অগ্নিপুরুষ: ১.৫-৬ লোরান যেমন আশা দিয়েছিল

অগ্নিপুরুষ: ১.৫-৬ লোরান যেমন আশা দিয়েছিল

১.৫-৬ লোরান যেমন আশা দিয়েছিল

০৫.

লোরান যেমন আশা দিয়েছিল, বডিগার্ড পাওয়া ভিটোর জন্যে তেমন সহজ হয়নি। লরার পছন্দ হবে এই রকম একজনকে বেছে বের করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তার।

বডিগার্ডের ব্যবস্থা হবে, এই কথা শোনার সাথে সাথে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল বাড়িতে, বডিগার্ড যেন নতুন একটা গাড়ি বা এক সেট অলঙ্কার। তখুনি প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে বসে যায় লরা। অনেক তর্কাতর্কির পর তার সিদ্ধান্তই বহাল থাকল, বডিগার্ড বাড়ির ওপরতলায় বড় একটা কামরায় থাকবে। লরা আর লুবনা। নিজেরাই ধরাধরি করে কিছু অতিরিক্ত ফার্নিচার নিয়ে গেল সেই ঘরে। দুজনেরই কনুই আর আঙুল ছড়ে গেল। মেহগনি কাঠের বিশাল একটা খাট আগে থেকেই। ছিল ওখানে, এবার জায়গা পেল বড় একটা ইজি চেয়ার, ছোট একটা টেবিল, একটা চেস্ট অভ ড্রয়ার, একটা ওঅরড্রোব। ঠিক হল বডিগার্ড আথিয়া আর লার্দোর সাথে কিচেনে বসে খাবে।

বডিগার্ডের কি কি কাজ হবে তারও একটা তালিকা তৈরি করে ফেলল লরা। লুবনাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আর বিকেলবেলা ফিরিয়ে নিয়ে আসা, এটাই তার সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ কাজ। এই দুটো কাজের মাঝখানে লরাকে সে মার্কেটে বা লাঞ্চ খেতে নিয়ে যাবে।

লোকটাকে কেমন হতে হবে তারও একটা রূপরেখা তৈরি করে দিল লরা। লোকজনের সামনে তাকে যেন বের করা যায়। আদবকায়দা জানতে হবে তার, হতে হবে দ্র আর বিনয়ী। আর একেবারে গুণ্ডা-পাণ্ডা মার্কা চেহারা হলে চলবে না। আদেশ নয়, স্বামীর হাত ধরে অনুনয়-বিনয় করে বলল সে, একটু যেন। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করা হয়। লুবনার নতুন স্কুল টার্ম শুরু হতে যাচ্ছে, তাছাড়া, ভিটোর সাথে এবার সে-ও প্যারিসে যেতে চায়।

এসবই সমস্যা হয়ে দেখা দিল। প্রথম দুজন প্রার্থীকে দেখামাত্র বিদায় করে। দিল ভিটো। দুজনেই রাস্তা থেকে উঠে আসা গুপ্তা, লরা ওদেরকে দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেবে না। তৃতীয় লোকটা বুড়ো, চার নাম্বার প্রার্থীর বা চোখ নেই। এজেন্সি অফিসে ফোন করে ভিটো অভিযোগ করল, বেছে বেছে শুধু আজেবাজে লোককে পাঠাবার মানে কি। জবাব এল, বডিগার্ডের এখন খুব অভাব, তাছাড়া, এই বেতনে এর চেয়ে ভাল কোন লোক কাজটা নিতে চাইছে না।

পরদিন এজেন্সি থেকে একটা ফোন পেল ভিটো। আরও একটা লোককে পাঠাচ্ছে ওরা। সে একজন বাংলাদেশী।

তেমন উৎসাহ বোধ করেনি ভিটো। বাড়িতে একজন বিদেশী লোক থাকবে, এর জন্যে সে মানসিকভাবে তৈরি ছিল না। মনে মনে লোকটার একটা ছবি আঁকল সে। কালো মোষের মত চেহারা, চোখ দুটো টকটকে লাল, সারাক্ষণ চুইংগাম চিবাচ্ছে।

তাই লোকটাকে যখন তার অফিসে হাজির করা হল, একাধারে খুশি আর বিস্মিত হল ভিটো। নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক, মুখে থমথমে গাম্ভীর্য, কিন্তু চোখ দুটোয় মায়া আছে। সবচেয়ে ভাল লাগল লোকটার রুচি। পরনে ঘন নীল সুট, পপলিনের সাদা শার্ট। হাতে একটা বড় এনভেলাপ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ভিটোর দিকে তাকিয়ে আছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে কাছে ডাকল ভিটো, এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে ডেস্কের সামনে বসল রানা। তারপর এনভেলাপটা বাড়িয়ে দিল। এজেন্সি থেকে আপনাকে এটা পাঠিয়েছে।

খুশির মাত্রা আরও একটু বাড়ল ভিটোর। লোকটা বিশুদ্ধ ইটালীয়ান বলে। এনভেলাপটা নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কফি? এর আগে যারা এসেছে তাদের সে। কফি খেতে বলেনি।

মাথা নাড়ল রানা।

সীল ভেঙে এনভেলাপ খুলল ভিটো। ভেতরে অনেকগুলো কাগজ। পড়তে শুরু করল সে। ইমরুল হাসানের কোয়ালিফিকেশন আর ইতিহাস। রেমারিকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো সাজিয়ে লিখে পাঠিয়েছে এজেন্সি।

পড়া শেষ করে মুখ তুলল ভিটো। রানার দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে। থাকল সে। রানাও তাকিয়ে আছে, চোখে কোন ভাষা নেই।

অসুবিধেটা কি? জানতে চাইল ভিটো। অসুবিধে যে একটা কিছু আছে, এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই। ওর যা কোয়ালিফিকেশন, ওকে একটা দুর্গ পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। অথচ সামান্য বেতনে একটা মেয়েকে পাহারা দেয়ার কাজ করতে চাইছে।

আমি মদ খাই, সোজা-সাপ্টা স্বীকার করল রানা।

ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময় নিল ভিটো। আবার সে কাগজগুলোর ওপর চোখ বুলাল। খারাপ দিকটা কি?

চোখ কুঁচকে চিন্তা করল রানা, ভিটো অনুভব করল খাঁটি সত্যি কথাই শুনতে পাবে সে।

হয়ত আমার রিয়্যাকশন টাইম ঠিক থাকবে না। ঝট করে গুলি করতে হতে পারে, আমি হয়ত একটু দেরি করে ফেলব। দূর থেকে মাথায় গুলি করলাম, কিন্তু লাগল হয়ত বুকে। আপনার জায়গায় আমি হলে, আর আমি যদি জানতাম আমার পরিবারের ওপর হামলা হতে পারে, এই রকম একটা লোককে চাকরি দিতাম না।

ভিটো জানতে চাইল, মদ খেয়ে-মানে, লোক হাসান?

মাথা নাড়ল রানা। টেরও পাবেন না। আমি শুধু রাতে খাই। সকালে আমার খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু দেখে কিছু বোঝা যাবে না।

আরেকবার কাগজগুলোর ওপর চোখ বুলাল ভিটো। লরা যদি মদ খাওয়ার। কথাটা না জানে, আর তো কোন সমস্যা নেই। বেতন কিন্তু খুব কম।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। আপনার মেয়েকে যদি টপ প্রফেশন্যালরা কিডন্যাপ করার চেষ্টা করে, বেতনের চেয়ে কম সার্ভিস পাবেন না।

কিন্তু যদি অ্যামেচাররা চেষ্টা করে?

ওরা যদি সত্যি অ্যামেচার হয়, স্রেফ ভয় দেখিয়েই ভাগিয়ে দিতে পারব, কিংবা হয়ত খুন হয়ে যাবে। সেরকম কোন ভয় আদৌ আছে নাকি?

মাথা নাড়ল ভিটো। বোধহয় নেই। আসলে, ভয়টা আমার স্ত্রীর। ইদানীং অনেকগুলো ছেলেমেয়ে কিডন্যাপ হল তো, আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ভাল কথা, ওকে এখানে-সেখানে আনা-নেয়া করাও আপনার ডিউটির মধ্যে পড়বে। ওর নিজের গাড়ি আছে। কাগজগুলোর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভাবল সে, ভাড়াটে যোদ্ধা ছিল এই লোক, কয়শো লোককে খুন করেছে কে জানে! আরেকটা কথা, আপনাকে কিন্তু একটু ঘরমুখো হতে হবে। ইঙ্গিতে কাগজগুলো দেখাল সে। এখানে দেখছি আপনি শুধু বাইরে বাইরে ছুটে বেড়িয়েছেন।

ওটা কোন সমস্যা হবে না, বলল রানা। তবে, আমি ঠিক সামাজিক নই। কাজটা করব, যতটা ভালভাবে পারি, তার বেশি আমার কাছ থেকে কিছু আশা করবেন না।

বেশ, বলল ভিটো। তাড়াতাড়ি জয়েন করতে পারবেন তো?হঠাৎ একটা চিন্তা এল। আপনার আর্মস আছে?

মাথা ঝাঁকাল রানা। এজেন্সি থেকে দেবে। ওদেরকে আপনার একটা চিঠি দিতে হবে। পুলিস পারমিটের ব্যবস্থা করবে ওরা। এর জন্যে বিল করবে এজেন্সি, আপনি দেবেন। উঠে দাঁড়াল ও। যে-কোন সময় জয়েন করতে পারি আমি।

রানার সাথে ভিটোও দরজা পর্যন্ত এল। হপ্তার ছুটিতে কাল আমি কোমোয় যাব। জিনিসপত্র নিয়ে দয়া করে কাল ছটায় চলে আসুন এখানে। ভাল কথা, আপনার মদ খাওয়ার কথা কারও জানার দরকার নেই, আমার স্ত্রীরও না।

রানার সাথে করমর্দন করল ভিটো।

ধন্যবাদ।

ভিটো বলল, চাকরির মেয়াদ সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারছি না। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তবে এজেন্সির সাথে আমার তিন মাসের কথা, ১ হয়েছে, এই তিনমাসকে ট্রায়াল পিরিয়ড হিসেবে ধরা হবে। তারপর আমরা দুজনেই নতুন করে চিন্তা করব। এমনও তো হতে পারে, চাকরিটা হয়ত আপনার ভাল লাগল না।

লাউঞ্জে রয়েছে লরা, ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর সামনে। সাদামাঠা একটা কালো ড্রেস পরে আছে সে, মুখ কালো চুলের ফ্রেমে বাধানো সাদা একটা চাঁদের আকৃতি। ভেতরে ঢুকল ওরা, ভিটোর পাশে দাঁড়াল রানা। ভিটোর চেয়ে অনেক লম্বা ও।

ধীরে ধীরে ফিরল লরা, স্বামীর দিকে এক সেকেণ্ডের জন্যে তাকাল, তারপর রানার ওপর আটকে গেল দৃষ্টি। রানাকে আপাদ মস্তক দেখছে সে, ভিটো পরিচয় করিয়ে দিল। লরার মনের ভাব চেহারায় ফুটল না, মৃদু গলায় সে জিজ্ঞেস করল,

আপনাকে ড্রিঙ্ক দেব?

ধন্যবাদ–স্কচ, সামান্য পানি।

বারের দিকে এগোল লরা, ওরা দুজন ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর সামনে এসে দাঁড়াল। লেকের দিকে তাকিয়ে রানা ভাবল, লোকটা ঠিক সহজ হতে পারছে না, কারণটা কি? ওর জন্যে স্কচ আর স্বামীর জন্যে মার্টিনি নিয়ে ফিরে এল লরা।

নামটা ভাল করে শুনতে পাইনি।

হাসান।

আপনি ইটালিয়ান নন, বলল লরা। কোন্ দেশের লোক, বুঝতে পারছি না।

বাংলাদেশী।

ভুরু একটু কুঁচকে উঠল লরার, স্বামীর দিকে একবার তাকাল।

কিন্তু উনি খুব ভাল ইটালিয়ান বলতে পারেন, তাড়াতাড়ি বলল ভিটো।

তথ্যটা লরাকে স্পর্শ করল বলে মনে হল না। আগে কখনও এই কাজ করেছেন?

না।

লরার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠছে দেখে হড়বড় করে ভিটো বলল, উনি একজন যোদ্ধা ছিলেন। এত জায়গায় যুদ্ধ করেছেন, তুমি অবাক হয়ে যাবে।

লোকটাকে রানার আত্মবিশ্বাসী আর নিজের ব্যাপারে নিঃসংশয় বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন তাকে বেশ খানিকটা অসহায় দেখাল। পরাজয়টা হয়ত স্ত্রীর রূপের কাছে, নাকি ব্যক্তিত্বের কাছে?

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রানাকে লক্ষ করছে লরা। কাপড়ের কাটছাট বা রঙ চিৎকার। করে কিছু বলছে না, এটা তার ভাল লাগল। গ্লাস ধরা হাতের উল্টোপিঠে একটা। কাটা দাগ। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, অনেক লম্বা। কিন্তু বয়সটা আন্দাজ করতে গিয়ে হোঁচট খেল সে। পয়তাল্লিশ, নাকি আরও বেশি? চোখের পাতা জোড়া ভারি, চোখ দুটো সুন্দর, কিন্তু অদ্ভুত একটা ঠাণ্ডা দৃষ্টি ফুটে আছে, সাপের মত। গা শির শির করে উঠল তার। লোকটা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে যে-কেউ ভয় পাবে।

এখানেই একটা ধাক্কা খেল লরা। পুরুষমানুষ দেখে ভয় পাবার মেয়ে নয় সে। দেখামাত্র এই প্রথম কোন পুরুষ ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

নিস্তব্ধতা ভাঙল ভিটো। লুবনা কোথায়, ডারলিং?

বাস্তবে ফিরে এল লরা। ওপরে। এখুনি নামবে ও।

ভিটো লক্ষ করল, লরার ইতস্তত ভাবটা আর নেই, কিন্তু তার জায়গায় বিমূঢ় একটা ভাব দেখা যাচ্ছে।

ক্ষীণ একটু হাসল লরা, রানাকে বলল, আমার মেয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে। বডিগার্ড ওর কাছে একটা খেলনার মত।

আমিই প্রথম? জিজ্ঞেস করল রানা।

হ্যাঁ। আপনি সুন্দর ইটালিয়ান বলেন–নিয়াপলিটানদের মত।

ওদের একজনের কাছ থেকেই শিখেছি।

ওখানে আপনি ছিলেন?

না, আসা-যাওয়া ছিল।

দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘুরল রানা।

মেয়েটা সাদা টি-শার্ট আর জিনস পরে আছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রানাকে দেখছে সে।

ওর মা বলল, লুবনা, ইনি মি ইমরুল হাসান।

ধীর পায়ে হেঁটে এল সে, কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিল হাতটা। তাকে। ছোট মনে করে কেউ যেন হালকা চোখে না দেখে, ভাবটা এই রকম। মেয়েটা রানার বুক পর্যন্ত লম্বা। ছোট্ট হাতটা ওর হাতের ভেতর হারিয়ে গেল, সেটা ধরে। নাড়ার সময় তার চোখে খুশির ঝিলিক আর চাপা উত্তেজনা দেখল রানা।

মি. হাসানকে তার কামরাটা দেখিয়ে দেবে? লরা বলল।

গ্লাসটা খালি করল রানা, ভক্তি মেশানো গাম্ভীর্যের সাথে ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল লুবনা।

.

দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে বিস্ফোরণের অপেক্ষায় কান পাতল ভিটো। কিন্তু টু শব্দটিও না করে নিজের গ্লাসে চুমুক দিল লরা।

লোকটা কিন্তু খুব অভিজ্ঞ,বলল ভিটো।

লরা নিরুত্তর।

বিদেশী, এই যা, আবার বলল ভিটো। কিন্তু ভাল ইটালিয়ান বলে, আমাদের কোন অসুবিধে হবে না।

ইটালিতে আগে কখনও কাজ করেছে?লরা জানতে চাইল।

না

ব্রিফকেস খুলে এজেন্সির দেয়া রিপোর্টটা স্ত্রীকে দিল ভিটো। ওর ব্যাকগ্রাউণ্ড।

সোফায় বসে কাগজগুলো দেখল লরা। বারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ভিটো, আরেকটা মার্টিনি বানাল। পড়া শেষ করে কাগজগুলো কফি টেবিলে রাখল লরা। লোকটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

ঝট করে স্ত্রীর দিকে ফিরল ভিটো। কি বললে?

মৃদু হাসল লরা। বিদেশী হওয়াতে বরং সুবিধে হয়েছে, আমাদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করার স্বপ্ন দেখবে না। অত সাহসই হবে না ওর।

কিন্তু তোমার ভয় লাগছে কেন?

কি যেন চিন্তা করল লরা। কি জানি। কাগজগুলোর দিকে তাকাল সে। উত্তরটা হয়ত এগুলোর মধ্যে আছে। আসলে, তুমি একটা খুনেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছ। কত লোককে খুন করেছে ও…

প্রতিবাদ করে কিছু বলতে গেল ভিটো, কিন্তু আবার মৃদু হাসি দেখা গেল লরার ঠোঁটে।

তবে দেখতে শুনতে ভাল…সুপুরুষ, তাই না? লোকের সামনে বের করতে লজ্জায় পড়তে হবে না।

ভিটো স্বস্তিবোধ করলেও তাকে বিমূঢ় দেখাল। বোঝা যাচ্ছে, হাসানকে বাতিল করা হয়নি।

উঠে দাঁড়িয়ে স্বামীর গালে চুমো খেল লরা। ধন্যবাদ, ডারলিং, এখন আমি খুশি।

.

ডিনারের পর পিস্তলটা পরিষ্কার করতে বসল রানা। দীর্ঘদিনের অভ্যেস, আপনা থেকেই হাত চলছে, মনে সন্ধেবেলার ঘটনা আর লোকজন।

ভিটো আভান্তি অন্যমনস্ক ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত ব্যবসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে।

লরার কথা ভাবল রানা। ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে ওর ওপর লরার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করল। মেয়েদের মধ্যে যা যা দেখলে ও খুশি হয় তার অনেকগুলোই লরার মধ্যে রয়েছে। সাদামাঠা সাজ, বাড়াবাড়ি নেই; নাক, চোখ, ভুরু, কপাল, ঠোঁট সব একই কারিগরের হাতে গড়া–ফলে একটার সাথে আরেকটার সামঞ্জস্য আছে; মেকআপের ব্যবহার নেই বললেই চলে। তার চুল স্বাভাবিক ভাবে ঝুলে আছে, হাতের নখ লম্বা, রঙ করা নয়। তার কোন সাহায্যের দরকার হয় না, এমনকি পারফিউমও লাগে না। স্বয়ংসম্পূর্ণ এক নারী। আর তার ব্যক্তিত্ব, আলাদা কিছু নয়, রূপেরই একটা প্রসারিত শাখা মাত্র।

এই জাতের মেয়েরা সাধারণত পুরুষদের নিয়ে খেলতে ভালবাসে, ভেড়া বানিয়ে মজা পায়। নিজেকে সাবধান করে দিল ও, বুঝে শুনে পা ফেল চাঁদ!

পিস্তলটা পরিষ্কার করার পর ট্রিগার মেকানিজম আর ম্যাগাজিন রিলিজ ক্যাচে তেল দিল রানা। আথিয়া আর লার্দোর কথা ভাবল ও। বিশাল কিচেনে বসে ডিনার খাওয়ার সময় তেমন কথাবার্তা বলেনি ওরা, রানাও কোন রকম উৎসাহ দেয়নি। ও যে একটু দূরে দূরে থাকতে পছন্দ করবে সেটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, ওর। উপস্থিতিতে ওরা অভ্যস্ত হয়ে উঠলে আবার নিজেদের আগের আলাপের ঢং ফিরে আসবে।

পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছর বয়স হবে আথিয়ার, সদা হাস্যময়ী, দশজনের খাটুনি একাই খাটতে পারে। রানার ব্যাপারে তার কৌতূহল পরিষ্কার বোঝা যায়। লার্দোর। বয়স সত্তর তো হবেই, আশিও হতে পারে। ভিটোর বাপের মালি ছিল সে, পুরানো লোক বলে তাকে বাদ দিয়ে কম বয়সী মালি রাখা হয়নি। তামাটে রঙের চোখা। মুখ, চোখে নিষ্পাপ সরলতা। রানার দিকে বারবার এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন। বলতে চায় এখানে তোমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।

এ বাড়ির রান্নাবান্না ভাল। প্রথমে এল ভেজিটেবল সুপ আর গ্রিসিনি (রুটি), তারপর বিসটেকা (বীফ স্টেক), গোরগোনজোলা (ভেড়ীর দুধ থেকে তৈরি হলদেটে সাদা পনির), রিসো (চাল আর সেলফিশ সহযোগে রান্না, বাঙালী রসনার জন্যে ভারি সুস্বাদু), সবশেষে ডোলসি (মিষ্টি আর ফুল)।

ইটালিয়ান খাবার পছন্দ করে রানা, পরিচয়ও অনেক দিনের। চুপ করে থাকলে অন্যায় করা হবে, তাই আথিয়ার একটু প্রশংসা করতে হল, চমৎকার রাধো তুমি।

চেহারা দেখেই বুঝল, আথিয়ার মুখে খই ফুটতে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি লার্দোর দিকে ফিরল ও, বলল, বাড়ির চারদিকটা কাল আমাকে দেখাবে তুমি। লে আউটটা আমার জানা দরকার। এরপর উঠে নিজের ঘরে চলে আসে ও।

পিস্তলের ম্যাগাজিন থেকে নাইন এম এম বুলেট বের করে স্প্রিং চেক করল। রানা। স্পেয়ার দুটোও পরীক্ষা করল। একটা বাক্স খুলে তিনটে ম্যাগাজিনেই গুলি। ভরল। নতুন শোল্ডার হোলস্টারে তেল ঘষল, আরও নরম করার জন্যে।

লুবনা-সে-ই হবে সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাকে পাহারা দেয়ার জন্যেই ওকে। রাখা। মন-মেজাজ ভাল থাকলে মেয়েটার সঙ্গ খারাপ লাগত না। কিন্তু এই বয়সের মেয়েরা কি রকম হয় জানা আছে ওর, ভয়টা সেজন্যেই। নিশ্চয়ই খুব ছটফটে মেয়ে, ঠোঁটে এক কোটি প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছে। প্রথম একবার দেখে সব বোঝা যায় না, কিন্তু রানার মনে হয়েছে মেয়েটা মায়ের ঠিক উল্টো স্বভাব। পেয়েছে, অথচ চেহারায় মায়ের আদল অনেকখানিই আছে, তবে মায়ের চেয়েও সুন্দরী।

রানাকে ওপরতলায় নিয়ে এসে ঘর দেখিয়ে দিয়েই চলে যায়নি লুবনা, ভেতরে ঢুকে রানার পিছনে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। খোলা সুটকেস থেকে। জিনিসপত্র বের করে ওঅরড্রোবে সাজাচ্ছিল রানা, থেমে থেমে এক-আধটা প্রশ্ন। করছিল মেয়েটা। বোঝাই যাচ্ছিল, রানার আগমন ওর জীবনে বিরাট একটা ঘটনা। বাড়িতে ওর বয়েসী আর কেউ নেই, স্কুলে যাওয়া বন্ধ, মা তার নিজের রূপ-যৌবন আর সোসাইটি নিয়ে ব্যস্ত। রানার জানা আছে, এ-ধরনের মায়েরা। নিজের মেয়েকেও প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। ওর ধারণা হল মেয়েটার বোধহয় খুব। একঘেয়ে জীবন। তা যদি হয়, বিচ্ছিরি একটা ঝামেলা হয়ে দেখা দেবে লুবনা। বডিগার্ডকে স্রেফ রক্ষক বলে মনে করবে না, তার কাছ থেকে আরও বেশি কিছু আশা করবে। বন্ধুত্ব চাইবে।

লুবনার প্রথম প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে। এক কথায় জবাব দিয়েছিল। রানা, অনেকদিন দেশে ফেরেনি ও। কিন্তু তবু তাকে নিরুৎসাহিত করা যায়নি। বাংলাদেশের সীমা কি? ওটা কি ভারতের একটা অঙ্গরাজ্য? বাংলাদেশীরা কি খেতে ভালবাসে? রয়েল বেঙ্গল টাইগার কত বড় হয়? বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর। এড়িয়ে গেছে রানা, তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে বলেছে, আমি এখন ক্লান্ত। অনেকক্ষণ কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখে চলে গেছে।

হোলস্টারে তেল মাখানো শেষ করে তাতে বেরেটা ভরল রানা। খাটের স্ট্যাণ্ডে ঝুলিয়ে রাখল সেটা, বাটটা বালিশের কাছাকাছি থাকল। টেবিলের কাছে ফিরে এসে একটা রোড ম্যাপ খুলল, মিলান আর কোমোর মাঝখানের রাস্তাটা দেখানো হয়েছে তাতে। কাজের টেকনিক্যাল দিকগুলো জেনে নিতে চায় রানা। গোটা ব্যাপারটাকে সামরিক দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করল। একটা সম্পদকে রক্ষা করতে হবে তার। শক্তিশালী এক শত্ৰু এটা দখল করার চেষ্টা করতে পারে। তার সম্পদ ওরা দখল করার জন্যে ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে, তারমানে বাড়িতে; কিংবা ঘাটির বাইরে, হয় প্রায়ই যাওয়া হয় এমন কোন ঠিকানায় বা আসা-যাওয়ার পথের। মাঝখানে কোথাও, তারমানে স্কুলে অথবা রাস্তায়।

ঠিক হয়েছে সকালে বাড়ির ভেতর-বার সব ঘুরিয়ে দেখানো হবে ওকে। আর লুবনা ওকে স্কুল দেখিয়ে আনবে। স্কুলের সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট জানতে হবে। ওকে। তবে, ওর ধারণা, কিডন্যাপ করার চেষ্টা হলে রাস্তাতেই কোথাও হবে, কাজেই কোন ছক না রেখে যখন খুশি ইচ্ছেমত রাস্তা বদল করে আসা-যাওয়া। করাটা জরুরি। ম্যাপ দেখে জানা গেল, স্কুলে যাওয়ার জন্যে কটা রাস্তা ব্যবহার। করা সম্ভব। মার্জিনে কিছু নোট লিখল রানা।

এরপর ওঅরড্রোব থেকে সুটকেসটা নামাল ও। ভেতরে কাগজে মোড়া কয়েকটা বোতল রয়েছে। একটা গ্লাস খুঁজে নিয়ে তাতে খানিকটা হুইস্কি ঢালল।

ইজি চেয়ারে বসে খাচ্ছে রানা। রাত অনেক হল। এক সময় পুরো বোতলটাই খালি করল ও। বিছানায় শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। নতুন দায়িত্ব সম্পর্কে সংশয় কোনমতে কাটতে চায় না।

জানো, লোকটাকে লুবনার পছন্দ হয়েছে।

মাথা নাড়ল ভিটো। গভর্নেস থাকবে না, তাতেই ও আত্মহারা। লোকটা যদি কাউন্ট ড্রাকুলা হত তাও তাকে পছন্দ করত ও।

উঁহু, তুমি জান না, বলল লরা। শুতে যাবার আগে লুবনার সাথে আমার কথা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি রে, তোর বডিগার্ড লোক কেমন? ঠোঁট উল্টে কি বলল জান? বলল ভারি অহঙ্কারী।

তাহলে যে বলছ পছন্দ হয়েছে ওর?

তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, অহঙ্কারী বলছিস কেন? লুবনা বলল, আমার। দিকে একবার ভাল করে তাকালও না। দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করলাম, হুঁ-হ্যাঁ। করে রয়ে গেল। এরপর আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি লুবনাকে, বলল লরা। লুবনা নিজেই বলল, লোকটা আসলে পাক্কা অভিনেতা। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে। এসে জানালার পর্দা একটু সরিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। দেখি, খানিক পর ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। আমাকে না দেখে কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল চেহারা, চোখে অপরাধ অপরাধ ভাব। গভীর না ছাই, আসলে প্রথম প্রথম তো, একটু ভাট দেখাচ্ছে।

সশব্দে হেসে উঠল ভিটো। তোমার মেয়েও তো দেখছি কম অভিনয় জানে না!

কিন্তু আমি ভাবছি, এত থাকতে বডিগার্ডের চাকরি করতে এল কেন? যেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করল লরা। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে।

রহস্য আবার কি থাকবে, বলল ভিটো। আজকাল ভাল একটা চাকরি পাওয়া খুব কঠিন।

ওর কি বিয়ে হয়েছে? কোথাও বাড়িঘর আছে?

কি জানি।

ঘাপলা একটা না থেকেই পারে না, বলল লরা। কি যেন একটা ধরতে পারছি না। আত্মবিশ্বাসী লোক, সন্দেহ নেই, কিন্তু বেশিদিন হয়নি কোথাও একটা। ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে হয়। হয়ত কোন মেয়ে ধোকা দিয়েছে।

ভিটো হাসল। মেয়েলি অনুমান এরচেয়ে ভাল আর কি হবে।

না, মাথা নাড়ল লরা। আমারই ভুল। মেয়ে-টেয়ের ব্যাপার নয়। ওর ব্যক্তিত্বের একটা অংশ যেন হারিয়ে গেছে। যাই বল, লোকটা আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছে।

ভিটো খুশি আর তৃপ্ত। লরা লোকটার প্রতি আকৃষ্ট হবে, এ আশঙ্কা তার। নেই। স্ত্রীকে সে অনেক দিন থেকে চেনে, অনেক আগেই এ-ধরনের ভয় তাকে ছেড়ে গেছে। জানে, পুরুষমানুষ লরার একটা প্রিয় সাবজেক্ট, স্টাডি করতে পছন্দ, করে। কে কোন্ প্রকৃতির মানুষ, আবিষ্কার করতে ওর মজা লাগে।

কিন্তু তুমি আমাকে বললে ও নাকি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

হ্যাঁ। ভয় শব্দটা বোধহয় ভুল। এক অর্থে, সত্যি ও একটা হুমকির মত। বুনো একটা জানোয়ার, কিন্তু পোষ মেনেছে। তবু এদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয়। আতিনিদের অ্যালসেশিয়ানটার কথা মনে আছে তোমার? পাঁচ বছর থাকার। পর খোদ মালিককেই একদিন কামড়ে দিল।

ও কুকুর নয়, লরা!

আমি শুধু একটা উদারহরণ দিলাম। লোকটার মনে কি যেন একটা আছে। ভেব না আমি বিপদের আশঙ্কা করছি। হয়ত এটাই ওর ভঙ্গি। তবে, ওর সম্পর্কে জানতে হবে আমাকে। ওর অতীত, ওর স্বভাব, অনুভূতি–সব।

.

০৬.

সামনের সিটে রানার পাশে বসেছে লুবনা। কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছে রানা, রাস্তার ওপর নজর রাখতে হবে ওকে। একটু অবাকই হয়েছে লুবনা, কারণ মেইন কোমো-মিলান রোডে রয়েছে ওরা, গাড়ি চালানো খুব সহজ, পথ ভুল হবারও কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু রানার উদ্দেশ্য, সহজে চোখে পড়ে না অথচ বিপদ আসতে পারে এই রকম জায়গাগুলো আবিষ্কার করা–যেখানে গাড়ির গতি কমাতে হবে বা বাঁক নিতে হবে, অথবা যে-সব জায়গায় কাছেপিঠে বিল্ডিং নেই। বেশ কয়েকটা স্পট আবিষ্কার করল ও, ম্যাপে নোট করল সেগুলো। আধ ঘন্টা পর শেষ বাকটা দেখাল লুবনা, কয়েক মিনিট পর স্কুল গেটের সামনে থামল গাড়ি। লাফ দিয়ে নেমে গিয়ে দেয়ালের সাথে আটকানো একটা পিতলের হাতল ধরে টানল লুবনা। গাড়িতে বসে উঁচু পাঁচিল, পাঁচিলের মাথায় সার সার বর্শা আকৃতির লোহার পাত লক্ষ করল রানা। দেখল ভারি গেটের সামনে কোন রকম আড়াল নেই।

লুবনার চোখ বরাবর গেটের গায়ে একটা শাটার খুলে গেল। ভেতর থেকে কেউ দেখল ওকে। দুএকটা কথা হল। তারপর প্রৌঢ় এক দারোয়ান ধীরে ধীরে। খুলে দিল গেট। হাত কঁকিয়ে ইঙ্গিত করল লুবনা, গেট পেরিয়ে এগোল, গাড়ি নিয়ে তার পিছু নিল রানা। ভেতরে একটাই বিল্ডিং, হলুদ আর সবুজ লতাগাছে ঢাকা। চারপাশে প্রচুর ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। শেডে গাড়ি থামিয়ে লুবনাকে অনুসরণ করল রানা। আঙুল দিয়ে এটা-সেটা দেখাল লুবনা। খেলার মাঠ, মাঠকে ঘিরে থাকা রানিং ট্র্যাক, বিল্ডিংটার বাঁ দিকে ছোট্ট একটা বাগান, বাউণ্ডারি। ওয়ালের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে। সুইমিং পুলও আছে, সেটা পিছন দিকে।

চারদিক একবার ঘুরে দেখে নিয়ে স্কুল-ভবনের সামনে চলে এল ওরা। স্কুলের ভেতরটা মোটামুটি নিরাপদ লাগল। সারা মুখে পবিত্র হাসি নিয়ে বয়স্কা এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, সব চুল সাদা। ছুটে গিয়ে তার দুই গালে চুমো খেল লুবনা, হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এল রানার সামনে। ইনি সিনোরা মিরিয়াম, আমাদের হেডমিসট্রেস, রানাকে বলল সে। তারপর বৃদ্ধার দিকে ফিরল, চেহারায় উথলে ওঠা গর্ব। ও হাসান, আমার বডিগার্ড।

মি. হাসান, শুদ্ধ করে দিলেন হেডমিসট্রেস।

মাথা নাড়ল লুবনা, হাত ঝাপটা দিয়ে কপাল থেকে চুল সরাল। ও আমাকে শুধু হাসান বলতে বলেছে।

করমর্দন করল ওরা, হেডমিসট্রেস ওদেরকে কফি খাওয়ার জন্যে ভেতরে ডাকলেন। একেবারে ওপরতলায় ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে ভদ্রমহিলার। অনেক আসবাবপত্র, কিন্তু সবই খুব হালকা। মেঝে ছাড়া প্রতিটি সমতল জায়গায় ফ্রেমে বাধানো গ্রুপ ফটোগ্রাফ রয়েছে। ছবিগুলো রানা দেখছে লক্ষ করে হেডমিসট্রেস বললেন, ওরা সবাই আমার ছেলেমেয়ে। কয়েক শো হবে। এখন ওরা বড় হয়ে গেছে, কিন্তু আমার কাছে চিরকাল ওরা খোকা-খুকুই রয়েছে।

পরিবশেটা খুব ভাল লাগল রানার। স্কুল যে এত ঘরোয়া হতে পারে, ভাবা। যায় না। আসতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠেছিল লুবনা, কারণটা বোঝা গেল।

মধ্যবয়েসী এক মেয়েলোক রূপালি একটা ট্রে নিয়ে এল। হেড মিসট্রেস। নিজের হাতে পট থেকে কাপে কফি ঢেলে পরিবেশন করলেন। লুবনার সাথে আলাপ করছেন তিনি। তারপর, রানাকে অবহেলা করা হচ্ছে মনে করে, ফিরলেন। ওর দিকে। এ-ধরনের কাজে অনেক দিন ধরে আছেন আপনি, মি. হাসান?

বডিগার্ড কখনও ছিলাম না, বলল রানা। কিন্তু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে।

বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি দিনকাল পড়েছে। আমারও দুটো মেয়ে। কিডন্যাপ হয়েছিল। এখান থেকে নয়, ওরা আহতও হয়নি, আবার স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগেছে ওদের। লুবনার হাটুতে হাত রাখলেন তিনি। আমাদের লুবনাকে আপনি দেখবেন। ও স্কুলে আসবে শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি।

আর কদিন বাড়িতে থাকলে দম আটকে মরেই যেতাম, বলল লুবনা। বন্দী। জীবনের বর্ণনা দিল সবিস্তারে। আপন মনে বকবক করে চলেছে লুবনা, হাসিমুখে শুনছেন বৃদ্ধা, একটা দুটো কথা যোগ করছেন তিনিও। গোটা পরিবেশটা চমৎকার লাগল রানার কাছে। কেমন যেন শান্তি রয়েছে মহিলার মধ্যে।

মিনিট কয়েক পর রানার সাথে লুবনার চোখাচোখি হল, দুজন একসাথে উঠে দাঁড়াল ওরা। গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্যে ওদের সাথে সাথে হেডমিসট্রেসও এলেন। আপনি ইটালিয়ান নন, বললেন তিনি।

ও বাংলাদেশী, দেশটা নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, বলে উঠল লুবনা। সে যুদ্ধে হাসানও ছিল।

অবাক হয়ে গেল রানা, এসব লুবনা জানল কিভাবে? দেখল, আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ওর প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছে লুবনা আর মুচকি মুচকি হাসছে। সাথে সাথে চেহারা গম্ভীর করে ফেলল রানা।

আপনি এত ভাল ইটালিয়ান বলেন! নিশ্চয়ই নেপলসে শিখেছেন?

হ্যাঁ, একজন নিয়াপলিটানের কাছে।

তাই তো বলি! সন্তুষ্ট দেখাল তাঁকে। স্কুল-ভবনের পিছন দিকের একটা দরজা দেখালেন তিনি। ওটা কিচেন। ছেলেমেয়েদের আমরা ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দিতে চেষ্টা করি, তবু যদি আপনাকে অপেক্ষা করতে হয়, মেইডকে বললেই কফি পাবেন। বিষণ্ণ হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে। এখন তো বেশ অনেকের সাথেই বডিগার্ড আসছে।

রানা ধন্যবাদ জানাল। লুবনা তার গালে চুমো খেল।

ফেরার সময় অন্য রাস্তা ধরল রানা।

লুবনাকে এবারও কথা বলতে নিষেধ করল ও। কিছুক্ষণ চুপ করেই থাকল সে, কিন্তু স্কুল আর হেডমিসট্রেসকে দেখার পর উত্তেজিত হয়ে আছে, বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে রানার দিকে। এক সময় আর নিজেকে সামলাতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, স্কুল তোমার কেমন লাগত, হাসান?

ভাল না।

ওমা, সেকি! বিস্ফারিত চোখে তাকাল লুবনা। কেন? তুমি বুঝি পড়া পারতে না?

রানা চুপ। ভাবল, উত্তর না পেলে হয়ত দমে যাবে।

হাসান, এটা কি তোমার ডাক নাম?

না।

কি সেটা?

নেই।

এবার লুবনা কোন রকম বিস্ময় প্রকাশ করল না। স্কুল তোমার ভাল লাগত –তারমানে তুমি খুব অসুখী ছিলে, না?

বিরক্তি চেপে শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল রানা। সুখী হওয়াটা মনের একটা অবস্থা। ব্যাপারটা আমি কখনও পাত্তাই দিইনি।

স্টিয়ারিং হুইল ধরা রানার হাতের দিকে চোখ আটকে গেল লুবনার। শুকনো কাটা দাগটা ওকে যেন জাদু করেছে। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দাগটা ছুঁলো সে। কি করে হল এটা?

ঝাঁকি খেয়ে সরে গেল রানা, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, গাড়ি চালাবার সময় আমাকে ছোবে না। কয়েকমুহূর্ত পর সিদ্ধান্তে পৌঁছুল ও, এখুনি ফয়সালা হয়ে যাওয়া দরকার। আর শোনো, সারাক্ষণ বক বক করবে না। আমি গল্প করার জন্যে আসিনি। আমার সব কথা তোমার জানার দরকার নেই। বিপদ হলে তোমাকে আমি রক্ষা করব–ব্যস। সুরটা রুক্ষ, চাবুকের মত আঘাত করল লুবনাকে।

কয়েক সেকেণ্ড রানার দিকে তাকিয়ে থাকল লুবনা। তারপর সরে গিয়ে যতটা সম্ভব জানালা ঘেঁষে বসল।

ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকাল রানা। সরাসরি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। লুবনা, ঠোঁট দুটো পরস্পরের সাথে শক্তভাবে চেপে আছে, চিবুক কাঁপছে। আর, দয়া করে কাঁদতে শুরু কোরো না! ঝাঁঝের সাথে বলল রানা, কেন কে জানে। নিজের ওপর রেগে গেছে ও।

ও নিস্তব্ধতা অস্বস্তিকর হয়ে উঠলে নিজের ওপর রাগ আরও বাড়ল রানার। আমি একটা দায়িত্ব নিয়েছি, সেদিকে আমার মনোযোগ থাকতে হবে। কেউ যদি সারাক্ষণ কানের কাছে বক বক করে, তাহলে কি করে হয়! স্টিয়ারিং হুইল থেকে একটা হাত তুলে বাইরেটা দেখাল ও। সম্ভব-অসম্ভব সব রকম জগৎ রয়েছে। ওখানে। সব রকম। সুখী আর অসুখী, ওখানে শুধু এই দুদল লোক বাস করছে না। খারাপ মানুষও আছে। খারাপ কিছুও ঘটতে পারে। বড় হও, তখন বুঝবে।

এখন আর আমি ছোট নই। দপ করে জ্বলে উঠল লুবনা। আমিও জানি। খারাপ কিছু ঘটতে পারে। এমন কিছু অন্যায় করিনি যে এত কথা শুনতে হবে আমাকে। আর জেনে রাখ, আমি কাঁদছি না। ওই বয়সটা আমি পেরিয়ে এসেছি।

কিন্তু লুবনার চোখে পানি ছলছল করছে, যদিও রানার দিকে স্থির হয়ে আছে। তার অগ্নিদৃষ্টি।

রাস্তার পাশে গাড়ি সরিয়ে আনল রানা, থামল। চিন্তা করছে ও, নিস্তব্ধতার মাঝখানে শুধু লুবনার নাক টানার আওয়াজ শোনা গেল। শোন, এক সময় বলল রানা। আমি আসলে এই রকমই। দরকার ছাড়া কথা বলি না, কেউ বললে বিরক্ত হই। এটা তোমাকে বুঝতে হবে, আর তা না হলে তোমার বাবাকে বলে আরেকজন লোকের ব্যবস্থা কোরো।

নাক টানার আওয়াজ থেমে গেল। স্থির হয়ে বসে আছে, সরাসরি সামনে। তাকিয়ে। আচমকা দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল সে, তারপর পিছনের দরজা খুলে ব্যাক সিটে উঠে বসল। আপনি আমাকে এখন বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন, মি, ইমরুল হাসান। মিস্টারের ওপর খুব জোর দিল সে।

ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল রানা। ওর দিকে তাকাবে না লুবনা। পিঠ সোজা করে বসে থাকল, রাগে নাকের ফুটো দুটো কাঁপছে।

গাড়ি ছাড়ল রানা। মন একটু খারাপ হয়ে গেছে। মেয়েটাকে আঘাত দিতে চায়নি। কিন্তু ওর খেলার সাথী হবার জন্যে চাকরিটা নেয়নি সে। কথাগুলো এক সময় না একময় বলতেই হত। ওর মা-বাবার বোঝা উচিত,ওর এখন একজন বন্ধু দরকার।

.

রবিবার। ডিনারের পর নিজের ঘরে বসে বই পড়ছে রানা। দরজায় নক হল।

শরীরটা ভাল লাগছে না। আগের রাতে একটু বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিল। প্রায় সারাদিনই ঘর থেকে বের হয়নি। ধরে নিয়েছিল লরা বা ভিটো কেউ একজন আসবে।

লরা।

জানতে এলাম যা যা দরকার সব আপনি পেয়েছেন কিনা, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল সে।

হাতের বই টেবিলে নামিয়ে রাখল রানা। না, আর কিছুর আমার দরকার নেই।

ঘরের চারদিকে চোখ বুলাল লরা। খাবার ঠিক আছে তো? আথিয়া বলছিল। সারাদিন প্রায় না খেয়ে আছেন আপনি।

রান্না তো খুবই ভাল। শরীর একটু খারাপ ছিল। এখন ভাল আছি।

ঘরের একটু ভেতরে ঢুকল লরা। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল…।

চেয়ার খালি করে দিয়ে বিছানায় বসল রানা। এগিয়ে এল লরা। তার হাঁটার ভঙ্গি ভাল লাগল রানার নর্তকীর মত, সাবলীল, যেন বাতাসে ভেসে এল। চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে দিল সে। তার হাটু পর্যন্ত ঢাকা আছে মোজায়। গায়ের রঙের সাথে মিশে গেছে, ভাল করে লক্ষ না করলে বোঝাই যায় না মোজা পরে আছে।

লুবনা কি আপনাকে খুব বিরক্ত করছে? হঠাৎ জানতে চাইল লরা।

ওকে বুঝতে হবে যে আমি নতুন কোন খেলনা নই, স্পষ্ট করে বলল রানা।

মৃদু হাসি দেখা গেল লরার ঠোঁটে। একটু উত্তেজনা তো থাকবেই–বডিগার্ড পেয়েছে, আবার স্কুলে যাচ্ছে। মাস কয়েক খুব একঘেয়ে সময় কেটেছে ওর, আপনি যদি একটু সয়ে নেন খুব ভাল হয়।

কিন্তু আমাকে রাখা হয়েছে ওর নিরাপত্তার দিকটা দেখার জন্যে, ওকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে নয়।

সায় দিয়ে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল লরা। ওকে কিছু বলেছেন নাকি? আমাকে তো কিছু বলবে না ও, কিন্তু কাল রাতে খুব চুপচাপ দেখলাম ওকে, মনে। হল রাগ করেছে।

বিছানা থেকে নেমে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। দেখুন, আমাকে দিয়ে বোধহয় হবে না। আমি ঠিক সামাজিক লোক নই। আপনার স্বামীকে অন্য মানুষ দেখতে বলুন।

লরার দিকে ফিরল রানা, দেখল এদিক ওদিক মাথা নাড়ছে। না, আপনার কথাই ঠিক। আপনি শুধু ওর নিরাপত্তার দিকটা দেখবেন। আর তাতেই আমরা খুশি। হোলস্টারে ভরা পিস্তলটা তার দৃষ্টি কেড়ে নিল। খাটের স্ট্যাণ্ডের সাথে ঝুলছে ওটা। আপনার সাথে আর্মস আছে জানতাম না তো! হাসল সে। জানি বোকার মত হয়ে গেল কথাটা, কিন্তু ছোট্ট একটা জিনিস গোটা ব্যাপারটাকে কি রকম সিরিয়াস করে তুলেছে!

রানা কিছু বলল না।

আমি ভেবেছিলাম কারাতে বা ওই ধরনের কিছুতেই এক্সপার্ট হবেন আপনি। হঠাৎ হাসানের ব্যাকগ্রাউণ্ড মনে পড়ে গেল তার। আন-আমড কমব্যাট, তাই না? আপনি তো একজন ইনস্ট্রাকটর ছিলেন।

হ্যাঁ,বলল রানা। তবে অনেক সময় আর্মড কমব্যাটের বিকল্প হয় না। পিস্তলটা হাতের কাছে থাকা ভাল, ব্যবহার করতে হোক বা না হোক।

কথাটা ভাবল লরা। কিন্তু দরকার পড়লে ব্যবহার করবেন, তাই না, লুবনা। যদি বিপদে পড়ে?

অবশ্যই।

লরার কৌতূহল টের পেয়ে গেল রানা, বুঝল এরপর কি আসছে।

আপনি তো যোদ্ধা ছিলেন, আর যুদ্ধ মানেই মানুষ মারার প্রতিযোগিতা তা..মানে, কত লোককে মারতে হয়েছে আপনার?

কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

রানার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লরা। আমি তো কল্পনাই করতে পারি। যুদ্ধের সময় অবশ্য দূর থেকে গুলি করে মানুষ মারা হয়। কিন্তু কাছ থেকে, সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে মারা, নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর একটা অভিজ্ঞতা?

অভ্যেস হয়ে যায়। আর এই অভ্যেস যার হয়ে গেছে সে কিভাবে একটা। নাবালিকা মেয়েকে সঙ্গ দেবে?

হেসে উঠল লরা। আমি এই জন্যে খুশি যে লুবনার বডিগার্ড মোমের পুতুল। নয়। হঠাৎ করেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সে, নিচে একটা অতিরিক্ত টু-ইন-ওয়ান। আছে। আথিয়াকে বলব, নিয়ে এসে দেবে আপনাকে। গান আপনার ভাল লাগে?

কিছু কিছু গান।

কি ধরনের?

দেশী আর কান্ট্রি সঙস্।

দেশী মানে কি রবীন্দ্রসঙ্গীত?

সরাসরি, তাকাল রানা। হ্যাঁ, রবীন্দ্রসঙ্গীতও। কিন্তু আপনি জানলেন, কিভাবে?

আমি না, আমার স্বামী, উঠে দাঁড়াল লরা। এশিয়ায় তো ওকে প্রায়ই যেতে হয়। একবার নাকি ঢাকাতেও গেছে। কোথাও গেলে কোন খবর জানতে আর বাকি রাখে না ও। সেদিন দেখি লুবনা ওর কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাংলাদেশ। সম্পর্কে সব জেনে নিচ্ছে। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত বা কান্ট্রির ক্যাসেট তো নেই আমাদের।

দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরল সে। তবে মিলানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কাল আমরা যাচ্ছি ওখানে। লাঞ্চ আছে।

রানাকে আরও কসেকেণ্ড দেখল লরা। তারপর আপনমনে কাঁধ ঝাঁকাল, বলল, ঠিক আছে, লুবনাকে আমি বলে দেব। আসলে আমাদের আরও ছেলেমেয়ে থাকলে ভাল হত। বেচারি একেবারে একা পড়ে গেছে।

লরা বিদায় হতে চেয়ারে বসে বইটা তুলে নিল রানা। কিন্তু পড়ায় আর মন। বসল না। ওঅরড্রোব খুলে সুটকেস থেকে একটা বোতল বের করল।

আউন্স দুয়েক হুইস্কি খেয়ে আবার বইটা নিয়ে চেষ্টা করল রানা। কিন্তু কাজ। হল না। লরা এসে সব গোলমাল করে দিয়ে গেছে। আমোঘ মহিলার রূপের টান।

.

আড়াইটার দিকে বেরিয়ে আসব, বলল লরা। রেস্তোরাঁর পাশের সরু গলিটা দেখাল সে। ওখানে পার্ক করবেন আপনি।

মাথা ঝাঁকাল রানা, বলল, পুলিস যদি আমাকে সরিয়ে দেয়, একটা চক্কর দিয়ে আবার ফিরে আসব। আপনি মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন।

গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পেরোল লরা।

হাতঘড়ি দেখল রানা ৷ দুঘন্টা কাটাতে হবে।

মা আর মেয়েকে ব্যাক সিটে নিয়ে সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে রানা। গাড়িতে উঠে লরা ওকে বলল, টু-ইন-ওয়ান আথিয়াকে দেয়া হয়েছে। স্কুলে যাবার পথে, আর কোন কথা হয়নি। সারাটা পথ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রানাকে এড়িয়ে গেছে লুবনা।

স্কুল গেটের বাইরে ইউনিফর্ম পরা একজন সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে ছিল, গাড়ি থামতে জানালা দিয়ে উঁকি দিল সে, লরা তাকে হাসানের পরিচয় জানাল। কয়েক মুহূর্ত রানাকে দেখল গার্ড, চেহারাটা স্মৃতিতে গেঁথে নিল। একটু ফাঁক করা ছিল গেট, লুবনা নামতে যাচ্ছে দেখেই দ্রুত বাধা দিল রানা, নড়বে না!

গাড়ি থেকে নেমে গার্ডকে পাশ কাটাল রানা, গেটের ভেতরটা ভাল করে। দেখল। সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে এল ও, গাড়ির পিছনের দরজা খুলে ইঙ্গিতে নামতে বলল, লুবনাকে। মাকে চুমো খেয়ে লাফ দিয়ে নামল লুবনা। রানার পাশ ঘেঁষে যাবার সময় সোজা নাক বরাবর তাকিয়ে থাকল সে, যেন ওর অস্তিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করতে চায় না। গার্ড লোকটা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রানার দিকে, কিন্তু কিছু বলল না। ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল রানা।

আপনি খুব সাবধানী, মন্তব্য করল লরা।

অভ্যেস।

লুবনার সাথে কথা বলেছি আমি। বলেছি, আপনাকে যেন বিরক্ত না করে।

ধন্যবাদ।

কাল রাতে আপনার সাথে কি কথা হয়েছে, ওকে বলিনি। শুধু বলেছি, আপনার মন ভাল নেই, তাই আপনার সাথে বেশি কথা না বলাই ভাল। ও আপনাকে ভয় পাক বা খারাপ চোখে দেখুক সেটা আমরা চাই না।

লরা রেস্তোরাঁর ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবার পর গাড়ি নিয়ে রেল স্টেশনে চলে এল রানা। একটা বুকস্টল থেকে কয়েকটা বই কিনল, অবসরের সঙ্গী। তারপর। টেলিফোন অফিসে এসে ফোন করল রেমারিককে।

হ্যাঁ, কাজ শুরু করেছে সে; কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত কেমন লাগবে এখনও ঠিক বলতে পারছে না। তবে, ওদের বাড়ির রান্নাটা ভাল। এরপর রিসোকে ফোন করে। আতিথেয়তার জন্যে ধন্যবাদ জানাল রানা। বলল, হপ্তা দুয়েক পর রিসো আর। জুলিয়ানাকে ডিনার খাওয়াতে চায় ও।

দিন দুয়েক ওদের বাড়িতে বেড়িয়ে এসেছে রানা। রেমারিকের আর সব আত্মীয়স্বজনদের মত রিসো আর জুলিয়ানাও ওকে নিকটতম আপনজন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ওদের খুব সুখের সংসার, তার স্পর্শ রানাও পেয়েছে। জুলিয়ানা রোমের মেয়ে, খুব লম্বা। রিসোর সাথে তার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়েটা যেমন হাসতে পারে, তেমনি হাসাতেও পারে।

স্টেশনের লাগোয়া দোকানগুলোয় ঢু মারল রানা। একটা দোকানে হিন্দী। গানের কিছু ক্যাসেট পাওয়া গেল, কিন্তু বাংলা কোন ক্যাসেট নেই। কোন রজার্স, জনি ক্যাশ আর ড. হুক-এর কয়েকটা ক্যাসেট কিনল ও। লিণ্ডা রনস্ট্যাণ্ড আর ডলি। পারটন-এর ক্যাসেট মাত্র একটা দোকানে পাওয়া গেল। সায়গলের একটা ক্যাসেটও কিনল ও, সো যা রাজকুমারী গানটা আছে ওতে। কেন কিনল, নিজেও বলতে পারবে না।

আড়াইটা থেকে অপেক্ষার পালা শুরু হল। রেস্তোরাঁ থেকে লরা বেরুল। তিনটের সময়, সাথে একটা লোক আর তার স্ত্রী। সবাই খুব হাসিখুশি। গাড়ি থেকে নামল রানা, দুজনের সাথে রানার পরিচয় করিয়ে দিল লরা।

এরা আলবারগো লোরান আর অলিভা লোরান হাসান।

লোরানকে পছন্দ হল না রানার। তার কুতকুতে চোখ, অস্থির দৃষ্টি দেখে মনে। হল লোকটা সুযোগসন্ধানী, মানুষের দুর্বলতা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তবে বেশভূষায় খুব। পরিপাটি, যদিও কাপড় ঠেলে বেরিয়ে থাকা ভুড়িটা রীতিমত অশ্লীল। আর অলিভা লোরানকে সাদামাঠা মহিলা বলে মনে হল-খায়, ঘুমোয় আর মার্কেটিং করে বেড়ায়।

লোরান ওকে খুঁটিয়ে দেখল। শুনলাম আপনি নাকি প্যালেস্টাইনীদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন?

মাথা ঝাঁকাল রানা।

ইসরায়েলিরা আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল?

আবার মাথা ঝাঁকাল রানা।

নিশ্চয়ই সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না?

মাথা নাড়ল রানা। মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে ফেলল অলিভা, লরার কানে কানে ফিসফিস করল, আদৌ কথা বলে?

কি বলছ! তীক্ষ্ণ স্বরে বলল লরা। লোকটার দিকে ফিরে তার গালে চুমো খেল সে। লাঞ্চের জন্যে ধন্যবাদ, লোরান। কথা দিচ্ছি, অলিভাকে বেশি খরচ করতে দেব না। অলিভাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল সে। লোরানের দিকে তাকিয়ে। আবার একবার মাথা ঝাঁকাল রানা, ছেড়ে দিল গাড়ি। গাড়ির দিকে তাকিয়ে। ফুটপাতের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকল লোরান। ভিউ মিররে তাকে দেখতে পেল রানা।

লোকটাকে ওর অন্যমনস্ক বলে মনে হল।

পরবতী দেড়ঘন্টা কেনাকাটা করল ওরা। তারপর রানা লুবনার কথা মনে করিয়ে দিল লরাকে।

আঁতকে উঠল লরা। সেকি, এরই মধ্যে পাঁচটা বেজে গেল! ঠিক আছে, আপনি যান। ভিটোকে ফোন করব, নিয়ে যাবে আমাদের।

স্কুলের ভেতর ঢুকে শেডে গাড়ি থামাল রানা। আরও অনেকগুলো গাড়ি রয়েছে শেডে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে এদিকে আসতেও শুরু করেছে। গাড়ি থেকে নামল না রানা। লুবনাকে এখনও দেখতে পায়নি ও।

মিনিট পাঁচেক পর আরও দুটো মেয়ের সাথে দেখা গেল লুবনাকে, স্কুল। ভবনের পিছন দিক থেকে সামনের দিকে বেরিয়ে এল ওরা। দাঁড়িয়ে পড়ে গল্প করছে তিনজন, বার কয়েক রানার দিকে তাকাল। তারপর ভেঙে গেল দলটা, মেয়ে দুটো একটা মার্সিডিজের দিকে এগিয়ে এল, লুবনা আবার সুইমিং পুলের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মেয়ে দুটোকে নিয়ে চলে গেল মার্সিডিজ। বিশ মিনিট পর আবার দেখা গেল লুবনাকে, ক্লাস রূম থেকে বইয়ের ব্যাগটা নিয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা খুলে দিল রানা। ওর পাশ ঘেঁষে যাবার সময় হাতের ব্যাগটা নিঃশব্দে বাড়িয়ে দিল লুবনা। স্ট্র্যাপ ধরে ব্যাগটা নিল রানা।

মা এল না?

তোমার মা তোমার বাবার সাথে ফিরবেন, বলল রানা।

মাথা ঝাঁকাল লুবনা। দরজা বন্ধ করে দিল রানা।

পথে কোন কথা হল না। কিন্তু বারবার চোখাচোখি হল ওদের রিয়ার ভিউ মিররে। মনে মনে হাসল রানা, কথা বলার জন্যে মরে যাচ্ছে লুবনা, রানার দিক থেকে সামান্য সাড়া পেলেই ছুটিয়ে দেবে তুবড়ি।

রাতে ডিনার খেতে বসে আজও আবার আথিয়ার প্রশংসা করতে হল রানাকে। রানার কাছ থেকে মাত্র একবার শুনেই চমৎকার খিচুড়ি বেঁধেছে সে, সাথে ভাজা ইলিশ। আজকের ইটালিয়ান পদগুলোও নতুন, একেকটার এক একরকম স্বাদ।

প্রশংসাটুকু নিঃশব্দে উপভোগ করল আথিয়া। ইতিমধ্যে সে জেনেছে, এই বিদেশী লোকটা বাঁচালতা একেবারেই পছন্দ করে না।

ডিনার শেষ করেই উঠে পড়া দৃষ্টিকটু, তাই বই নিয়ে বসল রানা। পোপকে নিয়ে আলোচনা শুরু করল আথিয়া আর লার্দো। রানার নির্বাক উপস্থিতি মেনে নিয়েছে ওরা। কিচেনের পরিবেশ শান্ত।

নিজের কামরায় ফিরে এসে টু-ইন-ওয়ানে একটা ক্যাসেট ভরল রানা। ড. হুক প্রেম আর অতীত নিয়ে গাইল। বোতল বের করে গ্রাসে খানিকটা হুইস্কি নিল। রানা। দিনটার কথা ভাবল ও। খুব খারাপ কাটেনি। অন্তত, তার কাছ থেকে কি। আশা করা যাবে আর কি আশা করা যাবে না, এটা সবাইকে বুঝিয়ে দেয়া গেছে।

একতলা। নিচে বিছানায় শুয়ে জেগে আছে লুবনা। ঘরের জানালা খোলা, গানের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে। খানিক পর গানটা থেমে গেল। নতুন একটা। ক্যাসেট শুরু হল এবার। ভরাট, ভারি, একটু নাকা গলা। কিন্তু ইটালিয়ান নয়, ইংরেজিও নয়, এই ভাষা আগে কখনও শোনেনি লুবনা। একের পর এক গান। বাজছে। কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল সে। অনেকক্ষণ চেষ্টা। করার পর শেষ গানের প্রথম কয়েকটা শব্দ যেন ধরতে পারল। সো যা রাজকুমারী…এর মানে কি?

গানটা শুনছে লুবনা, আর তার চোখের পাতা জড়িয়ে আসছে। একবার সে ভাবল, এটা কি ঘুমপাড়ানি গান? হঠাৎ তন্দ্রার ভাবটা কেটে গেল। গান থেমে। গেছে। কিন্তু আবার বাজল ক্যাসেট। আবার সেই একই গান, সো যা। রাজকুমারী… শুনতে শুনতে এবার ঘুমিয়ে পড়ল লুবনা।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত