারে, তাই বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া হবে প্রস্তাব। ওকে ওরা মাথায় তুলতে যাচ্ছে। বিশেষ কি একটা দায়িত্ব দেয়া হবে। আসলে…

প্রস্তাবটা কি জানা গেছে? জিজ্ঞেস করল বোরিগিয়ানো।

নিশ্চয়ই প্রোটেকশনের অফার, বলল বাকালা। আমাদের নাগাল থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার প্ল্যান।

তারমানে ওদেরও ধারণা আমাদের হাত থেকে নিস্তার নেই তার। একটু সন্তুষ্ট দেখাল বোরিগিয়ানোকে।

কিন্তু বাকালা আগের মতই গভীর আর উদ্বিগ্ন।

*

মোবেক্স থেকে বেরিয়ে এল সুসান, বিশাল কাঠামোটা লম্বা করে আড়মোড়া। ভাঙল। লম্বা হওয়ার অনেক অসুবিধে, তার মধ্যে একটা হল গাড়িতে করে কোথাও যাওয়া–হাত-পা মেলতে না পারায় আড়ষ্ট শরীর টনটন করতে থাকে। সুসানের পিছু পিছু নামল রকি। পিছন ফিরে মোবেক্সের ভেতর তাকাল সে। জিজ্ঞেস করল, তোমার কিছু লাগবে নাকি?

মাথা নাড়ল রানা। পেট পুরে খেয়ো। যদি বল, তোমাদের আমি ফিরিয়ে আনতে পারি।

না, আমরা একটু হাঁটতে চাই, বলল সুসান। কিছু কেনাকাটাও করব। চিন্তা। কোরো না, এ জায়গা আমরা ঠিকই খুঁজে বের করব।

পুব উপকূল ধরে পেসকারা থেকে বারি-তে পৌঁচেছে ওরা। সুসান ভেবেছিল, তিন দিন টিনের খাবার খেয়ে নিশ্চই অরুচি ধরে গেছে ফ্রেঞ্চ লোকটার, কাজেই সে-ও ওদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে খেতে চাইবে। কিন্তু প্রস্তাবটা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে রানা। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, ক্যাম্পসাইটে মোবেক্স পার্ক করেছে ওরা। কিন্তু বাইরে খুব একটা বেরোয়নি ও।

কৌতূহল চেপে রাখতে পারেনি সুসান। এক-আধটু ফ্রেঞ্চ জানে সে, প্রথম রাতে রানাকে পরীক্ষা করার জন্যে দুএকটা প্রশ্ন করে সে। মুচকি একটু হাসে। রানা, ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনর্গল জবাব দেয়। এরপর সুসান ভাষা বদল করে, কিন্তু ইংরেজিতেও চমৎকার কথা বলে রানা, মুচকি হাসিটুকু ঠোঁটে লেগেই ছিল। ইংরেজিতেই রানা জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করছ?

না, একটু অপ্রতিভ দেখায় সুসানকে। তবে তোমাকে আমার কেন যেন ঠিক ফরাসী বলে মনে হয় না।

ধমক লাগাল রকি, সুসানকে বলল, এত বকবক কোরো না তো। কিন্তু সুসানের কৌতূহল থেকেই গেল।

রোমের ক্যাম্পসাইটে পায়ে হেঁটে পৌচেছিল রানা, এক হাতে প্রকাণ্ড লেদার স্যুটকেস, আরেক হাতে একটা ক্যানভাস ব্যাগ। সরু দরজা দিয়ে ওগুলো ঢোকাবার সময় ওকে সাহায্য করল রকি। পরে সে সুসানকে বলে, স্যুটকেসটায় কি আছে কে জানে, অসম্ভব ভারি।

ওদের সঙ্গে বিশেষ কথাও বলে না লোকটা। তবে তার উপস্থিতি অস্বস্তিকর লাগে না।

.

ওখানে, দেখ, একটা বুটিক। ব্যস্ত রাস্তার ওপারে সার সার দোকান, সেদিকে হাত তুলল রকি।

আর ওখানে একটা রেস্তোরাঁ, বলল সুসান, তার দৃষ্টি আরও খানিকটা সামনে। আগে খাব, খিদেয় মরে যাচ্ছি। তাছাড়া, খাওয়াদাওয়ার পর আমার হয়ত আরও বড় সাইজ দরকার হবে।

এরচেয়ে বড় সাইজ তৈরি হয় না, বলেই কাঁধ আর মাথা সরিয়ে নিল রকি, জানে, ঠাট্টার ছলে যে কিলটা মারবে সুসান, রোগা শরীরটা ছিটকে পড়ে যেতে পারে ফুটপাথের ওপর।

কিন্তু সুসান কিল তুলল না। একটা নিউজস্ট্যাণ্ডের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে ওরা; সেদিকে তাকিয়ে আছে সুসান, চোখ দুটো রিস্ফারিত। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রকিও তাকাল।

রানার বয়স্ক চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। প্রায় বারোটা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে ছবিটা।

এক ঘন্টা পর। দুজন মহাতর্ক জুড়ে দিয়েছে। রকির একই কথা, বিপদ থেকে দূরে সরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

তোমার ব্যাগে টাকা আছে, পাসপোর্ট আছে, আর কি চাই? জিজ্ঞেস করল। সে। সোজা রেলস্টেশনে যাই চল, ট্রেনে উঠে কিছু মুখে দিয়ে নেব। যা কিছু কেনার, ব্রিন্দিসিতে গিয়ে কিনলেই হবে। কাল সকালে ফেরিতে উঠে রওনা হয়ে যাব গ্রীসে।

কিন্তু সুসানেরও একই জেদ। আমি কোথাও যাচ্ছি না।

রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে, ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ওরা। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে এসেছে, জানে না। সুসান, এই ভাবাবেগের কোন মানে হয় না, বলল রকি। লোকটা খুনী। আমরা তার কাছে কোনভাবে ঋণী নই। টাকা দিয়েছে, বদলে মোবেক্স পেয়েছে। বুঝতে পারছ না, ও আমাদেরকে কাভার। হিসেবে ব্যবহার করছে!

আবার মাথা নাড়ল সুসান। হাতের কাগজটা সুসানের চোখের সামনে ধরল। রকি। ভাল করে দেখ চেহারাটা। ওকে এখন হাজার হাজার লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন খুঁজে পাবে, ওর সঙ্গে আমাদের থাকা উচিত হবে না। এই সহজ কথাটা তুমি বুঝতে পারছ না?

রকি ওয়াট, তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই, থমথমে গলায় বলল। সুসান।

একাই হাঁটা ধরল সে। অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার পিছু নিল রকি। আবার ওরা ব্যস্ত শহরে ফিরে এল। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল সুসান, পিছু পিছু রকি। বেয়ারাকে ডেকে দুজনের জন্যে খাবার অর্ডার দিল সুসান।

খাওয়া শেষ হবার পর বিস্ফোরিত হল সে। রকির দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ, সত্যি কথা, লোকটা আমাদেরকে ব্যবহার করছে। কিন্তু কেন করবে না বলতে পার? ওর পিছনে কি একটা সেনাবাহিনী আছে? নেই। সরকার ওকে সাহায্য করছে? না। লোকটা কি গুণ্ডাদলের সর্দার, তার শিষ্য আছে কয়েক হাজার? না, নেই। লোকটা কি দেবতা? না। তাহলে কি সে? কে সে? একজন। মানুষ, সাধারণ একটা লোক। স্রেফ একা। কি করছে সে? একটা অতি জঘন্য, অতি ঘৃণ্য, অতি নিষ্ঠুর অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ওকে খুনী বললে পাপ হবে, রকি। গলা ধরে এল সুসানের। বলল, হাজার হাজার লোক খুঁজছে ওকে। পুলিসের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন? বুঝতে পারছ না, ওর সাহায্য দরকার। আর কারও কথা জানি না, আমি ওকে সাহায্য করব। বিপদের কথা বলছ? ওকে সাহায্য করতে গিয়ে যদি মারাও যাই, দুঃখ কিসের, স্বর্গে তো যাবই যাব। হ্যাঁ, বলতে পার. খানিকটা পুণ্যের লোভেই ওকে আমি সাহায্য করতে চাইছি। এইটুকুই আমার স্বার্থ।

অন্য দিকে তাকিয়ে আছে রকি, নির্লিপ্ত। আসলে চোখের পানি লুকাচ্ছে সে।

ভেবে দেখ, রকি, কচি মেয়েটাকে শুধু খুন করেনি ওরা, দুজন মিলে যখনই ইচ্ছে হয়েছে বারবার রেপ করেছে। ওর জায়গায় আমাকে কল্পনা কর। তেরো। বছর বয়স আমার, দুনিয়াদারি ভাল বুঝি না। আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করতে করতে মেরে ফেলা হল।

সুসানের দিকে তাকাল রকি, নিঃশব্দে হাসছে, চিক চিক করছে খুদে চোখ দুটো। ঠিক আছে, বীরাঙ্গনা হস্তিনী, এবার একটু শান্ত হও।

ভুরু কুঁচকে রকিকে কয়েক সেকেণ্ড দেখল সুসান। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি রাজি?

হ্যাঁ।

হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন?

কাঁধ ঝাঁকাল রকি। হঠাৎ নয়। সাহায্য আমিও করতে চাই, কিন্তু এতে বিপদ। আছে। একজন পুরুষকে যা মানায়, একটা মেয়েকে তা মানায় না।

হাত বাড়িয়ে রকির কটা রঙের চুল এলোমেলো করে দিল সুসান। ওরে শয়তান! আমাকে গ্রীসে পাঠিয়ে দিয়ে ওর কাছে ফিরে যাবার মতলব ছিল তোমার!

রাস্তায় বেরিয়ে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রকি। আচ্ছা, আমরা সব কথা জানি, টের পেলে ওর প্রতিক্রিয়া কি হবে? আমরা বেঈমানী করতে পারি ভেবে ও যদি কোন ব্যবস্থা নেয়?

রকির কোমর জড়িয়ে ধরল সুসান। সে-ধরনের কিছু ঘটবে না। আমরা মন্দ লোক নই, ও বুঝবে। আর, যতই বদরাগি বা নিষ্ঠুর হোক, ওকে আমি ভয় পাই না।

ভয় পাও না? রকির চোখে অবিশ্বাস।

সুসান হাসতে লাগল। ভয় পাব কেন? আমাকে দেখার জন্যে তুমি আছ না!

ফোনের রিসিভার নামিয়ে রেখে পাধানি আর রেমারিকের দিকে ফিরলেন গুগলি। কাজটা বাকালার, বললেন তিনি। সবগুলো কাগজ একই সময়ে ইনফরমেশনটা পেয়েছে।

কিন্তু কেন? জানতে চাইল রেমারিক।

উত্তর যোগাল পাধানি, এ থেকে বাকালার মনের অবস্থা টের পাওয়া যায়। সবাইকে রানার চেহারা দেখাবার এটাই ছিল সবচেয়ে সহজ উপায়। কর্নেলের দিকে ফিরল সে। এখন আমরা কি করব, স্যার?

গুগলি ইতস্তত করছেন।

প্রাইভেটলি কথা বলতে পারলে বোধহয় ভাল হত, স্যার, বলল পাধানি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেমারিকের দিকে তাকালেন গুগলি, মাথা নাড়লেন। তার কোন দরকার নেই, পাধানি। ওদের দিকে পিছন ফিরে ফোনের রিসিভার। তুললেন, ডায়াল করলেন রোমে, কারাবিনিয়ারি হেডকোয়ার্টারের নাম্বারে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটা নির্দেশ দিলেন তিনি। তারপর রিসিভার রেখে দিয়ে রেমারিকের দিকে ফিরলেন।

আপনাকে বিশ্বাস করা আমার উচিত হয়নি, ঝঝের সঙ্গে বলল রেমারিক। রেগে গেছে সে।

হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন গুগলি। এতে কিছু এসে যায় না। রানাকে যদি বাকালার লোকেরা খুঁজে না পায়, আমাদের লোকেরাও পাবে না।

কিন্তু আপনার ওপর নির্দেশ আছে, ওকে দেশত্যাগ করার সুযোগ করে দিতে হবে, বলল রেমারিক। অথচ আপনি নির্দেশ দিলেন ওকে দেখা মাত্র গ্রেফতার করে হেডকোয়ার্টারে…

যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর! আবার ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুগলি। নিচু কফি টেবিলে একটা খবরের কাগজ মেলা রয়েছে, সেটার দিকে ঝুঁকে পড়লেন তিনি। মাথা গরম না করে, আসুন, ওর অবস্থাটা ভেবে দেখি। সত্যি কথা বলতে কি, মেজর জেনারেল রাহাত খানের সাথে আমি একমত, রানার এখন আর কোন সুযোগ নেই। ওর এই নকল চেহারা লুকিয়ে রাখার নয়, লোকে দেখলেই চিনে ফেলবে। বাকালা পুরস্কার ঘোষণা করেছে–কি কি দেয়া হবে? নিউইয়র্কে একটা বাড়ি, সিসিলিতে একটা চালু রেস্তোরাঁ, নগদ এক বিলিয়ন লিরা। যা-শালা…আমারই তো লোভ হচ্ছে! সারা জীবন আর কাজ না করলেও চলবে। তাই বলছি, আসুন, চেষ্টা করি, ওদের আগে আমরা যাতে ওকে খুঁজে পাই।

কথা না বলে খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রেমারিক। নিচের ব্যস্ত রাস্তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

রেমারিক, বিশ্বাস করুন–রানার এখন বাঁচার আশা খুব কম। ওকে গ্রেফতার করার জন্যে এখন আমরা সাধ্যের বাইরে চেষ্টা করব, কথাগুলো প্রায় আবেদনের সুরে বললেন গুগলি। বসূকে পাধানি আগে কখনও এভাবে কথা বলতে শোনেনি। কিন্তু এ-ও জানি, গ্রেফতার এড়াবার সব রকম চেষ্টা করবে সে। সেজন্যেই নির্দেশ। দিয়েছি, দরকার হলে পায়ে গুলি করা যাবে।

ওদের দিকে না ফিরেই রেমারিক বলল, এখন তো গ্রেফতার করবেনই। মাফিয়া জগতটাকে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে ও, মস্ত উপকার করেছে আপনাদের, কিন্তু সে-কথা মনে রাখার দরকার নেই। গুলি করুন ওকে, গ্রেফতার করে জেলে পাঠান, সবাই আপনার কৃতিত্ব দেখে হাততালি দেবে। কর্নেল থেকে জেনারেল। হবেন আপনি…

কর্নেলকে কঠোর দেখাল। কে তাকে খুন করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছে? আমি? কে তাকে অস্ত্র যোগান দিয়েছে? আমি? জাল কাগজ-পত্র, ট্রান্সপোর্ট, সেফ-হাউসের ব্যবস্থা কে করেছিল? আমি? বলুন, জবাব দিন!

ঘুরে গুগলির দিকে তাকাল রেমারিক। দুজুনই উত্তেজিত, এই প্রথম। ঠিক। আছে, স্বীকার করছি! বলল রেমারিক। হ্যাঁ, ওকে আমি সাহায্য করেছি, আর। সেজন্যে আমি অনুতপ্তও নই। পরিস্থিতি অন্য রকম দেখে আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। ভেবেছিলাম আপনি কথার মর্যাদা রাখতে জানেন। কিন্তু এখন দেখছি। আমারই ভুল হয়েছিল।

এতক্ষণে মুখ খুলল পাধানি, আপনি ভুল করছেন, রেমারিক। খুব বড় ভুল করছেন। রানার ব্যাপারে কর্নেলের ব্যক্তিগত কোন দায়-দায়িত্ব নেই। কিন্তু, আমি। জানি, তার প্রতি কর্নেলের সহানুভূতি আছে। তার জন্যে, তার ভালর জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করবেন উনি। সব কিছু।

একটু নরম হল রেমারিক। রানা আপনাদের উপকার করেছে, এ-কথা তো সত্যি?

মাথা ঝাঁকালেন গুগলি। হ্যাঁ–মস্ত উপকার করেছে। অন্য কারও কাছে এ কথা আমি স্বীকার করব না। বেরলিংগারকে খুন করে আমাদের কাজ পানির মত সহজ করে দিয়েছে সে। আমি কল্পনাই করিনি, বাকালা এতটা ঘাবড়ে যাবে। রানা। যদি এখন তাকে না-ও ছুঁতে পারে, তবু তার ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাবে। অর্গানাইজেশনের মেইনল্যাণ্ড শাখাগুলো এরই মধ্যে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। শুধু এখানে, সিসিলিতে, এখনও তার ক্ষমতা টিকে আছে, কিন্তু তা-ও দিনে দিনে কমতে থাকবে।

একটা সিগারেট ধরাল রেমারিক, তার হাত এখন আর কাঁপছে না।

এদিকে আসুন, রেমারিক, নরম সুরে ডাকলেন গুগলি। এখানে বসুন। রানার খোঁজ পাওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আপনিই তার মন বোঝেন। সে এখন কি করবে, ভেবে বের করুন। কিভাবে হামলা করবে সে? কোন পথে পৌঁছুবে?

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলে বসল রেমারিক। প্ল্যানটা আবার আমাকে দেখতে দিন।

দৈনিকটা সরাতেই নিচে দেখা গেল ভিলা কোলাসির বড় একটা স্কেল প্ল্যান। ভিলার আশপাশের এলাকাও বেশ কিছুটা দেখানো হয়েছে স্কেচে। তিনজনেই ঝুঁকে পড়ল ওরা। প্ল্যানে একটা আঙুল রাখলেন গুগলি।

আজ সকালে আমরা জেনেছি, বাগান আর পঁচিলের মাঝখানে অনেকগুলো গাছ কেটে ফেলেছে বাকালা, একটা প্যাসেজ তৈরি করার জন্যে। সেই সঙ্গে ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পাঁচিল থেকে বাইরের দিকে কয়েক শো মিটার এলাকায় দিনের মত আলো থাকবে।

পাঁচিলের ভেতর দিকে? জিজ্ঞেস করল রেমারিক।

মাথা নাড়লেন গুগলি। না। বোঝাই যাচ্ছে, ভিলাটাকে আলোকিত করতে চায় না। রাতের বেলা বাগান, উঠন, লন, সব অন্ধকার থাকবে। সিকিউরিটিতে কোন খুঁত নেই। দুটো গার্ড-কুকুর আমদানি করা হয়েছে–ডোবারম্যান-শিকারি কুকুর, খুন করার ট্রেনিং পাওয়া।

পাধানি বলল, এতগুলো বাধা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। গেটে থাকবে দুজন গার্ড, প্রত্যেকের কাছে সাবমেশিনগান। পঁচিলের ভেতর সব মিলিয়ে বিশজন, তাদের হাতেও ওই সাবমেশিনগান। কোন গাড়িকে ভিলার কাছেপিঠে ঘেঁষতে দেয়া হবে না।

গম্ভীর এক চিলতে হাসি দেখা গেল রেমারিকের ঠোঁটে। এ-সব বাধা আশা করছে রানা। ভিলা, আর গ্রাউণ্ডের লে-আউট জানা আছে তার। সে একজন সৈনিক এবং একজন গুপ্তচর; আর বাকালা একটা গর্দভ। ঘোরাঘুরির মধ্যে থাকলে অনেক বেশি নিরাপদে থাকত সে, কিন্তু তা না করে ছোটখাট একটা জায়গায়। আটকে রেখেছে নিজেকে। ভিলার ভেতর ছোটখাট একটা সেনাবাহিনী থাকবে, তা রানাও জানে। একবার যদি ভেতরে ঢুকতে পারে ও, ওই সেনাবাহিনী বাকালাকে রক্ষা করতে পারবে না।

কিন্তু ভেতরে সে ঢুকবে কিভাবে? জানতে চাইলেন গুগলি।

তা আমি জানি না, বলল রেমারিক। তবে প্ল্যান একটা নিশ্চয়ই আছে তার। এইটুকু বলতে পারি, সেটা সাধারণ কোন প্ল্যান হবে না।

পাধানি বলল, অগাস্টিন মারা গেল পিস্তলে, এলি গেল শটগানে, ফনটেলা মরল বোমায়, বেরলিংগার ধ্বংস হল অ্যান্টিট্যাঙ্ক মিসাইলে, কর্নেলের দিকে তাকাল সে, এখন প্রশ্ন, বাকালাকে কি দিয়ে মারবে সে?

সবাই চিন্তামগ্ন। প্রথমে নড়েচড়ে বসলেন কর্নেল গুগলি। ক্ষীণ একটু হাসির রেখা দেখা গেল তার ঠোঁটে। বললেন, কি জানি! তবে নেতাদের নেতা এখন যদি মাটি খুঁড়ে ফলআউট শৈলটার তৈরিতে হাত দিয়ে থাকে, একটুও অবাক হব না।

.

ওই আরেকটা!

এইমাত্র একটা আলফা রোমিও ওভারটেক করল ওদের, সেটার দিকে হাত তুলল সুসান। আলফা রোমিওর পিছনের জানালায় একটা স্টিকার লাগানো রয়েছে, তাতে তিনটে শব্দ ছাপা রয়েছে, এগিয়ে যাও, রানা!

প্রথম ঢেউটা উঠেছে ইটালিতে নয়, আমেরিকায়। ইটালিতে মাফিয়ার কিছু হলে বা মাফিয়া কিছু করলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে যায় মার্কিন মুলুকে ওখানকার মাফিয়া, সরকারী প্রশাসন, আর জনসাধারণের মধ্যে দ্রুত প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর একটাই কারণ, ওখানেও মার্কিন সরকার আর জনসাধারণ মাফিয়াদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আছে। আনি। বেরলিংগার মারা যাবার পর সবগুলো টেলিভিশন আর রেডিও স্টেশন নির্ধারিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে খবরটা প্রচার করে। ওখানকার মাফিয়া মহলে বিষাদের ছায়া। নামে, আর আক্ষরিক অর্থেই জনসাধারণের মধ্যে নামে আনন্দের ঢল। রাতারাতি স্টিকার ছাপাবার ধূম পড়ে যায়। যুব সংগঠনগুলো চাদা তোলার জন্যে রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিটি দলের সঙ্গে একটা করে ব্যানার, তাতে লেখা একজন নিঃসঙ্গ মানবদরদীকে সহায়তা করুন–সে আহত হলে তার চিকিৎসা লাগবে, গ্রেফতার হলে আইনগত সহায়তা দরকার হবে। চার্চগুলো মাফিয়ার ওপর সবচেয়ে বেশি খ্যাপা, একশো একজন প্রিস্ট এক যুক্ত আবেদনে বললেন, দেশবাসী যেন এই শোকাভিভূত লোকটার জন্যে প্রার্থনা করে। দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ, প্রথম দিনেই কয়েক লক্ষ ডলার চাঁদা উঠল। একজন আর্মস ব্যবসায়ী ঘোষণা করল, সে একাই আড়াই লাখ ডলার দান করবে। সম্ভবত ব্যবসার সূত্রে যে পাপ সে কামিয়েছে, উপুড়-হস্ত হয়ে এটা তার খানিকটা খণ্ডাবার প্রয়াস। তার। দেখাদেখি আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী এগিয়ে এল, ঘোষণা করল মোটা অঙ্কের চাদা। বলতে গেলে, কে কত বেশি চাদা দিতে পারে, তার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।

কিন্তু মুশকিল হল, কেউ জানে না, কোথায় পাঠাতে হবে, টাকা। বেশিরভাগ যুব সংগঠন তাদের টাকা পাঠিয়ে দিল সংবাদপত্র অফিসে। ব্যবসায়ী রানার নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলল, কেউ কেউ সুইস ব্যাংকগুলোয়।

তবে ইটালির মানুষ আরও কল্পনাশক্তির পরিচয় দিল। স্টিকার তো ছাপা হলই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিশাল আকৃতির তোরণ নির্মাণ করল তারা। তোরণের। মাথায় সোনালি জরি আর কাগজ দিয়ে কিছু না কিছু লেখা হল। একটা তোরণে পাড়ার ছেলেরা লিখল, বাঙালি বীর, লহ সালাম! রোমের সবচেয়ে চওড়া চৌরাস্তায় যে প্রকাণ্ড তোরণটা তৈরি করা হল, তার মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকলঃ লুবনার জন্যে আমরাও কাদি!

ইটালি জুড়ে রাতারাতি গজিয়ে উঠল মাসুদ রানা ফ্যানস ক্লাব। গত দুদিন ধরে সবগুলো জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকটাই খালি থাকছে, মাসুদ রানা। ফ্যানস ক্লাবগুলো ভাগাভাগি করে কিনে নিয়েছে ওই আধ পৃষ্ঠা স্পেস। খালি জায়গার মাঝখানে ছোট অক্ষরে শুধু ছাপা হল, এই ফাঁকা জায়গা শুধু মাসুদ রানা। ব্যবহার করতে পারবেন। তার কিছু বলার থাকলে সংবাদপত্র অফিসে লিখে পাঠালে বা ফোন করলেই হবে। কিন্তু কোন দৈনিকের অফিসেই রানার কোন মেসেজ এল না।

কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খলা, আর এক-আধটু উত্তেজনাও দেখা দিল। মিলানে খবর ছড়াল, রানা আহত হয়েছে। ছোটবড় সবগুলো হাসপাতালের সামনে প্রচণ্ড ভিড় করল মানুষ। না, হাসপাতালে রানা আছে কিনা জানতে আসেনি তারা। এসেছে রক্ত দান করবে বলে। ভিড় হটাবার জন্যে অবশেষে লাঠি চার্জ করল পুলিস, কাঁদানে গ্যাস ছাড়ল। আহত হল বেশ কয়েকজন।

এ-পর্যন্ত বত্রিশটা তোরণ দেখতে পেয়েছে ওরা। তোরণ আর স্টিকারের। লেখাগুলো একটা কাগজে টুকে রাখছে সুসান। ব্রিন্দিসি ছাড়িয়ে শহরতলীতে চলে এসেছে মোবেক্স।

খবরের কাগজে রানার ছবি ছাপা হবার পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। মোবেক্সে ঢুকে কাগজটা রানার সামনে মেলে ধরে সুসান, বলে, দেখ তো, কার ছবি চিনতে পার কিনা।

নিজের ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মুখ তুলল রানা।

সবগুলো দৈনিকে ছাপা হয়েছে, বলল রকি। পুরো গল্পটা সহ। তোমার এই কদর্য চেহারা ইটালির যেখানেই দেখাবে, সাথে সাথে চিনে ফেলবে সবাই। টিভিতেও নিশ্চই দেখানো হচ্ছে।

কোন কথাই বলল না রানা। পালা করে শুধু ওদের দুজনকে দেখল।

ফ্রেঞ্চম্যান না ছাই! ঝাজের সঙ্গে বলল সুসান। আমরা প্রথমেই ধরেছিলাম। তুমি ইউরোপিয়ান নও!

ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে।

উত্তেজনা একটু হালকা হল। সাহায্যের প্রস্তাবটা এল সুসানের কাছ থেকে, ওরা দুজনেই রানার নিরাপত্তার জন্যে কিছু করতে চায়। কিন্তু মাথা নাড়ল রানা, সে রাজি নয়। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বিপদ এখন খাড়ার মত মাথার ওপর ঝুলছে। আমি যা বলছি তাই হবে, বলল রানা। ব্রিন্দিসিতে পৌঁছে ট্রেন। ধরবে তোমরা, তারপর ফেরিতে উঠে গ্রীসে চলে যাবে। আমার পথ আমি ঠিকই বের করে নেব। আমার সাথে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুসান আর রকি কোন যুক্তি মানতে রাজি নয়। রানার সঙ্গে এক ঘন্টা তর্ক করল ওরা। রানা একা হয়ে গেলে, ওকেই মোবেক্স। চালাতে হবে–লোকের চোখে না পড়ে উপায় থাকবে না ওর। কিন্তু সঙ্গে ওরা। থাকলে, সমাবেক্সের ভেতর লুকিয়ে থাকতে পারবে রানা, ইটালির যে-কোন। জায়গায় ওকে পৌঁছে দিতে পারবে তারা। অবশেষে ওদের জেদের কাছে হার। মানতে হল রানাকে। ও শুধু রেগিয়ো পর্যন্ত যেতে চায়, তবে তিন দিনের মধ্যে। নয়। ওকে রেগিয়োতে পৌঁছে দিয়ে সমাবেক্স নিয়ে চলে যাবে ওরা–ওটা তখন। আর ওর দরকার হবে না।

জোর করে টাকা ফেরত দিতে চাইল ওরা, কিন্তু.এবার রানার জেদের কাছে। হার মানতে হল ওদেরকে। সাহায্যের বিনিময়ে মোবেক্সটা রানার উপহার হিসেবে নিতে হবে ওদের। এটাই তার শর্ত।

বারির ক্যাম্পসাইটে আরও দুটো দিন ছিল ওরা। রাতে ব্যায়াম করার সময় ছাড়া মোবেক্স থেকে একবারও নামেনি রানা-সে-সময় সুসান আর রকি পাহারায় থেকেছে। সিসিলিতে কিভাবে ঢুকবে ও, ওদেরকে বলেনি। কথা দিয়েছে, রেগিয়োতে গিয়ে বলবে। ওরা ফেরি ধরার আগে রানার হয়ত আরেকটু সাহায্য লাগতে পারে।

চুল ছাড়া কেমন লাগবে রকিকে? জানতে চেয়েছে রানা। মানে, ছোট চুলে?

চোখ কপালে উঠে গেছে সুসানের। কোন ধারণা নেই–নিশ্চয়ই ভীতিকর একটা কিছু দেখাবে।

বাজে কথা বলবে না! চটে উঠেছে রকি। আমি দেখতে খারাপ নাকি! আমার এই চুল আর দাড়ি রাখার একটাই কারণ, মেয়েরা যাতে আমার পিছু না। নেয়। তা, আসল ব্যাপারটা কি?

কিন্তু ফাঁস করেনি রানা, মৃদু হেসে বলেছে, রেগিয়োয় পৌঁছে বলব।

গাড়ি চালাচ্ছে রকি, পাশে বসে আছে সুসান। রানার কথা ভাবছে ওরা।

যাই বল, আশ্চর্য একটা মানুষ, মন্তব্য করল সুসান। তোমার ভেতর এই বোধ কখনও জন্ম নেবে? অমন প্রচণ্ড ঘৃণা, যার ফলে ওর মত কিছু করার শক্তি পাবে মনে?

রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে সুসানের দিকে তাকাল রকি। সুসান সিরিয়াস। ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল রকি। অনেকের মনেই এই বোধ জন্ম নিতে পারে। শুধু ঘৃণা থাকলেই তো হচ্ছে না, যোগ্যতাও থাকতে হবে, এখানেই পার্থক্যটুকু। কাগজে ওর কথা পড়েছ তুমি। ওর মত মানুষ আর কটা আছে। রাস্তায়?

তোমার কি মনে হয়, জিজ্ঞেস করল সুসান। পারবে ও? ওখানে ঢোকা সম্ভব?

ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করল রকি। পারতেও পারে। অনেক বাধা পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে–তবে, ভাগ্যটা ভাল হতে হবে। ভাগ্য অবশ্য ভালই ওর–যেমন, আমাদের সাথে দেখা হয়েছে।

রকির দিকে তাকিয়ে হাসল সুসান, তৃপ্তির হাসি।

কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল রকি, কি ভাবছ?

ভাবছি, আবার হাসিটা দেখা গেল সুসানের ঠোঁটে, চুল ছোট করলে কেমন দেখাবে তোমাকে।

.

১০.

কয়েকশো বছরের পুরানো দেয়াল, বুলডোজারের ধাক্কায় আধ ঘন্টার মধ্যে ফার্ম হাউসটা মাটির সঙ্গে মিশে গেল।

গরুর গাড়ির পাশে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাইকেল এগেল, সংসারের যাবতীয় জিনিস-পত্ৰ এইমাত্র গাড়িতে তোলা শেষ করেছে সে। স্ত্রী এরই মধ্যে উঠে বসেছে গাড়োয়ানের এক পাশে, তার দিকে তাকাতে পারছে না এগেল।

ভিলা কোলাসির পাঁচিলটা এখান থেকে দেখা যায়, চোখে রাজ্যের ঘৃণা নিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে এগেল। পাহাড়ের নিচে এই ছোট্ট পাথুরে জায়গাটায় কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস করছিল ওরা। ঘরের তৈরি ঘি, পনির, মাখন ভিলার মালিককে নিয়মিত পাঠিয়েছে, অত্যাচারী লোকটা যাতে তাদের ওপর সন্তুষ্ট থাকে।

কথাটা প্রথম শুনে বিশ্বাস করেনি এগেল। ভিলার মালিক এই রকম নিষ্ঠুর কাজ কেন করবেন। গার্ডদের হাতে-পায়ে ধরেছে সে, ওদের মালিকের সঙ্গে তাকে একবার দেখা করতে দেয়া হোক। তার কাকুতিমিনতি কানে তোলা হয়নি। ভিলার মালিক নাকি কারও সঙ্গেই দেখা করছে না। শেষ কথা জানিয়ে দিয়ে চলে গেল ওরা–চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ফার্মহাউস ছেড়ে চলে যেতে হবে। কোথায় যাবে, সেটা ভিলার মালিকের মাথাব্যথা নয়।

বাপ-দাদার ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে এগেল পরিবার। কোথায় যাবে জানে না। হাতে নামমাত্র টাকা গুঁজে দিয়ে কাগজ পত্রে সই করিয়ে নিয়েছে ওরা, ফার্মহাউসের ওপর তার কোন অধিকার নেই। ফার্মহাউসই নেই, তার আবার অধিকার।

গরুর গাড়িতে উঠে বসল এগেল, এখনও সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ভিলার পাচিলের দিকে। তার দুই চোখ থেকে উথলে উঠছে ঘৃণা। বিড়বিড় করে বলল, গো উইথ গড, মাসুদ রানা।

.

দর নিয়ে বচসা শুরু হয়ে গেল। চুল দাড়ি কাটার জন্যে সাত হাজার লিরা, মগের মুলুক পেয়েছে নাকি! কিন্তু নাপিত ব্যাটা গোঁ ধরে বসে আছে। এত চুল দাড়ি নাকি কোন বনমানুষের শরীরেও থাকে না। একঘন্টার কমে সারতে পারবে না সে। সাত হাজার লিরার এক পয়সা কমে, সে রাজি নয়।

হাতে অনেক কাজ, সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হবে, অগত্যা রাজি হতে হল রকিকে।

আসল রহস্য এখনও তার জানা হয়নি। ক্যাম্পসাইটে কাল রাতে পৌচেছে ওরা, ডিনারে বসে রানা. কি চায় ব্যাখ্যা করে বলেছে ওদেরকে। কিন্তু কেন চায়, তা বলেনি। একটু একটু করে জান, সেটাই সবার জন্যে নিরাপদ।

প্রথমে রকিকে চুল-দাড়ি কামাতে হবে। তারপর ভাল দাম দিয়ে কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে–লেদার সুটকেস, ব্রিফকেস, বিজনেস স্যুট, সাদা শার্ট, একরঙা টাই, ফিতে লাগানো জুতো। নতুন কাপড়-চোপড় পরে হোটেল গ্র্যাণ্ডে উঠতে হবে তাকে, সবচেয়ে দামি সুইটে, তিন দিনের ভাড়া অ্যাডভান্স করবে সে। এরপর একটা গাড়ি ভাড়া নেবে রকি, ওই তিন দিনের জন্যে, সবচেয়ে ভাল যে মডেলটা পাওয়া যায়। রাতে হোটেলের ডাইনিংরূমে ডিনার খাবে সে, ওয়েটারকে সবচেয়ে দামি ওয়াইন দিতে বলবে, তারপর কফির সঙ্গে কনিয়্যাক খাবে।

তারমানে তুমি চাও রকিকে যেন একজন ধনী ব্যবসায়ী বলে মনে হয়? জিজ্ঞেস করেছে সুসান।

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

এ যেন রূপকথার মত লাগছে, চোরা চোখে রকির দিকে একবার তাকিয়ে মন্তব্য করল সে। কাদার ব্যাঙ হঠাৎ সোনার কাঠির ছোঁয়া পেয়ে রাজপুত্র হয়ে উঠবে।

থামলে! চোখ রাঙাল রকি।

জানি, নিজেকেই চিনতে পারবে না!

চেহারায় গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্ব আনার চেষ্টা করল রকি-এসবের দরকার হবে, এখন থেকে চর্চা করা ভাল।

রাজকীয় ডিনারের পর হোটেলে নিজের সুইটে ফিরতে হবে রকিকে, ওখান থেকে ফোন করতে হবে অস্ট্রেলিয়ায়–পুরানো কোন বন্ধু, বা যে-কোন একজনের কাছে করলেই চলবে। তবে কথা বলতে হবে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট, তার কম নয়। রাতটা হোটেলেই কাটাতে হবে তাকে, সকালে ক্যাম্পসাইটে এসে ওদের সঙ্গে দেখা করবে।

.

রকি যখন রেগিয়োর এ্যাণ্ডে ডিনার খাচ্ছে, কর্নেল গুগলি তখন পালার্মোর হিলটনে, রেমারিক আর পাধানিকে নিয়ে গ্রিলড লামপুকা সাবাড় করছেন।

তোমার কি মনে হয়? পাধানিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

রানা বোটে করে আসবে, বলল পাধানি। সম্ভবত ফিশিং বোটে করে– কালাব্রিয়ার কোথাও থেকে বোট যোগাড় করা তেমন কঠিন হবে না…

অসহিঞ্চু দেখাল কর্নেলকে। প্লেটের দিকে আঙুল তাক করলেন তিনি। আমি মাছের কথা জিজ্ঞেস করছি।

হাসি চাপল পাধানি; মাঝেমধ্যে বসূকে বিরক্ত করে মজা পায় সে। মন্দ নয়–তবে, একটু বেশি ভাজা হয়ে গেছে।

সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন গুগলি, রেমারিকের দিকে ফিরলেন, সম্ভাবনা আছে, কোন নিশ্চয়তা আছে তা বলছি না, ক্ষীণ একটু সম্ভাবনা আছে, একদিন হয়ত পাধানি প্রমোশন পেয়ে কর্নেল হতে পারবে।

আপনি বুঝি যোগ্যতার পরীক্ষা নিলেন? জানতে চাইল রেমারিক। কিন্তু ভাল খাবারের সমঝদার হওয়ার সঙ্গে যোগ্যতার কি সম্পর্ক?

সব কিছুর সম্পর্ক, জবাব দিলেন গুগলি। মানে একটা থাকতেই হবে, তা হলে শুধু বুদ্ধিমান আর নিবেদিতপ্রাণদের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিতে শুরু করবে ওরা। তা যদি ঘটে, সর্বনাশ হতে বাকি থাকবে না!

তারমানে কি আপনি কর্পোরাল পদে নেমে যাবেন?

মুচকি হেসে পাধানিকে বললেন গুগলি, দেখলে তো, আমাদের নিয়াপলিটান বন্ধুর সেন্স অভ হিউমার কি ভয়ঙ্কর?–কেন, ফিশিং বোটের কথা মনে হচ্ছে কেন?

কাধ ঝাঁকাল পাধানি। আর কি হতে পারে? কনভেনশনাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। প্রত্যেকটা প্লেন, ফেরি আর ট্রেনের ওপর নজর রাখা হবে। ছদ্মবেশ নেয়ায় ঝামেলা আছে, সে সুযোগ তার আছে বলেও মনে হয় না–তাছাড়া, ছদ্মবেশ নিয়ে ওই চেহারা খুব বেশি আড়াল করা যাবে না।

আপনার কি ধারণা? রেমারিকের দিকে ফিরলেন গুগলি।

কি জানি; বলল রেমারিক। আন্দাজ করার চেষ্টা বৃথা। অনেক ভেবেছি, কিন্তু উত্তর পাইনি। তবে একটা কথা ঠিক, এই চেহারা ও কোথাও দেখাতে পারবে না কোথাও না।

হ্যাঁ, ইটালিতে ওটা বোধহয় এখন সবচেয়ে পরিচিত মুখ। মানুষ যেভাবে নিল ব্যাপারটাকে–কল্পনাই করিনি। দেশের বাইরে থাকলে, এখানে এসব ঘটছে। শুনলে বিশ্বাস করতাম না। শুধু গতকালই দৈনিকগুলোর অফিসে এক বিলিয়নের ওপর লিরা পৌচেছে। রোমে মেয়ারা, টি-শার্ট পরছে, রানার ছবিসহ ছাপা রয়েছে, এগিয়ে যাও, রানা। ইটালির মানুষ সবাই ওর পক্ষে। কাগজগুলোর ছাপা। তিন গুণ বেড়ে গেছে, তারপরও নাকি চাহিদা মেটাতে পারছে না। এই পরিস্থিতিকে কোনমতেই স্বাস্থ্যকর বলা যায় না। মোটেও শুভলক্ষণ নয়।

এ অনিবার্য ছিল, বলল পাধানি। মাফিয়ার অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সরকারও ওদের সাথে পারে না। কাজেই এই লোককে হিরো মনে করছে। মানুষ। তাছাড়া, বীরপূজা সব সমাজেই চালু রয়েছে এখনও। যা ঘটছে, এর মধ্যে অন্তত যুক্তির কোন অভাব নেই।

আমার জন্যে সবচেয়ে বড় ধাঁধা হল, গুগলি বললেন। রানা থাকছে কোথায়? সে একা, অথচ, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না, কি করে তা সম্ভব? রেমারিকের দিকে ফিরলেন তিনি। আপনি ঠিক জানেন, রোমের পর তার আর কোন সেফ-হাউস নেই?

আমার জানামতে নেই, বলল রেমারিক। রোমের পর কি করবে, আমাকে বলেনি। কেন, বুঝতেই পারেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন গুগলি। বিষণ দেখাল তাকে। আমার দুর্ভাগ্য।

দুর্ভাগ্য কেন? শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল রেমারিক। তাকে খুঁজে বের। করার এত কেন গরজ আপনার?

গুগলি গম্ভীর হলেন। রেমারিক, বিশ্বাস করুন। আপনার বন্ধু মারা যাক, এ আমি দেখতে চাই না। আমাদের জন্যে অনেক করেছে সে। ইঙ্গিতে বেয়ারাকে ডেকে ডেজার্টের অর্ডার দিলেন। বেয়ারা চলে যেতে রেমারিকের হাতে হাত রাখলেন তিনি। কথাটা সত্যি। আপনার বন্ধুর কাছে আমি ঋণী। কি বলব, লোকটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। একজন লোক একার চেষ্টায় এতটা করতে পারে, কেউ বললে হাসতাম। কি ঘটছে জানি, তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। বিশেষ করে যেভাবে সে বেরলিংগারকে মারল।

ডেজার্ট দিয়ে গেল বেয়ারা।

পাধানি জিজ্ঞেস করল, আপনি তো তার বন্ধু, আপনি বলতে পারবেন। মানুষ তো আমরা সবাই, কিন্তু ওর মত অসাধারণ কজন? কি আছে তার মধ্যে, কিসের গুণে অসাধারণ সে?

তুমি তো তার ডোশিয়ে দেখেইছ, বললেন গুগলি। আসলে, অভিজ্ঞতা আর ট্রেনিং, আর সম্ভবত, আরও কি যেন কি একটা। চোখে প্রশ্ন নিয়ে রেমারিকের দিকে তাকালেন তিনি।

হ্যাঁ, আরও কি যেন কি একটা, একমত হল রেমারিক। এ অনেকটা সেক্স অ্যাপিলের মত-ছোঁয়া যায় না। হয়ত সমস্ত গুণ আর দক্ষতা আছে, তবু এই জিনিসটার অভাব থাকতে পারে একজন মানুষের টেকনিক্যালি যতই কিনা সে। ভাল হোক। হঠাৎ কোথাও এরকম লোক দেখতে পাওয়া যায়, যার মধ্যে জিনিসটা আছে। তাকে দেখেই অনেক সময় আলাদা বলে চেনা যায়। হতে পারে জিনিসটা আর কিছু না, ইচ্ছাশক্তি আর ভাগ্যের কমবিনেশন। অভিজ্ঞ ট্রেনিং পাওয়া এক প্লাটুন সোলজার ঠিক জায়গায় পজিশন নিতে ব্যর্থ হল। অথচ একজন লোক, কি যেন কি একটা আছে তার মধ্যে, প্রথমবারই ঠিক পজিশনে দাঁড়াল।

জিনিসটা কি আপনার মধ্যে আছে? নরম সুরে জানতে চাইলেন গুগলি।

হ্যাঁ, জবাবে বলল রেমারিক। কিন্তু রানার মধ্যে আছে অঢেল–ওটাই তাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আর হয়ত ভিলা কোলাসির ভেতরেও নিয়ে যাবে।

ওটা কি তাকে ভিলা থেকে বের করেও আনবে? দ্রুত জানতে চাইলেন। গুগলি।

কে জানে! প্রশ্নটা অস্বস্তি আর উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিল রেমারিককে। তার বিশ্বাস, ভিলায় ঢোকার প্ল্যান নিশ্চই আছে রানার, কিন্তু বেরুবার প্ল্যান আছে কিনা কে জানে!

.

ভাড়া করা ল্যানসিয়া মোবেক্সের পাশে থামাল রকি। ধাপে বসে তাকে নামতে দেখল সুসান। ল্যানসিয়ার দরজা বন্ধ করে ফিরল রকি, নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল সুসানের দিকে। অনেকক্ষণ কেটে গেল, এক চুল নড়ল না সুসান। তারপর সে তার বিশাল ছাতির ওপর হাত বেঁধে আগুপিছু দোল খেতে শুরু করল, হাসির প্রবল আওয়াজটা এল আরও এক মুহূর্ত পরে।

সুসানের পিছনে উদয় হল রানা। রকির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল ও, হাসল। ধাপ থেকে পিছলে নেমে গিয়ে ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। সুসান। তার অদম্য হাসি নির্জন ক্যাম্পসাইটের সবখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

মেয়েমানুষ এমন জঘন্য হয়! ক্ষোভ প্রকাশ করল রকি।

তাকে সমর্থন করে রানা বলল, সত্যিকার সৌন্দর্যের কদর নেই।

ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসল সুসান, হাঁটু জোড়া দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে। রকি ওয়াট, কাদার ব্যাঙ ডাঙায় উঠেছে, কিন্তু সেই ব্যাঙই আছ তুমি রাজপুত্র হওয়া তোমার কপালে নেই। গালভরা হাসি, কিন্তু এখন আর তার হাসিতে কোন আওয়াজ নেই।

ঘন নীল স্যুট পরে রয়েছে রকি, হাতে একটা কালো ব্রিফকেস, দাঁড়িয়ে আছে। ল্যানসিয়ার পাশে। সুসানকে সে গ্রাহ্য করল না। রানাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?

নিখুঁত, বলল রানা। সুসানের দিকে ফিরল ও। ওকে যদি ব্যাঙের মতই লাগবে, কাল রাতে তাহলে কাঁদছিলে কেন?

বাজে কথা! উঠে দাঁড়াল সুসান। ওর জন্যে কাঁদতে আমার বয়েই গেছে, চোখে বালি পড়েছিল। কিন্তু এগিয়ে এসে রকিকে আলিঙ্গন করল সে।

আঁতকে উঠল রকি, ব্যস্ত হয়ে বলল, আহ, করো কি! ছাড়ো, স্যুটের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!

সবাই ওরা মোবেক্সে চড়ল, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছোট টেবিলে বসল। রানার। নির্দেশগুলো কিভাবে পালন করেছে, বিশদ ব্যাখ্যা করে বলল রকি, তারপর জানতে চাইল, এবার কি?

পিছনে হাত দিয়ে ম্যাপটা বের করল রানা, ভাঁজ খুলে ছোট এয়ারফিল্ডটা দেখাল। রেগিয়োর ফ্লাইং ক্লাবের হেডকোয়ার্টার এটা। ওখানে গিয়ে একটা প্লেন। চার্টার করবে তুমি। ওদের বলবে, সিসিলির পশ্চিম উপকূল,ট্রাপানিতে যাবে।

রকি আর সুসান দৃষ্টি বিনিময় করল।

এতক্ষণে তোমার প্ল্যান জানা গেল, বলল সুসান। কিন্তু প্লেন নিয়ে ভিলায় তুমি নামবে কিভাবে?

মুচকি হাসল রানা। প্লেন নিয়ে নামব, আমি বলেছি?ওর প্রথম প্ল্যানটা কি ছিল, ব্যাখ্যা করল ও। টেলিফোনে একটা নাইট ফ্লাইট চার্টার করত, তারপর। দরকার হলে প্লেন হাইজ্যাক করত। রকি সাহায্য করতে চাওয়ায় ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছে।

কিভাবে কি করতে হবে, রকিকে সব বুঝিয়ে দিল রানা। ফ্লাইং ক্লাবে গিয়ে রকি বলবে, সে একজন ব্যবসায়ী, রেগিয়োতে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটছে তার। কয়েকটা মীটিং আছে, সেগুলো শেষ হওয়া মাত্র ট্রাপানির উদ্দেশে রওনা হতে চায়। ফ্লাইং ক্লাব বা আর কোথাও থেকে কেউ যদি চেক করে, জানবে শহরের। সবচেয়ে দামি হোটেলের সবচেয়ে খরচবহুল সুইটে উঠেছে সে, খাওয়াদাওয়ার। পিছনে খরচ করছে প্রচুর, স্রেফ গল্প করার জন্যে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় ফোন করে। মোটা বিল দেয়। সংক্ষেপে, রকির মধ্যে ভুয়া কিছু পাবে না তারা।

ফ্লাইং ক্লাবকে রকি জানাবে, ঠিক কখন যে সে রওনা হতে পারবে, আগে থেকে তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে ছঘন্টা আগে নোটিস দেবে সে। বেশিরভাগ সম্ভাবনা, শেষ সন্ধের দিকে রওনা হতে চাইবে সে, পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে যে-কোন একদিন।

নির্দিষ্ট একটা সময় ঠিক করতে পারছ না কেন? জানতে চাইল রকি।

কারণ ব্যাপারটা নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর।

তাহলে তিন দিনের মধ্যে কেন?

কারণ এই তিন দিন চাঁদ থাকবে না, বা থাকলেও খুব অল্প সময়ের জন্যে।

রকির কৌতূহল না মিটলেও, প্রশ্নটা চেপে রাখল সে। রানা ব্যাখ্যা করে বলল, ফ্লাইং ক্লাবে চারটে প্লেন আছে, তার মধ্যে একজোড়া সেসনা ওয়ান-সেভেন। টু। রকিকে একটা সেসনা চার্টার করতে হবে, অন্য কোন প্লেন হলে চলবে না। কারণ জানতে চাইলে রকি বলবে, আগেও এই প্লেনে চড়েছে সে, নিরাপদ বোধ। করে। পুরো টাকা অ্যাডভ্যান্স করবে রকি, নগদ।

সেসনা হতেই হবে, কেন?

রানা বলল, কারণ সেসনার রয়েছে হাই উইং কনফিগারেশন।

লাভ?

লাভ, সহজে জাম্প করা যায়।

কৌতূহল মিটল রকির।

.

গোটা ভিলাটা চক্কর দিচ্ছে ট্যানডন আর বোরিগিয়ানো। সব আয়োজন নিজের চোখে দেখেছে ওরা, তারপর এক জায়গায় থেমে নিজেদের মধ্যে আলোচনা। করছে।

মেইন গেটের বাইরে গার্ডদের সঙ্গে আলাপ করল ওরা, তারপর বাগানের পথ ধরে ফিরতে শুরু করল।

এভাবে আর যদি এক হপ্তা কাটে, আমি পাগল হয়ে যাব, বলল ট্যান্ডন।

তোমার পাগল হওয়ায় কিছু এসে যায় না, মন্তব্য করল বোরিগিয়ানো। ভাবো গডফাদারের কি অবস্থা হবে।

হুম। ট্যানডনের গম্ভীর চেহারায় দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ।

তুরিনের খবর শুনেছ নিশ্চই? জানতে চাইল বোরিগিয়ানো। নাইটক্লাব থেকে হপ্তার টাকা তুলতে গিয়ে আমাদের তিনজন লোক মারা গেছে। পাবলিক খেপে গেলে কি অবস্থা হয় জানই তো। উন্মত্ত মানুষ ওদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে পুলিস, কাউকে গ্রেফতার পর্যন্ত করেনি।

রোমে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে চারটে পরিবার মারামারি শুরু করেছে, বলল ট্যান্ডন। ছজন মারা গেছে এরই মধ্যে। এমনকি কালাব্রিয়াতেও গোলমাল শুরু হয়েছে। জেল থেকে আইন-শৃঙ্খলার জন্যে আবেদন জানিয়েছে ডন। ব্যামবিনো ফেটুচিনি, পরদিনই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। অথচ আমাদের গডফাদার কিছুই করছে না, কাউকে একটা নির্দেশ পর্যন্ত দিচ্ছে না সে।

গামবেরি আসছে কাল, পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে চায়, বলল বোরিগিয়ানো। গডফাদারের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যাবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্যানডন। আজ বিশ বছর ডন বাকালার সঙ্গে আছে সে। বিপদের সময় এই লোক ছাড়া আর কারও ওপর ভরসা করতে শেখেনি। সেজন্যেই এতটা অসহায় লাগছে তার।

হঠাৎ বোরিগিয়ানো ট্যানডনের একটা হাত খামচে ধরল। শিউরে উঠে। পাথরের মূর্তি হয়ে গেল দুজন।

কোন শব্দ না করে কালো এক জোড়া ছায়া অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল। একেবারে কাছে চলে এল ওগুলো, ঘন ঘন নাক কোচকাচ্ছে, তারপর যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বেজন্মা কুকুরগুলোকে দেখলেই আমার ল্যাট্রিনের বেগ চাপে, অভিযোগের সুরে বলল বোরিগিয়ানো।

ভয় পাবার কোন কারণ নেই, হেসে উঠে বলল ট্যানডন। আমাদের গন্ধ চেনে ওরা।

কোন কারণে যদি ভুল হয়, যদি চিনতে না পারে? শিউরে উঠল। বোরিগিয়ানো। কি জানি কি আছে কপালে!

কিচেনের দরজা দিয়ে ভিলায় ঢুকল ওরা। বিশাল কামর, পাথরের দেয়াল। অতিরিক্ত বডিগার্ডদের জন্যে ক্যানটিন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কামরাটাকে। আটজনকে দেখা গেল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে কফি খাচ্ছে, আর টেলিভিশন দেখছে। কাঠের টেবিলে এটো বাসনকোসন পড়ে রয়েছে এখনও। ছটা সাবমেশিনগান আর দুটো শটগান দেখল ওরা, সবগুলো হাতের কাছে রাখা। কিচেন থেকে একটা প্যাসেজ ভিলার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে। প্রথম কামরায় কাঠের বাক্স তৈরি করা হয়েছে, বডিগার্ডরা বিশ্রাম নেবে এখানে। কয়েকজনকে দেখা গেল ঘুমাচ্ছে, কেউ কেউ বসে গল্প করছে। ওদের টহলের পালা শুরু হবে। মাঝরাতে।

প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে গেছে সেটা, সেখানেই ডন বাকালার স্টাডি আর বেডরূম। ট্যানডন আর বোরিগিয়ানোর বেডরূমও ওই দোতলায়। বডিগার্ডদের সঙ্গে দুএকটা কথা বলে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় উঠে এল ওরা।

স্টাডির বাইরে ডন বাকালার পার্সোনাল বডিগার্ড একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে, কোলের ওপর সাবমেশিনগান। ওদেরকে দেখে উঠে দাঁড়াল সে, দরজায়। টোকা দিল দুবার, কবাট মেলে ধরল। রিপোর্ট করার জন্যে ভেতরে ঢুকল ওরা।

.

দুদিন পর দমকা বাতাস নিস্তেজ হয়ে পড়ল। চব্বিশ ঘন্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকবে। আকাশে ছোটখাট মেঘ জমতে পারে, পুবদিক থেকে হালকা বাতাস বইবে, উত্তর সিসিলির দুএক জায়গায় অল্প বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা।

তৈরি হল রানা।

সন্ধে নামতে বড়, চওড়া স্যুটকেস খুলে একটা পার্সেল বের করল ও, ফরাসী জেনারেল মার্সেলেসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এটা। বাইরে, ঘাসের ওপর বসে, ওর। দিকে তাকিয়ে আছে সুসান আর রকি। পার্সেল খুলে বিশাল একটা কালো কাপড়ের ভাঁজ করা থান বের করল রানা।

দেখে তো প্যারাস্যুট বলে মনে হচ্ছে না, অবাক হয়ে বলল রকি।

বরং অনেকটা ডানার মত, বলল রানা। লাফ দাও, তারপর ভাগ্যের ওপর নির্ভর কর, সেদিন ফুরিয়েছে। এটা ফ্রেঞ্চ মিস্ট্রাল। ভাল ট্রেনিং পাওয়া একজন প্যারাএমনকি বাতাসের উল্টো দিকেও এটা নিয়ে ফ্লাই করতে পারবে, টার্গেটের কয়েক গজের মধ্যে ল্যাণ্ড করা আজকাল কোন সমস্যাই নয়।

কর্ডগুলো একটা নকশার মত করে বিছাল রানা, ওরা তাকে সাহায্য করল। তারপর পিছিয়ে এসে দেখল কিভাবে রানা দক্ষতার সঙ্গে বাঁধল কর্ডগুলো। সবশেষে ক্যানোপিটা ভাঁজ করল আবার।

প্যারাস্যুট প্যাক করে মোবেক্সের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখল রানা। রকির দিকে ফিরে বলল, আধ ঘন্টার মধ্যে রওনা হব আমি।

কোন সাহায্য লাগবে? জিজ্ঞেস করল রকি।

না, নিজেই করতে পারব। এখানেই অপেক্ষা কর তোমরা।

মোবেক্সের ভেতরে এসে দ্বিতীয় পার্সেলটা খুলল রানা, ঢাকা থেকে মেজর জেনারেল রাহাত খান পাঠিয়েছিলেন এটা। পার্সেল খুলতে সোদা একটা গন্ধ ঢুকল। নাকে, অনেকদিন ব্যবহার না করলে কাপড় থেকে এই গন্ধটা বেরোয়। রানার পুরানো একটা ক্যামোফ্লেজ কমব্যাট ইউনিফর্ম। কাপড় ছেড়ে ইউনিফর্মটা পরল ও।

মোবেক্সের বাইরে যখন বেরিয়ে এল, চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। ল্যানসিয়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রকি আর সুসান। দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল রানা। চাপা গলায় ফুঁপিয়ে উঠল সুসান।

রানা কে, কি করতে কোথায় যাচ্ছে, সবই জানে ওরা, কিন্তু ওকে তৈরি হয়ে। বেরিয়ে আসতে দেখে এই প্রথম ধাক্কাটা খেল।

অতিরিক্ত ফোলানো বেলুনের মত লাগছে রানাকে। বুটি বুটি দাগ আর ছোপ, লাগানো ওভারঅল পরে আছে ও, নিচের দিকটা কালো আর লম্বা বুটের ভেতর। গোঁজা। ইউনিফর্মের দুটো পায়ে অনেকগুলো পকেট, ফুলে আছে সবগুলো। বুকের কাছে অনেকগুলো কর্ড আর একজোড়া পকেট। এই পকেট দুটোও ফুলে। আছে, ভেতরে গ্রেনেড। কোমরের কাছে বড়সড় একটা পাউচ। বেল্টের ডান দিকে একটা ক্যানভাস স্ন্যাপ-ডাউন হোলস্টার, সেটার পাশে আর পিছনে ছোট ছোট আরও অনেকগুলো পাউচ। গলা থেকে একটা স্ট্র্যাপের সঙ্গে ঝুলছে ইনগ্রাম সাবমেশিনগান, স্ট্র্যাপের লুপে ঢুকে আছে ডান, কনুই। বাঁ হাতে রয়েছে কালো, নিটেড, স্কালক্যাপ।

প্যারাস্যুট তুলে নিয়ে ল্যানসিয়ার দিকে এগোল রানা, মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তোমরা রেডি?

মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু বলতে গেল রকি, কিন্তু আওয়াজ বেরুল না। দরজা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়াল সে। প্যারাস্যুটটা ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে সুসানের দিকে ফিরল রানা। কিছু বলার নেই, সুসান; সবই তো জানো।

নাক টানল সুসান, প্রকাণ্ড হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল, তারপর রানার দিকে তাকাল। আমারও কিছু বলার নেই, রানা। শুধু একটা কথা জেনো, আড়াল থেকে সব দেখতে পাচ্ছে, লুবনা। ওর আর কোন কষ্ট বা দুঃখ নেই।

শক্ত পাথর হয়ে উঠল রানার চেহারা। পরমুহূর্তে শিথিল হল মুখের। রেখাগুলো। সুসানের কাঁধে একটা হাত রাখল ও। আমার জন্যে কোন দুশ্চিন্তা কোরো না। এসব কাজ আগেও আমি করেছি–পানির মত সহজ।

অবিরাম ধারায় সুসানের গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। হঠাৎ রানাকে আলিঙ্গন করল সে তারপর ছেড়ে দিয়ে পিছন ফিরল, মোবেক্সের ভেতর ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা।

.

এয়ারফিল্ড বিশ মিনিটের পথ। পিছনের সিটে শুয়ে আছে রানা, রাস্তা থেকে কেউ ওকে দেখতে পাবে না। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে ওরা।

রকি জানতে চাইল, তুমি বেরুবে কিভাবে?

বাতাসের দিকেও সেসনার দরজা খোলা যায়, বলল রানা।

না, ভিলা কোলাসির কথা জিজ্ঞেস করছি আমি। ভেতরে ঢুকবে জানি, কিন্তু বেরুবে কিভাবে?

পরবর্তী প্রশ্নের অবকাশ না রেখে, ছোট্ট করে জবাব দিল রানা, ঢোকার পথ। থাকলে বেরুবারও পথ আছে।

খানিক পর জানতে চাইল রানা, সব কথা তোমার মনে আছে তো, রকি? কি। করতে হবে না হবে?

আছে, বলল রকি।

আজ রাতে?

হ্যাঁ, মোবেক্স নিয়ে রওনা দেব আমরা।

এক মিনিটও দেরি করবে না, বলল রানা। চারদিকে নানা রকম গোলযোগ শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু সকালে তোমাদের ওই ফেরিতে ওঠা চাই।

জানি, বলল রকি। সামনে এয়ারফিল্ড বাইরে শুধু দুটো গাড়ি দেখতে পাচ্ছি। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না।

হ্যাঙ্গারের পিছনে ল্যানসিয়া থামাল রকি। হাতে স্যুটকেস নিয়ে নেমে পড়ল। পিছন দিকে একবারও তাকাল না সে, বলল, গুড লাক, রানা।

ধন্যবাদ, রকি।

.

স্টার্ট-আপ চেক শেষ করল ভেলুচি ডেলু। এই চার্টারের মেয়াদ শেষ হলে খুশি হয়। সে। এয়াফোর্স থেকে ট্রেনিং পাওয়া পাইলট, নিয়ম ভাঙতে অভ্যস্ত নয়। ছঘন্টা ধরে স্ট্যাণ্ড-বাই থাকায় গলায় এক ফোঁটা মদ ঢালতে পারেনি সে। ঠিক করেছে রাতটা ট্রাপানিতেই থেকে যাবে, বন্ধুদের নিয়ে মদ খাবে সকাল পর্যন্ত। ওখানে তার অনেক বন্ধু আছে।

আড়চোখে ডান পাশের সিটে বসা অস্ট্রেলিয়ান লোকটার দিকে তাকাল সে। লোকটাকে একটু নার্ভাস, লাগছে। এরকম নার্ভাস লোক দেখে অভ্যস্ত ডেলু। আমরা রেডি, বলল সে।

গুড। মাথা ঝাঁকাল আরোহী।

জ্যান্ত হয়ে উঠল সেসনার এঞ্জিন। অয়েল প্রেশার গজের দিকে তাকাল ডেলু। আরোহী, টোকা দিল তার কাঁধে। এঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল তার গলা, পৌঁছুতে কতক্ষণ লাগবে?

এক ঘন্টার কিছু কম, বলল ডেলু। তার দৃষ্টি ডায়ালের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্লেনে টয়লেট নেই? আবার জিজ্ঞেস করল আরোহী।

মাথা নাড়ল ডেলু।

কিন্তু আমার যে টয়লেটে একবার না গেলেই নয়!

ক্ষীণ একটু হাসল ডেল। এ লোক সত্যি নার্ভাস। হাত বাড়িয়ে ডান দিকের দরজাটা খুলে দিল সে। যান। সাবধানে নামবেন।

সিট বেল্ট খুলে প্লেন থেকে নেমে গেল আরোহী। আবার ডায়ালের দিকে মন দিল ডেলু।

দুমিনিট পর দরজায় একজনকে দেখা গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই পাথর হয়ে গেল পাইলট। প্রথমেই চোখ পড়ল পিস্তলটা। তারপর লোকটাকে দেখল।

তোমার কাজ তুমি কর,বলল রানা। কোন ভয় নেই।

বেল্ট দিয়ে নিজেকে আটকাল না রানা। সিটে বসে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকল শুধু, ডান হাতটা ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের মাথায়, শরীরটা পাইলটের দিকে বাঁকানো। হাতের পিস্তল নিচু করা, পাইলটের পাজরের কাছাকাছি।

চেক কমপ্লিট কর, বলল রানা। নিয়ম ধরে করবে। সেসনা চালাতে জানি আমি। রেডিও প্রসিডিউরও জানা আছে। বোকার মত কিছু করতে যেয়ো না।

স্থির হয়ে বসেই থাকল পাইলট। হাত দুটো হাঁটুর ওপর। মাথার ভেতর দ্রুত চিন্তা চলছে। নতুন আরোহী তার চিন্তায় বাধা দিল না, চুপচাপ বসে থেকে অপেক্ষা করছে। অবশেষে মনস্থির করল ডেলু। কিছুই বলল না সে, নিঃশব্দে টেকঅফের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।

দশ মিনিট পর। মেসিনা প্রণালীর চার হাজার ফিট ওপরে উঠে এসেছে সেসনা। সামনে দেখা যাচ্ছে সিসিলির আলো। আরও ওপরে উঠছে ওরা।

.

পিস্তলটা তুমি সরিয়ে রাখতে পার। আমি জানি তুমি কে। আমিও আছি তোমার পাশে!

মাত্র এক মুহূর্ত চিন্তা করল রানা, তারপর ক্যানভাস হোলস্টারে ভরে রাখল কোল্ট। দুই সিটের মাঝখানে হাত গলিয়ে পাইলটের চার্টটা তুলে নিল ও। ট্রাপানির রুট পেন্সিল দিয়ে দাগানো রয়েছে। ভিলা কোলাসি থেকে তিন মাইল দক্ষিণের পথ ধরে যাবে ওরা। টারমিনি ইমেরেসি বীকন পেরোবার পর, আমি চাই, একটু ঘুর-পথে যাবে তুমি, বলল রানা।

গম্ভীর একটু হাসি দেখা গেল পাইলটের মুখে। এই চার্টারের জন্যে আরও বেশি টাকা চাওয়া উচিত ছিল আমার।

কম–তোমার আরোহী সবটুকু পথ যাচ্ছে না।

ভাগ্যই বলতে হবে পুরোটা অ্যাডভান্স পেয়ে গেছি, বলল ডেলু। নিন, ব্রিফ করুন।

ম্যাপ নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকল রানা। দেখতে না পাওয়ার কোন কারণ। নেই। পালার্মো থেকে দক্ষিণ দিকে পাঁচ কিলোমিটার, মনরেলা থেকে পুব দিকে তিন কিলোমিটার। আলোয় ক্রিসমাস ট্রি-র মত ঝলমল করছে। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের দিকে তাকাল ও। পাঁচ হাজার ফিট ওপরে রয়েছে সেসনা। এখনও উঠছে। সাধারণত কহাজার ফিটে সিধে কর প্লেন?

সাত হাজারে।

গুড। বীকন না পেরোনো পর্যন্ত ওই হাইটেই থাক। তারপর আবার উঠতে শুরু করবে, বারো হাজার ফিট পর্যন্ত।

অবাক হয়ে রানার দিকে তাকাল ডেলু।

হাই অলটিচ্যুড, লো ওপেনিং, ব্যাখ্যা করল রানা।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল ডেলু। আমরা ওটাকে ডিলেইড ফ্লোট বলি। প্যারাস্যুট খুলবেন কহাজার ফিটে?

দুহাজার, তার আগে নয়–অবশ্য নির্ভর করবে আমার ফ্রি ফল ডিফটের ওপর। বাতাস পুব দিকে বইছে, দশ নটে।

প্যারাস্যুট প্যাকের দিকে তাকাল পাইলট। কি ধরনের ওটা?

একটা ডানা-ফেঞ্চ মিন্ট্রাল।

আপনার ভাগ্যই বলতে হবে, ডিউটিতে আজ আমি ছিলাম, বলল ডেলু। ওদের অত্যাচারে আমাদের পরিবার অনেক ভুগেছে। আপনি যা করছেন, আমরা। ইটালিয়ানরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকল ওরা। তারপর রানা জানতে চাইল, তুমি কি তারপর ট্রাপানিতে যাবে?

না। রেগিয়োতে ফিরে যাব–সেটাই নিরাপদ। অস্ট্রেলিয়ান লোকটা কে?

ককপিটের ম্লান লালচে আলোয় রানার চেহারা নরম দেখাল। তোমার মতই একজন।

*

হিলটনের বারে রয়েছেন কর্নেল গুগলি, খোলা জানালার দিকে পিছন ফিরে কাউন্টারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন-হাতে ককটেল গ্লাস, চোখে সুন্দরী রমণী। খুবই খোশ-মেজাজে আছেন তিনি, তার হাতের ককটেল একটা হাইবল। দেহ-মনে ফুর্তি এনে দিয়েছে স্বর্ণকেশী আমেরিকান মেয়েটা। এক কোণের একটা টেবিলে ওরা দুই বান্ধবী, বসে আছে, অপরজন নিগ্রো যুবতী। চোরা চোখে লেডিকিলার কর্নেলের দিকে প্রায়ই তাকাচ্ছে শেতাঙ্গিনী, চোখাচোখি হতে একটু লজ্জা পাচ্ছে, দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার আগে ক্ষীণ একটু হাসির রেখা ফুটে উঠছে তার ঠোঁটে।

কর্নেলের সঙ্গেই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেমারিক আর পাধানি। রেমারিক অন্যমনস্ক। কিন্তু পানি শুধু ব্যাপারটা টেরই পায়নি, উপভোগও করছে। আটত্রিশ বছর বয়স কর্নেলের, কোন মেয়ে এখনও তাকে বাঁধতে পারল না, সেজন্যে দুঃখের অবধি নেই পাধানির। আসলে কর্নেলেরই কপাল খারাপ। যখনই সুন্দরী কোন মেয়ের দিকে ঝুঁকবেন তিনি, তখনই জরুরি কাজের ডাক আসে, মেয়েটাকে হতাশ করে কর্তব্যের পিছনে ছুটতে হয় তার। শুধু এই একটা কারণে কত মেয়ে যে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, গুনে শেষ করা যাবে না।

কর্নেল আর আমেরিকান মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করে পানি উপলব্ধি করল, ওদের যদি মিলন হয়, আদর্শ একটা দম্পতি হতে পারবে ওরা।

কি যেন বলল পাধানি, রেমারিক শুনতে পেল না। কয়েকদিন থেকেই প্রচণ্ড একটা টেনশন অনুভব করছে সে। রানার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না।

সাধারণ একটা রেডিও, মানুষের মাথা থেকে বেরিয়েছে, দুনিয়ার সবখানে আর মহাশূন্যের কোটি কোটি মাইল দূরে সিগন্যাল পাঠাতে পারে। তাহলে এ-ও বাস্তব বলে মনে হয় যে মাথাটাও, রেডিওর চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত আর সফিসটিকেটেড, নিশ্চয়ই সিগন্যাল পাঠাতে পারে, পারে আরেক মাথার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

এসব কথা ভাবছে না রেমারিক। কিন্তু তার মন গাইছে, সে আসছে–রানা। আসছে। আর বেশি দূরে নেই। আশ্চর্য একটা অস্থিরতা বোধ করছে সে। মনে হচ্ছে, কি যেন একটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করা দরকার তার। তা না হলে রানার আগমন টের পাবে না।

বারটেণ্ডারকে আরও ড্রিঙ্কের জন্যে বললেন গুগলি। খুক করে কেশে আবার রেমারিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল পাধানি। মেয়েটার ব্যাপারে রেমারিকের মন্তব্য শুনতে চায় সে।

এত উদাস কেন? মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইলেন গুগলি।

না, অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল রেমারিক।

মেয়েটাকে দেখেছেন? জিজ্ঞেস করলেন গুগলি। ঠিক বুঝতে পারছি না, কাকে পছন্দ করছে ও। প্রতি মিনিটে বিশ সেকেণ্ড করে আমাদের তিনজনকেই দেখছে,। কি বুঝব?

ঘড়ি আমার হাতেও আছে, কর্নেল, পাধানি বলল। হিসেবে ভুল করছেন আপনি।

তাই? একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন গুগলি। কি রকম?

হঠাৎ কর্নেলের একটা হাত খামচে ধরল রেমারিক। শুনুন! চাপা গলায় বলল সে, তার হাত কাঁপছে।

খোলা জানালা দিয়ে অত্যন্ত অস্পষ্ট একটা যান্ত্রিক গুঞ্জন ভেতরে ঢুকছে। মনে, হল অনেক দূর দিয়ে একটা প্লেন যাচ্ছে।

রানা!

কর্নেল আর ক্যাপ্টেন হতভম্ব, তাকিয়ে আছে রেমারিকের দিকে।

রানা! আবার ফিসফিস করে বলল রেমারিক। এসে গেছে ও!

ক্যাপ্টেনের দিকে তাকালেন কর্নেল।

ঝট করে উঠে দাঁড়াল রেমারিক, টেবিলে একটা ধাক্কা খেল। কর্নেলের দিকে ঝুঁকল সে, চোখ দুটো বিস্ফারিত। ও একজন প্যারাটু পার কমাণ্ডো, কাঁপা গলায় বলল সে। প্লেন ছাড়া আর কিসে করে আসবে ও! দরজার দিকে ছুটল সে।

কর্নেল দাঁড়ালেন, দেখাদেখি পাধানিও। স্বর্ণকেশীর দিকে তাকালেন কর্নেল, তাঁর চোখে বিষাদের ছায়া দেখল পাধানি।

এসো, বললেন গুগলি। লোকটার সময়জ্ঞান আগের মতই আছে, একটুও বদলায়নি।

.

ঠেলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে দরজা। ফাঁকটার মাঝখানে রানার মুখ আর কাঁধ দেখা যাচ্ছে। রাবারের সোল লাগানো বুট জোড়া আণ্ডারক্যারিজের অবলম্বনের ওপর স্থির হয়ে আছে। খুলি কামড়ে বসে আছে কালক্যাপ, মুখের নিচের অংশ রঙ লাগিয়ে কালো করা হয়েছে। চোখ দুটো অপলক স্থির হয়ে আছে পাইলটের ওপর।

দক্ষ হাত, গভীর মনোযোগের সঙ্গে প্লেন চালাচ্ছে ডেলু। আস্তে ধীরে প্লেনটাকে কাত করল সে, ডানে-বামে ঘন ঘন তাকাচ্ছে, বেয়ারিংগুলো দেখে নিয়ে কমপাসের সঙ্গে মিলিয়ে কোর্স ঠিক রাখছে। তার বাঁ পা রাডারে উঠে এল, চাপ দেয়ার জন্যে তৈরি। তার ডান হাত শূন্যে উঠে পড়ল। চালিয়ে যাও, মাসুদ রানা! আমরা আছি তোমার…

ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ডেলু। দরজা খালি।

.

ভিলা কোলাসির সব কটা জানালা বন্ধ।

দোতলার একটা জানালা খুট শব্দ করে খুলল, সামান্য একটু ফাঁক হল কবাট। ধীরে ধীরে, এক চুল এক চুল করে সরল পর্দা। লাল টকটকে একটা চোখ দেখা গেল পর্দার ফাঁকে।

অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকল ডন বাকালা। বাগান আর লন পুরোপুরি অন্ধকার নয়, পাচিলের বাইরে থেকে ফ্লাডলাইটের আলো না এলেও, আলোর আভা আসতে বাধা পায়নি। গত কয়েক দিনে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। ভয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে হতাশা, আর রাগ। যুগ যুগ ধরে যারা অনুগত ছিল, সেই পা-চাটা কুকুরগুলো এখন তার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এমনকি যারা তার চারপাশে থাকে। মুখে কিছু না বললেও ওদের চেহারা দেখে সে বুঝতে পারে সব। তার এই স্টাডিতে বসে নির্লিপ্ত একটা ভাব দেখিয়ে গেছে গামবেরি। কি দুঃসাহস!

উন্মাদ লোকটা মারা যাক, তারপর সে ওদের দেখে নেবে। তখন ওরা বুঝবে, কতটুকু তার ক্ষমতা। বুলেট আকৃতির নিচে চওড়া মুখটা কঠোর হয়ে উঠল। দৃঢ় একটা প্রতিজ্ঞায় ঠোঁট জোড়া পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে সেঁটে আছে। পর্দা টেনে দিয়ে ডেস্কের দিকে ফিরল সে।

কয়েক সেকেণ্ড পর পাচিলের ওপর দিয়ে প্রকাণ্ড একটা কালো, পোয়াতি বাদুড়ের মত উড়ে এল রানা।

.

১১.

বাগানের পাশে ঘাসের ওপর ল্যাণ্ড করল রানা। পা মাটির স্পর্শ পেতেই ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটু, কয়েকটা ডিগবাজি দিয়ে ছোট্ট এক লাফে সিধে হয়ে দাঁড়াল-রিলিজ হ্যাণ্ডেল টান দিয়ে আগেই প্যারাসুট থেকে মুক্ত করে নিয়েছে নিজেকে। একটা গাছের গায়ে কালো আবরণের মত ঝুলে আছে প্যারাস্যুট।

ব্যস্ত হাতে বেরিয়ে এল কোল্ট আর সাইলেন্সার। আঙুলে বিদ্যুৎ খেলে গেল, প্যাঁচ ঘুরিয়ে ফিট করল সাইলেন্সর। সামনের দিকে ঝুঁকল রানা, একটা গাছের দিকে পিছন ফিরে আছে। বুকের একটা পাউচ থেকে নাইট সাইট বের করল।

বাঁ দিক থেকে ডান দিকে, পুরো লনের ওপর চোখ বুলাল, ভিলার একপাশ ঘুরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল ওগুলোকে। এক জোড়া নিচু, কালো আকৃতি, পাশাপাশি, ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে। কোল্ট আর নাইট সাইট একই সরল রেখায় স্থির রয়েছে। গভীর করে শ্বাস টেনে আরও একটু ঝুঁকল রানা। ডোবারম্যান নিঃশব্দে হামলা চালায়, খুন করে নিঃশব্দে।

ওগুলো মরলও নিঃশব্দে। প্রথমটা দশ মিটার দূরে, বুকে আর গলায় বুলেট নিয়ে। দ্বিতীয়টা হার্টে গুলি খাবার আগে পাঁচ মিটারের মধ্যে চলে এল, গুলি খাবার পরও তার গতি পুরোপুরি রুদ্ধ হল না, রানার পায়ের কাছে এসে একটা হেঁচকি তুলে মারা গেল।

কিচেনে ওরা ফুটবল খেলা দেখছে। জুভেন্টাস বনাম নেপলস। সবার চোখ আঠার মত আটকে আছে টিভির পর্দায়। জানালা বিস্ফোরিত হওয়ার শব্দে সবাই ঘাড় ফেরাল, দেখল, অশ্লীল আকৃতির একটা গ্রেনেড জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে।

তিন জন মারা গেল সঙ্গে সঙ্গে। দুজন চিরকালের জন্যে অচল হয়ে গেল শাপনেলের আঘাতে। বিস্ফোরণের আঘাত থেকে রক্ষা পেল চারজন, বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। লাথি মেরে খোলা হল দরজা, তখনও অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াবার। মত হুশ ফেরেনি ওদের।

বুকের কাছে সাবমেশিনগান ধরে দরজায় দাঁড়াল রানা। চোখ দুটো চঞ্চল, কিছু নড়ে কিনা দেখছে। সাদা আগুনের শিখা বেরুল ইনগ্রাম থেকে। ঘরের ভেতর। থেমে গেল প্রাণস্পন্দন।

যেন কোন ব্যস্ততা নেই, অথচ দ্রুত, এগোচ্ছে রানা। খোলা দরজার পাশে দাঁড়াল ও, বাইরে প্যাসেজ। পাথুরে মেঝেতে ছিটকে পড়ল খালি একটা ম্যাগাজিন। ক্লিক শব্দে নতুন আরেকটা বসাল জায়গামত। আবার ককু করল। ইনগ্রাম। দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ, কান দুটো সজাগ।

প্যাসেজের মাঝখান থেকে কর্কশ চিৎকার ভেসে এল, আরও অস্পষ্ট হৈ-চৈ এল ওপরতলা থেকে। কি ঘটছে, জানতে চাইছে ওরা। এক এক করে অনেকগুলো দরজা খোলার আওয়াজ হল। কোমর বাঁকা করে নিচু হল রানা, ঝট করে দাঁড়াল খোলা দরজার সামনে, ইনগ্রাম নিচের দিকে তাক করা, অগ্নি উদগীরণ করছে।

প্যাসেজে তিনজন লোক। একজন পিছিয়ে গিয়ে কামরার ভেতর ঢুকে পড়তে পারল। বাকি দুজন বুলেটের ধাক্কা খেয়ে নির্দিষ্ট একটা ছন্দে পিছিয়ে যেতে শুরু করল, সেই সঙ্গে লম্বায় ছোট হতে থাকল দ্রুত।

আবার এগোল রানা, আবার খালি ম্যাগাজিন ছিটকে পড়ার আওয়াজ হল পাথুরে মেঝেতে। এ যেন এক ধরনের উঁচু দরের তাল লয় সহ বিশুদ্ধ নৃত্য শিল্প। ছন্দোবদ্ধ, সুচারু, সুনিপুণ; প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে তাল ও লয়ের মিল থাকছে। নৃত্যের সঙ্গে মিল রেখে সঙ্গীত-আর্তচিৎকারকে চাপা দিয়ে উচ্চকিত হয়ে ওঠা। গানফায়ার, খরচ হয়ে যাওয়া কান্ট্রিজের টুনটুন বোল।

খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল না রানা, বাঙ্কগুলোর মাঝখানে একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে দিল শুধু। প্যাসেজ ধরে কয়েক পা এগিয়ে এল, বিস্ফোরণের আওয়াজে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পিছন দিকে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় প্যাসেজে বেরিয়ে এসেছে লোকটা, গোঙাচ্ছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে মেঝেতে। শটগানটা আটকে গেছে কাপড়ে, চেষ্টা করেও তুলতে পারছে না। ট্রিগারে চাপ পড়ল, ইনগ্রাম থেকে আধ সেকেণ্ড গুলি বেরুল। আবার ঘুরল রানা, পৌঁছে গেল সিঁড়ির গোড়ায়, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল, বুকের কাছে ইনগ্রাম, কান দুটো সজাগ।

.

ল্যাণ্ডিঙের ওপরে, স্টাডির দরজায় ডান হাতে একটা পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডন বাকালা। বাঁ হাত দিয়ে পার্সোনাল বডিগার্ডের শার্টের আস্তিন আঁকড়ে ধরেছে সে।

থাকো এখানে! খেঁকিয়ে উঠল বাকালা, ঘামে ভেজা চেহারায় আতঙ্ক। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্যানডন, বোরিগিয়ানো, আর গামবেরি। পিস্তলগুলো নিচের দিকে তাক করা। ট্যানডনের গায়ে শার্ট নেই, তার বুক আর পিঠ ঢাকা আছে কালো লোমে। নিচে নামো!

ঘাড় ফিরিয়ে ডন বাকালার দিকে তাকাল ওরা। সবাই ইতস্তত করছে। ঘৃণায়, রাগে, ভয়ে বিকৃত হয়ে উঠেছে বাকালার মুখ। নিচে নামো!কর্কশ গলায় আবার গর্জে উঠল সে, হাতের পিস্তলটা তুলল।

নড়ে উঠল ট্যানডন, সাপের মত এগোল তার পা, এক ধাপ নিচে নামল। তার শরীরের ওপরের অংশটুকু শুধু দেখতে পাচ্ছে বাকালা, এই সময় কানে তালা লাগিয়ে দিল সাবমেশিনগানের একটানা আওয়াজ। বাকালা দেখল, একটা ঝাঁকি খেয়ে শূন্যে উঠল ট্যানডন, কালো লোমের মাঝখানে কাঁচা লাল গর্ত দেখা গেল। পরমুহূর্তে চোখের আড়ালে পড়ে গেল সে। আওয়াজ শুনে বোঝা গেল লাশটা নিচের দিকে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে।

পিছিয়ে সিঁড়ির মাথায় উঠে আসছে বোরিগিয়ানো আর গামবেরি। নিচে নামবে না ওরা। দুজনেই ডান দিকে তাকাল, দশ মিটার পিছনে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাকালা, বডিগার্ডের পিছনে গা ঢাকা দিয়ে আছে। আবার যখন ওরা। সিঁড়ির দিকে ফিরল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুজনের ঠিক মাঝখানে। বিস্ফোরিত হল গ্রেনেডটা। ল্যাণ্ডিঙের কোণ আড়াল করে রাখায় বাকালা আর বডিগার্ড বেঁচে গেছে।

গ্রাস করল নিখাদ আতঙ্ক। বডিগার্ডের পিঠে ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে স্টাডির ভেতর ঢুকে পড়ল বাকালা। দড়াম করে দরজা বন্ধ করল, হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল জানালার সামনে। খোলার ধৈর্য হল না, পিস্তলের বাঁট দিয়ে কাঁচ ভেঙে, এক টানে ছিঁড়ে ফেলল পর্দা। তারপর বাইরে মুখ বের করে চিৎকার জুড়ে দিল, কোথায় তোমরা? ওপরে উঠে এসো! ওপরে উঠে এসো!

.

সিঁড়ির মাথায় থামল রানা, বিধ্বস্ত শরীরগুলোর ওপর চোখ বুলাল। প্যাসেজের গা। ঘেষে এগোল ও, বাকালার উন্মত্ত চিৎকারু পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।

ইনগ্রামটা ডান হাতে, বা হাত দিয়ে একটা গ্রেনেড বের করল। গ্রেনেড ধরা। হাতটা নিচু করে ইনগ্রামের পাশে আনল, ডান হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে খুলে নিল পিন। স্পিঙ রিলিজ করল, মাথার ভেতর ঘড়িটা টিক টিক করল দুবার, আঙুলগুলো ছড়াতে শুরু করল। হাত থেকে ছুটে গেল গ্রেনেড, কোণ ঘুরে মেঝেতে ড্রপ খেল দুবার, ঠক করে বাড়ি খেল স্টাডির দরজায়।

বিস্ফোরণের আওয়াজে জানালার দিকে পিছন ফিরল বাকালা। দেখল, ওক কাঠের মজবুত দরজা কজা সহ ভেতর দিকে ছিটকে পড়ছে। দরজার সঙ্গে তার। পার্সোনাল বডিগার্ডের লাশও আছড়ে পড়ল কার্পেটে।

নেতাদের নেতা দাঁড়িয়ে থাকল–আড়ষ্ট। রক্ত-মাংসের দলা পাকানো পিণ্ডটার। ওপর স্থির হয়ে আছে চোখ। মুখ খুলল সে, কিন্তু কোন আওয়াজ হল না। তার ব্রেন অচল হয়ে গেছে।

তারপর, নিচে থেকে ভেসে আসা চিত্তার শুনতে পেল সে। এতক্ষণে আসছে। ওরা! দরজার দিকে তাকাল, তাকিয়ে থেকেই কুঁজো হল ভারি ডেস্কের পিছনে, পিস্তল ধরা হাতটা লম্বা করা। বুকের ভেতর তড়পাচ্ছে হৃৎপিণ্ড, থেমে থেমে দমকা বাতাসের মত নিঃশ্বাস পড়ছে।

দোরগোড়া থেকে ডাইভ দিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা, কার্পেটে পড়েই গড়িয়ে। দিল শরীরটাকে। লাশের ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে ঘরের ঠিক মাঝখানে চলে। এল, উঠে দাঁড়াল এক লাফে। দুবার গুলি করল বাকালা। কাঁপা হাতের গুলি, তবে একটা বুলেট লাগল। ঝাঁকি খেয়ে পাশে, আর পিছন দিকে সরে গেল রানা। দেখতে পেয়ে ডেস্কের পিছনে সিধে হল বাকালা, উল্লাসে দুর্বোধ্য আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা থেকে। পরপর আরও দুবার গুলি করল সে–সেই কাঁপা হাতের গুলি।

তার অভিজ্ঞতা নেই। শুধু ভাগ্যই যথেষ্ট নয়।

রানার ডান কাঁধে গুলি লেগেছে, হাতটা কোন কাজে আসছে না। ইনগ্রামটা এখনও গলা থেকে ঝুলছে, বাঁ হাতে ধরে আছে সেটা। ডেস্কের দিকে এক ঝাঁক গুলি ছুটে গেল ওটা থেকে।

ধীরে ধীরে দাঁড়াল রানা, কাঁধের অসহ্য ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে। ইনগ্রাম সিধে করে সাবধানে ডেস্কের দিকে এগোল ও।

কার্পেটে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে বাকালা। একটা হাঁটু শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হাত দিয়ে তলপেটে চেপে ধরে আছে সে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে সাদা চর্বি দেখা যাচ্ছে, লাল রক্তের স্রোত মাঝেমধ্যে ঢেকে দিচ্ছে সাদা রঙটাকে। মুখ। তুলে রানার চোখে তাকিয়ে আছে সে। তার দৃষ্টিতে ভয়, ঘৃণা আর আবেদন। তার সামনে দাঁড়াল রানা, জখমগুলো লক্ষ করল, বুঝল বাচবে না। ডান পা-টা তুলল। ও। ঘামে ভেজা বাকালার গলার ওপর রাখল বুট। তুমি এখনও বেঁচে আছ। সেজন্যে আমি খুশি, মৃদু কণ্ঠে বলল রানা। বাকালার গলায় চাপ দিল ও। নিচু গলায় কথা বলছে, নরম সুরে লুবনার মত, বাকালা। ওর মত তুমিও দম আটকে মারা যাবে। ডান পায়ের ওপর শরীরের সমস্ত ভার চাপিয়ে দিল সে।

*

গেটের গার্ড দুজন ভয়ে ভয়ে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোল। কিচেন হয়ে। প্যাসেজে এল তারা, সিঁড়ি বেয়ে উঠল দোতলায়। এমন কিছু দেখল না যাতে মনে জোর পাওয়া যায়। ট্যানডন আর বোরিগিয়ানোর লাশ আরও মন্থরগতি করে তুলল তাদেরকে। গেরিলা ট্রেনিং পাওয়া আমেরিকান লোকটা অকারণেই হাপাতে শুরু করেছে। যদিও দুজনের মধ্যে তার সাহসই বেশি। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে বাকালার স্টাডির ভেতর তাকিয়ে আছে সে, একটু পিছনে দ্বিতীয় লোকটা। দলা পাকানো লাশটা দেখে বুঝল, বাকালার পার্সোনাল বডিগার্ড। অস্পষ্ট, প্রায় শোনা যায় না, গোঙানির আওয়াজ পেল তারা। স্টাডি থেকেই বেরিয়ে আসছে।

তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল আওয়াজ।

দুজনের কেউই প্রথমে ঢুকতে চায় না, কাজেই যুক্তি করে একসঙ্গে, পাশাপাশি, এগোল। ওকে ওরা ডেস্কের পিছনে দেখতে পেল, নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল ওরা।

দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল রানা, দেয়ালে ঘষা খেতে খেতে কার্পেটে নেমে আসছে শরীর। আবার গুলি হল, এবার ইনগ্রাম থেকে। ঘরের এক দিক থেকে আরেক দিকে ছুটে গেল ঝাঁক ঝাঁক বুলেট।

গেটের বাইরে ঘ্যাঁচ করে থামল পুলিস কার। প্রথমে লাফ দিলেন গুগলি, তারপর পাধানি। গেটটা ভেতর থেকে বন্ধ। গেটের ডান দিকে ছোট একটা জানালা, সেটাও তালা দেয়া। জানালার কপাটে লাথি মারছে পাধানি, বেলের হাতল ধরে ঘন ঘন নাড়তে শুরু করলেন গুগলি।

হঠাৎ ওদের পিছনে তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠল হর্ন। লাফ দিয়ে এক পাশে সরে। গেলেন গুগলি, পাধানি আর একটু দেরি করলেই ধাক্কা খেত। ভারি পুলিস কারটা খ্যাপা হাতির মত ছুটে এল গেটের দিকে।

গেটের এক পাশে গাড়ি তাক করল রেমারিক। সংঘর্ষের আওয়াজ হল প্রচণ্ড, কাজের কাজও হল। গেট নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, দেয়াল থেকে খুলে বেরিয়ে গেল কজা সহ ইস্পাতের খানিকটা পাত–মাথা গলিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্যে যথেষ্ট।

মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকটা গলে ভেতরে ঢুকে গেল রেমারিক, কাকর ছড়ানো গাড়ি-পথ ধরে ছুটল ভিলার দিকে।

চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া পুলিস কারের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন গুগলি, কিন্তু সংবিৎ ফিরে পেয়ে এরই মধ্যে ফাঁকের ভেতর মাথা গলিয়ে দিয়েছে পাধানি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার পিছু নিলেন কর্নেল।

রেমারিককে ওরা দেখতে পেলেন ভিলার সদর দরজায়, তারপর সে বিল্ডিঙের কোণ ঘুরে ছুটল, অদৃশ্য হয়ে গেল কিচেনের দিকে।

পাধানিকে নিয়ে গুগলি যখন কিচেনে ঢুকলেন, রেমারিককে কোথাও দেখা গৈল না। দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকালেন তিনি। প্রথমে নড়ে উঠল পাধানি, ঘুরে দাঁড়িয়ে বমি শুরু করল সে। তাকে সামলে ওঠার জন্যে খানিকটা সময় দিলেন গুগলি, তারপর রক্তের ওপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে এগোলেন। প্যাসেজের লাশ দেখে থামলেন একবার, উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর তাকালেন। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে আবার থামলেন, ধাপের ওপর পড়ে থাকা লাশটা চিনতে অসুবিধে হল না।

ট্যানডন, পাধানিকে বললেন তিনি। বাকালার ডান হাত।

সিঁড়ির মাথায় আবার একবার থামলেন গুগলি। লাশ দুটোর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হাসলেন তিনি। বাজি ধরবে?

নিঃশব্দে মাথা নাড়ল পাধানি। আপনি হারবেন।

চিনতে পারছ? চোখে অবিশ্বাস নিয়ে সহকারীর দিকে তাকালেন গুগলি। কিন্তু কিভাবে? তেমন কিছুই তো অবশিষ্ট নেই।

গামবেরি আর বোরিগিয়ানো, বলল পাধানি। ওদের কিমা বানিয়ে ফেললেও চেনা যায়।

যাই বল, আমাদের হাতে আর কোন কাজই থাকল না–সব আবর্জনা সাফ!

স্টাডিতে ঢুকলেন গুগলি। তিনটে লাশ। ডেস্কের পিছনে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে রেমারিক। ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফেরাল সে। কুইক! ফোপানো গলায় ডাকল রেমারিক। একটু সাহায্য করুন! কুইক!

ডেস্কের পিছনে এসে ঝুঁকলেন গুগলি। রানার মুখের দিকে তাকালেন। তাহলে সত্যি ফেরেশতা নয়! যেন মস্ত একটা ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। তাহলে এত কিছু সম্ভব হল কি করে?

ইউ বাস্টার্ড! সব ভুলে গাল দিল রেমারিক।

কর্নেলকে স্পর্শই করল না। ক্ষীণ, বিদ্রূপ মেশানো হাসি লেগে রয়েছে তার। ঠোঁটে। রানার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, রানার চোখ খোলা, সে-ও তাকিয়ে। আছে। দুজনের কারও চোখেই পলক নেই। ব্যথায় গাল কুঁচকে আছে রানার, কপালে চিটচিটে ঘাম। চোখ নামিয়ে রক্ত আর ছেঁড়া মাংসের দিকে তাকালেন গুগলি। রানার বগলের নিচে রেমারিকের একটা হাত ঢুকে গেছে, আরেক হাতে রানার হাত চেপে ধরে আছে সে। আপনার ডান হাত, জরুরি আবেদন জানাল রেমারিক। এখানে চেপে ধরুন, আমার হাতের পাশে!

হাঁটু মুড়ে বসলেন গুগলি। হাত বাড়ালেন। তার হাতটা ধরে জায়গা মত বসিয়ে দিল রেমারিক।

আর্টারি ছিঁড়ে গেছে। আঙুল দিয়ে চেপে ধরুন।

নির্দেশ পালন করে নিচের দিকে, গুঁড়িয়ে যাওয়া কব্জির ওপর চোখ রাখলেন গুগলি। গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে।

আরও জোরে! চেঁচিয়ে বলল রেমারিক। এখন আর ফোঁপাচ্ছে না সে।

আরও জোরে চাপ দিলেন গুগলি, পেশীর ভেতর তাঁর আঙুল ডেবে গেছে। এখন আর আগের মত রক্ত বেরুচ্ছে না, গতি শ্লথ হয়ে এসেছে।

আমি? আমি কি করব? পিছন থেকে অস্থির কণ্ঠে জানতে চাইল পাধানি।

ফোনে কথা বল। ওরা আসছে, কিন্তু বলে দাও সমস্ত ইকুইপমেন্ট যেন সঙ্গে নেয়। আর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে আমি একটা হেলিকপ্টার চাই।

ব্যস্ততার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে পাধানি, রেমারিক জখমগুলোর ওপর দ্রুত হাতে পট্টি বাঁধছে। ডান দিকে তাকিয়ে বাকালার লাশ দেখতে পেলেন গুগলি আধ হাত জিভ বেরিয়ে আছে। রানার দিকে ফিরলেন। রূপোর একটা চেইনের সঙ্গে গলায় ঝুলছে খুদে একটা বই। রেমারিকের কাছে শোনা গল্পটা মনে পড়ে গেল। লুবনার দেয়া পবিত্র উপহার বুকে নিয়ে রওনা দিয়েছিল রানা। রক্তে ভিজে গেছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। আবার তিনি লোকটার মুখের দিকে তাকালেন। চোখ দুটো। এখন বন্ধ। কান পেতে শুনলেন, বিড় বিড় করে বলছে রানা, এবার আমি ঘুমাব, লুবনা। এবার একটু ঘুমাব।

কর্নেলের আঙুলগুলো ব্যথা করতে শুরু করল, তবু চাপ এতটুকু ঢিল হতে দিলেন না। এই লোকের জীবন আক্ষরিক অর্থেই এখন তার হাতে। কিছু শব্দ ঢুকল তার কানে। সাইরেনের একটানা বিলাপ, অতি ব্যস্ত রেমারিকের নাক দিয়ে। গোঙানির মত আওয়াজ।

চোখ বন্ধ করে রানা যেন ঘুমাচ্ছে। মুখে ব্যথা-বেদনার কোন চিহ্ন নেই, চেহারায় পরম প্রশান্তি। এদিক-ওদিক মাথা নাড়লেন কর্নেল গুগলি, খুবই যেন হতাশ হয়েছেন।

.

১২.

জানাজায় প্রচুর লোক হল।

দিনটা ঠাণ্ডা, আকাশে মেঘ। নেপলসের পাহাড় ছুঁয়ে একটানা দখিনা বাতাস। বইছে। ইটালির সবগুলো দৈনিক থেকে রিপোর্টাররা এসেছে। বিদেশী রিপোর্টারও সংখ্যায় অনেক, পঞ্চাশ জনের কম হবে না। বাকালা মারা যাবার পরদিন থেকে, গত একটা মাস এই একটা খবরই হেডিং ছিল কাগজগুলোয়। এই একটা মাস বেঁচে থাকার জন্যে যেন নিয়তির সঙ্গে যুদ্ধ করেছে রানা, তার ভাল-মন্দের খবর। বশেষ বুলেটিন আকারে ছাপা হয়েছে সকাল-সন্ধ্যায়।

নিষ্ফল একটা যুদ্ধ, শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছে বেচারা।

প্রথমে রানাকে রাখা হয় পালার্মোয়, ইনটেনসিভ কেয়ারে। মেডিক্যাল বোর্ড থেকে সাংবাদিকদের বলা হল, ওর বেঁচে থাকার ক্ষীণ একটু আশা থাকলেও থাকতে পারে, মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে বেঁচে থাকল রানা, প্রাণ ধরে ঝুলে থাকল। দুহপ্তা পর কারাবিনিয়ারির বিশেষ একটা প্লেনে করে নেপলসে নিয়ে আসা হল ওকে। প্রস্তাব এবং ব্যবস্থা, সবই কর্নেল গুগলির। পালামোর হাসপাতালের চেয়ে নেপলসের কারাদারেলি হাসপাতালে। অনেক ভাল ইকুইপমেন্ট আছে, অনেক বেশি নিরাপদও।

ডাক্তাররা সবাই জান-জীবন দিয়ে লড়ল। অবশেষে একটু আশার আলোও দেখল তারা। কিন্তু জখমগুলো খুবই মারাত্মক, বেঁচে থাকার প্রচণ্ড আকুতি থাকলেও শেষ পর্যন্ত কি হয় বলা যায় না।

সত্যি বলা যায়নি। মাসের শেষের দিকে দিনে দিনে খারাপের দিকে যেতে লাগল রানার অবস্থা। ভিজিটর একেবারে নিষিদ্ধ। ইটালি জুড়ে সাধারণ মানুষ। প্রার্থনা করল ওর জন্যে। মেজর জেনারেল রাহাত খান ঢাকা থেকে নেপলসে চলে এলেন, সঙ্গে তিনজন বাংলাদেশী ডাক্তার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। মারা যাবার আগের দিন ছাপা হল কাগজে, কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল মাসুদ রানা, ইটালীর জনসাধারণকে ধন্যবাদ জনিয়েছে সে। পরদিন সকালে চিরবিদায় নিল মহান বাঙালি যুবক।

রানাকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন কর্নেল গুগলির বড় ভাই। সার্জেন ভদ্রলোক মেডিক্যাল বোর্ডের ডিরেক্টর নির্বাচিত হয়েছিলেন। জানপ্রাণ দিয়ে খেটেছেন গত একটা মাস।

আজ সাংবাদিকরা নাটকের শেষ দৃশ্যটা দেখতে এসেছে। খোলা কবরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক গণ্যমান্য মানুষ। জানাজা পড়িয়েছেন নেপলস শাহী মসজিদের ইমাম সাহেব। নেপলসের সমস্ত নারী-পুরুষ হাজির হয়েছে গোরস্থানে।

মা আর ভাইকে নিয়ে কবরের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রেমারিক। ওদের মা। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, লাঠির ওপর ভর দিয়ে। তার পরনে কালো পোশাক, বুকের কাছে ক্ৰশটা মুঠোয় নিয়ে বিড়বিড় করে বাইবেলের অংশ বিশেষ পড়ছে। ওদের পাশে জুলিয়ানা, তার পাশে ফুরেলা। জুলিয়ানার চোখ দুটো লাল। কবরের। উল্টো দিকে রয়েছেন কর্নেল গুগলি আর পাধানি, ওদের মাঝখানে লরা আভান্তি। খানিক আগে পর্যন্ত তাকেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখা গেছে। এখনও কাঁদছে, তবে আওয়াজ নেই, শুধু দুগাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। যাক, এতদিনে শান্তি হল মেয়েটার; লুবনার পাশেই কবর দেয়া হচ্ছে মাসুদ রানাকে। প্রভু, শান্তি হোক মহৎ-হৃদয় লোকটার মহান আত্মার।

কবরের ভেতর নামানো হল লাশ। কফিন নামাচ্ছেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। আগেই কবরে নেমে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তাঁর চোখে পানি নেই। শুধু খানিকটা উদভ্রান্ত, খানিকটা ভাষাহীন দৃষ্টি। কাঁচাপাকা ভুরুতে মাটি লেগে আছে। কবরে নামার সময় একটু পিছলে গিয়েছিলেন। কর্নেল গুগলির পাশে দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন, উনি ফ্রেঞ্চ জেনারেল। মাসুদ রানাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে এসেছেন তিনি। জেনারেলের পাশে থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভিনসেন্ট গুগল।

কবরে মাটি চাপা দেয়ার পর ফ্রেঞ্চ জেনারেল স্যালুট করলেন। সবাই ঘুরে দাঁড়াল, শুধু মেজর রাহাত খান দাঁড়িয়ে থাকলেন, আর দাঁড়িয়ে থাকল লরা আভান্তি।

রেমারিক আর পাধানি দেখল, রাহাত খানের দিকে এগোতে শুরু করেও কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লেন কর্নেল গুগলি, তারপর কবর ঘুরে লরা আভান্তির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকে নিয়ে কবরস্থানের গেটের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে লরাকে তার গাড়িতে উঠতে সাহায্য করলেন। তারপর নিজেও উঠে তার পাশে বসলেন।

রেমারিক আর পাধানির দিকে চোখ পড়তে হাত নাড়লেন কর্নেল। তারপর। গাড়ি ছেড়ে দিলেন।

সেইদিন সান্ধ্য-দৈনিকে ছাপা হল মাসুদ রানার মৃত্যু-সংবাদ। একটি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হলঃ এদেশের মিষ্টি এক মেয়ে একটা গান উপহার দিয়েছিল বাংলাদেশের এক দুঃসাহসী যুবককে। বলেছিল, একদিন ছাড়াছাড়ি হবে, তখন যেন আমার কথা ভুলে যেয়ো না। এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে। পড়বে ধরণী। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি। তোমায় ডাকছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোডড়া না। আর হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ে আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভেবো আমি আর বেশি দূরে নেই। তারপর হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে। লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছি। সে-রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না!

এই পবিত্র ভালবাসার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সেই বিদেশী যুবক।

কামনা করি, তার চিরনিদ্রা শান্তিময় হোক। আমেন।

.

১৩.

মাঝরাত পেরিয়ে যাচ্ছে।

গোজোর পাহাড়ে পাহাড়ে বাতাসের ফিসফিসানি।

চাপা স্বরে কী সব জল্পনা-কল্পনা।

গ্রামগুলো অন্ধকার, কিন্তু ঘুমিয়ে নেই।

রুচিতাস-এর ঝুল-বারান্দায় একজোড়া ভারি বুট দেখা গেল, লোমশ একটা ভারি হাত পড়ল রেলিঙের ওপর। বিদ্রোহীর চোখ পড়ে আছে জেটির দিকে। তার পিছনে দরজা খুলে গেল, পাশে এসে দাঁড়াল ক্ষতি কি! ক্ষতি কি-র হাত থেকে বিয়ারের একটা গ্লাস নিল বিদ্রোহী। দুজনেই সাগরের দিকে তাকিয়ে।

ফেরিবোট ডলফিন বাতাসের ধাক্কায় পানির ওপর মৃদুমন্দ দুলছে, জেটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে ওটা। ব্রিজের ডানায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অক্লান্ত। সে-ও অপেক্ষা করছে, চুমুক দিচ্ছে বিয়ারের গ্লাসে।

হাজির আর গুঁফো রয়েছে পাহাড়ের মাথায়, দুজনের চোখে দুটো বিনকিউলার।

পুলিস-লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে পুলিস অফিসার মেনিনো। বন্দরের শান্ত পানি কেটে সাবলীল গতিতে এগিয়ে আসছে লঞ্চ। জেটি আর বেশি দূরে নেই।

রুচিতাস-এর পিছনের রাস্তায় হ্যাণ্ডব্রেক রিলিজ হল, ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল ল্যাণ্ড-রোভার। গড়াতে গড়াতে জেটির শেষ প্রান্তে এসে থামল সেটা। ওখানটা অন্ধকার। একমাত্র বালবটা কি করে জানি ফিউজ হয়ে গেছে।

জেটিতে ভিড়ল লঞ্চ। আবার ডেকে বেরিয়ে এল মেনিনো। দশ মিটার দূরে। পার্ক করা রয়েছে ল্যাণ্ড-রোভার। আবছা অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি কোন রকমে। দেখতে পেল সে। মূর্তিটা দরজা খুলে নিচে নামল। ভাল করে দেখার পর মেনিনো বুঝল, ওটা একটা নারীমূর্তি।

পিছন দিকে হাত নাড়ল মেনিনো। হুইল হাউস থেকে বেরিয়ে এল মানুষটা, মেনিনোকে পাশ কাটিয়ে জেটির দিকে এগোল। ধীর পায়ে হাঁটছে সে। লম্বা। শরীর, হাঁটার ভঙ্গিটা অদ্ভুত, প্রথমে মাটি ছোঁয় পায়ের বাইরের অংশ।

মেয়েটা এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করল লোকটাকে।

সিগন্যাল দিল মেনিনো। এঞ্জিন থেকে জোরাল আওয়াজ বেরুল। মুখ ঘুরিয়ে। খোলা সাগরের দিকে ছুটল পুলিস-লঞ্চ।

পিছনে তাকিয়ে অস্পষ্টভাবে এখনও দেখতে পাচ্ছে মেনিনো, দুটো ছায়া এক হয়ে আছে।

গোজোর পাহাড়ে পাহাড়ে বাতাসের ফিসফিসানি।

চাপা স্বরে কী সব জল্পনা-কল্পনা।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত