অগ্নিপুরুষ: ২.১-২ পায়ের কাছে স্যুটকেস

অগ্নিপুরুষ: ২.১-২ পায়ের কাছে স্যুটকেস

অগ্নিপুরুষ ২ –- কাজী আনোয়ার হোসেন

২.১-২ পায়ের কাছে স্যুটকেস

০১.

পায়ের কাছে স্যুটকেস, ফেরি বোটের টপ ডেকে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা। নামের সাথে চেহারার কোন মিল নেই, বোটটা দেখতে বরং অনেকটা কাছিমের মত–মাল্টা আর গোজোর মাঝখানে সাগর মাত্র দুমাইল, শুধু এই পানি পথেই লোকজন আর যানবাহন নিয়ে চলাচল করে ডলফিন।

খুদে দ্বীপ কোমিনোকে পাশ কাটিয়ে এল বোট, পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন ওয়াচটাওয়ার। পানি এখানে স্বচ্ছ নীল, তলার বালি পরিষ্কার দেখা যায়– লেগুন। বেশ কবছর আগে, অথচ রানার মনে হল এই তো সেদিন রেমারিক আর জেসমিনের সঙ্গে এখানে সাঁতার কেটেছে ও।

সামনে, গোজোর দিকে তাকাল রানা। সাগর থেকে হঠাৎ প্রায় খাড়াভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সবুজ দ্বীপটা। পাহাড়গুলোর মাথায় মাথায় মুকুটের মত সাজানো গ্রাম। পাহাড়ের গা থেকে মাটি কেটে বিশাল আকারের ধাপ তৈরি করা হয়েছে, প্রতিটি ধাপ এক একটা খেত, নিচের খেতটা সাগরের কিনারা ছুঁয়েছে।

প্রথমবার গোজোয় এসে দ্বীপটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল রানা। গোজোর। সমাজে ছোট-বড় ভেদ নেই, সবাই সমান। ভূমিহীন কষক বা একেবারে গরীব জেলে লোকটাও জানে তার অধিকার আর স্বাধীনতা গোজোর সবচেয়ে ধনী লোকটার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সারাদিন খেটে যা সে রোজগার করে তা দিয়ে সংসারের ভরণ-পোষণ ছাড়াও হাতে কিছু থাকে, ইচ্ছে করলে অনেকের মত। সে-ও রুচিতাস-এ বসে সন্ধে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত আকণ্ঠ মদ খেতে পারে। অন্যদের চেয়ে নিজেকে কারও বড় মনে করার প্রবণতা থাকলে গাজোকে তার। এড়িয়ে চলা উচিত। গোজোর লোকেরা হাসিখুশি আর ফুর্তিবাজ, তোমাকে ওদের পছন্দ হলেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে।

ফেরি জেটিতে ভিড়তেই পেঁয়ো লোকগুলো শোরগোল তুলে নামতে শুরু করল।

পাহাড়ের খানিকটা ওপরে উঠে দ্বীপের একমাত্র বার রুচিতাস-এর সামনে এসে দাঁড়াল রানা। মান্ধাতা আমলের বিল্ডিং, সাগরের দিকে মুখ করা একটা স্কুল বারান্দা আছে। রেমারিক বলে দিয়েছে, জেসমিনের বাবাকে ফোন করতে হবে এখান থেকে। বারের ভেতরটা ঠাণ্ডা, সিলিং থেকে ঝাড়বাতি ঝুলছে, দেয়ালে আঁকা পাহাড় আর নদীর ছবি। দরজার কাছে সুটকেস রেখে কাউন্টারের দিকে এগোল রানা, মগভর্তি বিয়ার- দেখে অনুভব করল গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। গোলগাল চেহারার বারটেণ্ডার জিজ্ঞেস করল, এক পাইন্ট, নাকি অর্ধেক?

এক পাইন্ট, ধন্যবাদ। উঁচু টুলে বসে কাউন্টারের ওপর এক পাউণ্ডের একটা নোট রাখল রানা। খুব ঠাণ্ডা বিয়ার, প্রাণ জুড়িয়ে গেল। বাকি টাকা কাউন্টারে রাখল বারটেণ্ডার, রানা জিজ্ঞেস করল, পাজেরো তাজার ফোন নাম্বার দরকার আমার, দিতে পারবে?

বারটেণ্ডার শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল।

পাজেরো তাজা, আবার বলল রানা। নাদুরের কাছে তার একটা ফার্ম আছে।

কাঁধ ঝাঁকাল বারটেণ্ডার। তাজা একটা কমন নাম, আর গোজোয় তো অনেকেরই ফার্ম আছে, বলে অন্য এক লোককে বিয়ার দেয়ার জন্যে সরে গেল

বিরক্ত না হয়ে লোকটার আচরণ মনে মনে অনুমোদন করল রানা। গোজো ছোট্ট একটা দ্বীপ, লোকটা পাজেরো তাজাকে না চিনেই পারে না। কিন্তু এই দ্বীপবাসীদের বৈশিষ্ট্যই হল নিজেদের সমস্ত ব্যাপার বাইরের লোকদের কাছে গোপন করে রাখা। অচেনা আগন্তুকের পরিচয় আর উদ্দেশ্য না জেনে মুখ খুলবে না।

খানিক পর আরও এক পাইন্ট বিয়ার চাইল রানা। বারটেণ্ডারকে বলল, ভিটেলা রেমারিক পাঠিয়েছে আমাকে। পাজেরো তাজার বাড়িতে কিছুদিন থাকব। বলে এসেছি।

বারটেণ্ডারের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আচ্ছা, তুমি তাহলে ওই পাজেরো তাজার কথা বলছ! কৃষক–নাদুরের কাছে? মাথা ঝাঁকাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড। ওকে খুঁটিয়ে দেখার পর হাসল লোকটা, হাত বাড়িয়ে দিল। আমি সাকো। টেবিলে বসা এক যুবককে ইঙ্গিতে দেখাল সে। আমার ভাই, টাগলিয়া। তারপর দেখাল রোগা-পাতলা চেহারার এক লোককে, মুখের নিচের অংশ ঢাকা পড়ে আছে। লম্বা-চওড়া কালো গোঁফে। টাফি। আরও দুজন যুবককে দেখাল সে, বলল, মিলানো আর আলফানসো–ওরাই ফেরি চালায়।

মিলানো আর আলফানসোকে চিনতে পারল রানা, ফেরিতে দেখেছে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বারটেণ্ডার বুঝিয়ে দিল, গোজোয় এখন আর ও আগন্তুক নয়। ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল সাকো, মাল্টিজি ভাষায় দুচারটে কথা, বলল। রিসিভার রেখে দিয়ে রানার দিকে ফিরল সে। নিড়ো তোমাকে নিতে আসছে।

রানার সামনে মগভর্তি বিয়ার রাখল টাগলিয়া, ইঙ্গিতে গোঁফওয়ালা টাফিকে দেখাল। গোজোবাসীদের এই রীতিটা মনে পড়ে গেল রানার। একবার যদি পরস্পরকে বিয়ার কিনে খাওয়াতে শুরু করে ওরা, পালা করে সবাই সবাইকে খাওয়াতে কখনও কখনও দেড়-দুদিন লেগে যায়। পরিবেশটা শান্ত আর স্বস্তিকর লাগল, সহজেই এদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়া যাবে। বেয়াড়া কোন প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না ওকে, কারও সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ বাধবে না।

গোজোবাসীদের বন্ধুত্বে কোন কৃত্রিমতা নেই। গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে না এলে সবাই তোমাকে আপনজন বলে মেনে নেবে। শুধু তোমার যখন পালা, কিপটেমি কোরো না। আর ডাঁট দেখিয়ো না–গর্ব করা গোজোয় সবচেয়ে বড় পাপ। লম্পট, খুনী, ডাকাত বা পকেটমারকেও হয়ত সহ্য করা হবে, তারা যদি নিজের পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চায়, কিন্তু সে যদি কোন ব্যাপারে ডাঁট দেখায়, এ দ্বীপে তার ঠাঁই হবে না।

মগ খালি করে সাকোর দিকে তাকাল রানা। এগিয়ে এসে মগটা আবার ভর্তি করে দিয়ে রানার সামনে থেকে টাকা নিল সাকো। রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি?

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল সাকো। এত সকালে আমার চলে না।

দশ মিনিট পর সাকোর মুখে হাসিটা ফিরে এল, রানার সামনে থেকে গুনে গুনে দশ সেন্ট তুলল সে। ক্ষতি কি! বলে নিজের জন্যে মগভর্তি করে বিয়ার ঢালল।

রানার জানা নেই, এটাই সাকোর অভ্যেস। কেউ অফার করলে প্রথমে সাকো সেটা প্রত্যাখ্যান করবে, তারপর দশ মিনিট থেকে আধ ঘন্টা পর সহাস্যে এগিয়ে এসে বলবে, ক্ষতি কি!

গোজোয় প্রত্যেকেরই একটা করে ডাকনাম আছে, বলাই বাহুল্য, সাকোকে ক্ষতি কি বলে ডাকা হয়। সেই রকম টাফিকে বলা হয় গুফো, আর সাকোর ভাই টাগলিয়াকে কিন্তু। টাগলিয়াকে কিন্তু বলার কারণ শব্দটা অতিমাত্রায় ব্যবহার করে সে। মিলানোর ডাকনাম হাজির আর আলফানসোর অক্লান্ত। মিলানো ফেরি থেকে নেমে সোজা রুচিতাস-এ চলে আসে, এসেই ঘোষণা দেয়, আমি হাজির। আর আলফানসোর বিয়ার খেতে কোন ক্লান্তি নেই, যত দেবে তত খাবে, আজ পর্যন্ত কেউ তার রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। কিন্তু, ক্ষতি কি, গুফো, অক্লান্ত, বিদ্রোহী, হাজির–এদের মধ্যে এই মুহূর্তে বিদ্রোহী অর্থাৎ কার্লো ছাড়া আর সবাই রয়েছে বারে। এরা গোজোর ছয় ব্রত, দ্বীপটাকে আনন্দ-মেলা বানিয়ে রেখেছে।

বাইরে তোবড়ানো একটা ল্যাণ্ড-রোভার এসে থামল। লাফ দিয়ে নামল উনিশ-বিশ বছরের এক যুবক, মাথায় কোকড়া কালো চুল। বারে ঢুকে রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। হাই, আমি নিডো। ওয়েলকাম, হাসান ভাই।

জেসমিনের ভাইকে অস্পষ্টভাবে চিনতে পারল রানা, প্রায় আট বছর আগে দেখেছে। করমর্দন করার সময় অনুভব করল নিডোর হাত লোহার মত শক্ত। কোন তাড়া নেই তো? হাসিমুখে রানাকে জিজ্ঞেস করল সে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল রানা। ইতিমধ্যে নিডোর সামনে বিয়ার রেখে গেছে সাকো। এক চুমুকে মগের অর্ধেকটা খালি করে ফেলল নিডো। সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে বস্তায় জলপাই ভরেছি, তেষ্টায় একেবারে ফেটে যাচ্ছে ছাতি।

ছোটখাট একটা উৎসব জমে উঠল, একের পর এক বিয়ারের ক্যান খুলল সাকো। গোজোর দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি, আরবী আর ইটালিয়ানও কমবেশি জানে সবাই। ওদের কথাবার্তা বুঝতে বা হাসি-তামাশা উপভোগ করতে রানার কোন অসুবিধে হল না। একটু পর জেলেরা বারে ঢুকতে শুরু করল, মাথার ওপর সূর্য নিয়ে সারাদিন ভোলা লোটে কাজ করে সবাই খুব তৃষ্ণার্ত। মিলানো আর আলফানসো উঠল, আজকের মত শেষবার ফেরি নিয়ে মাল্টা থেকে ঘুরে আসলো ওরা। বেশিরভাগ লোক লাগার বিয়ার থেকে কড়া মদের দিকে ঝুঁকছে, এই সময় হাতঘড়ির দিকে তাকাল নিডো কি সর্বনাশ, এরই মধ্যে ছটা! রানার দিকে তাকাল সে। চল, চল–দেরি করায় মা আজ আমার কান ছিঁড়ে নেবে!

ল্যাণ্ড-রোভার নিয়ে পাহাড়ে চড়ল ওরা, খুদে গ্রাম কালার ভেতর দিয়ে উল্টো দিকে চলে এল, তারপর নিচে নেমে এসে বাঁক নিয়ে নাদুরের পথ ধরল।

ঘেরা উঠনের মাঝখানে পাথরের তৈরি ফার্মহাউস। বাড়ির একটা অংশ নতুন। বাইরে থেকে আলাদা সিঁড়ি উঠে গেছে সেখানে। কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো মোটাসোটা, তেল চকচকে এক প্রৌঢ়া। একই মানুষ, কিন্তু অন্য চেহারা, রানাকে চিনতে না পারলেও ভূত দেখার মত চমকে উঠল না, শুধু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল রানা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রৌঢ়া অনোরিয়ার পেশীতে ঢিল পড়ল, উজ্জ্বল হল তার চোখ জোড়া, সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসি। এগিয়ে এসে রানাকে আলিঙ্গন করলো সে, চুমো খেল গালে। ওয়েলকাম, রানা। অনেকদিন পর এলে। ছেলের দিকে কটমট করে তাকাল সে। এতক্ষণ রানার পিছনে গা ঢাকা দিয়ে ছিল নিডো।

মাসুদ ভাইয়ের তেষ্টা পেয়েছিল, মা, আমি কি করব! রানার উদ্দেশে এক চোখ টিপল নিডো।

মাসুদের সুটকেস দোতলায় রেখে আয়, হুকুম করল অনোরিয়া। চপ্পল জোড়া নিয়ে আসবি। রানার একটা হাত ধরে কিচেনে ঢুকল সে।

বড়সড় একটা ঘর। রানার মনে পড়ল, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে পারিবারিক আড্ডা সব এখানেই চলে। ডাইনিংরূম আর লাউঞ্জ ব্যবহার করা হয় শুধু কোন মেহমান এলে।

জুতো খুলে বস, বাবা, অনোরিয়া বলল। রানার সামনে পট ভর্তি কফি আর কাপ-পিরিচ রাখল সে। তিনটে স্টোভে রান্না হচ্ছে, মাংস আর মশলার গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল অনোরিয়া, কিন্তু মুখ বন্ধ নেই।

রেমারিক কেমন আছে? রানা কি জানে, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ভায়োলার? ডাইভোর্সের জন্যে আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু সেটা মঞ্জুর হতে কত বছর লাগবে কেউ বলতে পারে না। ইটালিতে বিবাহবিচ্ছেদ অত্যন্ত জটিল আর ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবে ভায়োলা, টেলিফোন করে জানিয়েছে তার নাকি খুব শখ মাসুদ ভাইকে চিংড়ি মাছের কোপ্তা বেঁধে খাওয়াবে।

পরিবেশটা ঘরোয়া, অনোরিয়া রানার ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ না ভোলায় ওর পেশীতে ঢিল পড়ল। খানিক পর খেত থেকে ফিরল পাজেরা তাজা। হাসি খুশি একহারার শক্ত-সমর্থ পুরুষ, কথা বলে কম। রানাকে দেখে মাথা আঁকাল সে, জিজ্ঞেস করল, সব ঠিক?

মাল্টায় সবার মুখে এই শব্দ দুটো শুনতে পাওয়া যাবে। এ শুধু কুশল জানতে চাওয়া নয়-দরদভরা সহানুভূতি প্রকাশের সাথে সাথে সাহায্য করার প্রস্তাবও। বিদায়, শুভেচ্ছা আর অভ্যর্থনা জানাবার জন্যেও শব্দ দুটো ব্যবহার করা হয়। সব এক, জবাব দিল রানা। ওর সামনে একটা চেয়ারে বসে অনোরিয়ার হাত থেকে এক কাপ কফি নিল তাজা। হাতে বানানো সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিল।

সবাই ওকে এমনভাবে অভ্যর্থনা জানাল যেন আট বছর নয়, শুধু এক রাত বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে।

সামনে লম্বা পাচিলের মত দাঁড়িয়ে আছে নিচু পাহাড়, একটানা দৌড়ে এসে দম নেয়ার জন্যে মাথায় উঠে থামল রানা। এখানে দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত উপসাগর দেখতে পাওয়া যায়। ঘামে ভিজে ওর ট্র্যাক স্যুটের রঙ গাঢ় হয়ে গেছে। সুর্য তখনও দিগন্তরেখার কাছাকাছি, উপসাগরে পাহাড়ের ছায়া। নিচু পাচিলের ওপর বসে হাঁপাতে লাগল রানা। সারা শরীরে ব্যথা, প্রতিটি পেশী আড়ষ্ট। বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না, জানে ও। একটা শিরায় টান পড়লে কয়েক দিন বা কয়েক হপ্তা পিছিয়ে যাবে ওর প্রোগ্রাম।

ভোর হবার অনেক আগে ঘুম থেকে উঠেছে রানা। টেরেসে বেরিয়ে এসে এক ঘন্টা ব্যায়াম করেছে। প্রথম দিকে শুধু হালকা ব্যায়ামগুলো, ইনস্ট্রমেন্ট ব্যবহার করবে আরও পরে। এরপর ঠাণ্ডা পানিতে শাওয়ার সেরে নিচে নেমে আসে। এত সকালে কিচেনে অনোরিয়াকে দেখে অবাক হয় ও।

ওর প্রশ্ন শুনে মৃদু, ম্লান হেসে প্রৌঢ়া বলল, পাপ করার বেলায় সবাই আছে, কিন্তু প্রার্থনার বেলায় কেউ নেই, তাই আমাকেই যেতে হয় চার্চে।

মিটি মিটি হেসে রানা বলল, তাহলে আমার জন্যেও একটু প্রার্থনা কর, মা।

সে কি তোমাকে বলে দিতে হবে, বাবা! রানাকে মগভর্তি কালো কফি বানিয়ে দিল অনোরিয়া। কাপে চুমুক দিচ্ছে রানা, এই সময় কাজে যাবার কাপড় পরে কিচেনে ঢুকল তাজা আর নিডো।

রানা গোজোয় পৌঁছবার আগে শ্বশুরের সঙ্গে বারকয়েক টেলিফোনে কথা বলছে রেমারিক। রানার শারীরিক অবস্থা এবং মিলানে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা সম্পর্কে সব কথাই তাকে জানিয়েছে সে। তবে রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান সম্পর্কে কিছু বলেনি।

জেসমিনকে বিয়ে করার পর থেকে প্রতি মাসে শ্বশুরবাড়িতে কিছু কিছু টাকা পাঠায় রেমারিক, জেসমিন মারা যাবার পরও টাকা পাঠানো বন্ধ করেনি। প্রথম দিকে বাড়ির সবাই প্রতিবাদ জানিয়েছিল, কারণ তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ নয়। কিন্তু রেমারিককে থামানো যায়নি, এখানে টাকা পাঠালে তার নাকি ইনকাম ট্যাক্সের বোঝা কমে। সেই টাকা দিয়েই বাড়ির সঙ্গে একটা দোতলা তৈরি করা হয়েছে, রেমারিক বেড়াতে এলে আরাম করে নিরিবিলিতে থাকতে পারবে। সেই খুদে দোতলার সবটুকু ছেড়ে দেয়া হয়েছে রানাকে।

কাল রাতে ডিনারে বসে কথা হয়েছে, রানার দৈনন্দিন প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানে তাজা। রানাকে সে বলল, দৌড় আর সাঁতার শেষ করে পাহাড়ে চলে এস।

রাখ তোমার পাহাড়, স্বামীকে বাধা দিয়ে বলল অনোরিয়া। রানার দিকে ফিরল সে, বলল, সাঁতার শেষ করে সোজা বাড়ি ফিরে আসবে তুমি। নাস্তা করে বিশ্রাম নেবে, তারপর যেখানে খুশি যেয়ো।

, নতুন একটা পাহাড় কিনেছে ওরা, পাথর কেটে মাটি বের করা হয়েছে। প্রথমে পাহাড়ের দুপাশে পাথরের পাঁচিল দেয়া হবে, তারপর মাটি কেটে তৈরি করা হবে বিশাল সব ধাপ, সেই ধাপে চাষাবাদ হবে।

ওরা তিনজন একসাথে বাইরে বেরুল। সাগরের দিকে একটা পাহাড় দেখিয়ে তাজা বলল, সাঁতার কাটতে হলে ওদিকে যেয়ো। ছোট্ট একটা ইনলেট আছে ওখানে, পাহাড় থেকে সরাসরি নামা যায়। পানি খুব গভীর, আর একেবারে নির্জনবোটে করে, আর নাহয় আমার জমির ওপর দিয়ে যাওয়া যায়।

দম ফিরে পেতেই প্রচণ্ড খিদে অনুভব করল রানা। কিন্তু বাড়ি ফেরার আগে সাঁতার কাটতে হবে। পাঁচিল থেকে নেমে ঘোড়ার মত দুলকি চালে ছুটল ও।

তিন দিক ঘেরা সাগরের খুদে একটা অংশ, প্রাণের কোন চিহ্ন নেই কোথাও গভীর তলদেশ, কাঁচের মত স্বচ্ছ পানি। পাহাড়ের গা থেকে সমল একটা কার্নিস সাগরের ওপর ঝুলে আছে। কাপড় খুলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। একশ মিটারের মত সাঁতরে উত্তর কোমিনো চ্যানেলে চলে এল ও, খুদে দ্বীপটা এত কাছে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আসলে কিন্তু দ্বীপের সবচেয়ে কাছের প্রান্তটা এক মাইলের কম দূরে নয়। কদিন অভ্যেস হোক, তারপর ওখানে যাবে রানা। তারও কদিন পর বিরতি না নিয়ে ফিরে আসবে। আগের শক্তি ফিরে এলে একটানা চার পাঁচ বার আসা-যাওয়া করতে পারবে ও।

ব্রেকফাস্টের বিশাল আয়োজন করেছে অনোরিয়া। মুরগির সুপ, সেদ্ধ ডিম, ভুনা গরুর মাংস, তন্দুরে সেঁকা গরম রুটি আর স্বচ্ছ মধু। প্লেটের ওপর রুটির পাহাড়, অনোরিয়ার কঠোর নির্দেশে সবগুলো গিলতে হল। সবশেষে এক মগ ধূমায়িত কফি।

রানার খাওয়া দেখছে, আর আট বছর আগের কথা ভাবছে অনোরিয়া। তখনও এই রকম চুপচাপ থাকত রানা। টেলিফোনে রেমারিক যদি ওঁর ছদ্মবেশের, কথা না জানাত, রানাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠত ওরা। মাত্র আট বছরে তরতাজা, প্রাণচঞ্চল একটা যুবক আধবুড়ো হতে পারে না। শুধু যে ছদ্মবেশ নিয়ে আছে তাই নয়, মৃত্যুর দরজা থেকে একটুর জন্যে ফিরে এসেছে রানা, স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে।

মেয়ে মারা গেলেও, জামাই রেমারিককে এখনও ছেলের মত ভালবাসে অনোরিয়া। বিয়ের আগের দিন ওদের সাথে কথা বলতে এসেছিল রেমারিক। নিজের অতীত সম্পর্কে বিস্তারিত বলে সে, ভবিষ্যতে ভাল-মন্দ কি ঘটতে পারে না। পারে সে-সম্পর্কে একটা আভাসও দেয়। সবশেষে রেমারিক ওদের বলে, তার যদি কোন বিপদ ঘটে, জেসমিনের যদি কোন সাহায্য দরকার হয়, তারা যেন রানাকে খবর দেয়। রানার কয়েকটা ঠিকানাও ওদেরকে দিয়েছিল রেমারিক।

জেসমিন মারা যেতে অনোরিয়াই টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল ঢাকায়। রেমারিকের বন্ধু, কাজেই রানাকেও নিজের ছেলের মত দেখে অনোরিয়া। ছেলেটা যাতে তার স্বাস্থ্য ফিরে পায় তার জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করবে সে। ব্যায়াম আর কঠিন পরিশ্রম, এ-দুটোই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে, তার কাজ প্রচুর তাজা খাবার যোগান দেয়া।

নাস্তার পর পাহাড়ে চলে এল রানা। গায়ের শার্ট খুলে তাজার পাশে দাঁড়িয়ে। কাজ শুরু করল। শুকনো, আলগা পাঁচিল তৈরি করতে অভিজ্ঞতা লাগে। মাপমত সঠিক পাথর বাছাটাই আসল, পাথরের ওপর ঠিকমত পাথর বসানও কম গুরুত্বপূর্ণ। নয়। প্রৌঢ় তাজ অবাক হয়ে দেখল, আনাড়ি ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে উঠছে রানা। এক ঘন্টাও পেরোয়নি, অথচ প্রথমবারেই সঠিক পাথরটা বেছে নিতে পারছে ও।

বার বার ঝুঁকে কোমরে ব্যথা ধরে গেল রানার, পাথরের ঘষা খেয়ে ছড়ে গেল। তালুর চামড়া। বেলা দুটোর দিকে রানার অবস্থা দেখে মায়া হল তাজার, থামতে বলল সে। খুদে ইনলেটে এসে সাগরের লোনা পানিতে হাত ধুল রানা।

ভেজিটেবল সুপ দিয়ে শুরু হল দুপুরের খাওয়া। মাছ দিয়ে রান্না ভাত, তন্দুরে। সেঁকা রুটি, মুরগি আর গরুর মাংস, সালাদ, সবশেষে ফল। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে দিনের সবচেয়ে গরম সময়টা সবাই ছোট্ট একটা করে ঘুম দিয়ে নিল। পাথরের চওড়া দেয়াল, উঁচু সিলিং, ঘরের ভেতরটা তাই ঠাণ্ডা। শরীরে ব্যথা থাকলেও- ভাল ঘুম হল রানার। চারটের দিকে জাগল ও, শরীর আড়ষ্ট, হাতের, ক্ষতগুলো ব্যথা করছে। শুয়ে-বসে থাকতে ভাল লাগবে এখন, ঝোঁকও চাপল, কিন্তু নিষ্পাপ এক কিশোরীর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল, পাহাড়ে এসে আবার দাঁড়াল তাজার পাশে।

এক ঘন্টা কাজ করার পর থামতে হল ওদের, বালতি করে বরফ আর বিয়ার নিয়ে এসেছে অনোরিয়া। রানার হাতের অবস্থা দেখে শিউরে উঠল প্রৌঢ়া, রাগের। সাথে ফিরল স্বামীর দিকে, তোমার আক্কেল বলি, এই হাত দিয়ে কেউ ওকে কাজ করতে দেয়?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাজা বলল, এবার নাহয় তুমিই বারণ করে দেখ!

রানার হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করল অনোরিয়া।

এ কিছু না, বলল রানা। সন্ধের দিকে সাঁতার কাটবলোনা পানি ওষুধের কাজ করবে।

পরের তিন দিন খুব ভুগল রানা, রোজ রাতে বিছানায় এল যেন আহত একটা

তবে ছক বাঁধা একটা রুটিন দাঁড়িয়ে গেল। ভোর অন্ধকারে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম, তারপর দৌড়, দৌড় শেষে সাঁতার, প্রতিবার আগের দিনের চেয়ে বেশি সময় নিয়ে, এরপর পাহাড়ে গিয়ে মাটি কেটে ধাপ তৈরি করার কঠিন কাজ, সন্ধ্যার দিকে আরও একবার সাঁতার, তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুম। শোবার আগেও কিছুক্ষণ যোগ ব্যায়াম করে ও।

এই রুটিন মেনে চলতে প্রথম দিকে খুব কষ্ট হল, আড়ষ্ট শরীর নিয়ে বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু এই আড়ষ্ট ভাব আর ব্যথা সারাক্ষণ ওকে লুবনার কথা মনে করিয়ে দিল, মনে করিয়ে দিল ওকে নিয়ে জানোয়ারগুলো কি করেছে। প্রচণ্ড ঘৃণা আর প্রতিশোধ নেয়ার উগ্র বাসনা ভুলিয়ে দিল.সমস্ত ব্যথা আর যন্ত্রণা।

রানার এই ঘৃণা হঠাৎ একদিন চাক্ষুষ করে ঘাবড়ে গেল তাজা। ডিনারের পর বাইরে খোলা উঠনে বসেছিল ওরা তিনজন, ব্র্যাণ্ডি মেশানো কফি খাচ্ছিল। কালো সাগরের ওপর কোমিনোর ঢাউস আকৃতি, আরও দূরে আলো ঝলমলে মাল্টা দেখা যাচ্ছিল। মাল্টার এই আলো নেপলসে আসার কথা মনে করিয়ে দিল রানাকে। ভাবল, অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে। লুবনার কথা মনে পড়ল।

আকাশে অনেক তারা জ্বলছে, তার মধ্যে সবচেয় উজ্জ্বল তারাটা দৃষ্টি কেড়ে, নিল রানার। কান পাতলে কোকিলের ডাকও হয়ত শুনতে পাবে। বাগান থেকে ভেসে এল মিষ্টি ফুলের গন্ধ। ফুরফুরে বাতাস এলোমেলো করে দিল ওর চুল। কিন্তু। তবু অন্তরে সেই গানটা বেজে উঠল না।

ভিটো আভান্তির বাড়ি থেকে রানার ব্যক্তিগত জিনিস-পত্র নিয়ে এসেছিল রেমারিক, সেগুলোর মধ্যে লুবনার প্রেজেন্ট করা গানের ক্যাসেটটাও ছিল। নেপলস থেকে একটা রেকর্ড-প্লেয়ার কিনেছে রানা। কিন্তু লুবনার ক্যাসেটটা ও আর বাজায় না।

উজ্জ্বল তারাটার দিকে তাকিয়ে হাসপাতালের কথা ভাবছে রানা। রেমারিক এসে ওকে বলল, লুবনা নেই।

কি যেন বলার জন্যে রানার দিকে ফিরল তাজা, রানার চেহারা দেখে গায়ের। পশম খাড়া হয়ে গেল তার, মুখ থেকে আওয়াজ বের হল না। দেখল, মানুষটার। সমগ্র অস্তিত্ব থেকে উথলে উঠছে ঘৃণা, ঠাণ্ডা সাগর থেকে কুয়াশা ওঠার মত।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রানা, ওদেরকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

বাবার দিকে ফিরল নিডো। তাজার হাসিখুশি চেহারায় গাম্ভীর্য আর উদ্বেগ। নিডো বলল; মাসুদ ভাই মাঝে মাঝে কেমন যেন হয়ে যায়।

মাথা ঝাঁকাল তাজা। ওর ভেতর একটা আগুন জ্বলছে, বলল সে। ওই আগুনে কেউ না কেউ পুড়ে মরবে।

খুক করে কেশে একটু হাসল নিডো, পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করল। উঠে দাঁড়াল সে, হাতঘড়ি দেখল, তারপর বলল, আমার ভেতরেও একটা আগুন। জ্বলছে, তবে ঐ আগুন সে আগুন নয়। আমি বারবেরালায় যাচ্ছি। শুক্রবারের রাত, টুরিস্ট মেয়েগুলো আমাকে না পেলে হোটেল থেকে বেরুতেই চাইবে না।

মৃদু হেসে ছেলেকে উৎসাহ দিল তাজা। কিন্তু সাবধান করে দিয়ে বলল, বেশি রাত কোরো না, খেতে কাল অনেক কাজ। আর, খবরদার, বেশি গিলবে না–তোমার মা তাহলে আস্ত রাখবে না।

মাকে গোপন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল নিডো, বেরুবার সময় সামনে পড়ে গেলে বিদেশী মেয়েদের চরিত্র সম্পর্কে লেকচার শুনতে হবে। সুজুকিতে চেপে স্টার্ট দিল সে।

.

শনিবার বাড়ি এল ভায়োলা।

কিচেন টেবিলে বসে আছে মেয়েটা, ওরা তিনজন লাঞ্চের জন্যে ভেতরে ঢুকল। মেয়েকে দেখিয়ে অনোরিয়া জিজ্ঞেস করল, মাসুদ, ভায়োলাকে চিনতে পার?

একটু একটু, জবাব দিল রানা। ভায়োলাকে বলল, তখন তুমি বেণী বাঁধতে।

আড়ষ্ট একটু হাসি দেখা গেল ভায়োলার মুখে। বড় বোন জেসমিনের বিয়ের সময় তার বয়স ছিল চোদ্দ, আট বছর পর রানাকে দেখে চিনতে পারল না সে। মার মুখ থেকে ওর সব কথা শুনেছে, জানে চেহারা আর বয়স দুটোই নকল।

ভায়োলাই ওদেরকে পরিবেশন করল। কাল অনেক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল নিডো, সকালে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে। কোন মেয়ের খপ্পরে পড়েছিস বুঝি?ঠাট্টা করে জানতে চাইল ভায়োলা। কিন্তু মা নিডোকে বকাঝকা শুরু করতে ভাইয়ের পক্ষ নিল সে।

রানাকে ভায়োলা জিজ্ঞেস করল, রেমারিক কেমন আছে? এ-বছর কবে আসবে কিছু বলেছে? তার কণ্ঠস্বর সুরেলা, মিষ্টি।

ভাল আছে। না, মাস তিন-চারের আগে আসতে পারবে বলে মনে হয় না।

একহারা, লম্বা, সুন্দরীই বলা যায় ভায়োলাকে। রানা ভাবল, রেমারিকের সঙ্গে ভায়োলার কোন ব্যাপার আছে কিনা। বোধ হয় নেই, থাকলে রেমারিক তাকে বলত। মেয়েটা সম্পর্কে অনোরিয়ার কাছে অনেক কথা শুনেছে রানা, সব জেনে দুঃখবোধ করেছে। তিন বছর আগে সুদর্শন এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় ভায়োলার, বিয়ের দুমাস পরই ভায়োলা জানতে পারে তার স্বামীর একাধিক ভাগীদার আছে। তারা যদি মেয়ে হত, তাদের খপ্পর থেকে স্বামীকে বের করে আনার চেষ্টা করত সে, কিন্তু তাগড়া চেহারার কয়েকজন পুরুষের সাথে কিভাবে সে প্রতিযোগিতা করে!

বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন কবে মঞ্জুর, হবে কেউ বলতে পারে না। ভ্যাটিকানের ধর্মযাজকরা বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘোর বিরোধী, কারণ বিয়ে অত্যন্ত। পবিত্র এক বন্ধন, ছিড়লে পাপ হয়। দশ-পনেরো বছর পার হয়ে গেছে অথচ বিচ্ছেদের আবেদন বিবেচনা করা হয়নি, এমন ঘটনা ভুরি ভুরি।

বাড়ির সবাই জানে, ভায়োলার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। বিবাহ-বিচ্ছেদের। আবেদন মঞ্জুর হলেও, গোজো এমন একটা সমাজ, কোন মা তার ছেলের জন্যে ভায়োলার মত একটা মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নেবে না। তাছাড়া, দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ভায়োলারও নেই। মাল্টার একটা হোটেলে রিসেপশনিস্টের চাকরি করে সে, বছরে দুবার লম্বা ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। বাড়ির সবাই তার দুঃখে দুঃখী, তার কোন কাজে কেউ কখনও বাধা দেয় না।

শেষ বিকেলের দিকে সুইমস্যুট নিয়ে খুদে ইনলেটের পথ ধরল ভায়োলা। সমতল পাথরে কাপড় দেখল সে, সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল সাঁতার। কাটছে রানা।

চারশো মিটারের মত সাঁতার দিয়ে ফিরে এল রানা।

আমি ভাবলাম তুমি বোধহয় কোমিনা পর্যন্ত যাবে, রানাকে পানি থেকে উঠতে দেখে বলল ভায়োলা।

আগামী হপ্তায়। ভায়োলার পাশে বসে দম নিচ্ছে রানা।

রানার উদোম শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে ভায়োলা, চোখ ফেরাতে পারছে, না। রানা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে লজ্জা পেল সে।

নামবে নাকি? জিজ্ঞেস করল রানা।

হ্যাঁ। তুমি পেছন ফের, কাপড় বদলাই।

এক মিনিট পর ওয়ান-পিস সুইমস্যুট পরে পানিতে লাফিয়ে পড়ল ভায়োলা। এক ডুবে অনেকটা দূরে চলে গেল সে, মাথা তুলে রানার দিকে তাকাল, হাসছে। একটা হাত তুলে ডাকল সে। এক সেকেণ্ড ইতস্তত করে ডাইভ দিল রানা।

ইনলেট থেকে চ্যানেলে বেরিয়ে এল ওরা। ভায়োলা ভাবল, কোমিনো পর্যন্ত যাওয়া রানার উচিত হবে কিনা। চ্যানেলের মাঝখানে প্রচণ্ড স্রোত, গোজোর দক্ষ সাতারুরাও অনেকে কোমিনো পর্যন্ত যেতে সাহস পায় না। তীরের কাছাকাছি রয়েছে ওরা, অথচ স্রোতের টান বেশ ভালভাবেই অনুভব করছে। রানাকে সাবধান। করে দেয়া উচিত ভেবে মুখ খুলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে। একটা মেয়ের উপদেশ ওর হয়ত পছন্দ হবে না।

পানি থেকে উঠে পাথরের ওপর পাশাপাশি শুয়ে থাকল ওরা, শেষ বিকেলের নিস্তেজ রোদে চকচক করছে ভেজা গা। রেমারিক আর ফুরেলার কথা জানতে চাইল ভায়োলা, কিডন্যাপ আর গোলাগুলি প্রসঙ্গের ধার দিয়েও গেল না। ইটালির খবরের কাগজে ঘটনাটা সম্পর্কে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু আরও অনেক কিছু। জানতে চায় ভায়োলা–তবে এখুনি নয়।

.

তোবড়ানো ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে শেষ ফেরিতে চড়ল রানা। সেন্ট এলমো থেকে গোজোয় ফিরছে ও। পিওতর মেনিনোর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে ওর।

দুদিন আগে এক সন্ধ্যায় কাগজে একটা খবর পড়ছিল তাজা, ধারণাটা তখনই মাথায় আসে রানার পশ্চিম জার্মানীতে একটা প্লেন হাইজ্যাকের চেষ্টা করা। হয়, কিন্তু স্পেশাল অ্যান্টি টেরোরিস্ট স্কোয়াড় হাইজ্যাকারদের কোণঠাসা করে ফেলে। তাজা বলল, মাল্টায়ও এ-ধরনের একটা স্কোয়াড আছে। তার ভাইপো, পিওতর মেনিনো, পুলিসের একজন ইন্সপেক্টর, ওই স্কোয়াডের কমাণ্ডার। কথা প্রসঙ্গে রানা বলল, সুযোগ পেলে পুরানো ট্রেনিংটা ঝালাই করে নিলে ভাল হত। পরদিনই ভাইপোকে টেলিফোন করে তাজা, রানাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে রাজি হয় মেনিনো।

ব্রিটিশ আর্মির ফেলে যাওয়া অস্ত্র পাতি ব্যবহার করছে ওরা। স্টার্লিং সাবমেশিন গান আর বিভিন্ন ধরনের হ্যাণ্ডগান। রানার সাথে মেনিনোর কথা হল পুরানো দুর্গে বসে, এ্যাণ্ড হারবারের প্রবেশ পথটা পাহারা দিচ্ছে এই দুর্গ। দুর্গের ভেতরই চমৎকার একটা রেঞ্জ আছে ওদের, অনেক দিন পর অস্ত্রশস্ত্রের ছোঁয়া উপভোগ করেছে রানা। ফায়ারিং রেঞ্জে, ঘন্টাখানেক ছিল ও; বুঝেছে, লক্ষ্যভেদে আগের মত দক্ষতা ফিরে পেতে কয়েক হপ্তা সময় লাগবে। এরপর স্কোয়াডের পনেরো জনের সঙ্গে জিমনেশিয়ামে যায় ও, ওখানে আনআমড কমব্যাট এ্যাকটিস। করে। স্কোয়াডটা মাত্র গঠন করা হয়েছে, এখনও সরাই অনভিজ্ঞ, কিন্তু শেখার আগ্রহ কারও চেয়ে কারও কম নয়। পিওতর মেনিনো লম্বা চওড়া, হাসি-খুশি পুলিস অফিসার, রানাকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। কিন্তু খানিক পরই ভুরু কুঁচকে ওঠে তার, চিন্তিত দেখায় তাকে। রানার অস্ত্রপাতি নাড়াচাড়ার। ভঙ্গি দেখে বুঝে নিয়েছে সে, এ লোক সাধারণ কেউ নয়।

বিদায় নিয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়ল রানা, অমনি চাচাকে ফোন করল মেনিনো। চাচা, তুমি জান কি ধরনের লোককে মেহমান হিসেবে রেখেছ, বাড়িতে?

কেন, বাবা? উদ্বিগ্ন হল ভাজা। রেমারিকের বন্ধু ও–কোন অসুবিধে করেছে, নাকি?

না না, তা নয়। কিন্তু চাচা, হাসান প্রফেশনাল একজন সত্যিকার এক্সপার্ট। মাল্টায় ও ঠিক কি করছে বল তো?

লুবনার কিডন্যাপ আর রানার আহত হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করল তাজা, বলল, আমাদের এখানে এসেছে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে।

মেনিনো হাসল, বলল, যাক, তুমি তাহলে সামরিক অভ্যুত্থানের কোন প্ল্যান করছ না!

তাজাও হাসল। মনে হচ্ছে কু্য করার জন্যে একজন লোক আমি পেয়েছি। ও কি সত্যি অতটা ভাল?

এক মুহূর্ত পর জবাব দিল মেনিনো, ইংল্যাণ্ড আর ইটালিতে ট্রেনিং নিয়েছি। আমি, ওর মত দক্ষ লোক আর দেখিনি। এমনভাবে আর্মস নাড়াচাড়া করছিল যেন। মায়ের পেট থেকে প্র্যাকটিস করে এসেছে। আরও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর সে প্রস্তাব দিল, চাচা, আমাকে তুমি ডিনারের দাওয়াত দাও। হাসান সম্পর্কে সব কথা জানতে চাই আমি। আমাদের এখানে ইনস্ট্রাকটরের অভাব রয়েছে, কথা। বলে দেখব ওকে কোন কাজে লাগানো যায় কিনা। অবশ্যই আনঅফিশিয়ালি।

ভাইপোকে শনিবারে ডিনারের দাওয়াত দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল তাজা।

ফেরি থেকে সবার শেষে নামল রানা, ল্যাণ্ড রোভারে ওর পাশের সিটে উঠে বসল মিলানো। রুচিতা’স-এর দরজায় পৌঁছেই মিলানো ঘোষণা করল, আমি হাজির!

বড়সড় বার, লোকজনে প্রায় ভরে গেছে। প্রকাণ্ডদেহী বিদ্রোহীকেও দেখল রানা, চেয়ারটা সম্পূর্ণ ঢেকে দরজার দিকে মুখ করে বসে আছে। চোখাচোখি হতে হাসল গরিলা। ওর সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছে রানার। বিশাল আকৃতি, এমনিতে গোবেচারা আর সরল, কিন্তু কোথাও কাউকে অন্যায় করতে দেখলে স্থান-কাল পাত্র জ্ঞান থাকে না, তীব্র প্রতিবাদ করে বসে। তার প্রতিবাদ জানাবার ধরনটা অদ্ভুত। সম্ভব-অসম্ভব নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক লোক ভোটে জিতল একবার, কিন্তু ছমাস পেরিয়ে যাবার পরও সে তার একটা প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করল না। ইতিমধ্যে বার দুয়েক তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে বিদ্রোহী, কোন কাজ হয়নি। একদিন রাজনীতিকের অফিসে গিয়ে উঠল সে, কাজ শুরু করল সামনের ঘরটা ধরে। এক এক করে প্রতিটি টেবিল, চেয়ার মেঝেতে আছাড় দিয়ে ভাঙল। সে। বাধা দিতে এসে আহত হল ছয়জন কর্মচারী। খবর পেয়ে পিছনের জানালা গলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল রাজনীতিক। সেদিন তার অফিসের প্রতিটি ফার্নিচার গুঁড়িয়ে দিয়ে এসেছিল সে। পরদিনই তাকে গ্রেফতার করে পুলিস। ভাগ্য ভাল। বলতে হবে মাননীয় বিচারক রাজনীতিকদের পছন্দ করতেন না, মাত্র তিন মাসের জেল খেটে রেহাই পায় বিদ্রোহী। এই রকম ঘটনা তার জীবনে আরও অনেক আছে।

গুঁফোর পালা চলছিল, সবাইকে বিয়ার খাওয়াচ্ছিল সে। রানা আর মিলানোর সামনেও বিয়ার ভর্তি দুটো মগ রাখল। কামরায় এক কোণ থেকে রানার উদ্দেশে। হাত নাড়ল নিডো। ভায়োলাকেও দেখল রানা, আলফানসোর বউয়ের সঙ্গে একটা টেবিলে বসে আছে। কাছাকাছি হল না ওরা, দূর থেকে নিঃশব্দে হাসল দুজনেই।

প্রায় রোজই ওরা দুজন একসঙ্গে সাঁতার কাটে। ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ তুলে রানাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে না ভায়োলা, নিজের দুঃখের কথা বলে সহানুভূতি। আদায়ের চেষ্টাও তার মধ্যে নেই। রানাকে সঙ্গ দিতে পেরেই খুশি সে। তার যেন ধারণা, ওর সঙ্গ রানার দরকার আছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে রানা, ওর কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে মেয়েটা। কখন কি দরকার হয় রানার। অনোরিয়ারও এতে সমর্থন আছে। রানার কি লাগবে না লাগবে জানার জন্যে মেয়েকেই পাঠায় সে।

টাগলিয়া রানার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি, বারোটার আগে কেউ আজ ফিরতে পারবে না। ওর মুখেই রানা শুনল, সর্বশেষ মামলায় রায় দেয়া হয়েছে বিদ্রোহী নিরপরাধ। রাত দশটার পর বিদ্রোহীর তরফ থেকে সবাইকে বিয়ার খাওয়ানো শুরু হবে।

কাউন্টারে টাকা রেখে অপেক্ষা করছে রানা। ইতিমধ্যে অফার দেয়া হয়েছে। সাকোকে, কিন্তু বরাবরের মত প্রত্যাখ্যান করেছে সে। মিনিট পনেরো পর ফিরে এসে কাউন্টার থেকে গুনে গুনে দশ সেন্ট তুলল সাকো, সহাস্যে বলল, ক্ষতি কি!

.

ডিনারের পর বাইরের উঠনে বসে আছে রানা আর পিওতর মেনিনো। ওদেরকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে নিডোকে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেছে তাজা। ভায়োলা ওদেরকে কনিয়্যাক মেশানো কফি দিয়ে কিচেনে ফিরে গেল। কালো রঙের ঢাউস একটা পাইপ ধরাল মেনিনো, চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আপনি জানেন। দ্বীপগুলোর সিকিউরিটি আমার দায়িত্ব?

মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন করল রানা, আসলে আপনি জানতে চাইছেন আমি একটা সিকিউরিটি রিস্ক কিনা, তাই তো?

মাথা নাড়ল মেনিনো। না। আপনি এখানে কি করছেন চাচা আমাকে বলেছে। তাছাড়া, আপনার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য ইতিমধ্যে যোগাড় করেছি আমি। আড়ষ্ট একটু হাসি দেখা গেল তার মুখে। কাল সকালে প্যারিসে একটা টেলেক্স পাঠিয়েছিলাম, আজ সকালে তার উত্তরও পেয়ে গেছি।

আর প্যারিসে?

হ্যাঁ–ইন্টারপোলে। সমস্ত মার্সেনারি সম্পর্কে তথ্য রাখে ওরা। আমার ইনকোয়ারি ছিল সি গ্রেডের, তাই খরচ কম পড়েছে। এ গ্রেডের ইনকোয়ারি হলে আপনার সম্পর্কে ওদের জানা সমস্ত তথ্য পেয়ে যেতাম আমি, কিন্তু অত সব জানার আমার দরকার ছিল না।

কৌতুক বোধ করল রানা। জিজ্ঞেস করল, তা কি জানতে পারলেন?

জেনেছি আপনি একজন দুর্ধর্ষ মার্সেনারি, একজন মেজর, ইন্টারপোল জানে বর্তমানে আপনি কোথায় আছেন।

প্রতিক্রিয়া?

না, আপনার অনুরোধ আমরা প্রত্যাখ্যান করছি না, বলল মেনিনো। স্কোয়াডের ফ্যাসিলিটি আপনি ব্যবহার করতে পারবেন। অবশ্যই আনঅফিশিয়ালি। কেন আপনি লুকিয়ে আছেন, জানতে চাইব না।

আমি কৃতজ্ঞ।

মুচকি একটু হাসি দেখা গেল মেনিনোর ঠোঁটে। কিন্তু একটা শর্ত আছে– তেমন কঠিন কিছু না। আপনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক, আমরা আপনার ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই।

কিভাবে?

পাইপ নিভে গেছে, সেটা আবার ধরিয়ে কথা বলতে শুরু করল মেনিনো।

হাইজ্যাকার আর টেরোরিস্টদের মোকাবেলা করার জন্যে গঠন করা হয়েছে। এই স্কোয়াড আজকাল প্রায় সব দেশেই এ-ধরনের একটা করে স্কোয়াড আছে। কিন্তু ওদের এই স্কোয়াডে যারা রয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা বলতে গেলে একেবারেই নেই। আমড ফোর্সেস অব মাল্টায় এমন অফিসারের সংখ্যা খুব কম যারা। কমাণ্ডোদের ট্রেনিং দিতে পারে। যা-ও দুএকজন আছে, তারা আরও জরুরি দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। ফলে ছক বাধা নিয়ম ধরে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে, প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা ছাড়া যার কোন দামই নেই। আসল কথা ইনস্ট্রাকটরের অভাব। ইচ্ছে করলে রানা এই অভাব অনায়াসে পূরণ করতে পারে।

চেষ্টা করে দেখব কতটুকু কি করতে পারি, রাজি হল রানা। অস্ত্রপাতি যা দেখলাম, ওগুলো ছাড়া আর কি কি আছে আপনাদের?

ট্রেনিঙের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত আলোচনা করল। ওরা। রানার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করেছে মেনিনোকে, আর ট্রেনিংটা ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পেয়ে রানা খুশি।

*

খুদে ইনলেট থেকে কোমিনোয় এল রানা, কোন বিরতি ছাড়াই তিনবার আসা যাওয়া করল ও। পাহাড়ের ওপর বাড়ি, নিজের শোবার ঘরের জানালা থেকে চোখে বিনকিউলার লাগিয়ে রানাকে দেখছে ভায়োলা। খুদে বে-তে পৌঁছুল রানা, হোটেল জেটির দিকে সাঁতার কাটছে। নিচ তলায় নেমে এসে নিড়োকে ফোন। করল ভায়োলা। গত তিন দিন থেকেই রোজ সকালে কোমিনোর হোটেলে। নিডোকে পাঠায় সে, প্রচণ্ড স্রোতের মধ্যে পড়ে রানার কোন বিপদ হলে বোট আর জেলেদের নিয়ে নিভো যাতে তাকে সাহায্য করতে যেতে পারে। আর কোন কাজ নেই তোর, নিডো, ছুটি, বলে কানেকশন কেটে দিল ভায়োলা, তারপর ফোন করল তার এক বান্ধবীকে। মেয়েটা হোটেল কোমিনোর রিসেপশনিস্ট।

খালি পা আর ভেজা গা নিয়ে হোটেলের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে রানা, ধাপ কটা টপকে রাস্তায় নেমে এল মেয়েটা। তার এক হাতে একটা পাস্টিকের ব্যাগ, আরেক হাতে বরফ দেয়া শরবত। রানাকে সে বলল, কমপ্লিমেন্টস অভ। ভায়োলা।

হেসে উঠল রানা, সাগরের ওপর দিয়ে ভায়োলাদের বাড়ির দিকে তাকাল। রোদ লেগে ঝিক করে উঠল বিনকিউলারের লেন্স। গ্রাস ধরা হাতটা মাথার ওপর তুলে নাড়ল রানা।

ব্যাগের ভেতর থেকে বেরুল একটা জিনস প্যান্ট, একটা সাদা টি-শার্ট, এক জোড়া রাবার স্যাণ্ডেল–সব নতুন। একটা তোয়ালেও আছে, তাতে পিন দিয়ে। আটকানো একটা চিরকুট।

মনে রাখতে হবে এই দেশটা ক্যাথলিকদের, পড়ল রানা। আধ-ন্যাংটো হয়ে চলাফেরা করা উচিত নয়।

মেয়েটা হাত তুলে দেখাল। ওই ওদিকে একটা আড়াল আছে, ব্লু লেগুনে যাবার পথেই পড়বে। হাতঘড়ি দেখল সে। চল্লিশ মিনিট পর ছাড়বে ফেরি।

ধন্যবাদ জানিয়ে খালি গ্লাসটা ফিরিয়ে দিল রানা।

জিনস আর টি-শার্ট মাপমতই হল। ওর সব কিছু খুঁটিয়ে লক্ষ করে ভায়োলা, ভাবল ও। কিন্তু দিনে দিনে যেভাবে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ছে মেয়েটা, একটা জটিলতা সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র কিছু না। রেমারিককে ব্যাপারটা জানাবে? না, তারচেয়ে নিজেরই আরও সাবধান হওয়া উচিত।

সে-রাতে ডিনারে বসেছে ওরা, নেপলস থেকে ফোন এল রেমারিকের। আমি আগে কথা বলে নিই, বলে কিচেন থেকে লাউঞ্জে বেরিয়ে এল ভায়োলা। রেমারিকের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক তার, কিন্তু আজ সে সিরিয়াস। এক এক করে। রানা সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করে গেল ভায়োলা। লোকটার ভবিষ্যৎ কি? এখান। থেকে কোথায় যাবে ও-কেন?

কি ঘটতে যাচ্ছে, মুহূর্তে বুঝে নিল রেমারিক। ভায়োলাকে সে বলল, তোমার এ-সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ধারণা ব্যাপারটা একতরফা, ঠিক কিনা?

এ-প্রান্তে চুপ করে থাকল ভায়োলা। খানিক পর রেমারিকই আবার বলল, শুধু শুধু সময় নষ্ট, ভায়োলা। ওর হাতে একটা কঠিন কাজ রয়েছে। তাছাড়া, এমনিতেও ওকে তুমি বাঁধতে পারবে না।

বাঁধতে যে পারব না তা আমিও কিভাবে যেন বুঝেছি, বলল ভায়োলা। বাঁধতে চাই, তাই বা তোমাকে বলল কে?

তাহলে এত কথা জানতে চাওয়া কেন?

যদি বলি, বাঁধতে চাই না, কিছু পেতেও চাই না, শুধু কিছু দিতে চাই? আমাকে নির্লজ্জ ভাববে?

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল রেমারিক, তারপর বলল, না। ভাবব তুমি সাক্ষাৎ দেবী। কিন্তু আমি যদি বলি যাকে দিতে চাও তাকে ভুল করে দিতে চাও?

মানে?

ওকে তুমি চিনতে পারনি, ভাই, বলল রেমারিক।

কিন্তু আমার তো কোন প্রত্যাশা নেই!

ওরও তো নেই, কাজেই তুমি দিলেই বা ও নেবে কেন?

তুমি ওর এমন একটা ছবি দিচ্ছ আমাকে, ও যেন দেবতা, ব্যঙ্গ করে বলল ভায়োলা। যেন কোন মেয়ের পক্ষে ওকে টলানো সম্ভব নয়।

কথা না বলে সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেমারিক।

এরপর রানাকে ডেকে দিল ভায়োলা। রানা আর রেমারিকের মধ্যে আভাসে ইঙ্গিতে কথা হল। রানা বুঝল, মার্সেলেসে যোগাযোগ করা হয়েছে গগলের সাথে, সাহায্য করার জন্যে তৈরি হয়ে আছে সে। অন্যান্য প্রস্তুতি কাজও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলেছে। রানা আভাস দিল, তিন-চার হস্তার ভেতর রওনা হবে ও। রেমারিককে বলল, ওদিকের কাজ শেষ হলে সে যেন একটা চিঠি লিখে জানায় ওকে।

.

০২.

লোকটা মোটাসোটা, লম্বা, আঁটসাট ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম পরে আছে। কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলছে ট্রানসিভার আর গ্রেনেড, হাতে স্টার্লিং সাবমেশিনগান। পাথুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দম নিচ্ছে, খোলা উঠনের ওপর দিয়ে ছুটে এসে হাঁপিয়ে, গেছে।

দোতলা একটা বাড়ি, ওপর তলায় উঠতে হবে তাকে। করিডর ধরে একটু একটু করে বাঁকের দিকে এগোল সে। জানে, বাকের পর আবার লম্বা একটা করিডর, শেষ মাথায় সিঁড়ি। কোণে এসে দাঁড়াল সে, তারপর নিচু হয়ে লাফ দিল। সামনে, স্টার্লিঙের ট্রিগার টেনে ধরেছে আঙুল।

গুলির একনাগাড় আওয়াজে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল।

সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে লোকটাকে আসতে দেখল রানা, তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিনাটি সবকিছু লক্ষ করছে। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে আবার দেয়ালে হেলান দিল লোকটা। খালি একটা ম্যাগাজিন পড়ল মেঝেতে, ক্লিক করে জায়গামত বসল। নতুন আরেকটা। মুখের কাছেট্র্যানসিভার তুলে বলল সে, ওপরে যাচ্ছে। রানার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করল। রানা। বাড়ির চারদিক থেকে ব্রাশ ফায়ারের আরও আওয়াজ আসছে, মাঝে মধ্যে গ্রেনেড় ফাটছে দুএকটা।

.

এক এক করে পনেরোজনই বাগানে বেরিয়ে এল ওরা, পরনে এখনও সবার ক্যামোফ্লেজ গিয়ার, কথা বলছে উত্তেজিতভাবে। সবার পিছু পিছু এল পিওতর মেনিনো। নিচু একটা পাঁচিল দেখিয়ে সবাইকে বসতে বলল সে।

পাঁচ মিনিটের এক্সারসাইজ, কিন্তু ভিব্রিফিঙে সময় লাগল এক ঘন্টা। হামলার প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে কথা বলল মেনিনো, কারও সমালোচনা করল, কারও প্রশংসা। পনেরোজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে, পাশে রানা। স্কোয়াডের সবাই উৎসাহে ভরপুর, এটাই তাদের প্রথম ফুল-স্কেল এক্সারসাইজ, বিস্ফোরণের আওয়াজ আর ছুটোছুটি ওদেরকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে। কথা শেষ করে রানার দিকে ফিরল। মেনিনো। এনি কমেন্ট?

সামনে এগোল রানা, স্কোয়াডের সবাই কিছু শুনতে পাবার আশায় স্থির হয়ে গেল।

সব মিলিয়ে ভাল, বলল রানা। খুশি হয়ে হেসে উঠল সবাই।

কিন্তু সত্যিকার যুদ্ধে, আট থেকে দশ জন মারা যেতে তোমরা, না হয় আহত হতে। মুছে গেল মুখের হাসি।

লম্বা মোটাসোটা যুবকের দিকে হাত তুলল রানা। মারাঞ্জানো, করিডর ধরে। আসার সময় দেয়াল ঘেষে ছিলে তুমি–ভুলে গিয়েছিলে ওটা একটা পাথরের। দেয়াল। শক্ত দেয়ালে বুলেট ঢোকে না, পিছলে যায়–সেজন্যেই বারবার, করিডরের মাঝখানে থাকতে বলা হয়েছে সবাইকে। মাঝখানে থাকলে তোমার মনে হবে শত্রু তোমাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু তবু মাঝখানে থাকাই। নিরাপদ। বাকটা ঘোরার সময় নিচু হয়ে ছিলে তুমি, কিন্তু তারপরই সিধে হয়ে গেলে। আরেকটা কথা, কোমর-সমান উঁচুতে লক্ষ্যস্থির করছিলে তুমি। শত্রু মেঝেতে শুয়ে থাকতে পারে, বাতাসে ওড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, কাজেই সব সময় নিচের দিকে গুলি করতে হবে।

মাথা ঝাঁকাল মারাঞ্জানো, হতভম্ব দেখাল তাকে। কিন্তু রানা তাকে এখনও রেহাই দেয়নি।

আমি টেরোরিস্ট হলে, এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেতে। ম্যাগাজিন বদলাতে অনেক বেশি সময় নিয়েছ। ওটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়, তোমার সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্ত। সবাইকে বলছি, আরও প্র্যাকটিস কর। বাঁচতে চাইলে এর কোন বিকল্প নেই।

মাঝারি আকৃতির এক যুবকের দিকে ফিরল রানা। ডেগা, জোনাথনের পিছু পিছু দুনাম্বার কামরায় ঢুকলে তুমি। অথচ উচিত ছিল করিডর থেকে তিন আর চার নাম্বার কামরার দরজা কাভার দেয়া। কি আশা করেছিলে, দুনাম্বার কামরায় তোমার জন্যে কোন মেয়ে অপেক্ষা করছে?

হাসির হররা বয়ে গেল। সবাই জানে, ডেগা একজন রোমিও, মেয়ে দেখলে। পিছু ছাড়ে না।

স্কোয়াডের প্রায় সবার সঙ্গে কথা বলল রানা। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকল মেনিনো, দোষ-ক্রটি আবিষ্কার আর সম্ভাবনার নতুন নতুন দিক উন্মোচনে রানার কৃতিত্ব দেখে বিস্মিত। তার লোকেরা সবাই ওর কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে, কারণ একজন অভিজ্ঞ লোক কর্তৃত্বের সাথে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় গলদ। ওরা সবাই রানাকে স্টার্লিঙের ম্যাগাজিন পাল্টাতে দেখল বিদ্যুৎ খেলে গেল হাতে, একটানা গুলিবর্ষণে বিরতি পড়ল কি পড়ল না। রানাকে হ্যাণ্ডগান, এস-এম জি আর কারবাইন চালাতেও দেখল ওরা–দক্ষ, আত্মবিশ্বাসী, দ্রুত। এর আগে তারা আন-আর্মড কমব্যাট প্র্যাকটিস করতে দেখেছে ওকে, ওর গতি আর রিফ্লেক্স দেখে মুগ্ধ হয়েছে। পনেরো জনের কারও বয়সই পঁচিশের বেশি। নয়, সবাই শক্ত-সমর্থ, কিন্তু জানে রানার সঙ্গে কেউ ওরা পারবে না। কাজেই ওর কথা মন দিয়ে শুনল সবাই।

সবশেষে মেনিনো, ধন্যবাদ জানাল রানাকে। বলল, বিল্ডিংটা আরও এক মাস আমাদের দখলে থাকবে, আমি চাই আরও দুটো এক্সারসাইজে আপনি থাকুন। এয়ার মাল্টার সাথে কথা হয়ে গেছে, দুঘন্টার জন্যে ওরা আমাদের একটা বোয়িং ধার দেবে। হাইজ্যাক অ্যাসল্টের মহড়া আপনি পরিচালনা করবেন।

রাজি হল রানা।

ওর আগের স্বাস্থ্য আর শক্তি ফিরে এসেছে, ফিরে পেয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দক্ষতাও। নিয়মিত প্র্যাকটিস করে এখন শুধু ওগুলো ধরে রাখা।

.

একটা রুটিন করে নিয়েছে ভায়োলা।

ভোর অন্ধকার থাকতে ঘুম ভাঙে তার, দোতলায় উঠে রানার দরজায় টোকা। দেয়। রানার সাড়া পেলে নিচে নেমে কফি তৈরি করে সে। আবার দোতলায় উঠে।

আসে, দেখে, ব্যায়াম শুরু করেছে রানা। বিছানায় বসে রানাকে ঘেমেনেয়ে উঠতে দেখে সে। তারপর চেয়ারে বসে কফি খায় রানা। তখনও. সূর্য ওঠে না, গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। চুপচাপ থাকে ওরা, দুএকটা কথা হয় কি হয় না। কফি শেষ করে, দৌড়াতে যায় রানা–এখন একটানা দশ মাইল দৌড়ায় ও। দৌড় শেষ করে খুদে ইনলেটে চলে আসে, এসে দেখে ভায়োলা সেখানে আগেই হাজির হয়েছে, ওর জন্যে কিছু একটা ঠাণ্ডা পানীয় আর তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষা করছে। ডাইভ দিয়ে। পানিতে নামে রানা, তিন বার কোমিনো হয়ে ফিরে আসে। তারপর সমতল পাথরে আধ ঘন্টা শুয়ে থাকে, ওর পাশে বসে বা শুয়ে থাকে ভায়োলা।

ব্রেকফাস্ট সেরে পাহাড়ে চলে যায় রানা, তাজা আর নিডোর সঙ্গে মাটি কাটার কাজ করে।

সন্ধের সময় আবার রানার সঙ্গে দেখা হয় ভায়োলার, খুদে ইনলেটে সাঁতার। কাটে দুজন। তখন ওদের মধ্যে কিছু কিছু কথাবার্তা হয়। ব্যক্তিগত কোন প্রসঙ্গ কেউ তোলে না, অতীত আর ভবিষ্যতের কথা দুজনেই সচেতনভাবে এড়িয়ে। যায়। আভাসে জানিয়ে দিয়েছে ভায়োলা, তার কোন প্রত্যাশা নেই, কিন্তু ভাল লাগা আছে, আছে সমর্থন আর সহানুভূতি। সেবা, শুশ্রূষা আর সঙ্গ দিয়ে নিজেই তৃপ্তি পেতে চায় সে; অনুরোধ–নারীসুলভ তার এই আচরণকে যেন অন্য চোখে দেখা না হয়।

মাঝে মধ্যে রানাকে হাসতে দেখে ভায়োলা, অদ্ভুত একটা তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। তার অন্তর। রেমারিকের কাছে শুনেছে সে, অসহনীয় একটা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে। আছে এই লোকের মন। রেমারিকের সাথে আরও কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তার, রানার ভবিষ্যৎ প্ল্যান সম্পর্কে এক-আধটু আভাস পেয়েছে সে।

প্রথম দিকে একটু ধাঁধা লাগলেও, এখন রানা ভায়োলাকে বুঝতে পারে। অসাধারণ, বুদ্ধিমতী সে, মনটা ফুলের মত কোমল। কথাবার্তা থেকে বোঝা যায়, সত্যিকার পৌরুষ আছে এই রকম পুরুষ মানুষের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে, সে। হতে পারে স্বামীর সঙ্গে যে-কারণে ঘর করতে পারেনি, এ তারই প্রতিক্রিয়া।

সময় বয়ে চলল, কিন্তু ওদের সম্পর্ক আগের মতই থাকল। ভায়োলা সব সময় রানার কাছাকাছি আছে, কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ হবার কোন চেষ্টা নেই তার। নাগালের মধ্যে রয়েছে ভায়োলা, কিন্তু কখনও হাত বাড়াবার কোন প্রবণতা রানার মধ্যে দেখা যায় না।

রানা একদিন মৃদু কণ্ঠে বলল, আর দিন দশেক পর রওনা হব আমি। মার্সেলেসে যেতে হবে আমাকে। দেখি আজ যদি পারি জাহাজের শিডিউল চেক করে আসব।

সে তো আমিই পারি, বলল ভায়োলা। ভ্যালেটায় একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে, আমার এক বান্ধবী কাজ করে। যতদূর মনে পড়ছে, হপ্তায় একটা করে জাহাজ যায়–বন পুয়ারো।

পরদিন রেমারিকের চিঠি পৌঁছুল।

স্পষ্ট, খুদে হস্তাক্ষরে চার পৃষ্ঠা চিঠি লিখেছে রেমারিক। প্রথম পৃষ্ঠায় একটা টিকেটের অর্ধেক পিন দিয়ে আটকানো। মার্সেলেন্স রেলওয়ে স্টেশনের। ব্যাগেজরূমের টিকেট ওটা।

সে-রাতে দুটো চিঠি লিখল রানা। প্রথমটা ঢাকায়, মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের কাছে। চিঠিতে সি. আই. এ-র মতিগতি কি রকম জানতে চাইল সে। লিখল, শুধু ভাল কোন খবর থাকলে বি. সি. আই রেমারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আর, একটা ইকুইপমেন্টের জন্যে অনুরোধ করল রানা, মার্সেলেসে, পোস্ট রেসতাত-এ পাঠাতে হবে।

দ্বিতীয় চিঠিটা লিখল ফেঞ্চ আর্মির একজন জেনারেলকে। এই ফ্রেঞ্চ জেনারেল কিছু ব্যাপারে রানার প্রতি দুর্বল। লেবাননে পাঠানো জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীতে ছিলেন তিনি, খ্রিস্টান ফ্যালাঞ্জিস্টদের গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। রানা তাকে কাঁধে তুলে নেয়, তিন ঘন্টা হেঁটে, পৌঁছে দেয় হাসপাতালে। এই জেনারেলকেও একটা পার্সেলের জন্যে লিখল রানা।

.

কাল সকালে গোজো ছেড়ে চলে যাবে রানা।

স্কোয়াডের শেষ মহড়াটাও পরিচালনা করল ও। সবারই যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, মেনিনো আর রানার সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াল ব্রা, নিন্দার চেয়ে প্রশংসাই বেশি জুটল কপালে।

রানার এটা শেষ সেশন, তাই ফেয়ারওয়েল ড্রিঙ্কের জন্যে জেদ ধরল ওরা। ফেরি ধরতে পারবে না বলেও এড়াতে পারল না রানা, ওর জন্যে আগেই মাল্টা। নেভির একটা পেট্রল বোট তৈরি রাখা হয়েছে, গোজোয় পৌঁছে দেবে ওকে। মেনিনো বলল, নিডোকে ফোন করেছিলাম, তাকে না পেয়ে ভায়োলার সাথে কথা। হয়েছে আমার। আপনাকে ফেয়ারওয়েল জানাবার জন্যে রুচিতাস-এ অপেক্ষা করবে সবাই।

স্কোয়াডের অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত আটটা বেজে গেল। এক সময় রানাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে মেনিনো বলল, মাল্টায়, বিশেষ করে গোজোতে আপনার অনেক বন্ধু রয়েছে, মি. হাসান। আপনি যে কাজে যাচ্ছেন, তার ফলাফল যাই হোক, কথাটা কিন্তু ভুলবেন না।

ভুলব না,বলল রানা। অসংখ্য ধন্যবাদ।

গোজোয় পৌঁছে রানা দেখল আলফানসো আর মিলানো ওর জন্যে জেটিতে অপেক্ষা করছে, ওকে রুচিতাস-এ নিয়ে যাবে। বারের কাছাকাছি পৌঁছে হতবাক হয়ে গেল রানা। বারের ভেতর একশো জনের ওপর লোক ধরে, অথচ জায়গা না পেয়ে বহু লোক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ওকে দেখেই উমো এসেছে, উমো এসেছে বলে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল ভিড়ের ভেতর থেকে।

উমো এসেছে মানে? জিজ্ঞেস করল রানা।

তোমার ডাক নাম, বলল আলফানসো।

মানেটা জিজ্ঞেস করতে হল না, জানে রানা ইটালিয়ান ভাষায় উমো মানে, পুরুষ। সেই সঙ্গে মনে পড়ল, বহিরাগত কাউকে ডাকনাম দেয়া হয় না।

রানার সাথে যাদের বন্ধুত্ব হয়েছে তারা তো আছেই, গোজোর কৃষক আর জেলেরাও দলবেধে ফেয়ারওয়েলু জানাতে এসেছে রানাকে। কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে, কি করতে যাচ্ছে, কিছুই কাউকে বলেনি রানা, অথচ সবাই যেন সব কিছু জানে। প্রসঙ্গটা কেউ তুলল না বটে, কিন্তু হাবভাব দেখে বোঝা গেল, রানার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থনও আছে।

দরজার কাছে একটা টেবিলে বসেছে নিডোভায়োলা, অনোরিয়া আর তাজা। বারটেণ্ডার সাকো মগভর্তি বিয়ার ধরিয়ে দিল রানার হাতে, বলল, আমার তরফ থেকে।

রানা জিজ্ঞেস করল, তুমি?

ক্ষতি কি!

হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। চেয়ার ছেড়ে উঠল ভায়োলা, তার কাঁধে একটা। ব্যাগ। রানার হাতে একটা টেলিগ্রাম ধরিয়ে দিল সে। প্যারিস থেকে জেনারেল। পাঠিয়েছেন। রানার অনুরোধ রক্ষা করেছেন তিনি।

খানিক পর বিদ্রোহী এসে ওর কাঁধে হাত রাখল, বলল, একটু বাইরে। আসবে? তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।

বার থেকে বেরিয়ে নির্জন একটা জায়গার খোঁজে বেশ কয়েক পা হেঁটে আসতে হল ওদেরকে। কি ব্যাপার, কালো?জানতে চাইল রানা।

রানার সামনে ছোটখাট একটা পাহাড়ের মত লাগল বিদ্রোহীকে। উমো, ভারি গলায় বলল সে, কখনও যদি তোমার সাহায্য দরকার হয়, আর প্রথমে যদি। আমাকে না ডাক, আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করব, হ্যাঁ।

রানা হাসল। তোমাকেই প্রথমে ডাকব, কথা দিলাম।

মাথা ঝাঁকাল বিদ্রোহী। স্রেফ রুচিতা’স-এ একটা তার পাঠিয়ে দেবে, সাকো জানে কোথায় আমাকে পাওয়া যাবে।

আবার বারে ফিরে এল ওরা। এরপর একে একে কিন্তু, ক্ষতি কি, গুঁফো, অক্লান্ত আর হাজির একইভাবে আড়ালে ডেকে নিয়ে একই কথা বলল রানাকে। সবাই ওরা সাহায্য করতে চায় রানাকে।

শেষবার বারে ফিরে এসে পাজেরো তাজাকে একপাশে ডেকে নিল রানা, বলল, তুমি আমার কাছে টাকা পাও, তাজা।

প্রৌঢ় অবাক হয়ে তাকাল, কিসের টাকা?

তোমার বাড়িতে এতদিন থাকলাম, খেলাম–এ-সবে টাকা লাগে।

একগাল হাসল তাজা। তা ঠিক। বেশ, হপ্তায় পনেরো পাউণ্ড চার্জ করলাম। আমি–এদিকে ফার্ম লেবাররা ওই পনেরো পাউণ্ডই মজুরি পায়, তারমানে কাটাকাটি হয়ে গেল। কথা শেষ করে বার কাউন্টারের দিকে চলে গেল সে। অসহায়ভাবে কাধ ঝাঁকাল রানা।

রাত বারোটার আগেই নিডো আর অনোরিয়াকে নিয়ে চলে গেল তাজা। ল্যাণ্ড রোভারটা ভায়োলা আর রানার জন্যে থাকল। বিদায় সম্বর্ধনা শেষ হতে দুটো বাজল। সবার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিল রানা, আবার একবার করে সবাইকে কথা দিতে হল, সাহায্য দরকার হলে প্রথমে গোজোর বন্ধু-বান্ধবদের স্মরণ করবে ও। সবশেষে ভায়োলা ওর হাত ধরল, টেনে বের করে আনল বার। থেকে। পিছন দিক থেকে কে যেন বলল, জোড়া কিন্তু দারুণ মানিয়েছে, তাই না?

পাহাড়ী পথ ধরে ধীরে ধীরে উঠছে ল্যাণ্ড রোভার, ভায়োলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে রানা। প্রচুর বিয়ার খেয়েছে ও, কিন্তু নেশা হয়নি। ভায়োলা খুব বেশি খায়নি, কিন্তু বারে থাকতেই তার চোখে ঢুলু ঢুলু একটা ভাব লক্ষ করেছে ও। গভীর রাত, চারদিকে নির্জন বন-জঙ্গল, আর নিস্তব্ধ পাহাড়। শুধু কৌতূহল নয়, সেই সাথে পুলক অনুভব করল রানা। ভাবল, কি ব্যাপার, এভাবে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন ভায়োলা?

আর ভায়োলা ভাবছে, দিন তো বেশ কটা কাটল, এখনও আমার মন বুঝতে পারেনি ও? অনেক বছর পর একজন পুরুষ আমাকে মুগ্ধ করেছে, কিন্তু সে কি সত্যি নির্লোভ দেবতা? নাকি ভালবাসতে জানে না, শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে? এত কাছাকাছি থাকি, কিন্তু স্পর্শটুকুও পাই না–একি ওর ভদ্রতা, নাকি অনীহা? কিন্তু আমি তো অসুন্দরী নই! আমাকে পাবার জন্যে কত লোকই তো পাগল। তবে কি অহঙ্কারী ও? আশা করছে, প্রথম নিবেদন আমার তরফ থেকে আসুক?

পাহাড়ের মাথায় উঠে এল ল্যাণ্ড রোভার। ভায়োলার দৃষ্টি এখনও অনুভব করছে রানা। ভাবছে, ও কিছু বলে না কেন? কি করে বুঝব আমি ওকে কাছে টানলে ফোঁস করে উঠে ফণা তুলবে না? ওদের পরিবারের সবাই খুব সরল, আমার সাথে ওর এই ঘনিষ্ঠতা হয়ত সেই সরলতারই প্রকাশ, এর মধ্যে হয়ত আর কিছু নেই। হাত বাড়াতে দেখলে যদি চরিত্রহীন বলে গাল দিয়ে বসে?

পাহাড়ের মাথা থেকে নিচে নেমে এল ল্যাণ্ড রোভার। ডান পাশে সাগর, খানিকটা দূরে, পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। দুজনই ওরা আড়ষ্ট, ঘামছে একটু একটু, ঢোক গিলছে।

এভাবেই হয়ত বাড়ি ফিরত ওরা, বুকভরা বঞ্চনা আর অতৃপ্তি নিয়ে। কিন্তু ওদেরকে সাহায্য করল একটা জানোয়ার।

রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির সামনে পড়ে গেল একটা শিয়াল। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করল রানা। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল শিয়ালটা, তারপর ঘুরে যেদিক। থেকে এসেছিল সেদিকেই ছুটে পালাল। ঝাঁকি খেয়ে রানার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ভায়োলা। গিয়ার পাল্টে আবার গাড়ি ছাড়তে গিয়ে অনুভব করল ও, ভায়োলার দুই হাত ওকে ছেড়ে না দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। হাত দুটো স্টিয়ারিং হুইল থেকে নামিয়ে নিল রানা।

এঞ্জিন বন্ধ হল। খুলে গেল মনের দুয়ার।

রানার কাঁধের ওপর মাথা রাখল ভায়োলা, ভায়োলার পিঠের ওপর ভাঁজ করা কনুই আর কাঁধের ওপর হাত রাখল রানা। কিছুক্ষণ কেউ নড়ল না। তারপর কাঁধে। রানার হাতের চাপ অনুভব করল ভায়োলা। রানার কাঁধ থেকে মুখ তুলল সে, ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে আছে। তাকে বুকে টেনে নিল রানা, দুই জোড়া ব্যাকুল ঠোঁট এক হল।

প্রথমে দীর্ঘ একটা চুমো–প্রচণ্ড তৃষ্ণায় এক ফোঁটা বৃষ্টির মত। তারপর মুষলধারে শুরু হল, উন্মত্ত আবেগে দুজনেই দিশেহারা।

তারপর এক সময় থামল ওরা। একবার যখন জ্বলেছে, এ আগুন নেভাতেও হবে।

শুনতে পাচ্ছ? ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল ভায়োলা।

কিসের কথা বলছে ভায়োলা বুঝতে না পারলেও, আন্দাজ করতে পারল রানা, অস্ফুটে বলল, হ্যাঁ। সাগর আমাদের ডাকছে। কিন্তু সাথে যে সুইমস্যুট নেই?

দরকার কি। বলেই রানার বুকে মুখ লুকাল ভায়োলা।

কেউ দেখলে চোখ কপালে উঠত তার, জড়াজড়ি করে গাড়ি থেকে নামার সময় কিম্ভূত আকৃতির দুমুখো একটা প্রাণী মনে হল ওদেরকে, যেন প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল একটা।

খুদে ইনলেটে চলে এল ওরা। পানির ওপর ঝুলে থাকা পাথরে দাঁড়িয়ে থাকল, দুটো শরীর পরস্পরের সাথে সেঁটে আছে। ডাইভ দিল না, ঢালু পাথরের ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে দুজন একসাথে ঝুপ করে পড়ল সাগরে।

পাহাড়ের এক কোণ থেকে সবই দেখল চাঁদ মামা। কানের পাশে ফিস ফিস করে সায় দিল ফুরফুরে বাতাস। গম্ভীর, ভরাট আওয়াজ তুলে একের পর এক ছুটে এল ঢেউগুলো, পিঠে তুলে নিল প্রকৃতির দুই নগ্ন সন্তানকে।

সাগর থেকে উঠে পাথরের ওপর পাশাপাশি শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে। পেতে একটু সময় নিল দুজনেই। সাগর থেকে উঠে সমতল পাথরের ওপর শুয়ে থাকল ওরা। দম ফিরে পেয়ে প্রথমে কথা বলল ভায়োলা।

অনেক কথা বলতে চাই, কিন্তু কিভাবে বলতে হয় জানি না।

আমি তোমাকে ভালবাসি, এভাবে শুরু করতে পার, মুচকি হেসে উৎসাহ দিল রানা।

কিন্তু হাসল না ভায়োলা, তবে সিরিয়াস দেখাল। একবার ঠকেছি, আর নয়–নিজেকে কারও সাথে বাধব না, কাউকে বিয়ে করব না, এভাবে যদি শুরু করি?

তাহলে জিজ্ঞেস করব, কাছে এলে কেন, কেন টানলে?

ভাল লেগেছে, তাই, ভায়োলার সরল জবাব। যতদিন তোমাকে ভাল লাগবে, আমি তোমার। কাছে গেলে যদি বুকে টেনে নাও, খুশি হব, কৃতজ্ঞবোধ করব। যদি ফিরিয়ে দাও, আহত হব, কিন্তু অভিশাপ দেব না ভালবাসার দাবি নিয়ে তোমাকে দখল করতে চাই না।

কিন্তু জীবন? ভবিষ্যৎ?

সে তো তোমাকে দেখার আগেই একটা ছকে ফেলে সাজিয়ে রেখেছি, বলল ভায়োলা। বিয়ে নয়, বাঁধন নয়, মুক্ত-স্বাধীন জীবন। আর ভবিষ্যৎ? হ্যাঁ, ভবিষ্যৎও ঠিক করা আছে, তবে তোমাকে দেখার পর একটু বদলাবে। আগের প্যানে কারও জন্যে অপেক্ষা ছিল না, এখন থাকবে। জানি, চলে যাবে তুমি। আর হয়ত কোন দিন দেখা হবে না। কিন্তু তবু আমি অপেক্ষা করব। যদি কখনও ফের, নিজেকে নিবেদন করে ধন্য হব। আর যদি না ফের, চলতে থাকবে অপেক্ষার পালা, শেষ হবে. সেই যেদিন মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে যাবে আমাকে।

কাছের ঝোপটা হঠাৎ নড়ে উঠতে দুজনেই ওরা চমকে উঠে তাকাল। সেই। ধাড়ী শিয়ালটা ঝোঁপের আড়াল থেকে মুখ বের করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

দেখছ, কি রকম বিরক্ত হয়েছে ব্যাটা?

কেন, বিরক্ত হবে কেন? চোখ বড় বড় করল ভায়োলা।

ওদের মধ্যে বোধহয় এত দেরি করার রীতি নেই, হাসি চেপে বলল রানা। আমরা শুধু কথা বলে সময় নষ্ট করছি, আসল কাজের নামও নিচ্ছি না, বিরক্ত হবে না তো কি!

হাত মুঠো করে কিল তুলল ভায়োলা, ঝট করে ভায়োলারই বুকের ভেতর মুখ লুকাল রানা। কিলটা পড়ল রানার চওড়া, ভিজে পিঠে। ভায়োলার বুকের ভেতর আরও একটু সেঁধিয়ে গেল রানার নাক-মুখ।

হুক্কা-হুয়া করে একটা ডাক ছাড়ল শিয়ালটা, তারপর ঝোপ টপকে ছুটল। বোধহয় সঙ্গিনীর খোঁজে।

রানা আর ভায়োলা তখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।

.

কি যেন জিজ্ঞেস করল ভায়োলা, অন্যমনস্ক ছিল বলে শুনতে পায়নি রানা। চাঁদের আলোয় ওদের নগ্ন শরীর ঘামে চকচক করছে। রানার পাশেই ভাঁজ করা হাঁটুর উপর চিবুক ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা। শান্ত, মৃদু কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল রানা।

বলল কোথায় যাচ্ছে ও, কেন যাচ্ছে। নেপলসে যখন এল তখন ওর মানসিক আর শারীরিক অবস্থা কি ছিল। রেমারিক আর রিসো কিভাবে ওকে যোগাড় করে দিল কাজটা। প্রথম দিকে লুবনার সঙ্গে কি রকম কঠোর ব্যবহার করেছিল ও, কিন্তু। ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে ধীরে ধীরে তার মন জয় করে নেয়।

এসব কথা ভায়োলাকে কেন বলছে রানা, ও নিজেও বোধহয় ভাল করে জানে না। কারণ হয়ত ভায়োলার নিঃস্বার্থ আত্মনিবেদন, কিংবা হয়ত রাতের নির্জন। পরিবেশটাই এমন যে বিদায় লগ্নে মনের সমস্ত ভার লাঘব করার একটা অবকাশ তৈরি করে দিয়েছে।

লুবনাকে নিয়ে পিকনিকে যাবার ঘটনাটাও বলল রানা। সেদিন লুবনা ওকে ছোট্ট একটা কোরান শরিফ উপহার দিয়েছিল। ওর নির্বাচিত শব্দগুলো জ্যান্ত করে, তুলল লুবনাকে, চোখের সামনে মেয়েটাকে পরিষ্কার যেন দেখতে পেল ভায়োলা। চঞ্চল, কৌতূহলী, কথায় কথায় ঠোঁট ফোলায়, আবার অকারণ আনন্দে খিল খিল করে হেসে ওঠে।

তারপর, শেষ দিনটা। কিডন্যাপাররা লুবনার পথরোধ করে দাঁড়াল। গুলি খেয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে রানা, চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকল লুবনা সেই হাহাকার ধ্বনি আজও পরিষ্কার শুনতে পায় রানা। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালে, জানে না বাচবে কিনা, কিন্তু বাঁচার প্রচণ্ড একটা আকুতি রয়েছে। এরপর রেমারিক এসে জানাল, লুবনা নেই। জানাল, কিভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।

আর বলল সেই গানের কথা; যে গান ওকে ঘুমাতে দেয় না।

ভাঁজ করা হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে ভায়োলা, তার লম্বা কালো চুলে। ঢাকা পড়ে আছে মুখ। অনেকক্ষণ হল চুপ করে গেছে রানা। পাথরের গায়ে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে পড়ার আওয়াজ, মনে হল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে প্রকৃতি। মুখ তুলল ভায়োলা, চাঁদের ম্লান আলোয় তার চোখে পানি চিকচিক করতে দেখল রানা। দাতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাবার। চেষ্টা করল ভায়োলা, রুদ্ধস্বরে বলল, মার, রানা! ওদের তুমি খুন কর! এমন, প্রতিশোধ নাও, মানুষ যেন শিউরে ওঠে!

ভাঁজ করা হাঁটুতে আবার মুখ ঢাকল ভায়োলা, তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠল। লুবনার জন্যে কাঁদছে সে। উঠে বসেছে রানা, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে, নির্বাক।

এক সময় শান্ত হল ভায়োলা। চোখ মুছে জিজ্ঞেস করল, যে-কাজে তুমি যাচ্ছ, ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু?

জানি না, অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল রানা। খুব কম, নেই বললেই চলে।

কিন্তু ফিরে তোমাকে আসতেই হবে…।

ভায়োলার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল রানা। দেখল, ভায়োলার ঠোঁটের কোণে একটু ক্ষীণ হাসি লেগে রয়েছে।

ফিরে আসতে হবে, তোমার কাছে?

হ্যাঁ, হাসিটা আরও একটু বড় হল ভায়োলার মুখে। আমার কাছে। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।

হেসে ফেলল রানা। চেষ্টার কোন ক্রটি করব না, কথা দিলাম।

যতদিন তুমি না ফের, রোজ সকালে চার্চে যাব আমি, অস্ফুটে বলল ভায়োলা। তোমার জন্যে প্রার্থনা করব।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত