অগ্নিপুরুষ: ১.৯-১০ পিয়ানো শিখতে যাবার দিন

অগ্নিপুরুষ: ১.৯-১০ পিয়ানো শিখতে যাবার দিন

১.৯-১০ পিয়ানো শিখতে যাবার দিন

০৯.

লুবনার আজ পিয়ানো শিখতে যাবার দিন।

ছেলেমেয়েদের গান-বাজনা শেখানো মিলানে একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামকরা একজন বাদকের সাথে আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছে, তাঁর বাড়িতে লুবনাকে নিয়ে যাচ্ছে রানা। শেখার আগ্রহ আর ক্ষীণতম হলেও প্রতিভার আভাস দেখতে পেলে তবেই লুবনাকে তিনি নিয়মিত শেখাবেন। তখন একটা পিয়ানো। কেনা হবে, আর ভদ্রলোক নিজেই হপ্তায় তিনদিন এসে শিখিয়ে যাবেন।

ইতিমধ্যে রানার মদ্যপান প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। রোজ সকালে। নিয়মিত এক্সারসাইজ শুরু করেছে ও। কোমোয় ছোটখাট একটা জিমনেশিয়ামও পাওয়া গেছে, দুএক দিনের মধ্যে সেখানে নাম লেখাবে।

নিউইয়র্ক থেকে ভিটো আর লরা ফিরে এসেছে, কিন্তু লরা খুব সাবধানে আছে। যাতে রানার সামনে তাকে পড়তে না হয়। ফেরার পরপরই স্বামীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একটা আলোচনা হয়ে গেছে তার। আজ চার দিন পর প্রসঙ্গটা আবার তুলল সে। ভিটো বলল, কিন্তু তোমার এই জেদের আমি কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না, লরা। এতদিন যা বলে এসেছ, এখন ঠিক তার উল্টো কথা বলছ।

কারণ ঘটেছে বলেই বলছি, শান্ত কিন্তু দৃঢ় সুরে বলল লরা। এই লোককে এ বাড়িতে আমি রাখব না। এই আমার শেষ কথা। যত তাড়াতাড়ি পার বিদায় কর ওকে।

কিন্তু…

তোমাকে তো বলেছি, লোকটার দিকে বড় বেশি ঝুঁকে পড়ছে লুবনা। আমি চাই না…

এর মধ্যে নোংরা কিছু দেখতে পেয়েছ তুমি?

মাথা নাড়ল লরা। সেরকম কিছু না। চরিত্রহীন বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। কিন্তু ও তো শুধু একজন বডিগার্ড, তাই না? লুবনা যদি বেশি মাখামাখি করে, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগবে। লাগবে কি, লাগছে। হাসান বলতে ও অজ্ঞান। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, তোমার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ওই লোক। এ আমি হতে দিতে পারি না। তুমি আজই ওকে বিদায় কর।

পাগল হলে?

কেন, অসুবিধে কি?

তিন মাসের কথা বলে রাখা হয়েছে ওকে, বলল ভিটো। হঠাৎ জবাব দিয়ে। দিলে ইউনিয়ন যদি..

ও জোর করে থাকতে চাইবে বলে মনে হয় না, বলল লরা।

তাই বলে আজই? মাথা নাড়ল ভিটো। তা হয় না, লরা।

ঠিক আছে, এই হার ভেতর, বলল লরা। তার বেশি একদিনও ওকে আমি রাখব না।

বেচারা খুব আঘাত পাবে, অস্ফুটে বলল ভিটো।

ছেলেমানুষ, সামলে নেবে, বলল লরা।

আমি লুবনার কথা ভাবছি না, বলল ভিটো।

.

ভিটো আর লরার মধ্যে কি কথা হয়েছে ওরা জানে না। রোববারটা কিভাবে কাটাবে, তাই নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। জুলিয়ানা জেদ ধরেছে, কাজেই রোববারে। আবার রানাকে ওদের বাড়িতে লাঞ্চ খেতে যেতে হবে। শুনে লুবনাও আবদার। ধরল, সে-ও যাবে।

মাথা নাড়ল রানা। তোমার মা-বাবা বাড়িতে ফিরেছেন, ছুটির দিনটা তোমার ওদের সাথে কাটানো উচিত।

কিন্তু জুলিয়ানা তো আমাকেও যেতে বলেছে, বলল লুবনা। বাচ্চা দুটো আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।

কিন্তু রাজি হল না রানা। সুযোগ তো আরও আসবে। ওর মা-বাবা কদিন পরই তো আবার বাইরে যাচ্ছে।

ভদ্রলোকের অ্যাপার্টমেন্ট সহজে খুঁজে পাওয়া গেল না। একটা ম্যাপ বের করল লুবনা, সে-ই গাইড করে কোরসো বুয়েনস এয়ার্স এভিনিউয়ে নিয়ে এল। রানাকে চওড়া একটা রাস্তা, রাস্তার দুপাশে সার সার গাছ, তারপর প্রশস্ত লন। বাড়িগুলো রাস্তা থেকে বেশ অনেক দূরে। পার্কিং লেখা সাইনবোর্ড দেখে রাস্তার এক ধারে গাড়ি থামাল রানা। লুবনাকে নিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে অ্যাপার্টমেন্টের দরজার দিকে এগোল। দরজায় সিকিউরিটি লক আর ইন্টারকম রয়েছে, ইন্টারকমে লুবনার উপস্থিতি ঘোষণা করতেই ভেতর থেকে খুলে গেল দরজা।

বেশি দেরি হবে না, হাসান, স্রেফ এক ঘন্টা।

মৃদু হাসল রানা। একেবারে যা-তা বাজিয়ো। জানে, শেখার কোন আগ্রহ নেই লুবনার। ওর বাবার চাপে পড়ে রাজি হতে হয়েছে ওকে। অ্যাপয়েন্টমেন্টটা নাকি ওদের পারিবারিক বন্ধু আল বারগো লোরানের করা।

তা আর বলতে! চাপা হাসি দেখা গেল লুবনার ঠোঁটে।

গাড়িতে ফিরে এসে খবরের কাগজ নিয়ে বসল রানা। ওপরতলা থেকে একটা জানালা খোলার অস্পষ্ট আওয়াজ এল কানে।

এক ঘন্টা পেরিয়ে গেল। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যেতে মুখ তুলে তাকাল রানা। একটা হাত তুলে নাড়ল লুবনা, লনের ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। এখনও সে চল্লিশ মিটার দূরে, রানার পিছনে মোড় ঘুরে একটা কালো গাড়ি এগিয়ে এল। রাস্তা ছেড়ে এক জোড়া গাছের মাঝখানে ঢুকে পড়ল। গাড়িটা, লনের ওপর দিয়ে এগোল। চারজন লোককে দেখল রানা, সাথে সাথে বুঝে নিল কি ঘটতে যাচ্ছে। দ্রুত গাড়ি থেকে নামল ও, পিস্তলটা আগেই বেরিযৈ এসেছে হাতে। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে লুবনা।

দৌড়াও, লুবনা, দৌড়াও! চিৎকার করল রানা।

ঘ্যাঁচ করে লুবনার সামনে থামল কালো গাড়ি, রানার দিকে তার আসার পথ আটকে দিয়েছে। পিছনের দরজা খুলে গেল, লাফ দিয়ে নামল দুজন লোক। কিন্তু লুবনার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। বাড়িয়ে দেয়া এক জোড়া হাতের তলা দিয়ে। স্যাঁৎ করে বেরিয়ে এল সে, গাড়ির পিছন দিকটা ঘুরে ত্রস্ত হরিণীর মত ছুটল তার। বডিগার্ডের দিকে। লোক দুজন ধাওয়া করল তাকে, দুজনের হাতেই রিভলভার রয়েছে। দুবার লক্ষ্যস্থির করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল রানা, ওদের মাঝখানে লুবনা রয়েছে। একজন লোক ধরে ফেলল লুবনাকে, এক হাত দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে। ধরে তুলে ফেলল শূন্যে, ঘুরে গাড়ির দিকে ছুটল। অপর লোকটা রানার দিকে। ফিরে আছে, একটা গুলি করল সে। মাথার অনেক ওপর দিয়ে ছুটে গেল বুলেট। তার বুকে গুলি করল রানা, দুবার।

প্রথম লোকটা লুবনাকে গায়ের জোরে পিছনের সিটে তোলার চেষ্টা করছে, কিন্তু হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে লুবনা। গাড়ির ভেতর তাকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হল, ইতিমধ্যে অনেকটা কাছে চলে এসেছে রানা। লুবনাকে গাড়ির ভেতর ফেলে দিয়েই ঘুরল লোকটা, হাতের রিভলভার রানার দিকে তাক করা। একটু ওপর দিকে লক্ষ্য করে গুলি করল রানা, ভয় যদি ছিটকে গিয়ে লুবনাকে আঘাত করে বুলেট। লোকটার নাকের নিচে লাগল বুলেট, মগজের ভেতর দিয়ে খুলি ফুটো করে বেরিয়ে গেল। দরজায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল লোকটা, বন্ধ হয়ে গেল দরজা। পরমুহূর্তে গাড়ির সামনের সিট থেকে পরপর তিনটে গুলি হল, দড়াম করে ঘাসের ওপর আছড়ে পড়ল রানা। ইঞ্জিন গর্জে উঠল। চাকা ঘুরল। লন। থেকে রাস্তায় উঠে পড়ল কালো, গাড়ি। গাড়ির ভেতর থেকে ওর নাম ধরে চিৎকার। করে উঠল লুবনা।

নড়তে পারছে না, বুলেটের ধাক্কা খেয়ে রানার নার্ভাস সিস্টেম থমকে গেছে। ব্যথা আর উদ্বেগ নিয়ে শুধু একটাই প্রার্থনা করল, যেন মরে না যায়। মনের সবটুকু। শক্তি এক হল, প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোয়ার বয়ে গেল সমগ্র অস্তিত্বে-বাচতে হবে, আমাকে বাচতে হবে। লুবনার ডাক ও শুনতে পেয়েছে। সাহায্য চেয়ে কোন আবেদন নয়–লুবনা তাকে পড়ে যেতে দেখেছে–ওর কণ্ঠে ছিল ব্যাকুল হাহাকার।

.

১০.

বিছানার পাশে একজন নার্স বসে বই পড়ছে। প্রচুর কড়া ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে রানাকে, জেগে আছে কিনা বোঝা যায় না। ওর মাথার ওপর একটা মেটাল ফ্রেমে উল্টো করা দুটো বোতল ঝলছে। নিয়মিত ছন্দে ফোঁটা ফোঁটা রঙহীন তরল পদার্থ পড়ছে ট্র্যান্সপারেন্ট টিউবে। টিউবের একটা ওর বাঁ নাকে ঢুকেছে, অপরটা ডান কব্জির ব্যাণ্ডেজের ভেতরে।

দরজা খুলে এক পা ভেতরে এল ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিস অফিসার। নার্সের সঙ্গে কথা বলল সে। একজন ভিজিটার। ডাক্তার বললেন, এক মিনিটের বেশি নয়।

ঘরে ঢুকল রেমারিক, ধীর পায়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল, ঝুঁকে তাকাল রানার দিকে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, হাসান?

বোঝা যায় কি যায় না, মাথা একটু যেন নড়ল।

বিপদ কেটে গেছে। তুমি বাঁচবে।

এবারও মাথা যেন একটু নড়ল।

আমি মিলানে থাকব। পরে আসব, তখন কথা হবে। নার্সের দিকে ফিরল রেমারিক। ওর কাছে আপনি থাকবেন?

আমি বা আর কেউ, উনি একা থাকবেন না।

নার্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল রেমারিক।

করিডরে অপেক্ষা করছিল রিসো আর জুলিয়ানা।

ও জেগে আছে, কিন্তু কথা বলতে আরও দুএকদিন সময় লাগবে। চল, ফেরা। যাক। আমি আবার কাল আসব।

ডাক্তার ওদেরকে জানিয়েছে, রানাকে প্রায় মরা অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল হাসপাতালে। সাথে সাথে অপারেশন করা হয়, সেলাই করে বন্ধ করা হয় রক্তক্ষরণ। ওটা ছিল ইন্টারিম ইমার্জেন্সি সার্জারি। পোস্ট অপারেটিভ শক যদি কাটিয়ে উঠতে পারে রানা, ওর শক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে তারা, তারপর আবার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে, তখনকার অপারেশনগুলো হবে জটিল আর বিপজ্জনক।

অর্থাৎ ওকে নিয়ে যমে মানুষে লড়াই এখন চলতেই থাকবে।

.

আরও দুটো দিন বার বার মৃত্যুর কিনারায় গিয়েও ফিরে এল রানা। ডাক্তার বিস্ময় প্রকাশ করে রেমারিককে বলল, এ স্রেফ বেঁচে থাকার প্রচণ্ড আকুতি। এরকম জখম নিয়ে কোন মানুষ বাঁচতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

পরদিন কথা বলতে পারল রানা।

রেমারিককে প্রথম কথা জিজ্ঞেস করল, লুবনা?

আলাপ-আলোচনা চলছে, উত্তর দিল রেমারিক। এ-ধরনের ব্যাপারে সময় লাগে।

আমার অবস্থা?

সাবধানে, ভেবেচিন্তে উত্তর দিল রেমারিক। এ ব্যাপারে ওরা দুজনেই অভিজ্ঞ। গুলি খেয়েছ দুটো। তলপেট আর ডান ফুসফুঁসে। ভাগ্য ভাল যে বত্রিশ, ক্যালিবারের বুলেট ছিল। ভারি কিছু হলে আর বাঁচতে হত না। ফুসফুঁসে অপারেশন ওরা সেরে ফেলেছে, ওটা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। সমস্যা তলপেটের জখমটা নিয়ে। ওখানে আবার অপারেশন করতে হবে, তবে ডাক্তাররা বলছে। ভয়ের কিছুই নেই। এখানে এরা সবাই অভিজ্ঞ, গুলি খাওয়া অনেক রুগীর। চিকিৎসা করেছে।

গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল রানা। তারপর জানতে চাইল, আমি যে দুজনকে গুলি করলাম?

মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। একজনের হার্ট ফুটো করেছ। দুটো গুলি, কিন্তু ফুটো ওই একটাই। আরেকজনের মগজ বেরিয়ে গেছে। চমৎকার শুটিং।

মাথা নাড়ল রানা। দেরি হয়ে গেছে আমার…অনেক দেরি করে ফেলেছি।

ওরা প্রফেশন্যাল ছিল, হাসান।

জানি। কিন্তু তেমন একটা বাধা পাবে বলে আশাও করেনি। প্রথমে ওরা। ফাঁকা গুলি করে, ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চেয়েছিল। আমি যদি আরেকটু তাড়াতাড়ি করতাম ওদের সব কটা মরত। ব্যাপারটাকে খুব হালকাভাবে নিয়েছিল ওরা।

ক্লান্ত হয়ে পড়ছে রানা, ফেরার জন্যে উঠল রেমারিক। কোমোয় গিয়ে। ভিটোর সাথে দেখা করব আমি। দেখব আমার যদি কিছু করার থাকে। কালো। মখমলে মোড়া ছোট্ট একটা বাক্স চোখে পড়ল তার। ঝুঁকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করল।

কোরান শরীফের ইংরেজি অনুবাদ, বলল রানা। পরে তোমাকে বলব সব।

কোমোয় গিয়ে হতাশই হল রেমারিক। সাথে রিসোকেও নিয়েছিল ও। ভিটো। আভান্তি আর তার স্ত্রী লরা আভান্তি বাড়িতেই ছিল। কিন্তু দুজনেই বোবা হয়ে গেছে। দেখে মনে হল গোটা ব্যাপারটা সামলাচ্ছে আলবারগো লোরান। সে তার স্ত্রীকে নিয়ে ভিটোদের বাড়িতেই রয়েছে। দুএকটা কথা হল লোরানের সাথে। তেমন কোন তথ্য লোকটা ওদেরকে দিতে চাইল না। ফিরে আসছে ওরা, এই সময় বিস্ফোরিত হল লরা। আগে সব কথা জানত না সে, কিন্তু এখন সব ফাঁস হয়ে গেছে। স্রেফ তার মুখ রক্ষার জন্যে রাখা হয়েছিল হাসানকে, শুধু তাকে প্রবোধ দেয়ার জন্যে।

বদ্ধ একটা মাতাল! রেমারিকের সামনে দাঁড়িয়ে উন্মাদিনীর মত চেঁচাতে থাকল লরা। আমার মেয়ের জন্যে একটা নেশাখোরকে রাস্তা থেকে ধরে আনা হয়েছিল। স্বামীর দিকে ফিরল সে। তুমি একটা অপদার্থ, একটা আহাম্মক! আমার মেয়ের যদি কিছু হয়…

প্রতিবাদ করতে গেল রিসো, কিন্তু রেমারিক তাকে থামাল। রানার জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। মেয়ে ফিরে এলেই শান্ত হবেন মহিলা, মন্তব্য করল রেমারিক।

ঘটনাটা রানাকে জানায়নি রেমারিক। এক হপ্তা পর ডাক্তাররা আবার অপারেশন করল। রানা ওদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। বাঁচার কোনই আশা নেই, কিন্তু রোগীর প্রচণ্ড জেদ সে মরবে না, জান-জীবন দিয়ে লড়ল তারা। অপারেশনের পর আটচল্লিশ ঘন্টা ভাল-মন্দ কিছুই বোঝা গেল না, তারপর হাসি ফুটল তাদের মুখে। বিপদ কেটে যাচ্ছে।

.

ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসল রেমারিক। রানাকে আগের চেয়ে ভাল দেখাচ্ছে, রঙ ফিরে আসছে মুখে। রেমারিকের চেহারায় উদ্বেগ লক্ষ্য করে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল ও।

মেয়েটা মারা গেছে, হাসান।

মুখ ফিরিয়ে সিলিঙের দিকে তাকাল রানা, চেহারায় নির্লিপ্ত ভাব, চোখে ভাষাহীন বোবা দৃষ্টি।

একটু ইতস্তত করল রেমারিক, তারপর বলে চলল, ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়। ওদের টাকার দাবি দুদিন আগে মেটানো হয়েছে। কথা ছিল সেই রাতেই লুবনাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু সে ফেরেনি, পরদিন সকালে পুলিস একটা চুরি করা। গাড়িতে তার লাশ দেখতে পায়।

একটু থেমে আবার শুরু করল রেমারিক, রেড ব্রিগেডের একটা গ্যাংকে খুঁজে বের করার জন্যে শহরে ব্যাপক তল্লাশি চলছিল। ধারণা করা হচ্ছে, কিডন্যাপররা খুব নার্ভাস হয়ে পড়ে, ঘন্টা কয়েকের জন্যে আণ্ডার গ্রাউণ্ডে চলে যায় তারা। লুবনার হাত আর মুখ বাধা ছিল, এই অবস্থায় বমি করে সে–সম্ভবত পেট্রলের গন্ধে। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে কি ঘটতে পারে তুমি জান। পোস্ট মর্টেম হয়েছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছে সে।

ফিসফিস করে কথা বলছিল রেমারিক, সে থামতে ঘরের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এল।

অনেকক্ষণ পর রানা জানতে চাইল, আর কিছু?

উঠে পড়ল রেমারিক। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিচে রাস্তা, লোকজন আর যানবাহনের ভিড়। তার পিছনে সপাং করে যেন চাবুক পড়ল।

বল!

ঘুরে দাঁড়াল রেমারিক, নিচু গলায় বলল, ওকে রেপ করা হয়েছে। অনেক বার। ওর কাঁধে আর হাতেও দাগ দেখা গেছে।

আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল। দূরে কোথাও চার্চে ঘন্টা বাজছে, অস্পষ্ট শোনা যায়। এগিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়াল রেমারিক, রানার দিকে ঝুঁকল। রানার মুখে এখনও কোন ভাব নেই। দৃষ্টি এখনও সিলিঙের দিকে, কিন্তু এখন আর ভাষাহীন নয়–ঘৃণায় জ্বলজ্বল করছে যেন দুটুকরো হীরে।

.

ধকলটা সামলে উঠতে সময় লাগল, কিন্তু সেরে ওঠার গতি অটুট থাকল, ওঠা নামা করল না। এ-ধরনের রোগীকে ডাক্তারদের খুব পছন্দ, সব কথা মন দিয়ে। শোনে আর প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলে। দ্বিতীয় অপারেশনের এক হপ্তা পর বিছানা থেকে হুইলচেয়ারে নামতে পারল রানা। আর কদিন পর হাটাহাটি শুরু করে দিল।

নিজের ওপর জোর খাটাল না। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, তার শরীরকে সময়। দিতে হবে। রোজ বাগানে হাঁটল, ও, সাথে একজন নার্স থাকল। উদোম গা, ব্যাণ্ডেজগুলোর মাঝখানে পিঠ গরম করে তুলল রোদ। নার্স আর ডাক্তার, সবার সাথে ওর মধুর সম্পর্ক। দরকার না হলে কাউকে বিরক্ত করে না। আর মৃত্যুর। কিনারা থেকে ওকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে এনেছে বলে তারাও সবাই ওকে নিয়ে গর্বিত।

একজন নার্সকে কিছু টাকা দিল রানা, খুশি মনে অনেকগুলো খবরের কাগজ কিনে এনে দিল সে। লুবনা কিডন্যাপ হবার দিন থেকে যে কটা কাগজ বেরিয়েছে, সবগুলো। তারপর আরও অনেক মাস পিছনের কাগজও তাকে দিয়ে কেনাল রানা। নোটবুকটা আগেই কেনা হয়েছে। রোজই পড়ে রানা, আর দরকারি খবরগুলো নোটবুকে টুকে রাখে।

এক সন্ধেবেলা ওকে দেখতে এলেন এক ভদ্রমহিলা। তাকে দেখে অবাক হয়ে। গেল রানা। হাতে একটা ঝুড়ি ভর্তি ফল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন লুবনার স্কুলের হেডমিসট্রেস, সিনোরা মিরিয়াম। আধ ঘন্টা থাকলেন তিনি, লুবনাকে নিয়ে কথা বললেন, চোখের পানি ফেললেন দুফোঁটা। রানা হঠাৎ খেয়াল করল, সিনোরাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে সে। যাবার আগে সিনোরা বললেন, যে যাই বলুক, আপনি কিছু মনে করবেন না। তিনি শুনেছেন, লোকে বলাবলি করছে, লুবনার বডিগার্ড স্রেফ একটা লোক দেখানো ব্যাপার ছিল। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আপনি কি করবেন? কাঁধ ঝাঁকিয়ে রানা বলল, তার কোন প্ল্যান নেই। সিনোরা খুব অবাক হলেন। রানাকে নিরুদ্বিগ্ন আর হাসিখুশি দেখাল। এটা যেন তিনি আশা করেননি। সবশেষে রানার গালে চুমো খেয়ে বিদায় নিলেন তিনি।

রোজ একবার করে সাইকোথেরাপি রূমে যেতে হয় রানাকে। সুইমিং পুলের গরম পানিতে সাঁতার কাটে আধ ঘন্টা। অন্যান্য এক্সারসাইজও শুরু করল।

এক মাস পর ডাক্তাররা সবাই একবাক্যে বলল, রোগী এত তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে এটা তারা আশা করেনি। আর এক হপ্তা পর হাসাপতাল থেকে ছাড়া পাবে সে। এই শেষ হপ্তাটা বেশির ভাগ সময় সাইকোথেরাপি ডিপার্টমেন্টে কাটাল রানা, ব্যবহার করল ইকুইপমেন্টের পুরো সেট।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও, পুরোপুরি সেরে উঠতে আরও অনেক সময়। লাগবে ওর। এখনও ও দুর্বল। তবে শরীরে কোথাও আড়ষ্ট ভাব নেই, প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ যে যার ভূমিকায় কাজ করতে পারে।

বিদায়ের দিন ডাক্তার আর নার্সরা দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল ওকে। সবাই ওকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাল। ধন্যবাদ জানিয়ে ধাপ কটা টপকাল রানা। দরজায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকল ওরা, হাতে সুটকেস নিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে।

অদ্ভুত একটা মানুষ, মন্তব্য করল মেট্রন।

মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে সমর্থন করল হেড ফিজিশিয়ান। হাসপাতাল সম্পর্কে ওর প্রচুর অভিজ্ঞতা।

.

নেপলস সেন্ট্রাল স্টেশন। মিলান থেকে একটা ট্রেন এসে থামল। বিলাসবহুল স্লীপিং কার থেকে নামার আগে সুন্দরী স্টুয়ার্ডেসকে টিপস দিল রানা। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিল ও। ড্রাইভারকে বলল, প্রেজো ফিসো।

সকালের বাজার সেরে ফিরে এসেছে ফুরেলা, ভ্যান থেকে মালপত্তর নামাচ্ছে, এই সময় পৌঁছুল ট্যাক্সি। রানার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল সে। একগাল হেসে জানতে চাইল, কেমন আছেন?

ভাল। দেখি, সর, কয়েকটা ঝুড়ি আমাকেও বইতে দাও।

কিচেন টেবিলে বসে আছে রেমারিক, কফি খাচ্ছে, ভেতরে ঢুকল ওরা।

দোস্ত, বলে টেবিলের ওপর তিনটে ঝুড়ি নামিয়ে রাখল রানা।

নড়ল না রেমারিক। রানাকে সতর্ক চোখে দেখল সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আলিঙ্গন করল। দোস্ত!

আধ মিনিট পর পরস্পরকে ছাড়ল ওরা। রেমারিক কাঁদছে, কিন্তু চোখে পানি নেই। রানা হাসছে, কিন্তু চেহারায় তার কোন ছাপ নেই।

পট থেকে রানার জন্যে কফি ঢালল রেমারিক। আমি তো ভেবেছিলাম একটা ভূত ফিরে আসবে। নাহ, ওরা তোমার যত নিয়েছে।

ওরা সবাই খুব ভাল মেকানিক। দুজনেই হাসল, পুরানো দিনের পরিচিত সংলাপ।

আলোচনা শুরু হল ডিনারের পর, টেরেসে সামনাসামনি বসে।

ও কি করতে চায় শান্তভাবে ব্যাখ্যা করল রানা। বিবেক, নীতি, আদর্শ– এসব প্রসঙ্গে গেল না। প্রশ্ন বিচার নিয়েও নয়, এ স্রেফ নির্জলা প্রতিশোধ। ওরা তার হৃদয়ের একটা টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে গেছে, প্রতিশোধ নেবে ও।

চোখের বদলে চোখ? শান্ত সুরে জানতে চাইল রেমারিক।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ভারি গলায় বলল, তারচেয়েও বেশি, রেমারিক।

মেয়েটাকে সত্যি তুমি ভালবাসতে! ঠিক প্রশ্ন নয়, স্বগতোক্তির মত শোনাল কথাটা।

উত্তর দেয়ার আগে অনেকক্ষণ চিন্তা করল রানা। ভালবেসেছিলাম কিনা, কতটুকু ভালবেসেছিলাম, এ-সব কথা থাক, রেমারিক। শুধু জান, লুবনা মরেনি, নিজের বুকে আঙুল ঠেকাল রানা। এখানে লুকিয়ে আছে। আমাকে একটা গান দিয়ে গেছে ও। আমি ঘুমাতে পারি না।

রানার ব্যথা আর শোক উপলব্ধি করতে পারে রেমারিক। জেসমিন মারা যাবার পর তারও এই রকম হয়েছিল। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল তার। কোরান শরীফের ইংরেজি অনুবাদ ওটা…?

আমাকে দিয়েছিল ও। জন্মদিনের উপহার।

রানাকে কখনও ধর্ম নিয়ে কথা বলতে শোনেনি রেমারিক। ও নাস্তিক কিনা, তাও জানে না। লুবনা হয়ত জানতে পেরেছিল, তাই এই উপহার।

আমার সাহায্য দরকার, রেমারিক।

উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। এগিয়ে এসে বন্ধুর কাঁধে একটা হাত রাখল। রানাও উঠল। দুজনে এসে রেলিঙের সামনে দাঁড়াল ওরা।

পাবে, বলল রেমারিক। সাধ্যের বাইরে করব আমি। কিন্তু খুন নয়। ওটা। বাদ দিয়েছি। তুমি তো জান, জেসমিনকে কথা দেয়া আছে। ওটা ছাড়া যা তুমি বল।

জানি। ওটা তোমাকে করতে বলবও না। খুনগুলো আমিই করব, এ আমার ব্যাপার। কিন্তু আমাকে সাহায্য করলে তোমার বিপদ হতে পারে।

রেমারিক হাসল। তা হতে পারে। বিপদ আমার জীবনে নতুন কিছু নয়। ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল সে। কাজটা কার, জেনেছ?

মাথা ঝাঁকাল রানা। জানি। তখনই আমি ওদেরকে ভাল করে দেখেছিলাম। তারপর খবরের কাগজ ঘেঁটেছি। আমাকে যে গুলি করেছিল তার নাম এলি। ড্রাইভারের নাম অগাস্টিন। হিনো ফনটেলা-র লোক ওরা। গম্ভীর হাসি দেখা গেল ওর ঠোঁটে। নিজেদের খুব বুদ্ধিমান মনে করে। বলেছে, ঘটনার সময় ওরা তুরিনে ছিল। দশ-বারোজন সাক্ষী দিয়েছে।

তুমি ওদের নাম জানলে কিভাবে?

পুলিস আমাকে কয়েক শো ফটো দেখিয়েছিল, একবার চোখ বুলিয়েই ওদের আমি চিনতে পারি।

পুলিসকে তুমি জানাওনি?

মাথা নাড়ল রানা। জানালে কি হত ওদের, বল?

তা ঠিক, বলল রেমারিক। খুব বেশি হলে দুচার বছরের জেল হত। কিন্তু জেলের ভেতর রাজার হালে থাকত ওরা। তারপর পেরোলে ছাড়া পেয়ে যেত।

হ্যাঁ। কিন্তু এখন আর তা হবে না।

একটু ভাবল রেমারিক। বলল, তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। ওরা কেউ। পাল্টা কিছু আশা করছে না। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে কেটে পড়তে পারবে তুমি। ওরা সম্ভবত কেউ গভীর জলের মাছও নয়।

তুমি ঠিক বোঝনি, রেমারিক, শান্তভাবে বলল রানা।

অবাক দেখাল রেমারিককে। তাহলে কিভাবে?

প্ল্যানটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করল রানা।

হতভম্ব হয়ে গেল রেমারিক।

কাজেই বুঝতে পারছ তো, কেন তোমার সাহায্য দরকার আমার?

কিন্তু কিভাবে? কি বলছ তুমি জান?ঘাবড়ে গেছে রেমারিক। ওদের। সেটআপ সম্পর্কে ধারণা রাখ?

শান্তভাবে মাথা ঝাঁকাল রানা। ভালোই রাখি। হয়ত সুবটুকু নয়, কিন্তু কাঠামোটা কি জানি। মিলানে প্রধান বস দুজুন–ফনটেলা আর গামবেরি। এই কিডন্যাপ ফনটেলার কাজ। রোমে বসে আনি বেরলিংগার টাকার একটা ভাগ। পেয়েছে। আর সবশেষে পালার্মোর পেটমোটা শুয়োরটা–ডন বাকালা। বাকালা সব কিছু থেকে ভাগ পায়।

হঠাৎ কি হল, সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল রেমারিকের, উন্মাদের মত অদম্য হাসিতে ফেটে পড়ল। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকল রানা। এতক্ষণে ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছে রেমারিক, সেই সঙ্গে, যতই অসম্ভব। বলে মনে হোক, প্রস্তাবটা অনুমোদনও করছে সে।

হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা ধরে গেল রেমারিকের। এক সময় থামল সে। বলল, এতদিনে একটা কাজের কাজ হবে তাহলে। আমার হিংসা হচ্ছে, দোস্ত। এই একটা কাজেই তুমি অমর হয়ে যাবে।

অমর আমি হতে চাই না, বলল রানা। বেঁচে ফিরব সে আশাও কম। আমি শুধু প্রতিশোধ নিতে চাই, রেমারিক। বদলে যা-ই হারাই না কেন, দুঃখ করব না।

আবার হাসল রেমারিক, ছোট্ট করে। আতুনি বেরলিংগার, তাই না? বাছাধন, এবার? বাস্তবে ফিরল সে, রানার দিকে তাকাল। এত সব তুমি জানলে কিভাবে?

কিছু কিছু আগে থেকেই জানতাম, বলল রানা। পুরানো খবরের কাগজ থেকে কিছু জেনেছি। নিজেদের ক্ষমতা আর প্রভাবের ওপর ওদের এত বিশ্বাস যে। অপরাধ করে সেগুলো আবার ফলাও করে প্রচার করে। এরই নাম মাফিয়া। আরেক সরকার নামে একটা বইও পড়েছি, একজন জার্নালিস্টের লেখা। লোকটা যে এখনও বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্য।

বই ছাপা হয়ে গেছে, তাই মারেনি। বাইরের লোককে ওরা তখনই খুন করে যখন গোপন একটা তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার ভয় দেখা দেয়। বই বেরিয়ে যাওয়া মানে যা ফাস হবার হয়ে গেছে, কাজেই লোকটা ওদের হাতে মরবে না। রানার হাতে একটা সিগারেট গুঁজে দিল সে। তারপর লাইটার জ্বালল। এবার বল, ও আমাকে কি করতে হবে।

কফির জন্যে কিচেনে ফিরে এল ওরা। টেবিলে বসে বিশদ আলোচনা শুরু করল। গোটা ব্যাপারটা সতর্কতার সাথে একটা ছকে বেঁধে নিয়েছে রানা। নোটবুকে একটা নকশাও এঁকেছে। দেখেশুনে মাথা ঝাঁকাল রেমারিক, প্রভাবিত হয়েছে সে। পরিবহন, ঘটি, ইকুইপমেন্ট কি কি দরকার সব লিখল রানা। চেয়ারে হেলান দিল ও, কাপের কিনারা দিয়ে তাকাল বন্ধুর দিকে।

দারুণ, রানা, চমৎকার, বলল রেমারিক। কিন্তু সত্যি জান তো কিসের। বিরুদ্ধে লাগতে যাচ্ছ তুমি?

তুমিই না হয় জানাও আমাকে।

যা জানে সব গুছিয়ে বলল রেমারিক। মানুষ যতটা বিশ্বাস করে বা যতটা। বিশ্বাস করতে চায়, মাফিয়া তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। পুলিসকে ওরা কেয়ার করে না, অনেক সময় তাদের ওরা নিয়ন্ত্রণ করে। আইন, কোর্ট, বিচার। এসব ওরা কিনে ফেলে। রাজনীতিকদের-গ্রামের কাউন্সিলর থেকে শুরু করে। ক্যাবিনেট মিনিস্টার–সবাইকে ওরা ঘুষ দেয়। কোন কোন এলাকায়, বিশেষ করে। দক্ষিণে আর সিসিলিতে, আক্ষরিক অর্থে ওরাই আইন, ওদের সুবিধে মত শাস্তি বা। পুরস্কার দেয়া হয়। ভেতর আর, বাহির থেকে জেলখানাগুলো ওরাই চালায়। মাঝেমধ্যে দুচার বছরে এক-আধবার, মাফিয়াদের কোন কোন কাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই করতে পারে না। সমাজের সব স্তরে। আছে ওরা, ওদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার সাহস কারও নেই।

কর্তৃপক্ষের অস্ত্র বলতে, পুলিস, কোর্ট, জেলখানা। আগেই বলেছি, এগুলোর ভেতর মাফিয়ার লোক ঢুকে আছে। তবু, ভাল পুলিস, সৎ বিচারকও দুচারজন আছে বটে। কিন্তু তারা সংগঠিত নয়, কেউ তাদেরকে সাহায্য করার নেই। ত্রিশ দশকে শুধু মুসোলিনি ওদেরকে এক হাত দেখাতে পেরেছিল, তার কারণ সে ব্যবহার করেছিল ফ্যাসিস্ট মেথড। মাফিয়ার সাথে প্রচুর নিরীহ লোককেও ভুগতে হয়েছিল তখন। মুসোলিনির পর আবার ওরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতিটি শহরের প্রতিটি থানায় ওদের ইনফরমার আছে, ঘুষ খাওয়া পুলিস আছে, শহরটা যত ছোটই হোক না কেন। প্রতিটি গ্রামের অবস্থাও তাই। গুণ্ডা-পাণ্ডাদের নিয়ে তৈরি বিশাল একটা সেনাবাহিনীও রয়েছে ওদের।

কাজটা সহজ হবে না, স্বীকার করল রানা। তবে, এসবই আমার জানা আছে। কিছু কিছু দিকে সুবিধে পাব আমি। যেমন, মুসোলিনির মত, আমি এমন কৌশল ব্যবহার করতে পারব, পুলিসের পক্ষে যা সম্ভব নয়। একটা উদাহরণ দিই–আতঙ্ক। এটাকে ওরা একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু নিজেরা এই আতঙ্কের শিকার হতে অভ্যস্ত নয়।

যুক্তিগুলো উপলব্ধি করল রেমারিক। জানে, রানা ওদের মুখ ভোলাতে পারবে।

আরেকটা সুবিধে, বলে চলল রানা, পুলিসের মত আমার কাজ প্রমাণ, সাক্ষী ইত্যাদি জোগাড় করা হবে না। ওদেরকে আমি কোর্টে হাজির করতে যাচ্ছি না।

সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাল রেমারিক। অস্ত্র?

খবর নাও গগল কোথায় আছে, বলল রানা। নোটবুক খুলে অস্ত্রের তালিকাটা পড়ল ও।

মাইরি, রানা, তুমি সত্যি যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে! এত কিছু কি দিতে পারবে গগল?

আমি বললে সাগর সেঁচে মাণিক এনে দেবে, রেমারিককে আশ্বস্ত করল রানা। একটা ফোন নাম্বার দেব, ডায়াল করলেই জানতে পারবে কোথায় আছে ও।

এসব তোমার কবে দরকার?

মাস তিনেক পরে, বলল রানা। এই তিন মাসে শরীরটাকে পুরোপুরি ঠিক করে নেব আমি। গগলকে আমার কথা বলবে, বলবে ওগুলো আমি মার্সেলেস থেকে রিসিভ করব। তাপর কিভাবে ইটালিতে নিয়ে আসব, ভেবে রেখেছি।

স্বাস্থ্য উদ্ধারের প্রসঙ্গ আবার ফিরে এল। রানা বলল, নিরিবিলি একটা জায়গা। দরকার। কোন সাজেশন দিতে পার?

মাত্র একমুহূর্ত চিন্তা করল রেমারিক। মাল্টায় যাও না কেন? জেসমিনের বাপের বাড়ি, গোজোয়? দ্বীপটা তোমার খুব ভাল লেগেছিল, মনে আছে? সবাই ওরা চেনে তোমাকে, আপনজনের মত আদর পাবে, কিন্তু কেউ তোমাকে একটা প্রশ্নও করবে না। আমি জানি। ফি বছর আমিও হপ্তা দুয়েক কাটিয়ে আসি ওখানে। বল তো ফোন করি ওদেরকে।

প্রস্তাবটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করল রানা, তারপর মাথা ঝাঁকাল। মনে হয় ভালই হবে। কিন্তু ওদের কোন অসুবিধে করব না তো?

ঠোঁট টিপে হাসল রেমারিক। জেসমিন তোমার সম্পর্কে এমন সব সাটিফিকেট দিয়ে গেছে, তোমাকে পেলে ওরা আকাশের চাঁদ হাতে পাবে। একবার শুধু গিয়েই দেখ না। আমার শ্বশুরের সাথে ক্ষেতে কাজ করতে পার, শরীরটাকে যদি লোহা বানাতে চাও।

আলোচনার এক পর্যায়ে রানার ছদ্মবেশ প্রসঙ্গ উঠল। দুজনেরই ধারণা, যুদ্ধ শুরু হবার পর কিছুদিনের মধ্যেই ওর আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবে। হয় হবে, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত বর্তমান পরিচয়ই বহাল থাকবে। রানা জানাল, যেজন্যে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সেই বিপদ এখনও কাটেনি, কাজেই দেশে বা কাজে ফেরার ওর। কোন তাড়া নেই। হাতে প্রচুর সময় পাওয়া যাবে।

টাকা পয়সার কথাও উঠল। রেমারিক বলল, অস্ত্রশস্ত্র কেনার টাকা সে দেবে। ইটালি থেকে যা যা কিনতে হবে তাও সে কিনে রাখবে। ব্রাসেলসে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে।

হাসল রানা। বলল, অস্ত্রের জন্যে টাকা লাগবে না। টাকার কথা বললে খেপে যাবে গগল। এটা আমাকে শোধ করতে হবে ওর কোন উপকার করে। তারপর রানা জিজ্ঞেস করল, ধর যদি কাজের মাঝখানে আমি মারা যাই?

ঠাণ্ডা চোখে তাকাল রেমারিক। তখন আমি জেসমিনের কছে ক্ষমা চাইব। বলব, দুঃখিত, কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু রাখতে পারলাম না।

রাত শেষ হতে চলেছে, কিন্তু ওদের আলোচনা থামল না। ঠিক হল, দুদিন। পরই ফেরিতে চড়ে পালার্মোয় যাবে রানা। উন বাকালার আস্তানাটা দেখে আসা। দরকার ওর। ওখান থেকে ট্রেনে করে রেগিয়ো, তারপর আবার ফেরিতে চড়ে মাল্টা।

উঠে দাঁড়িয়ে নিজের নোটবুক খুলে পাতা উল্টালো রেমারিক, দেখে নিচ্ছে। কিছু বাদ পড়েছে কিনা। দেখা শেষ করে বলল, এখন তাহলে আসল কাজ তোমার শরীরটাকে আগের ফর্মে ফিরিয়ে আনা।

হ্যাঁ। মুচকি একটু হাসল রানা। পাঞ্জাটা মৃত্যুর সাথে লড়তে হবে কিনা।

চল, শোবে চল।

আমি একটু বারান্দায় বসব, বলল রানা। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগোল ও। তুমি যাও।

.

ভোরের আলো ফুটছে। বারান্দায় একা একটা চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। সবচেয়ে বড় তারাটা মিটমিট করছে দেখে চমকে উঠল ও। নিচের বাগান থেকে ফুলের গন্ধ এসে ঢুকল নাকে। বসন্তকাল, দূরে কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠল। তারপর, হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে লুটিয়ে পড়ল গায়ে।

সেই গানটা বেজে উঠল অন্তরে।

এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি। সে-রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পড়ো না। আর, হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ো আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভের আমি আর বেশি দূরে নেই। তারপর, হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছি। সে-রাতে তুমি জেগে থেকো বন্ধু, ঘুমিয়ে পড়ো না।

উঠে দাঁড়িয়ে রেলিঙের সামনে চলে এল রানা। রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরল। দুহাত দিয়ে, সারা শরীর কাঁপছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে বিড়বিড় করে বলল ও, জেগে আছি, আমি জেগে আছি।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত