অগ্নিপুরুষ: ১.৭-৮ লুবনাকে দেখার জন্যে

অগ্নিপুরুষ: ১.৭-৮ লুবনাকে দেখার জন্যে

১.৭-৮ লুবনাকে দেখার জন্যে

০৭.

লুবনাকে দেখার জন্যে বাড়িতে লোক রয়েছে, কাজেই স্বামীর সাথে এখন আবার বিদেশে যেতে পারে লরা। এশিয়া বা আফ্রিকা ভ্রমণে তার তেমন কোন উৎসাহ নেই, কিন্তু ভিটো ইউরোপের কোন শহরে বা আমেরিকায় গেলে সাথে যাবার। সুযোগটা কখনও ছাড়েনি সে। স্ত্রী সাথে গেলে ভিটোও খুব খুশি হয়। সাধারণত বোটের বাজার ধরতে যায় সে, লরার রূপ আর ব্যক্তিত্ব তার বিক্রি অনেক বাড়িয়ে দেয়।

হাসানের ছুটিছাটার ব্যাপারটা কি রকম হবে আলোচনা করতে ভুলে গেছে। ভিটো। তারা স্বামী-স্ত্রী দেশের বাইরে গেলে লুবনার সাথে থাকতে হবে হাসানকে। আলোচনার দায়িত্ব স্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিল ভিটো, বলতেই হাসান রাজি হয়ে গেল। দেখে স্বস্তিবোধ করল লরা। ছুটির ব্যাপারে রানা কিছু ভাবেইনি। লরাকে সে বলেছে, মাঝেমধ্যে তাকে বাইরে ডিনার খেতে হতে পারে, তবে সেটা ওরা যখন। বাড়িতে থাকবে তখন। লরা উপলব্ধি করল, লোকটার কোন সংসার বা বাধন না থাকায় মস্ত সুবিধে হয়েছে। নিশ্চিন্ত মনে প্যারিসে চলে গেল ওরা।

ডকইয়ার্ডের জন্যে নতুন মেশিনপত্র কেনার ব্যাপারে আলোচনা করতে যাচ্ছে। ভিটো। মেশিনগুলোর দাম পড়বে প্রায় চারশো মিলিয়ন লিরা। ফ্রেঞ্চ যদি মোটা অঙ্কের বাকি না দেয়, হতাশ হয়ে ফিরতে হবে তাকে। নিজের ওপর তার আস্থা আছে, ওদেরকে রাজি করাতে পারবে বলে বিশ্বাস করে। তাছাড়া, সাথে একটা জাদুর কাঠি অর্থাৎ লরা থাকছে। ও যদি কোম্পানির ডিরেক্টরদের দুএকজনকে মুগ্ধ করতে পারে, তাতেই নব্বই ভাগ কাজ হয়ে যাবে।

মা-বাবার অনুপস্থিতি মানে কিচেনে বসে খাবে লুবনা। লুবনার আচরণে, রানা খুশি–মেয়েটা ওকে এড়িয়ে চলে। রানার ওপর রাগ দেখায় না সে, চেহারা থেকে অভিমানের ছাপটুকুও মুছে ফেলেছে। ভাবটা যেন কিছুই ঘটেনি বা ঘটছে না, রানা। যেন একটা দরকারি কিন্তু একঘেয়ে জীব।

কাজেই খেতে বসে তার কথা বলার লোক বলতে আথিয়া আর লার্দো। খুব আদরের সাথে তাকে উপদেশ দেয় আথিয়া, এত কম খায় না, মা-মণি। তোমার এখন উঠতি বয়স, সামনে যা দেয়া হবে গোগ্রাসে গিলে ফেলবে…

রানা না থাকলে আথিয়ার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া শুরু করে দিত লুবনা। কিন্তু এখন সে শুধু চুপচাপ থাকে, মুখ তুলে তাকায়ও না। বুড়ো লার্দোর সাথে তার ভারি ভাব, শ্রদ্ধা-ভক্তির সাথে কথা বলে। পাল্টা কোন জবাব না পেয়ে উপদেশ দেয়ার উৎসাহ এক সময় হারিয়ে ফেলে আথিয়া, আর তখনই আলাপ শুরু করে লুবনা। সে, লার্দো আর আথিয়া গল্প করতে থাকে। রানা লক্ষ্য করেছে, ওরা। দুজনেই মেয়েটাকে খুব ভালবাসে, ওদের সাথে লুবনা খাচ্ছে দেখে দুজনেরই। আনন্দের সীমা নেই।

কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই আসলে লুবনার একটা চাল। মায়ের মতই মেয়ের মধ্যেও রয়েছে স্বভাবসুলভ অভিনয় প্রতিভা। রানার প্রতি তার আচরণ একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ মাত্র। অত্যন্ত সাবধানে, একটু একটু করে এগোচ্ছে। সে, রানা যেন কিছু টের না পায়।

প্রথমে লুবনা ঠিক করল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে সে, আবিষ্কার করবে। লোকটার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোথায় কি দুর্বলতা আছে। দুর্বলতা যে আছে সে। ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই। জীবন আর দুনিয়া সম্পর্কে আগ্রহ নেই, এমন মানুষ স্রেফ থাকতে পারে না। কাজেই সে অপেক্ষা করছে, অপেক্ষার সময়টা। কাটছে আথিয়া আর লার্দোর সাথে গল্প করে। রানার ওপরও তীক্ষ্ণ নজর আছে তার, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে ওর ব্যাপারে তার কোন উৎসাহ বা মাথাব্যথা নেই।

দিন কাটতে লাগল, সেই সাথে চলতি সময় আর পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখল, রানা। সচেতনভাবে কিছু চিন্তা না করেই নিজেকে দূরে। সরিয়ে রাখার প্রবণতা শিথিল করল ও, পছন্দ না হলেও কারও কারও আচরণ, এখন ও সইতে পারে। এমন কিছু ঘটছে না যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এমন কিছু অর্জন করার নেই যে প্ল্যান করতে হবে, তেমন কিছুর সাথে নিজেকে জড়ায়নি যে। ভাবাবেগের রাশ টেনে ধরতে হবে। চাকরিটা আরামের, সময়টা কেটে যায়। এভাবে কতদিন চলবে, ভাবেনি ও। আপাতত ও খুশি, কারও সাথে কোন বিরোধ নেই, অভিযোগও নেই।

ওর মদ খাওয়া একটু কমেছে। কোন কোন সকালে দেখা যায়, বোতলের, নিচের দিকে এক-আধটু হুইস্কি রয়ে গেছে।

একটা রুটিন দাঁড়িয়ে গেল। সকালে লুবনাকে স্কুলে দিয়ে আসে রানা, বিকেল। পাঁচটায় ফিরিয়ে আনে। মাঝখানের সময়টা ওর ছুটি। মাঝেমধ্যে মিলানের সুপার মার্কেটে গিয়ে দুএকটা বই বা ক্যাসেট কেনে, বেশিরভাগ দিন সোজা বাড়িতে ফিরে আসে। বিরাট এলাকা নিয়ে বাড়িটা, কোথাও ঝোঁপঝাড় গজিয়েছে, পিছনে দুএক জায়গায় ভেঙে গেছে পাচিলের ওপর কাটাতারের বেড়া। মালি লার্দোকে, অনেক কাজে সাহায্য করে ও। কোথাও কোন কাজ পড়ে থাকতে দেখলে কাউকে। কিছু না বলে নিজেই সেটা হাতে নেয় ও। ওর এই অভ্যেসটা দেখে রেমারিক একদিন মন্তব্য করেছিল, আর কিছু না, এ হল অপরাধবোধ-জীবনের বেশিরভাগ সময় তো এটা-সেটা ধ্বংস করেই কাটল, কিছু মেরামত না করলে কি চলে? স্রেফ একটা কথার কথা, আসল ব্যাপারটা ঠিক উল্টো, রেমারিকও সেটা জানে। বেশিরভাগ ধ্বংসই করেছে রানা, গড়েছে কম, কিন্তু সেগুলো ছিল ন্যায়, সভ্যতা আর শান্তির পথে এক একটা বাধা। এই বাধা ভাঙতে না পারলে সৃষ্টি গতি পাবে না, কাজেই এই ধ্বংসের মধ্যেও কম গৌরব নেই।

লার্দো একা সব কাজ পেরে ওঠে না। রানার উৎসাহ দেখে তার প্রাচীন রক্তে যেন বান ডাকল। বাড়ির পিছন দিকটা ক্রমশ উঁচু হয়ে, তারপর প্রায় খাড়া হয়ে পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে। ওদিকেই ঝোঁপঝাড় জন্মেছে, কাঠের বেড়াটাও মেরামত করা দরকার। লার্দো বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি করে এড়িয়ে গেছে ভিটো, টাকা আর বের করেনি। প্রথমে দুজনে মিলে ঝোঁপঝাড় কেটে সাফ করল ওরা। তারপর নিজের পকেটের টাকা থেকে কিছু

কাঠ, তার ও পেরেক কিনে আনল রানা। বেড়াটা মেরামতের কাজে হাত দিল। ওরা, শেষ করতে কয়েক হপ্তা লাগবে। ভিটো কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে, বাড়ির। নিরাপত্তার জন্যে ভাঙা বেড়া একটা হুমকি হয়ে ছিল।

সারাদিন খাটতে হয়, তাই সন্ধে হতে না হতেই প্রচণ্ড খিদে নিয়ে ডিনারে বসে পড়ে ওরা। সবাই ধরে নিয়েছিল লুবনা এত তাড়াতাড়ি খেতে আসবে না। কিন্তু দেখা গেল সে-ও সময় মত হাজির হয়ে যায়। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে এক কি দুঘন্টা কিচেনে বসেই বই পড়ে রানা, কিংবা টেলিভিশন দেখে। বাকি তিনজন। নিজেদের মধ্যে গল্প করে।

ঠিক এই রকম একটা সময়ে, মা-বাবা ফিরে আসতে আর দুদিন বাকি আছে, হাসানের বর্মে প্রথম ফুটোটা দেখতে পেল লুবনা। টেলিভিশনে ভাল কিছু না। থাকলে সেদিনের খবরের কাগজ অথবা কোন পত্রিকা পড়ে সে। বেশ মনোযোগ। দিয়েই পড়তে হয় তাকে, কারণ কোথায় কি ঘটছে না ঘটছে আথিয়া আর লার্দো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় সব।

সেদিন লুবনার পড়া শেষ হতেই আথিয়া আর লার্দোর প্রশ্নপর্ব শুরু হল। ওদের কথায় মন ছিল না রানার, কিন্তু একটা শব্দ ওর কানে বাজল-প্যালেস্টাইন। লার্দো একটা প্রশ্ন করেছে, উত্তরে লুবনা বলল, এখানে লিখেছে লেবাননে কমাণ্ডো। হামলা চালিয়ে প্যালেস্টাইনীদের একটা ঘাটি ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েলিরা। প্যালেস্টাইনীরা ঠিক কি চায় তা তো আমি বলতে পারব না।

এই প্রথম ওদের আলোচনায় যোগ দিল রানা। প্যালেস্টাইন জায়গাটা কোথায়, ইহুদিদের জবরদখল, অত্যাচার, উদ্বাস্তু প্যালেস্টাইনীদের দুর্দশা, তাদের। গেরিলা ট্রেনিং, দলাদলি, ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বলল ও। গভীর মনোযোগের সাথে কথাগুলো শুনল ওরা।

এরপর লুবনা আরেকটা প্রসঙ্গের অবতারণা করল। তৃতীয় বিশ্ব কি? ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রসঙ্গও চলে এল। ব্রিটিশরা কিভাবে শোষণ করেছে। কিভাবে পাচার হয়েছে সম্পদ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেন আজও অশিক্ষা, গোঁড়ামি আর কুসংস্কার, সব বিষয়েই দুচার কথা বলল রানা।

তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল ও, বইটা তুলে নিল হাতে। গোটা। ব্যাপারটাই অপ্রত্যাশিত, ওর কাছ থেকে কেউ আশা করেনি। লুবনা কোন রকম চাপ তো দেয়ইনি, সরাসরি একটা প্রশ্নও করেনি রানাকে। রানা থামতে আথিয়ার সাথে আলাপ জুড়ে দিল সে। কয়েক মিনিট পর উঠে দাঁড়াল রানা, ভারি গলায় গুডনাইট বলে নিজের কামরায় চলে গেল।

ওর পিছনে দরজা বন্ধ হতে আপনমনে হাসল লুবনা। তোমার একটা দুর্বলতা। টের পেয়ে গেছি, মনে মনে বলল সে। এক পা এগোলাম।

পরদিন স্কুলে যাবার পথে বা ফেরার পথে লুবনা একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। সেদিন ডিনারের পর টেলিভিশন দেখায় মন দিল সে। রানার যেন কোন অস্তিত্বই নেই। মনে মনে স্বস্তি বোধ করল রানা। কিন্তু মেয়েটার ষড়যন্ত্র যদি টের। পেত, অশান্তি পেয়ে বসত ওকে। তবে স্বীকার করতে বাধ্য হত, লুবনার রণ কৌশল নিখুঁত সামরিক নিয়মে বাঁধা। প্রথমে টার্গেট সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা। তারপর দুর্বলতা আবিষ্কার। সবশেষে শত্রুর দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাবার ব্যবস্থা করা, আর তারপরই পিছন দিয়ে চুপিচুপি ঢুকে পড়ে ঘাঁটি দখল করে নেয়া। লুবনা দক্ষ একজন গেরিলা নেতা হতে পারত।

.

রিসো আর জুলিয়ানাকে নিয়ে মিলানের মনোরেলিস-এ ডিনার খেতে এল রানা। রেস্তোরাঁর ব্যাপারে সুপারিশ ছিল আথিয়ার। মিলানে আসার পর প্রথম ওখানেই চাকরি হয় তার। মিলানে মনোরেলিস-এর মেনু নাকি একটা বিস্ময়। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি করে আথিয়া আরও বলল, তবে বিল খুব বেশি হবে।

জুলিয়ানার জন্যে আজকের সন্ধে বিরাট একটা উৎসব। রিসো কাজে ব্যস্ত থাকে বলে বাইরে ডিনার খাওয়ার সুযোগই হয় না তার। একা একা বাইরে বেরুতে তার ভাল লাগে না। মনোরেলিস-এর নাম শুনে তার আনন্দ উৎসাহ দ্বিগুণ। বেড়ে গেল।

রিজার্ভেশনের জন্যে ফোন করেছিল আথিয়া। রেস্তোরাঁয় পৌঁছে রানা বুঝল, নিজের সম্পর্কে খুব কম করে বলেছে আথিয়া। ওদের জন্যে সেরা একটা টেবিল। রাখা হয়েছে, এবং খোদ মালিক এগিয়ে এসে ওদেরকে অভ্যর্থনা জানাল। কথায়। কথায় জানা গেল, আথিয়া এখানে সাধারণ ওয়েট্রেস ছিল না, কিচেনের দায়িত্বে। ছিল। আভান্তি পরিবার প্রায়ই এখানে আসে, সেই সূত্রেই আথিয়ার সাথে তাদের পরিচয় হয়েছিল।

প্রথমে হালকা পাস্তা পরিবেশন করা হল, তারপর ইন্তারকোস্তা পিসেলি আর রোজমেরী। ঢিলেঢালা, হাসিখুশি পরিবেশ, চাকরিতে ঢোকার পর আজই প্রথম বাইরে ডিনার খাচ্ছে রানা। আর জুলিয়ানার আমোদ-আহ্লাদ কাউকে স্পর্শ না করে পারে না।

রানার মুড দেখে একটু অবাকই হল রিসো। এক মাস আগে জুলিয়ানার রসিকতায় বিরক্তি প্রকাশ না করলেও, হাসেনি রানা। কিন্তু আজ ওর ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা গেল। মেয়েলি কৌতূহল নিয়ে আভান্তি পরিবার, বিশেষ করে লরা। সম্পর্কে সব কিছু জানতে চাইল জুলিয়ানা, বলল, ভদ্রমহিলার রূপের নাকি তুলনা হয় না, অভিজাত মহলে তার নাকি সাংঘাতিক খাতির। লোকে যা বলে, লরা কি সত্যি অতটা সুন্দরী? ছোট্ট করে জবাব দিল রানা, হ্যাঁ।

স্বামীর উদ্দেশে একটা চোখ টিপে রানাকে জিজ্ঞেস করল জুলিয়ানা, মা আর মেয়ের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী?

গম্ভীর হয়ে উঠল রানা, জুলিয়ানার দিকে তাকাল। ভারি গলায় বলল, মেয়ে। এ প্রসঙ্গ কেন?

জুলিয়ানা বুদ্ধিমতী মেয়ে, মেসেজটা পেয়ে সাবধান হয়ে গেল সে।

লুবনাকে ঘিরেই ঘুরছে রানার চিন্তা। প্যালেস্টাইনীদের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার দুতিন দিন পর লুবনা তাকে খোলাখুলি দুএকটা প্রশ্ন করেছে। বোঝাই যায়, জানার অদম্য উৎসাহ রয়েছে মেয়েটার মধ্যে। গত পরশুই তো, স্কুলে যাবার পথে পিছনের সিট থেকে হিউম্যান রাইট সম্পর্কে জানতে চাইল। বিষয়টা নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছে, প্রসঙ্গটা প্রথম তোলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তারপর অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা তাকে সমর্থন করে বিবৃতি দিতে শুরু করেন। সবারই এক কথা, মানবাধিকারের অবমাননা করা চলবে না।

উত্তরে রানা বলেছে, মানবাধিকার মানে ব্যক্তির স্বাধীনতা, এবং একটা। সমাজে বসবাসরত সবার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হবার অধিকার। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত উত্তরে সন্তুষ্ট করা যায়নি লুবনাকে, খুটিয়ে খুঁটিয়ে আরও অনেক প্রশ্ন তোলে সে। মেয়েটার দুর্বার আগ্রহ দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথা বলতে হয় রানাকে। রাজনীতি প্রসঙ্গ এসে যায়। ডানপন্থী বামপন্থী কাদের বলে, গণতন্ত্র কি, এসব যখন ব্যাখ্যা করছে, স্কুলে পৌঁছে যায় ওরা। রানার ধারণা ছিল, ফেরার পথে আবার প্রসঙ্গটা তুলবে লুবনা, কিন্তু না, একদম চুপচাপ ছিল সে।

অতীত রোমন্থনে বাধা পড়ল, একজন লোক ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। আভান্তি পরিবারের সেই বন্ধু, আলবারগো লোরান।

মি. হাসান না?

লোকটাকে পছন্দ না হলেও, ভদ্রতার খাতিরে রিসো আর জুলিয়ানার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল রানা। লক্ষ করল, জুলিয়ানার দিকে কুতকুঁতে চোখে তাকিয়ে। ঘন আর চওড়া গোফের ভেতর মিটমিট করে হাসছে লোরান। গায়ে জ্বালা ধরে গেল রানার।

আপনার রুচির প্রশংসা করতে হয়, বলল লোরান। মিলানের সবচেয়ে ভাল রেস্তোরাঁ এটা। ডিনার কেমন লাগল?

ডিনারের প্রশংসা করল সবাই। জুলিয়ানাকে দাঁত বের করা আরও খানিকটা হাসি দিয়ে চলে গেল লোরান। খানিক পর ওয়েটার এসে ওদেরকে পানীয়। পরিবশেন করল, বলল, মি. আলবারগো লোরান পাঠিয়েছেন।

অদ্ভুত লোক তো, মন্তব্য করল জুলিয়ানা।

হাঙর, বলল রিসো। কিন্তু ভারি চালাক। ব্যবসায়ী মহলে সবাই ওকে চেনে। সরকার আর মাফিয়া, দুই রাক্ষসের সাথেই নিরেট যোগাযোগ আছে ওর। শুনতে পাই, ও নাকি বলেই বেড়ায়–সরকার, ব্যবসা আর ক্রাইমের মধ্যে এখন আর বলতে গেলে প্রায় কোন পার্থক্যই নেই। আপনার বসের স্ত্রীর সাথে লোকটার একটা অ্যাফেয়ার আছে।

মনে মনে একটা ধাক্কা খেল রানা। লরার কারও সাথে জড়িয়ে পড়াটা আশ্চর্যের কিছু না, কিন্তু এত থাকতে লোরান? রুচিতে বাধল না!

ভিটো আভান্তিকে ব্যাঙ্ক লোন পাইয়ে দেয়ার জন্যে কাজ করছে লোরান, বলল রিসো৷ লোরান নাকি ব্যক্তিগত গ্যারান্টি দিয়ে হলেও বন্ধুকে এ যাত্রা উদ্ধার করবে।

তোমার ফার্ম কি ভিটোর খাতাপত্র অডিট করে? জিজ্ঞেস করল রানা।

মাথা নাড়ল রিসো। কিন্তু সব কথাই আমাদের কানে আসে।

মনোরেলিস-এর মালিক মনোরেলি এবার স্বয়ং উদয় হল। তার তরফ থেকে আরেক প্রস্থ ড্রিঙ্ক পরিবেশন করা হল ওদেরকে। ইতিমধ্যে ওরা নিজেরাও বারকয়েক কনিয়াকের অর্ডার দিয়েছে। ফলে সামান্য একটু নেশা মত ধরল জুলিয়ানাকে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরুবার সময় দুজনের মাঝখানে থাকল সে, রিসো আর রানার দুই কাঁধে দুটো হাত তুলে দিল। বেরুবার আগে লোরানের টেবিলের। পাশ ঘেঁষে আসতে হল ওদেরকে। লোরান হাত দেখাতে একবার থামতেও হল। টেবিলে লোরানের সাথে হোঁকা চেহারার দুজন লোক রয়েছে। দুজনের। একজনকে ইংরেজ বলে মনে হল রানার, পোশাক দেখে ধারণা হল ব্যাঙ্কার। খুব উৎসাহের সাথে রানাকে দেখাল লোরান, বলল, লুবনা আভান্তির বডিগার্ড। ভারি অভিজ্ঞ। কেন যেন, লোরানের হাসিটা ব্যাঙ্গাত্মক বলে মনে হল রানার।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসার পর রানার দুই গালে চুমো খেল জুলিয়ানা, ধন্যবাদ দিয়ে অনুরোধ করল যে-কোন রোববারে রানা যেন লাঞ্চ খেতে ওদের বাড়িতে আসে।

.

প্যারিস থেকে ফিরে আবার বন্ধুকে নিয়ে লাঞ্চ খেতে বসল ভিটো। বডিগার্ড প্রসঙ্গটা লোরানই তুলল, এত সস্তায় ওকে তুমি বাগালে কিভাবে?

লোকটা মদ খায়। এলকোহলিক।

আচ্ছা! মাথা ঝাঁকাল লোরান। কিন্তু দেখে তো মনে হয় না!

শুধু রাতে খায়। তবে ও নিজে আমাকে বলেছে মদ ওর শরীরের বারোটা বাজাচ্ছে। অবশ্য গাড়ি চালাতে কোন অসুবিধে হয় না। এমনিতে লোকটা খুব কাজের, আমাদের বেড়া মেরামত করে দিচ্ছে, ঝোঁপঝাড় কেটেছেটে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলেছে গোটা বাড়ি।

তারমানে প্রায় বিনা পয়সায় প্রচুর সার্ভিস পাচ্ছ, বলে হাসতে লাগল। লোরান। সবচেয়ে সুখের কথা, ভাবী এখন খুশি। গিদাস-এ হঠাৎ দেখা হয়েছিল, পরে আমার সাথে ককটেলও খেল। কথা বলে বুঝলাম, মুখ রক্ষা হওয়ায় ভাবীর খরচের হাতও আর আগের মত নেই।

না, নেই, স্বীকার করল ভিটো। মিলানে এখনও আসে বটে, কিন্তু আগের। মত কেনাকাটা করে না।

এরপর ব্যবসায়িক কথাবার্তা শুরু হল। সারাক্ষণ প্রায় একাই কথা বলে গেল লোরান। চেহারায় থমথমে গাম্ভীর্য, খানিকটা উদ্বেগ, আর গভীর মনোযোগ নিয়ে তার কথা শুনে গেল ভিটো। খুব নিচু গলায় কথা বলল ওরা অনেক কথা।

.

হাসানের ব্যাকগ্রাউণ্ড শুধু লুবনা নয়, আথিয়া আর লার্দোরও জানা হয়ে গেছে। ডিনারে বসে একদিন লার্দো বলল, আমিও যুদ্ধে ছিলাম। উত্তর আফ্রিকায়। মন্টগোমারী আমাকে বন্দী করেছিল। কথাটা এমন ভাবে বলল, যেন স্বয়ং ফিল্ড মার্শাল নিজের হাতে তাকে গ্রেফতার করেছিলেন। খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে। ছোট্ট করে একবার মাথা ঝাঁকাল রানা। এরপরই লুবনা সরাসরি জানতে চাইল, তুমি তো রোডেশিয়ায় যুদ্ধ করেছ, তাই না?

তুমি জানলে, কিভাবে? তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল রানা।

বাবার কাছ থেকে।

কিছু না বলে কাগজে চোখ ফিরিয়ে আনল রানা। এক মিনিট পর উঠে দাঁড়াল ও, নিজের কামরায় চলে গেল।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে গান শুনছে লুবনা, আর ভাবছে। বন্ধুত্ব অর্জনের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করা বোকামি, বুঝতে পেরেছে সে। শুধু। কথাবার্তা বলিয়ে কোন লাভও নেই, তাকে ওর জীবন সম্পর্কে জানতে হবে। গান। থেমে যেতে তার চিন্তায় বাধা পড়ল। কয়েক সেকেণ্ড পর আবার শোনা গেল, এবার সেই গানটা, সো যা রাজকুমারী, সো যা…

এক সময় শেষ হল গানটা। তারপর আবার বাজল। দুবার, কোন কোন দিন। তিনবারও এই একই গান বাজায় ও। কি বলা হয়েছে এই গানে? প্রশ্ন করে লাভ নেই, কটমট করে তাকাবে কিন্তু উত্তর দেবে না।

কিন্তু একদিন সে এই গানের অর্থ জানবেই। চোখ ভারি হয়ে আসছে, এই সময় আবার তার মনে হল, এটা কি আসলে কোন ঘুমপাড়ানি গান? তাই যদি হয়, কার জন্যে বাজায় ও? নিজের জন্যে, নাকি তার জন্যে?

যতই এড়িয়ে থাকুক, যতই গাম্ভীর্য দেখাক, ভেতরের মানুষটা নিশ্চয়ই নিপ্রাণ। নয়। আর নিষ্প্রাণ যদি না হয়, ওর বন্ধুত্ব পাবার জন্যে তার এই যে ব্যাকুলতা, ও কি একটুও তা টের পাবে না?

হয়ত পায়, আর সেজন্যে হয়ত এই ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। ঠোঁটে তৃপ্তির ক্ষীণ একটু হাসি নিয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায় লুবনা।

.

মাঝখানের পাঁচিলটা হঠাৎ করে ভাঙল। এক হপ্তার জন্যে লণ্ডনে গেছে ওর মা বাবা। কিচেনে ছিল লুবনা, লার্দো এসে ঘোষণা করল, বাড়ির পিছনের গাছে একটা নাইটিঙ্গেল বাসা বেঁধেছে। বাসায় দুটো ছানাও আছে। সন্ধে প্রায় হয়ে এসেছে তখন, আলো নেই বললেই চলে, তবু জেদ ধরল লুবনা ছানা দুটো তাকে দেখাতে হবে। প্রায় খাড়া ঢালের অনেক উঁচুতে গাছটা, কিন্তু লম্বা লম্বা পা নিয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছিল লুবনা, উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ দুটো। কিভাবে। ঠিক জানা গেল না, সম্ভবত আলগা একটা পাথরে পা পড়ায়, পিছলে নিচে নামতে শুরু করল সে। ঢালটা মসৃণ নয়, বিপদটা সেজন্যেই ঘটল। মাথা উঁচিয়ে থাকা বড়সড় একটা পাথরে এসে ধাক্কা খেল সে, কোমর আর পাজর চেপে ধরে বাঁচাও!বলে আর্তনাদ করে উঠল। পা পিছলাবার সময় ডান পায়ের গোড়ালিতেও ব্যথা পেয়েছে সে। খানিকটা দূরে, তার বা দিকে ছিল রানা, যন্ত্রপাতি গুছিয়ে বাক্সে। ভরছিল, লুবনার চিৎকার শুনে উড়ে চলে এল যেন।

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লুবনা, পাঁজর চেপে ধরে আছে, ব্যথায় নীল হয়ে গেছে চেহারা। হুড়মুড় করে নেমে এসেছে লার্দো, লুবনার মাথা ঊরুর ওপর নিয়ে বসে আছে।

লুবনার গোড়ালি ছল রানা, আঙুলের চাপ দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল। কোথাও হাড় ভেঙেছে কিনা। এরইমধ্যে গোড়ালি ফুলে উঠেছে, কিন্তু হাড়ে কিছু হয়নি, স্রেফ মচকে গেছে পা। এরপর পাজর থেকে লুবনার হাত সরিয়ে দিল ও, টি-শার্ট টেনে তুলে দিল ওপর দিকে। চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল লুবনার, শিউরে উঠল বারকয়েক, কিন্তু সেটা সঙ্কোচে নাকি ব্যথায় ঠিক বোঝা গেল না। পাজরের নিচে মাখনের মত চামড়া লালচে হয়ে উঠেছে। কয়েকটা পাজরের ওপর আঁচড়ের। দাগও দেখা গেল। আলতভাবে পাজরে আঙুল রাখল রানা, নরম চাপ দিয়ে পরীক্ষা। করল। বারবার শিউরে উঠল লুবনা।

খুব ব্যথা করছে? জিজ্ঞেস করল রানা।

ওখানে নয়, আরও নিচের দিকে…মাগো!

আরও নিচের দিকে বলতে তলপেটের পাশের হাড়, ইঙ্গিতে লুবনা সেটাই বোঝাতে চাইল। এক সেকেণ্ড ইতস্তত করে আবার জিজ্ঞেস করল রানা, কি রকম ব্যথা?

প্রচণ্ড, চোখ বুজে কাতরাতে লাগল লুবনা। ওখানে বোধহয় হাড় বলতে কিছু নেই, সব গুড়ো হয়ে গেছে!

ভয় পেয়ে গেল রানা। কিন্তু তারপরই লুবনার কথা শুনে খানিকটা স্বস্তি বোধ করল।

ওই ওখান থেকে, হাত তুলে উঁচু ঢালটা দেখাল লুবনা। কিভাবে যে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। ঘাড় ফিরিয়ে তোমাকে যেই দেখতে গেলাম।

রানা লক্ষ করল, কান্না চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে লুবনা। হাড় ভেঙে গেলে এত কথা ও বলতে পারত না। আমার মনে হয় হাড় ভাঙেনি, শুধু চোট লেগেছে। অন্তত গোড়ালি আর পাজর ঠিকই আছে।

ধুলোর একটা মেঘ তুলে ছুটে এল আথিয়া, হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল সে। একটা ধমক দিয়ে তাকে থামাল রানা। ঠিক করল, এক্স-রে করাবার জন্যে লুবনাকে কোমোয় নিয়ে যাবে ও। ভিটো বা লা ফোন করতে পারে, কাজেই বাড়িতে থাকতে হবে আথিয়াকে। লার্দোর চোখের পানিও লুবনার কোন সাহায্যে আসবে না, তাই আথিয়ার সাথে তাকেও থেকে যেতে বলল রানা। তারপর খুব সাবধানে, জখমে যাতে চাপ লাগে, দুহাতে পাঁজাকোলা করে লুবনাকে তুলে। গাড়িতে নিয়ে এল।

এক্স-রে থেকে জানা গেল, কোথাও কিছু ভাঙেনি। ডাক্তার লুবনার গোড়ালি ব্যাণ্ডেজ করে দিল, আর ব্যথা কমাবার জন্যে পেইনকিলার দিল কয়েকটা।

বাড়ি ফিরে আথিয়া আর লার্দোকে আশ্বস্ত করল রানা, লুবনাকে বয়ে নিয়ে। এল তার বেডরূমে। আথিয়া তাকে আরাম করে শুতে সাহায্য করছে, কামরা থেকে বেরিয়ে এল ও, হলঘর থেকে টেলিফান করল লণ্ডনে। রিসিভার তুলল লরা। লুবনার পড়ে যাওয়ার কথাটা বলল রানা। না, তাড়াহুড়ো করে চলে আসার দরকার। নেই। গোড়ালি মচকে গেছে আর দুএক জায়গায় আঁচড় লেগেছে। কাল সকালে স্কুলেও হয়ত যেতে পারবে লুবনা। ঠিক আছে, লুবনাকে ওদের ভালবাসা জানাবে সে। রিসিভার নামিয়ে লাখল রানা। তারপর লুবনার ঘরে ফিরে এল আবার।

দুটো বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে আছে লুবনা। তার পাশে ভেলভেটে মোড়া মেটে রঙের ঢাউস একটা সিংহ। রানাকে দেখেই খোনাটা লুকাতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিংহটাকে খুঁটিয়ে দেখল রানা, অনেক দিনের পুরানো, তুবড়ে গেছে। বিছানার কিনারায় বসল ও। হাসিটা চেপে রাখল। এখন ভাল লাগছে?

বিষণ্নভাবে মাথা ঝাঁকাল লুবনা।

সিংহটা দেখিয়ে রানা জানতে চাইল, এটা বুঝি তোমার খেলনা?

যাহ! কিল তুলল লুবনা। আমি কি ছোট নাকি যে ওটা নিয়ে খেলব!

তাহলে কার?

বিপাকে পড়ে গেল লুবনা। কি বলবে ভেবে পেল না। তারপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চেহারা। ছোটবেলায় এটা আমারই ছিল। এখন আর খেলি না।

ও, বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রানা। তা নাম কি এর?

ওর কোন নাম নেই, বলল লুবনা।

সাদা বালিশে ছড়িয়ে থাকা লুবনার চুল কুচকুচে কালো, মুখটা ম্লান। ভক্তি। আর গাম্ভীর্যের সাথে রানার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ কেউ কথা বলল না। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রানা। ট্যাবলেট খেলে তোমার ঘুম পাবে। ব্যথা বাড়লে রাতে ঘুম ভেঙে যেতে পারে, তখন আরও দুটো খেয়ে। নিয়ো। দরজার কাছে পৌঁছে ঘূরল আবার। ফোনে তোমার মার সাথে কথা বলেছি। ওরা তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছে।

ধন্যবাদ। গুড নাইট, হাসান।

গুডনাইট, লুবনা, ভারি গলায় বলল রানা।

ট্যাবলেট খাওয়ায় সত্যি ঘুম পেল লুবনার। আলো নিভিয়ে বুকের কাছে নিল সিংহটাকে, একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। রানাকে মিথ্যে কথা বলেছে সে। এটার একটা নাম আছে।

.

লণ্ডন সিটি হোটেলে ফিরে স্ত্রীর কাছ থেকে দুঃসংবাদটা শুনল ভিটো। ডিনারের। জন্যে তৈরি হতে হবে তাকে, ব্যস্ত। তার এজেন্ট নতুন একটা প্রস্তাব নিয়ে কথা বলবে আজ। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে লরার সাথে কথা বলল সে। তুমি ফিরে। যেতে চাও না? রাতে মিলানে যাবার একটা ফ্লাইট আছে।

বাথরুমের দরজায় হেলান দিয়ে রয়েছে লরা। মাথা নাড়ল সে। হাসান বলল ও ভাল আছে।

শ্যাম্পুর জন্যে হাতড়াল ভিটো, এগিয়ে গিয়ে বোতলটা স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিল লরা। এ খুব ভাল হয়েছে, তাই না?

কি ভাল হয়েছে? মাথায় শ্যাম্পু ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞেস করল ভিটো।

বাড়িতে এই রকম একটা কাজের লোক থাকা, নিশ্চিন্তে বাইরে বেরোনো। যায়। হাসান না থাকলে কি হত চিন্তা করতে পার? আথিয়া নার্ভাস হয়ে পড়ত, পড়িমরি করে ছুটে যেতে হত আমাকে। অথচ আজকের ডিনারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই না?

হ্যাঁ, খুব গুরুত্বপূর্ণ, বলল ভিটো। বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল সে। প্রকাশ্য একটা, গরম তোয়ালে দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। আমাদের এজেন্ট কলিন। বলছে দাম একটু বাড়িয়ে ধরলেও বাজার হাতছাড়া হবে না, কারণ এই এলাকায় আমাদের বোট এখনও সেরা। তবে বাকি দিতে হবে। আমার মনে হয় আমরা। বাকি দিলে কলিনের লাভ হয়। ওকে বোঝাতে হবে…

বোঝাবার দায়িত্বটা আমার ওপর ছেড়ে দাও, বলল লরা।

দাড়ি কামাতে কামাতে হাসল ভিটো। সন্দেহ নেই, হাসান একটা ভাল ইনভেস্টমেন্ট।

পরদিন ভোরবেলা প্রথমে ঘুম ভাঙল লরার। রাতের ডিনারের কথাই সবচেয়ে। আগে মনে পড়ল তার। কলিনকে বোঝাতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তার। মিষ্টি হাসি, হাত ধরতে দেয়ার সুযোগ, পরে গায়ে গা ঠেকিয়ে খানিক নাচানো, মতলব, হাসিল হয়ে গেছে।

হঠাৎ ভুরু কুঁচকে উঠল লরার। ইস, কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিল সে। হাত দিয়ে ভিটোকে ধাক্কা দিল, বলল, এই শুনছ?

কি হল? কাল রাতে ভিটোর একটু বেশি মদ খাওয়া হয়ে গেছে।

বলতে ভুলে গেছি, এক ভদ্রলোক কাল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে ফোন করেছিলেন তোমাকে। বললেন, কাল সকাল এগারোটায় তার অফিসে। স্বামীর গায়ের ওপর ঢলে পড়ল সে। ব্যাপারটা কি গো?

কিছু না, টাকা-পয়সার একটা ব্যাপার, জুড়ানো গলায় বলল ভিটো। ভদ্রলোক লোরানের বন্ধ।

সিরিয়াস কিছু?

বিড়বিড় করে কি বলল ভিটো, বোঝা গেল না। তারপর আবার সে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

খোঁড়াতে খোঁড়াতে ধাপ কটা টপকাল লুবনা, গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। পিছনের দরজা খুলে এক পাশে সরে গেল রানা। খানিক ইতস্তত করে লুবনা বলল,

আমি বরং সামনেই বসি। তাহলে পা লম্বা করার জন্যে বেশি জায়গা পাব।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠে রানা জিজ্ঞেস করল, রাতে ভাল ঘুম। হয়েছে?

হয়েছে। শুধু পাশ ফেরার সময় একবার কিছুক্ষণের জন্যে ঘুম ভেঙেছিল।

গোড়ালির ব্যথা কমেছে? শরীরের ভার চাপাতে পার?

একটু কমেছে, বলল লুবনা। ভাল হতে কি অনেক সময় লেগে যাবে? উদ্বিগ্ন দেখাল তাকে। আর পাঁচ হপ্তা পর স্কুল স্পোর্টস। হানড্রেড মিটার দৌড়ে নাম দিয়েছি আমি।

পাঁচ হপ্তা অনেক সময়, বলল রানা। বেশি দয়া দেখিয়ো না ওটাকে। যতটা পার ভার চাপাবে দুএক হপ্তার মধ্যে টেরই পাবে না কিছু।

মেইন মিলান রোডে উঠে এল গাড়ি। রানা জানতে চাইল, কেমন দৌড়াও তুমি?

ভালই, কিন্তু শুরুটা আমার হয় না। সবাই পাঁচ-সাত হাত এগিয়ে যাবার পর। আমি রওনা দিই। ওদের পাশে যখন আসি, তখন আর সময় থাকে না।

তারমানে প্র্যাকটিস দরকার।

কোঅর্ডিশেন আর রিয়্যাকশন টাইম সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখে রানা, জানে লুবনাকে ট্রেনিং দিতে পারবে সে। কিন্তু সময় মত নিজেকে সামলে নিল, প্রস্তাবটা উচ্চারণ করল না। বেশি জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না।

এরপর আর কথা হল না।

লুবনা অনেক বদলে গেছে। এখন আর ব্যাপারটা তার কাছে শুধু খেলা নয়, নয় শুধু রানাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার ছেলেমানুষি একটা ঝোঁক। রানা তার কাছে এখন একটা আলাদা জগৎ, যে জগতকে সে দেখতে পায়, কিন্তু প্রবেশের অনুমতি মেলে না। স্বভাবসুলভ কৌতূহল আর সচেতনতার সাহায্যে মানুষটার ভেতরের কিছু কিছু আলো পলকের জন্যে দেখতে পেয়েছে সে। এখন সবটুকু দেখতে চায়, আর কিছু দিতেও চায়। ওকে কখনও হাসতে দেখেনি লুবনা। প্রতি মুহূর্তে একা, সবসময় নির্লিপ্ত। তার বিশ্বাস, এই লোক যদি নিজেকে মেলে ধরে, আশ্চর্য সুন্দর কিছু বেরিয়ে আসবে। ২ সেদিন বিকেলে, স্কুল থেকে ফেরার পথে লুবনা আমেরিকা আবিষ্কার সম্পর্কে জানতে চাইল। বিষয়টা এই প্রথম ক্লাসে পড়ানো হচ্ছে, আমেরিকা মহাদেশ একজন ইটালিয়ান আবিষ্কার করেছে জেনে লুবনা অভিভূত।

রানা বলল, ব্যাপারটা তা নাও হতে পারে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে। ভাইকিংরাই প্রথমে ওখানে গিয়েছিল। আবার কারও কারও বিশ্বাস, একজন। আইরিশ সন্ন্যাসী প্রথম আমেরিকায় যায়।

এরপর অভিযাত্রীদের নিয়ে শুরু হল আলোচনা। রানা ওকে মার্কো পোলো আর তাঁর চীন অভিযানের কথা বলল। এসব বিষয়ে খুব কমই জানে লুবনা, কিন্তু জানার আগ্রহ তার প্রচণ্ড। দুদিন পর ডিনারের সময় লুবনার হাতে একটা। প্যাকেট ধরিয়ে দিল রানা। বলল, এই বইটা পড়লে মার্কো পোলোর অভিযান। সম্পর্কে জানতে পারবে তুমি। মিলানের একটা দোকানে দেখতে পেয়ে নিয়ে এলাম। আসলে বইটা খুঁজে বের করতে দেড় ঘন্টা সময় লেগেছে রানার।

আমার জন্যে? উপহার? উত্তেজনায় চকচক করছে লুবনার চোখ।

হ্যাঁ, মানে, অস্বস্তি বোধ করল রানা। তোমার খুব আগ্রহ দেখলাম, তাই। ইনি ইটালির সবচেয়ে বিখ্যাত অভিযাত্রী, ওঁর সম্পর্কে তোমার জানা দরকার।

ধন্যবাদ, হাসান, নরম গলায় বলল লুবনা। অনুমান করল, তার সাধনা। সফল হয়েছে।

পরের রোববারে আর কোন সন্দেহ থাকল না তার।

.

০৮.

আচ্ছা, কংকিউবাইন কি?

ও রাস্তা থেকে চোখ ফিরিয়ে লুবনার দিকে একবার তাকাল রানা। ওর এ ধরনের প্রশ্নে এখন আর অবাক হয় না সে। এক রকম বউ-ই বলা যায়।

হতভম্ব দেখাল লুবনাকে। বউ? কিন্তু চীন সম্রাটের যে এক হাজারেরও বেশি। ছিল! তা কি করে হয়?

এধরনের বিষয় জটিল নয়, তাই সাবধান হবার দরকার করে না, এটা আগেই উপলব্ধি করেছেরানা। বয়স যাই হোক, মানসিকভাবে পরিণত হয়ে উঠেছে। লুবনা। নারী পুরুষের সম্পর্ক, মিলন ইত্যাদি সম্পর্কে অজ্ঞ নয় সে। মার্কো। পোলোর ওপর লেখা বইটা তার মনে এধরনের অনেক প্রশ্ন তুলেছে। অনেক সমাজেই বহু বিবাহের চল আছে, এ-কথা শুনে খিল খিল করে হাসলও না লুবনা, বা মেয়েলি ঢঙে পাকা কোন মন্তব্যও করল না। তার সহানুভূতি পুরুষদের প্রতি, জানতে পেরে হাসি পেল রানার।

এতগুলো বউ, বেচারা স্বামীদের জন্যে সত্যি আমার দুঃখ হচ্ছে, চিন্তিতভাবে বলল লুবনা। হয়ত নিজের মায়ের কথা ভাবছে সে। খুব বেশি হলে একজন লরাকেই কোন পুরুষ কোনরকমে সামলাতে পারে। এক হাজার লরা, ভাবতেও ভয় লাগে।

এখন আর আংশিক উত্তর দেয় না রানা, সবটা বুঝিয়ে বলে, আর বলেও এমনভাবে, যেন পরিণত বয়স্কা মেয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছে।

লুবনা রাজনৈতিক ভাষণ পছন্দ করে না, নেতারা কেউ কথা বলতে শুরু করলে টিভি অফ করে দেয় সে, কারণ তার ধারণা ওঁরা বেশিকথা বলেন, আর। ওঁদের হাসি কত্রিম। ধর্মের ব্যাপারেও তার মন্তব্য আছে। ধর্ম ভাল জিনিস, কিন্তু প্রিস্টরা যা বলবে সব সময় তাই সত্যি হবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। স্কুলে যেতে

তার ভাল লাগে, কিন্তু শিক্ষককে যদি পছন্দ হয় তবেই তার মন বসে পড়ায়। এ জীবন সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা আছে তার, সেগুলো দেখিয়ে দেয় রানা। এখন এমনকি রানার সঙ্গে তর্ক করতেও সাহস পায় সে।

মিষ্টি সুন্দর একটা সম্পর্ক শেকড় গাড়ছে, রোববারের লাঞ্চ তাতে পানি ঢালল। লুবনা জানল, মনের দরজা খুলে দিয়েছে হাসান, কৃতজ্ঞতার সাথে ভেতরে ঢুকল সে।

খুশি ধরে না, তবু খুব সাবধান ছিল লুবনা। হাসান তার নতুন পাওয়া একটা জগৎ, হঠাৎ বোকার মত কিছু একটা করে বসে, সেটাকে সে বৈরী করে তুলতে চায়নি। রিসোদের বাড়িতে লাঞ্চ খেতে গিয়ে সে দেখল, হাসানের চেহারায় গাভীর্য থাকলেও পেশীতে টান টান ভাব নেই, চোখে নেই লিলিপ্ততা, খুব একটা সতর্কও নয়। তার সাথে হাসান একজন অভিভাবকের মত আচরণ করেনি। অনেকটা যেন বন্ধুর বাড়িতে, আরেক বন্ধুকে নিয়ে এসেছে। সারাটা সময় হাসি আর আনন্দের মধ্যে কেটেছে লুবনার। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে খেলেছে, সে, জুলিয়ানাকে। কিচেনে সাহায্য করেছে, পুরুষ দুজনকে নিয়ে জুলিয়ানার হাসি-ঠাট্টায় দুএকবার যোগ দিয়ে হাসিয়েছে ও সবাইকে। কি লাঞ্চ থেকে ফেরার পথে রানার হাতের সেই কাটা দাগের ওপর আঙুল। রেখেছিল লুবনা, জানতে চেয়েছিল, এটা কি করে হল, হাসান?

আগের মত ঝাঁকি খেয়ে সরে যায়নি রানা। লুবনার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল সে। তারপর রাস্তার ওপর চোখ রেখে বলেছিল, একজন লোক আমাকে জেরা করছিল। খুব বেশি সিগারেট খেত লোকটা। আশপাশে অ্যাশট্রে ছিল না।

রানার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর রাস্তার দিকে ফিরল লুবনা, আর কোন প্রশ্ন করল না। খানিক পর ঘাড় ফিরিয়ে রানা দেখে, লুবনার। চোখ ছলছল করছে। খারাপ অনেক কিছুও ঘটে দুনিয়ায়। তোমাকে একবার। বলেছি।

চোখে পানি নিয়েও হেসেছিল লুবনা। ভাল অনেক কিছুও ঘটে।

এরপর থেকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে আর কোন বাধা পায়নি লুবনা।

.

লরা খুব সুখে আছে। লুবনাকে নিয়ে তাকে আর মাথাই ঘামাতে হয় না। বন্ধু বান্ধবদের কাছে ডাঁট মারে সে, বলে, হাসান একটা রত্ন। রানা যে অনেক বদলেছে, এটা তার চোখে পড়ে না, তার কাছে লোকটা আগের মতই গম্ভীর আর রহস্যময়। স্বামীর কাছে সে গল্প করে, এমন লোক ভাগ্যগুণে পাওয়া যায়।

মনে মনে ভিটোও তা স্বীকার করে। ভাগ্যিস লোকটা মদ খায়, তা নাহলে। এত কম বেতনে থাকত না।

কিন্তু মদ খাওয়া, আরও অনেক কমে গেছে রানার। সকালে দেখা যায় বোতল অর্ধেকটাও খালি হয়নি।

লুবনাকে, ট্রেনিং দিতে শুরু করল রানা। তার গোড়ালির ব্যথা সেরে গেছে, এবার স্কুল স্পোর্টসের জন্যে তৈরি হতে হবে। বাড়ির সামনের লনে দুটো দাগ কাটা হল, দৌড় শুরু আর শেষের চিহ্ন। লুবনা এল নীল আর সাদাট্রাকসুট পরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল রানা, কী আশ্চর্য লম্বা দেখাচ্ছে ওকে!

রিয়্যাকশন টাইম সম্পর্কে বলল রানা, স্টার্টিং গানের আওয়াজ প্রথমে তোমার কানে ঢোকে, কান থেকে যায় মাথায়, ব্রেন মেসেজ পাঠায় হাত-পায়ের নার্ভে। এই মেসেজটা বলে, যাও! গুমোরটা হল, এই মেসেজ পাঠাবার সময় কমিয়ে নিয়ে আসা।

লুবনাকে শেখাল রানা, কিভাবে শুধু শব্দটার দিকে সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিতে হবে। শব্দটা এই এল এই এল ভাব নিয়ে থাকলে চলবে না, কিংবা শোনার। জন্যে সচেতন থাকারও দরকার নেই। আওয়াজটা যখন আসবে তার প্রতিক্রিয়া। অবশ্যই আপনা-আপনি হতে হবে।

পিস্তলের বদলে একবার হাততালি দিল রানা। মাত্র এক বিকেল প্র্যাকটিস করেই দাগ থেকে চমকে ওঠা হরিণীর মত লাফ দিতে শুরু করল লুবনা। রানা। তাকে বলল, রোজ যদি এক ঘন্টা প্র্যাকটিস করতে পার, ফাস্ট প্রাইজ তোমার ঠেকায় কে।

সে-রাতে বিছানায় শুয়ে জনি ক্যাশ-এর গান শুনছে আর মেয়েটার কথা, ভাবছে রানা। কি চটপটে, কি প্রাণবন্ত! বড় হচ্ছে, অথচ নিজেকে নিয়ে তার কোন ভয় নেই। জানে, বিপদ হলে হাসান আছে। কিন্তু আরও এক ধরনের বিপদ। সম্পর্কেও ওর কোন ভয় নেই, অবিবাহিতা মেয়েদের যে ভয়টা থাকে। তার ভুলও হতে পারে, এই ভয়টা লুবনার হয়ত ঠিকই আছে, কিন্তু তার সঙ্গে থাকার সময় সেটা ওকে স্পর্শ করে না। তাকে বিশ্বাস করে মেয়েটা।

নিজের কথা ভাবল রানা। আর কতদিন এভাবে লুকিয়ে বেড়াতে হবে কে জানে! সি. আই. এ.-এর সাথে যদি কোন আপোস হয়ে যায়, দেশে ফিরতে হবে তাকে।

বুকের ভেতর একটা মোচড় অনুভব করল রানা।

আরও একটা কথা ভাবল ও। মদ খেয়ে আর কুঁড়েমি করে শরীরে মেদ। জমিয়ে ফেলেছে সে। অনেক দিন হল এক্সারসাইজ করা হচ্ছে না। তেমন ভয়ঙ্কর কোন বিপদে পড়লে সামাল দিতে অসুবিধে হবে। শরীরটাকে আগের ফর্মে ফিরিয়ে আনতে হলে সময় লাগবে, তিনমাসের কম নয়।

ক্যাসেট থেমে গেল। অভ্যস্ত হাতে সায়গলের ক্যাসেটটা তুলে নিল ও।

নিজের বিছানায় শুয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে লুবনা। সেই ভারি-গলায় বিদেশী গায়ক গাইছে, সো যা রাজকুমারী…

একটু পরই ঘুমিয়ে পড়ল লুবনা, ঠোঁটে তখনও হাসি লেগে আছে।

.

হেয়ারড্রেসারের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাল। লরা। দিনটা মেঘলা, রাস্তায় যানবাহনের অসম্ভব ভিড়। প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে গাড়িটাকে দেখল সে, পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাসান। ওর দিকে এগোচ্ছে, চোখের কোণে দ্রুত একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল।

রাস্তার এপারে, এইমাত্র একটা ফোক্সওয়াগেন ভ্যান এসে থামল। থামতে না থামতেই পাশের দরজা খুলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল দুই যুবক, দুজনের হাতেই পিস্তল। ছুটছে ওরা, একটা সাদা ফিয়াটের দিকে।

ফিয়াটটা রাস্তার ওপারে। গুলি হল, প্রথমে একটা। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ফিয়াটের দরজা বন্ধ করছিল বয়স্ক এক লোক, গুলির আওয়াজ শুনে ঝট করে ঘাড় ফেরাল সে, হাতটা ঢুকে গেছে জ্যাকেটের পকেটে। পৌঁছে গেল রানা, কিন্তু। ওকে ভাল করে দেখতে পেল না লরা। শুধু অনুভব করল, বুডিগার্ড কোমর জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে নিয়েছে তাকে। এই সময় আবার গুলি। লরাকে নিয়ে ছিটকে পড়ে গেল রানা, এখন আর আড়াল খোঁজার সময় নেই। লরা দেখল, পেভমেন্টে শুয়ে আছে সে, বডিগার্ড নিজের শরীর দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ ঢেকে রেখেছে। তারপর, কিভাবে বলতে পারবে না সে, মাত্র দুতিন সেকেণ্ডের মধ্যে পেভমেন্টের কিনারায় চলে এল ওরা, একটা দোকানের সামনে। আরও গুলি হল। ওদের মাথার। ওপর জানালার কাঁচ ভাঙল। আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল লরার গলা থেকে। বডিগার্ডের হাতে পিস্তল, দেখল ও, কিন্তু শরীরের পাশে লম্বা করা রয়েছে পিস্তল। ধরা হাত, কারও দিকে তাক করা নয়। বডিগার্ড বুক দিয়ে ঢেকে রেখেছে তার মুখ, তাই কি ঘটছে কিছুই সে দেখল না। শব্দ হল, বন্ধ হল ভ্যানের দরজা। রাস্তার সাথে চাকার ঘর্ষণ, ইঞ্জিনের গর্জন, তারপর আর কোন আওয়াজ নেই।

এখানে অপেক্ষা করুন, নড়বেন না, রানার কণ্ঠস্বর শান্ত, দৃঢ়। উঠে দাঁড়াল ও, লরার সারা শরীর ভারমুক্ত হল। খুব সাবধানে সরল রানা, কাঁচের টুকরোগুলো যাতে লরার গায়ে না পড়ে। স্থির হয়ে শুয়ে থাকল লরা, তাকিয়ে আছে, দেখল গাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে হাসান। হাতের পিস্তলটা অদৃশ্য হয়েছে। গাড়ির পাশে। দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপারে তাকিয়ে আছে সে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লরাও তাকাল। ফিয়াটের বনেটে বুক আর মাথা দিয়ে পড়ে আছে বয়স্ক লোকটা, সাদা। রঙের ওপর জ্বলজ্বল করছে লাল রক্ত পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, মারা। গেছে। গাড়ির পিছনের দরজা খুলে বডিগার্ড ফিরে এল। ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে। ও কাঁপছে, টলমল করছে পা দুটো। ওর পিঠ আর। কাঁধে একটা হাত রেখে ধীরে ধীরে হাঁটতে বলল সে। টলতে টলতে এগোল লরা। লোকজন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আবার চলাচল শুরু করেছে। পেভমেন্টের। কিনারায় দাঁড়িয়ে ফোঁপাচ্ছে একটা মেয়ে। সাইরেনের আওয়াজ পাওয়া গেল, দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওকে ব্যাক সিটে তুলে দিল সে। বলল, নামবেন না! ফিরতে আমাদের দেরি হবে।

লরার তরফ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না।

রানা বলল, পুলিস রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। কাগজপত্র দেখতে চাইবে।

এখনও একটু একটু কাঁপছে লরা। মুখের চেহারা ফ্যাকাসে। সামনের সব কিছু ঝাপসা লাগছে তার, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না। মাথা ঘুরছে। হাত বাড়িয়ে ওর চোখ থেকে কালো চুল সরিয়ে দিল রানা। তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে। লরার গাল স্পর্শ করল। ঠাণ্ডা। ওর চিবুকে হাতের তালু ঠেকিয়ে মুখটা একটু উঁচু। করল রানা, তাকিয়ে আছে লরার চোখে। কোন ভাব নেই দৃষ্টিতে, যেন বহুদূরে তাকিয়ে আছে।

শরীর খারাপ লাগছে? আমার দিকে তাকান।

চোখের মণি জোড়া নড়ে উঠল, ঝাপসা ভাবটা কাটল একটু। রানার দিকে তাকাল লরা। ধীরে ধীরে মাথা দোলাল। এখন আর মাথা ঘুরছে না।

এখানে থাকুন, বলল রানা। পুলিসের সাথে কথা বলে আসি। রাস্তার ওপর ঘ্যাচ করে একটা পুলিস কার থামল। কারের মাথায় আলো ঘুরছে, ঝিমিয়ে আসছে। সাইরেনের আওয়াজ। আরও এক জোড়া পুলিস কার এসে থামল। লোকজনের ভিড়, শোরগোল।

কাজটা রেড ব্রিগেডের, খুন হল একজন প্রসিকিউটিং অ্যাটর্নি। মিলানে এধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। বডিগার্ডের লাইসেন্স বের করে যা যা দেখেছে সব পুলিসকে শোনাল রানা। দুজনের চেহারা বর্ণনা করল ও, কিন্তু এই চেহারার লোক মিলানে হাজার হাজার পাওয়া যাবে। ফোক্সওয়াগেনের নাম্বার দিল ও, কিন্তু প্লেটটা। নিশ্চয়ই চুরি করা।

আধ ঘন্টা পর কোমোর দিকে রওনা হল ওরা। পিছনের সিটে লরা ক্লান্ত, চুপচাপ। বাড়ির দিকে অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছে এই সময় বিস্ফোরিত হল সে। জানোয়ার! রাস্তার ওপর মানুষ মারে, জানোয়ার!

কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

আর আপনিই বা কিছু করলেন না কেন?? সব রাগ রানার ওপর গিয়ে পড়ল লরার। আপনার হাতে আমি পিস্তল দেখলাম, কুকুরগুলোকে গুলি করতে কি হয়েছিল?

আমি একা থাকলে হয়ত করতাম, বলল রানা। ওদের সাথে আরও লোক ছিল, আপনি দেখেননি। ভ্যানের সামনে, হাতে শটগান নিয়ে। আমি, ওর বন্ধুদের গুলি করলে ও তামাশা দেখত না। ভাগ্যের জোরে বেচে গেছি আমরা। ফিয়াটের মালিকও গুলি করেছিল, কয়েক ইঞ্চির জন্যে আমার বা আপনার মাথায় ঢোকেনি। বুলেট।

কথাটা দশ মিনিটের জন্যে চুপ করিয়ে দিল লরাকে। রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে তার দিকে তাকাল রানা। তার নিরাপদ জগৎ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। গোলাগুলি হঠাৎ করে টিভির পর্দা থেকে লাফ দিয়ে উঠে এসে ঠাস করে চড় কষেছে তার গালে। রানা দেখল, নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে লরা, আবার নিজের বিপদমুক্ত জগতে ফিরে আসতে শুরু করেছে। সামনের দিকে ঝুঁকে রানার চুল থেকে কাঁচের খুদে একটা কণা তুলল সে।

আপনি অবশ্য একেবারে হাওয়ায় ভেসে আমার পাশে চলে এলেন, নরম সুরে বলল লরা। আমি আপনাকে দেখতেই পাইনি। ভাগ্যিস আপনি ছিলেন।

বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল গাড়ি। দরজার সামনে থামল।

আমার ব্র্যাণ্ডি দরকার, বলে গাড়ি থেকে নামল লরা। আপনিও আসুন।

লুবনা, বলল রানা, নামল না।

লুবনা?

পৌনে পাঁচটা বাজে।

আরে, তাই তো! ভুলেই গিয়েছিলাম। ঠিক আছে, আপনি যান। পরে আপনার সাথে দেখা করব।

দরজার সামনে, সিঁড়ির ধাপের ওপর দাঁড়িয়ে রানাকে গাড়ি ঘোরাতে দেখল। লরা। গেট দিয়ে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়ি, রানা একবারও ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল না। ধীরে ধীরে দরজার দিকে ফিরল লরা। ভেতরে ঢুকে গ্রাসে ব্র্যাণ্ডি ঢালল, দুতিন চুমুকেই গরম হয়ে উঠল শরীর। সোফায় বসে গোটা দৃশ্যটা স্মরণ করল সে।

তাকে শরীর দিয়ে ঢেকে রেখেছিল লোকটা। তার ওপর শুয়েছিল। আশ্চর্য, একটু নড়ছিল না। একেবারে শান্ত, এতটুকু উত্তেজিত হয়নি। আজই রোমে ফোন করে সব বলতে হবে ভিটোকে। বন্ধু-বান্ধবদেরও জানাবে সে। বিরাট একটা ঘটনা, প্রমাণ হল বডিগার্ড সত্যি দরকার ছিল। তারপর তার মনে পড়ল, লাশের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় লোকটার চেহারায় কোন ভাবাবেগ ছিল না। এরকম লাশ তার আরও অনেক দেখা আছে। ওর গালের ওপর তার হাত এখনও যেন লেগে রয়েছে–শক্ত, কাটা একটা দাগ। এই দাগের ইতিহাস লুবনার কাছ থেকে জেনেছে সে। গভীর, আন্তরিক চোখ দুটো স্থির হয়ে ছিল ওর মুখে। গ্লাসে আরও একটু ব্র্যাণ্ডি নিল সে। ধীরে ধীরে চুমুক দিল।

.

দেরি করে ফেলেছে ও। শরীরটা আগের ফর্মে নেই।

সুটকেস থেকে আজ মদের বোতল বের করেনি রানা। গানও শুনছে না। মনের একটা অংশ অপেক্ষা করছে, আরেকটা অংশ নিজেকে নিয়ে চিন্তায় ব্যস্ত। জানে, আজ যদি লুরা টার্গেট হত, তাকে ও বাঁচাতে পারত না। ছমাস আগে হলে। খুনে তিনজন পাঁচ পা এগোবার আগেই মারা পড়ত ওর হাতে, শটগানধারীকে প্রথমেই পাঠিয়ে দিতে পারত যমের বাড়ি। তিনজনই ওরা এ-লাইনে নতুন, সাহসী অ্যামেচার। তা নাহলে নিহত লোকটা গুলি করার সুযোগ পেত না। লোকটা অবশ্য একটাই গুলি করেছে, সেটাও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, কিন্তু তবু বলতে হয় ভাগ্য গুণে। বেচে গেছে টেরোরিস্টরা। ওদের আসলে উচিত ছিল শট গান দিয়ে কাজ সারা, ভ্যান থেকে নামারও দরকার ছিল না। ডাবল ব্যারেল শটগান, দশ মিটার দূর থেকে গুলি করলে ছাতু হয়ে যেত লোকটা। অথচ তা না করে রাস্তায় নেমে কাছ থেকে পিস্তল ব্যবহার করল। অ্যামেচার।

আবার নিজের কথা ভাবল রানা। তার রিফ্লেক্স অ্যাকশন অসম্ভব ঢিলে হয়ে গেছে।

লরা আজ মারা যেতে পারত।

শরীরটাকে চিরকাল একটা অস্ত্র বলে জ্ঞান করে এসেছে সে। তার অন্যান্য অস্ত্রের মত এটারও যত নিয়েছে। কোথাও চোট খেলে বা জখম হলে সেবা-শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলেছে। এক্সারসাইজ করে প্রতিটি অঙ্গকে উন্মুখ করে রেখেছে, ব্রেনের মেসেজ পেয়ে যাতে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিতে পারে। এখন আর ব্যাপারটা সেরকম নেই। আগের অবস্থা সহজে ফিরিয়ে আনা যাবে না। এ তো আর একটা বন্দুক নয় যে তেল দিলেই আবার সাবলীল হয়ে উঠবে পার্টসগুলো। গোটা জিনিসটা আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে। অনেক সময় আর পরিশ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না, শুধু একটু যা মোটা হয়েছে, কিন্তু অস্ত্রের মালিক জানে জিনিসটায় মরচে ধরেছে। আর হয়ত ধরতে পারবে রেমারিক–একটু ঢিলেঢালা ভাব, মাসল টোনের অভাব। চমৎকার একটা মেশিন কিন্তু অবহেলার শিকার। আবার ওটাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

প্রায় মাঝরাতে মৃদু টোকা পড়ল দরজায়। অপেক্ষার পালা শেষ হল। ঘুমিয়ে থাকার অভিনয় করার ইচ্ছে নেই, তাই দরজা খুলেই রেখেছে রানা। আসতে চায়। আসুক।

সাদা আর লম্বা একটা নাইটড্রেস পরে এসেছে লরা। তার হাতে কনিয়াক ভরা। একটা বেলুন গ্লাস। সিল্ক খসখস করে উঠল, ঘরে ঢুকল সে। গ্লাস ধরা হাতটা রানার দিকে বাড়িয়ে দিল।

গ্লাসটা নিল রানা। ছোট্ট একটা চুমুক দিল। কি করবে মনে মনে ঠিক করা আছে। প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছে। ব্যাপারটাকে কিভাবে নেবে লরা। সবচেয়ে ভাল হয় যদি বোবা সেজে উত্তর এড়িয়ে যাওয়া যায়। কথা না হলে আঘাতটা হয়ত তেমন অনুভব করবে না।

ধীরে ধীরে বিছানার কিনারায় বসল লরা, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রানার পা থেকে কোমর পর্যন্ত ঢাকা রয়েছে চাঁদরে, কোমর থেকে মুখ পর্যন্ত চোখ বুলাল লরা। একটা হাত বাড়িয়ে কাঁধের শুকনা ক্ষতটা আঙুল দিয়ে হালকাভাবে স্পর্শ করল। রানার একটা হাত ধরল সে, হাতটা তুলে নিজের গালে চেপে ধরল, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, দোল খেল কালো চুল, তারপর উঠে দাঁড়াল সে, পিছিয়ে গেল।

সাড়া না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে? ভাবল রানা।

কিন্তু না।

তিন হাত পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লরা, রানার ঠিক নাগালের বাইরে। সাদা সিল্ক খসে পড়ল মেঝেতে। ওর সামনে মেলে ধরল নিজেকে। উত্তেজক কোন ভঙ্গি নয়, পোজ নিয়েও দাঁড়ায়নি, শুধু দেখাচ্ছে। এই আমার সম্পদ, দেখ আমি কি। সুন্দর, তোমাকে দিতে এসেছি। উপহার– যা শুধু আমিই দিতে পারি।

গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে চোখ বুজল রানা। কোন শব্দ নেই। কিছুই শুনল না রানা। তিন মিনিট পর যখন চোখ খুলল, দেখল লরা চলে গেছে।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার চোখ বুজল রানা।

কালই হয়ত নট হয়ে যাবে ওর চাকরি।

.

কাল রাতে তুমি গান শোননি।

প্রায় চমকে উঠল রানা। সে তো অনেক রাতে বাজাই, তুমি জেগে থাক? লুবনার দিকে তাকাল না ও। হাত দুটো আরও শক্ত করে চেপে ধরল স্টিয়ারিং হইল। আজ যতবার কথা হয়েছে লুবনার সাথে, বারবার মনে হয়েছে তাকে ও যেন কিছু বলতে চায়। কাল রাতের ঘটনা টের পেয়ে গেছে নাকি?

জবাব না দিয়ে আরেকটা প্রশ্ন করল লুবনা, ওই গানটার মানে কি? সব শেষে যেটা বাজাও? আমার ঘুম পেয়ে যায়।

ওটা একটা ঘুমপাড়ানি গান।

তাহলে তো ঠিকই ধরেছি!।

প্রসঙ্গ থেকে সরে গেল লুবনা। বলল, আমরা তো ইচ্ছে করলে তোমার পিস্তলটাই ব্যবহার করতে পারতাম।

না। ওটা সে-ধরনের পিস্তল নয়। কোমোয় যাচ্ছে ওরা, লরার ট্রেনিং নিখুঁত করার জন্যে স্টার্টিং পিস্তল কিনবে। হাততালি স্টার্টিং পিস্তলের বিকল্প হতে পারে না।

আওয়াজ হওয়া নিয়ে কথা, তা তো হয়ই, বলল লুবনা।

শুধু আওয়াজ হয় না, বুলেটও বেরোয়।

আকাশের দিকে গুলি করলে অসুবিধে কি?

লুবনা, ওপর দিকে কিছু ছুঁড়লে নিচে সেটা নামবেই, আর এক মাইল ওপর থেকে নেমে আসা, একটা বুলেট বিপজ্জনক হতে পারে।

খবরের কাগজে মন দিল লুবনা, কিন্তু বারবার আড়চোখে রানার দিকে তাকাচ্ছে। খানিক পর হঠাৎ মুখ তুলে জানতে চাইল, তোমার রাশি কি, হাসান?

ভুরু কুঁচকে উঠল রানার। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখল, কাগজে আজকের রাশিচক্র পড়ছে লুবনা।

কিংবা তোমার জন্মদিন বল।

পনেরোই এপ্রিল, হাসানের জন্মদিন বলল রানা।

সেকি! আর তো তাহলে বেশিদিন নেই!হিসেব করল সে। আগামী রোববারে!

তাতে কি?

স্পোর্টসের পরদিনই তাহলে! বাহ, কেক কাটবে না? আথিয়াকে বললে চমৎকার কেক বানাবে

চোখ গরম করে লুবনার দিকে তাকাল রানা। খবরদার, আথিয়াকে কিছু বলবে না। হৈ-চৈ একদম ভাল লাগে না আমার।

বললেই হল! বাবা নিউইয়র্ক যাচ্ছে, সাথে বোধহয় উনিও যাবেন। হঠাৎ একটা আইডিয়া ঢুকল মাথায়। আচ্ছা পিকনিকে গেলে কেমন হয়?

সূক্ষ্ম আভাস, কিন্তু ধরতে পারল রানা। কাল রাতের ঘটনা লুবনা টের পেয়েছে। মা-কে তার সম্বোধন করার ধরন থেকেই বোঝা যায়। অস্বস্তি বোধ করল ও। আড়ষ্ট একটা ভাব ঘিরে ধরল, ওকে।

কি হল, অমন চুপ করে আছ কেন? রানার হাতে একটা হাত রাখল লুবনা। কেমন হবে, বললে না?

কি কেমন হবে? বাস্তবে ফিরে এল রানা।

এতক্ষণ তুমি ছিলে কোথায়? কৃত্রিম রাগে কটমট করে তাকাল লুবনা। জানতে চাইছি, পিকনিকে যাবে কিনা। ইচ্ছে করলে দূরের একটা পাহাড়ে যেতে পারি আমরা।

কিন্তু…এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ নয়, লুবনা।

বলে দাও নিয়ে যেতে পারব না, অভিমানে ঠোঁট ফোলাল লুবনা। কিন্তু টিন্তুর দরকার নেই।

ঠিক আছে, বলল রানা। কিন্তু শনিবারে তোমাকে ফার্স্ট প্রাইজ পেতে হবে, তা না হলে পিকনিক বাদ।

এ অন্যায়! তীব্র প্রতিবাদ জানাল লুবনা। এরকম একটা শর্ত জুড়ে দেয়ার কোন মানে হয় না।

তাহলে আরও ভালভাবে চেষ্টা করবে, বলল রানা। প্রাইজ না পেলে পিকনিক হবে না।

ফেরার পথে লুবনাকে অন্যমনস্ক দেখাল। বাড়ির দরজার সামনে গাড়ি থেকে নামার সময় এক সেকেণ্ড ইতস্তত করল সে। তারপর বলল, আমি কৃতজ্ঞ, হাসান।

পাথর হয়ে বসে থাকল রানা। মুখে কোন কথা যোগাল না। চোখে পানি নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল লুবনা।

.

স্কুলে যাবার পথে একটা কথা ভেবে খারাপ লাগল রানার। আজ স্পোর্টস, ছেলেমেয়েদের অভিভাবকরা সবাই আসবে, শুধু লুবনার মা-বাবা বাদে। ভিটো আর লরা নিউইয়র্কে চলে গেছে। নিশ্চয়ই লুবনা খুব একা আর অসহায় বোধ করবে।

স্কুলের গেট পেরিয়ে শেডে গাড়ি থামাল রানা। লুবনা বলল, নাম, তাড়াতাড়ি নাম!

আমি?

রানার একটা হাত খামচে ধরল লুবনা। তো কে? জলদি, জলদি!

ইতস্তত করল রানা। অভিভাবকরা থাকবে, ওকে ঠিক মানাবে না।

কেউ কিছু মনে করবে না, বলল লুবনা, তার চেহারায় শঙ্কা। রানা কি ভাবছে টের পেয়ে গেছে। আবেদনের সুরে আবার বলল সে, তুমি শুধু আমার বডিগার্ড নও, হাসান, আমার বন্ধু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সেই পরিচয়ই দেব। আমরা।-প্রীজ!

লুবনার ব্যাকুল চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল রানা, তারপর মাথা ঝাঁকাল। গাড়ি থেকে নেমে রানার একটা হাত ধরল লুবনা, ওকে টেনে নিয়ে চলল।

ব্যাপারটা প্রায় একটা সামাজিক অনুষ্ঠানের মত। সাদা আর লাল রঙের। সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, নিচে অসংখ্য চেয়ার। মা-বাবারা ধোপদুরস্ত কাপড় পরে কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। রানাকে রেখে কাপড় বদলাতে চলে গেল লুবনা। এক কোণে সরে দাঁড়াল রানা, অস্বস্তি বোধ করছে। এক মিনিট পর দেখল, ওর দিকে এগিয়ে আসছেন সিনোরা মিরিয়াম। অস্বস্তিটা আরও বেড়ে গেল।

আপনি মি. ইমরুল হাসান, তাই না? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

জ্বি,বলল রানা। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল ও জরুরি কাজে লুবনার মা বাবাকে বিদেশে যেতে হয়েছে।

ওঁরা থাকলে খুব ভাল হত, সিনোরা মিরিয়াম বললেন। কিন্তু আপনি এসেছেন সেজন্যে আমি খুশি। রানার একটা হাত ধরলেন তিনি। আমার সাথে আসুন। অপমান বোধ করবে কিনা ঠিক বুঝতে পারল না রানা। বোঝাই যাচ্ছে। সামিয়ানার নিচ থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। সম্মানিত মেহমানদের সঙ্গে তাকে বসতে দেয়া হবে না।

রানাকে পিছন থেকে সামনের দিকে নিয়ে এলেন সিনোরা মিরিয়াম। আবার ওরা সামিয়ানার নিচে ঢুকল। প্রথম সারির একটা চেয়ার দেখিয়ে রানাকে তিনি বললেন, আপনি এখানে বসবেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে একজন বেয়ারাকে ডেকে রানাকে ড্রিঙ্ক দিতে বললেন।

একটু পরই শুরু হল প্রতিযোগিতা। বসন্তের দিন, না শীত না গরম। মেয়েরা, অনেকেই কিশোরী আর তরুণী, খুদে শর্টস পরে থাকায় ভাল লাগছে।

তারপর হানড্রেড মিটার দৌড়ের জন্যে হাজির হল লুবনা। রানা দেখল, ওর। মত কেউ নয়। রূপে, লাবণ্যে, লম্বায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে লুবনা। দেখল সে। শুধু একা নয়, লুবনার দিকে যারই চোখ পড়ছে আটকে যাচ্ছে দৃষ্টি।

মেয়েরা তৈরি হচ্ছে, তীক্ষ্ণ সমালোচনার দৃষ্টিতে লুবনার দিকে তাকিয়ে আছে রানা, মনের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে উদ্বেগ। লুবনা প্রাইজ না পেলে খারাপ লাগবে ওর।

উদ্বেগের কোন কারণ ছিল না। এত পরিশ্রমের ট্রেনিং সার্থক হয়েছে। শুরুটা চমৎকার হল লুবনার, কেউ শুরু করার আগেই প্রাচ পা এগিয়ে থাকল ও। লাল টেপটা যখন ওর বুক স্পর্শ করল, সবচেয়ে কাছের মেয়েটা তখন দশ গজ পিছনে পড়ে আছে।

দৌড় শেষ, কিন্তু থামল না লুবনা। ঘুরে আবার ফিরে আসছে সে। দর্শকরা, মনে করল, কতটা দম রাখে মেয়েটা বোধহয় সেটাই দেখাতে চাইছে। সবার চোখ তার ওপর স্থির হয়ে থাকল।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। ঘাবড়ে গেছে ও। এ কি করছে লুবনা!

সোজা ছুটে এল সে। কারও দিকে তাকাল না। সোজা একেবারে রানার। বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল রানা। শান্ত হও, লুবনা, শান্ত হও! কান্নার কি আছে, এ তো খুশির ব্যাপার! কিন্তু আর কেউ না। জানলেও, রানা জানে, মা-বাবার কথা ভেবে কাঁদছে লুবনা। বাবা তাকে সঙ্গ দেয় না, আর মা…মাকে সে ঘৃণা করে। আজকের এই আনন্দের মুহূর্তে যাকে সবচেয়ে। বিশ্বাস করে সে, যাকে তার ভাল লাগে, নিজের এই অন্তহীন বেদনার কথা তার কাছে এভাবেই প্রকাশ করে ফেলল মেয়েটা।

বুদ্ধিমতী মেয়ে, লোকে হাসাহাসি শুরু করার আগেই সামলে নিল নিজেকে। রানার শার্টে মুখ ঘষে চোখের পানি শুকিয়ে নিল। রানাকে ছেড়ে দিয়ে পাশে তাকাল লুবনা, দেখল, চেহারায় উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সিনোরা মিরিয়াম। হেডমিসট্রেসকে চুমো খেল সে, তারপর আলিঙ্গন করল। হাসি ফুটল বৃদ্ধার মুখে। ইতিমধ্যে আরেকটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, কেউ ওদের দিকে তাকিয়ে নেই।

একটু পরই বান্ধবীদের কাছে চলে গেল লুবনা। যাবার সময় দেখল, হাসান তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এই প্রথম ওকে হাসতে দেখল সে। আশ্চর্য মিষ্টি হাসি তো!

.

হ্যাপি বার্থডে, হাসান।

নরম মখমলের মত সবুজ ঘাসে শুয়ে আছে রানা, মুখ তুলে তাকাল। লুবনার হাতে সোনালি রঙের কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট। কি ওটা? জানতে চাইল রানা।

জন্মদিনের উপহার।

আমি না তোমাকে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করেছিলাম?

রানার পাশে, ঘাসের ওপর বসে পড়ল লুবনা। তুমি ট্রেনিং না দিলে ফাস্ট হতাম? তাই ধন্যবাদ জানালাম আর কি।

উঠে বসল রানা। প্যাকেটটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল, কিন্তু খুলল না। আড়চোখে তাকিয়ে লক্ষ করল, লুবনার চেহারা একটু ম্লান হল। প্যাকেটটা ঘাসের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল ও।

গাড়ির কাছে ফিরে এল রানা। পিছু পিছু লুবনাও এল। গাড়ি থেকে পিকনিক বাস্কেট আর টু-ইন-ওয়ানটা নিয়ে আবার ওরা ঢালের মাথায়, সবুজ ঘাসে চলে এল। টু-ইন-ওয়ান নিয়ে আসার বুদ্ধিটা লুবনার। হয়ত ক্যাসেট উপহার দিয়েছে, ভাবল রানা। ওর বাবার সাথে গত হপ্তায় মার্কেটিং করতে গিয়েছিল, তখনই কিনে থাকবে। ক্যাসেট হয়ে থাকলে ভালই, দামি কিছু বা লজ্জায় পড়তে হয় এমন কিছু না হলেই হল।

ঘাসের ওপর হলুদ রঙের একটা চাদর বিছাল লুবনা। তারপর দুজন মিলে বাফেট থেকে জিনিসপত্র নামাতে শুরু করল। খুব যতের সাথে পিকনিক লাঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে আথিয়া। একটা করে জিনিস নামাচ্ছে আর ব্যাখ্যা করছে লবনা। মুরগীর ঠাণ্ডা রোস্ট, ওমলেট, ক্রীম আর মাখন দিয়ে মোড়া মচমচে রুটি, তিন রকম ফল, কাগজে মোড়া দুবোতল ওয়াইন, এখনও বরফের মত ঠাণ্ডা।

জায়গাটা লেক ম্যাগিওর-এর অনেক ওপরে, গরমের দিনে রাখালরা এখানে। গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে আসে। ফাঁকা মাঠ নয়, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক পাইন গাছ। দূরে উত্তর আর পশ্চিমে ক্রমশ উঁচু হয়ে। সুইটজারল্যাণ্ডের দিকে উঠে গেছে তুষারে মাথা টাকা পাহাড়গুলো। ওদের সামনে, দক্ষিণে, পো ভ্যালি-সেই দিগন্তরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত।

কিছুক্ষণের মধ্যে হলুদ চাঁদরে ছড়িয়ে পড়ল টিন ফয়েল আর পাষ্টিক প্লেট। দুটো গ্লাসে ওয়াইন ঢালল রানা। বলল, ভোতর সাতে।

অর্থ?

ফ্রেঞ্চ। মানে, চিয়ার্স।

য়ামসিং, জবাবে বলল লুবনা, রানার চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখে হেসে খুন হল সে। চাইনিজ।

জানি, কিন্তু কিভাবে…? তারপর মার্কো পোলোর বইটার কথা মনে পড়ল রানার। কিছুই বাদ দেয়নি লুবনা, সব গোগ্রাসে গিলেছে।

এরপর ভাষা নিয়ে আলোচনা শুরু হল। ওকে একটা কৌতুক শোনাল রানা।

টেক্সাসের এক লোক জীবনে প্রথম ইউরোপে এসেছে। প্যারিসে এসে কয়েকদিন থাকল সে। প্রথম রাতে হোটেলের চীফ স্টুয়ার্ড ডিনার টেবিলে তাকে একজন ফরাসীর সাথে বসাল। ফরাসী লোকটা ইংরেজি জানে না। খাবার পরিবশেন করা হল, ফরাসী লোকটা মৃদু হেসে বলল, বন আপেতিত। টেক্সান। ভাবল, লোকটা বোধহয় নিজের পরিচয় জানাচ্ছে। উত্তরে সে-ও মৃদু হেসে বলল, রয় ডিকসন। এই রকম চলল পর পর পাঁচদিন।

শেষদিন ডিনারের আগে টেক্সান লোকটা বারে বসে হুইস্কি খাচ্ছে, এই সময়। একজন আমেরিকানের সাথে তার পরিচয় হল। ফরাসীরা অদ্ভুত মানুষ, কোন। সন্দেহ নেই, কথায় কথায় মন্তব্য করল টেক্সান।

কি রকম?

তখন ফরাসী লোকটার আচরণ ব্যাখ্যা করল টেক্সান। বলল, এই কদিনে কম করেও বারো থেকে পনেরো বার দেখা হয়েছে আমাদের, প্রতিবারই লোকট আমাকে নিজের পরিচয় জানিয়েছে।

কি নাম তার?

বন আপেতিত।

গলা ছেড়ে হেসে উঠল দ্বিতীয় আমেরিকান। বলল, ওটা, ফরাসী লোকটার নাম নয়। এ এক ধরনের শুভেচ্ছা, খাওয়াটা যেন আনন্দময় হয়।

বলাই বাহুল্য, টেক্সান লোকটা খুব লজ্জা পেল। সে-রাতে ডিনারে বসে। ফরাসীর দিকে তাকিয়ে মদু হাসল সে, বলল, বন আপেতিত।

একগাল হেসে ফরাসী লোকটা জবাব দিল, রয় ডিকসন।

হাততালি দিয়ে হেসে উঠল লুবনা। হাত বাড়াল রানা। সোনালি প্যাকেটটা তুলে নিয়ে ফিতে খুলতে শুরু করল। ভেতর থেকে প্রথমে সত্যিই একটা ক্যাসেট বেরুল, কিন্তু সাথে আরও কিছু রয়েছে। রানার দিকে তাকিয়ে আছে লুবনা, হাসি থেমে গেছে তার। একটা অ্যালবামও রয়েছে, তাতে শুধু লুবনার ছবি। ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হয়ে গেল রানা। সেই ছোটবেলা থেকে তার যত ফটো তোলা হয়েছে, বেশিরভাগই রয়েছে অ্যালবামে। অনেকগুলো ছবি কাচি দিয়ে কাটা, লুবনার পাশে যে বা যারা ছিল তারা বাদ পড়েছে। বাড়ির সবার সঙ্গে ফটো রয়েছে লুবনার, কিন্তু শুধু তার মায়ের সঙ্গে তোলা কোন ফটো নেই। কাটা অংশগুলোয় কে ছিল, পরিষ্কার বোঝা যায়।

লুবনার দিকে একবার শুধু মুখ তুলে তাকাল রানা, কিছু বলল না।

আর রয়েছে কালো মখমলে মোড়া খুদে একটা বাক্স। বাক্সটা খুলে অবাক। হয়ে গেল রানা। ভেতরে খুব ছোট্ট একটা কোরান শরিফ, ইংরেজি অনুবাদ, সাথে চকচকে ইস্পাতের হাতলওয়ালা একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস।

উপহারের প্রতিটি জিনিস একটা করে তাৎপর্য বহন করে। কোরান শরীফ উপহার পাওয়ার কারণটা বুঝল রানা। ধর্ম নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। এই বয়সের যা স্বভাব, কখনও যুক্তির ওপর নির্ভর করতে চায় লুবনা, আবার। কখনও বিশ্বাসের ওপর। তবে তার ঝোঁকটা বিশ্বাসের দিকেই বেশি। ধর্ম নিয়ে বোকার মত তর্ক করেনি ওরা। যার যার ধারণা, অভিজ্ঞতা, এই সব পরস্পরকে শুনিয়েছিল মাত্র।

নাপাম বোমায় দগ্ধ একটা শিশু, কি তার অপরাধ? এটা তো তার পাপের শাস্তি হতে পারে না। কিশোরী একটা মেয়ে, বারবার তাকে ধর্ষণ করা হল, কিন্তু সৃষ্টি কর্তাকে ডেকেও বেচারা সাড়া পেল না। স্যাডিস্ট এক লোক একজন সন্ন্যাসিনীর ওপর অত্যাচার চালিয়ে বহাল তবিয়তে শেষ বয়েসে মারা গেল। এরপর তার শাস্তি হবে? সারাটা জীবন নিরীহ মানুষকে নরকযন্ত্রণায় ভোগাবার। পর? এসবের ভেতর যুক্তি কোথায়?

ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করতে দেখা যায়। ধর্মের নামে নোংরা রাজনীতি চলে। শেষ পর্যন্ত লাভবান হয় কারা? হ্যাঁ, সুবিধাভোগী একটা শ্রেণী।

ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার ফিলিপাইনে গিয়েছিল লুবনা। সে-সময় পোপ ওখানে সফর করছিলেন। এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাথলিক দেশ ফিলিপাইন, আর সম্ভবত গরিব দেশগুলোর একটা। দারিদ্রের সাগরে সুন্দর সুন্দর সব চার্চ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের দূর-দূরান্ত থেকে পোপের সাথে দেখা করার জন্যে ম্যানিলায় আসছিলেন বিশপরা। বাবার সাথে লুবনাও আসছিল ম্যানিলায়। ছয়জন। বিশপ ওদের সহযাত্রী ছিলেন। ফার্স্টক্লাসে ভ্রমণ করছিলেন তাঁরা, সবাই শ্যাম্পেন। খাচ্ছিলেন। কোথায় যুক্তি?

আবার অন্য রকম ঘটনাও আছে। জিপ নিয়ে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তের একটা গ্রামে গিয়েছিল রানা, সাথে রেমারিকও ছিল। ওখানে একটা ছোট হাসাপাতাল ছিল। আর ছিল একটা মসজিদ। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আক্রমণের ভয়ে গ্রাম খালি হয়ে গিয়েছিল, থাকার মধ্যে শুধু মসজিদের ইমাম সাহেব আর। হাসপাতালের কয়েকজন নার্স আর দুজন মহিলা ডাক্তার ছিল। যুদ্ধের একটা কৌশল হিসেবে প্যালেস্টাইনী গেরিলারা ইসরায়েলিদের ভেতরে ঢুকতে দেবে, কোন রকম বাধা দেবে না। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বোঝানো হল ইমাম সাহেব। আর ডাক্তারদের। কিন্তু গ্রাম ছাড়তে ওদের কাউকে রাজি করানো গেল না। ইমাম সাহেবের যুক্তি, তিনি মসজিদ ছেড়ে বিশ বছর নড়েননি, আজও নড়বেন না। ডাক্তারদের কথা, রোগীদের ছেড়ে তাঁরাও যাবেন না, গেলে পাপ হবে। এখানে থাকলে কি ঘটতে পারে, ব্যাখ্যা করে বলল রানা। কিন্তু ওর কোন কথাই কানে। তুলল না তারা। শেষ পর্যন্ত জোর খাটাবার চেষ্টা করেও কোন ফল হল না। যারা হাসিমুখে নিরাপত্তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় তাদের ওপর কিভাবে জোর খাটানো যায়?

ফেরার জন্যে গাড়িতে বসে আছে রানা, ফিরে যেতে মন চাইছে না। সুন্দরী। একজন ডাক্তারকে ডেকে তার সাথে আবার কথা বলল ও। বলল, আপনি। সবচেয়ে বেশি ভুগবেন। ওরা আপনাকে ছিঁড়ে খাবে।

উত্তরে মৃদু হেসে ডাক্তার বলল, আমাদের সাথে খোদা আছেন।

ওদের ইউনিট অনেক পিছিয়ে আসে, ইসরায়েলি সেনাদের মাঝারি একটা গ্রুপ সীমান্ত পেরিয়ে বেশ অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়ে। তাদের ঘিরে ফেলা হয়, এবং সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে গোটা গ্রুপটাকে নিশ্চিহ্ন করা হয়। সেই গ্রামে আবার ফিরে এসেছিল ওরা। মসজিদের ভেতর ইমাম সাহেবের লাশ দেখে। হাসপাতালে এল ওরা। ওখানে যা দেখল, চিরকাল ওদের মনে থাকবে।

কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ল ওরা, গর্তের ভেতর মেয়েদের যা অবশিষ্ট ছিল ফেলে মাটি চাপা দিল। সেই রাতেই রেমারিক আর রানা অসম্ভব একটা কাজ করে। বসে। ইসরায়েলি সীমান্ত পেরিয়ে একটা ঘাঁটির ওপর আকস্মিক হামলা চালায় ওরা। শক্ররা প্রস্তুত ছিল না, থাকার কথাও নয়। জীপ নিয়ে ঘাঁটির ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা। রেমারিক জীপ চালাল, আর মেশিনগানে থাকল রানা। ঘাটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পাঁচবার আসা-যাওয়া করল ওরা। সৈনিকরা বেশিরভাগ তাঁবুর ভেতর ঘুমিয়ে ছিল, সম্ভবত যুবতী ডাক্তারকে যতজন ধর্ষণ করেছিল তারচেয়ে বেশি লোককে সে-রাতে খুন করে রানা। কি বলবে? খোদার ইচ্ছে? খোদার প্রতিশোধ?

আলোচনার উপসংহার টেনেছিল লুবনা। আসল কথা বিশ্বাস। নিশ্চিতভাবে জানলে তো আর তোমার বিশ্বাসের দরকার হচ্ছে না। যতদিন না উল্টোটা কেউ প্রমাণ করতে পারছে, ধর্মে তার বিশ্বাস থাকবে।

প্রমাণ হয়েছে কিনা তুমি জানবে কিভাবে?জিজ্ঞেস করেছিল রানা।

সহজ-সরল জবাব ছিল লুবনার, টেলিভিশনে ঘোষণা করা হবে।

.

এ-সব আমি নিজে কিনেছি, বলল লুবনা। আমার নিজের জমানো পয়সা দিয়ে।

কথা না বলে তাকিয়ে থাকল রানা।

ক্যাসেটটা শুনবে না?টু-ইন-ওয়ানে নিজেই ক্যাসেট ভরল লুবনা।

ইতালির গান, কিন্তু ইংরেজিতে গাওয়া। গানের কথাগুলো শুনতে শুনতে অন্য এক জগতে চলে গেল রানা।

এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না। আর, হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে। নিয়ে আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভেব আমি আর বেশি দূরে নেই। তারপর, হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছি। সে-রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পোড়ো না!

গান শেষ হবার পর অনেকক্ষণ কেউ কথা বলল না। তারপর বিষণ্ণ একটু হেসে লুবনা নিস্তব্ধতা ভাঙল, তুমি আমাকে ঘুম পাড়াতে চাও, তাই না, হাসান? কিন্তু আমি, তোমাকে জাগিয়ে রাখতে চাই। একদিন ছাড়াছাড়ি হবে, তখন কিন্তু আমার কথা ভুলে যেয়ো না। গানের কথাগুলো শুনলে তো? সবচেয়ে বড় তারাটা মিট মিট করলে বুঝবে সত্যিই আমি তোমাকে জেগে থাকতে বলছি।

দুজন রাখাল তাদের গরুর পাল নিয়ে ঢালের ওপর উঠে এল, সাথে একটা কুকুর। কুকুরটাকে দুটুকরো, রুটি খেতে দিল লুবনা, অমনি তার সঙ্গে ওর ভাব। হয়ে গেল, শুরু হয়ে গেল ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া। রাখাল দুজনকে ওয়াইন খেতে দিল রানা।

সূর্য অস্ত যাবার একটু আগে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠল ওরা। ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে লুবনা, ফেরার পথে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। তার মাথা রানার কাঁধে ঠেকে থাকল। খুব সাবধানে গাড়ি চালাল রানা, লুবনা। যাতে ঝাঁকি না খায়।

দুষ্টু মেয়েটাকে সত্যিই ভালবেসে ফেলেছে ও।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত