অগ্নিপুরুষ: ২.৩-৪ ভিনসেন্ট গগলের অফিস

অগ্নিপুরুষ: ২.৩-৪ ভিনসেন্ট গগলের অফিস

২.৩-৪ ভিনসেন্ট গগলের অফিস

০৩.

ভিনসেন্ট গগলের অফিস কামরায় একা দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা, দেয়ালে সাঁটা অস্ত্রশস্ত্রের ছবি দেখছে। রিসেপশনে দুজন ক্রেতার সঙ্গে আলাপ করছে গগল, ওদেরকে বিদায় করে কথা বলবে রানার সাথে। অস্ত্র চোরাচালানের ব্যবসা আগের মতই চালু রেখেছে গগল, তবে আর্মস ডিলারের লাইসেন্স যোগাড় করে এখন সে ব্যবসাটাকে একটা বৈধ আবরণ পরিয়ে নিয়েছে।

কি চাই? ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল গগল। তীক্ষ্ণ চোখে রানার আপাদমস্তক লক্ষ করল সে। রানাকে চিনতে পারেনি। দেখল, ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা লোকটা, আত্মবিশ্বাস, শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে শক্তি আর সাহস।

আমি মাসুদ রানা।

সামনে সাপ দেখলেও বোধহয় এতটা আঁতকে উঠত না গগল।

যা যা চেয়েছি সব যোগাড় হয়েছে? সরাসরি কাজের কথা পাড়ল রানা, বিস্ময় প্রকাশের কোন সময়ই দিল না গগলকে।

ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে হাত বুলিয়ে মাথা ঝাঁকাল গগল। হ্যাঁ। ঢালাও অর্ডার। দিয়েছিলে, কিছু কিছু আইটেমের বিকল্প যোগাড় করে রেখেছি, পছন্দমত বেছে নিতে পারবে। হাতঘড়ি দেখল সে। আগে লাঞ্চ সেরে নিই, তারপর ওয়্যারহাউসে যাব। ইতিমধ্যে ফোন করে দিলে আমার লোকেরা তোমার দেখার জন্যে সব বের করে রাখবে।

ঠিক আছে, বলল রানা।

অপেক্ষা করছে গগল, তার মনে হল আরও কি যেন বলবে রানা।

জাল কিছু কাগজ-পত্র লাগবে আমার, বলল রানা। ভাবছি…

পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, এই সব?

হ্যাঁ।

কঠিন কিছু না। কোন দেশের?

ফ্রেঞ্চ, কানাডিয়ান বা আমেরিকান, বলল রানা। ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজি জানি, কাজেই তিন দেশের যে-কোন একটা হলে চলবে। সমস্যা অন্যখানে, ওগুলো। আমার খুব তাড়াতাড়ি দরকার–চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে।

আঙুলের গিঁট গুনতে শুরু করল গগল, অন্যমনস্ক। ফ্রেঞ্চ কাগজ হলে যদি চলে, এই সময়ের মধ্যে সম্ভব।

গুড।

ফটো?

জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করল রানা। বারোটা ফটো আছে এতে। সাধারণ একজন ফরাসী বিদেশে যেতে চাইলে যে-সব। কাগজ-পত্র লাগে, সব আমার দরকার হবে।

রানার হাত থেকে এনভেলাপটা নিয়ে একটা দেরাজে রাখল গগল। পাবে। অস্ত্রশস্ত্র বা কাগজ-পত্র কেন দরকার রানার জানতে চায়নি সে, চাইবেও না। রানাকে সে চেনে, কোথাকার পানি কোথায় গড়াবে অর্ডার দেখে আন্দাজ করে। নিয়েছে।

এ সবের জন্যে প্রচুর খরচ হবে তোমার, বুলল রানা। চেক বা…

ভেব না এসব তোমাকে আমি দান করছি, রানার একটা হাত ধরে দরজার দিকে এগোল গগল। সময় হলে ঠিকই আমি কিছু চাইব, বিনিময়ে। চল, লাঞ্চটা সেরে আসি।

কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই, জানে রানা। অস্ত্র আর কাগজ-পত্রের জন্যে কোন পয়সা নেবে না গগল। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে এই ঋণ শোধ করতে হবে ওকে।

.

পরও রাতে বন পোয়ারোয় চড়ে মার্সেলেসে পৌচেছে রানা।

ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রেলওয়ে স্টেশনে চলে এসেছে, ব্যাগেজ রূম থেকে কালো রঙের লেদার ব্রিফকেসটা সংগ্রহ করেছে। রেস্তোরাঁয় ঢুকে নির্জন এক কোণে বসে, কফির অর্ডার দিয়ে পকেট থেকে বের করেছে রেমারিকের চিঠিটা।

নাম্বার মিলিয়ে কমবিনেশন লক খুলেছে রানা। ভেতরে একটা বড়সড় ম্যানিলা এনভেলাপ, তাতে এক গোছা চাবি, একটা রোডম্যাপ আর দুইসেট কাগজ-পত্র। এক সেট কাগজ বিনো গারবান্ডির নামে–তার পাসপোর্ট, পরিচয় পত্র ইত্যাদি। লোকটা আমালফিতে বাস করে, তরি-তরকারি আমদানির ব্যবসা। আছে। দ্বিতীয় সেট কাগজ টয়োটা ভ্যানের জন্যে। রোড ম্যাপটা খুলল রানা। ম্যাপের গায়ে এখানে-সেখানে কালো কালি দিয়ে বৃত্ত রচনা করা হয়েছে, মার্জিনে লেখা রয়েছে বেশ কিছু নির্দেশ। দেখা শেষ করে আবার সব ব্রিফকেসে ভরে তালা লাগিয়ে দিল ও।

কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে রানা, কাঁচের পার্টিশন ভেদ করে প্ল্যাটফর্মে চলে গেছে ওর দৃষ্টি, কিন্তু ভাবছে রেমারিকের কথা। ওর সাহায্য ছাড়া এতসব আয়োজন করা কঠিন হত। ও জানে, বিনো গারবান্ডি বাস্তবেও একজন ব্যবসায়ী। হবে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি তার নাম আর পরিচয় ধার করা হয়েছে। পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজও নেপলসের সেরা জালিয়াতকে দিয়ে জাল করানো হয়েছে, কারও সাধ্য নেই খুঁত বের করে। রানা জানে, নেপলসে পৌঁছে সে দেখবে সব একেবারে তৈরি অবস্থায় আছে। এক হপ্তা পর শুরু হবে আগুন নিয়ে খেলা।

ভ্যানটা সম্ভবত ফুরেলা চালিয়ে নিয়ে এসেছে মার্সেলেসে, আন্দাজ করল রানা। ফুরেলার নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে রেমারিকের সঙ্গে আলাপ করতে হবে, নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পোস্ট অফিসে এল রানা, ঢাকা আর প্যারিস থেকে আসা পার্সেল দুটো সংগ্রহ করল। বিনো গারবান্ডির নাম ভাড়িয়ে একটা হোটেলে উঠল ও।

পাথরের মেঝে, অনেক ওপরে ইস্পাতের সিলিং, ওদের পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে আসছে। চারদিকে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে আছে কাঠের বাক্স, সার সার বাক্সের মাঝখানে গোলকধাঁধা তৈরি করেছে অসংখ্য প্যাসেজ। নাকে পরিচিত একটা গন্ধ ঢুকল–মেটালের সাথে গ্রিজের মাখামাখি হলে এই তামাটে গন্ধ পাওয়া যায়। ইস্পাতের ভারি একটা দেয়াল ওয়্যারহাউসটাকে দুভাগে ভাগ করে রেখেছে, দেয়ালের মাঝখানে পাঁচ সের ওজনের বড় একটা তালা। তালা খুলে একটা বোতামে চাপ দিল গগল। মাথার ওপর এক সঙ্গে জ্বলে উঠল ডজনখানেক নিয়ন টিউব। দুটো স্টীল টেবিল দেখা গেল; একটা খালি, অপরটা নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র আর ইকুইপমেন্টে ঢাকা পড়ে আছে।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল গগল, তাকে পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় টেবিলের সামনে চলে এল রানা। আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর ওপর প্রথমে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ও, তারপর এক এক করে পরীক্ষা করল। প্রথম সেট, পিস্তল। ওর পাশে এসে দাঁড়াল গগল।

ছোট, হালকা আর ফরটি-ফাইভ ক্যালিবার চেয়েছিলে তুমি, বলল সে। বেছে নাও।

বিভিন্ন দেশের তৈরি বারোটা পিস্তল রয়েছে টেবিলে, সাইলেন্সর রয়েছে। কয়েক ধরনের। একটা কোল্ট, উনিশশো এগারো, আর একটা ব্রিটিশ ওয়েবলি, পয়েন্ট থ্রি-টু, হাতে নিল রানা। দ্বিতীয়টা ওকে হাতে নিতে দেখে একটু যেন বিস্মিত হল গগল।

জানি, বলল রানা। সেকেলে। কিন্তু এটার ওপর নির্ভর করা যায়। পিছনের খালি টেবিলে পিস্তল দুটো রাখল ও। এরপর এক জোড়া সাইলেন্সর বাছল, সে দুটোও রাখল পিস্তলের সঙ্গে। প্রতিটার জন্যে পঞ্চাশ রাউণ্ড করে গুলি লাগবে।

ছোট্ট একটা প্যাড আর বল-পয়েন্ট পেন বের করে লিখতে শুরু করল গগল। রানা ওদিকে সাবমেশিনগান পরীক্ষা করছে। চার ধরনের সাবমেশিনগান রয়েছে ইসরায়েলি উজি, ব্রিটিশ স্টার্লিং, ডেনিশ ম্যাডসেন, ইনগ্রাম মডেল টেন। দ্রুত হাতে শেষেরটা তুলে নিল রানা। মেটাল বাট ভাজ করা অবস্থায় রয়েছে, গোটা অস্ত্রটা মাত্র সাড়ে দশ ইঞ্চি লম্বা। সাবমেশিনগান, কিন্তু দেখতে বড় একটা। পিস্তলের মত, ফায়ারিং রেট প্রতি মিনিটে এগারোশো।

আগে ব্যবহার করেছ? জানতে চাইল গগল।

মাথা ঝাঁকাল রানা। এর সবচেয়ে বড় সুবিধে, ছোট। এর জন্যে সাপ্রেসর লাগবে, আছে?

দিন দুয়েকের মধ্যে যোগাড় হয়ে যাবে।

এরপর স্নাইপার রাইফেল। গগলের কালেকশনে রয়েছে এম ফোরটিন এর উন্নত সংস্করণ, সাথে উইভার সাইট। আর রয়েছে ব্রিটিশ এল-ফোর-এ-ওয়ান, সাথে স্ট্যাণ্ডার্ড থারটি টু সাইট। এম ফোরটিন বেছে নিল রানা। বলল, কারট্রিজের স্ট্যাণ্ডার্ড একটা বাক্স আর দুটো স্পেয়ার ম্যাগাজিন।

রকেট লঞ্চারের দিকে সরে এল ওরা। রানা বলল, আর. পি. জি. সেভেন দরকার আমার।

নিঃশব্দে হাসল গগল, বেঁটে আর মোটাসোটা একটা টিউব তুলে নিল হাতে। যোগাড় করতে পারলে লাখ দশেক বিক্রি করতে পারতাম। টিউবের দুই প্রান্ত। ধরে মোচড় দিল সে, মাঝখানে খুলে গেল সেটা। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা আঁকাল রানা। চমৎকার, স্ট্রোক ডি। মিসাইলের স্ট্যাণ্ডার্ড প্যাকিং কি রকম?

দুরকম বাক্স, আটটা আর বারোটা ধরে, বলল গগল। লঞ্চারটাকে জোড়া। লাগিয়ে ইনগ্রামের পাশে শুইয়ে রাখল সে।

তাহলে আটটার একটা বাক্স দাও। গ্রেনেডের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। ব্রিটিশ ফ্র্যাগমেন্টেশন থারটি সিক্স আর ফসফরাস এইটি সেভেন বেছে নিল ও। গ্রেনেডের প্যাকিং স্ট্যাণ্ডার্ডের চেয়ে ছোট হলে ভাল হয়, এক-একটা বাক্সে গোটা পনেরো ধরলেই চলবে। মোট ত্রিশটা।

ঠিক আছে।

এরপর রানা একটা ডাবল ব্যারেল শটগান তুলল, ব্যারেল আর স্টক ছোট করা হয়েছে। ব্রিচ খুলে আলোর সামনে ধরল ও, পরীক্ষা শেষে বন্ধ করে রেখে। দিল গ্রেনেডগুলোর পাশে। একজোড়া এস. এস. জি.-র বাক্স। প্যাডে লিখে নিল, গগল।

নেড়েচেড়ে দেখে একটা ট্রাইলাক্স নাইট সাইট, খাপে ভরা একটা কমান্ডো নাইফ আর কয়েক ধরনের ওয়েবিং নির্বাচন করল রানা। সবশেষে, টেবিলের শেষ। মাথায় পৌঁছে, গভীর একটা মেটাল ট্রে-র তলা থেকে খুদে আকৃতির কয়েকটা জিনিস তুলে মনোযোগের সাথে পরখ করল।

ওগুলো একেবারে লেটেস্ট, রানার কাঁধের কাছ থেকে বলল গগল। এর আগে বোধহয় দেখনি?

রানার হাতে হোট একটা সার্কুলার টিউব। টিউবের এক প্রান্ত থেকে, সরু একটা সূঁচ আধ ইঞ্চি বেরিয়ে আছে।

এ-ধরনের ডিটোনেটর ব্যবহার করেছি, বলল রানা। কিন্তু টাইমারটা এই প্রথম দেখছি।

আরেকটা মেটাল টিউব তুলে নিল গগল। এটার এক জোড়া কাঁটা রয়েছে, ইলেকট্রিক প্লাগের মত। স্কু খুলে রানাকে ক্যাডমিয়াম সেল ব্যাটারি, আর দুটো ডায়াল দেখাল. সে। তরপের ডিটোনেটরে টাইমারের প্রাগ ঢুকিয়ে দিল। জোড়া লাগানো জিনিসটা মাত্র দুইঞ্চি লম্বা, আর ডায়ামিটারে পৌনে এক ইঞ্চি। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলল সে, ইলেকট্রনিক্সের বদৌলতে এ-সব একেবারে পানির মত সহজ হয়ে গেছে। রেমারিক এক কিলো প্লাস্টিক-এর কথা বলেছিল। যোগাড় হয়েছে, কিন্তু রেখেছি আরেক জায়গায়।

গুড, বলল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দ্বিতীয় টেবিলের দিকে তাকাল ও। আর দরকার নেই আমার।

টেবিলের দিকে গগলও তাকাল। বন্ধুর চাহিদা মেটাতে পেরে সে তৃপ্ত।

ওয়েবলির জন্যে হালকা একটা শোল্ডার-হোলস্টার দিতে পারবে? জিজ্ঞেস করল রানা। আর কোল্টের জন্যে একটা বেল্ট হোলস্টার?

পারব, বলল গগল। কোল্টের জন্যে স্ট্যাণ্ডার্ড ইস্যু ক্যানভাস।

চলবে। একটা টেপ মেজার আর নোট বুক বের করল রানা। স্কেল আছে?

আছে, বলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল গগল। টেপ মেজার নিয়ে কাজ শুরু করল রানা।

.

রোড ম্যাপে চোখ রেখে ড্রাইভারকে বলল রানা, রুসেন্ট অনুরির মোড়ে নামবে ও। হোটেলে গিয়ে কাপড় বদলে এসেছে, পরনে এখন ডেনিম জিনস আর শার্ট। শহরের মাঝখান দিয়ে পুব দিকে যাচ্ছে ট্যাক্সি। মার্সেলেসকে একটা কারণে ওর। পছন্দ, রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য-যে-কোন লোক পরিচয় গোপন করে এই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে। এই শহরের লোকেরা নিজেদের চরকায় তেল। দিতে পছন্দ করে, কারও সাতে-পাচে নেই। আর্মস আর ড্রাগস স্মাগলারদের জন্যে এটা একটা আদর্শ শহর।

পেভমেন্টের পাশে থামল ট্যাক্সি, ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নামল রানা। বাঁক নিয়ে দশ মিনিট হাঁটল ও, পৌঁছে গেল রু কাটিনাট-এর মোড়ে। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রাস্তাটা ভাল করে দেখে নিল ও।

শহরের বাইরে, শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা। রাস্তার দুপাশে পাঁচ-সাত তলা। বিল্ডিং, নিচে ছোটখাট ওয়র্কশপ, কারখানা আর গ্যারেজ। ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল রানা। দশ মিনিট পর তালা দেয়া একটা গ্যারেজের সামনে থামল ও, দুপাশে আরও কয়েকটা করে গ্যারেজ রয়েছে, সবগুলো বন্ধ। গ্যারেজের দরজায় লেখা নাম্বারটা দেখল-দশ। কোন দিকে না তাকিয়ে চাবি বের করল ও, তালা। খুলে ভেতরে ঢুকল। আলো না জ্বেলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, কিন্তু কোন শব্দ পেল না।

আলো জ্বালার পর দেখল, গ্যারেজের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে এক টয়োটা ভ্যান। গাঢ় খয়েরি রঙ করা, এক পাশে বড় বড় অক্ষরে লেখাটা ঝাপসা হয়ে গেছে বিনো গারবান্ডি, ভেজিটেবল ডিলার।

পুরানো আর তোবড়ানো হলেও রানা জানে, ভ্যানের এঞ্জিন আর, সাসপেনশনে কোন খুঁত নেই। পিছনের দরজা খুলল ও। সামনেই ভ্যানের। মেঝেতে রয়েছে ইলেকট্রিক্যাল কর্ডের একটা কয়েল, প্রাগ সহ। আপন মনে একটু হাসল ও, বুদ্ধি করে আলোর ব্যবস্থাও করে রেখেছে রেমারিক। ভ্যানে চড়ল রানা, প্রাগটা তুলে নিয়ে দেয়ালের গায়ে ফিট করা সকেটে ঢোকাল। বাবটা জ্বলে উঠে আলোকিত করে তুলল বাকি সব জিনিস। লম্বা সাইজের কিছু কাঠ, তুলো ভরা। কয়েকটা বস্তা, ফেল্টের লম্বা একটা রোল, কাঠের একটা বেঞ্চ আর একটা টুলবক্স।

এক এক করে ভ্যান থেকে সব নামাল রানা। তারপর কমপার্টমেন্টের সামনে। এসে প্যানেলিংটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল, এই প্যানেলিং-ই ড্রাইভারের সিটের পিঠ হিসেবে কাজ করছে। টুলবক্স থেকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে এল ও, প্যানেলের রঙ নাচটিয়ে গর্তে লুকিয়ে থাকা বারোটা ভ্রু খুলল। আস্তে করে খসে পড়ল ফলস। প্যানেল, সামনে দেখা গেল এক ফুট গভীর আর লম্বা-চওড়ায় কমপার্টমেন্টের। সমান একটা ফাঁকা জায়গা। গুড, বিড়বিড় করে বলল রানা, প্যানেলটা ভ্যান। থেকে নামিয়ে গ্যারেজের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল। এরপর টেপ মেজার আর নোটবুক বের করে চোরা-কুঠরির নিখুঁত মাপ নিল ও।

আগে নোট করা মাপজোখের সঙ্গে চোরা কুঠরির মাপ মিলিয়ে দ্রুত হাতে একটা নক্সা আঁকল রানা, গ্যারেজের দরজায় সেঁটে দিল সেটা। পরবর্তী দুঘন্টা কোন বিরতি ছাড়াই কাজ করে গেল ও। টেপ মেজার দিয়ে মাপ নিল, তারপর ছোট একটা পাওয়ার স দিয়ে কাটল কাঠগুলো।

কাজটা উপভোগই করছিল রানা, কিন্তু বন্ধ গ্যারেজের ভেতর গুমোট হয়ে উঠল পরিবেশ। বাইরে ইতিমধ্যেই অন্ধকার নেমেছে, খোলা বাতাসে দশ মিনিট হেঁটে ছোট একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল ডিনার খাবে বলে।

পরদিন সকাল আটটায় গ্যারেজে ফিরে এল ও, কাজ করল দুপুর পর্যন্ত। সেই ছোট রেস্তোরাঁতেই লাঞ্চ সারল, ওর মত একই ধরনের নোংরা কাপড় পরে আরও অনেকে খেতে এসেছে।

বিকেল নাগাদ কাজটা শেষ করল রানা। কাঠের একটা ভারি ফ্রেম তৈরি করেছে ও, চোরা কুঠরিতে সেটা ঢুকিয়ে দেয়া হল। ফ্রেমের গায়ে অনেকগুলো ঘর। রয়েছে, আলগা কাঠের টুকরোগুলো বসে গেল খাপে খাপে। পিছিয়ে এসে হাতের কাজটা খুঁটিয়ে দেখল ও। বাচ্চাদের খেলনা, অসমাপ্ত একটা গোলকধাঁধার মত দেখাল কমপার্টমেন্টটাকে। খোপগুলো বৃহস্পতিবারে ভরবে ও।

বৃহস্পতিবার।

একজন গার্ডকে সাথে নিয়ে অপেক্ষা করছে গগল। রাস্তায় আর কেউ নেই। রাত দশটা পাঁচে গাঢ় নীল রঙের একটা ভ্যান বাঁক নিয়ে এগিয়ে এল, থামল একশো মিটার দূরে। হেডলাইটের আলো দুবার জ্বলে উঠে নিভে গেল, আর জ্বলল না।

ওই মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা কর, গার্ডকে বলল গগল। ভ্যান চলে গেলে তবে ফিরবে। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল গার্ড, এবার ভ্যানটা এগিয়ে আসতে শুরু করল।

সব ঠিক? ক্যাব থেকে লাফ দিয়ে নামল রানা।

ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ওয়্যারহাউসের তালা খুলল গগল। দরজার কাছেই। একটা ফর্ক লিফটের ওপর তিনটে কাঠের প্যাকিং কেস রয়েছে–এ. বি. আর. সি. লেখা। এক এক করে তিনটের দিকেই আঙুল তাক করল গগল। অ্যামুনিশন, উইপনস, আদার ইকুইপমেন্টস। দুমিনিটের মধ্যে বাক্সগুলো ভ্যানে তোলা হল, রানাও উঠে বসল ক্যাবে।

মুখ তুলে রানার দিকে তাকাল গগল। কাল বিকেলে আমার অফিসে এসে কাগজ-পত্রগুলো নিয়ে যেয়ো।

ঠিক আছে, বলে ভ্যান ছেড়ে দিল রানা।

শহরের ভেতর চল্লিশ মিনিট ভ্যান নিয়ে ঘুরল ও বারবার স্পীড কমাল আর বাড়াল, অপ্রত্যাশিতভাবে বাঁক নিল কয়েকবার। না, কেউ ওর পিছু নেয়নি। রু কাটিনাটে পৌঁছে গ্যারেজটাকে পাশ কাটাল রানা, আরও পঞ্চাশ মিটার এগিয়ে। তারপর থামল। এঞ্জিন বন্ধ করল ও, আলো নেভাল, চুপচাপ আধ ঘন্টা বসে থাকল ড্রাইভিং সিটে–তীক্ষ্ণচোখে চারদিকটা দেখছে, কান দুটো সজাগ। এরপর স্টার্ট। দিয়ে পিছিয়ে আনল ভ্যান, দাঁড় করাল গ্যারেজের দরজার সামনে। বাক্সগুলো। গ্যারেজে রেখে তালা দিল দরজায়, ভ্যান নিয়ে রওনা হল হোটেলের দিকে। ধীর। গতিতে ভ্যান চালাল ও, একটা চোখ থাকল রিয়ার ভিউ মিররে।

সকালে ভাড়া করা ভ্যানটা ফেরত দিয়ে গ্যারেজে চলে এল রানা। বাক্স তিনটে খুলল ও। এক এক করে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ আর গ্রেনেড বের করে। যার যার বরাদ্দ করা জায়গায় খাপে খাপে বসিয়ে দিল। ফ্রেম আর ইকুইপমেন্টের মাঝখানে যেখানে যত ফাঁক-ফোকর দেখল, সব তুলো দিয়ে ভরল ও। এরপর গোটা ফ্রেমের সামনে ফেল্টের একটা পর্দা ঝুলিয়ে দিল। ফলস্ প্যানেলটা ভ্যানে। তুলল ও, জায়গামত বসিয়ে এক এক করে এটে দিল বারোটা স্কু। কাজ সেরে প্যানেলের গায়ে কয়েক বার ঘুসি মারল ও। ফাপা নয়, নিরেট আওয়াজ হল। সন্তুষ্ট এবার রানা। ওর অস্ত্রের বাহন এখন তৈরি।

.

রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দোল খাচ্ছিল গুগল, ভেতরে ঢুকল রানা। ওকে দেখে সিধে হয়ে বসল গগল, চোখ-ইশারায় সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল। কফি?

না।

গগল আর দ্বিতীয়বার সাধল না। ডেস্ক থেকে একটা এনভেলাপ তুলে বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। কাগজগুলো অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করল রানা। তারপর মুখ তুলে বলল, খুবই ভাল হাতের কাজ।

গগলের ঠোঁটে ক্ষীণ একটু তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। খানিক ইতস্তত করে জানতে চাইল সে, তোমার আর কি কাজে লাগতে পারি আমি?

মাথা নাড়ল রানা। আর কিছুর দরকার নেই আমার। ভাল কথা, এই পাসপোর্ট আর কাগজগুলোর ব্যাপারে রেমারিকও যেন কিছু না জানে।

এবার সরাসরি প্রশ্ন করল গগল, মস্ত বড় একটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছ তুমি, কিন্তু কারও সাহায্য চাইছ না কেন?

চাইছি না মানে? রেমারিক আর তুমি সাহায্য করছ না?

আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছ তুমি, বলল গগল। এসব যোগান দেয়ার মধ্যে কোন বিপদ নেই। আমি বলতে চাইছি।

চেয়ার ছেড়ে উঠল রানা। এ আমার একার যুদ্ধ, গগল।

দুই বন্ধু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর মাথা ঝাঁকাল গগল। রানা কি বলতে চায় উপলব্ধি করেছে সে।

বিদায়ের মুহূর্তে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়াল গগল, রানাও তাকে ধন্যবাদ জানাল না। উপকার, উপকারের বিনিময়ে উপকার, এরই ওপর ভিত্তি করে ওদের বন্ধুত্ব। পরস্পরকে ওরা শ্রদ্ধা করে, কেউ কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। অদ্ভুত একটা সম্পর্ক, কিন্তু এমনই মজবুত যে ভেঙে যাবার নয়।

.

০৪.

চোখে বিনকিউলার নিয়ে বোর্ডিং হাউসের টেরেসে দাঁড়িয়ে আছে রেমারিক। নীল আর সাদা রঙের ফেরি ডকে ভিড়ল। জাল কাগজ-পত্রের ওপর আস্থা আছে। রেমারিকের, কিন্তু মার্সেলেস থেকে আসা গাড়িগুলো প্রায়ই তন্ন তন্ন করে সার্চ করা। হয়।

তিনটে লাইন ধরে ফেরি থেকে নামতে শুরু করল গাড়ি। একটা লাইনে কয়েকটা ট্রাক আর একটা কন্টেইনার-ট্রেলর দেখা গেল। তারপর খয়েরি রঙের ভ্যানটা। ক্যাব থেকে রানাকে নামতে দেখল, রেমারিক। ভ্যানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানা, চেহারায় নির্লিপ্ত ভাব। ওর পরনে ডেনিম ওভারঅল, হাতে একটা বড় ম্যানিলা এনভেলাপ। অলস ভঙ্গিতে পায়ে বাড়ি মারছে এনভেলাপটা দিয়ে।

বিশ মিনিট পর রানার সামনে একজন কাস্টমস অফিসার এসে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে টেরেসে রেমারিকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ফুরেলা।

উনি পৌচেছেন? জানতে চাইল সে।

হ্যাঁ, ডকের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে জবাব দিল রেমারিক।

রানার কাগজ-পত্র খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল অফিসার, তারপর ভ্যানের পিছন দিকে হেঁটে এল। ভ্যানের দরজা খুলে দিল রানা, ওর হাতে এনভেলাপটা ফিরিয়ে দিয়ে ভ্যানে চড়ল অফিসার।

রেমারিকের মনে হল অনন্তকাল ধরে ভ্যানের ভেতর রয়েছে অফিসার। তারপর এক সময় বেরিয়ে এল সে, দুহাত দিয়ে কি যেন একটা বুকের কাছে ধরে রয়েছে। শিউরে উঠল রেমারিক, ভাল করে দেখার জন্যে কাঁপা হাতে বিনকিউলারটা অ্যাডজাস্ট করল। এবার অফিসারের হাতে ধরা জিনিসটা চিনতে পারল। সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল সে।

কি ওটা? জানতে চাইল ফুরেলা।

তরমুজ-বেজন্মা শালা একটা তরমুজ চায়!

হেসে ফেলল ফুরেলা।

খয়েরি ভ্যান সিকিউরিটি গেটের দিকে এগোল। গেটে মুহূর্ত কয়েকের জন্যে থামল মাত্র, তারপরই রাস্তায় উঠে এল রানা। চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে হাতঘড়ি দেখল রেমারিক। এক ঘন্টার মধ্যে ফোন করবে ও। লাঞ্চ খেতে বেরিয়ে যাব আমি–এদিকটা তুমি সামলাতে পারবে তো?

পারব, বলল ফুরেলা। ওঁকে আপনি আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।

হাতে একটা ক্যানভাস ব্যাগ নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকল রেমারিক। ভেতরে ঢুকেই দাঁড়িয়ে পড়ল ও, রোদ থেকে এসে অল্প আলোয় ভাল দেখতে পাচ্ছে না। ধীরে ধীরে প্রসারিত হল দৃষ্টিসীমা, খদ্দের বলতে একমাত্র রানাকেই এক কোণে একটা। টেবিলে বসে থাকতে দেখল সে। বারোটাই বাজেনি এখনও, নেপলসের লোকেরা। এত তাড়াতাড়ি লাঞ্চ খায় না।

দুই বন্ধু পরস্পরকে আলিঙ্গন করল। রানাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল রেমারিক, ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, গোজো তোমার বয়স কমিয়ে দিয়েছে দশ বছর।

মৃদু হাসল রানা। ওরা সবাই তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছে।

বসল ওরা। ওয়েটারকে ডেকে হালকা লাঞ্চের অর্ডার দিল রানা।

ওয়েটার সরে যেতে রেমারিক জিজ্ঞেস করল, মার্সেলেসে কোন অসুবিধে হয়নি তো?

না।

ভায়োলা কেমন আছে?

মৃদু হাসল রানা। ভাল। বলেছে, কাজ শেষ করে ফিরতে হবে ওর কাছে।

মুচকি একটু হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে এল রেমারিক। ফুরেলাকে আমি মার্সেলেসে পাঠিয়েছিলাম। বেশিরভাগ লেগওঅর্ক ওকে দিয়েই করিয়েছি, রোম। আর মিলানোও গিয়েছিল ও।

ও খুব কাজের ছেলে, মন্তব্য করল রানা।

ওয়েটার লাঞ্চ দিয়ে গেল।

খেতে শুরু করে রানা বলল, ফুরেলার বিপদ হতে পারে।

জানি, বলল রেমারিক। তুমি শুরু করলেই ওকে আমি গোজোয় পাঠিয়ে দেব। গোটা ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই থাকবে ও।

গুড, বলল রানা। ওকে ছাড়া ম্যানেজ করতে পারবে তো?

প্রেজো ফিসো বন্ধ করে দিচ্ছি,বলল রেমারিক। শুধু যারা রেগুলার, তাদের জন্যে লাঞ্চ আর ডিনারের ব্যবস্থা থাকবে। ক্যানভাস ব্যাগ খুলে পাঁচ গোছ চাবি বের করল সে, সাথে একটা রোড ম্যাপ, আর একটা ফোল্ডার। চাবির গোছাগুলো রানার দিকে বাড়িয়ে দিল, প্রতিটির সঙ্গে একটা করে ট্যাগ আছে। বলল, মিলানের অ্যাপার্টমেন্ট, ভাইজেনটিনোয় কটেজ, একটা আলফেটা জি. টি., রোমে অ্যাপার্টমেন্ট, আর রোমে একটা রেনল্ট টোয়েন্টি।

চাবি নিয়ে হাসল রানা। আমার দেখছি প্রচুর সম্পত্তি!

ভাড়া করা, জবাব দিল রেমারিক। এগুলো সবই তিন মাসের জন্যে ভাড়া নেয়া হয়েছে, মাস শুরু হয়েছে দশ দিন আগে।

খোঁজাখুঁজি শুরু হলে তোমার নাম বেরিয়ে আসবে না তো?

মাথা নাড়ল রেমারিক। অসম্ভব। অ্যাপার্টমেন্ট দুটো আর কটেজটা ব্রাসেলসের একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া করেছে। আর গাড়ি দুটো ভাড়া নিয়েছে বিনো গারবান্ডি।

আচ্ছা, বিনো কি…?

প্রেমিকাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে গেছে সে, ফিরতে মাস কয়েক দেরি হবে। রোড ম্যাপ খুলে কালো কালি দিয়ে আঁকা দুটো বৃত্ত দেখাল রেমারিক। মিলানের অ্যাপার্টমেন্ট, আর এটা এখানে বাংলোটা। এরপর এক এক করে। গ্যারেজ, রোমের অ্যাপার্টমেন্ট, আরেকটা গ্যারেজ, সব দেখিয়ে দিল রানাকে। অ্যাপার্টমেন্ট আর বাংলোয় টিনের খাবার পাবে। ফোল্ডারে টোকা দিল সে। এতে সবগুলোর ঠিকানা আছে।

ভেরি গুড, সন্তুষ্ট হয়ে বলল রানা। চার্জার?

মুচকি একটু হেসে ব্যাগের ভেতর থেকে চকচকে দুটো সিলিণ্ডার বের করল রেমারিক। একটা হাতে নিয়ে সাবধানে পরীক্ষা করল রানা।

জিনিসটা অ্যানোডাইজড অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি। সাড়ে তিন ইঞ্চির মত লম্বা, ডায়ামিটারে পৌনে এক ইঞ্চি, প্রান্ত দুটো ঢালু। দুদিক ধরে ঘোরাতেই মাঝখানে। খুলে গেল সিলিণ্ডারটা। গর্ত দুটো দেখল রানা, বাইরের মত ভেতরের দিকও মসৃণ।

এগুলো আমি লোকাল মেশিনশপে তৈরি করিয়েছি, বলল রেমারিক। সিলিণ্ডার দুটো ব্যাগে ভরল সে। এগুলো সাধারণত আরেকটু বড় হয়–নিশ্চয়ই। কষ্টকর, আমার ধারণা।

ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল রানার ঠোঁটে যত খুশি আপত্তি জানাতে পারে ব্যাটা, আমিও সহানুভূতি জানাব।

ফোল্ডার ছাড়া বাকি সব ব্যাগে ভরে রাখল রেমারিক। আমার রেস্তোরাঁয় এক লোক খেতে আসে, নাম ডেরিক। সিসিলিতে ডন বাকালার হয়ে কাজ করেছে এককালে। সারাক্ষণ বক বক করে লোকটা, দুনিয়ার সব ব্যাপারে তার অভিযোগ। সিসিলির গল্প করতে ভালবাসে।

আমার সম্পর্কে কিছু জানে?

মাথা নাড়ল রেমারিক। কিছুই জানে না। আসল কথা, ডন বাকালার ওপর ভারি চটা সে, ডন নাকি তার ওপর অন্যায় করেছে। ভিলা কোলাসি আর, ওখানের। সেট আপ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন না করেই তার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, লিখে এই ফোল্ডারে ভরে রেখেছি–তোমার কাজে লাগবে।

ফোল্ডার খুলে দেখল রানা। ভিলার একটা স্কেচ ম্যাপ রয়েছে, আর কয়েক পাতা নোট। মুখ তুলল ও, বলল, চমৎকার, আমার অনেক খাটনি কমিয়ে দিলে।

ওয়েটারকে ডেকে কফি দিতে বলল রেমারিক। ওয়েটার চলে যেতে বলল, ভিলা কোলাসিতে ঢোকা খুব কঠিন হবে তোমার জন্যে। গড ফাদার ডিলা থেকে বেরোয় না বললেই চলে।

রানা হাসল। যখন জানবে সে-ও টার্গেট, একেবারেই বেরুবে না।

কিভাবে ঢুকবে, কোন বুদ্ধি পেয়েছ?

কয়েকটা উপায়ের কথা ভেবে রেখেছি, বলল রানা। কোনটা বেছে নেব। সেটা নির্ভর করে আর কি তথ্য পাই তার ওপর। আসলে ভিলা কোলাসিতে কিভাবে ঢুকবে রানা, ঠিক করা হয়ে গেছে। তিন মাস আগে পালার্মোয় গিয়েছিল ও, তখনই বুদ্ধিটা আসে মাথায়। ব্যাপারটা নিয়ে রেমারিকের সঙ্গে আলোচনা না করার একটা কারণ আছে।

কফি এল, কাপে চুমুক দিয়ে প্রসঙ্গে ফিরে এল রানা। রোমে আতুনি। বেরলিংগারের পর, আমি সম্পূর্ণ একা মুভ করব। কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগ বা নির্দিষ্ট কোন ঘাঁটি থাকবে না। ততদিনে গাড়ি দুটো আর ভ্যানটা আমার কাছে থাকবে না–কেন বুঝতে পারছ তো?

মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। কারণ ততদিনে পুলিস আর ডন বাকালা হিসেব। কষে বের করে ফেলবে কাজগুলো কার। তোমাকে চিনলে আমাকেও চিনতে সময়। লাগবে না। ওরা আমাকে জেরা করতে আসবে, কিন্তু আমি যা জানি না তা। ওদেরকে বলব কিভাবে?

রানা গম্ভীর হল। তুমি না জানলে, ওরাও বুঝতে পারবে তুমি জান না। কাজেই এদিক থেকে তুমি নিরাপদে থাকছ। ইতিমধ্যে আমি যদি যোগাযোগ। করতে চাই, কিভাবে করব? ফোন ব্যবহার করতে চাই না।

ফোল্ডারটা দেখাল রেমারিক। সামনের পৃষ্ঠায়। নেপলস পোস্ট অফিসের একটা নাম্বার আছে–ফোন নাম্বার আর সময় জানিয়ে একটা তার পাঠিয়ে দিয়ো, বাইরে কোথাও থেকে ডায়াল করব আমি।

ফোল্ডার খুলে পোস্ট বক্স নাম্বারটা পড়ল রানা। ঠিক আছে। সব যদি ভালভাবে এগোয়, কোন যোগাযোগই আমি করব না–পুরো কাজ শেষ না হওয়া। পর্যন্ত।

এরপর অনেকক্ষণ ওরা কেউ কথা বলল না।

রেমারিক এক সময় জিজ্ঞেস করল, কবে শুরু করছ?

সামনের দিকে ঝুঁকল রানা। নিচু গলায় জানাল।

আজই মিলানে যাবে রানা। কাল খুব সকালে বাংলোয় পৌঁছুবে ও। অগাস্টিন আর এলি প্রথম শিকার, কিন্তু ওদের শুধু একজনের সঙ্গে কথা বলার দরকার হবে। রানার–সম্ভবত অগাস্টিনের সঙ্গে। দেখে তো মনে হয় পেশীসর্বস্ব একটা মূর্খ, এলির চেয়ে ওকেই সহজে ভাঙা যাবে। দুএকদিন নজর রাখবে রানা, তারপর একদিন তুলে নিয়ে আসবে।

ফোল্ডারটা টেবিল থেকে তুলে ব্যাগে ভরল রেমারিক। বলল, তুমি আগে বেরিয়ে যাও।

দাঁড়াল রানা। ফুরেলাকে আমার ধন্যবাদ দিয়ো।

দেব, বলল রেমারিক। ও তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।

দাঁড়াল রেমারিক। ওর কাঁধে হাত রাখল রানা, চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ব্যাগটা নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেল।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত